micro-story-upolobdhi

উপলব্ধি
অনুভা নাথ

-আজ আমরা মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ব। তোমরা কি জান? রাশিয়ার জাতীয় মহাকাশ সংস্থা রককসমস আগামী পাঁচবছরের মধ্যে নতুন স্পেস স্টেশন বানাবে। ভাবতে পারছ, ব্যাপারটা কী দারুণ হবে! পৃথিবীর বাইরে আমরা প্রাণের সন্ধান করতে সক্ষম হব।

বন্ধুদের সঙ্গে নিকোলাই এতক্ষণ মন দিয়ে ক্লাস করছিল। শেষ কথাটি শুনে তার নিজের অজান্তেই মন উতলা হয়ে উঠল।

-নিক্, তুমি কিছু বলতে চাও?

শিক্ষিকার আকস্মিক প্রশ্নে মুহূর্ত সময়ের জন্য নিকোলাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল।

-ম্যাম, আমাদের পৃথিবীর বাইরে কোনও গ্রহ বা গ্রহাণুতে প্রাণের সন্ধান পেলে আমরা কী করব?

ঝলমলে মুখ আর আনন্দিত গলায় শিক্ষিকা উত্তর দিলেন
-তেমন হলে রাশিয়ার জন্য ভীষণ গর্বের ব্যাপার হবে। আমরা সেই প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করব। আর…

নিক্ তার শিক্ষিকার কথা শেষ করতে দিল না, তার আগেই উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল
-আমি জানি ম্যাম। আমরা ওই ভিন গ্রহের প্রাণীদের নির্বিচারে হত্যা করব।

মুহূর্তে শিক্ষিকা সমেত পুরো ক্লাসের দৃষ্টি নিকোলাই এর দিকে। আকস্মিক ছন্দপতনে শিক্ষিকা যেন একটু বিরক্ত।
-তুমি এসব কী বলছ নিকোলাই?

আর ঠিক তখনই সকলকে চমকে দিয়ে ক্লাস শেষ হওয়ার বেল পড়ল।
-ম্যাম, আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন…নিককে ইদানীং আমিও দেখছি একটু যেন অন্যমনস্ক। আমি ভাবছিলাম, ও তো টিনএজার, এইসময়ে শরীর ও মনের বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। তেমনই হয়তো কিছু হয়ে থাকবে।

নিকোলাই এর স্কুলে প্রিন্সিপালের ঘরে বসে ওর মা যখন প্রিন্সিপালের সঙ্গে নিকের এমন অদ্ভুত আচরণের কথা আলোচনা করছেন, তখন জানলার বাইরে টুকরো তুষারে ঢেকে যাচ্ছে জনজীবনে। জানলার শার্সির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিকের মা আবারও বলে উঠলেন,
-আমি মধ্যবিত্ত মানুষ, চেষ্টা করি নিজের সন্তানকে সবচেয়ে সেরাটা দিয়ে বড় করতে।

প্রিন্সিপাল চোখের চশমাটি আঙুল দিয়ে চোখের ওপর আঁটতে আঁটতে বললেন,
-ম্যাদাম, বুঝতে পারছি এই আকস্মিক গার্জেন কলে আপনি একটু মুষড়ে পড়েছেন। আসলে সেদিনের নিকের এমন অদ্ভুত আচরণের আমরা কোনও কারণ খুঁজে পাইনি। তাই আজ ক্লাস শেষের পর ওকে ডেকে পাঠিয়েছি, সেদিনের ক্লাসের ম্যামও থাকবেন। ওর কাউন্সিলিং এর প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি আমরা।

অবিরাম তুষার পাতের ফলে চারিদিক আরও বর্ণহীন হয়ে উঠেছে। সাদা রঙের আধিক্য বেশী হলে তা ভীষণ নিঃস্ব দেখায়। নিকোলাইয়ের মা বাইরের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে পড়লেন।
তারপর পায়ের শব্দে তাকিয়ে দেখলেন, নিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।

কিছুমাত্র ভূমিকা না করেই ওর ক্লাসের শিক্ষিকা ওকে বললেন
-নিকোলাই, আমরা জানতে চাই গতকাল ক্লাসে তোমার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী?

নিক ধীর গলায় বলে উঠল
-আমার বাবা রাশিয়ান আর্মিতে ছিলেন। সীমান্ত রক্ষা করতে গিয়ে মারা যান। আমরা সবাই জানি, আজকের দিনে রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধে আমাদের, ওদের বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন। আর আমরা কী করছি? মহাকাশ নিয়ে মেতে উঠেছি, প্রচুর রুবেল খরচ করে অনিশ্চিত মহাকাশে কী ঘটছে জানতে চাইছি। সেখানে যদি ভুল করেও আমরা প্রাণের সন্ধান পেয়ে যাই তাহলে আজ থেকে কিছু বছর পরে সেখানেও পৃথিবীর মানুষ ইউক্রেনের মতোই হত্যা, হিংসা করবে, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।

চোদ্দ বছরের নিকোলাই এর সামনে বসে তিনজন নারী নিজেদের বড় অসহায় বোধ করলেন। অনুতাপ, দুঃখ ও অসহ বেদনায় তাঁদের মন অচিরেই ভরে উঠল। তাঁরা নিকোলাইকে আর কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। শুধু অঝোর বরফের দিকে তাকিয়ে রইলেন,বরফের মতোই সাদা আর ঠান্ডা দৃষ্টিতে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *