বেগম জাহান আরা
ঘুম ভেঙে যায় আবছা ভোরে। আর বিছানায় থাকতে পারে না আনিকা। ত্বরিত উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। নইলে আলসেমিতে পেয়ে বসে। তখন গড়াগড়ি করতে ইচ্ছে করবে অনেকক্ষন। যেটা হয় না প্রবাস জীবনে। সম্ভবই না। সেখানে কেউ নেই যে, চোখ মেলতেই একজন এক কাপ চা দিয়ে যাবে। আর সে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আয়েস করে চায়ের কাপে চুমুক দেবে। যে আরামটা ছোট বোন জাবিনের বাসায় পায় সে।
তখনই মনে পড়লো, চা দেনেওয়ালি তো আজ নেই। কাল ছুটিতে গেছে। মেয়েটা খুব কাজের এবং চটপটে। শ্যামলা মুখে বেসামাল লাবন্য। সেটাই ওর কাল। অনেক বাসায় থাকতেই পারে না। ত্যক্ত হয়ে ছেড়ে দেয় কাজ। তবে এখানে সে ভালো আছে। জাবিনের হাতের নড়ি এই দুলালি। তাকে ছাড়া জাবিনের চলে না।
শোয়ার ঘর লাগোয়া ছোটো ব্যালকনিতে গিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আনিকা। বেনু উঠবে একটু বেলা করে, তবেই চা পাওয়া যাবে। সে তো আবার গজেন্দ্রগামিনী। ঘুম ঠেকে উঠে স্মার্টফোনের লট বহর, মানে চার্জার, ইয়ারফোন, ওড়না, ইত্যাদি ঝুলুম ঝালুম করে হাতে নিয়ে বের হয়। স্টোর রুমের একটা তাকে সেগুলো রেখে ফোন চেক করে ধীরে সুস্থে। কী দেখে কে জানে, প্রায় একা একা মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসে খুক খুক করে। তারপর রান্নাঘরের সাথে লাগা ওয়াশরুমে যায় অনেকক্ষণের জন্য। মানে ওর ব্যাপার স্যাপার একটু আলাদা। জাবিনের পেয়ারা কাজের লোক সেও। রোজ একবার সারা গায়ে তেল মালিশ করে দেয়। পা টিপে দেয়। কী যে একটা স্বভাব হয়েছে জাবিনের।
সেদিন বলেছিলো আনিকা।
শুনে জাবিন বলে, ‘তুমিও মালিশ নাও আপা। দেখবে খুব ভালো লাগবে।’
‘পাগল হয়েছিস?’
‘কেন?’
‘বিদেশে এই সব আদিখ্যেতার সময় আছে?’
‘শুনেছি বিদেশেও ম্যাসাজ আছে।’
‘তা আছে। তবে সময় হয় না, এবং বেশ এক্সপেনসিভ।’
‘তুমি একা মানুষ, আয় করো মন্দ না। এসব কথা মানায় না তোমার মুখে।’
‘কী বলিস জাবি? টাকা আয় করলেই কি সব নিজের হতে হয়?’
‘তাহলে কার হবে?’
‘এতে অন্যেরও হক থাকে।’
‘দুর ছাই বুঝি না তোমার কথা।’
‘থাক, বুঝে কাজ নেই। শোন, প্রতি মাসে নিয়মিত দুঃস্থ শিশুদের কল্যাণ ফান্ডে অনেক টাকা দিই রে। নিজের তো বাচ্চা নেই, তাই অতো ভাবি না আর।’ দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়েই পড়ে।
‘এখন আর পেছনের কথা মনে করো কেনো আপা?’
‘আঘাত ভোলা কি সহজ? আমাকে এতিম করে চলে গেলো মানুষটা মন্টির সাথে। পেছন ফিরে তাকালো না একবারও। আমার কি দোষ ছিলো তাও বলে গেলো না। এসব কি ভোলা যায়?’
‘কী হলো বলো? লং ড্রাইভে গিয়ে মরলো তো দুজনেই পাহাড় থেকে পড়ে। উচিত শাস্তি হয়েছে।’
‘থাক জাবি, মৃত মানুষ সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে হয় না।’
‘এখনও ভালোবাসো কুত্তাটাকে?’
‘বাদ দে রে।’
‘আমি তো তুমি নই, তাই বলি। তোমার কষ্টে আমি কষ্ট পাইনি?’
‘তুই যে আমার সোনা বোন। তবে ও আমাকে কী প্রচন্ড দীন অবস্থার মধ্যে ফেলে গিয়েছিলো, বল?’ ‘এখন আমার অনেক টাকা, তা সত্যি, কিন্তু সেগুলো ভোগ করার মনটা মরে গেছে।’
‘কেন আপা, তুমি আবার জীবন গড়ো।’
‘কী বলিস ছোট? বয়স হয়নি?’
‘দুনিয়া পালটে গেছে আপা। বাঙলাদেশেই এখন ছেলের বা মেয়ের বিয়ে দিয়ে বিধবা বিপত্নিক বেয়াই বেয়ানে বিয়ে করছে, এমন ঘটনাও তো আছে।’
‘তোর যতো আজগুবি গল্প। আমার এখন একা জীবনই ভালো লাগে। দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই। হারাবার ভয় নেই কাউকে। কৈফিয়ত নেবার কেউ নেই। তাতেই আনন্দ পাই। তুই যেমন সংসার জীবনে আনন্দ পাস।’
‘আমিও তোমাকে সংসারি দেখতে চাই আপা।’
‘ওসব আর হবে না বোন। তোদের কাছে আসি, এক বুক আনন্দ নিয়ে ফিরে যাই। এটাই কি কম কথা?’
আনিকা ভাবে, সুখি মানুষেরা অন্যরকম। জীবনটা যে প্রতি মুহুর্তে উজানি নৌকার গুন টানার মতো টান টান সংগ্রামের বিষয়, সেটা বুঝতেই পারে না। সহজলভ্য সুখকে গায়ে মেখে আলস্যে বিলাসে আনন্দে সময় কাটায়। শাড়ি গয়না কেনে। রেস্তোঁরায় খায়। ছেলেদের ভালো বোর্ডিং স্কুলে পড়ায়। বছরে একবার সপরিবারে ভ্রমণে যায়। বিষাদ বিষন্নতার ধার ধারে না। কে জানে কতোদিন এমন জীবন কাটাবে?
আটটার আগে ওঠে না জাবিন। ফলে ভোর পাঁচটা থেকে আটটা পর্যন্ত বাড়িটা শুনশানই থাকে বলতে গেলে। সুখি মানুষদের সুখের সংসার। ওর বর হাজারিও খুব ভালোমানুষ। আমুদেও। ছুটি ছাটা পেলে কেউ তাকে ঘরে রাখতে পারবে না। পরিবার পরিজন নিয়ে যাবেই যাবে কোথাও। বেশ আছে দুটিতে। দুটো ছেলে, দুটোই রেসিডেনশিয়াল স্কুলে পড়া লেখা করে। এটাই কেমন যেন লাগে আনিকার। কিন্তু সুখি পরিবারের অঙ্ক বোধহয় আলাদা। আসলে বাবা মায়ের সুখ দেখলে বাচ্চারাও সুখি থাকে। কেমন আরাম আরাম বাতাস বয়ে যায় গায়ের ওপর দিয়ে। ভরে থাকে দেহ মন।
দু’দিন আগে এসেছে একটা বুয়া। নাম চম্পা। চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে আসে কোণার ঘর থেকে। এখনও জানে না চায়ের সরঞ্জাম কোথায় থাকে। ফলে ওর দ্বারা চা-ও পাওয়া যাবে না। তার সাথে কথা বলতে গিয়েই কাল প্রথম জানা গেলো, ওরাও আজকাল ঢাকাতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে শেয়ার করে থাকে। তিন বছর হলো ঢাকায় আছে। প্রত্যেক ঘরে চার পাঁচজন করে থাকে হোস্টেলের মতো। প্রতি ঘরে একটা করে বাথরুম সংলগ্ন। কমন একটা রান্নাঘর আছে। সবাই রাঁধে পালা করে। এমন বাড়ি পাঁচ ছয়তলা হলেও লিফট থাকে না।
ফ্ল্যাট ভাড়া করে কয়েকজনে মিলে ঢাকায় থাকা শুরু করেছিলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা। শহরের নতুন সংস্কৃতি। হুড়মুড় করে গজিয়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আবাসন সমস্যার সম্মুখীন হয় ছেলেমেয়েরা। সবারইতো আর আত্মীয় স্বজন ঢাকায় থাকে না। তখন তারা বুদ্ধি করে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার চলন করে। তো ছেলেদের বেলায় সমস্যা না হলেও মেয়েদের বেশ সমস্যা হয়েছিলো বাড়ি ভাড়া নিয়ে। কয়েকটা মেয়ে একসাথে থাকবে, এমন অবস্থায় কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। কেরিয়ার উইমেন্স হোস্টেলে আর কতই জায়গা? বাকিরা তাহলে থাকবে কোথায়? কয়েক বছরের মধ্যেই সব অন্য রকম হয়ে গেলো। প্রয়োজন কিছুই মানেনি। জীবন ঘষে আগুন জ্বালালো তারা। বলতে গেলে, মফস্বলের ভিরু মেয়েরাই ভেঙে দিলো সংস্কারের দেয়াল। এখন এসব সাধারণ ব্যাপার।
এবার শুধু সংস্কার নয়, শ্রেনির হীনমন্যতা নির্মূল করার লক্ষে সংগ্রামের দায় নিয়ে উঠে এসেছে বাসায় কাজের গৃহকর্মীরাও। কাজের সন্ধানে অনেকেই ঢাকায় আসে। দিন রাতের বাঁধা লোক হলে মালিকের বাসাতেই থাকা যায়। কিন্তু ছুটো মানে, খন্ডকালিন হলে কাজ সেরে বাসায় ফিরতে হয়। কার বাসায় কে কত দিন থাকতে দেবে? খুঁজে নিতেই হয়েছে সমাধান। অতএব সমঝোতার মাধ্যমে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকার সাহস করেছে তারা। পুরুষ ছাড়াও এখন বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। কাজের মেয়েরা বেশ শক্ত আর সাহসি হয়েছে। কথাবার্তা চাল চলন দেখলেই বোঝা যায়। ‘এম আর’ করার কথাও জানে ওরা। ঢাকায় চাকরি খুঁজতে এসে আপৎকালে কেউ কেউ তাদের কাছে থাকে দু’দশ দিনের জন্য। বাঁধা কাজ খুঁজে পেলে ছেড়ে দেয় বাসা। চম্পা বাসা ছেড়ে এখন জাবিনের বাসাতেই থাকে।
চম্পা বলেছে পুরনো ঢাকায় সে কাজের মেয়েদের মেসে থাকতো। সেখানকার ভাড়া আরও কম। হয়তো দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়েছে। প্রতি ঘরে ৪/৫ জন রাতে ঘুমায়। সারাদিন ছুটো কাজ করে, সেখানেই একাধিক বাড়িতে খায়। নিজেদের রান্নার ঝামেলা রাখে না। কখনও সন্ধেবেলায় দুটো রুটি কিনে আনে সাথে সামান্য সবজি বা ভাজি। ব্যস। ছুটা কাজের হিসেব হলো, প্রতি কাজে এক হাজার টাকা। মানে, ঘর মোছা এক হাজার টাকা, ডাস্টিং এক হাজার, কাপড় ধোয়া এক হাজার, বাসন ধোয়া এক হাজার, রান্নার কাজে কাটাকুটি এক হাজার, ইত্যাদি। তাতে মাসে ওরা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা আয় করে। বুঝাই যাই, গ্রামে সংসার স্বামী সন্তান ফেলেই ওরা নগরে আসে রোজগারের সন্ধানে।
এরই মাঝে প্রেম পিরিতির ঘটনাও ঘটে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সংস্কৃতির নতুন এক দিক উন্মোচিত হচ্ছে। সূত্রপাত করেছে গার্মেন্টসের কর্মীরা। তারাও মেস করে থাকে ব্যাপক হারে। ভালো মন্দের প্রশ্ন নয়, এটাই বাস্তবতা। আনিকার যৌবনে দেখা সেই ঢাকা এখন বদলে গেছে একেবারে। ভালোই হয়েছে। শোষন বঞ্চনার পেষন ঠেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে মেয়েরা পথে বেরিয়েছে। কোনও শোষক তো ওদের পথ দেখাবে না।
চম্পার হাঁটা একটু অন্য রকম। দুইপাশে দুলে দুলে হাঁটে। কেমন যেন পুরুষ পুরুষভাব তার চলায়। দুই পায়ের মধ্যে অনেকটা ফাঁক থাকে হাঁটার সময়। দেখলে একটু অস্বস্তি লাগে আনিকার। অন্যদিকে, বেনুর হাঁটা অন্যরকম। ফুটবল খেলার মতো পা একটু সামনে ছুঁড়ে ছুঁড়ে হাঁটে। লক্ষ করে দেখলে অদ্ভুত লাগে। জাবিনও তো কেমন করে হাঁটে। পা দুটো ভেতর দিকে চলে আসে। ওর বর, জাকিরের হাঁটা তো একেবারে চার্লি চ্যাপলিনের মতো। তার নিজের হাঁটা শো-বিজের মেয়েদের সেই ক্যাটস ওয়াকের মতো না হলেও ব্যালানসড। তাদের এক টিচার ছিলেন রাজসাহি কলেজে, জুতো মচমচিয়ে সামান্য সামনে ঝুঁকে দাপটের সাথে তিনি হাঁটতেন। ইতিহাসের ম্যাডাম হাঁটতেন স্যান্ডাল ছেঁচড়ে। যেনো অনিচ্ছা সত্বে হাঁটছেন। আনিকা ভাবে, এই জন্যই কি কনে দেখার সময় মানুষ মেয়েদের হাঁটা দেখে? সত্যি, কতো রকম ভাবে হাঁটে মানুষ? হাঁটা কি মানুষের চরিত্রের প্রতিফলন প্রকাশ করে? হয়তো করে। কিন্তু এসব ভাবছে কেনো সে? চা-শূন্য সকালই তাকে নস্টালজিক করেছে।
একতলা দোতলা মিলে বড় বাড়ি জাবিনের। ঝাড়া মোছার জন্যই লাগে একজন মানুষ। একজন রান্না করে। একজন বিছানা করে এবং তোলে, কাপড় ধোয়, ইস্ত্রি করে। একটা ছোট ছেলে আছে, সে হাজারির পিছে ছায়ার মতো থাকে। সকালে গা ডলে দেয় কিছুক্ষণ। নেংটির মতো কালো একটা জাঙ্গিয়া পড়ে শুয়ে থাকে হাজারি। বিশ্রি লাগে আনিকার। দিনের মধ্যে হাজারবার ডাক শোনা যায়, জসীম, কই গেলি?
মাঝে মাঝে কেউ একজন ছুটিতে গেলে বাকিরা টেনে তোলে সংসারের কাজ। তাই চারজন লোকই রাখে জাবিন। মানে ছোটখাটো একটা কারখানা বাসায়। মাঝে মাঝে খিটিমিটিও লেগে যায়। সামলাতে হয় জাবিনকে। বেশ পরিপক্ক হয়েছে মেয়েটা।
বাসায় প্রায় দিন অনেক লোকজন, বন্ধুবান্ধব আসে। নাশতা তো দিতেই হয়, মাঝে মাঝে দুপুরেও খায় তারা। সেটা হিসেবের মধ্যে ধরেই রান্না হয় বাসায়। কাঁচা পাকা খাবারে ঠাসা থাকে তিনটে ফ্রিজ। কাজের বুয়ারাই ম্যানেজ করে সব। তবে জাবিনও পাকা গিন্নি। তদারকির ওপরেই থাকে। সংসার খুব ভালোবাসে মেয়েটা। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, বিকেলের হালকা নাশতা, রাতের খাবার, সব মেনু তার। বাজারের লিস্টও করতে হয়, মানে নিজেই করে।
একদা গান গাইতো জাবিন। সব গেছে চুলোর দক্ষিন দুয়ারে। স্টোররুমে পড়ে থাকে বেচারা হারমোনিয়াম। কিছু রিড খুলে পাশে পড়ে আছে। তবলা বাঁয়া ফেঁসে আছে সেই কবে থেকে। বিঁড়ে দুটো কেটে ছিঁড়ে ছড়িয়ে রেখেছে ইঁদুর ছানারা। দেখলে মায়া লাগে। আসলে বেশি সুখ আর ঐশ্বর্য মানুষকে ললিত জগতের যত্নে স্থিতি দেয় না, ভাসিয়ে নিয়ে যায় হৈ হুল্লোড়ে। চাপা পড়ে থাকে সুকুমার বৃত্তিগুলো। আবার উল্টোটাও আছে। বেশি দারিদ্র মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিকশিত হতে দেয় না। সেও ভালো নয়। আসলে ঠিক পথ যে কোনটা, সেটাই কি মানুষ খুঁজে পায়? সিরাতাল মুস্তাকিম কি সত্যি আছে পৃথিবীতে?
বাবার অনেক স্বপ্ন ছিলো জাবিনকে নিয়ে। অনেক এগিয়ে গিয়েছিল জাবিন। সব গেলো বিয়ের পর। বেঁকে গেল শিল্পী জীবনের সরল পথ। একটাই স্বস্তি। গান না গাইতে পারার জন্য ওর আফসোস নেই। হাজারি কিছু বলেনি বা করেনি। আপোসেই হয়েছে। অতি সুখ স্বাচ্ছন্দ শখ আহ্লাদই কেড়ে নিয়েছে সব।
চোখের সামনে আঁধার কেটে আলো ফুটতে শুরু করে ধীরে ধীরে। সত্যি, কী অপূর্ব এই সময়টা! না দিন, না রাত। এটাই তো ব্রাহ্ম মুহুর্ত। বাবা ফাইয়াজ আলি ছিলেন মফস্বল শহরের বিখ্যাত গানের শিল্পী। ঝাপসা ভোরে নিজের সাধনার ঘরে তানপুরা নিয়ে বসে যেতেন রেওয়াজে। বলতেন, পৃথিবীতে এমন আমির কেউ নেই, যে তাঁর এই সময়টা দাম দিয়ে কিনে নিতে পারবে। নিবিড় মগ্ন রেওয়াজের দু’ঘন্টা সময় তিনি কারও না।
মায়ের ব্যস্ততা ছিলো ছেলেমেয়ে নিয়ে। বাবার রেওয়াজের সময়টুকু মায়ের জন্য
আশীর্বাদ ছিলো। চারটে ছেলেমেয়েকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সবার নাশতার আয়োজন করে ফেলতেন। তানপুরাটা রেখেই বাবা আসতেন ভেতর বাড়িতে। নাশতার টেবিল সাজানো না দেখলে বিরক্ত হয়ে না খেয়েই চুপচাপ টিউশনিতে বেরিয়ে যেতেন বাবা। ফলে মায়েরও হতো না খাওয়া। সকাল শুধু নয়, দুপুর পর্যন্ত দিনটা নিরানন্দে কাটতো মায়ের। মুখে হাসি থাকতো না। বেশি বেশি কাজ করতেন। একটুতেই রাগারাগি করতেন ছেলেমেয়ের সাথে। এখন বোঝে আনিকা স্বামী স্ত্রীর এইসব নীরব কষ্ট এবং অভিমানের ব্যাপারটা।
পাখপাখালি কূজন শুরু করেছে মহানন্দে। নানা রকম শ্রুতিনন্দন শব্দে ভোরের হালকা আঁধার কেঁপে কেঁপে ওঠে। দুলে ওঠে সমীরণ। কার বাগান থেকে যেন হালকা সুবাস আসে ভেসে সকালকে স্বাগত জানাতে। আমেজে ভরে যায় ব্যালকনিটা। ফোনের ঝুলে থাকা গুচ্ছ তারের ওপর বসে দু’একটা কাকও ডাকে কর্কশ কন্ঠে। রাস্তার ধারেই বাসা। তারপর আবার বাড়ি। এই অঞ্চলে সবগুলোই ছয়তলা। হঠাৎ কোনও ধনাঢ্য ব্যক্তি চৌদ্দ তলা বাড়ি বানাচ্ছেন ডানদিকে। সেটাই ব্যতিক্রম। সারারাত সেখানে বেশ বড়ো তিনটে উজ্জ্বল আলো জ্বলে। সূর্য উঠে গেলেও সেগুলো জ্বলতে থাকে। কি অপচয়! বিরক্ত লাগে আনিকার। আবছা ভোরের আমেজটা মাটি করে দেয়।
ব্যালকনির পাঁশে তাদের বাড়ি ঘেঁষা বেশ কটা গাছ। মেহগনি, দেবদারু, আম, জারুল এবং নিম গাছ একেবারে জড়াজড়ি করে থাকে। কেউ তো যত্ন করে লাগায়নি। এতিমের মতো আপনি হয়েছে। আপনি বেড়েছে। গাঢ় সবুজ রঙের পাতা কেমন কালচে দেখায় ভোর ভোর সকালে। বারোমেসে আম গাছের একপাশে কয়েকটা কালচে আমের গুটি দেখা যায়। এই গাছটা আনিকার খুব প্রিয়। হতভাগা দেশ। নইলে গাছটা নিয়ে গবেষনা হতো। গাছটার কলমে নার্সারি ভরে থাকতো। আহা, কী মজা হতো বারো মাস আম পাওয়া গেলে!
দেবদারু গাছের নিচে মানুষের পদশব্দ শোনা যায় এই আঁধার সকালে। কিশোর ছেলে ওরা। আসে গাছের পাতা ভেঙে নিতে। বেশ অনেক পাতা নেয় রোজ। বিক্রি করবে ফুলের দোকানে। এটাও একটা পেশা। বিনে মূলধনের কারবার।
বেচারা গাছ। নীরবে সহ্য করে নিষ্ঠুর ব্যবসায়িদের উতপীড়ন। প্রতিদিন।
সকালের বাতাসে মেহগনি গাছের কোমল ডালগুলো পাতাভরা মাথা বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ললিতকলার শিল্পীদের মতো হিল্লোলিত আন্দোলিত হচ্ছে। যেন অকারণ খুশির দোলায় বান ডেকে যাচ্ছে সারা শরীরে। আনন্দের উল্লাসে পরস্পরের গায়ে উপচে পড়ে ঢলাঢলি করে কোমল শাখাগুলো। আম গাছের শক্ত কর্কশ ডাল তেমন দোলে না। তবে নড়াচড়া বোঝা যায়। আমের মরসুম শেষ। নিস্ফলা গাছগুলোকে এখন রুক্ষ্ম এবং রাগি রাগি লাগে দেখতে।
পাশেই আমগাছের গলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে জারুল গাছ। দৃষ্টিনন্দন বেগুনি জারুল ফুলগুলো প্রায় ঝরেই গেছে। এই গাছের ডালে পায়রাদের আড্ডা জমে ওঠে দুপুর বারোটার দিকে। পড়শি বয়সি মহিলা তার দোতলার ছাদে রোজ এই সময় দানা ছিটিয়ে দেয় ওদের জন্য। মাটির দুটো সরায় পানিও ভরে দেয়। অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছাদের ওপর শ-দেড়েক পায়রা। বাকবাকুম করে সে কী আনন্দে ঘুরে ঘুরে তারা দানা খায়, পানি খায়। কয়েক মিনিটেই সমাপ্ত হয় খাদ্য উৎসব। তারপর উড়ে যায় পতপত করে কোথায় কে জানে। দৃশ্যটা বড্ড সুন্দর লাগে আনিকার। সবচেয়ে ভালো লাগে, কেউ ওদের তাড়া দেয় না। ধরে খাওয়ার চেষ্টা করে না। নির্ভয়ে আসে, খায়, উড়ে যায়। প্রত্যেক দিন।
রাস্তার কোণায় ফুল ফোটানোর পাগলপারা মৌসুমি খেলায় উন্মাদ গাছটা ঝরে পড়ে গেছে। বেচারা গাছ। কৃষ্ণচুড়া তো নয়, টকটকে লাল ফুলের আগুন ধরে যেত গাছটায়। পাতা দেখা যেত না। বৈশাখের খরতাপ লাগতো না তার গায়ে। বরং আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতো তার রঙ। এমন ফুল ফোটানো গাছ আনিকা আর দেখেনি। জাবিন বলেছে ঝড়ে গাছটা উপড়ে যাওয়ার কথা। আহা, কী যে কষ্ট লেগেছিলো তার। গন্ধ না থাকলে কী হবে, রূপেই বাজিমাত।
জাপানে চেরি ফুলের মৌসুমে ফুলে ভরা গাছের ছবি দেখেছে সে। ইচ্ছে আছে স্বচক্ষে দেখার। কপালে আছে কী না, কে জানে? আগামি বছর জাপান যাওয়ার ইচ্ছে আছে আনিকার। কোমাকি সানের আমন্ত্রণ আছে।
কার্নিশে কখনও কাক দম্পতি হঠাৎ আসে। সে কী ব্যাস্ত সমস্ত ভাব! যেন সারা পৃথিবীর কাজ তাদের ঘাড়ে। দু’দন্ড বসে থাকার জো নেই। কাকরতির দৃশ্যও দেখেছে আনিকা দু’একদিন। অদ্ভুত দৃশ্য। মুর্তেই লীলা শেষ। কাকের মতোই কাজ। তারপর ডানা ঝাপটে উড়ে যায়। এই চটুল চনমনে উচাটন স্বভাবের কাকেরা প্রজন্মের জন্মের ব্যাপারে অসম্ভব কৌশলী। চতুরও বলা যায়। পরিশ্রম করতে চায় না। কোকিলের বাসায় তাদের ডিম খেয়ে, নিজেরা ডিম পেড়ে আসে কোকিলের বাসায়। ব্যালকনিতে কিছু রোদে দেয়ার উপায় নেই কাকদের জ্বালায়। বেপরোয়া ভঙ্গিতে উড়ে এসে হানা দেবেই।
নাহ। বেলা উঠে যাচ্ছে। বেনু এখনও উঠলো না। চায়ের তৃষ্ণা পাচ্ছে আনিকার।
পুবের আকাশ লালচে হয়ে উঠেছে। মেহগনি আর দেবদারু গাছের মাঝখান দিয়ে উঁকি দেবে সুয্যিমামা একটু পরেই। সেই আলোটা এসে লাগবে ঠিক তার চেয়ারের পেছনে। যেন কেউ অতি উজ্জ্বল টর্চ দিয়ে দেখছে কিছু। তখন আর থাকে না সে ব্যালকনিতে। উঠে আসে তার ঘরে, মানে গেস্টরুমে।
ভাবনায় ব্যাঘাত হয় কিছু একটা পতনের শব্দে। রান্নাঘর থেকে এল শব্দটা। নিস্তব্ধ বাড়িতে শব্দটা একটু বেশিই আওয়াজ তোলে। সাথে সাথে আতঙ্কসূচক একটা চিৎকার, ‘গেসে গেসে আমার মোবাইলটা এক্কেরে গেসে গো।’
মনে হচ্ছে গজেন্দ্রগামিনীর কন্ঠস্বর। আনিকা গা করে না। ওর হাত থেকে প্রায় জিনিসপত্র পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার, ‘হায় আল্লা কী অইলো আমার!’ রাগে গর গর করতে করতে জাবিন বলে, ‘তোর আবার কী হবে, গেলো তো আমার সেট-এর বাসন। তোর বেতন থেকে কেটে নিতে হবে দামটা।’
অমনি আরো জোরে কেঁদে বলে, ‘আমি ইসসা করে ফেলিনি গো আম্মা। বিশ্বাস যান। কেমুন কইর্যা যে পইড়া গেলো!’
‘বেতন থেকে জিনিসের দাম কেটে নিলে আর পড়বে না। ছোটোলোকেরা পেটে লাথি দিলে ভালো বোঝে।’ নির্বিকারভাবে বলে জাবিন।
সত্যি সত্যি ভাঙা বাসনের দাম কেটে নেয় কিনা জাবিন, তা জানে না আনিকা। তবে কথাটা বড্ড অমানবিক লাগে। কী বিশ্রি করে বললো! গতরাতে অতিথি ছিলো। জমা রাখা হয়েছিলো অনেক এঁটো বাসন। জাবিন আগেই বলে রেখেছে, ‘সাবধানে ধুবি বাসন। এগুলো ভাঙলে পিঠের চামড়া উঠিয়ে নেবো।’
ইস, আনিকার কানে কেউ যেন তপ্ত শীসা ঢেলে দেয় এমন শব্দাবলী। তারই বোন হয়ে জাবিন এই ভাষায় কথা বলে? পারে কী করে? ভালো লাগে না তার। ইচ্ছে করলে সে হোটেল কিংবা গেস্ট হাউসে থাকতে পারে। তাহলে জাবিন কষ্ট পাবে। সেও পাবে। দেশে এসে একা একা থাকার কোনও মানে হয় না। এখানে তার আরাম আছে, আনন্দ আছে। ছেলে দুটো আসবে দুই সপ্তার জন্য। একটা আনন্দঘন পারিবারিক পরিবেশ হবে। এসবের দাম আছে না?
আজ বোধ হয় ঊষাকালীন চা নেই কপালে। বেনু নিশ্চয় তার ফোন নিয়ে ব্যস্ত। দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়। মনে হয় বেনু নিচে যাবে ড্রাইভার মামার কাছে। ছেলেটা ভালো। পরিবারের সদস্যের মতো তার আচার আচরণ। ড্রাইভিং ছাড়াও জাবিনের ব্যক্তিগতো কাজ-টাজ করে দেয়। কাজের বুয়াদের পান কেনা, বাদাম চানাচুর কেনা এবং কখনও সিঙাড়া জিলেপিও এনে দেয়, যদি জাবিন বাড়িতে না থাকে। ওর বাড়ি সিলেট। নাম মফিজ। সে নাকি হাসন রাজার গান গাইতে পারে। একদিন শোনার ইচ্ছে আনিকার, কিন্তু জাবিন চায় না। বলে, ‘ওদের এত আস্কারা দিতে নেই আপা।’ অবাক লাগে। জাবিনটা সামন্ত প্রভুর মতো হয়ে গেছে। অযাচিতভাবে মানুষের বেশি টাকা হলে বুঝি এ রকমই হয়।
সত্যি যা ভেবেছিল তাই। বেনু ভাঙা ফোন নিয়ে নিচে গেছে। মফিজ ছাড়া গতি নেই এখন। জাবিন জানতে পারলে খবর আছে। ওদের নিষেধ আছে নিচে যেতে। নিচে দারোয়ান আর ড্রাইভারের আড্ডা। কাজের মেয়েদের সামলে না রাখলে দোতলার রায়হান সাহেবের মতো বিপদে পড়তে হবে। শেষে দারোয়ানের সাথে বিয়ে দিতেই হল তাঁর কাজের মেয়ে বুলির সাথে। কথা রটলো, কার পাপ কার ঘাড়ে চাপালো। কী অকাতরে সন্দেহ করে কথা বলে মানুষ। ফ্ল্যাট বাড়ির এই এক ঝামেলা। কথার বাচ্চা গজাতে সময় লাগে না। শুধু কাজের লোকেরা নয়, ফ্ল্যাটের মানুষেরাও কম যায় না।
বিষয়টা অরুচিকর লাগে আনিকার। ছোট পরিবেশে মানুষের মনও ছোটো হয়। পাশাপাশি যদি থাকে দারিদ্র এবং অশিক্ষা, তাহলে আরও জটিল হয় সব কিছু। কাজের লোকদের দোষ কী? জন্ম থেকেই এরা অপরাধ এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস দেখে বড়ো হয়। মিথ্যে বলা শোনে। হিংসে করা শেখে। কারও ভালো দেখতে পারে না। নগন্য কথায় ঝগড়া ফ্যাসাদ, কুট কচালি, মারামারি, মামলা মকদ্দমা দেখে দেখে ভাবে এটাই জীবন। এই সবের ওপারেও যে অন্য রকম সুশীল জীবন থাকতে পারে, তা ভাবতেই পারে না। দেখলেও শেখে না। মনে জন্ম নেয় না সুবোধ জীবনের আকাঙ্ক্ষা।
মনটা খারাপ হয়ে যায় এই সব কথা ভাবলে। জাবিনের ইচ্ছে, আনিকা দেশে এসে সেটল করুক। শুনে আতঙ্কিত হয় আনিকা। দেশে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছে সে। তার বাবা বিদেশ থেকে ডিগ্রি করে দেশেই ফিরে এসেছিলো। তখনকার রেওয়াজ ছিলো ওইরকমই। এখন যে দেশ ছেড়ে যায়, সাধারণত সে থেকে যেতেই চায়। আনিকা নিজেও চেয়েছিলো দেশে ফিরতে। তার মানুষটা ভন্ডুল করে দিলো সব। দেশে আর ফেরা হবে না। দু’তিন সপ্তার জন্য জন্মভুমিতে বেড়াতে আসা ঠিক আছে। কিন্তু জাবিনের মতো সংসার পেতে বসা অসম্ভব।
হাজারি আজ সকালে বেড়াতে যায়নি। করোনার সময় হোম অফিস সাজাতে হয়েছিল, সেখানেই মাঝে মাঝে কাজ করে। বেশি রাত হলে ঘুমিয়েও পড়ে। কাজ নিয়ে জাবিনের সাথে বচসা নেই। সারা বাড়িতে একটা আরামের বাতাবরন। জসীম গা ডলে দিচ্ছে। সাড়া পাওয়া যায়। নিঝুম বাড়িতে একটুতেই সাড়া ওঠে।
আচমকা জসিমের আর্ত চিতকারে সারা বাড়ি কেঁপে উঠলো। সাথে সাথেই বিদীর্ন হয়ে গেলো প্রাতঃকালিন স্তব্ধতার নিভাঁজ ঘোর। ঠিক তখনই সুর্যিমামা নাফিসার চেয়ারের পেছনে টর্চ ফেললো। প্রাতঃকালীন স্তব্ধতার আবছা ঘোমটা। মনে হলো ছিঁড়ে গেল ফালা ফালা হয়ে।
রক্তাক্ত জসিম দৌড়ে যেতে চাইলো নিচে। ধরে ফেললো হাজারি।
‘চুপ হারামজাদা। মেরেই ফেলবো তাহলে।’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন