short-story-pichhudaak

পিছুডাক
অজিতেশ নাগ



সিনেমাতে তো এমনটা হরবকতই দেখা যায়। একটা শুনশান সমাধিস্থল। প্রচুর শুকনো পাতা পড়ে আছে, যার বিপুল পরিমাণ প্রায় ঢেকে দিয়েছে পুরো সমাধিক্ষেত্রটাই। আচমকা দমকা হাওয়া এবং কিছু পাতা উড়ে গিয়ে আবছা দেখা যাচ্ছে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্ম-মৃত্যু তারিখ। শ্যুটিঙে সেই হাওয়া হয়ত পেডেস্ট্রাল বা স্টর্ম ফ্যানের দৌলতে। কিন্তু বাস্তবেও এমনটা হয় সুধারঞ্জন টের পেলেন। ছবিটা পাওয়া ইস্তক এমনটা বোধ হল। অনেকটা ধুলো সরসর করে সরে গিয়ে একটা আবছা মুখ ভেসে উঠল। যেন অনেক কালের সিন্দুক খুলে ধুলো ঝেড়ে ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া একটা শতছিন্ন ইতিহাসের পাতা। সুধারঞ্জন ছবিটা উল্টে পিছনে দেখলেন – লাল ফাউন্টেন কালিতে লেখা ২৮শে মাঘ ১৩৭৭। আবার সামনে ঘোরালেন। একজন বছর সতের-আঠেরর দুই বিনুনি করা মেয়ের ফটোগ্রাফ, যার অনেকটাই কালের অবক্ষয়ে মুছে গিয়েছে। সুধারঞ্জন অস্ফুটে বিড়বিড় করলেন, নীহার, আমার নীহার!

এবার সুধারঞ্জনের বিষয়ে একটু বলে নেওয়া দরকার। সুধারঞ্জন সেনগুপ্ত অবসর নেওয়া একজন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। রিটায়ার করেছেন এই বছর ছয়েক হল। বিয়ে-থা করেননি। থাকেন উত্তর কলকাতায় অনাদিচরণ মিত্র লেনে। গলিতে ঢুকলে যেখানে সরু গলিটা বাঁদিকে বাঁক খেয়েছে তার একটা বাড়ি আগে ডানদিকে সাদা-মেরুন রঙয়ের একতলা বাড়িটা সুধারঞ্জনের। পৈত্রিক বাড়ি ছিল আমতায়। রিটায়ার করার অনেক আগেই সুধারঞ্জন চলে আসেন উত্তর কলকাতায়। সুধারঞ্জনের দুই ভাই, তিন বোন। সবাই বিয়ে করেছেন, একটি দুটি বাচ্চা সবারই, তাদেরও ছানাপোনা সাবালক হয়ে গেছে। তাই পৈত্রিক বাড়িটির অধিকার সুধারঞ্জন ছেড়ে দিয়েছেন। কী করবেন সম্পত্তি নিয়ে? উত্তর কলকাতায় এই বাড়িটা সুধারঞ্জন কিনে রেখেছিলেন তা প্রায় আজ থেকে বছর তিরিশ আগে। তখন আলাদা স্বপ্ন ছিল, ইঁট-সিমেন্টের বাড়ি নয়, একখানা বাসার। যাক গে। আসলে কেউই জানে না, কেন সুধারঞ্জন আর আমতায় থাকতে চাইছিলেন না। অনেক ফিকে স্মৃতি, অনেক অস্পষ্ট সুখের রেণু কণা কণা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল আমতায়। যাই হোক, এখানে সুধারঞ্জন একাই থাকেন। রান্নাবান্নার ঝামেলা রাখেননি। হোম ডেলিভারিতে চালিয়ে নেন। আর খাওয়াই বা কী! দুপুরে সামান্য ভাত, মাঝের ঝোল, রাতে দুটো রুটি আর সব্জি। চা-কফি নিজেই বানিয়ে নেন। সুধারঞ্জন জানেন জীবনের বেলা যত গড়ায় ততই নিজেকে ভারমুক্ত রাখতে হয়। শরীরে যত ভার দেবে, মাধ্যাকর্ষণ ততই তোমাকে মাটির দিকে টানবে আর সেটা হলেই বিছানায় শুয়ে পড়া অনিবার্য। তাই সকালে উঠেই প্রাতঃভ্রমণ। আর ফিরেই বড় কাপের এক কাপ ব্ল্যাক কফি। ব্যস।

সুধারঞ্জনের শরীরটা আজ ঠিক নেই। অঘ্রান শেষ করে পৌষ ডাক দিচ্ছে। এই সময়টা ওয়েদার চেঞ্জের জন্যই বোধহয় একটু সর্দি সর্দি ভাব আসছে। অন্য কেউ হলে সোজা না করে দিতেন কিন্তু অশ্বিনীর ডাকে না করতে পারলেন না। অশ্বিনী বাঁড়ুজ্জে সুধারঞ্জনের ছোটবেলার খেলার সাথী নয়, দীর্ঘ সাইত্রিশ বছরের কর্মসূত্রে বন্ধু। একই অফিসে এতগুলো বছর কাটিয়েছেন। অনেক সুখ, হাসি, আড্ডা, রসালোচনা, কষ্ট, যন্ত্রণা ভাগ করে নিয়েছেন দুজনে দুজনার। রিটায়ার করার পর সেই অশ্বিনী এখন মালবাজারে। একমাত্র মেয়ের কাছে। ফোনে আলাপ হয় মাঝে মাঝেই। অনেক বার করে বলেছিলেন অশ্বিনী, ওঁর মেয়ের বাড়ি যেতে, যাচ্ছি যাব করে যাওয়া হয়নি। গত পরশু ওর মেয়ে ফোন করে জানাল, বাবা গুরুতর অসুস্থ। মেজর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। সুধারঞ্জনকে দেখতে চাইছেন।

প্রাণবন্ধুর এই খবর সুধারঞ্জনকে বিচলিত করে তুলেছে। তাড়াতাড়ি তৎকালে টিকিট কেটে ফেললেন কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের। শিয়ালদা থেকে নিউ মাল জংশন। কিন্তু আজ যাত্রার দিনে সুধারঞ্জন নিজের শরীরটাই ঠিক বুঝছেন না। হাল্কা জ্বর জ্বর ভাব আসছে। তবে একে পাত্তা দিলে হবে না। সুধারঞ্জনকে যেতেই হবে, দরকার পড়লে দু-চারটে প্যারাসিটামল বা ক্রোসিন সঙ্গে রাখলেই হবে। দরকার বুঝলে জল দিয়ে মেরে দেবেন। তাছাড়া সুধারঞ্জনের নিজের শরীর বেহাল হলে তখন যাওয়াটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তবু ভাগ্যিস এসি চেয়ার কারে টিকিট কাটেননি। থ্রি টায়ার স্লিপারে জার্নি করতে এমনিতেই সুধারঞ্জন বেশী পছন্দ করেন। এসি কমপার্টমেন্টে যেন দম আটকে আসে। আরে, যদি জানলা দিয়ে প্রকৃতির শোভা কাঁচের মত পরিষ্কার নাই দেখা যায়, কী, হাত বাড়িয়ে কোনও অজানা স্টেশন থেকে এক ভাঁড় চা-ই না খাওয়া যায়, তবে ট্রেনজার্নির মজাটা কোথায়! তবু চাকরির সুবাদে দু-তিন বার এসি টু টায়ারে শুয়ে-বসে দেখেছেন তিনি আর বরাবর লক্ষ্য করেছেন এসি’র মানুষগুলো কেমন গোমড়ামুখো হন, সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, চুপিসাড়ে কথাচালাচালি করে। একদম ভাল লাগে না। আর ঠান্ডা! সুধারঞ্জনের হাত পা কেঁপে যায়। তার উপর একজনের ঠান্ডা বেশী লাগছে তো কম কর, পরক্ষণেই কারও গরম লাগলো তো ঠান্ডা বাড়াও। উফ! লোকে পয়সা দিয়ে কেন যে এই যমযন্ত্রণা ভোগ করতে করতে যায়!

দুপুরে সুধারঞ্জন প্রায় কিছুই খেলেন না। সামান্য নাড়ানাড়ি করে উঠে পড়লেন। পরে খিদে পেলে দেখা যাবে। হোম ডেলিভারির ছেলেটা টিফিন ক্যারিয়ার ফেরত নিতে এলে বলে দিলেন, তিনি হপ্তাখানেক থাকবেন না, মালিককে যেন বলে দেয়। আর আজ রাতের খাবার দিতে হবে না। শিয়ালদা পৌঁছে কালেক্ট করে নেবেন ভেজ স্যান্ডুইচ জাতের কিছু খাবার আর ট্রেনে উঠে তো স্রেফ ঘুম। সকালেই খরবের কাগজওয়ালাকে বলে দিয়েছেন, তিনি থাকছেন না আর ধোপাকে ময়লা জামাকাপড় হস্তান্তর করা হয়েছে কালকেই।

দুপুরে কোনওদিনই সুধারঞ্জন ঘুমোন না, বইও পড়েন না। তিনি দুপুরটা কাটান কবিতা লিখে। হ্যাঁ। সুধারঞ্জন অনেক দিন থেকেই কবিতা লিখছেন। অবশ্য এ খবর জানে গুটিকয়েক কাছের মানুষ। তার মধ্যে একজন অশ্বিনী, আরেকজন মৃন্ময়। আর জানতো একজন, যার ছবি আজই সুধারঞ্জন খুঁজে পেয়েছেন। অনেকদিন পর বাইরে যাবেন বলে গুদামঘর থেকে একটা ট্রলিগোছের কিছু আছে কী না খুঁজতে গিয়ে একটা মাঝারি মাপের খুঁজে পেলেন। তারই মধ্যে পেলেন একটা বাতিল পার্স আর তাতে টাকাকড়ি কিছু আছে কিনা দেখতে গিয়েই বেরিয়ে এল এই ফটোগ্রাফটা। কবে রেখেছিলেন সুধারঞ্জন অনেক কষ্ট করেও আজ মনে করতে পারলেন না।

সুধারঞ্জন কবিতা রোজ লেখেন না। যখন কবিতা আসে, তখনই লেখেন। সে সব কবিতা কোথাও ছাপার উদ্দেশ্যে নয়, কাউকে ধরে শোনাবারও নয়। নিজের খেয়ালে লেখেন তারপর যত্ন করে গুছিয়ে রেখে দেন দেওয়াল আলমারিটার তাকে। আজ অবধি ধরলে এটা বত্রিশতম ডায়েরী চলছে যাতে সুধারঞ্জন কবিতা লিখছেন। হ্যাঁ। তিনি শোনাতেন যদি সেই মানুষটা শোনার অপেক্ষায় থাকতেন। সুধারঞ্জন খেয়াল করলেন একটা কবিতা তিনি লিখে চলেছেন আজ তৃতীয় দুপুর হল। আজ শেষ করতেই হবে। সুধারঞ্জন আবার পকেট থেকে ফটোগ্রাফটা বার করলেন এবং ডায়েরীর পাশে টেবিলের ওপর রাখলেন। আজ অনেক কিছুই দিকভ্রান্ত প্রবল হাওয়ার মত মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্মৃতি যেন একটা শিরীষ কাগজের মত। যত কাহিনী, যত অভিজ্ঞতা, যত প্রবহমান সময় একবার পিছনে চলে যায়, আবার হয়ত গ্রে-ম্যাটারের অদ্ভুত খামখেয়ালে তার কিছুটা পিছলে সামনে এসে যায়, আবার পিছনে চলে যায়, আর এই প্রতিবারের আসা যাওয়ায় শিরীষ কাগজে ঘষা খেতে খেতে একটু একটু করে চিরতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে। শেষ অবধি যেটুকু পড়ে থাকে তার না থাকে কাল, না থাকে পাত্র, না সময়কালের হিসেব। মনে হয় এই তো কালকের ব্যাপার, আসলে হয়ত ঘটে গেছে বছর তিরিশ আগেই। নয়ত উল্টোটা।

বছর পনেরর একটা ভারি ডানপিটে মেয়ে, বেদম দস্যি। সেই সময়ের হিসেবে বিয়ের বয়স পেরিয়ে না গেলেও যুগ্যি হয়েছে বেশ খানিকটা। সুধারঞ্জনের মাসির বিয়েতে দেখা। আর ঐ বয়সে ভালোবাসা হয় কিনা বুঝতে পারেননি, তবে ভালো লেগেছিল তো বটেই। তা সুধারঞ্জনেরই বা দোষ কোথায়। বয়সটাই তো তখন তার ওমনি। তবে এ যুগের মতো খুল্লামখুল্লা মেলামেশা তো নৈব নৈব চ ছিল তখন। তাই মাসির বিয়ে মিটে যেতেই ভালোবাসা শেষ। সুধারঞ্জন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ব্রহ্মচর্যের পালন সে যাত্রা সযত্নে রক্ষা হল বুঝি।

ফের সেই মেয়ের দেখা পাওয়া গেল আরও মাস আস্টেক পর। গরমের ছুটি। এইবার চোখাচোখি, একটু হাসি এবং শ্রীমান সুধারঞ্জন বুঝলেন যে তিনি ডুবেছেন সখাত সলিলে। আর ফেরার উপায় নাই। যদিও সুধারঞ্জন আর ফিরতে খুব একটা উৎসাহীও ছিলেন না। সদ্যবিবাহিতা মাসির ননদের মেয়ে। অভিজাত বনেদি বাড়ি এবং গোদের ওপর সতেজ বিষফোঁড়াটি হল বংশটি ব্রাহ্মন। সুধারঞ্জন দমে গেলেন। যদিও কুমারী নীহারিকা দেবীর তাতে কিস্যু গেলো আসল না। তিনি মনপ্রাণ সঁপিয়া দেবার স্টাইলে সুধারঞ্জনের সাথে মেতে উঠলেন। সুধারঞ্জনের সব কবিতার তিনিই প্রথম পাঠিকা এবং যত্রতত্র বানান ভুল ধরে ধরে (না শুনলে প্রবল কান্নাকাটির মাধ্যমে) সুধারঞ্জনের জীবনের সাথে জড়িয়ে মড়িয়ে এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠতে লাগলেন।

‘সহস্র পাতা পরিক্রমা শেষেও যখন;

বোঝা বা না বোঝার মাঝে কিছু অবুঝ স্মৃতিরেখা চলে যায়,

শেষ পাতায় তোমার নাম দেখে নিই;

নীহার, আমার নীহার; অনন্ত প্রহর অকারণে মুছে যেতে চায়।’

অসমাপ্ত কবিতার শেষ লাইনক’টি লিখে যখন ঘড়ির দিকে তাকালেন সুধারঞ্জন তখন ঠিক চারটে। এবার উঠতে হয়। যদিও এখনও অনেকটা সময় হাতে। তবুও অফিস ট্যুরের অভ্যেস মত এখন সুধারঞ্জন একটা লিস্ট বানাবেন। তাতে ঘড়ি, পার্স, পাঞ্জাবি, পায়জামা, শার্ট, পাতলুন, রুমাল, হাওয়াই-চপ্পল, পেস্ট, টুথব্রাশ, চিরুনি মায় অন্তর্বাস অবধি। শেষ পাতে একটা রাইটিং প্যাড আর জেল পেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সাথে ট্রেনের টিকিট, তার জেরক্স। লিস্ট মিলিয়ে নিয়ে যাবেন, আবার ফেরার সময় লিস্ট মিলিয়ে নিয়ে আসবেন। না হলেই কিছু একটা ঠিক রয়ে যাবে। সুধারঞ্জন আরেকবার কবিতাটার দিকে তাকালেন। ‘অনন্ত প্রহর অকারণে মুছে যেতে চায়।’ ওখানে ‘মুছে’ শব্দটা কেটে ‘পুড়ে’ লিখলে কি যুৎসই হবে? ভাবতে ভাবতেই ল্যান্ডলাইন বেজে উঠল। নাঃ থাক। কবিতার নিচে ‘সমাপ্ত’ লিখে সুধারঞ্জন উঠে এসে ফোন ধরলেন।

‘হ্যালো।’

‘আঙ্কল, আমি জয়ীতা।’

সুধারঞ্জন শঙ্কিত হলেন। জয়ীতা অশ্বিনীর মেয়ে। তবে কী…

‘আঙ্কল শুনতে পাচ্ছেন?’

‘বল মা।’ সুধারঞ্জন নিজেকে সামলালেন।

‘আজ আসছেন তো?’

সুধারঞ্জন দম ছাড়লেন, যাক খারাপ খবর না।

তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আজ রাত্তিরে কাঞ্চনকন্যা ধরব।’

‘দেখবেন, সকাল সাড়ে সাতটা আটটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন এনজেপি। এনজেপি থেকে মাত্র একটা স্টপেজ পরেই কিন্তু নিউ মাল। মাঝে শিলিগুড়ি। খুব লেট না করলে সব মিলিয়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। একটু খেয়াল করবেন। নিউ মালে কিন্তু মাত্র দু’মিনিট দাঁড়ায় গাড়ি। আপনার কোন বগি?’

‘এস-৮।’

‘ওকে। আপনার জামাই থাকবে ষ্টেশনে। কোনও চিন্তা করবেন না। এমনিতে কাঞ্চনকন্যা ট্রেনটা ভালো কিন্তু মাঝে মাঝেই বড্ড লেট করে, বিশেষ করে ডালখোলা, কিষেনগঞ্জের পর থেকে।’

‘তুমি আমার জন্য চিন্তা কোর না মা। আমি ঠিক চলে যাব। তুমি খালি বল অশ্বিনী কেমন আছে?’

জয়ীতার গলা আচমকা বুজে আসে, ‘বাবা ভাল নেই আঙ্কল। কাল রাত্রেও বুকে খুব পেইন ছিল। বমিও করেছে দুবার। ডাক্তার বলেছেন সেকেন্ড অ্যাটাক হলে আর বাঁচানো যাবে না।’

‘জয়ীতা, আমি বলছি, শোন, শোন, অশ্বিনীর কিছু হবে না। আমি ফোন ছাড়ছি, এখন রেডি হতে হবে।’

সুধারঞ্জন ক্রেডেলে রিসিভার নামিয়ে রেখে একটু ভাবলেন। নাঃ একটু জ্বর জ্বর লাগছে সত্যি। একটা প্যারাসিটামল বের করে গিলে ফেললেন জল দিয়ে। মনে পড়ল যাঃ, আজ বিকেলেই তো কুড়ি-লিটার জলের দুটো জার দিয়ে যাওয়ার কথা। সুধারঞ্জন মিনারেল ওয়াটার খান। টিউবওয়েলের জল বা কর্পোরেশনের জল তার সহ্য হয় না। সুধারঞ্জন ফোন তুলে জানিয়ে দিলেন, যেন সামনের বুধবার জল দিয়ে যায় আর আগের তিনটে জলের দাম নিয়ে যায়। যাক। নিশ্চিন্ত। যদিও এই বয়সে আর নিজে অনেক কিছুই করতে ইচ্ছা জাগে না। কিন্তু কী উপায়? বাবা, মা, আত্মীয়, স্বজন, বন্ধুরা প্রচুর পীড়াপীড়ি করেছিল কিন্তু সুধারঞ্জন আর ছাদনাতলামুখো হলেন না। সে কী স্বইচ্ছায় নাকি প্রগাঢ় অভিমান! আজ এই বয়েসে এসে তেমন স্পষ্ট মনে পড়ে না আর মনে করতেও চান না সুধারঞ্জন।

ঘড়ি ধরে ঠিক পৌনে আটটায় বাড়ি থেকে বেরোলেন। বাড়ি তালাবন্ধ করে গলির মোড়ে এসে একটা ট্যাক্সিও পেয়ে গেলেন। ডিকিতে ট্রলিব্যাগটা ফেলে দিয়ে এবার আয়েস করে বসে একটা সিগারেট ধরালেন সুধারঞ্জন। এই একটা বদভ্যাস তিনি কিছুতেই বাদ দিতে পারলেন না। কম বয়সে অনেক খেতেন দিনে। সেই নিয়ে নীহারিকার কী দাপাদাপি, কী ধমকানি। কিছুতেই কিছু হল না। নীহারিকা গুম মেরে যেতেন। সুধারঞ্জন মান ভাঙাতে পায়ে ধরতে বাকি রেখেছেন, কিন্তু সিগারেট? ছাড়েননি সুধারঞ্জন। তবে এখন অনেক স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছেন। দিনে হয়ত একটা কী দুটো। এছাড়া আর কোন বদনেশাই নেই সুধারঞ্জনের। মদ ছুঁয়েও দেখেননি সারাজীবন। এমন কি চা-কফিরও সেই অর্থে নেশা নেই। পেলে খান, না পেলে নয়। হয়ত সিগারেটটা ছাড়তে পারলেন না নীহারিকা আর তার মাঝের একমাত্র যোগসূত্র বলে। লোকে শুনলে হয়ত বলবে ফালতু সেন্টিমেন্ট, হয়ত বলবে ধূমপানের অবধারিত বাজে অজুহাত। তবু সুধারঞ্জন সেটাই বিশ্বাস করেন অন্তর থেকে। আর প্রতিটি মানুষের কাছে তার নিজের অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত বিশ্বাসটাই চরম সত্য।

শিয়ালদা পৌঁছে প্রথমেই তিনি স্টেশনের একটা ফুডকোর্ট থেকে দুটো স্যান্ডইউচ নিয়ে চিবুতে লাগলেন। এরপর যথাসময়ে ট্রেন এবং লোয়ার বার্থ। ট্রেন ছাড়তে এখনও বেশ খানিকটা দেরী। সুধারঞ্জন বেশ গুছিয়ে বসলেন। ট্রেনে সুধারঞ্জনের কোনওদিনই ঘুম আসে না। প্রধানত দুলুনির জন্য। অনেকের আবার এই দুলুনির জন্যেই ঘুমোয়। আচ্ছা, সুধারঞ্জন ভেবে পায় না, ঘরে যদি শোবার খাট ধরে কেউ অনবরত নাড়ায়, ঘুম আসবে? তাই আধশোয়া হয়ে পড়বেন বলে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছেন। ড্রেস চেঞ্জ করার কোনও প্রশ্নই নেই, কিন্তু নিজের সিটটা অন্যের ব্যবহৃত ভাবলেই সুধারঞ্জনের গা ঘিনঘিন করে। তাই ট্রেনে উঠেই তিনি প্রথমে পরিষ্কার বেডশিট পেতে নেন, আর একখানা হাওয়া বালিশ ফুলিয়ে নেন। বার্থের নিচে ট্রলি ঢুকে গেছে। ব্যস। এবার নিশ্চিন্তি।

সুধারঞ্জনের খোপটা একদম খালি। কী রে বাবা, কেউ উঠবে না নাকি? তা না উঠলেই বেশ হয়। বিশেষ করে যাত্রী মহিলা হলে জানলার ধারের সিট চায়। আরও বিপদ। মাঝের সিটে যতক্ষণ না কেউ শুচ্ছে, ততক্ষন সুধারঞ্জনকে বসে থাকতে হবে। আবার সেখানে তাড়াহুড়ো করে কেউ শুয়ে পড়লে ঘুম না এলেও ঘাড় গুঁজে বসে থাকতে হবে। সে আরেক যন্ত্রণা। তার চেয়ে কেউ না এলে বেশ হয়। পরক্ষনেই মনে হল ছিঃ ছিঃ। এত নিতান্ত স্বার্থপরের মত ভাবনা হল।

অবশ্য সুধারঞ্জনের ভাবনায় পুরো এক বালতি জল ঢেলে দিতেই ট্রেন ছাড়ার মাত্র মিনিট খানেক আগে হইহই করে একটা পুরো ফ্যামিলি এসে হাজির। সুধারঞ্জন চোখ বুজলেন। হয়ে গেল! তবু অভদ্রতা হবে বলে চোখ মেলে দেখলেন মোট পাঁচজন মেম্বার। একটি মাঝবয়সী লোক, দেখলে বোঝা যায় অভদ্র নয়, আরেকজন মহিলা, সম্ভবত ভদ্রলোকটির স্ত্রী। সাথে একটি অল্পবয়সী মেয়ে, খুব সম্ভবত অবিবাহিতা। এঁদের সাথে একটি বাচ্চা মেয়ে আর সবশেষে যিনি কামরায় পা রাখলেন তিনি একজন সম্ভ্রান্ত দর্শন মহিলা যিনি খুব তাড়াতাড়ি প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠ পেরিয়ে যাবেন। তবু এই বয়সেও বেশ ছিপছিপে এবং চটপটে। খুব ফরসা আর হাল্কা গোলাপি পাড়ের সাদা শাড়ি পরে আছেন। যদিও এসব দৃশ্য শুধু সময় কাটানোর জন্য। সুধারঞ্জন ম্যাগাজিনটা টেনে নিলেন। অযথা লোকের সঙ্গে ভাব জমাতে পারেন না সুধারঞ্জন। একটু নিজের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। হতে পারে দীর্ঘ সময় একাকী বসবাসের অভ্যেস। আজকাল আর কাউকেই দরকারি মনে হয় না সুধারঞ্জনের। নেহাৎ অশ্বিনী, না হলে তিনি কদাপি বাইরে পা রাখতেন না।

একটু থিতু হতেই মাঝবয়সী ভদ্রলোকের চোখ গেল সুধারঞ্জনের দিকে। সামান্য হাসি, একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘ইয়ে, আপনি বাঙালী তো?’

আপাদমস্তক গৌর অঙ্গ, লম্বায় পাঁচ এগারো আর শক্ত চোয়ালের জন্য অনেকেই এই ভুল করে।

‘কিছু বলছেন?’

‘বেশ, তাহলে আপনি বাঙালী। তা যাচ্ছেন কদ্দূর?’

নেহাৎই মামুলি বাঁধা ধরা গতের প্রশ্ন। যাত্রাপথে এই সব প্রশ্নের তালিকা নিয়ে বসে যায় অধিকাংশ লোক। কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে, কোথা থেকে আসছে – এসব জেনে লোকের কী কাজ! তুই কোথায় যাচ্ছিস সেইটাই তো বড় কথা। যেখানে যাচ্ছিস যা। অন্য লোকে কোথায় যাচ্ছে তার সুলুকসন্ধান রেখে কী এমন উপকারটা হয় সুধারঞ্জনের মাথায় আসে না। তবু সুধারঞ্জন তথাকথিত ভদ্রলোক। জবাব দিতেই হল, ‘আমি যাব মালবাজার অবধি।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা, আমরা এনজেপিতে নেমে যাব।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার শুরু হল, ‘আমরা পুরো ফ্যামিলি নিয়ে গ্যাংটক যাচ্ছি, সেখান থেকে লাচুং, জিরোপয়েন্ট আর এদিক ওদিক।’

সুধারঞ্জন চুপ। চুপ না হলে পাশ কাটানো যাবে না। ভদ্রলোক দমবার পাত্র নন, মুখে সামান্য হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বললেন, ‘আচ্ছা, এক সঙ্গে যখন এতটা পথ যাচ্ছি, পরিচয় করিয়ে দিই। তাতে বাকি রাস্তা গল্প করতে করতে কেটে যাবে।’

সুধারঞ্জন প্রমাদ গুনলেন।

‘আমি অমিয় কুমার বসু, এ আমার স্ত্রী দেবযানী, আর এ আমার বোনঝি স্বাতী আর এই দুষ্টুটা আমার মেয়ে আর ইনি আমার মা।’

সবার দিকে একবার অলস দৃষ্টি ঘুরিয়ে স্বাতীর মুখে চোখ পড়তেই সুধারঞ্জন লুচিভর্তি মুখে বিষম খাবার মত চমকে উঠলেন। এ কী করে সম্ভব! একদম এক না হলেও প্রায় এক। সেই টানা চোখ, ছোট কপাল, কোঁকড়ানো চুল, হাসলে একটা গালে টোল পড়ছে, এমন কী চোখে কাজল! পরক্ষণেই সুধারঞ্জন বাস্তবে ফিরে এলেন। ধুস! এ মেয়ের বয়স মেরেকেটে আঠার কী উনিশ। আর সুধারঞ্জন ছেষট্টি পার হবেন সামনের মাঘে। সুধারঞ্জনের হাসি পেল। কিন্তু আড়চোখে ফের তাকাতে বাধ্য হল। একবার মনে হয়েছিল নীহার দাঁড়িয়ে আছে। সেই দুষ্টু দুষ্টু চোখের হাসি, মুখ গম্ভীর।

‘উনি বোধহয় একা থাকতে চাইছেন। অমিয়, ওকে ডিস্টার্ব কোর না।’

সুধারঞ্জন চমকে তাকালেন। প্রৌঢ়া মহিলা এক দৃষ্টে তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। কথাটা উনিই বলেছেন বুঝতে পেরে অপ্রতিভ হল সুধারঞ্জন। ছিঃ ছিঃ। মাত্র তো কয়েক ঘণ্টার যাত্রা। অনর্থক বাজে ব্যবহার করছে এমন যে, প্রথম আলাপেই তার মুখে ফুটে উঠেছে। সুধারঞ্জন ঈষৎ লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘আরে না না। সে রকম কিছু নয়। আসলে আমার বন্ধু খুব অসুস্থ। থাকে মালবাজারে। ওকে দেখতেই যাচ্ছি। তাই একটু টেনশনে ছিলাম।’

ভদ্রলোক তড়বড় করে উঠলেন, ‘এ বাবা! তাই নাকি? সরি সরি।’

‘না, আপনি কেন সরি হবেন? তা অমিয়বাবু, আপনারা থাকেন কোথায়?’

সুধারঞ্জন প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইছিলেন এবং তার সাথে দৃষ্টিটাও। এরপর স্বাতীর দিকে ক্রমাগত তাকিয়ে থাকলে এরা নির্ঘাৎ তাকে চরিত্রহীন মনে করবে।

‘আমরা থাকি শ্যামবাজারে। ঐ নেতাজীর ঘোড়ার যেদিকে মুখ সেই দিকে পাঁচ মিনিটের পথ।’

অমিয়বাবু নিজের রসিকতায় নিজেই একটু হেসে নিলেন। খুব আমুদে মানুষ সন্দেহ নেই। কিন্তু সুধারঞ্জনের হাসি পেল না। যাই হোক এরা নিজেরা একটু ব্যস্ত হলে হাতের ম্যাগাজিনটায় মনযোগ দেওয়া যাবে‘খন।

রাতের অন্ধকার ভেদ করে ট্রেন ছুটে চলেছে উদ্দাম বেগে। একটানা ঝম ঝম শব্দ শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোর লাগে, চোখ বুজে আসে। সুধারঞ্জন বালিশে ভর দিয়ে আড় কাতে শুয়ে চেষ্টা করছিলেন ম্যাগাজিনটা পড়ার। বুঝলেন, চোখের ওপর স্ট্রেইন পড়ছে। এই বয়সেও সুধারঞ্জনের চশমা লাগে না। আর তাছাড়া সবাই শুয়ে পড়েছে। কামরার আলো প্রায় সবই নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুধারঞ্জনের ঠিক উল্টোদিকের বার্থে সেই প্রৌঢ়া মহিলা। শুয়ে পড়েছেন একটা চাদর গায়ে দিয়ে। সুধারঞ্জন ম্যাগাজিনটা বালিশের নিচে চালান করে দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রাত একটা নাগাদ সুধারঞ্জন উঠে পড়লেন। আর বাইরের দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছে না। শুধুই কালো কালো গাছপালা দুদ্দারিয়ে চলে যাচ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সুধারঞ্জন পালাবেন কোথায়?

টয়লেটের কাছে এসে দেখলেন কেউ নেই। টিটি অনেকক্ষণ আগেই চলে গিয়েছেন। সাহস করে সুধারঞ্জন একটা সিগারেট ধরালেন। রেলের কেউ দেখে ফেললে নির্ঘাৎ ফাইন। সিগারেট শেষ করে মুখ ধুয়ে সুধারঞ্জন বার্থে ফিরে এসে সবে বসেছেন ঘাড় গুঁজে, আচমকা কানে এলো, ‘আপনি সিগারেট খান?’

সুধারঞ্জন চমকে উঠলেন। পরক্ষণে বুঝলেন সেই নিচের বার্থের প্রৌঢ়া। ঘুমোননি এখনও!

‘এই, তেমন কিছু না।’

‘নেশার কম বেশি বলে কিছু নেই। না খেলে খাবেন না। আর খেলে প্রাণভরে খান, একটা দুটো কেন?’

সুধারঞ্জন রেগে উঠতে গিয়েও থেমে গেলেন। কে হে বাপু অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর? কিন্তু সুধারঞ্জন অন্যমনস্ক হলেন। কত কাল আগে যেন কেউ এইভাবে মিষ্টি কথায় হুল ফোঁটাত। সুধারঞ্জনের একটা লম্বা শ্বাস পড়ল। ভদ্রমহিলার গলা কানে এল, ‘রেগে গেলেন নাকি?’

সুধারঞ্জন হাল্কা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ঘুমোননি?’

‘আমি ইনসমনিয়ার পেসেন্ট। ওষুধ ব্যাগে আছে। বের করতে ইচ্ছা করছে না। আর কত খাব? লাস্ট পনের বছর ধরেই তো খাচ্ছি।’

‘তা ভাল, একদিন না খেলে কিছুই হয় না।’

‘আপনি ডাক্তার?’

‘আরে না না, আমি রিটায়াড পার্সন।’

‘তাহলে জানলেন কী করে ওষুধ একদিন না খেলে কিছু হয় না?’

মহা জ্বালাতন তো! সুধারঞ্জন বুঝলেন এর বৌমাকে কত জ্বালাতন সহ্য করতে হয়। কথায় কথায় যদি কেউ কথার দোষ ধরে। সুধারঞ্জন চুপ করলেন। ঘাট হয়েছে, আর একটাও কথা নয়।

‘এবার আপনি রেগেছেন। তাই না? সত্যি কথা বলুন। আসলে জানেন এইটাই আমার মহাদোষ। মুদ্রাদোষও বলতে পারেন। কিছুতেই মানুষকে না রাগিয়ে থাকতে পারি না। ধরে নিন এটা আমার আনন্দ।’

এবার সুধারঞ্জনের হাসি পেল। এমন মানুষও আছে। তিনি বললেন, ‘আমার নাম সুধারঞ্জন। সুধারঞ্জন সেনগুপ্ত।’

‘জানি তো।’

সুধারঞ্জন চমকে উঠলেন। বলে কী? জানেন মানে! কোথায় দেখেছেন ওকে? অন্ধকারেও মহিলার মৃদু হাসির শব্দ পেলেন, ‘মজা করছিলাম। তা থাকেন কোথায় মিস্টার গুপ্ত?’

‘উত্তর কলকাতায়।’

‘পুরো উত্তর কলকাতা জুড়েই আপনার বাড়ি?’

এবার সামান্য শব্দ করে হাসলেন সুধারঞ্জন, ‘আপনাকে বলে কী হবে? আপনি সব চেনেন উত্তর কলকাতার অলিগলি?’

‘নাই বা চিনলাম। থাক আপনাকে বলতে হবে না। আপনার স্ত্রী যাচ্ছেন না সাথে?’

‘বিয়ে করিনি।’

‘ওহো! তা ভালই করেছেন। বিয়ে হওয়া অবধি তো আমি সল্টলেকের বাইরে কোলকাতাটাকেই চিনলাম না। আমার ছেলে আমাকে নিয়ে ইন্ডিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরেছে। কিন্তু সল্টলেকটাই ভাল করে দেখা হল না, তো আপনার উত্তর কলকাতা।’

ভদ্রমহিলার নাম জিজ্ঞাসা করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সুধারঞ্জনের, কিন্তু সাহস করতে পারছেন না। কী জানি আবার কী রসিকতা করে বসেন। ভদ্রমহিলা এরপর চুপ করলেন, সুধারঞ্জনবাবুও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

শেষ রাতে সুধারঞ্জন একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলেন। কথার আওয়াজে ঘুম ভাঙতে দেখলেন বাকি পাঁচজন একদম রেডি। সুধারঞ্জন আড়মোড়া ভাঙতেই অমিয়বাবু বললেন, ‘সুপ্রভাত। আমাদের স্টেশন তো এসে গেল। আপনার এখনও দেরী আছে।’

‘এনজেপি বুঝি? পাঁচজন তাহলে এখান থেকে সোজা গ্যাংটক?’

হ্যাঁ, তবে আমরা এই পাঁচজনই শুধু নই। আমাদের আরেক ফ্যামিলি আসছে শিলিগুড়ি থেকে বড় গাড়ি ভাড়া করে। ওরা ছ’জন। এখান থেকে মোট এগারো জন বেড়িয়ে পড়ব। বলেছিল তো চলে আসবে। নেমে দেখি।’

সুধারঞ্জন আড়চোখে প্রৌঢ়ার মুখের দিকে তাকালেন। জানালা দিয়ে ভেসে আসা স্বল্প আলোয় বুঝলেন, ইনি একসময় অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। স্বাতী এরই নাতনী। তাই মেয়েটা এত সুন্দর। ছেলেটা নিশ্চয়ই বাপের গড়ন পেয়েছে। ভদ্রমহিলার কালকের রাতের হাল্কা স্বভাব কিন্তু সকালের আলোয় একদম উধাও। সুধারঞ্জন বুঝলেন ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা। বাইরের দিকে চেয়ে আছেন কঠোর দৃষ্টিতে।

গুমগুম করে ট্রেন ঢুকে পড়েছে নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে। ট্রেন থামতে ওরা নেমে পড়লেন। সুধারঞ্জন জানলা দিয়ে দেখছিলেন স্বাতীকে। ঈশ্বর! মানুষের মত মানুষ হয়! প্রায় মিনিট ছয়েক পর চোখে পড়ল একটা ফ্যামিলি এগিয়ে এসে মিট করছে এদের। তাদের মধ্যে একজন, ঐ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ হবে, ভারি উচ্ছসিত হয়ে প্রৌঢ়াকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘নীহারিকাদি, কতদিন পর! আমি তো ভাবিইনি রাজস্থান ট্রিপের পর তোমার সঙ্গে দেখা হবে আবার। তুমি তো আরও মিষ্টি হয়েছ গো।’

সুধারঞ্জনের কানে আর কিছুই প্রবেশ করছিল না। মাথাটা যেন ঘুরে গেল এক পাক। একটা নাম, সেই নাম। শুধু আকুল দুটি চোখে দেখতে পেলেন আলিঙ্গন ছাড়িয়ে প্রৌঢ়া মহিলা ফিরে ফিরে সুধারঞ্জনকেই দেখছেন। বারকয়েক দেখার পর এবার তার জানলার দিকেই এগিয়ে এলেন, চোখের কোল বয়সের ভার বহন করছে, তবে দৃষ্টি সেই দুষ্টুমিতে ভরা। বললেন, ‘তুমি আর আমতা গেলে না কেন? আমার ভয়ে?’

সুধারঞ্জন অনেক কিছুই বলতে চাইলেন। একসাথে অনেক অনেক কথা। অনেক কিছু বলার আছে, জানারও। সবটাই কেমন তালমণ্ড পাকিয়ে গেল। নীহারিকা জানলার শিক গলিয়ে এক টুকরো কাগজ সুধারঞ্জনের হাতে গুঁজে দিলেন, ‘তুমি নাকি ট্রেনে ঘুমোও না, নাক ডাকছিল কেন তবে?’

নীহারিকা চলে যাচ্ছেন। সুধারঞ্জনের গলার কাছটা কেমন আটকে আটকে যাচ্ছে, চোখের কোণদুটো জ্বালা জ্বালা। ভীষণ চেষ্টা করছিলেন নীহারিকাকে আরও স্পষ্ট করে দেখার, তেমন পারলেন না। চোখদুটো আজ বিদ্রোহ করছে।

ট্রেন ছেড়ে দিল। সুধারঞ্জন হাতের কাগজটায় ঝাপসা দেখতে পেলেন লেখা – ‘বুদ্ধুমশাই, আমি আছি তো।’ পিছনে উল্টে দেখলেন একটা ল্যান্ডলাইন নাম্বার। যেন তিনযুগ পরে কেউ গাবগাছের পিছন থেকে ভীষণ সুরেলা মেয়েলি কন্ঠে ডাক দিল, ‘বুদ্ধুমশাইইইইইইইইইই’। সুধারঞ্জন খুঁজছেন, খুঁজছেন, অথচ পাচ্ছেন না, ঐ তো দেখা যাচ্ছে বাজে পোড়া তেঁতুলগাছটার পিছনে একটু হলুদ শাড়ির আভাস। সুধারঞ্জন দৌড়ে গেলেন, না, কেউ নেই তো। আবার ঈশান কোন থেকে সেই ডাক উড়ে এলো মেঘলা বাতাসে ভর করে, ‘বুদ্ধুমশাইইইইইইইইইই, এই যে আমি এখানেএএএএএএএ’। সুধারঞ্জন পিছন ফিরলেন, পাশে, ডানে, বামে, কই দেখতে পাচ্ছেন না তো! তিনিও চেঁচিয়ে উঠলেন – ‘নীহার, কোথায় তুমিইইইইইইইইইই?’

সুধারঞ্জন হাউহাউ করে এবার কেঁদে ফেললেন। সেটা দুঃখে না আনন্দে নিজেই বুঝে উঠতে পারলেন না।

মালবাজার স্টেশন আসছে। সুধারঞ্জন ঠিক করলেন ফিরে গিয়ে তার লিখে আসা শেষ কবিতার নিচে লেখা ‘সমাপ্ত’ অংশটি কেটে দেবেন। এখনও সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *