অনিন্দিতা গোস্বামী
দৌড়চ্ছে, দৌড়চ্ছে, দৌড়চ্ছে, একটা বাঘ দৌড়চ্ছে। মাংসপেশির হিল্লোলে টের পাওয়া যাচ্ছে তার গতি। মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে, দূরে, ওই ওই শীর্ণকায় একটা কুকুর দৌড়চ্ছে। না না একটা শেয়াল, ধূর্ত শেয়াল দৌড়চ্ছে, ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ পিছনে দৌড়চ্ছে, ধাওয়া করা বুটের আওয়াজ। কমে আসছে, দূরত্ব কমে আসছে, একটা মানুষ দৌড়চ্ছে, একটা মানুষ! একটা তাড়া খাওয়া মানুষ। যে হোঁচট খাচ্ছে, যার গলা শুকিয়ে আসছে, যে এইবার পড়ে যাবে।
পাপ কাকে বলে?
কামমাশ্রিত্য দুষ্পূরং দম্ভমান মদন্বিতাঃ।
মোহাদ্ গৃহীত্বাসদ্গ্রাহান্ প্রবর্তন্তেহশুচিব্রতাঃ।।
দম্ভ, অভিমান ও মদযুক্ত মানুষেরা দুষ্পূরণীয় কামনার আশ্রয় গ্রহণ করে এবং অজ্ঞানবশত মিথ্যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও ভ্রষ্টাচারে প্রবৃত্ত হয়ে সংসারে বিচরণ করে।
সূর্য উঠছে। কিচ কুইচ করে দু’-একটা পাখি ডাকছে ইতিউতি, কিন্তু কলকাকলি এখনও শুরু হয়নি। মহাজ্যোর্তিময়ের আগমনের প্রস্তুতিতে আকাশে ছড়িয়েছে এক আশ্চর্য আলোর বিভা। আঁধার ফিকে হয়ে এসেছে। এখানে জঙ্গল তেমন ঘন নয়। মাথা নিচু করে ঝুপড়ির বাইরে এলেন লাকা। সমুদ্রপ্রভু এখন জল পান করছেন ঢক ঢক করে। কারেজেয়র টান। পাড়ের কাছে ঢেউ ভাঙার শব্দ নেই। জঙ্গলও নিস্তব্ধ। এই সময় ছেলের দল যাবে মৎস্য শিকারে। সে আকাচাপান, তার আর একটু আগে ওঠা উচিত ছিল বইকি। তিনি আশেপাশের ঝুপড়িগুলোতে ঝুঁকি দিয়ে দেখলেন, না এখনও সবাই ঘুমোচ্ছে। বিশেষ করে নাও যখন ঘুমোচ্ছে তখন অন্য কেউ এখনও শিকারে বেরয়নি। এরজুমের অনুমতি না নিয়ে কেউ যাবে না। খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে বড় করে শ্বাস ছাড়লেন আকাচাপান।
এই সময় তিনি বেশ কয়েকবার এরকম করেন। বড় করে শ্বাস নেন, তারপর বড় করে শ্বাস ছাড়েন। এতে দম বাড়ে। নেতা হওয়া বড় কঠিন। কাঁধ শক্ত না রাখলে লোকে মানবে কেন তাকে! তবে আজকাল কিছু খিমিলের সাহস খুব বেড়েছে। রক্তের জোর বড় জোর, বয়সের জোর বড় জোর। চর্বি ভক্ষণ বন্ধ করেও কিছু করা যাচ্ছে না। দেখ না দেখ ডুঙি নিয়ে চলে যাচ্ছে সাগরে! লাওয়ের ভয় নেই ওদের, ভাবতে অবাক লাগে আকাচাপানের। আসলে শিকার তো একটা ছুতো, সাগর ডাকে ওদের, স্বপ্ন ডাকে ওদের। ওই বয়স তো তারও ছিল একদিন। আঃ স্বপ্ন! মোরামিখু! বলে বুকে হাত দিলেন লাকা। আর ঠিক সেই সময় গুম্ গুম্-ম্, আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে গড়িয়ে গেল বন্দুকের আওয়াজ, ঝুপড়ির ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠল সবাই। হৈ ই ই ই ই। সকলে হাতে হাতে তুলে নিল লেইক আর কো, তীর আর ধনুক। তারপর লাকার নির্দেশে নাওয়ের পিছে পিছে সবাই ছুটতে আরম্ভ করল সমুদ্রপারের দিকে আর প্রার্থনায় বসলেন আকাচাপান। সূর্যদেব তখন রক্তিম আভা ছড়িয়েছেন আকাশের গায়ে।
ঠিক তাকেই বর্শাটা মেরেছিল লুক। কিন্তু নিউরে মাছের গাগুলো এমন মসৃণ আর তেলতেলে যে একটুর জন্য ত্বরিতে পিছলে গেল মাছটা। রোখ চেপে গেল লুকের। নিশানা ব্যর্থ হওয়া তার কাছে ইজ্জৎ যাবার সামিল। তাছাড়া তাড়া করার মধ্যেও একটা মজা আছে। যা সহজে ধরা দেয় তাকে ধরায় কেরামতি কী!
কত পরিশ্রম করে গাছের চটা পাথরে ঘষে ঘষে লম্বা বাঁশের মাথায় বিঁধিয়ে এমন রিও তৈরি করেছে সে, এই বর্শাফলক দেখেই না সুরমাইয়ের মুখে হাসি ফুটেছিল, তা মাছই যদি না গাঁথতে পারল তবে তার সম্মান থাকল কোথায়! তবে হ্যাঁ লোহার ফলা থাকলে নিউরের মতো মাছও আর পালাতে পারে না।
তাকে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর পাবে না। দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা। না লুক এ গান জানে না, তবে সে ও ওলে লে লে করে একটা মিঠে সুর গুন গুন করছিল, জলের ওপর দিয়ে মৃদৃ তরঙ্গে বাতাস বয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু দৃষ্টি ছিল তার স্বচ্ছ নীল জলের নীচে, হিল্লোলিত মাছের শরীরে। ও যখন ওর আঁকাবাঁকা গতি থামিয়ে ক্ষণিক বিশ্রাম নেবে তখুনি লুক ওর গায়ে বিঁধিয়ে দেবে তাঁর ফলা। কিন্তু মনটা টুক টুক করছে, লোহার ফলার মতো কাঠের ফলায় ধার আর হয় কই!
ছপাৎ ছপাৎ শব্দ কানে যেতেই লুক পিছনে ঘুরে তাকাল। লাও! ক্ষণিকের জন্য পাংশু হয়ে গেল ওর মুখ। কতই বা ওর বয়স হবে, চোদ্দ কি পনেরো, সদ্য গোঁফের রেখা উঠেছে নাকের নীচে। সে দ্রুত লগি ঠেলে ডুঙ্গিটাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল খাঁড়ির কাছে, কিন্তু তাকিয়ে দেখল সে শিকারের আনন্দে পাড় ছেড়ে চলে এসেছে অনেক গভীরে। চারিদিকে শুধু নীল জল, আর খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে ওই লাও বোট। উহ্ মাগো, গায়ে একটু রক্ত নেই, সাদা সাদা হাত পা, নীল নীল চোখ, ভয়ে প্রাণটা পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে গেল লুকের।
বোট একটু কাছে আসতে লুক দেখল বোটে দু রকমেরই লাও আছে, সাদা ভূত, বাদামি ভূত। বাদামি লাওগুলোকে একটু কম ভয় লাগে লুকের। ওদের দেখে ধড়ে যেন একটু প্রাণ এল তার। একটা বল পেল যেন মনে, ভাবল, যাই না কেন ডুঙ্গিটা নিয়ে একটু ওদের কাছে, একটু যদি লোহার টুকরো পাওয়া যায়! আহা, বর্শাটা যা বানাব না। দেখে তাক লেগে যাবে সুরমাইয়ের। ও ভাবতেই পারবে না আমি লাওদের বোট থেকে লোহা নিয়ে এসেছি। ভাবতে ভাবতে সে তার ডুঙ্গিটা নিয়ে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল লাও বোটের দিকে।
নৌকোর মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টেম্পলার সাহেব, তিনি লুককে তাদের নৌকোর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, হেই স্টপ্ স্টপ্। লুক এক বর্ণ বুঝতে পারল না তার কথা, সে তার বর্শাটা তুলে দেখাতে চাইল, সে কেবল একটা লোহার টুকরো চাইছে যাতে সে তার বর্শার ফলক তৈরি করতে পারে। বর্শা তুলতেই টেম্পলার সাহেব একজন সৈনিককে তার সামনে বর্ম হিসাবে টেনে নিয়ে আকাশে গুলি ছুড়লেন। লুক তড়িঘড়ি নিজেকে বাঁচাতে তুলে নিল তার আত্মরক্ষার একমাত্র হাতিয়ার তীর আর ধনুক। কিন্তু তীর ছুড়বে কী, লুকের তো তখন পা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে, লুককে তীর ধনুক তুলতে দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে টেম্পলার সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, হাউ ডেয়ার ইউ, বিইং সাচ্ আ পেটি লিটিল বয়, ইউ হাভ কাম টু কনফ্রন্ট উইথ মি! বলে তিনি দ্বিতীয় গুলিটি চালিয়ে দিলেন লুকের বুক ভেদ করে। তার ছোট্ট ডুঙ্গির ওপর কাত হয়ে লুটিয়ে পড়ল লুক।
আঁ! নৌকোর অন্য আরোহীরা চেঁচিয়ে উঠল, সাহেব! তীরের দিকে দেখুন। সাহেব লক্ষ করলেন ততক্ষণে এক ঝাঁক কালো-কুলো বুনো মানুষ ধনুকে তীর প্রতিস্থাপন করে তার বোটের দিকে তাক করে দাঁড়িয়েছে। এত সাহস! দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রাইফেল থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে আরম্ভ করলেন টেম্পলার সাহেব সমুদ্রের পাড়ে জমা হওয়া মানুষগুলোর দিকে। নৌকোর অন্য সৈনিকদের অর্ডার দিলেন ফায়ার! ফায়ার!
বন্দুকধারী সাদা ভূতের ভয়ে লোকগুলো সিঁধিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে। একটা বুনোকেও মারতে না পেরে রক্ত চড়ে গেল টেম্পলার সাহেবের মাথায়। বললেন, নৌকো পাড়ে ভেড়াও। ভয়ে কাঁপতে লাগল নৌকোর অন্যান্য আরোহীরা। বলল, সাহেব, ওরা জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে, যেখান সেখান থেকে তীর ছুড়তে পারে। কোনো কথা শুনলেন না সাহেব, বললেন ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করতে করতে চলো। ওরা কাছে ঘেঁষার সুযোগই পাবে না। আজ ওদের ডেরা খুঁজে বার করবই। ওই তো কটা মোটে লোক। দোজ় ব্লাডি বিস্টস! এভরিটাইম দে হ্যাভ বিন ডিস্টারবিং আস। টুডে আই উইল ফিনিশ দেম অফ। আজ ওদের শেষ করেই ছাড়ব।
পাড় ধরে উঠতে লাগলেন টেম্পলার সাহেব। পিছনে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা, বেশি দূর যেতে হল না। সামান্য এগিয়েই তিনি পেয়ে গেলেন সালাই পাতায় ছাওয়া ছোট্ট ছোট্ট গোল ঝুপড়ি। হো! তাছিল্য ভরে হাসলেন টেম্পলার সাহেব বললেন, ম্যাটার অফ মিনিটস, বলে তিনি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বার করলেন তাঁর বাঁকানো কাঠের চুরুট, তামাক ভরে অগ্নি সংযোগ করলেন তাতে, তারপর জ্বলন্ত কাঠিটি নিক্ষেপ করলেন পাতার কুটিরে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল শুকনো পাতার ছাউনি। আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে চলল এক কুটির থেকে আর এক কুটিরে। হা হা করে হেসে উঠলেন টেম্পলার সাহেব। চিৎকার করে বললেন, গভীর জঙ্গল থেকে এক পা বেরনোর চেষ্টা করলে তোমাদেরও এরপর পুড়িয়ে মারব। সমুদ্রের ত্রিসীমানায় যেন তোমাদের না দেখি। এই সমুদ্রে কোনো রকম বেয়াদপি চলবে না, এই সমুদ্রের রাজা হামি টেম্পলার সাহেব, কিং, মনে থাকে যেন।
সমস্ত গাছের মাথায় মাথায় বসে ছিল ওরা। পাতার আড়ালে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ওরা দম বন্ধ করে ঝুলে ছিল ডালে। ফিরে যাচ্ছিল টেম্পলার সাহেবের দল। সাহেব জানে না বন্যেরা বনে সুন্দর। ওদের ঘরে আছেই বা কী! প্রকৃতি ওদের কোল পেতে দিয়েছে। গাছের ডাল আর ঘরের ছাউনির মধ্যে ওদের তফাত কতটুকু! দু’হাজার বছরের পুরনো এই জনজাতির কাছে সাহেবের অস্ত্রশিক্ষার আস্ফালন কত হাস্যকর। তাদের অত অহঙ্কারের সাদা চামড়া এদের কাছে বর্ণহীনতার প্রতীক মাত্র, তাদের দম্ভ, শিক্ষা, সভ্যতা ওদের কাছে এক অশুভ শক্তির নামান্তর। সাহেবেরা ওদের কাছে সাদা ভূত। লাও। মনুষ্য পদবাচ্যই নয়।
সরু আঁকা বাঁকা পথ ধরে ঝোপজঙ্গল লতা পাতা সরিয়ে জলের দিকে নেমে আসছিল সুরমাই। গোষ্ঠীর সকল নারীপুরুষ যখন জঙ্গলের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থেকে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত, আকাশ ঘন ঘন কেঁপে উঠছে যখন সাহেব ভূতের গুরুম গুরুম শব্দে, হইহট্টগোল, ঠিক সেই সময় বনের পথ ধরে জলের কিনারে হাঁটা দিয়েছে সুরমাই। জলের পারে গিয়ে দুহাত মুখের কাছে চোঙ করে সে ডাক দিল, লুউ উউক্, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে, আর সাঁতরে সাঁতরে খুঁজে বেড়াতে লাগল লুকের ডুঙ্গিটাকে। সুরমাই জানে লাও সবার আগে লুককে খেয়েছে, কিন্তু চারে বেফাইলের সময় জল বাড়বে সাগরের, লুকের ডুঙ্গিখানা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
খানিক দূর এগোতেই সুরমাইয়ের চোখ গেল উত্তরে খাঁড়ির দিকে ঢেউয়ের ধাক্কায় লুকের ডুঙ্গি এসে কাত হয়ে আছে বালির মধ্যে, আর ডুঙ্গির ওপর থেকে লুকের মাথাটা কিছুটা ঝুলে আছে নীচে। ধীরে ধীরে সাঁতরিয়ে সেদিকে গেল সুরমাই, উঠে এল পাড়ে, ডুঙ্গির কাছাকাছি। দেখল লুকের কানের পাশ দিয়ে রক্ত চুইয়ে নামছে ডুঙ্গির গা বেয়ে। একটু ভয় লাগল সুরমাইয়ের, তার যেন মনে হল লুকের সব রক্ত ঝর্না নদীর মতো বয়ে চলে যাচ্ছে সাগরের নোনা জলের দিকে। সে একটা চোখ কচলাল, দেখল সব ঠিক আছে, সে ডুঙ্গির ওপর উঠে আস্তে করে ঠেলে চিত করে দিল লুককে তারপর চারপাশ দেখে নিয়ে লুকের কপালে ঠোঁটটা ঘষে দিল তার। ফের ডুঙ্গি থেকে নেমে ডুঙ্গিটাকে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে। আর লুকের পা দুটো আঁকড়ে ধরে বসে রইল সারাটা প্রহর।
যখন রোদের তাপ কমে এল, জলের ওপর রুপো গলানো রোদ ঝিকমিক করতে আরম্ভ করল, তখন সুরমাই নিশ্চিত হল যে এবার সাদা ভূতগুলো ফিরে গেছে তাদের ডেরায়, সে উঠে দাঁড়াল, তারপর চিল চিৎকার করে উঠল, মায়েহ!
ভস্মীভূত পাতার স্তূপের ধিকিধিকি আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছিল এঁকেবেঁকে। ঝাঁকড়া গাছের পাতার আড়াল থেকে একে একে নেমে আসছিল ওরা। উবু হয়ে বসে ছিল ঝুপড়ির চারপাশ ঘিরে। ঘর ওদের কাছে এমন কিছু স্থায়ী আগ্রহের বস্তু নয়। ঘর গেছে বলে ওদের দুঃখ নেই এমন কিছু, কিন্তু ওরা ভয় পেয়েছে খুব। মানেও লেগেছে। সত্যিই তো আর ওরা জন্তু নয়, ওদের দুঃখ আছে, শোক আছে, তাপ আছে, আছে অহংবোধ, সহমর্মিতা, রাগ, ঈর্ষা, জেদ, ভালোবাসা আর সারল্য।
লাকা বলল, জলের লাও এবার ডাঙ্গায় এল, আরও গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের এখন আর উপায় নাই। ছেলেছোকরার দল তোমরা এখনও যদি সাবধান না হও আমরা কেউই আর বাঁচব না।
নাও বলল, আকাচাপানের কথা মানি। কিন্তু আমরা কি শুধু সাবধানই হব? বদলা নেব না? আকাচাপানের বউ ওদের সবার মা, বলল, চুপ যা নাও। বদলা নিবি? লাওয়ের সঙ্গে বদলা নিবি? ওদের গায়ে রক্ত নেই! দেখেছিস? আমাদের তীর কি ওদের গায়ে বিঁধবে? ওদের মোমের গা, পিছলাই যাবে।
নাও বলল, হঁ, তুমি যে কী বল মিমি, আমরা অকাবেয়া তো, তাই আমরা ভিতুর ডিম, যখন গর্জন ফুল ফুটেছিল তখন জুয়োইরা একটা সাদা ভূত মেরেছিল, আমি জেনেছি। পিচার বলল, হ্যাঁ আমিও জেনেছি, আর এও জেনেছি, ওদের গায়েও রক্ত আছে, তীর যেখানে বিঁধিছিল যেখান থেকে লাল রক্তই বেরচ্ছিল।
লাকার বউ বোরো কপাল চাপড়ে বলল, হা আমার পূর্বপুরুষ, এরা যে আমার কোনো কথাই শুনতে চায় না, আজ যে কচি ছেলেটা চলে গেল তার দেহও তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, জোয়ারের জলে ভেসে সে দেহ হাঙ্গরের কিম্বা কুমিরের পেটে গেছে গিয়ে।
একথা বলতেই গোলের মধ্যে থেকে উঁউউ করে ককিয়ে উঠল একটা মেয়ে, লিফে, লুকের মা।
লাকা বলল, এখনও তো সূর্য ডোবেনি, একবার আমাদের সাগরের পাড়ে যাওয়া উচিত, যদি লুকের ডুঙ্গিটার দেখা পাওয়া যায়… বলতে বলতেই অসম্ভবের কল্পনায় কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন লাকা। লিচো, লাকার বড় মেয়ে, রাজকন্যার মতো তার হাবভাব, খানিক উদ্ধত, সুন্দরী বটে সে, কুচকুচে কালো রং, বেতলতার মতো শরীর, দলের ছেলেরা তার পায়ে মাথা ঘষতে পারলে ধন্য হয়ে যায়, সে অবশ্য অত পাত্তা টাত্তা কাউকে দেয় না। তার বিজাতীয় পুরুষ পছন্দ, সে সমুদ্রের পারে গিয়ে দূরে লাও বোটের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ঝাঁঝরিতে চুনো মাছ আটকালে সে তাকিয়ে দেখে রুপোলি ছটফটানি। সে আড়িমুড়ি ভেঙে বলল, আমি আর গভীর জঙ্গলে যাব না। আরও গভীর জঙ্গলে গেলে তো জারোয়ারা আমাদের ছিঁড়ে খাবে।
নাও সঙ্গে সঙ্গে বলল, হাঁ হাঁ আমারও তাই মত। আর গভীর জঙ্গলেই যাই আর যেখানেই যাই, শিকারের জন্য তো আমাদের সাগরে আসা লাগবেই। ফলমূল খেয়ে তো আর শুধু আমাদের দিন চলবে না। ‘রা’ আর কটা, সেই তো আবার শিকার নিয়েও লড়াই। তাছাড়া আমাদের দলটা তো তাহলে বসে যাব। আমরা তো টারো শিকারি, ‘কারাড়া’, ‘কে’ও। না না কিছুতেই আমরা গভীর জঙ্গলে যাব না।
আকাচাপান চুপ করে ছিলেন। অধিক আবেগ দিয়ে কোনো কাজ হয় না। সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার জন্য সময় দরকার। শত্রু অধিক শক্তিশালী হলে তার থেকে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়, অসম লড়তে গেলে অযথা রক্তপাতই হয়।
ঠিক এই সময়ে সুরমাইয়ের চিৎকারে চমকে উঠল সবাই। আঁ! কোথায় ছিল সুরমাই এতক্ষণ, আঁতকে উঠল বোরো। সুরমাই, তার আদরের ছোট্ট সুরমাই, লুকের সঙ্গে যে তার খুব ভাব ছিল এ কথা তো চোখ এড়ায়নি বোরোর। লুক টেনে নিচ্ছে না তো ওকে সাগরে! সমুদ্রপ্রভু যে ভক ভক করে জল উগরাচ্ছে এখন, চারেজেফিলে, মানে জোয়ার। সাগর এগোচ্ছে এখন পাড় মুখে। তীরধনুক কাঁধে তুলে নিয়ে চিৎকার লক্ষ্য করে ততক্ষণে পাড়ের দিকে ছুটেছে ছেলের দল। বোরোও অনুসরণ করেছে ওদের, কিন্তু তার পা ভারী হয়ে আসছে, পা যেন সরছে না।
সূর্য ডুবছে। ছাইরঙা সমুদ্রের ঢেউ এসে লাগছে মৃত প্রবালের গায়ে। জলের ওপরে ফিনফিনে শেষ রক্তিম রশ্মি। সুরমাইয়ের দেখা পেয়ে প্রথমে থমকে গেল সকলে। লুক! সবার প্রথমে দৌড়ে গেল লিফে। লুক, লুক রে, আমার টোটা। সবাই গোল করে ঘিরে বসল লিফেকে, আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল চুপ করে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে কাঁদতে আরম্ভ করল সকলে মিলে। ওগো আমাদের কী হল গো, ওগো আমাদের পূর্বপুরুষ লাওদের হাত থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করো। লুককে যারা মেরেছে তাদের যেন কুমিরে খায়।
বেশ কিছুক্ষণ কাঁদার পর যখন ক্লান্ত হয়ে গেল সকলে, তখন লুকের দেহটা ডুঙ্গির থেকে নামিয়ে নিয়ে ওরা চলল লুককে কাঁধে করে। গাছ থেকে ডাল ভেঙে নিল নাও। তারপর সকলে মিলে কুপিয়ে কুপিয়ে গর্ত খুঁড়ল ওই পোড়া ঝুপড়ির পিছনে, আর ওই গর্তের মধ্যে শুইয়ে দিল লুককে। হাত থেকে একটা কড়ির মালা খুলে সুরমাই রেখে দিল লুকের বুকের ওপরে। লিফে জিভ থেকে একটু থুতু নিয়ে মাখিয়ে দিল লুকের কপালে, তারপর চুমু দিল সুরমাইয়ের গালে। সবাই মিলে আদর করতে লাগল সুরমাইকে। ওর জন্যই আজ তারা লুকের দেহটাকে ফিরে পেয়েছে।
আকাচাপান বাঁশপাতা দিয়ে ঢেকে দিলেন লুকের দেহ। তারপর সকলে মিলে তা বুজিয়ে দিল মাটি দিয়ে। একটা ঝিনুকের খোল মন দিয়ে পাথরে ঘষে ঘষে ফুটো করছিল কোটা, লুকের বাবা, লতার দড়ি দিয়ে ঝিনুকটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে এতক্ষণে একটা গাছের গুঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে প্রথম কেঁদে উঠল সে, ওহ্হ্।
নিশাচর পাখির ডাক উড়ে গেল তোবড়ানো চাঁদের দিকে। অন্ধকার নামল।
নতুন করে ঘর বাঁধছে ওরা। কাঁচা বাঁশের কাঠামোর ওপর সালাই পাতার ছাউনি। একটু ভেতরের দিকে। একটু উঁচু জায়গায়। সামনেই রেয়েতাল হবে, টিপটিপ করে বর্ষা নামবে, আর কাখারের ফুল ফুটলে তো তাদের দুঃখের অন্ত থাকবে না। ঘোর বর্ষা। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হবে। সেই সময় জঙ্গলে শিকার পাওয়াই ভার। তবে এখানে বৃষ্টি হয় প্রায় রোজ। সূর্যের তাপ কমলেই আকাশ কালো করে আসে মেঘ, তারপর ঝম ঝম করে ভিজিয়ে দেয় গাছপালা মাটি বালি সব। ব্যাস ঝকঝকে।
কিন্তু বর্ষার বৃষ্টি সে বৃষ্টি নয়। রাতবিরেতে শোবার পর্যন্ত উপায় নেই, গায়েগতরে পেঁচিয়ে উঠবে সুবি, ফনা তুলে ছোবলও দেবে দু একবার। কানে মাথায় সুরসুর করবে পিঁপড়ে। তাই এই সময় ঘর বাঁধে ওরা একটু পাকাপোক্ত ভাবেই। সে কাজে ব্যস্ত কম বেশি সকলেই। তবে বয়স্ক মানুষ আর মেয়েরাই এ কাজ করে বেশি। এই সময় সাগর থাকে কিছু বেয়াড়া ধরনে, তাই ফলফলাদির ওপরেই নির্ভর করতে হয় বেশি। কলা ঝোলানোর মাচাটা তাই একটু শক্তপোক্ত করে বাঁধছিলেন আকাচাপান নিজে। এই সময় ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে এল পিচার, মায়েহ মায়েহ! চমকে তাকালেন লাকা, বটে! কী হল রে? কোনো বিপদ?
পিচারের সারা গায়ের কাদামাটি তখন ঘামে ভিজে চপচপ করছে, খানিক দম নিয়ে পিচার বলল, মায়েহ্, দেখেছ, ওই দিকের জঙ্গল পুরো সাফা। এটারি দেখেবুইয়া! একটা গাছও নেই ওই দ্বীপে।
আকাচাপান ভারী একটা শ্বাস ফেলে বললেন, আমি আগেই দেখেছি। কদিন ধরে সমানে চলছে গাছ কাটা। সাগর জলের শব্দ পেরিয়ে সারা রাত ধরে যেন আমার কানে এসে লাগে মর্ মর্ মরাত শব্দ। আমি ঘুমোতে পারি না।
—কিছু করবে না মায়েহ? জঙ্গল চলে যাচ্ছে, সাগর চলে যাচ্ছে, আমরা খাব কী? থাকব কোথায়?
আকাচাপান পিচারের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, দুষ্টু মাছ যেদিন আমাদের মাটি খেল, খণ্ড খণ্ড করে ভাসিয়ে রাখল সমুদ্রের মধ্যে, সেদিন থেকেই তো আমরা ভয়ে আছি। আমাদের চারিদিকে তো সবাই মুখ হাঁ করে আছে আমাদের গিলে খাবে বলে। আমাদের মাটি কি আগে এমন খণ্ড খণ্ড ছিল, সব লম্বা হয়ে জোড়া ছিল, আমাদের কত জাতি, সব আমরা ভাই-ভাই, সব আমরা আলাদা আলাদা হয়ে ছড়িয়ে গেলাম, আমাদের শক্তি কমে গেল।
পিচার বলল, ভূতেদের ভূত নেই মায়েহ? হা হা, হেসে উঠলেন লাকা, তারপর পিচারের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, আজ নেই কাল হবে। এত গাছের কান্না কি আর বিফলে যাবে! ভাবিস না পিচার, প্রকৃতির দেবী ওরা, ওদের বিচার ওরা নিজেরাই করে নেবে। আর আমরা যখন ওদের ভরসায় আছি, আমাদেরও ওরাই দেখবে।
লাকার কথা পিচারের একটুও পছন্দ হল না। সে মাথা নিচু করে উঠে গেল সেখান থেকে। আকাচাপানের সব সময় শুধু মানিয়ে নেবার কথা। মানাতে মানাতে মরে যাচ্ছে সবাই, তবু মানিয়েই যাও। নাওয়ের সঙ্গে সে এই নিয়ে আলোচনা করবে আজ রাতে। তাঁর মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওই ভুতগুলোকে দেখলে। খাবার না পেলে এরপরে তারা স্রেফ মানুষ খাবে, এ কথা আকাচাপানকে জানিয়ে দেবে তারা। আকাচাপানের মতো সারাদিন ঘরে বসে গান তো করে না তারা, তাদের খিদে পায়, খুব খিদে পায়। সারাক্ষণ শুয়োর আর কচ্ছপের মাংস খেতে খেতে জিভে চড়া পড়ে গেছে তাদের। এবার তাদের ভূতের মাংস চাই। আচ্ছা, ভূতের মাংস কেমন হয়? নরম না ছিবড়ে? বলে কাঁধের তীরধনুকটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে সে কাত হয়ে বেড়ে ওঠা সুপুরি গাছের গুঁড়ির ওপর পা ঝুলিয়ে বসল তারপর কচি বাঁশের ডগা চিবিয়ে খেতে খেতে পা দুলিয়ে দুলিয়ে ভাবতে লাগল, ভূতেদের গায়ে যখন রক্ত আছে, মাংস তখন নরমই হবে। আঃ, দারুণ মজা জমবে সেদিন। ওলে লে লে লে, গুনগুন করতে লাগল পিচার।
গাছের মতো বেড়ে ওঠা মৃত প্রবালের স্তূপের ওপরে গিয়ে দাঁড়ালো লিচো। এই জায়গাটা থেকে অনেক দূর পর্যন্ত সমুদ্র দেখা যায়। লাওদের ইয়া মস্ত মস্ত ডুঙ্গি। বাব্বা, ডুঙ্গি নয় তো যেন দানো এক-একটা। সমুদ্র পর্যন্ত ভয় খায়। কেমন কাঁপন তোলে, থুতকারি উল্টায়, ফেনায় ফেনা।
এদিকটায় শামুক, ঝিনুক, মাছ সবই বেশি। তবু শিকারের খোঁজে তাপ কমলে এদিকটায় কেউ আসে না। মরা প্রবালের খোলের ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পায়ে বিঁধে যায়, কেটে যায়, রক্ত পড়ে। লিচো তবু আসে। এ যেন এক নেশা। কে যেন ডাকে তাকে। কখনও প্রবালের খাঁজে খাঁজে সাঁতরে বেড়ানো মাছগুলো নিয়ে সে খেলা করে, কখনও পাথুরে ফুল পোকার গায়ে হাত ছোঁয়ায়, অমনি মুখ লুকায় ফুলপরী। সুরমাইকে সবাই ভালোবাসে। তাকে কেউ ভালোবাসে না সে জানে। ওই মদ্দাগুলো ওর শরীর চায়, তাই লাফ দেয় উড়ুক্কু মাছের মতো, লিচো সব জানে।
শরীর নিয়ে খেলতে লিচোর মন্দ লাগে না। শরীরে আছেটাই বা কী? ওই তো পাহাড়, নদী, উপত্যকা, খেলাতে পারলে সাগর। তা চরে বরে না বেড়ালে মানুষ বাঁচবে কেমন করে? ওই সাগরটাই লিচো খোঁজে কিন্তু পায় না। অনেক দূর দূর দিয়ে চলে যায় লাও বোট, কোথা থেকে আসে? কোথায় যায়? তাদের চারিদিকে তো শুধু জল আর জল। তবু তারই মধ্যে দিয়ে একদিন ভাসতে ভাসতে এসেছিল একটা ছোট ডুঙ্গি। তখন জোয়ারের জল বলে তাই রক্ষে। নাহলে পোকা গাছের খোলের খোঁচায় ডুঙ্গি যেত উল্টে।
দূর থেকে লাও বোটের যাওয়া-আসা দেখতে লিচোর খুব ভালো লাগে। তাই বলে যেদিন সত্যি সত্যি একটা সাদা ডুঙ্গি তার দিকে এগিয়ে আসছিল, তার বেশ ভয় লেগে গিয়েছিল। সে ওই প্রবালগুঁড়ির মাথা থেকে নেমে দে দৌড়। দৌড়তে দৌড়তে হাঁপাতে হাঁপাতে সে এক্কেবারে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে প্রথম দম ফেলেছিল। তারপর পিছন ফিরে দেখেছিল, না কেউ কোত্থাও নেই। কিন্তু সেদিন সারারাত তার ঘুম এল না। তার চোখের সামনে অসংখ্য লাও ডুঙ্গি যেন নাচতে লাগল ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনার মতো।
পরদিন তাপ বাড়তেই চুপি চুপি পা ফেলে ফেলে সে গিয়ে দাঁড়াল ফের ওই প্রবালগাছের মাথায়। সেদিন সে কোথাও কিছু আর দেখতে পেল না। সে দাঁড়িয়েই রইল। তাঁর গা দিয়ে রোদ পিছলে গেল। আকাশে মেঘ ঘনাল, সমুদ্র রং পাল্টাল, ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি নামল, তার কুঞ্চিত কেশদাম ভিজে লেপ্টে রইল গালে, কপালে, ঘাড়ের ওপরে, আনন্দঘন কালো ঠোঁট বিষণ্ণতায় মেদুর হল।
বৃষ্টি থেমে গেল, মেঘ সরে গিয়ে রুপোলি রোদ উঠল, সে ধীরে ধীরে নেমে এল উঁচু ওই পাটাতন থেকে, তারপর ব্যথা বাঁচিয়ে সাবধানে এগোতে লাগল জঙ্গলের দিকে। বালির ওপর একটু এগোতেই হঠাৎ চোখ আটকে গেল তার কেয়া গাছের ঠেস দেওয়া মূলের দিকে। ওম্মা, ঝক্ঝক্ করছে কী একটা আলোর ঝিনুক। কিন্তু ওরম কাঠিতে বিঁধিয়ে দাঁড় করাল কে? এমন ঝিনুক তো এই দ্বীপে এর আগে সে কক্ষনো দেখেনি! অচেনা কোনো জিনিস দেখলেই প্রথমটা একটু ভয় লাগে ওদের। ওদের তো পদে পদে ভয়। একবার তার কাকার ছেলে গোলাট তখন ছোট্ট, পুচকে। মায়ের পিঠে চেপে জলে নেমেছে। কালো ফুল দেখে যেই না হাতে নিয়েছে, ওম্মা, কী চুলকানি। চুলকাতে চুলকাতে সারা গায়ে লাল লাল ফোস্কা। দানো কাঁটা, বোঝে নি গো ছেলেটা। মরে যায় যায়। লিচো না থাকলে সেদিন বাঁচতই না গোলাট। দিন রাত সে গোলাটকে কোলে করে বসে গায়ে লাল মাটির কাদা লেপেছে। কাকির অত ধৈর্যই নেই। কাকি তো ঘুমিয়েই বাঁচে না। ছেলেটা পাশে ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদলেও কাকির ঘুম ভাঙে না।
সে খুব সন্তর্পণে এগোল বস্তুটির কাছে, পাশ থেকে আস্তে করে একটু ছুঁল আঙুলের ডগা দিয়ে। না তো, ঠিক ঝিনুকের মতো তো নয়। সামনে যেতেই ধড়াস করে উঠল তার বুক। ওমা, ওর মধ্যে একটা মানুষ যে! অনেকটা তারই মতো। জলের মধ্যে দিয়ে তাকে যেমন দেখতে লাগে সেরকম। কিম্বা তার থেকেও সুন্দর। সে ফিস্ ফিস্ করে ডাকল, এই!
আরে! সেই মেয়েও বলল, এই!
সে জিভ ভেঙাল ওর দিকে।
ও–ও জিভ ভেঙাল তার দিকে।
সে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল, ও–ও তাকাল। সে হাততালি দিল, দেখল হাততালি। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল এটা এক রকমের জল। খুব মসৃণ জল। আর ভেতরের মানুষটা অন্য কোনো মানুষ না। সে-ই। কিন্তু জলকে এমন খাড়া করে দাঁড় করাল কী করে? এ নিশ্চয়ই ওই ভূতটার কাণ্ড। ভূতরা কী না পারে। কিন্তু জিনিসটা খুব সুন্দর। কী সুন্দর দেখা যাচ্ছে তাকে। নাঃ, কেউ এটাকে দেখে ফেললে চলবে না। হুজ্জুতি বাধাবে। সে গাছের ডাল ঝোপঝাড় পাতা সব ছিঁড়ে এনে ঢেকে দিতে লাগল জিনিসটাকে।
পরদিন সকাল থেকে এক কাণ্ড হল বটে। সূর্য উঠলে সকলে যখন শিকারে যাচ্ছে তখন পা ছড়িয়ে সাজতে বসে গেল লিচো। সারা গায়ে টোলোডু করল। তার কৃষ্ণবর্ণ গায়ে যখন সমুদ্রের তলা থেকে তুলে আনা সাদা মাটির প্রলেপ কিছুটা শুকাল তখন সে কাঠি দিয়ে তাঁর টোলোডু করা গায়ের ওপর আঁকিবুকি করে কেটে দিল নানা রকম নকশা। তাই দেখে পিচার বলল, লিচো তোর হল কী! সূর্য না উঠতেই এমন সাজ! মন বড় খুশি মনে হচ্ছে। সচকিত হল লিচো। এই রে পিচার যদি আবার তার পিছু ধরে! সে আলস্যভরে একটা ছোট জাল হাতে তুলে নিয়ে বলল, আমি কাল স্বপ্ন দেখেছি টোলোডু করে সাগরে গেলে আজ বেশি মাছ পাব।
পিচার বলল, বেশ দেখাচ্ছে কিন্তু তোকে আজ, আয় একটা চুমু খাই।
আঁতকে উঠল লিচো, ইস! না না একদম না। মছলি রাজা আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
পিচার বলল, মছলি রাজ না নাগ রাজ? বলে চোখ মটকাল পিচার। কিছু না বলে ঠোঁটটা একটু বেঁকাল লিচো, তারপর মন্থরগতিতে এগিয়ে গেল সাগরের দিকে। লিচোর পশ্চাৎদেশ খুব উঁচু। এত উঁচু যে তাতে স্বচ্ছন্দে একটা বাচ্চা বসিয়ে দেওয়া যায়। আর ওই উদ্যত ঢেউয়ের মতো পশ্চাৎদেশ দেখে পাগল হয়ে যায় ছেলেপেলের দল। পিচার সুপুরি কাঠের তৈরি লম্বা বর্শা ফলক নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে লিচোর পাশে এসে বলল, যা তুই তোর মছলি রাজার কাছে, আমি আজ অন্য পথ ধরি রে, দুদিন ভালো শিকার পাইনি। আজ ভালো মাছ না পেলে নাও আমাকে দুয়ো দেবে, বলবে আমারও মছলি রানি জুটে গেছে। বলে ঠাঁই করে লিচোর পশ্চাৎদেশে একটা চাঁটি মেরে সে বাঁক নিল জঙ্গলের ভিতরে।
পিচার বিদায় হবার অপেক্ষা করছিল লিচো, পিচার চলে যেতেই, ওফ্ বলে হাঁপ ছাড়ল। অসহ্য! বলে দাঁতে দাঁত ঘষল একবার। যে ফুর্তি মনে নিয়ে সে বেরিয়েছিল সেই মনটাই বিগড়ে গেল তার। সে হাঁটু পর্যন্ত জলে নেমে জাল ডুবিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল পাড়ের কাছে। লাল নীল সোনালি মাছের ঝাঁক ওকে ঘিরে মালার মতো জড়িয়ে পেঁচিয়ে চলে যাচ্ছিল এদিক ওদিক দিয়ে। কেউ কেউ আটকেও যাচ্ছিল সুন্দরীর পেতে রাখা জালে। এমন মৃত্যুতেও সুখ ভাবতে পেরেছিল কি ওরা? নাকি মৎস্যজীবনের সমাপ্তির মধ্যে দিয়ে ওরা এগিয়ে গিয়েছিল মুক্তির পথে আরও একটি ধাপ, নাকি কেবলই খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে ভেসে ছিল রুপোলি ফাতনা।
সে যাই হোক আপাতত লিচোর মন নেই মাছ ধরায়। খিদেও পাচ্ছে না ঠিকমতো। মাছগুলো ছেড়ে দিয়ে ফলপাকুড় সংগ্রহে গেলে কেমন হয়! দু’-একটা কলা-টলা খেয়ে নিলেই তো চলে। পিচার কি মায়েহ্-কে খবর দেবে যে মাছ ধরতে গিয়েছে লিচো? চুনো মাছ একটাও বাধেনি জালে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, ওহ্ পিচারের খপ্পর থেকে বেরতেই মাছ ধরার জালটা আজ হাতে নিতে হল তাকে। না হলে সে আজ জঙ্গলেই যেত। ভাবতে ভাবতেই মুশকিল আসান। সুরমাই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে বালির ওপর দিয়ে। কী রে, কী হলো? শুধাল লিচো।
দু’হাত দিয়ে চোখ কচলে সুরমাই বলল, আজ একটা মাছও আটকায়নি আমার জালে।
—আহা রে, ছোট বোনটি আমার, বলে সুরমাইকে কোলের কাছে টেনে নিল লিচো, বলল তোর তো আবার মাছ না খেলে ভালোই লাগে না, বল? আচ্ছা নে ধর, তুই আমার জালটা ধর, এই সব মাছগুলো তোর। বরং আমি জঙ্গলে যাচ্ছি দু’-একটা কলাটলা পাওয়া যায় কিনা দেখি, বা চুলেমো, কোনা, কেমো যা ফল পাওয়া যায়, বনে কি ফলের অভাব, বল?
দিদির এ হেন আচরণে বেশ হকচকিয়ে গেল সুরমাই, দিদি তো তাকে কিছুই দিতে চায় না, আজ এমন হঠাৎ উদার কেন! তবু দিদির কাছ থেকে এই ভালোবাসা পেয়ে চোখে জল এসে গেল সুরমাইয়ের। সে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল দিদির কোমর। লিচোরও কেমন অকারণে আর্দ্র হয়ে গেল বুকের ভেতরটা। সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সুরমাইয়ের।
সুরমাই মাছের ঝুড়ি নিয়ে নাচতে নাচতে চলে গেল ঘরের দিকে।
পাতার আড়াল সরাতেই দেখল সূর্যের আলো ঠিকরে যাচ্ছে ওই বস্তুটার গায়ে, চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। খুব মন খারাপ হয়ে গেল লিচোর। সে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল একটা পাথরের ওপরে, তারপর ঘাড় উঁচু করে তাকাল আকাশের দিকে। তবে কি এটা তাদের পূর্বপুরুষের কোনো কারসাজি? তারা কি ডাক পাঠাচ্ছে লিচোকে? সে কি আর তবে বাঁচবে না?
দেখতে দেখতে যেন একটা হালকা পাতলা মেঘের চাদর ঢেকে দিল আকাশ। সূর্য ঝিকিমিকি খেলতে খেলতে মুখ লুকাল। কিন্তু আলো কমল না আকাশে। সে অভিমান ভরে আর এক বার উঠে দাঁড়াল ওই চকচকে চাকতির সামনে। দেখল। —হুম্। তাই তো, তাকে তো আজ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে, সে আদর বুলিয়ে দিল ওই চাকতিটার গায়ে। সে ঠোঁট কুঁচকে চুমু দিল, দেখল চুমু দিলে তাকে আরও সুন্দর লাগে। সে তার ঝকঝকে সাদা দু’সারি দাঁত বের করে হাসল, দেখল হ্যাঁ, হাসলে তাকে আরও সুন্দর লাগে। ছেলেগুলো তো তবে মিথ্যে বলে না। তবে এই আজব জিনিসটাকে কীভাবে লুকিয়ে রাখা যায়! হঠাৎ হেলো হেলো মতো একটা শব্দ কানে যেতেই সে তাড়াতাড়ি পাতা দিয়ে ফের ঢেকে দিল চাকতিটাকে। তারপর এদিক ওদিক তাকাল, না, কেউ নেই তো। সে বুকের মধ্যে হাত দিল, বুকটা তখনও ধড়াস ধড়াস করছে। এটা কী জন্তুর ডাক বটে! এরকম ডাক তো সে আগে কখনও শোনেনি এ জঙ্গলে। সে দ্রুত পা চালিয়ে ফেরার পথ ধরল। ফের শুনল, হেই, হেলো। এবার ঘাড় ঘোরাতেই দেখল, ওরে বাবা সেই সাদা ভূতটা ডুঙ্গি নিয়ে এইদিকেই আসছে! সে সবে পড়িমড়ি করে দৌড়তে যাবে, ফের শুনল ভূতটা মানুষের মতো গলায় বলছে, লুক লুক, মিরার মিরার। লুক! লুককে ফিরিয়ে আনল নাকি ভূতটা! সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সাহসে ভর করে ভালো করে তাকাল। সব ভূতই তো আর খারাপ নয়, ভালো ভূত ও হয়। কিন্তু তাকিয়ে দেখল ভূতটা ওই রকম আর একটা চকচকে বস্তু উঁচু করে ধরে লাফালাফি করছে আর তাকে ডাকছে। কোথায় লুক? কেউ তো নেই ওর ডুঙ্গিতে! সে ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ওই জিনিসটা কিন্তু খুব মজার। তার মানে ওই জিনিসটা ওই দিয়ে গিয়েছে। সে এখন এখান থেকে পালিয়ে গেলে ভূতটাও ওই জিনিসটা নিয়ে চলে যাবে। একবার গিয়ে দেখাই যাক না ভূতটা কী বলতে চায়। তার গায়েও শক্তি এমন কিছু কম না, সে রকম বুঝলে দেবে একটা জোর কামড় বসিয়ে।
কিছুটা এগোতেই ভতের কাণ্ডকীত্তি দেখে লিচোর একটুও ভয় তো লাগলই না বরং হাসিই পেল। ট্যাং ঢ্যাঙে ঢ্যাঙা, কোল কুঁজো, কেমন লাফাচ্ছে দেখো উচ্চিংড়ের মতো! বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল লিচো, বলল, আও কী বলছ টা কী?
লোকটা ওই চকচকে জিনিসটা তুলে ধরে বলল মিরার, ইয়োরস। টেক ইট।
বুকের ওপর হাত রেখে লিচো বলল, আমার? লোকটা বলল, ওহ ইয়েস, ইয়োরস। লুক, ইউ ক্যান সি ইয়োর ওন ফেস। মিরার।
মিরা?
ইয়েস মিরার।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলে লিচো। পাড়ের থেকে হাত বাড়িয়ে ধরল আয়নাখানা। এবার নৌকা থেকে হাত বাড়িয়ে দিল লোকটা ডাঙায় উঠবে বলে। নাঃ, লোকটার ডুঙ্গিতে আর কিছু নেই। ভয়ে ভয়ে লিচো হাতটা ধরল ভূতটার, ওমা, তাদের শরীরের মতোই গরম তো!
লিচো একটা ঝিনুক তুলে বলল, কাটো, তোমার আঙুল কাটো, রক্ত দেখব।
লোকটা ভয়ে ভয়ে বলল, কেন? উই আর ফ্রেন্ডস, ফ্রেন্ডস। বাটা।
বাটা?
হাঁ, ইয়েস, বাটা। ফ্রেন্ড।
তবু, তোমার রক্ত দেখি।
জাস্ট আ মিনিট, বলে লোকটা ঝিনুকের খোলে আঙুলের কোণটা একটু কাটল, অমনি লাল টকটকে রক্ত গড়িয়ে পড়ল লোকটাকে সাদা পোশাকে।
ইস্। বলে ঝটিতি লোকটার কড়ে আঙুল মুখে পুরে চুষতে লাগল লিচো। তারপর মুখ থেকে আঙুল নামিয়ে লিচো বলল, জাটামিনি। বলতেই হো হো করে হেসে উঠল লোকটা, বলল ইয়েস, ইয়েস, জাস্ট আ মিনিট। সুন্দরী এক মিনিট কেন, তোমার জন্য আমি অনন্ত কাল অপেক্ষা করতে পারি।
লঘু পায়ে দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল লিচো, ফিরে এল দু’-এক মুর্হূতের মধ্যেই। নিয়ে এলো বুরুক গাছের ছাল, তারপর সেটাকে জলে ভিজিয়ে চেপে চেপে দিতে লাগল কাটা জায়গাটার ওপর। যেন মরমে মরে যাচ্ছিল লিচো, বার বার বলতে লাগল এম্ফোহে, এম্ফোহে, ইস কেটে গেল। লোকটা বলল ডোন্ট ওরি, আমি ফিরে গিয়ে ওষুধ লাগিয়ে নেব। আর এই দেখো আমার গড, বলে গলার চেন তুলে দেখাল ক্রস, জেসাস। সব্বাইকে রক্ষা করে। তোমরা যদি জেসাসকে ডাকো জেসাস তোমাদেরও রক্ষা করবে। তোমাদের তখন এত কষ্ট থাকবে না।
লিচো লোকটার কথা ঠিক মতো কিছুই বুঝল না, শুধু আকাশের দিকে মুখ তুলে কী সব যেন বিড়বিড় করল।
লোকটা বলল, নেবে?
ঘাড় ঝাঁকাল লিচো, না বাবা।
লোকটা বলল, কেন, নাও না।
লিচো বলল, আচ্ছা তোমার কি সুড়সুড়ি লাগে?
ভুরু কুঁচকে তাকাল লোকটি, হোয়াট? আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইউ ওয়ান্ট টু সে। কী বলছ তুমি?
লিচো লোকটার পা থেকে জুতো খুলে নিল।
লোকটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইল লিচোর দিকে। এই রে দিল বোধ হয় তার পা দুটো ধরে শরীরটাকে দু’ফালা করে ছিঁড়ে। লিচো আঙুল দিয়ে লোকটার পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিল।
বিস্ময়ে, মজায়, লোকটা ফিক্ করে হেসে উঠল, তারপর হেই! বলে পাটা সরিয়ে নিয়ে দৌড় লাগাল ডুঙ্গির দিকে।
লিচো লোকটার জুতো তুলে ধরে নাড়তে লাগল নাকের ডগায় আর হাসতে লাগল হি হি করে। বলল, গন্ধ, বাজে, বুই!
লোকটা বলল, মাই শু! কাম, কাম হেয়ার।
লিচো লোকটার জুতো হাতে নিয়ে দোলাতে দোলাতে গিয়ে উঠল ডুঙ্গিতে, তারপর দু’হাত দিয়ে কাতুকুতু দিতে লাগল লোকটার সারা শরীরে, দু’জনের হাহা হিহি হোহো হিহি হাসিতে নৌকো দুলতে লাগল টলমল করে।
ছাউনির পর্দা সরিয়ে শাহু দেখল বুধা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ওর কষের পাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে গিয়েছে চাদরের ওপরে। শাহু পা দিয়ে বুধার উরুর কাছে একটা ঠেলা মেরে বলল, এই ওঠ্। শাহুর ঠেলায় বুধা লাট খেয়ে গেল চিত হয়ে। শাহু বলল, উঁ কী টানা টেনেছে দেখো সন্ধ্যে হতে না হতেই, একেবারে লেদ্রে গিয়েছে, কোনো সান জ্ঞান নেই। এই ওঠ্ ওঠ্, বিজলি বাইয়ের খিল্লি দেখবি যদি চল।
বুধা এইবার শুধু মুখ দিয়ে একটু শব্দ করল, উঁ?
শাহু বলল, ওহ্ বিজলি চমকেছে কি মেঘ ডেকেছে দেখো, এতক্ষণ ডাকছিলাম সাড়া তুলছিল না। বলছি, যাবি? সাহেব আমাদের জন্য ভেট পাঠিয়েছে, আফগানি পুত্লি। মস্ত্ গায়। এবার ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসল বুধা, বলল, হুঁ মস্ত্ গায়। ও কি আজ আর গান গাওয়ার অবস্থায় আছে? দু’তিন দিন ধরে তো সাহেব ছাউনিতে ঘুরছে। তোরা আর কত ছিবড়ে গিলবি? এর পর তো সাহেবরা ডাঁটা চিবিয়ে আমাদের জন্য লাপসি বানাবে।
বুধার কথায় থমকে গেল শাহু, বল তো কী করবি? বিদ্রোহ করবি? বিদ্রোহীরা জিতেছে কোন জায়গায়? পালাবি কোথা দিয়ে, আমাদের দেশের রাজারাই তো তিনদিক দিয়ে আমদের ঘিরে রেখেছে।
বুধা বলল, হুম্ খচ্চর। ওগুলোর জম্মের ঠিক নেই। সব রানিগুলো রাতের বেলায় সাহেবগুলোকে মহলে ঢোকায় জানিস!
শাহু বলল, এই, না জেনে উল্টা সিধা বলিস না। আমাদের দেশের মেয়েরা সম্মান রক্ষার জন্য আগুনে ঝাঁপ দেয়, তারা দেবী, রানি লক্ষ্মীবাই তো নাকি বিদ্রোহী সেনাদের জোর সাপোর্ট দিচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে ঝাঁসিও যোগ দেবে বিদ্রোহে।
—হুম্ সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে আর আমরা বসে বসে বাইয়ের নাচ দেখছি।
—আরে যখন পালানোর পথ নেই তখন সেই জাগাটাকেই মেনে নিতে হয়, ফূর্তি করতে হয়। বাঁচতে তো হবে বল, তোর আমার রোজগারের দিকে তাকিয়ে আছে কতগুলো পেট, বল।
বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল বুধা, বলল, সেই। আমাদের তো কিছুই ছিল না, না দালান কোঠা, না খেতি-বাড়ি, জমিদারের জমি চাষ করতাম, সেখানেও তো জুলুম কম ছিল না, পেটের দায়ে পল্টনে নাম লিখিয়েছি, কিন্তু যাদের জমিজিরেত তারা নিজেরাই দেশটাকে বেচে দিল সাহেবদের হাতে!
শাহু বলল, সেটাই তো, তবে আমরা কেন খামোখা লড়াই করে প্রাণ দিতে যাব? আরে গরুর চর্বি শুয়োরের চর্বির কার্তুজ দাঁতে কেটে তবে আমাদের জাত যাবে? যেদিন থেকে গোরা সেপাইয়ের পা চেটেছি সেদিন থেকেই তো আমাদের জাত গিয়েছে।
বুধা বলল, হুম্, তা যা বলেছিস। যখন উর্দি এক তখন জাতও এক, ওদের কাছে তো আমরা সবাই নেটিভ।
শাহু বলল, চল তবে বিজলি রানির ধামাকাটা দেখেই আসি।
চল, বলে উঠতে গিয়েও আঃ করে বসে পড়ল বুধা। বলল, তুই যা, আমি যাব না।
শাহু এবার একটু রেগে গিয়ে বলল, শালা এত টেনেছে উঠতে পারছে না দেখো।
বুধা বলল, এই হারামি, আমি টেনেছি না? আমার জ্বর। গায়ে হাত দিয়ে দেখ শালা। পাটা দেখ, পা। আমি শালা পালাব, যে করেই হোক পালাব। কাল আমি মার্চে যাব না। আমি মরে যাচ্ছি।
শাহু এগিয়ে এল কাছে, কপালে হাত দিয়ে বলল, এই তোর তো ভালো তাপ আছে গায়ে। আগে বলবি তো, চল ডাক্তারের কাছে চল।
বুধা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, পা দেখ, কত ফোস্কা। চলতে চলতে চলতে চলতে জিনা হারাম হো রাহা হ্যা রে মেরা। আর চলতে পারছি না, এবার একটু শান্তি চাই, বাড়ি যাব, গোরা পল্টন আমার গাঁটাকেও গুঁড়িয়ে দিল কিনা কে জানে!
শাহু ফিসফিস করে বলল, কিন্তু এখন পালাতে গেলে তোকে সবাই বিদ্রোহী সিপাই ভাববে। গুলি করে মারবে।
বুধা বলল, সে মারলে মারবে। মরতে ভয় পেলে কি আর সৈন্য হওয়া চলে।
শাহু বলল, সে যখন পালাবি পালাস, তোর এখন শরীরের যা অবস্থা তাতে তোর পালানোর ক্ষমতাও নেই। নে আমার কাঁধে ভর দে, চল ডাক্তারের কাছে চল।
দুই বন্ধু ছাউনির বাইরে বেরতেই দেখল হ্যাজাকের খুঁটির নীচে দুই গোরা সেপাই ধোঁয়া ফুঁকছে। ওদের দেখেই চিৎকার করে উঠল, হেই কিধার যাও?
শাহু বলল, এর বুখার হয়েছে, ডাক্তার সাহেবের কাছে যাচ্ছি।
এক গোরা সেপাই বলল, ডাক্তার কী করবে? ইধার আও, পিছওরে মে ইঞ্জেকশান লাগা দেতা হু।
চুতিয়া। বলে একমুখ থুতু ফেলে শাহু বুধাকে নিয়ে চলে গেল ডাক্তারের ছাউনির দিকে।
ডাক্তারের কাছ থেকে আনা হাকুচ তেতো বড়ি জল দিয়ে কোঁত করে গিলে ফেলে বুধা বলল, আমাদের গাঁয়ে বলে ডাক্তার ছুঁলেও নাকি জাত যায়। জ্বরে পটাপট কত লোক মরে যায় তবু পাদ্রি ডাক্তারের ওষুধ গেলে না। আমাদের আর জাতধর্মের আছে কী বল!
শাহু বলল, জাত আর জাত, চুপ কর তো শালা। আমাদের নিজেদের জাতের মধ্যেই তো এ ওকে ছোঁয় না তো সে তার পাতে খায় না। হাতে হাত ধরে থাকলে গোরা সৈন্যগুলো আমাদের এখানে ঢুকতে পারত? দেখছিস না রাজারাজড়াগুলো বিদেশি মাল খাবার জন্য নিজেদের জায়গির বেচে দিচ্ছে। আর আমাদের মতো বোকা সৈন্যগুলো লড়াই করে মরছে।
বুধা বলল, তাই বলে ল্যাগব্যাগে গোরা সেপাইগুলোর একরকম মাহিনা আর আমাদের একরকম মাহিনা, এগুলো কি তুই মেনে নিতে বলিস? আমরা কি ওদের থেকে কম পরিশ্রম করি?
মাথা ঝাঁকাল শাহু, তা ঠিক, সত্যি কথা যদি বলিস, এইটাতেই আমার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে।
বুধা বলল, আর ওদের হাবভাব! আমরা তো কম্পানির চাকরি করি বল? আমরা কি ওদের গোলাম?
শাহু গোঁফে তা দিতে দিতে বলল, গোলাম মানে চাকরই। নে তুই এখন ঘুমা। তোর জন্য সুখবর আছে। কাল আমাদের মার্চ শুরু হচ্ছে না। পরিস্থিতি নাকি বেজায় গোলমেলে, চারিদিক আঁটঘাট না বেধে নাকি মার্চ শুরু করা যাবে না। মনে হয় দু’-একদিন বিশ্রাম পাওয়া যাবে। আশা করা যায় তার মধ্যে তুই সেরে উঠবি। আমি ঝাড়ুদারের বউ বিন্দিরানিকে খবর পাঠিয়েছি ঘর থেকে চুন-হলুদ নিয়ে আসার জন্য। কাল লাগিয়ে দেব।
সকাল না হতেই সেনা ছাউনিতে জোর রঙ্গ। এক গোরা সেপাই সকাল বেলার কাজকম্মো সারতে গিয়েছিল। তা তার নাকি হাঁটুর পিছনে হয়েছে ঘা। প্যান্ট পরে সে নাকি বসতে পারছে না। সে প্যান্ট খুলে রেখেছিল পাশে। চটের মধ্যে দিয়ে মুখ বাড়িয়ে এক কুত্তা তার প্যান্ট নিয়ে দিয়েছে ছুট্। আর সে, ‘হেই হেই ব্লাডি বিচ’ করতে করতে লাঙ্গুল দুলিয়ে সারা চত্বর ছুটে বেরিয়েছে।
ও হো হো হো হো হো করে হাসতে হাসতে হাঁপাতে হাঁপাতে শাহু বলল, বুধা তুই যা আজকে তামাশা দেখা থেকে ঠকলি না রে, কাল তোকে ব্যাটা পিছনে রুলার ঢুকাচ্ছিল না, আজ দেখ শালাকে সকলের সামনে কুত্তা কেমন নাঙ্গা করে ছেড়েছে। দেশিকুত্তা না!
বুধা তখন ঘুমচোখে বিছানার ওপর বসে বসে ঢুলছিল, বলল, ব্যাটার লাঙ্গুলটা কুত্তা ছিঁড়ে নিয়ে গেল না কেন, তবে খিল্লি আরও জমত ভালো।
উর্দির বোতাম লাগাতে লাগাতে শাহু বলল যাই, এক মিনিট দেরি হলেই আবার বচন শুনতে হবে। তবু এখনও নিজের সঙ্গে একটা অস্ত্র আছে, একটু হলেও মনে হয় যেন একটা সম্মান আছে। শুনছি বার্মা নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি নাকি এসে পৌঁছলেই আমাদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হবে। তখন তো ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার। মার্চ করে গিয়ে বিদ্রোহী সেনাদের সামনে বুক পেতে দাঁড়ানোই হবে আমাদের কাজ। এতদিন মাইনা দিয়ে পুষেছে, কিছু আদায় না করে নিয়ে তো আর ছাড়বে না। ওরা বেনিয়ার জাত। ছাড়, শোন তোর যখন মর্নিং প্যারেডের ছুটি মঞ্জুর হয়েছে তখন তোর আর এখন উঠে কাজ নেই। স্রেফ ঘুমিয়ে থাক। দেখি তোর জন্য যদি কোনোভাবে একটু দুধের বন্দোবস্ত করা যায়। হলদি দুধ খেলে ব্যথাবেদনার দারুণ উপশম হয়।
পুনরায় কম্বলের ওপর গড়িয়ে পড়তে পড়তে বুধা বলল, তুই আর আমার জন্য কত করবি! বুধার এই ফালতু বকোয়াসের কোনো উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করল না শাহু। সে গট গট করে বেরিয়ে গেল তাঁবু থেকে। তার লাল উর্দি আনুগত্যের নিশানা উড়িয়ে মিলিয়ে গেল প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে।
স্কোয়াড সাবধান, স্কোয়াড বিশ্রাম। আকাশ ফাটিয়ে ফিল্ড অফিসারের কমান্ড কানে আসছিল বুধার। মাথার কাছে ফেলে রাখা গামছার কোনা দিয়ে সে চেপে ধরল নিজের কান। কদিন ধরে অসহ্য লাগছে তার। সে যেন গঙ্গা মাইয়ার স্রোতের বিপরীত দিকে চলেছে। সারা দেশ যখন এই কুত্তাগুলোকে তাড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তখন তারা এই কুত্তাগুলোর জন্য জান লড়িয়ে যুদ্ধে নেমেছে!
খবর বাতাসে ছড়ায় বিদ্রোহী সেপাইরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছে সেই পথের ধারে সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছে গোরা সেপাইরা। তার মা বোন, কি জানি কেমন আছে তারা। কবে বিদ্রোহের আগুন নিভবে? কবে ছুটি পাবে সে? দেশের কোনো রাজা কম্পানির বিরুদ্বে লড়ছে তো কোনো রাজা কম্পানির হয়ে সেনা নামাচ্ছে। কে যে কোন দিক থেকে ঘুস খাচ্ছে, কে যে কোন দিক থেকে উপটোকন পাচ্ছে, কার যে কী ভাবে স্বার্থে ঘা লেগেছে, এসব তাঁর মতো চুনোপুঁটি মানুষদের পক্ষে বোঝা ভারি মুশকিল। সে এসেছিল সেপাই হতে পেটের দায়ে, দুটো পয়সার লোভে। কিন্তু তখন তো সে বোঝেনি কোম্পানি যেন হাড় মাংস মজ্জা সবকিছু নিংড়ে নেবে তার। এমন কী রেতঃস্খলনের ক্ষমতাটুকুও। মেয়েলোকের প্রতি তার দুর্বলতার কথা গাঁ গঞ্জে সকলেই জানত। কিন্তু এখন রাতবিরেতে আশেপাশের গাঁয়ে যখন সেপাইরা মাঝে মাঝে ফুর্তি করতে যায় বুধার সেটাও ইচ্ছা করে না। সে বড়ই ক্লান্ত, কাহিল। তার কেবলই মনে হয় সে যেন এই খাঁচা থেকে মুক্তি পায়। চাকরিও যে এমন পায়ের বেড়ি হয়ে দেগে বসে, আগে কে বা জানত। মাইনে তলব পায় বলে আগে যে সে বুক ফুলিয়ে গাঁয়ে ঢুকত!
কিন্তু মুক্তির পথ বড় কঠিন। একটা ধাক্কা ছাড়া মুক্তি পাওয়া সহজ না। তাদের গাঁয়ে কথক ঠাকুর রামায়ণ গান গাইত আর মাঝে মাঝে এমন সব বচন দিত। তারও কিন্তু রামায়ণ গান গাইতে খুব ভালো লাগে। সন্ধ্যেবেলা একটু রামায়ণ গান মনটাকে শুদ্ধ করে দেয়। মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা সে যখন রামায়ণ গান ধরে, গোল হয়ে এসে বসে সব, তখন ভালোও লাগে। মনে হয় সকলের সঙ্গে মিলে মিশে থাকার একটা আলাদা মজাও আছে। কম্পানি তাদের জন্য একেবারে কিছু করে না তা তো না, মাঝে মাঝে খানা পিনা মওজ মস্তির ব্যবস্থাও করে, এটুকুই বা তাদের জন্য কে কবে করেছে। আসলে সেপাইরা বিদ্রোহী হওয়াতেই তো কম্পানি এমন বিগড়ে গেল। না হলে এত খারাপ অবস্থা তো আগে ছিল না।
বিন্দিরানি চুন হলুদের বাটি নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে বুধার বিছনার পাশে। সে উঠে তিন আঙুলে গরম চুন হলুদ উঠিয়ে আস্তে করে লাগাতে লাগল তার ব্যথা পায়ের ওপরে।
ঠুমক চলত রামচন্দ্র… তুলসীদাস অতি আনন্দ…। গ্যাসলাইটের বৃত্তের বাইরে ঝুঁঝকি অন্ধকারে খইনি ডলতে ডলতে ভজন ধরেছিল ধরম সিং। বুধা এসে উবু হয়ে বসল ধরম সিংয়ের পাশে। বলল, ভাই খবর শুনেছ?
ধরম সিং গান থমিয়ে বলল, কী রে? বুধা ফিসফিস করে বলল, এই যে লোক বলছে শেয়ালকোট থেকে নাকি একটা বড় দল সিপাহি পালিয়ে গিয়েছে। তারা নাকি বিদ্রোহী শিবিরে ভিড়েছে। খুব শিগিগিরি তারা নাকি ২৪ নম্বর ফুট রেজিমেন্ট আক্রমণ করবে, ওটা তো ইউরোপীয় সেনা শিবির। তাহলে তো কুরুক্ষেত্র।
নির্বিকার চিত্তে হাতে তালি দিয়ে তামাক থেকে চুন উড়াতে উড়াতে ধরম সিং জবাব দিল, তাতে কী? আমিও তো কাল দলবল নিয়ে এখান থেকে ভাগব। কুরুক্ষেত্র বাধবে না, বেধে গেছে। সারা দেশে আগুন জ্বলছে বুঝলি।
—আঁ! বলে আঁতকে উঠে ধপ করে বসে পড়ল বুধা। বলল, বলো কী? তবে আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে।
—কিঁউ?
—ঘর যানে কে লিয়ে। বাড়ি যাব।
—ডড়পোক কাঁহিকে, বলে ধরম সিং একটা চাঁটি বসাল বুধার মাথায়, বলল, কোনো ভিতু আদমিকে আমরা সঙ্গে নিই না। যা ভাগ, তুই ভালো রামায়ণ গান করিস, তাই তোর সঙ্গে দুটো মনের কথা বলে ফেললাম। এই কথা যেন তোর মুখ থেকে দুবার আর না বেরয়। তাহলে প্রথম গুলিটা তোকেই করব। বন্দুকের ধর্ম জানিস তো, কখন কোন দিকে ঘোরে তার ঠিক নেই।
বুধা বলল, কী যে বল ধরম ভাই, বেইমানি করব? তুমি আমার জাত ভাই আছ। জান থাকতে একথা আমার মুখ দিয়ে বেরবে না।
ধরম সিং বলল, হুম্ মনে থাকে যেন, হলদি দুধ পিয়া?
ঘাড় নাড়ল বুধা, হ্যাঁ।
ধরম সিং বলল, ও ম্যায়নে ব্যবস্থা করকে ভেজা। প্যার মে দরদ্ কুছ কম হুয়া? কমেছে পায়ে ব্যথা?
ঘাড় ঘাড় নাড়ল বুধা, হ্যাঁ।
—যা এখন গিয়ে বিশ্রাম নে। যদি কখনও নিজের থেকে মনে হয় পালাতে পারবি, তখন পালাবি। কাউকে বিশ্বাস করিস না, ভরসাও করিস না।
মাথা নিচু করে তাঁবুর দিকে ফিরছিল বুধা। দিন-কে-দিন সে যেন একটা কেঁচো হয়ে যাছে। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, কী করা উচিত আর কী করা উচিত না, সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। কী সব সে শুনছে বাব্বা, জিন্দের রাজার লোক নাকি সাহেবদের হয়ে গুপ্তচরের কাজও করেছে। আসলে সাহেবরা তো এদেশের পথঘাট তেমন চেনে না। পথঘাট চেনানোর জন্য রাজার লোকজন তাদের সত্যিই দরকার। আজব কাণ্ড বটে, তাদের না হলে সাহেবদের কোনো কাজই চলবে না অথচ হেনস্থা করে তাদেরই সবচেয়ে বেশি। আজকাল তার সঙ্গীসাথিরাও তাকে দুব্লা রুগ্ণ বলে মজা উড়ায় অথচ তার চওড়া ছাতি, ফুলে ওঠা পেশি দেখেই না সাহেবরা তাকে সৈন্যদলে নিয়েছিল। আসলে সে এই কাজটায় এখন আর কোনো আনন্দ পাচ্ছে না। কোনো কাজে আনন্দ না পেলে সেই কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় দম পাওয়া যায় না। অথচ কাজটা থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী সেপাইদের দলে যোগ দেবার মতো সাহসও এখনও পর্যন্ত সে সংগ্রহ করতে পারল না।
কেমন যেন এলোমেলো, ছত্রভঙ্গ সেনা শিবির। সব সময় যেন একটা সন্দেহের বাতাবরণ। এই বুধাই তো একদিন কত উৎসাহ নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে এসেছিল। ট্রেনিং নিয়েছিল। ব্যান্ডের তালে তালে কুচকাওয়াজ করতে তার কী ভালো লাগত। লেফট রাইট লেফট, লেফট রাইট লেফট। কদমতল। ভারী বৃষ্টির মতো বুটের আওয়াজ যেন লহরী তুলত বুধার কানে। আজ সেই কাজটাকেই সবচেয়ে অসহ্য লাগছে তার।
কিছুদিন হল ছাউনিতে পাদ্রি সাহেবের আনাগোনা বন্ধ হয়েছে। যদিও সাহেবটাকে বেশ ভালোই লাগত বুধার। ওদের ধর্মগ্রন্থ— কী যেন নাম, বাইবেল, থেকে যখন বাণী শোনাত, বুধার গ্রামের কথক ঠাকুরের কথা মনে পড়ত। অনেকটা একই রকম ঠেকত কথাগুলো। তোমরা সত্যের আজ্ঞাবহতায় অকল্পিত ভ্রাতৃপ্রেমের নিমিত্ত আপন আপন প্রাণকে বিশুদ্ধ করিয়াছ বলিয়া অন্তঃকরণে পরস্পর একাগ্র ভাবে প্রেম করো। কারণ, তোমরা ক্ষরণীয় বীর্য হইতে নয়, অক্ষর বীর্য হইতে ঈশ্বরের জীবন্ত ও চিরস্থায়ী বাক্য দ্বারা পূর্ণজাত হইয়াছ। কেন না মর্ত্যমাত্র তৃণের তুল্য, ও তাহার সমস্ত কান্তি তৃণপুষ্পের তুল্য, তৃণ শুষ্ক হইয়া গেলেও এবং পুস্প ঝরিয়া পড়িলেও প্রভুর বাক্য চিরকাল থাকে। শেষে আমেন করে ফাদার বলতেন, বাইবেলে ঈশ্বরের মনন, মানবের অবস্থা, মুক্তির পথ, পাপীদের বিচার এবং বিশ্বাসীদের সুখ সন্নিবেশিত আছে।
প্রায় রোজ শুনতে শুনতে কথাগুলো মুখস্ত হয়ে গেছে বুধার। জোর করে ধরে যিশুর বাণী শোনানো, তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা বেজায় চটে যেত, বিড়বিড় করে নিজেদের ইষ্টদেবতার নাম জপত। কেউ ফাদারের কোনো কথাই শুনত না। বুধার কিন্তু বেশ লাগত। মনে হত সব ধর্মকথাতেই জ্ঞানগম্যি বাড়ে। মন্দ কী! এই যে বিদ্রোহী সেপাহিরা এত সাহেব-মেমদের মারছে, কাটছে। সব সাহেব মেমরা কি খারাপ? ফাদারের শরীরে কী মায়া, আশেপাশে দেখলেই কেমন হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। শাহু চোখ পাকিয়ে বলে চুপ কর, ওগুলো সব চালাকি। নিজেদের বশে আনার চাল। ওরা কিছু দিলে খবরদার খাবি না। বুধা বলে, আর যদি লাপসির মধ্যে কিছু মিশিয়ে দেয় তো?
শাহু রেগে বলে, তো কী? কিছু মিশালে গন্ধ পাওয়া যাবে না নাকি! আর তাছাড়া সাহেবদের কি প্রাণের ভয় নেই? ধরা পড়লে তো সেপাইরা জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরে দেবে সাহেবদের। বুধা বলে, আচ্ছা শাহু এই অশান্তি আর কদিন চলবে?
আড়িমুড়ি ভেঙে শাহু বলে, বেশি দিন না, কোম্পানি কব্জা করে ফেলেছে বিদ্রোহী সেপাইদের। দেখ বেনো জলে এখন যে যার মতো মাছ ধরছে বুঝলি। আমার তো মনে হচ্ছে কয়েকদিনের মধ্যেই সব ঝামেলা মিটে যাবে। তবে তার আগের পথটা বড় কঠিন বুঝলি বুধা। আর সেটা পেরনোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোম্পানির কাছে।
বুধা বলে, কোম্পানি নাকি ব্যবসা করতে এসেছে, একে ব্যবসা করা বলে? সব লুটেপুটে খাচ্ছে!
শাহু বলল, সে লুটেপুটে খাওয়াটা আর কি কোনো দিন কম ছিল? আগেও ছিল, এখনও আছে, আগামী দিনেও থাকবে। বরং দিনে দিনে এমন সব যন্ত্রপাতি বেরবে যে লুটেপুটে খাওয়াটা তখন আর আমরা বুঝেই উঠতে পারব না।
ফেরো থেকে গলায় ঢকঢক করে খানিক জল ঢেলে বুধা বলল, ওহ্ এখনও যেন আমরা কত বুঝে উঠতে পারছি। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়। আর উলুখাগড়ড়ার প্রাণ যায়। আমার তো মনে হয় ব্যারাকপুরে সেপাইদের নানা সাহেব, তাঁতিয়া তোপির লোকজনেরাই খেপিয়েছে। আমরা হলাম গিয়ে উলুখাগড়ার দল বুঝলি শাহু, জলার ধারে বেড়ে ওঠা নলবন। মসমসে জুতোর তলায় চাপা পড়ার জন্যই জন্মেছি আমরা।
উঠে এল শাহু বুধার কাছে, পিঠে চাপড় মেরে বলল, আরিব্বাস, হলদি দুধ আর ডাক্তার সাহেবের দাওয়াই খেয়ে তোর তো বেশ জোশ ফিরেছে! না রে, তুই ঠিকই বলেছিস। তুই তো আসলে টোলো পণ্ডিতদের সঙ্গ করেছিস। তাই তোর জ্ঞানগম্যি একটু বেশিই আমাদের থেকে। তারপর আবার পাদ্রি সাহেবের পিছনেও ঘুরঘুর করিস। আবার শায়রিও পড়িস। তোর এই লড়াইয়ের ময়দানে আশা উচিত হয়নি। তুই যাত্রাদলে নাম লিখাতে পারতিস।
বুধা বলল, তাতে কি আর মাইনা তলব পেতাম?
শাহু বলল, তুমি দুদুও খাবে তামাকুও খাবে, সব হয় না। আমি বাবা একটা কথা বুঝি, যার নুন খেয়েছি তার হয়ে কাজ আমাকে করতেই হবে। যার খাব যার পরব তারই দাড়ি ওপড়াব, ও আমার দ্বারা হবে না।
বুধা বলল, দেখ তোর ভালোবাসার দাম সাহেবরা কদ্দিন দেয়।
শাহু বলল, ভালোবাসার কি কোনো দাম হয় রে বোকা, এই নাকি তুই গান বাঁধিস। জানিস, ভাইয়ের বউটা গ্রামের মোড়লের সঙ্গে ভেগে গেছিল বলে আমার ভাইটা গলায় দড়ি নিয়ে ঝুলে গেছিল বাড়ির চালে।
বুধা প্রশ্ন করে। আর তোর বউ?
—আমার পথ চেয়ে বসে বসে চাপাতি বানাচ্ছে, ম্লান হাসে শাহু, তার চোখের কোণটা যেন চিকচিক করে ওঠে। বলে, তবু মাইকে যেতে চায় না জানিস, বলে তোমার ঘরে থাকলে মনে হয় তোমার সঙ্গে রয়েছি।
১
২
৩
৪
৫
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন