গওহর গালিব
অদ্য শুক্কুরবার, জুমার নামাজের পর আলী হেলালের বিয়া। তয় এইটা তার দ্বিতীয় বিয়া, প্রেমের সম্পর্কটা বহুদূর গড়াইছে বইলাই বিয়াটা হইতাছে। আলী হেলালের দ্বিতীয় বিয়ার কনের নাম-ধাম আর বংশলতিকায় যাওনের আগে হেলালের প্রথম বিয়ার গল্পটা লন কইয়া লই।… আলী হেলালের বয়স তখন বাইশ কি তেইশ, পুরান ঢাকার বংশাল রোডের বড় মসজিদের পাশের মোটর মেকানিকের গ্যারেজে দীর্ঘ দশ বছরের এসিসটেন্সি শ্যাষ কইরা হেলাল যখন চার বাই ছ’ফুটের একটা দোকান ভাড়া কইরা ‘হেলাল বাইক কেয়ার’–নামে নিজেই ছোট্ট একটা গ্যারেজ দিল– তখন তার আশপাশের লোকজন ব্যাগতেই খুশি হইছিল। এই ঘটনার মাসে-ছয়ের মধ্যেই হেলালের বিয়ার নহবত বাইজা উঠল৷ বিয়া হইলো খানদানি বংশেই, কনের বাপ আজগর সাবের তিন-চারটা দোকানসহ লক্ষী বাজারে রইছে তিনতলা বাড়ি–যেইটার নিচতলায় হেলাল তার খোঁড়া মারে লইয়া বছর তিনেক ভাড়াও আছিল। এমুন টাকাওয়ালা ঘরের মাইয়ার জন্য হেলাল কারো হাতে পায়ে ধরতে যায় নাইক্কা বরং তার শ্বশুরই তারে বিছড়াইছিল তাগোর লম্বা-ফর্সা সুন্দরী মাইয়াটার জামাই হওনের লাইগা–যে-কিনা মহল্লায় মিস মারিয়ম নামে অনেকেরই ক্রাশ আছিল! অবশ্য বিয়া হওনের হপ্তাখানেক পরে হেলাল জানছিল— মারিয়মের আগে যে জায়গায় বিয়া ঠিক হইছিল, তাগোর লগে কি একটা ক্যাচাল বাঁধায় আজগর সাব এক মাসের নোটিসে ওই পাত্রের আগেই মাইয়ার বিয়া দিতে জবর একখান জেদ ধরছিল। নাগালের ভিত্রে খাটুইন্না আর ভালা পোলা বইলা হেলালের গলায় যে সার্টিফিকেটখান ঝুলছিল, সেইটার বদৌলতে হেলাল মিস মারিয়মের মতোন উচ্চবংশীয় মাইয়ারে বউ হিসাবে পায়া গেলো। অবশ্য বিয়ার দিন মারিয়মের খালু বানিয়া দুলাল আজগর সাবের সামনে খেদোক্তি কইরা বলতেছিল– কুন পোলার লগে মাইয়ার বিয়া দিলেন ভাইজান! সারাদিন কালিঝুলি মাইখা থাহে, পেশাব লাগলে টয়লেটে পর্যন্ত যায় না–রাস্তার পাশের ড্রেনেই চেন খুইলা বইয়া পড়ে! শ্বশুরজি দুলাল মিয়ার মন্তব্যের কোন প্রতিবাদ না করায় কথাটা আলী হেলালের গায়ে এমন বিঁধেছিল যে–শক্ত হওয়া চোয়াল লইয়াই হেলাল বিড়বিড় করছিল– হালার পুত,খালি চেন খোলাই দেখছস, চেনের ভিত্রে হাতুড়ির মাথাটা দেহস নাই! অবশ্য হাতুড়ির মাথাটা সে বাসর রাতে মিস মারিয়মরেই দেখাইছিল৷ ফলত বাসর রাতে বড় লোকের নন্দিনী বইলা হেলাল মিস মারিয়মের লগে কোন সহবত দেখায় নাই। ভুখা নাঙা, দীর্ঘদিন অনাহারে থাকা মানুষ ভালো খাবার পাইলে যেমন হামাগুড়ি দিয়া আগায় যায়, হেলালও তেমনি গোঙাইতে গোঙাইতে বাসর ঘরে আগায় গেছিল৷ হেলাল ভাবছিল– তার তেল মবিলের গন্ধমাখা উদম শরীরটা দেইখা মিস মারিয়ম বোধ হয় তারে লাত্থিগুতা দেবে, কিন্তু মেয়েটা উল্টা তারে সজোরে জাপটে ধরায়–হেলাল সেরাতে সত্যি সত্যি বিয়াইত্তা পুরুষের লাহান আরাম আর আমোদ পাইছিল। সে ভাবছিল– মিস মারিয়ম বোধ হয় তারে ভালোবাইসাই ফালাইলো। কিন্তু বিয়ার দিন কতক পরেই মিস মারিয়মের চোখেও যখন তার প্রতি অভক্তি আর বিতৃষ্ণা দেখলো, আলী হেলাল তখন ঠিক বুইঝা গেলো– খাওন আর সঙ্গম সুখ ছাড়াও সুখী হইবার জন্য বড়লোগগের রইছে নানান ফিকির! সেইগুলা তার রপ্ত নাই বইলা হেলাল তার মাখনরাঙা বউয়ের চোখে সেই প্রোলেতারিয়েতই থাইকা গেল। সে বুঝলো রাতের বেলার ওই আধাঘন্টার দাপাদাপি আর লাফালাফি আফিমের নেশার মতো ধনী-গরীব সকলরেই মোহাচ্ছন্ন কইরা রাখলেও, মানুষ আসলে মানুষরে মাপে তার অহম ও আভিজাত্যের চশমা পইড়াই। ফলে হেলাল একই বাড়িতে থাকলেও বউ ও শ্বশুরের চোখে সে-ই রাস্তার লোকই থাইকা গেল। তয় হেলালের পৌরুষ থেঁতলে গেছিল সেইদিন, যেদিন তার বউ মিস মারিয়ম চিৎকার কইরা কইতেছিল– আরে ওই ফক্কিনির পুত, তুই তো কপালের জোরে আমারে পাইছস! তোর কোন গুণ আছে রে বলদ? কপালটা না থাকলে আমগো বাড়ির কাজের মাইয়াটাও তোর ঘরে আইতো নারে! হেলাল সেদিন বউয়ের চিক্কুরের সামনে একটা কথাও কয় নাই। তয় মনে মনে সে তার বউরে শোনাইতেছিল– তুই দেহিস বৌ, আমি এবার এমুন একখান বিয়া করমু–সেই মাইয়া ধনী তো হইবই, তোর চায়াও সুন্দরী হইবার পারে! সেই থাইকা আলী হেলাল প্রেম সাধনায় মগ্ন হইয়া গেল। প্রেম সাধনায় আলী হেলালের চেষ্টার কোন ত্রুটি আছিল না, সে বহুত মেহনত করছিল একখান বড় লোকের মাইয়ার লগে প্রেম করার। প্রায় বছর চারেকের চেষ্টার পর সে সফল হয়। সেই চেষ্টার মণিহার আজ সে পরবে গলায় অর্থাৎ আজ আলী হেলালের প্রেমের বিয়া..! তা হেলালের প্রেমের বিয়ার কনে কিডা, জানতে মন চায় না! তাইলে কই শোনেন– আলী হেলালের দ্বিতীয় বিয়ার পাত্রী হইলো–উম্মে হানি, যে কিনা মিস মারিয়মের আপনা ছোট বইন আর আজগর সাবের সবচে আদরের কইন্যা…!!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন