মহুয়া ব্যানার্জী
ফুলির বড় শখ প্রেম করবে। তাও আবার ওই সিরিয়ালে যেমন দেখায়, তেমনটি। তিন বাড়ি বাসন মাজা, ঘর মোছার কাজ করেও ফুলির এই প্রেমের বাতিকটা বসন্ত বাতাসের মত নরম না হয়ে কালবৈশাখীর মত হু হু করে বেড়ে চলে। আঠারো বসন্ত পেরোনো ফুলি আজকাল ভেবেই নিয়েছে যে এবারে একটা সলিড দেখে প্রেম করতেই হবে। প্রেম যে তার হয়নি তেমনটি নয়। সেই দশ বছর বয়স থেকেই চকলেট, মুখে মাখার ক্রিম, মাথার ক্লিপ ইত্যাদির বিনিময়ে পাড়ার মদনা মুদি, বেঁটে বদন বাদামওয়ালা, ফটিক ফেরিওয়ালা এদের সাথে খুচখাচ প্রেম হয়েছিল। কিন্তু বয়েসের সাথে সাথে চাহিদাও বাড়ে। তাই পাড়ার মোড়ের চাউমিন, ফুচকা খাওয়ানো বা সিরিয়ালের মত হাত ধরে পার্কে বা নদীর ধারে একটু ইয়ে করা সেসব এদের দিয়ে হচ্ছিল না। তারওপর কাজের বাড়ির দিদিমনিদের দেখে দেখে সে বেশ চৌখস হয়েছে। তাদের দাক্ষিণ্যে বেশ ভালো ভালো পোশাক এবং লিপস্টিক জুটছে প্রায়ই। তা হোক না সে দিদিমনিদের ব্যবহার করা। জিনিসগুলো তো খাসা। সে সব পরে বেবুনের মত ঠোঁটের ভঙ্গি করে সেলফি তুলতে শিখেছে ওই ইংলিশ মতন দিদিমনিদের দেখে। প্রথম প্রথম অবশ্য বুঝতে পারেনি, ভেবেছিল লাল, বেগুনি লিপিস্টিক লাগিয়ে অমন বিচ্ছিরি মুখ করে ছবি কেন তোলে সুন্দর মেয়েগুলো! পরে নিজের স্কুলছুট বুদ্ধিতে বুঝে গেল যে ওটাই এখন ইস্টাইল। অর্থাৎ কিনা বাজারে চালু ব্যাপার। তারপর থেকেই ফুলি বেশ রঙীন প্রজাপতি হয়ে ফড়ফড়াতে শুরু করল। পড়াশোনা তার কোনকালেই ভালো লাগত না। তাই সংসারের প্রয়োজনে যেই মা তাকে কাজের কথা বলেছিল সে যেন বেঁচে গেল। প্রাইমারির গন্ডি কোনমতে পেরিয়ে এই ঠিকে কাজে ঢুকে সে হাতে স্বর্গ পেল। বুদ্ধি তার বরাবরই একটু বেশি। সে সব বুদ্ধি পড়াশোনা করে বেকার নষ্ট না করে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার কাজে লাগাতে এই বয়সেই শিখে গেছে। রুমিদের বাড়িতে ঠিকে কাজের পাশাপাশি রান্নার মেয়েটিকে হাতে হাতে সাহায্য করে বেশ উপরি দু পয়সা রোজগার হয়। এই করেই তো ফোন কিনলো। রুমিদের পুরনো টিভিটাকেও বাগিয়ে নিয়েছে। জীবন এখন ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু ফুলির তো ঠিকঠাক হলে হবে না। জীবনটা রুমিদের গাড়ির মত সাঁ করে চলবে এমনটাই ফুলির স্বপ্ন। সে স্বপ্নকে গাছে চড়িয়েছে ওই সিরিয়াল। ‘যে আপন সে পর’ সিরিয়ালের নায়িকা বস্তির ঠিকে ঝি থেকে যদি একলাফে বাবুদের বাড়ির হিরো চরমের মত একখানা পরম সুন্দর ছেলের বউ হতে পারে, তাহলে ফুলি কেন পারবে না? এই দিবাস্বপ্ন সত্যি করার তাগিদেই সে ভাবে যে একখানা সলিড মত পেরেম যেন ঠাকুর তাকে করে দিতে পারে। বুড়ো বটের থানেএই মানত করে ফি সোমবার বাতাসা পুজো দিচ্ছে ফুলি আজ একমাস হল।
তাই আজকাল মদন মুদি তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে কাছে ডাকলেও সে ধরা দেয় না। বরং একটু ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ নাচিয়ে বলে,’আজ বসে গপ্পো করার টেইম নাই গো। রুমি দিদিমনির ডেরাইভারের আসার সময় হল। দিদিমনি বেরুবে।’ বলেই গা দুলিয়ে হাঁটা দেয়। মদনা কাকু ভেবেছেটা কি? আর ফুলি ছোটটি নেই যে দুটো চকলেটের বদলে হামি খেতে দেবে। তার হামির এখন অনেক দাম। যত্ন করে রেখেছে। যাকে তাকে বিলিয়ে দিলে হবে। তাছাড়া সেই শেষবারে হামি খাওয়ার সময় মদনার বাসি মুখের সেকি বিচ্ছিরি গন্ধ। ফুলির তো গা গুলিয়ে উঠেছিল। ম্যাগো! ছোট থেকেই ফুলির এক দোষ। অন্যান্য গরীবের মত সে নয়। বদ গন্ধ তার মোটে সহ্য হয় না। তাই বাপ্পা বাদামওয়ালা যেদিন চুল্লু খেয়ে, ‘ফুলি মেরি জান’ বলে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিনই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সস্তার ফ্রকের বিনিময়ে একটু আধটু জড়িয়ে ধরতে দেওয়াই যায়। কিন্তু ওই চুল্লুর গন্ধ! ফুলি ওসব সহ্য করে না। সীমা বৌদির বরের মত ইংলিশ মদ খেলে ফুলির আপত্তি নেই। সে তো প্রায়ই থাকে ওদের ঘরের পার্টি হলে। সাহায্য করার জন্য। কত সুন্দর সুন্দর বোতলে কত রকম মদ। গন্ধটাও মন্দ নয়। দাম বেশি যত তত ভালো সেটা ফুলি জানে। অন্তত ওই চুল্লুর মত তো নয়ই। বৌদিরাও তো খায়। ফুলি ওইরকম ঘরের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সে আর হচ্ছে কই।
যাকগে। যা গেছে তা যাক। রুমি দিদিমনির মত সেও আজকাল নিজেকে বলতে শিখেছে চিল বেবি। মানে হল গিয়ে চাপ নিও না সন্টামনা, জীন্দেগি খুশ রাখো। এই খুশ রাখার জন্যই একটা সিরিয়ালের মত প্রেম ফুলির বড় দরকার। হয় সুন্দর নায়ক তাকে নিয়ে পাহাড়ে, সমুদ্রে বেড়াতে যাবে নয়ত হঠাৎ করেই কোন নায়কের সাথে তার মন্দিরে ধাক্বা লাগবে আর অন্যকারও নৈবেদ্যর থালা থেকে ঝরঝর করে সিঁদুর ফুলির মাথায় পড়বে। ধুস। এসব কিছুই হয় না। তবুও সারাদিনের কাজের পর ফুলি ক্লান্ত হলেও তার প্রেমের ইচ্ছে কখনো ক্লান্ত হয় না। বরং গরমকালের দখিনা বাতাসের মত ফুরফুরিয়ে মনের দরজা খুলে দেয়। বস্তির কোলাহল, মাতালের চিৎকার সব ছাড়িয়ে ফুলি একচিলতে ঘরে আরও তিন ভাই বোনের সাথে গাদাগাদি করে বসে ছোট টিভিটায় মনোনিবেশ করে। সেখানে তখন ধুন্ধুমার চলছে। ‘যে আপন, সেই পর’ সিরিয়ালের মহাপর্ব। গোলাপ নামের নায়িকা এক হাতে ঝাঁটা আর এক হাতে লঙ্কাগুঁড়ো নিয়ে সাতটা মদ্দা কে হারিয়ে হিরোকে উদ্ধার করল। হেবি বড়লোক মায়ের লালটু ছেলে তারপরই গোলাপকে কোলে তুলে একেবারে বেডরুমে। উফ। ফুলি পরের ঘটনাটা কল্পনা করেই শিহরিত হয়। এহেন ফুলির অবশেষে একজনকে মনে ধরেছে। রুমির মাসলওয়ালা ড্রাইভার রকি। কদিন বেশ চোখে চোখে কথা হল। ফুলি ভাবে ‘ছেলেটার বেশ ইস্টাইল আছে। সারা গায়ে কি সুন্দর বডি ইস্পেরের গন্ধ। এমন লোককেই চুমু খাওয়া যায়। আহা। গা ঘসাঘসি করে ফিরিতে গাড়িও চড়া যাবে। সেইমত দুজনে একদিন রুমিদের আবাসনের একটি অর্ধেক তৈরি ফ্ল্যাটে অভিসারে গেল। দুটো শরীর কাছাকাছি, আরও কাছাকাছি। কি সুন্দর গন্ধ রকির গায়ে। আবেশে চোখ বুজে ফুলি নিজের ঠোঁট এগিয়ে দেয়। তারপরেই চিল চিৎকার। বডি স্প্রের গন্ধ ছাপিয়ে বিটকেল ইঁদুর পচা গন্ধ। ফুলি ছিটকে দেওয়ালে চিপকে গেল। তার চোখ বনবন করে ঘুরছে। তারপর ওই বিটকেল গন্ধের উৎসের দিকে নজর গেল। রকির খুলে রাখা জুতো মোজা থেকেই ওই গন্ধ ছড়াচ্ছে। যা বোঝার বুঝে গেল ফুলি। এক ছুটে সোজা বাড়ি। তারপর থেকে ফুলির সিরিয়ালের মত জুতো মোজা পরা টিপটপ প্রেমিকের প্রতি অনাগ্ৰহ নামক রোগ দেখা দিল। আপাতত ফুলি হাওয়াই চটি পরা বদন বাদামওয়ার সাথেই প্রেমটা জমানোর চেষ্টায় আছে। আর যাই হোক বাদামের গন্ধ বেশ ভালো। তাছাড়া বদন কস্মিনকালেও জুতো মোজা পরে না। আজকাল ফুলি সিরিয়াল দেখাও ছেড়ে দিয়েছে। বদলে বাদাম ভাজা প্র্যাকটিস করছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন