অমিতা মজুমদার
রাতের আলো আঁধারিতে গাড়িটা এসে দাঁড়ায় জীবনপুর মোড়ের ফুট ওভার ব্রিজের নিচে। এই ব্রিজের উপরেই খদ্দেরের অপেক্ষা করে উর্মি। উর্মি তৃতীয় লিঙ্গের হলেও ওর মধ্যে নারীসুলভ কমনীয়তা যেন একটু বেশি। তাই সরাসরি ভিক্ষা না করে এ পথ বেছে নিয়েছে। এতদিনে এও জেনে গেছে, কিছু ভদ্রবেশী খদ্দের সুন্দরী নারী থাকার পরেও, তাদের মতো বৃহন্নলাদেরই খোঁজে। আজ সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি পড়ছিল, লোক চলাচল একেবারেই কম। কেমন একটা ভুতুড়ে অবস্থা। উর্মি কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ছিল, আজ আদৌ কোনো খদ্দের আসবে কি? খদ্দেরের সাথে যেতে পারলে অনেকগুলো অস্বস্তি থেকে বাঁচে উর্মি। যেমন খদ্দেররা ভালোমন্দ খেতে দেয়, একটা গোটা রাতের জন্য সে বৃহন্নলা থেকে মানুষ হয়ে ওঠে। আর সেই মানুষের অধিকারেই সাজানো-গুছানো বাথরুমে সুগন্ধি সাবান, শ্যাম্পু দিয়ে একটা শান্তির স্নান দিতে পারে, ঠান্ডা গরম জলে। পরিষ্কার ধোয়া পোশাকও মেলে। মোটের উপর এই একরাতে সে খদ্দেরের বাড়ির মালকিন হয়ে যায়। সাহেব যখন খাবার টেবিলে নিজের হাতে খাবার তুলে দেয়, আবার এটা সেটা খাওয়ার জন্য বেশ আহ্লাদী সুরে সাধাসাধিও করে তখন উর্মির বেশ লাগে। হোক না কয়েক ঘন্টার তবুও মনে হয় এটা তার সংসার। এই সংসারের লোভটুকু এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রাতভর বিকৃত অমানবিক ভালোবাসার যে অত্যাচার তাকে সইতে হয় সেটাকে আর মনে রাখে না।
হঠাৎ দেখে একটা বড়ো কালো গাড়ি এসে থেমেছে ব্রিজের পাশে। গাড়ি থেকে একজন সুঠামদেহী পুরুষ ব্রিজের উপরে অপেক্ষমান উর্মির কাছে এসে দাঁড়ায়। তাকে ইশারা করতেই সে সাহেবের পিছু পিছু গিয়ে গাড়িতে ওঠে। এই শহরের সব রাস্তা উর্মি চেনে না। সেই কোন ছোটবেলায় বাবা গাড়িতে বসিয়ে বেড়াতে যাবার নাম করে, কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে একটা ট্রেনে বসিয়ে রেখে বলেছিল, তুমি বসো আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি। হ্যাঁ খাবার নিয়ে এসেছিল বাবা, ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বাবা দৌড়ে এসে জানালা দিয়ে খাবার দিতে দিতে ট্রেনটা যেন দৌড়াতে শুরু করে, আর বাবাও কেমন দূরে যেতে যেতে মিলিয়ে যায়। ছোট্ট উর্মি হয়তো সেদিন কেঁদেছিল, আজ আর স্মৃতিতে সে-সব কিছুই নেই। কবে কখন কিভাবে এই বৃহন্নলাদের দলে ভিড়ে গেছে, তাদের জীবনে অভ্যস্ত হয়েছে কিছুই আজ আর মনে করতে পারছে না বা চাইছেও না। উর্মির মতো সেতু, সুইটি, ববিতা সকলের গল্পগুলো একইরকম। এই যে নামগুলো ওদের এটাও নিজেদেরই দেওয়া বা দলের মাসির দেওয়া। যাযাবর জীবনের কুড়িটি বসন্ত পার হতে হতে এখন উর্মি মহানগরের বাসিন্দা। ওরা জোটবদ্ধ হয়ে এক এক এলাকায় থাকে। এক একজন মাসির অনুশাসনে ওরা নিজেদের মতো করে জীবনের একটা ছন্দ তৈরি করে নিয়েছে। ভালো আছে ওরা।
খদ্দেরের সাথে যেতে যেতে এসব কথাই ভাবে উর্মি। ছেলেবেলায় সে ঢাকাতেই থেকেছে, মাঝে মাঝে একটা স্বপ্ন দেখে জেগে জেগেই– একদিন সে তার বাড়ি বাবা মাকে খুঁজে পাবে। যদিও বড়ো হয়ে বুঝতে পেরেছে সেদিন বাবা তাকে ইচ্ছে করেই ট্রেনে রেখে এসেছিল।
গাড়িটা মহাসড়ক ছাড়িয়ে একটা গলির রাস্তা ধরে চলতে থাকে। দুপাশে সব আকাশছোঁয়া বাড়ি।
এইরকম বাড়িগুলোকে ফ্লাটবাড়ি বলে উর্মি তা জানে। উর্মি এও জানে এই ফ্লাটবাড়িতে অনেক কিছু হয়, কিন্তু কেউ কারও ঘরের খবরে মাথা ঘামায় না।
উর্মির ঝাপসা স্মৃতিতে মনে পড়ে তাদের বাড়িটা এরকম ছিল না। একটা দোতলা বাড়ি, সামনে উঠোন এরকম কিছু ছবি ছায়া ছায়া ভেসে ওঠে মাঝে মাঝে মনের পর্দায়। এসব ভাবনার মধ্যে গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকতে যাবে এমন সময় উর্মির চোখ আটকে যায়–
একটা বকুলগাছ! এই বর্ষায় গাছটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। উর্মির অস্পষ্ট স্মৃতিতে ভেসে ওঠে দুই বোন মিলে গাছটা লাগিয়েছিল। এই লোকটাই কি আপুর স্বামী!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন