রম্যাণী গোস্বামী
খাঁচার ভিতরে দুই পাখির বাস। একটি উজ্জ্বল হলুদ। অন্যটির রঙ কচি কলাপাতার মত সবুজ। হলদে পাখির দাপটই আলাদা। সে রাতদিন মহা বিক্রমে সবুজ পাখিকে জ্বালাতন করে চলে। সবুজ যেইমাত্র দাঁড়ে গিয়ে বসবে, ওমনি হলুদ তাকে ঠোকর দিতে দিতে এমনি কোণঠাসা করে ফেলবে যে সে বেচারির খাঁচার শিক আঁকড়ে ঝুলে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। দুটি আলাদা পাত্রে খাওয়ার ব্যবস্থা, যাতে গোল না বাঁধে। তবুও সবুজ যেই দানা খেতে নামবে, সঙ্গে সঙ্গে হলুদ নিজের খাওয়া ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঠিক তার পাশের বাটিতেই। সবুজ ভারি নির্বিবাদী। ওইটুকু ঘুপচি জায়গার ভিতরেও সে আপ্রাণ মানিয়ে চলে। সবসময় চেষ্টা করে হলুদ পাখির মন জুগিয়ে চলার। পরিবর্তে একটু একটু তার মন পাওয়ার। কিন্তু হায় জগতের নিয়ম! এভাবে কি আর মন পাওয়া যায়? মনোজগতের রহস্য যে এর চাইতে অনেক বেশি জটিল।
অশান্তির পারদ আরও চড়ল যখন খাঁচার মালিক কোথা থেকে একটি চমৎকার দোলনা আমদানি করলেন। ঝলমলে সোনালি জড়ির আস্তরণে মোড়া রাজকীয় দোলনাটি। উপরে তার বাঁকানো হুক। ঈগলপাখির নখের মত। যার সাহায্যে তাকে ঝোলানো যায় শিকে। খাঁচার শোভা শতগুণ বাড়িয়ে বাতাসে সেটি দোলে। দোলনার মাঝের দাঁড়ের দুই প্রান্তে দুটি সোনালি ঘণ্টা ঝুলছে। বাতাসে যখন দোলা লাগে তখন সেই ঘণ্টা দুটি বেজে ওঠে টুং টাং নরম শব্দে। হলুদ সবুজ দুজনেই প্রথমে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায় নতুন জিনিসটার দিকে। কিন্তু এগুতে সাহস করে না। সবুজের চাইতে হলুদের সাহস বেশি। একদিন সে লাফিয়ে উঠে বসে দোলনাটির দাঁড়ে। দোল খায় তুমুল। টুং টাং আওয়াজ জাগে। তাকে দেখে সাহস পায় সবুজ পাখিও। কয়েকবার শরীর ঝাঁকিয়ে দোল খেয়ে সে তো ভারি খুশি! কয়েকটা দিন যেতে না যেতেই ওমনি দোলনায় বসা নিয়ে আরম্ভ হল দুজনের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা।
দুষ্টু হলুদ পাখি এক নতুন কায়দা বের করেছে তার ছোট্ট মাথা খাটিয়ে। সে নিজে বেশ কিছুক্ষণ দোল খাওয়ার পর খাঁচার শিক পায়ে আঁকড়ে গলা বাড়িয়ে দোলনার একপ্রান্ত ঠোঁট দিয়ে কামড়ে এমনি জোরে ঝাঁকাতে থাকবে, যতক্ষণ না সেটা শিক থেকে খুলে খসে পড়ে যায় খাঁচার মেঝেতে। কারণটা আর কিছুই নয়। সেই সবুজ পাখিকে দোল খেতে না দেওয়া। যতবার ঝুলিয়ে দাও দোলনা, সেই একই অবস্থা। বিস্তর অশান্তি। অবশেষে খাঁচার মালিক দোলনাটি সরিয়েই ফেললেন বাধ্য হয়ে।
একদিন সকালে সবুজ পাখিটি মরে গেল। আগের দিনও সে দানা খেয়েছে। লাফালাফি করেছে কত। থরথর করে কাঁপতে থাকা ওর পালকের মত কোমল শরীরটা কিছুক্ষণ খাঁচার মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে থেকে থেকে একসময় স্থির হয়ে গেল। দাঁড়ে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে নীচে টানটান হয়ে যাওয়া অনড় সঙ্গীটিকে ঠায় তাকিয়ে দেখল হলুদ পাখি। নামল না। টুঁ শব্দটি করল না।
দুটো দিন কেটে গেছে এরপর। হলুদ পাখিটি আর নামে না। দানা খায় না। সে কেমন যেন সিঁটিয়ে বসে থাকে দাঁড়ের প্রান্তে। তাকে নিয়ে খাঁচার মালিকের চিন্তা ভারি। কতভাবেই না হলুদ পাখির মনোরঞ্জনের প্রচেষ্টা চালান তিনি দিনভর। দোলনাও ফের আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। কিন্তু হলুদ পাখি নির্বিকার। সে শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় এদিক ওদিক। যেন খোঁজে কারোকে। অস্ফুট কিচিরমিচির শব্দে নাম ধরে ডাকে কারোর উদ্দেশ্যে। সাড়া পায় না। আবার ডাকে। দানা যেমন তেমন পড়ে থাকে খাবার রাখার পাত্রে।
আহা শোক! নানা জনে নানা পরামর্শ দেয়। কেউ বলে, উড়িয়ে দাও, এ-ও মরে যাবে নির্ঘাত। কেউ বলে, তাই তো! ওরা যে জোড়া ছাড়া বাঁচে না। এখনই যাও, আর একটি সঙ্গী নিয়ে এসো ওর।
চার দিনের দিন হলুদ পাখি হঠাত দোলনায় গিয়ে বসে। দোল খায় খানিক। এবারে সে আর দোলনাটিকে মেঝেতে ফেলে দেয় না। বরং ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় খাবারের বাটির দিকে। তারপর ঘাড় হেঁট করে টুকটুক করে দানা খায়। দেদার দানা ঠাসা রয়েছে দুটি পাত্রে। সে অনায়াসে সেসব ফেলে ছড়ায়। নষ্ট করে। অনেকটা যেন এক জীবনে হারানো সম্ভাবনাগুলির মত। অথবা কখনওই না গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলির মত।
মালিকের মুখে আবার হাসি ফোটে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন