শ্যামলী আচার্য
অনেকদিন পরে মার খেল চাঁপা। পিসি ওকে মারে না কখনও। মা মাঝেসাঝে গায়ে হাত তুলত। বছরখানেক হল মা চলে যাবার পর পিসিই গার্জিয়ান। ওকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে। অকালে ভাই চলে গেল, তারপর ভাইয়ের বউটাও। ভাইঝিটাকে জান দিয়ে ভালোবাসে সীমা। চাঁপার কোনও বেচাল সহ্য করতে পারে না। পড়াশোনা না’ই বা হল, তা’ বলে চরিত্তিরের ঠিক থাকবে না?
চাঁপার একটাই অপরাধ। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে বল্টুর সঙ্গে গায়ে গা ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরছিল। এই ঢলানি সহ্য হয়নি সীমার।
তোকে কতদিন বারণ করেছি ওই বদ ছোঁড়াগুলোর সঙ্গে মিশবি না?
বা রে! বদ কেন হতে যাবে? ওরা আমার বন্ধু!
চাঁপার ঘাড়-হেলানো জবাবে চিড়বিড়িয়ে ওঠে সীমা।
কীসের বন্ধু? কতগুলো উটকো লাফাঙ্গা ছোকরা।
অন্য সময় হলে চাঁপা রা কাড়ত না। পিসিকে সে বড্ড ভালোবাসে। বাবা বকলে, মা গায়ে হাত তুললে, ইস্কুলের দিদিমণি বেঞ্চিতে দাঁড় করিয়ে রাখলে একছুট্টে সে চলে আসত এই পিসিটার কাছে। সব দুঃখের সাথি। ওরও কপাল পোড়া। নামেমাত্র বিয়ে হয়েছিল। কেন যে সে চলে এল বরের ঘর ছেড়ে, সে কারণ আর যেই জানুক, চাঁপা জানে না।
কিন্তু আজ কী যে হল। পিসি অমন বলামাত্র চাঁপা ক্ষিপ্ত।
কী অন্যায় করেছি শুনি? বল্টু ওই সময় বিশ্বাসদের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল। হাঁক পাড়ল আমায় দেখে। তা’ সাড়া দেব না? নাহয় দু’পা হেঁটে এসেছি… তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে শুনি?
শোন চাঁপা, যা বলি তোর ভালোর জন্যই বলি…
আমি কি শুতে গেছি ওর সঙ্গে?
এই উত্তরটার জন্য প্রস্তুত ছিল না সীমা। আচমকাই সপাটে চাঁপার ফর্সা গালে এক চড়।
পিসির সঙ্গে চাঁপার বয়সের তফাত বছর কুড়ির। চোদ্দ আর চৌতিরিশ। মেজাজে তো ফারাক থাকবেই। সদ্য যৌবন যার দুয়ারে কড়া নাড়ে, তার সঙ্গে মধ্যবয়সের শরীর পাল্লা দেবে কী দিয়ে? চাঁপার উদ্ধত উত্তর সীমা সহ্য করতে পারেনি।
চাঁপা ফুলে ফুলে কাঁদছে। কান্নার দমকে ওর ছোট্ট বুকের কাঁপন স্পষ্ট দেখা যায় পাশ থেকে।
কাঁদিস না রে।
চাঁপার পিঠের ওপর হাত রাখে সীমা। স্কুলের জামাগুলো আজকাল এত মোটা আর শক্ত। গরমে ঘেমে গেছে মেয়েটা। এতটা পথ হেঁটে আসে। না মারলেই হত।
জামা ছেড়ে আয়। খাবি না? আজ পলতাপাতার বড়া আছে। ভাতে জল দেওয়া। একটা মরিচ পুড়িয়ে দিই?
চাঁপা দুচোখ ভর্তি জল নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে পিসির।
চাঁপার শিরদাঁড়ার দুপাশে নরম আস্তরণ। কাঁধের দুপাশ থেকে তার হাতদুটো অজান্তেই যেন ডানা মেলে দেবে কখন। সীমার বড় ভয়। চাঁপা যেদিন তাকে ছেড়ে যাবে, তার সেদিনই যেন মরণ হয়। এক চতুর্দশীর চাঁদ তার হাতের নাগালে এখনও। চাঁপার স্কুলের শার্টের বোতামগুলো একের পর এক খুলতে খুলতে তার শরীরে এক অজানা জোয়ার ঝাঁপিয়ে আসে। নারীশরীরের এই আশ্চর্য বাঁক তার বড় প্রিয়। পুরুষালি গন্ধের চেয়ে কিশোরী বাহুমূল তাকে টানে বেশি। কেউ তাকে বোঝেনি। বুঝবেও না। স্কুলে পড়ার সময় পম্পা ওর ঠোঁটে আঙুল রাখত বারবার। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে নিত। পম্পার বিয়ে হয়ে গেল ষোলোতেই। সীমা আজও বিশ্বাস করে, পম্পা ওর মতোই অসুখী। সীমা পালিয়ে এসেছে। পম্পা পারেনি। সবাই পারেনা।
যতদিন চাঁপা থাকবে, ওর শরীরের সুগন্ধ নিয়ে বেঁচে থাকা। সীমার জীবনের চাওয়াপাওয়া এটুকুই।
অনেকদিন পিঠটা ঘষে দিই না তোর। ইস কী মাটি পড়েছে রে। আয় দেখি কুয়োর পাড়ে। ডলে দিই।
বলতে বলতেই সীমার আঙুল বেয়ে পরিণত আদর নেমে আসে এক কিশোরীর শরীরে। যে শরীর তখনও ইশারা চেনেনি।
আকাশের নীল ওড়নায় চড়া রোদের ঝাপটা।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন