অমিতা মজুমদার
কুড়ি বছর আগে ধীরাজ তাকে একা করে দিয়ে স্বর্গের পথে পা বাড়ায়। ছোট ছোট দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারে টিঁকে থাকার সংগ্রামটা খুব একটা সহজ ছিল না। কিন্তু স্বর্ণ সেই কাজটা করেছে অপরিসীম ধৈর্য আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোরে। এ বাড়িতে তাকে সোনা খুড়িমা, সোনা ঠাকুমা, সোনা দিদা, আবার সোনা বৌ বলেও ডাকে। কুড়ি বছরে বাড়ির ভেতরে বাইরে অনেক বদল ঘটেছে। দূরে থাকা কলঘর এখন সকলের শোয়ার ঘরের সাথে ।
একখানা রান্নাঘরও ভাগ হয়ে অনেকগুলো হয়েছে। যার যেমন খুশি রান্না করে খেতে পারে। বড় খাবার ঘরে পিঁড়ি পেতে সবাই বসে একসাথে খাওয়ার চল অনেক আগেই উঠে গেছে।
শুধু পালা-পার্বণে ঠাকুর আসে, রান্না করে সকলের ফরমায়েশ মতো। সেখানেও দেখা যায় সেজো-জা প্লেট নিয়ে এসে ঠাকুরকে বলবে গোটা দশেক চিকেন কাটলেট দাও তো আমার নাতি তার বন্ধুদের নিয়ে খাবে। আর গোটা দশেক ফিশ ফিঙ্গারও দিয়ো। এভাবে যার যার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের আপ্যায়ন করে। আগের সেই যৌথ ভাবনা আর নেই। স্বর্ণর কেউ আসে না। তাই এসব প্রয়োজন পড়ে না।
স্বর্ণর ছেলে দীপ্ত বরাবর পড়াশুনায় ভালো ছিল। তাই সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে বিদেশে পাড়ি জমায়। সেখানেই এক বিদেশিনীকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। স্বর্ণকে অনেক বলেছে তাদের সাথে গিয়ে থাকার জন্য, কিন্তু স্বর্ণর যাওয়া হয়নি। আর মেয়ে ঝুমুর, সবাই ঝুমু বলে ডাকে সেও ঢাকায় সেটেল। নিজে ভালো চাকুরি করে আর জামাইও। তারাও অনেক বলেছে সেখানে গিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু স্বর্ণর কেন যেন মনে হয়েছে সে এই বয়সে ওদের সাথে গিয়ে তাল মিলিয়ে থাকতে পারবে না। ফলে ওদের পারিবারিক শান্তি নষ্ট হবে। যা সে চায় না। তাই এ বাড়িতেই রয়ে গেছে। মনে সাধ ছিল এবাড়ি থেকেই একেবারে চিতায় উঠবে। ধীরাজের পাশেই সমাধি হবে। কিন্তু এক জীবনে সব সাধ আহ্লাদ পূরণ হয় না মানুষের। স্বর্ণ এখন জেনে গেছে পৃথিবীটা তার হিসেবে চলে না।
এবারের পয়লা বৈশাখে স্বর্ণর ছেলে-মেয়ে বাড়িতে এসেছে। বিদেশি বৌমা, ফুটফুটে দুই নাতি নাতনী, মেয়েরও দুই ছেলে সব মিলিয়ে এই নববর্ষে স্বর্ণর নিজেকে পূর্ণ মনে হচ্ছে। সকলে ছেলে-মেয়েকে দেখে ধন্য ধন্য করছে।
মা হিসেবে আর কি চাই!
গড়পরতা জীবনের গল্প বিশেষ করে মায়েদের এমন গল্প শুনতেই সকলের ভালো লাগে। কিন্তু গল্পের পেছনে আর একটা গল্প যে থেকে যায় —-
স্বর্ণময়ীর ছেলে-মেয়ে এবারে এত আয়োজন করে এসেছে তার কারণ আছে। বাড়ির প্রাপ্য অংশ তাদের কাকা জ্যাঠার কাছে বিক্রি করতে চায়। যদিও তাদের কোনো অভাব নেই তাও পাওনা অংশের দাবি ছাড়তে যাবে কেন? আবার বাড়ির লোকেরাও ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিশ্চিন্ত হতে চায়, যাতে ভবিষ্যতে স্বর্ণর ছেলে-মেয়ে এসে দাবি না করতে পারে।
এসমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্বর্ণময়ীর সাথে কেউ কোনো কথা বলেনি। স্বর্ণময়ী যখন জেনেছে তখন সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গেছে। স্বর্ণ কাউকে কিছু বলেনি। ছেলে-মেয়ে তার জন্য কি ব্যবস্থা নিয়েছে তা একবারের জন্যও জানতে চায়নি। যদিও ভাসুর, দেবর, তাদের ছেলে বৌরা বলেছে সে যেমন আছে তেমনই থাকবে। কিন্তু স্বর্ণ তো জানে সে কেমন আছে! বাঙালি ঘরের বিধবা তার স্বামীর রেখে যাওয়া যৌথ পরিবারে কেমন থাকে।
স্বর্ণ সকলের অগোচরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে। কিছু জমানো সঞ্চয় ছিল সেটা নিয়ে সোজা গিয়ে উঠল আনন্দ নিকেতন নামের প্রবীণ নিবাসে। একটা ঘর পেয়েও গেল অযাচিত ভাবে, তবে ভাগ করতে হবে অনুরাধা নামে আর একজনের সাথে। তাতে কী, এতো তার নিজের ঘর, যা কোনোদিনই স্বর্ণর ছিল না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন