দীপু মাহমুদ
রেস্টুরেন্টে ঢুকে হকচকিয়ে গেছি। মানুষ থইথই করছে। সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। করোনাকালে এখানে এত মানুষ থাকবে ভাবিনি। বসার জায়গা খুঁজছিলাম। মানে যেখানে বসে নিরিবিলিতে কাজ করা যায়।
রেস্টুরেন্টের নাম সল্ট। কক্সবাজারে সুগন্ধা আর লাবনী পয়েন্টের মাঝামাঝি নিরিবিলি রেস্টুরেন্টের ওপরতলায়। এখানে এসে অনেকে অফিসের কাজ করে। ইমেইল চেক করা, উত্তর দেওয়া। তবে সন্ধ্যার পর সেটা বাড়ে। এখানে যারা আসে তাদের বেশিরভাগ বিদেশি কোনো সংস্থায় চাকরি করে। সেসব সংস্থার হেড অফিস ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়। বাংলাদেশে যখন রাত তখন হেড অফিসের মানুষজন দিনেরবেলা অফিস শুরু করে। ইমেইল পাঠায়।
ল্যাপটপ হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। নিজেকে কেমন যেন বোকাবোকা লাগছে। চওড়া কলামের ওপাশে কোণার দিকের জায়গাটা পেলে ভালো হতো। সেখানে একজন মেয়ে বসে আছে। তার সামনে ল্যাপটপ খোলা। আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি ইংরেজিতে বলল, “তুমি সামনে বসতে পারো। এখানে কেউ নেই।”
মেয়েটির গায়ের রং শ্যামলা। গাঢ় শ্যামলা। মাথার চুল ছেলেদের মতো ছোটো করে কাটা। ঘাড় এবং কান দেখা যাচ্ছে। পরনে গাঢ় নীল টি-শার্ট আর ছাই রঙের প্যান্ট। মেয়েটিকে দেখে মনে হলো শ্রীলংকান হতে পারে। তবে ইংরেজি উচ্চারণে ভারতীয় টান আছে। বিদেশ থেকে কক্সবাজারে এখন প্রচুর মানুষ আসছে রোহিঙ্গা রেসপন্সে কাজ করতে। অবশ্য সে বাংলাদেশীও হতে পারে। ইংরেজি বলা অভ্যাস হয়ে গেছে। কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানালাম। কোলের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে নিচু সোফায় বসে পড়লাম। সামনের সোফায় বসে মেয়েটি কফিমগে হালকা চুমুক দিয়েছে। ঠোঁট থেকে কফিমগ নামিয়ে বলল, “আমি জেসিকা। ওয়ার্ল্ড ভিশনে কাজ করছি। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের হায়ার এডুকেশনের ব্যাপারটা দেখি।”
আমার পরিচয় দিলাম, “আমি মাঈন। মাঈন হাসান। ইউএন মিশনে আছি। রোহিঙ্গা রেসপন্স। প্রায় আসতে হয়। আজ দুপুরেই ঢাকা থেকে এসেছি।”
জেসিকা নরম হাতে তার ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করে দিলো। মনে হয় উঠবে এখন। মুখ তুলে দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে সরাসরি। ঘাড় নাড়াচ্ছে না। আমার অস্বস্তি লাগতে থাকল। বললাম, “কফির অর্ডার করছি। তোমার জন্য কি আরেক মগ দিতে বলব?”
জেসিকা আমাকে অবাক করে দিয়ে অদ্ভুত এক প্রশ্ন করল। জানতে চাইল, “মাঈন, তুমি কোথায় পড়াশোনা করেছ?”
সামনের টেবিলে কফির মগ নামিয়ে রেখেছে। পুরো কফি সে এখনো শেষ করেনি। ওয়েটারকে আমার জন্য ফ্রেস পেঁপের জুস দিতে বললাম। জেসিকা টেবিলের ওপর দু’হাতে ভর দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং গভীর। মনে হচ্ছে সে যেন আমার ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। চোখ নামিয়ে বললাম, “চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি থেকে মেরিন বায়োলজিতে গ্রাজুয়েশন করেছি। সায়েন্স পড়তে ভালো লাগছিল না। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের স্কলারশিপ জোগাড় করে ফেললাম। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করতে।”
ওয়েটার এসে জুস দিয়ে গেল। জেসিকা মনে হচ্ছে কফি খেতে ভুলে গেছে। সে জিজ্ঞাসার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব আস্তে নরম গলায় বলল, “তুমি কখনো ব্রেবোর্ন রোডে গেছ?”
চমকে উঠেছি। বলা যায় থরথর করে কেঁপে উঠেছি। বললাম, “ব্রেবোর্ন রোড তুমি চেনো?”
জেসিকা এরপরের কথাগুলো বলেছে বাংলায়। সে বলল, “আমি কলকাতার মেয়ে। কোনো এক জুন বা জুলাই মাসের মধ্যরাত। তখন প্রচণ্ড গরম। তোমার নামটা পরিচিত মনে হলো। মাঈন হাসান। বাংলাদেশের ছেলে। কলকাতায় পড়তে গেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে!”
ভূমিকম্প হচ্ছে বোধ হলো। পায়ের নিচে মাটি নড়ছে। চোখের সামনে সবকিছু দুলছে। জেসিকার মুখ অস্পষ্ট হয়ে এলো।
আমি থাকতাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হোস্টেলে। বেলেঘাটায় থাকত রতনভাই। আমার চেয়ে চৌদ্দ/পনেরো বছরের বড়ো। বাড়ি সিরাজগঞ্জে। কলকাতায় গিয়ে পরিচয়। ওষুধের ব্যবসা করত। শনিবার সন্ধ্যায় বেলেঘাটার দোকানে রতনভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। বলল, “আগামীকাল তোমার ভার্সিটি বন্ধ। বিকেলে শোভাবাজারে চলে এসো। রাতে থাকবে।”
আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না। শোভাবাজারে রতনভাইয়ের বন্ধুর বাড়ি। পুরাতন ধাঁচের চারতলা বাড়ি। ওপরতলায় বড়ো ভাই রাজনদা থাকে। তাকে রতনভাই রাজুদা বলে ডাকে। ছোটভাই ষষ্টিদা থাকে দোতলায়। তেতলায় থাকেন বৃদ্ধা মা। রাজুদা’র বয়স আনুমানিক চল্লিশ। ষষ্টিদা পঁয়ত্রিশ পার করেছে। নিচতলায় কেমিক্যালসের গোডাউন। তাদের কেমিক্যালসের ব্যবসা। শোভাবাজারের ওই বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। রাজুদা, ষষ্টিদা আর রতনভাই একসঙ্গে বসে মদ খায়। আমার ভালো লাগে না। রাজুদা আর ষষ্টিদার মা-ও অ্যাডিকটেট। তিনি প্যাথিডিন নেন। ঘোর কেটে গেলে কিংবা ঘোরের ভেতর চিৎকার করে বলেন, “আহ্ কী সৌভাগ্য আমার! এক ছেলে আমাকে মাথায় তুলে রেখেছে। হুইস্কি দিয়ে পূজো করে। আরেক ছেলে পূজো করে আমার মাথায় ভদকা ঢেলে। আর আমার পোড়াভাগ্যে একবোতল রামও জোটে না।”
যেতে ইচ্ছে না করলেও আমাকে শোভাবাজারে যেতে হয়। রতনভাইকে না করা যায় না। কলকাতায় আমার পরিচিত বেশি কেউ নেই। রতনভাই লোকাল গার্জিয়ান হয়ে গেছে। দেশ থেকে নেওয়া গোল্ডলিফ সিগারেটের প্যাকেট পকেটে নিয়ে শোভাবাজারে হাজির হলাম শেষ বিকেলে। ষষ্টিদার ঘরে সন্ধ্যা থেকে মদ খাওয়া শুরু হয়। রামের কাচের বোতলের বদলে প্লাস্টিকের বোতল বেরিয়েছে। কয়েক বোতল রাম, ঠান্ডা পানির বোতল, চানাচুর, বাদাম, আর চিকেনগ্রিল নিয়ে ফ্লোরে কাগজ বিছিয়ে বসেছে।
আমাকে খেতে বলে। আমি খাই। প্রথমে অসুবিধা হচ্ছিল। সিগারেটের ঝাঁজে পরে আর অসুবিধা হয়নি। গ্লাসে খানিকটা রাম দিয়ে তাতে ঠান্ডা পানি মেশাচ্ছিল। একবার গ্লাস শেষ হলে ষষ্টিদা আবার নতুন করে গ্লাস ভরে দিচ্ছিল। ওপর তলা থেকে রাজুদার মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে, “কী রে সব মরেছিস নাকি। বাড়িঘর অন্ধকার! নাকি আমি মরে গেছি! শ্মশানে আমাকে পুড়িয়ে দিয়েছিস!”
মায়ের কথা কেউ গ্রাহ্য করল না। তিনি চিৎকার করে চললেন। রাজুদা শুধু বলল, “দেখে আসবি নাকি একবার?”
ষষ্টিদা বলল, “শিকল দিয়ে খাটের সাথে বাঁধা আছে। ঝামেলা করতে পারবে না।”
কয়বার আমার গ্লাস ফাঁকা হয়েছিল মনে নেই। আচমকা শরীর গুলিয়ে উঠল। আমি উঠে বাথরুমে চলে গেলাম। মুখ ভরতি করে বেসিনে হড়হড় করে কালো বমি করলাম। বিচ্ছিরি গন্ধ সেই বমির। বাইরে থেকে যেন বমি করার শব্দ শোনা না যায় সে জন্য পানির কল খুলে তার নিচে ফাঁকা বালতি রেখে দিলাম। পেট উজাড় করে বমি হয়ে যাওয়ার পর ভালো লাগল। পানি ঢেলে বেসিন পরিষ্কার করলাম। চোখমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখি আমার শূন্য গ্লাস রাম আর পানিতে পূর্ণ হয়ে আছে। খাব কি খাব না ভাবছি। রাজুদা বলল, “হাত গুটিয়ে ফেললে কেন? চিকেন নাও।”
আমি চিকেন নিলাম না। গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিলাম। ষষ্টিদা বলল, “চলো যাই।”
রাজুদা বলল, “চল।”
রতনভাই আমার দিকে তাকাল। তারা কোথায় যাবে আমি জানি না। আমার একা এখানে থাকতে ভয়ও লাগছে। রাজুদার মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি বেড়েছে। তিনি চিৎকার করে বলছেন, “বিছানায় পেশাব করেছি। খুলে দে বলছি। নাহলে বিছানায় হেগে দেব।”
রতনভাই কী বুঝল জানি না। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো।”
সুজুকি-মারুতিতে উঠলাম আমরা চারজন। ষষ্টিদা গাড়ি চালাচ্ছে। ষষ্টিদার পাশে সামনের সিটে রতনভাই। পেছনের সীটে আমার পাশে রাজুদা বসে আছে। ব্রেবোর্ন রোডের একটা বাড়ির সামনে গিয়ে ষষ্টিদা গাড়ি থামাল। গলির ভেতর কাঠের বারান্দাওয়ালা দোতলা বাড়ি। দেয়ালে হলুদ রং। সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে উঠে গেলাম। দরজা খোলা ছিল। বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরের ঘর থেকে মধ্যবয়সী একজন নারী বের হয়ে এলেন। আলো ছিল তার পেছনে তাই ভালোভাবে মুখ দেখতে পাইনি। পরনে ঢোলা ম্যাক্সি। রতনভাইয়েরা তিনজন সেই নারীর সঙ্গে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। তাদের হাবভাব দেখে মনে হলো আমি যে সাথে এসেছি একথা বেমালুম ভুলে গেছে।
হাতে ঘড়ি নেই। কত রাত হয়েছে বুঝতে পারছি না। বারান্দায় একা হয়ে গেলাম। দেয়াল ঘেঁষে রাখা কাঠের লম্বা বেঞ্চের একপাশে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লাম। আমার এখন আর কিছু করার নেই। ডানদিকের ঘরের দরজার সামনে ছায়া পড়েছে। তাকিয়ে দেখি দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে কালোছাপা স্কার্ট। গায়ে সাদা টপস। আমার দিকে স্পষ্ট চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি সোজা হয়ে দাঁড়াল। পরিষ্কার গলায় থেমে থেমে বলল, “আমার নাম জেসিকা কস্তা। সেন্ট পল’স মিশন স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি। ওঘরে যে মহিলাকে দেখেছেন তিনি আমার মা।”
জেসিকার গলা অত্যধিক শীতল আর গম্ভীর। তাকে দেখে মনে হয়েছিল সে ইলেভেন ক্লাসে পড়ে বা এসএসসি পরীক্ষা দেবে। স্বাস্থ্য বেশ ভালো। আর এখানে ওড়না পরার তেমন চল নেই। তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। তাকে কিছু জিগ্যেস করিনি। নিজে থেকে এতগুলো কথা বলল। তারপর আবার দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, “এ বাড়িতে যারা আসে, আমার সাথে দেখা হলেই প্রথমে এই কথাগুলো জানতে চায়, আমার নাম কী, কোন ক্লাসে পড়ি, কোন স্কুলে। তোমার কি এছাড়া আর কিছু জানার আছে? যেমন এখান থেকে স্কুল কতদূর, কীভাবে আমি স্কুলে যাই, একা নাকি সঙ্গে কেউ থাকে?”
সেসব কিছু না বলে কেন জানি তাকে বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলাম, “মায়ের ব্যাপারটাতে তোমার খারাপ লাগে না?”
জেসিকা সেই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বলল, “এখানে বড্ড গরম। আমার ঘরের বারান্দার ওপাশটা ফাঁকা। বাতাস আছে। চলো ওখানে গিয়ে দাঁড়াই।”
বললাম, “গরম লাগছে না। ঠিক আছি।”
জেসিকা বলল, “আমার সাথে এসো।”
বলার ভেতর কিছু ছিল। ডাক উপেক্ষা করতে পারলাম না। উঠে জেসিকার পেছন পেছন তার ঘরে ঢুকলাম। জেসিকা ঘুরে ঘরের দরজার ছিটকিনি আটকে দিলো। খানিকটা অবাক হলেও কিছু বললাম না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এ পাশটা অন্ধকার। একেবারেই সুনসান। জেসিকা বলল, “সিগারেট আছে?”
বললাম, “আছে।”
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেয়াশলাই বের করলাম। বললাম, “তুমি কোন ব্র্যান্ড খাও জানি না। এটা বাংলাদেশ থেকে আনা। একটু কড়া।”
জেসিকা বলল, “আমি কখনো সিগারেট খাইনি। আজ তোমার সাথে খাব।”
বিস্ময়ে থমকে গেলাম। জেসিকা সিগারেট হাতে নিয়ে বলল, “আগুন জ্বালাও।”
দেয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে জেসিকার সিগারেটের কাছে ধরলাম। বললাম, “ধীরে ধীরে টানতে থাকো।”
জেসিকা সিগারেট ধরাতে পারল না। আমাকে বলল, “তুমি জ্বালিয়ে দাও।”
বললাম, “তুমি পারবে।”
তৃতীয়বারে জেসিকা সিগারেট জ্বালাতে পারল। জোরে টেনে ফেলে খুকখুক করে কাশল কয়েকবার। আমি আমার সিগারেট জ্বালিয়েছি। জেসিকা বলল, “কী ইচ্ছে করে আমার জানো, অনেক বড় কেউ হব। বিশাল চাকরি করব। কলকাতায় সিনিয়র সিটিজেন ক্লাব বানাব। বয়স্ক মানুষদের অনেক যন্ত্রণা। তাদের কেউ মেনে নিতে চায় না। এমন ব্যবস্থা করব, ওই বয়স্ক মানুষেরা হবে এলাকার মূল শক্তি।”
জেসিকা ধীরে ধীরে সিগারেটের ধোঁয়া টেনে হালকাভাবে বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমাকে ডেকে বলল, “অ্যাই শোনো।”
তাকালাম জেসিকার দিকে। জেসিকা মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে টুপ করে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটেছে যে আমি কিছু বুঝতে পারিনি। এমন ঘটনা ঘটবে তাও ভাবিনি। আশপাশে তাকালাম। আবছায়া, অন্ধকার। টিমটিম করে আলো জ্বলছে কয়েকটা বাড়িতে। দূরে দুটো বাড়ির এদিকটাতে বারান্দা আছে। সেখানে কেউ নেই। বুঝলাম এখন অনেক রাত।
জেসিকা বলল, “কোন এক দেশে পাহাড়ের নিচে বাড়ি কিনব। সন্ধেবেলা যখন সূর্য ডুববে তখন বাড়ির সামনে বসে ভায়োলিন বাজাব।”
এমনভাবে জেসিকা কথা বলছে যেন কিছুক্ষণ আগে কোনো ঘটনা ঘটেনি। সে হুট করে আমাকে চুমু খায়নি। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, “ব্যাপারটা সুন্দর কিনা বলো!”
সিগারেট রেলিংয়ের সঙ্গে ডলে নেভাতে নেভাতে বললাম, “সুন্দর।”
জেসিকাও সিগারেট নিভিয়ে ফেলল। পায়ে ঠেলা দিয়ে সিগারেটের নিভে যাওয়া টুকরো নিচে ফেলে দিলাম।
জেসিকা দু’হাত বাড়িয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে। ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। বাধা দিলাম না। জেসিকার ঠোঁট ভেজা। দাঁতের সঙ্গে তার দাঁতের ঘষা অনুভব করলাম। সে জিভটাকে চিকন করে আমার জিভের ভাঁজে রাখল। একেবারে নতুন এক অনুভূতির অভিজ্ঞতায় ডুবে যেতে থাকলাম। তবু মনে হলো কিচ্ছু ঠিক হচ্ছে না। জেসিকার ঠোঁট থেকে আমার ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে এলাম। জেসিকা ঘরে ঢুকল। আমিও ঘরে ঢুকেছি। জেসিকা বিছানায় উঠে বসল। আমি সোজা দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ জেসিকা আমার হাত ধরে টান দিয়েছে। তাল সামলাতে না পেরে কাত হয়ে জেসিকার গায়ের ওপর পড়ে গেলাম।
বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে জেসিকা। সে দুপা ফাঁক করে রেখেছে। হাঁটুর ওপরে স্কার্ট তুলে এনেছে। আমাকে জাপটে ধরে বলল, “আমার ভেতরে এসো। পিষে দম বন্ধ করে মেরে ফেলো।” জেসিকা আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। আমার বুকে সে বুক চেপে রেখেছে। মনে হলো হাঁপাচ্ছে। জেসিকা বলল, “স্কুলে মায়ের কথা সবাই জানে। কেউ আমার সাথে মিশতে চায় না। কিছু বাজে ছেলে আমাকে খারাপ ইঙ্গিত করে।”
শান্ত হয়ে আসছে জেসিকা। যেন লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। সে ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “মা প্রতিদিন এই কাজ করে। মা যা করছে আমিও তাই করব। মায়ের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাই।”
জেসিকার শক্ত বাঁধন আলগা করে উঠে বসলাম। স্কার্ট দলা পাকিয়ে কোমরের কাছে নেমে এসেছে। কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত মসৃণ ঘন শ্যামলা পা দেখা যাচ্ছে। কচি কলাপাতার মতো মসৃন। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে। সেই সৌন্দর্য দেখা ছিল আমার কাছে অপ্রত্যাশিত।
স্কার্ট টেনে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত টেনে দিলাম। জেসিকা উঠে বসল। দুই চোখের কোণায় পানি জমে আছে। টলটলে পানি। স্থির হয়ে আছে। পড়ছে না। তার পিঠে আলতো করে হাত রাখলাম। জেসিকার দুচোখের কোণা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে তাকে বুকের ভেতর টেনে নিলাম। জেসিকা হুহু করে কেঁদে উঠল। কান্নার দমকে থিরথির করে কাঁপছে জেসিকা। তার মাথায় মুখ ঘষলাম। চুলে মুগ্ধ হওয়ার মতো অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। আমি মুগ্ধ হলাম।
জেসিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, “অন্যে যা করছে হুবহু তাই করে কারও ওপর প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। নিজে যা করতে চাইছ সেটা ঠিকঠাকমতো করতে পারলেই চরম প্রতিশোধ নেওয়া হবে।”
ওয়েটার এসে জানতে চাইল আর কিছু লাগবে কিনা। তাকে কিছু বললাম না। সে চলে গেল। জেসিকা ব্যাগের ভেতর ল্যাপটপ রাখছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। জেসিকার এখন বয়স হয়েছে পঁয়তাল্লিশ বছর। আমার বয়স পঞ্চান্ন। জিগ্যেস করলাম, “তোমার মা?”
জেসিকা বলল, “নিজের ঘরের সিলিংয়ে কাপড় বেঁধে আত্মহত্যা করেছে। তখন আমি টুয়েলভ ক্লাসে পড়ি। পাড়ার কয়েকটা খোজা পুলিশের কাছে লাগিয়েছিল মাকে আমি মেরেছি। পুলিশ বারোঘণ্টা আমাকে হাজতে রেখে দিয়েছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলেছে আত্মহত্যা।”
শেষের দিকে জেসিকার গলা কেমন অনিশ্চিত হাহাকারের মতো শোনাল। জিগ্যেস করলাম, “তোমাদের ব্রেবোর্ন রোডের সেই বাড়িটা এখনো আছে?”
জেসিকা ল্যাপটপের ব্যাগের চেইন আটকাচ্ছে। বলল, “আছে। সল্টলেকের পাশে বাঙ্গুর এভিনিউতে বিশাল সিনিয়র সিটিজেন ক্লাব বানিয়েছি। ক্লাবের মেম্বাররা এখন অল ইন্ডিয়াতে লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের না হলে মোটিভেশনাল সেশন চলেই না।”
আমার ভেতর থেকে অদ্ভুত আনন্দ মেশানো প্রশান্তির শব্দ বেরিয়ে এলো, “বাহ্।”
জেসিকা ওয়েটারকে বিল বুঝিয়ে দিয়ে বলল, “নিউজিল্যান্ডে পাহাড়ের নিচে ছোট্ট একটা বাড়ি কিনেছি। এখন সরকার দেখাশোনা করে। প্রজেক্ট শেষ হলে নিউজিল্যান্ড চলে যাব। সিনিয়র সিটিজেন ক্লাব তারা নিজেরাই চালাবে।”
জেসিকার দিকে তাকিয়ে আছি। তার চোখ ভর্তি পানি। সে কি কাঁদছে! কেন কাঁদছে? টেবিলের ওপর মোমবাতি জ্বলছিল। জেসিকা ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিলো। অমনি রেস্টুরেন্টের চওড়া কলামের এপাশটা আলো-আঁধারিতে ডুবে গেল। আমার ধারণা জেসিকা কান্না আড়াল করার জন্য মোমবাতি নিভিয়েছে। জানালা দিয়ে একটা জোনাকি ঢুকেছে। জোনাকি আলো ছড়াচ্ছে। জ্বলছে আর নিভছে। বিস্ময় নিয়ে জোনাকির আলো জ্বলা-নেভার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন