short-story-canvas-e-rong-nei

ক্যানভাসে রং নেই
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

অ্যাকাডেমির সাউথ গ্যালারিতে অনেকদিন পরে প্রদর্শনী করতে পেরে বেশ খুশিয়াল মেজাজে ঋভু। তাঁর শিল্পীজীবনের চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই প্রদর্শনী। তিনি এখন খ্যাতির মধ্যগগনে। তাঁর এবারের ছবির বিষয় একেবারেই নতুন। ‘তন্ত্র আর্ট’ – এই ক্যাপশনে এঁকেছেন ছবিগুলি। অনেক গবেষণা করে, বহু বইপত্তর ঘেঁটে একসঙ্গে বত্রিশটা ছবি এঁকে ফেলে নিজেরও খুব ভালো লাগছিল। যাঁরা প্রদর্শনী দেখতে এসেছেন, তাঁরাও খুব উচ্ছ্বসিত ঋভুর ব্যবহৃত রঙের ব্যবহার, বিষয় ও রেখার টান দেখে।

এর মধ্যে ভিজিটর’স বুকও ভরে উঠেছে অনেক নামীদামী শিল্পীর মন্তব্যে। সাধারণ দর্শকদের মধ্যেও অনেকে কী দুর্দান্ত সব মন্তব্য করেছেন। পড়লেই বোঝা যায় অনেক সমঝদার দর্শক আছেন যারা খুব একটা জাহির করতে চান না নিজেকে, অথচ ছবি খুব ভালো বোঝেন।

তিনদিনের প্রদর্শনী, শেষদিনে রাত্রি আটটা নাগাদ প্রদর্শনী গুটিয়ে ফেলা শুরু করেছেন, দেওয়াল থেকে নামিয়ে ফেলছেন ছবিগুলি। সঙ্গে তাঁর অনুরাগী এক তরুণ শিল্পী সোমঋক তাঁকে সাহায্য করছে। আর এক তরুণ শিল্পী রজতাভ এই প্রদর্শনীর উদ্বোধনের দিন খুব খেটেছিল, তাকেও আসতে বলেছিলেন, তবে তাকে দেখতে পাচ্ছেন না।

প্রত্যেকটি ছবি দেওয়াল থেকে খুলে কাগজে মুড়ে পর পর সাজিয়ে রাখা খুবই ঝঞ্ঝাটের কাজ। প্রদর্শনী যারা দেখতে এসেছিলেন, একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে একটি তরুণী একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল ঋভু আর সোমঋকের তৎপরতা। হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, “আমি কি আপনাদের সঙ্গে হাত লাগাতে পারি?”

ঋভু একটু অবাক হলেন, আবার হলেন না। মেয়েটার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ, পরনে ফাটা-চটা জিন্‌সের উপর হালকা গোলাপি শার্ট। কানে বড়ো বড়ো লাল-সবুজ পাথর-বসানো দুল, গলায় একই রকম পাথর-বসানো হার। কীরকম উসকো খুসকো হর্সটেল করা চুল। কিছুক্ষণ নিরিখ করে, ইতস্তত করে বললেন, “লাগাতে পারো। কিন্তু একাজে একবার হাত দিলে তোমার অনেক রাত হয়ে যাবে।”

“তা হোক। অনেক ছবি। আমি একটু সাহায্য করে দিলে কিছুটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারবেন।”

ঋভুর অনুমতি পেতেই মেয়েটি খুব দক্ষ হাতে দেওয়াল থেকে ছবি পাড়তে শুরু করে, সাবধানে নামিয়ে খবরের কাগজ দিয়ে যত্ন করে জড়িয়ে পাশে রাখতে লাগল একের পর এক।গত তিনদিন ধরেই ঋভু খেয়াল করছিলেন এই মেয়েটি রোজই একবার করে তাঁর প্রদর্শনী দেখতে এসেছে, ও দু’তিন ঘণ্টা ধরে থাকছিল গ্যালারিতে। প্রতিটি ছবি বারবার খুঁটিয়ে দেখেছে ও একটা কাগজে নোট করেছে। ঋভু ভেবেছিলেন মেয়েটা কোনও কাগজের প্রতিবেদক, প্রদর্শনী বিষয়ে কিছু লিখবে। কিন্তু তিনদিনের মধ্যে ছবি বিষয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা নাকরায় বুঝতে পারছিলেন না মেয়েটার কী অভিপ্রায়। আজ তাঁদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে দ্রুত ও দক্ষ হাতে প্যাক করছে, তার মধ্যে দু-একবার তাকাচ্ছে তার দিকে।

ঋভু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কি?”

“তনিমা। সবাই তনু বলে ডাকে।”

একটু হাস্কি কণ্ঠস্বর। উত্তর দিয়েই তনিমা আবার প্যাক করে চলেছে।

তার প্যাকিং-এর দ্রুততা দেখে ঋভু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কী করো?”

“কিছু না। ছবিটবি আঁকি। এলোমেলো ঘুরে বেড়াই।”

ঋভু আশ্চর্য হচ্ছিলেন মেয়েটার উদাসীন কথাবার্তা শুনে। প্যাকিং শেষ হতে রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটা। ঋভু সোমঋককে বললেন, “একটা বড়ো গাড়িকে বলেছিলাম বাইরে এসে দাঁড়াতে। দেখে আয় তো এল কি না!”

সোমঋক দ্রুত বেরিয়ে গেলে ঋভু তাকালেন তনিমার দিকে, “তুমি কোনদিকে থাকো? এখন ফিরবে কী করে? অনেক তো রাত হয়ে গেল!”

তনিমা তাঁকে অবাক করে দিয়ে বলল, “কোথায় ফিরব? আমার তো কোনও ফেরার ঠিকানা নেই।”

“নেই! সে কী! বাড়িতে কেউ নেই?”

“থেকেও নেই।”

“তার মানে?”

“আমার একটা বাড়ি আছে, বাবা আছে মা আছে, কিন্তু তাঁরা আমাকে এলেক দিয়ে দিয়েছেন!”

“এলেক”

“মানে বাড়ির দুটো মেয়ের একটা যদি বাউণ্ডুলে হয়, কারও কথা শোনে না, বাড়ি থাকলে দরজা বন্ধ করে হাবিজাবি আঁকে, হঠাৎহঠাৎ বেরিয়ে যায় কাউকে নাবলে, তার তো বাড়ি বলে কিছু থাকে না!”

“কিন্তু সেটাও তো একটা ঠিকানা? কোনদিকে বলো। তোমাকে যাওয়ার পথে নামিয়ে দিয়ে যাই। আমি যাব যাদবপুর।”

তনিমা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমি থাকি দমদম, আপনার উল্টোদিকে।”

পরের মুহূর্তে বলল, “না-ই বা ফিরলাম বাড়িতে। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন না আপনার বাড়ি। আমি আপনার সব কাজ করে দেব।”

এমন আচম্বিত প্রস্তাবে ঋভু চমৎকৃত, মেয়েটা বলে কী!

“আমি তো একটু আধটু ছবি আঁকি, মাউন্ট করতেও জানি। আপনি ছবি আঁকবেন, আমি ছবিগুলো মাউন্ট করে প্যাক করে ঘরে গুছিয়ে রাকব। একজিবিশন হলে নিয়ে যাব। দেওয়ালে টাঙিয়ে দেব। একজন নামী শিল্পীর কত কাজ। আমি আপনাকে সাহায্য করব। নিয়ে যাবেন আপনার বাড়িতে?”

ঋভু খুব সমস্যায় পড়লেন। তাঁর ফ্ল্যাটটা খুব ছোটো নয়, এগারোশো স্কোয়ার ফুট। ফ্ল্যাটে তিনি ছাড়া তাঁর স্ত্রী গায়ত্রী থাকে। গায়ত্রী বেশ অসুস্থ। প্রায় শয্যাশায়ী। হার্টে সমস্যা আছে। তা ছাড়া দুটো হাঁটুই প্রায় অকেজো। হাঁটু পাল্টাতে বলেছেন ডাক্তার, কিন্তু হৃৎপিণ্ডের সমস্যা গুরুতর হওয়ায় অপারেশনে রাজি হচ্ছেন না তিনি। একজন রান্নার মাসি আছে। একজন কাজের মাসি ঘণ্টাদুই থেকে অনেক টুকিটাকি কাজ করে দিয়ে যায় বলেই সংসারটা চলছে এখনও।

গায়ত্রীর সঙ্গে কথা নাবলে হঠাৎ এই বয়সের একটা মেয়েকে কি ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া শোভন হবে। কিন্তু যদি গায়ত্রীকে ফোন করে পরামর্শ করতে চান, গায়ত্রী যদি না বলে দেয়, তা হলে মেয়েটাকে এই রাতে কি দমদমে দিয়ে আসা যাবে!

ভাবনাটা নিয়ে মাথায় পাক খাওয়াচ্ছেন, তার মধ্যে সোমঋক ফিরে এসে বলল, “স্যার, গাড়ি এসে গেছে।”

শুনেই তনিমা দুটো বড়ো ছবি একবারে কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, “আমি এ দুটো গাড়িতে রেখে এখনই আবার ফিরে আসছি। কোথায় গাড়ি, দেখিয়ে দিন তো।”

তনিমার তৎপরতা দেখে সোমঋকও দুটো ছবি তুলে নিয়ে বলল, “চলো।”

ঋভুকে বলল, “স্যার, আপনি এখানে দাঁড়ান, আমরা দুজনে ছ-সাতটা ট্রিপে তুলে দিচ্ছি ছবিগুলো।”

সব ছবি গাড়িতে তুলে রওনা দিতে রাত্রি সাড়ে এগারোটা। কলকাতার রাস্তায় তখন গাড়ির চলাচল ক্রমহ্রাসমান। সোমঋক উঠে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে। বলল, “স্যার আমাকে গড়িয়াহাট মোড়ে নামিয়ে দিলেই হবে।”

সোমঋক গাড়িতে উঠতে ঋভু তাকায় তনিমার দিকে, বললেন, “উঠে পড়ো।”

তনিমা অপেক্ষা করছিল ঋভুর ডাকের। অমনি পিঠের ব্যাগটা কোলে নিয়ে উঠে বসল পিছনের সিটে। তার পাশে ঋভু উঠতেই গাড়ি রওনা দিল যাদবপুরের উদ্দেশে। রাস্তায় খুব একটা কথা হল না। সোমঋককে গড়িয়াহাট মোড়ে নামিয়ে দিয়ে যাদবপুরে ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছোলেন দুজনে, রাত তখন মধ্যরাত।

লিফটে উঠে তিনতলায় নেমে বেল নাবাজিয়ে পকেট থেকে চাবি বার করে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। এত রাতে গায়ত্রীর ঘুমিয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। অন্যদিন হলে তাকে নাডেকে টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার খেয়ে চুপ করে শুয়ে পড়তেন বিছানায়। কিন্তু আজ তনিমা সঙ্গে থাকায় আস্তে আস্তে গিয়ে ডাকলেন, “গায়ত্রী…”, গায়ত্রীর ঘুম খুব আলগা। এত রাতে ঋভুর সঙ্গে একটি অচেনা তরুণীকে দেখে বেশ তাজ্জব। তার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে ঋভু বললেন, “তনিমা ছবি আঁকে। বাকিটা পরে বলছি। আমরা দুজনে ভাত বেড়ে খেয়ে নিচ্ছি। তারপর ওকে গেস্টরুমে থাকার ব্যবস্থা করে আমি আসছি।”

ঋভুদের গেস্টরুমটা ওদের ফ্ল্যাটের একটু নিরিবিলি কোণে। খাওয়া শেষ করে তনিমাকে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে ঋভু ফিরে এলেন গায়ত্রীর কাছে। গায়ত্রী আজ এখনও ঘুমোয়নি। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বললেন তনিমাকে কী করে পেলেন সেই বৃত্তান্ত। তনিমা তাঁদের ফ্ল্যাটে থাকতে চেয়েছে তাও বললেন।

গায়ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি যা ভালো বুঝেছ তাই করো।”
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঋভু দেখলেন তনিমা তাঁদের অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে স্নান সের বসে আছে সোফায়। নিজের বিছানা তুলে সাজিয়েছে পরিপাটি করে। ঋভুকে দেখে বলল, “গুড মর্নিং, স্যার।”

ঋভু প্রত্যুত্তরে গুড মর্নিং বলতেই তনিমা বলল, “চা করে আনব?”

সকালের চা-টা ঋভুকেই করতে হয়। ঋভু ইতস্তত করে বললেন, “তুমি তো জানো না কোথায় কী থাকে। আমি করে আনছি।”

তনিমা সোফা থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “আমাকে দেখিয়ে দিন কোথায় কী আছে। ততক্ষণে আপনি আর আন্টি ব্রাশ করে নিন।”

ঋভুর অনুমতির অপেক্ষা নাকরেই তনিমা ঢুকে গেল রান্নাঘরের ভিতর। সামান্য গলা চড়িয়ে বলল, “চায়ের সরঞ্জাম কোথায় থাকে, স্যার।”
ঋভু চলে এল রান্নাঘরের দরজার মুখে, ঝুঁকে পড়ে দেখিয়ে দিল চা, ইলেকট্রিক কেটলি ও কাপ-প্লেটের অবস্থান। তারা দুজনেই বিনা দুধচিনি চা খায় রোজ। সেকথা জানিয়ে ঋভুগায়ত্রীকে গিয়ে বললেন, “ব্রাশ করে নাও। তনিমা চা করছে।”

একটু পরে গায়ত্রী পা টেনেটেনে বেরিয়ে এসে মুখ-হাত ধুয়ে এসে বসল সোফায়। তার একটু পরে তনিমা একটা ট্রে-তে করে তিন কাপ চা এনে সেন্টার টেবিলে রেখে নিজেও বসে পড়ল একটা সোফায়। তার কাপ তুলে নিয়ে বলল, “দেখুন তো আন্টি, চায়ের ফ্লেভার ঠিক আছে কি না!”

গায়ত্রী কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছিল তনিমার দিকে। চায়ে চুমুক দিয়ে ঘাড় নাড়ল, ঠিক আছে।

তনিমা ঋভুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আপনার ছবিগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। আমি কোনও একটা জায়গায় গুছিয়ে রাখব?”

ঋভু অনেকটাই অবাক। এর মধ্যে তনিমা কখন দেখে নিয়েছে তার ছবিগুলি পড়ে আছে এলোমেলো হয়ে। ঋভু কতদিন ধরে ভাবছে ছবিগুলো গোছাতে হবে, আঁকার সময়কাল হিসেব করে পর পর সাজিয়ে রাখবে, তারপর একটা ক্যাটালগ করে রাখলে আরও ভালো হয়। কিন্তু তাঁর সময় হচ্ছে না, করতে ইচ্ছেও করে না। তনিমার মতো একজন কেউ করে দিলে কি ভালোই না হয়। বললেন, “ঠিক আছে, সে হবে’খন পরে।”

গায়ত্রী হঠাৎ ঋভুকে বলল, “ঘরে সবজি-মাছ কিছুই নেই। কাল বিমলা বলছিল।”

বিমলা ওদের রান্নার মাসি। ঋভু ব্যস্ত হয়ে বললেন, “তা হলে আমি আগে বাজারে যাই।”

গায়ত্রী আবার বলল, “একটা রুটি কিনে এনো। ডিম আর মাখন। সকালে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো।”

তনিমা বলল, “আমি আলুর পরোটা বানাতে পারি? করব?”

গায়ত্রী-ঋভু দুজনের কাছেই বেশ চমক, বললেন, “তা হলে তো ভালোই হয়। রোজ ব্রেড আর বাটার খেতে খেতে একঘেয়ে হয়ে গেল।”

গায়ত্রী গ্রিন সিগনাল দিতে তনিমা অমনি একলাফে রান্নাঘরে। চেঁচিয়ে বলল, “স্যার, আলু আর ময়দা কোনওটা খুঁজে পাচ্ছি না!”

ঋভু আবার রান্নাঘরে গিয়ে সব দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি করতে থাকো। আমি আধঘন্টার মধ্যে বাজার করে নিয়ে আসছি।”

তনিমা বলল, “আমি সঙ্গে গেলে অসুবিধা আছে? আপনি শিল্পী মানুষ। রোজ বাজার করতে গিয়ে কত সময়ের অপচয়। আমাকে আজ বাজারটা দেখিয়ে দিন। ব্রেকফাস্ট করে দিয়ে আমি রোজ এই সময়ে বাজার করে আনব। সেই সময়টা আপনি ছবি আঁকবেন।”

ঋভু ক্রমশ চমৎকৃত হচ্ছিলেন তনিমার কাজের তৎপরতায় ও বুদ্ধিমত্তায়। সত্যিই তো, রোজ না হলেও সপ্তাহে তিনদিন বাজারে যেতে হয়, সকালের এই সময়টা তাঁর কাছে প্রাইম টাইম, বাজারে যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় এক-দেড়ঘণ্টা সময় নষ্ট। এ সময়ে আঁকাতে পারলে বেশ হয়।

মিনিট পনেরোর মধ্যে আলুর পরোটার পাশে টমেটোর সস দিয়ে তিনজনের জন্য সাজিয়ে নিল প্লেটে প্লেটে। গায়ত্রীর মুখ দেখে ঋভু অনুভব করছিল এতক্ষণে তার মুখে খুশির ঝিলিক। রোজ একই প্রাতরাশ। আজ বেশ অন্যরকম।বাজারে যাওয়ার সময় তনিমাও চলল ব্যাগ হাতে। যেতে যেতে বলল, “বাজারটা আমার হাতে ছেড়ে দিন। প্রথম-প্রথম হয়তো একটু ঠকব, কিন্তু ক’দিনে সড়োগড়ো হয়ে যাব।”

অনেকটাই বাজার করে ফেলল দু’জনে। তনিমা বলল, “বাড়িতে থাকলে বাজার তো আমিই করি। বাজার করতে আমার বেশ ভালোই লাগে। তবে ওই – বারগেনিং করতে তেমন পারি না।”

ঋভু ক্রমশ বিস্মিত হচ্ছিলেন তনিমার সারল্য ও কর্মক্ষমতার পরিচয়ে। বললেন, “দেখলে তো দরাদরি আমিও তেমন করতে পারি না। ভালো জিনিস কেনা নিয়ে কথা।”

ঋভু ফ্ল্যাটে ফিরে দেখল রান্নার মাসি-কাজের মাসি দুজনেই যার যার কাজ শুরু করে দিয়েছে পুরোদমে। ঘরে হঠাৎ নতুন অতিথি দেখে তারা খুব কৌতূহলী। কি জানি কী বলেছে গায়ত্রী! ঋভু আপাতত সেবিষয়ে নাক নাগলিয়ে বসলেন নিজের কাজে। তনিমা অবশ্য বসে নেই, ঋভুদের খাটের তলা থেকে টেনেটেনে বার করল অজস্র ছবির বাণ্ডিল। সেগুলো পাতিয়ে নিয়ে বসল লিভিং রুমের মেঝেয়। প্রতিটি ছবির উল্টোপিঠে লেখা আছে কবে আঁকা, কোথায় বসে আঁকা। সেগুলি খুলে-খুলে সন-তারিখ ঘেঁটে রাখতে শুরু করল পাশে পাশে।প্রায় ঘণ্টাদুয়েক টানা খেটে কিছুটা বাগে আনল ছবিগুলোকে। তখনও অনেক কাজ বাকি। ঋভু বললেন, “আজ এই পর্যন্ত থাক। নইলে টায়ার্ড হয়ে যাবে।”

তনিমা থামল, বলল, “ছবি সাজাতে আমার কোনও কষ্ট হয় না। ছবি নিয়েই তো আমার দিনরাত।”

ঋভু বোঝার চেষ্টা করছিলেন সদ্য-পরিচিত মেয়েটিকে। কিছুই জানেন না তার সম্পর্কে। হঠাৎ বলল ‘আমাকে নিয়ে যাবেন’ বলে চলে এল তাঁর সঙ্গে। এখন বলল ছবি নিয়েই তার দিনরাত। জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি নিয়মিত ছবি আঁকো?”

“নিয়মিত কোথায়? কখন কোথায় থাকি তার কোনও ঠিক নেই। যখন থিতু থাকি, মুড আসে, অমনি তুলিতে রং ঢালি।”

বলতে বলতে ছবিগুলো ভালো করে মুড়ে আবার রেখে দিল যেখানে ছিল। বলল, “কাল আবার বাকিটা করব।”

ঋভু বুঝে উঠতে পারছিলেন না মেয়েটা কতদিন থাকবে, কী তার অভিপ্রায়। তাঁর ছবির খুব ভক্ত তা বলেছিল কাল। গায়ত্রী এর মধ্যে একবার আলোচনা করেছে একেবারেই অচেনা মেয়েকে বাড়িতে থাকতে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত।তবে এখনও পর্যন্ত যা অভিজ্ঞতা তাতে উতলা হওয়ার কোনও কারণ নেই। ঋভুতার হাতে রং তুলি আর ক্যানভাস ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এখানে তুমি নিয়মিত ছবি আঁকবে।”

তনিমা কী যে খুশি হল, বলল, “ভুল হলে আপনি আমাকে দেখিয়ে দেবেন।”

সারা দুপুর রং আর তুলি নিয়ে কাটাল তনিমা।

সেদিন বিকেলে তাঁর বন্ধুর একটি প্রদর্শনী দেখতে যাওয়ার কথা, গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার এসে খবর দিতে প্রস্তুত হলেন। গায়ত্রীকে বলতে গেলেন ফিরতে রাত হবে। তনিমা কোথাও ছিল, তাঁর কথা শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে বলল, “আমাকে নিয়ে যাবেন? আমি তো বিকেল হলেই কোনও না কোনও প্রদর্শনী দেখতে বেরিয়ে পড়ি।”

ঋভু সামান্য অপ্রস্তুত, কিন্তু না বলে পারলেন না, “চলো তা হলে।”

গায়ত্রীকে বলতেই সেও বলল, “নিয়ে যাও, নইলে সারা সন্ধে একা-একা করবে কী!”

অনুমতি পেতে তনিমা পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে অমনি তাঁর গাড়ির সামনের সিটে আসীন।প্রদর্শনীতে গিয়ে তনিমা শুরু করল ছবি দেখতে। ঋভুর ধারেকাছে থাকল না। শিল্পীর টেবিল থেকে একটা ব্রোশিওর তুলে নিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখছে, ব্যাগ থেকে একটা নোটবই বার করে কী যেন লিখেই চলেছে ছবিগুলো দেখে।ঠিক এরকমই করেছিল তাঁর ছবির প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে।ঋভু আশ্চর্য হচ্ছিলেন তার অধ্যবসায় দেখে। কী তন্ময় হয়ে ছবি দেখছে, আর নোট করছে একমনে। তবে কাজের ফাঁকে সে যে ঋভুর দিকে নজর রাখছিল তা বোঝা গেল। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর ছবি দেখা শেষ করে ঘরে ফিরবেন ভাবছেন, কোথায় ছিল তনিমা, এসে হাজির। বলল, “আমার হয়ে গেছে।”

ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন লাগল শুভেন্দুর একজিবিশন?”

তনিমার ঠোঁটের ডগায় উত্তর মুখিয়ে ছিল, বলল, “ভালো। তবে আপানার ধারেকাছে নয়।”

বাহ্‌, বেশ মন রেখে কথা বলতে পারে তনিমা।

“আপনার ছবিতে দেশজ প্রতীকের বিমূর্ত বা আধা-বিমূর্ত রূপ। এক আশ্চর্য রহস্যময় ভাবের সৃষ্টি। কিন্তু শুভেন্দুবাবুর ছবিতে গ্রামীণ সম্প্রদায়ের জীবনধারা।”

ঋভু খুবই আশ্চর্য হলেন মাত্র এক দু’লাইনের মধ্যে দুটি প্রদর্শনীর ছবির প্রেক্ষাপট বলে দিল কি সাবলীল ভাষায়! তার মানে মেয়েটা খুব ভালো ছবি বোঝে।

তনিমা হঠাৎ বলল, “আপনি তন্ত্র আর্ট এঁকেছেন বলেই আমি আপনার ফ্যান হয়ে গেলাম। তন্ত্র আমার প্রিয় বিষয়। আপনার তন্ত্র সিরিজ নিয়ে আমার শুধু একটাই বক্তব্য।”

“কী বক্তব্য?”

“তন্ত্র বিষয়ক ছবিতে রং আর একটু চড়া হলে ভালো হত।”

ঋভু বেশ অবাক হলেন। তাঁর ছবি নিয়ে বোদ্ধা-দর্শকরা সবাই এত প্রশংসা করেছেন, আর এই মেয়েটা কিনা বলছে – পরক্ষণে ভাবলেন আঁকার সময় তাঁরও তো মনে হয়েছিল আরও একটু ব্রাইট রং হলে খুলত ছবিগুলো! কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তন্ত্র নিয়ে পড়াশুনো করেছ বুঝি?”

“প্রচুর। থিয়োরেটিক্যাল প্রাকটিক্যাল দুইই।”

“প্র্যাকটিকাল!” রীতিমতো স্তম্ভিত হলেন ঋভু। মাত্র একদিনের পরিচয়ে মেয়েটাকে ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছেন। তন্ত্রের প্রাকটিক্যাল দিকটা তিনি নিজেও বোঝেন না, অথচ তনিমা বোঝে।

“স্যার, জীবনটাকে নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি পঞ্চম-কারের কী এফেক্ট। একটাই তো জীবন। দেখিই না পরীক্ষানিরীক্ষা করে।”

ঋভুর দু’চোখ বিস্ফারিত। তন্ত্র বিষয়ে তিনি বেশ কিছু বই পড়েছেন। তন্ত্রে নারীশরীর এক বিচিত্র আধার। নারীশরীরে বাহান্ন বর্ণমালার অবস্থান। খুব জটিল বিষয়। তনিমা তার কতটা কী জেনেছে তা বুঝে উঠতে পারলেন না। বেশ জটিল মেয়ে – এই শব্দগুলো মাথায় এল তাঁর। অথচ তার মুখে অজস্র সারল্য।তাঁর ছবিতে রং বোধহয় একটু কমই থাকে, তার একটা কারণ হয়তো এই যে, তাঁর জীবনেও তো রঙের বেশ অভাব।

“স্যার, আপনার তন্ত্র সিরিজে বিষয়টা এমন সাবলীলভাবে এনেছেন যা আমাকে শিহরিত করেছে।”

তার বলা শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি ফ্ল্যাটের সামনে। লিফটের মুখে দোতলার বর্ণনা ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা। চড়া মেক-আপে পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলাকে দারুণ সুন্দরী লাগছে। নিশ্চয়ই কোনও পার্টি থেকে ফিরছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আড়চোখে দেখলেন তনিমাকে।

তনিমা শুধু ছবিই ভালো বোঝে তা নয়, দু-তিন দিনের মধ্যে ঋভুর সমস্ত ছবি ঝেড়েমুছে সাজিয়ে রাখার কাজ শুরু করে দিল। শুধু তাই নয়, গায়ত্রী অসুস্থ থাকায় বাড়ির আসবাবপত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিস ঝেড়েমুছে ঝকঝকে করে ফেলল দ্রুত ও দক্ষ হাতে।

গায়ত্রীও অবাক মেয়েটির কর্মদক্ষতায়। যেন এরকম একটি মেয়ের খুব দরকার ছিল তাদের সংসারে। স্বস্তিও বোধ করছেন, আবার ভাবছেন সম্পূর্ণ অচেনা একটি মেয়েকে এভাবে রেখে দেওয়াও তো মুশকিল।

কয়েকদিনের মধ্যে তনিমাই হয়ে উঠল তাদের ফ্ল্যাটের কেন্দ্রবিন্দু। সকালের চা থেকে শুরু করে নিত্যনতুন ব্রেকফাস্ট, বাজার-দোকান করা, তাঁর যে কোনও জরুরি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে দেওয়া। গায়ত্রীকে যা একটু-আধটু কাজ করতে হত তাও এখন আর করতে দেয় না তনিমা। এমনকি তার সারাদিনের ওষুধ খাওয়ানোর দায়িত্বও তনিমার।এখন ফ্ল্যাটের মধ্যে বাস করার আনন্দই আলাদা।

একদিন একটু বেশি রাতে তনিমাকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরেছেন, লিফটে উঠছেন, লিফটে তাঁদের বিপরীত ফ্ল্যাটের আনন্দ পাকড়াশিও উঠেছেন, বেশ আড়চোখে দেখছেন তনিমাকে, কিছু বলছেন না, কিন্তু তাকানোর ধরনটা বেশ খারাপ।লিফট থেকে নামার সময় হঠাৎ মুচকি হেসে বললেন, “আপনি বেশ রসেবশে আছেন।”বলে আর দাঁড়ালেন না, গট গট করে ঢুকে গেলেন তাঁর ফ্ল্যাটে।

ঋভু স্তম্ভিত, এক ঝলক তাকালেন তনিমার মুখের দিকে। তার মুখ বিবর্ণ, গম্ভীর।ফ্ল্যাটে ঢুকে অনেকক্ষণ বাক্যহীন রইলেন ঋভু। তনিমা তার ঘরে চলে যেতে গায়ত্রীকে বললেন আনন্দ পাকড়াশির কথাগুলো। গায়ত্রী চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বললো, “তোমাকে তো বলিনি, গত দু’তিনদিন ধরে পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস পাকড়াশি, নীচের ফ্ল্যাটের মিসেস পাল আর মিসেস বটব্যাল – এরা দল বেঁধে আসছিলেন আমাদের ফ্ল্যাটে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মেয়েটা কে, আমাদের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, কতদিন থাকবে, তার বাবা-মা কোথায় থাকে – এইসব।”

ঋভুর বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। তাঁর অনুপস্থিতিতে এত সব কাণ্ড ঘটে গেছে আর গায়ত্রী তাঁকে কিছুই বলেনি! বিড়বিড় করে বললেন, “ওদের অত খেয়েদেয়ে কোনও কাজ নেই। শুধু পরনিন্দা আর পরচর্চা।”

“আরও কতকিছু বলছিল!”

“কী বলছিল?”

“আমাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছিল। বলছিল, তুমি তো বিছানায় শুয়ে থাকো। সেই সুযোগ নিয়ে তোমার বর আর একটা মেয়েকে জুটিয়ে এনে…”বাকিটা বলল না গায়ত্রী, যা বোঝার বুঝে গেলেন ঋভু।

ডাইনিং টেবিলে থালাবাসনের নাড়াচাড়া দেখে ঋভু ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন তনিমা রাতের খাওয়ার আয়োজন করছে। একটু পরেই ডাকল, “স্যার, ভাত বেড়েছি। আপনি আন্টিকে নিয়ে আসুন।”

রাত অনেকটাই হয়ে গেছে, ঋভু খেয়াল করলেন ঘুমে টসটস করছে তনিমার চোখ, কিন্তু তার মুখ গম্ভীর। খাওয়ার মুহূর্তগুলো মনে হচ্ছিল এক অনন্ত সময়। তনিমা ভাত মুখে দিচ্ছে, কিন্তু অন্যদিনকার মতো কলকল করে কথা বলছে না, মুখের ভিতর ভাত আটকে যাচ্ছে যেন। নিশ্চয়ই গায়ত্রীর কথাগুলো কানে গেছে তার।ঘরের আলো কি আজ একটু ফ্যাকাসে! তনিমার মুখখানা কি রোজকার তুলনায় নিষ্প্রভ! এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাইলেন না ঋভু। কাল সকালে একটু নিভৃতি খুঁজে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবেন। বলবেন জীবনের সব ক্ষেত্রেই কিছু ইঁদুর-আরশোলা-ছুঁচো থাকে যারা সুস্থ, সুন্দর জীবন বিশৃঙ্খল করে দিতেই আহ্লাদ বোধ করে।রাতে বিছানায় শুয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন গায়ত্রীর সঙ্গে। গায়ত্রী বলল, “আমার তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বরং ও আসার পর আমার অনেকটাই রিলিফ। কী সুন্দর গুছিয়ে সংসারের কাজগুলো করছে!”

স্বস্তির শ্বাস ফেলে ঋভু বললেন, “আমার ছবির ঘরটা একেবারেই এলোমেলো হয়ে ছিল। তনিমা এমন ঝকঝকে করে রেখেছে যে, এখন ছবি আঁকতে আরও জোশ পাচ্ছি। আসলে কি জানো, আমরা নানা সমস্যার মধ্যে আছি তা কিছু মানুষ বেশ উপভোগ করে। তারা চায় আমাদের সমস্যা স্থায়ী হয়ে থাকুক। কেউ এসে আমাদের জীবনটা ভালো করে দিচ্ছে তা সহ্য হয় না তাদের।”

পরদিন ঘুম ভাঙল একটু দেরি করেই। তনিমা অন্যদিন দরজায় নক করে ঘুম ভাঙায়। ঋভু দরজা খুলতেই দেখেন দু’কাপ চা হাতে সহাস্য তনিমা। আজ বেলা আটটা বাজে, অথচ এখনও তনিমা ডাকেনি। তা হলে কি সেও এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে।ঋভু বাইরে বেরিয়ে দেখলেন তনিমার ঘর খোলা। তার মানে সে আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। তবে কি কিচেনে গিয়ে চা করছে!কিন্তু না, কিচেনেও নেই।

ঋভু বিস্মিত হয়ে ঘুরতে লাগলেন ঘরে। হঠাৎ চোখে পড়ল ডাইনিং টেবিলে পড়ে থাকা একটা চিরকুটের দিকে। চামচ দিয়ে চাপা। দ্রুত তুলে নিয়ে চোখ রাখলেন গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘স্যার, আমার কপালটা চিরকালের মন্দ। ছোটো থেকেই আমি একটু ব্যাকরণের বাইরে বাস করা মেয়ে। আমার পরের বোন যখন বই নিয়ে নিবিষ্ট, আমি ছবি আঁকতাম নিজের মনে। বাবা পছন্দ করতেন না ছবি আঁকা। হাত থেকে রং তুলি কেড়ে নিতেন প্রতিবার। এভাবেই চলে আসছে এত বছর। কিন্তু আমি কী করব। পৃথিবীতে সবাই লেখাপড়া করার জন্য জন্মায় না। কেউ ছবি আঁকবে, কেউ গান করবে, কেউ সাহিত্য রচনা করবে, কেউ পাহাড়ে উঠবে – এই তো নিয়ম। এ কারণেই নিজের বাড়িতে আমি সুস্থির থাকতে পারি না। আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল আপনার কাছে থাকলে আমার নিজের জগৎটা ফিরে পাব। জীবনের সব রং যখন শেষ হয়ে গিয়েছিল, আপনি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন রং আর তুলি। আস্তে আস্তে রঙিন হয়ে উঠছিল আমার পৃথিবী। কিন্তু ভাগ্য যার সহায় নেই, তার জীবনে রং কী করে থাকবে! অদৃশ্য থেকে কেউ এসে আবার রং তুলি কেড়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিল। আমি চাই না আমার মতো একটি সহায়সম্বলহীন মেয়ের জন্য আপনার সুন্দর জীবনে কালি লাগুক। যেমন হঠাৎ করে এসেছিলাম, সেভাবেই চলে গেলাম আমার পুরনো ঠিকানায়।

ক’টা দিন আপনারা আমাকে যে সম্মান দিয়েছিলেন তা আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। হয়তো আবার কোনও দিন এভাবেই দেখা হয়ে যাবে কোনও প্রদর্শনীতে। আন্টিকে আমার খুব ভালো লেগেছে। ইতি – তনিমা।’

চিরকুটটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে রইলেন ঋভু। গায়ত্রীও পায়ে-পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর পাশে। চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়ল। তাকাল ঋভুর দিকে। বলল, “তুমি ওর ঠিকানা রাখোনি?”

ঋভু ঘাড় নাড়লেন, “না। বলেছিল, পরে দেব।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল গায়ত্রী।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *