জয়তী রায়
ভ্রমণের তালিকায় টার্কি বা তুরস্ক যোগ হওয়ার পরে বেশ উত্তেজিত হলাম। দেশটা সম্পর্কে নানা কারণে আগ্রহ ছিল। প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি সেই সঙ্গে অপরূপ ভাস্কর্যগুলি।
প্রতিটি ভাস্কর্য যেন ইতিহাসের দলিল। ইংরেজি শব্দ turkish, প্রাচীন তুর্কি শব্দ turk থেকে এসেছে। নদী পাহাড় সবুজ বনভূমি নিয়ে অপরূপ এই দেশটির বর্ণময় শোভা মুগ্ধ করে আমায়। তাই ঠিক করে ফেলি, ছোট্ট একটা ট্রিপে চলে যেতে হবে তুরস্ক। বাড়ি থেকে বলল – লন্ডন আমেরিকা না গিয়ে টার্কি? ভ্রমণ শেষে বুঝলাম, সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের দেশ হিসেবে এই দেশের কোনও তুলনা পাওয়া যাবে না।
এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য আর ইউরোপের আধুনিকতা – দুইয়ের মিশেলে গড়ে উঠেছে তুরস্কের সংস্কৃতি। সভ্যতা অতি প্রাচীন। রোমান লাতিন বাইজেন্টাইন আর অটোমান সাম্রাজ্য প্রায় ১৬০০ বছর ধরে এই দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। ভ্রমণের সঠিক সময় নির্ধারণ করা বেশ কঠিন কাজ। অনেক হিসেব করা হলেও প্রকৃতি গোলমাল করতে পারে। তবে, এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তুরস্ক ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময়। আমরা আগস্টের মাঝামাঝি সময় বেছে নিলাম। টার্কিশ এয়ার ব্যবহার করব বলে মনস্থির করলাম। ট্রাভেল এজেন্ট ভিসা থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং সবকিছুই করে দিয়েছিল, কাজেই সেই ব্যাপারে আলোচনা করে সময় নষ্ট না করে, আয়া সোফিয়া সম্পর্কে কথা বলি বরং।
টার্কি যাওয়ার পরিকল্পনা যেদিন থেকে করেছি, সেদিন থেকে দর্শনীয় স্থানের তালিকায় প্রথম দিকে ছিল ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া। অনেক ইতিহাস, অনেক গল্প আর অসাধারণ স্থাপত্য – পৃথিবীতে বিরল এই রকম শিল্পকীর্তি। কাজেই, দেখতে তো হবেই।
প্রথমে ছিল চার্চ তারপর মসজিদ। এখন জাদুঘর হিসেবে পরিচিত। সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, খুলে গেল স্বপ্নের দুয়ার। সোনার মত ঝলমল করছিল মসজিদ। আয়া সোফিয়া নামের অর্থ হল – পবিত্র জ্ঞান। পুরুষদের ফুল প্যান্ট, নারীদের লম্বা পোশাক বাধ্যতামূলক। যদি ভুল হয়ে যায়, তবে ওখানেই পাওয়া যায়।
দূর থেকেই নজর কেড়ে নেয় কারুকার্য করা বিশাল গম্বুজ, তারপরে ভিতরে প্রবেশ করে অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। প্রধানকক্ষটি বিশাল। ছাদের সোনালি গম্বুজটি মেঝে থেকে কমপক্ষে ১৫০ ফুট উঁচুতে। গম্বুজের ছাদ থেকে তারের সাহায্যে ঝুলে আছে সোনার তৈরি ঝাড়বাতি। দিনে কয়েক হাজার দর্শনার্থী এখানে ভিড় করেন। চল্লিশটি জানলা দিয়ে ভিতরে ঢুকে আসে পবিত্র আলো।
তালিকার দুই নম্বর তালিকায় ছিল, বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের জন্মস্থান আধুনিক তুরস্কের এফেসাসে। প্রাচীন সেই শহরে এসে মুগ্ধ-বিস্মিত-স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। টিকিট কেটে এফিসাসের সীমানায় ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মাঝে একটি হওয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। বহু বছর মাটির নিচে থাকার পরে, খনন শুরু করে উদ্ধার করা হয় জীবন্ত ইতিহাস। ২৫০০ বসার জায়গা সহ থিয়েটার, বিশাল লাইব্রেরি, বাড়িঘর, জল সরবরাহের পাইপ, বিলাসবহুল স্নানের জায়গা, হাম্মাম, স্মৃতিস্তম্ভ শোভিত রাজপথ, গন শৌচাগার, প্রমোদ ভবন, প্রাচীন গ্রীক শহরটি খুব সুন্দর শৈলীতে সাজানো। একোরা বা সমাবেশের জন্য স্থানটি অসাধারণ। কুয়ো, উনোন ইত্যাদি দিয়ে অপূর্ব করে সুরক্ষিত। টার্কি ভ্রমণে এই স্থান অবশ্য দেখা উচিত।
<br>চারদিনের সফরের মধ্যে খাবারের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এত ভালো খাবার খুব কম দেশেই খেয়েছি। কয়েকটি খাবারের কথা বলছি, যা আমাদের পেট এবং মন ভরিয়েছে। যেমন: বাকলাভা (বিখ্যাত মিষ্টি), একটি খেলে তারপর আর নিজেকে আটকে রাখা মুশকিল। শিস কাবাব (মাংসের তৈরি অপূর্ব একটি পদ), কফতে (ভাত এবং রুটির সঙ্গে মিটবল ভাজা পরিবেশন করা হয়),
<br><br>এছাড়া নিরামিষ পদ আছে প্রচুর। সুতরাং, টার্কি ঘুরতে গেলে, চোখের যেমন তৃপ্তি হবে রসনার তৃপ্তিও হবে তেমনই। <br>
একটা দেশ ভ্রমণ করা মুখের কথা নয়। বিখ্যাত স্থানগুলি দেখলেই শুধু হয় না, দেখতে হয় মানুষ। এই যেমন তুরস্ক। নানা রাজনৈতিক গন্ডগোল নিয়ে চলতে গিয়ে মানুষগুলি দিশাহারা। গ্রাস করেছে দারিদ্র্য। তবু সরল লোকগুলির মুখের অমলিন হাসি আছে অটুট। গ্র্যান্ড বাজারে গিয়ে অভিজ্ঞতা সুখকর হল। নাহ্, শুধু বাজার বললে কিছুই বোঝানো যাবে না। ঢাকা দেওয়া ছাদের তলায় এই বাজারে দৈনিক প্রায় পাঁচলাখ লোকের আগমন ঘটে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চয় হয়ে থাকবে এই গ্র্যান্ডবাজার।
বাজারটির ৬১ গলিতে দোকানের সংখ্যা চার হাজার। ২২ টি পথ দিয়ে ঢোকা যায়। ১৪৫৫ সালে এর প্রতিষ্ঠা। সমস্ত জিনিসের মধ্যে আমার চোখ টেনেছে রঙ বেরঙের ল্যাম্প। টেবিল ল্যাম্প, দেয়াল ল্যাম্প, ছাদে ঝোলানোর ল্যাম্প, কত রকমের বাতি। মেশিন নয়, সব হাতে তৈরি।
মশলার গলি দেখেও মোহিত হলাম। সমস্ত রকমের মশলার গুঁড়ো এখানে পাওয়া যায়।
তারপরে, চোখ টেনে নিল সিরামিক। নানা রঙ আর নকশার বাটি, ফুলদানি প্লেট পাওয়া যায়। সাদা আর নীল রঙের আধিক্য থাকে, থাকে ফুল লতা পাতার নকশা।
৪০০ বছর পরেও বিশ্বের দরবারে যার সৌন্দর্য অমলিন। রহস্যময় নীলরূপের আকর্ষণে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক সম্মোহিতের মত ছুটে আসছে এই মসজিদের দিকে। মসজিদের অপরূপ সৌন্দর্য যেন স্বপ্নময় কাব্য কথা। তুরস্কের অন্যতম শহর ইস্তাম্বুলের বসফরাস প্রণালীর তীর ঘেঁষে মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন কোলে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘সুলতান আহমেদ মসজিদ’। মসজিদের ভিতরে হাতে আঁকা টাইলসের মোহনীয় নীল কারুকার্য, দিনের বেলায় শত শত রঙিন কাচের জানালা, আর রাতে, মসজিদের প্রধান পাঁচটি গম্বুজ সহ মোট তেরোটি গম্বুজ ও ছয়টি মিনার থেকে নীল আলোর বিচ্ছুরণ এমন সুন্দর যে, লোকের মুখে মুখে মসজিদের নাম দাঁড়িয়ে যায়, নীল মসজিদ। ১৬১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে উসমানি সুলতান প্রথম আহমেদ কর্তৃক নির্মিত এই মসজিদটির স্থপতি ছিলেন মুহম্মদ আগা। মসজিদ দেখলে মনে হবে, স্থপতি বুঝি বা স্বপ্নের ভিতর দিয়ে হেঁটে বাস্তবে পৌঁছেছেন। অরূপের ভিতর দিয়ে রূপের দিকে যাত্রার এই অসাধারণ কীর্তি চোখের সঙ্গে সঙ্গে জুড়িয়ে দেয় মন।
যদি স্থাপত্যের কথা বলা যায় তবে, নীল মসজিদ তুর্কি স্থাপত্যের উপযুক্ত উদাহরণ। এর মিনার ও গম্বুজগুলো সীসা দ্বারা আচ্ছাদিত এবং মিনারের ওপরে সোনার প্রলেপযুক্ত তামার তৈরি ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের ভিতর ঢুকলে মনে হবে নীল জলরাশির মাঝে প্রস্ফুটিত পদ্ম।
মসজিদের দৈর্ঘ্য ২৪০ ফুট, প্রস্থ ২১৩ ফুট। মূল স্থাপত্য শৈলী হল এর বিচিত্র মিনার আর গম্বুজ। সুউচ্চ শক্তিশালী বর্গাকার ক্লেরেস্টরির ওপর গম্বুজ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে একে অতিশয় জমকালো ও মর্যাদাময় করা হয়েছে। মূল গম্বুজটির উচ্চতা ৪৩ মিটার। মন্দিরের ভিতরের দেওয়াল নীল টালি দিয়ে সুসজ্জিত। মিনারগুলি দূর থেকে দেখতে পেনসিলের মত মনে হয়। প্রধান চারটি মিনারের প্রতিটিতে তিনটি করে ব্যালকনি আছে। গম্বুজগুলো নীল সাদা সীসার গাঁথুনি, গম্বুজের ওপর ভাগের প্রতিটিতে সোনার প্রলেপ যুক্ত। উপরে তামা দিয়ে নকশাকৃত।
মসজিদের মাঝখানের দিকের ছাদ এবং চারদিকের দেয়াল জুড়ে ২০ হাজার অত্যন্ত উঁচু মানের টাইলস বসানো হয়েছে। এছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছে হাতে নির্মিত ইজনিক সিরামিক টাইলস।
ভিতরের পিলারগুলোতে আছে আকর্ষণীয় গল্প নকশা। গ্যালারির দেওয়ালে রকমারি ফল ও বাহারি ফুল।
প্রতিটি গম্বুজের আছে চোদ্দটি জানালা, কেন্দ্রীয় গম্বুজের আঠাশটি জানালা। ভিতরের দেওয়ালে বাহারি কারুকাজ ও নকশা চিত্রের পাশাপাশি কোরানের বিভিন্ন বাণী ক্যালিগ্রাফির নিখুঁত টানে তৈরি হয়েছে। চারিপাশের দৃশ্য অতি সুন্দর। গাছ গাছালি, টিউলিপ দিয়ে ঘেরা, নীল জলাধারের ফোয়ারা – সব মিলিয়ে প্লেস অফ ম্যাজিক অ্যান্ড ওয়ান্ডার মনে হয়।
৪০০ বছর অতিক্রম করেও, নীল মসজিদ প্রতিদিন নতুন করে বিস্ময় জাগ্রত করছে। দর্শনার্থীদের কাছে নতুনভাবে ধরা পড়ছে। এক সার্থক শিল্পের পরিভাষা ফুটে উঠেছে ইস্তাম্বুলের নীল মসজিদের মধ্যে দিয়ে।
ঐশ্বর্য আর শিল্পবোধের যুগলবন্দী এই তোপকাপি প্রাসাদ। ৪০০ বছরের বেশি পুরনো অপরূপ প্রাসাদটির সামনে চুপ করে থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। সোনা হীরে মুক্তো দিয়ে কাজ করা ছাদ মেঝে খিলান গম্বুজ। পায়রার ডিমের মত পান্না, স্ট্রবেরির মত রুবি, জ্বলজ্বল হীরের পানপাত্র। এত ঐশ্বর্য দেখে দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। সেই তো পড়ে রইল সব। কিছুই তো সঙ্গে যায় না। হারেম নিয়ে কৌতূহলী ছিলাম বেশ। হারেম শব্দ নিষিদ্ধ প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে বুকের ভিতর। ৪০০টির বেশি কক্ষ আছে। সারা বিশ্বের পরাজিত দেশের সুন্দরীদের ধরে এনে রাখা হত এখানে। সুলতানের মা ছিল প্রধান। পাহারা দেবার জন্য ছিল খোজার দল। হারেমে বিলাস-ব্যসন পুরো মাত্রায় ছিল। শৌচাগার বেশ আধুনিক ছিল। হারেমে রাখা হত বেগমদের সঙ্গে রক্ষিতাদেরও। সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য দেখার জন্য। বলে রাখা ভালো, হারেমের জন্য টিকিট কিন্তু আলাদা কাটতে হবে।
ইস্তাম্বুলের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এই প্রাসাদটির একপাশে মারমারা সাগর, আরেক পাশে বসফরাস প্রণালী। প্রাসাদটি ১৪০০ মিটার দীর্ঘ দেয়াল দিয়ে ঘেরা, যাকে রাজকীয় দেয়াল বলা যায়। প্রাসাদটির মূল আয়তন ৭ লক্ষ বর্গ মিটার। মোটামুটি দুইভাগে বিভক্ত প্রাসাদের একটি হল ভিতর দিক। অপরটি বাইরের দিক। উসমানি সুলতানদের ব্যবহৃত খাট টেবিল চেয়ার পানপাত্র আরও অনেক কিছু এখানে সংগ্রহে রাখা আছে। আছে টাঁকশাল, স্কুল, হাসপাতাল আরও অনেককিছু। দ্বিতীয় শহর এই প্রাসাদ দেখে আমরা মুগ্ধ। হজরত মহম্মদের পবিত্র দাড়ি, জুব্বা, পাগড়ি, পানের বাটি সহ প্রচুর জিনিস পুরনো পুঁথি – ইত্যাদি সংগ্রহ দেখে মন ভালো হয়ে গেল।
আরও একটি জায়গার কথা না বললেই না। ভার্জিন মেরির হাউস। ক্যাথলিক তীর্থ যাত্রীরা এটি বিশ্বাস করে যে যিশুর মা মেরি এই প্রাসাদে বাস করতেন। বিভিন্ন ফলের গাছ, ফুল, আলো, ঝর্ণা আছে। স্থানটির মধ্যে পবিত্র একটি আভা আছে, যা দেখলেই ভালো লাগে।
বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এলো। মন খারাপ লাগল। গত পাঁচদিনের সফরে তুরস্কের মত দেশের এক অংশও দেখা হয় না। তুরস্কের আছে অদ্ভুত লাবন্য। কখনও কোথাও অহমিকার প্রচার দেখিনি। মানুষগুলি সরল সহজ, আপন করে নেয়। হাসিমুখে আপ্যায়ন করে। সবসময় রঙিন ঝলমলে থাকে। একটা গোটা দিন গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কাটিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। চা, ঘরে বানানো ওয়াইন, নিজের হাতে বানানো মিষ্টি খাবার ইত্যাদি খেলাম। খুবই দরিদ্র, অথচ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাড়ি। ফুল লতা পাতার নকশা করা বাড়ির দেওয়াল। ঘরের মধ্যিখানে বড় টেবিলের উপর এমব্রয়ডারি করা টেবিল কভার। সুফি নাচ ও গানের কথা বলতেই হয়। সাদা লম্বা পোশাক পরে ঘুরে ঘুরে নাচ ও গান গাইছে। কথা বুঝিনি, কিন্তু সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম বহুক্ষণ। সব মিলিয়ে, টার্কি/ইস্তাম্বুল ভ্রমণ মনের স্মৃতি কোঠায় অমলিন হয়ে থাকবে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন