সুমনা সাহা
এসেছে হিমের ঋতু। ভোরবেলার হিমেল কুয়াশা-চাদর, ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা নগরায়নের দূষণ সয়ে আজও অমলিন। কৃষিমাতৃক দেশগুলোর দরিদ্র চাষিঘরে নতুন শস্য ফলিয়ে দুটি পয়সার মুখ দেখার খুশিতে নতুন ধান বা গম কিম্বা যব থেকে তৈরি পিঠে-পায়েস রেঁধে দেবতাকে ভোগ নিবেদন করে আত্মীয়-পরিজন নিয়ে খাওয়া-দাওয়া—এসমস্ত যে কেবল বাংলার বা ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা নয়। ভারতের বাইরেও সব দেশেই পিঠে খাওয়ার চল আছে, আর তা এই নতুন ফসল ঘরে তোলার অনুষঙ্গে সংযুক্ত হয়েই। পিঠের ইংরাজি শব্দ কেক। কেক তৈরির নেপথ্যেও একই প্রাণের উৎসব জড়িয়ে আছে। মানুষ যেদিন থেকে পশুশিকারী যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে কৃষিকাজ আরম্ভ করল, থিতু হল, সেইদিন থেকে সূচনা হয়েছিল মানবসভ্যতার নতুন অধ্যায়, সমাজবদ্ধতার ইতিহাস। সমাজ থাকলেই সামাজিকতা থাকে, আর সেই সূত্রে এসে পড়ে লৌকিকতা, আতিথেয়তার প্রসঙ্গ। যে জিনিসটা সংরক্ষণ করলে কিছুদিন থাকবে, চট করে নষ্ট হবে না, এমন কিছু ঘরে থাকলে তা দিয়ে অতিথি সেবা করা যাবে, প্রাক-রেফ্রিজারেটর যুগের এমন জিনিসগুলো প্রযুক্তির জেট যুগে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির আদানপ্রদানের আতিশয্যে মোমো-চাউমিন-পিতজার আকর্ষণে একটু পিছনে পড়ে গেছে ঠিকই, তবে তাদের আদর আজও এতটুকুও কমেনি। বরং একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার হওয়ায় বাড়িতে তৈরি করার ঝকমারিতে সেসব মিষ্টি-দোকানে লভ্য হয়ে এখন মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছে, ক্ষেত্রবিশেষে ঘটেছে উদ্ভাবনী নব-সংযোজন। কিন্তু মুড়ি, চিঁড়ে, খই-এর মোয়া, মুড়কি, দুধ-ক্ষীর-নারকেল সহযোগে চালের গুঁড়ির পিঠে-পুলি ইত্যাদি গ্রাম-বাংলা তথা সমগ্র ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।
শৈশবে পঠিত ‘কাঁকনমালা ও কাঞ্চনমালা’ রূপকথার কাহিনীতে নিজের পরিচয় প্রমাণ করবার জন্য পিঠে তৈরির প্রতিযোগিতা হয় দুই রানীর মধ্যে। কাঁকনমালা তৈরি করে আস্কে, চাস্কে আর ঘাস্কে পিঠে, নাম শুনলেই বোঝা যায় ভারি শক্ত আর বিশ্রি তাদের স্বাদ। আর কাঞ্চনমালা এক রহস্যময় সুতোওয়ালার সাহায্যে চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী প্রভৃতি শৈল্পিক সুন্দর পিঠে বানিয়ে প্রমাণ করেন যে তিনিই প্রকৃত রাণী! কোনও বিষয় যখন কোনও জনপদের লোকগাথার অঙ্গীভূত হয়ে যায়, তখন বোঝা যায় সেই বিষয় বা বস্তুটি সেই বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের সংস্কৃতির অংশ ও মানুষের প্রাণের ভালবাসার বস্তু। এ তো বাংলার রূপকথার কাহিনী। বৈদিক যুগের সাহিত্যেও আমরা পিঠের উল্লেখ পাই, আর্যরা যখন থেকে চাল বা নানাধরনের শস্য পাথরের সাহায্যে গুঁড়ো করতে শুরু করেছিল। তখন যজ্ঞে যব ব্যবহৃত হত। সেই যব দিয়ে তৈরি পিঠেকে বলা হত ‘পুরোডাশ’, যা অতি পবিত্র রূপে যজ্ঞে নিবেদিত হত। ঐতিহাসিক মহাকাব্য মহাভারতেও এই পুরোডাশের উল্লেখের মাধ্যমে রয়েছে পিঠে-প্রসঙ্গ। কর্ণ যখন অঙ্গরাজ্যের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হলেন, তখন ভীমসেন বলেছিলেন “কুকুর যেমন যজ্ঞের পুরোডাশ খাওয়ার অধিকারী হতে পারে না, তুমিও অঙ্গরাজ্য ভোগ করবার অধিকারী নও।”
পরবর্তী কালে বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে পিঠে বারবার এসেছে কবিদের হাত ধরে।
‘পিঠেপুলি’ বলতে সাধারণত পুর ছাড়া এবং পুর দেওয়া পিঠেকে একসাথে বোঝানো হয়৷ ‘পিঠেপুলির আয়োজন’-এ তাই চিতই পিঠে, তেলের পিঠে, নকশি পিঠে, দুধে বা রসে ভেজানো পিঠের সঙ্গত করে নারকেল, ক্ষীর, বিউলির ডাল বা অন্যান্য জিনিসের পুর দেওয়া ভাজা বা ভাপা রসপুলি, চন্দ্রপুলি ইত্যাদি৷ প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসেবে মিষ্টি মণ্ডার চেয়ে পিঠের জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। চৈতন্যচরিতামৃত-এ পাই, ‘পঞ্চাশ ব্যাঞ্জন’-এর সঙ্গে ‘ক্ষীর পুলি নারিকেল পুলি আর পিষ্ট’ তৈরি হচ্ছে। আগেকার দিনের মানুষ এক আধখানা পিঠে খেয়ে ডায়াবেটিস আর সুগারের ভয়ে কাঁপত না, ‘কাজল রেখা’ আখ্যানে কবি সোনার থালা ভরে পিঠে সাজিয়ে পরিবেশন করবার বর্ণনা লিখেছেন—‘চই চপরি পোয়া সুরস রসাল৷/তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল।’ প্রাচীন বাংলায় মানুষ থালা ভরে, গণ্ডা (৪ টায় এক গণ্ডা) গুনে যেমন পিঠে খেত, দেবভোগ্য সেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত করত না অবোলা প্রাণিদেরও। হিন্দু সম্প্রদায়ে তো বটেই, কোনো কোনো অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়েও বছরের প্রথম বানানো পিঠে ঘরের চালের উপর দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়ার প্রথা ছিল, যাতে শেয়াল-কুকুর-পাখ-পাখালিও পিঠের ভাগ পায়৷
‘পিঠা’ বা চলতি কথায় ‘পিঠে’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পিষ্’ ক্রিয়াপদ জাত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকে, যার অর্থ চূর্ণিত বা মর্দিত৷ হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের মতে, ‘পিঠা হলো চাল গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ’ (বঙ্গীয় শব্দকোষ )। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান৷ ধান ভাঙিয়ে চাল তৈরি করে, সেই চালের গুঁড়ো থেকে প্রস্তুত হয় পিঠে। মনসামঙ্গল কাব্যে কবি বিজয়গুপ্ত লিখেছেন ‘খির খিড়িয়া রান্ধে দুগ্ধের পঞ্চ পিঠা, গুড় চিনি দিয়া রান্ধে খাইতে লাগে মিঠা।’ সাধারণত পিঠে মিষ্টান্ন রূপে প্রসিদ্ধ এবং গুড় সহযোগে খাওয়া রেওয়াজ হলেও কোথাও কোথাও ঝাল পিঠেও খাওয়া হয়। বাংলাদেশের কোন কোনও জেলায় চিতই পিঠে সর্ষে বাটা কিংবা লঙ্কা বা শুটকির ঝাল ভর্তা দিয়েও খাওয়া হয়৷ আবার ছিট পিঠের লেচি মরিচ বাটা মিশিয়ে ঝাল করে ভাজা হয়, এই পিঠে আবার হাঁসের মাংস দিয়েও খাওয়া হয় বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে৷ সিলেটের ‘চুঙ্গি পিঠা’, বিক্রমপুরের ‘বিবিখানা পিঠা’ ইত্যাদি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে তেমন প্রচলিত নয়।
সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলামায়ের আঁচল ভরা ধন-রতনের কথা কবিরা কৃতজ্ঞচিত্তে কাব্যে প্রকাশ করেছেন। তাই বঙ্গভূমে জলের রূপোলী শস্য মাছ আর ক্ষেতের সোনালী ধানের প্রাচুর্য ভোজন-রসিক বাঙালি রসনায় নতুন নতুন স্বাদের জন্ম দিয়েছে। বাংলার নদীর জল যেমন মিষ্টি, তেমন মিষ্টি বাংলা ভাষা আর তাই বুঝি বাঙালির মিষ্টান্ন-প্রীতির কথাও সর্বজনবিদিত। শীত বঙ্গভূমিতে পিঠে-পার্বণের ঋতু। ভারতীয় উপমহাদেশে ঠিক কোন সময় থেকে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে, তার লিখিত নথি না থাকলেও পিঠের প্রতি বাঙালির এই আকর্ষণ কিন্তু আজকের নয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে শুরু করে, মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যচরিতামৃত সর্বত্রই পিঠের জয়জয়কার। কৃত্তিবাসের রামায়ণে বিদেহরাজ জনক রাজনন্দিনী সীতার বিবাহে অতিথিদের জন্য যে ভোজের আয়োজন করেছেন, তার মধ্যে ‘দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত’-র উল্লেখ পাই, তেমনই মহাভারতে নল-দময়ন্তীর বিবাহভোজের বিবরণেও ‘সুমিষ্ট পিষ্টক এবং দই’-এর কথা রয়েছে। কাব্য ও আখ্যানে উল্লিখিত সূত্র ধরে অনুমান করা যায় যে, বিগত পাঁচশ বছর ধরে বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠে জনপ্রিয় হয়ে আছে৷ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কবি মুকুন্দরাম লিখেছেন—“নির্মাণ করিত পিঠা বিশা দরে কিনে আটা, খণ্ড কিনে বিশা সাত-আট।’
১৫৭৫-এ মনসামঙ্গল কাব্যে দ্বিজ বংশীদাসের লেখাতে সনকার রান্না করা স্বাদু সব পদের মধ্যেও পিঠে বাদ যায়নি। “কত যত ব্যঞ্জন যে নাহি লেখা জোখা/ পরমান্ন পিষ্টক যে রান্ধিছে সনকা/ ঘৃত পোয়া চন্দ্রকাইট আর দুগ্ধপুলি/ আইল বড়া ভাজিলেক ঘৃতের মিশালি/জাতি পুলি ক্ষীর পুলি চিতলোটি আর/ মনোহরা রান্ধিলেক অনেক প্রকার।” ষোড়শ শতাব্দীর রাঢ়দেশের কবি কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর গ্রন্থেও পিঠার উল্লেখ আছে। খুল্লনা চণ্ডীদেবীর আশির্বাদ লাভ করে স্বামীর তৃপ্তির উদ্দেশ্যে রেঁধেছিলেন—“কলা বড়া মুগ সাউলি ক্ষীরমোন্না ক্ষীরপুলি/নানা পিঠা রান্ধে অবশেষে।”
চৈতন্যের জীবনীকার জয়ানন্দ ‘চৈতন্যমঙ্গলে’ নিমাইয়ের সঙ্গে বিবাহের পরে রন্ধনপটিয়সী নববধূ লক্ষ্মীদেবীর প্রথমদিনের রান্নার বর্ণনা দিচ্ছেন, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষে কেমন খাওয়াদাওয়া হতো, সেই বিবরণে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে—“পঞ্চাশ ব্যঞ্জন অন্ন রাঁধিল কৌতুকে/পিষ্টক পায়স অন্ন রান্ধিল একে একে।” চৈতন্যদেবের বিভিন্ন জীবনীকারের লেখায় দেখা গেছে, ভক্তবৃন্দ মহাপ্রভুকে নানা পদ রেঁধে খাওয়াচ্ছেন, পিঠেপুলি তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসগ্রহণের পর ভাববিহ্বল শ্রীচৈতন্য দেহবোধরহিত অবস্থায় তিনদিন ছিলেন। গঙ্গা পার হয়ে যখন তিনি শান্তিপুরে অদ্বৈতভবনে এলেন, তখন ক্ষুধায় কাতর। ভক্তরা নানারকম নিরামিষ ব্যঞ্জন তৈরি করে প্রভুর উপবাস ভঙ্গ করালেন—“মুদগ বড়া, মাস বড়া, কলা বড়া মিষ্ট/ ক্ষীর পুলি নারিকেল পুলি পিঠা ইষ্ট।” অতএব ঐতিহ্যময় বঙ্গ খাদ্যসংস্কৃতির ‘শেষপাতে মিষ্টি’ বলতে ছিল ‘পিঠাপুলি’ খাওয়ার চল।
প্রাচীন পালাগান মৈমনসিংহ গীতিকার রূপকথা ‘কাজল রেখা’-তেও পিঠেপুলির উল্লেখ মেলে। যেমন “নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত/ চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রে আকিরত/ চই চপরি পোয়া সুরস রসাল/তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল/ক্ষীর পুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া/ রসাল করিল তায় চিনির ভাজ দিয়া।”
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলি বাঙালি ভাঁড়ারের বহু সুলুকসন্ধান দিয়েছেন। এমনকি অষ্টাদশ শতকে ঘনরাম রচিত ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে কবি বারবনিতাদের রন্ধন-পারদর্শিতার বর্ণনাও দিচ্ছেন। বারবধূও তো নারী, আর রন্ধন করে প্রিয় মানুষকে বসিয়ে খাওয়ানোর তৃপ্তিতে সকল নারীর অধিকার—“উড়ি চেলে গুঁড়ি কুটি সাজাইল পিঠা/ক্ষীর খণ্ড ছানা ননী পুর দিয়া মিঠা।”
পঞ্চদশ শতকের কবি বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’-এ সনকার ছয় পুত্রবধূ নিরামিষ ও আমিষের বহু পদ রান্নার পর নানারকম পিঠে তৈরি করে—
“মিষ্টান্ন অনেক রাঁন্ধে নানাবিধ রস
দুইতিন প্রকারের পিষ্টক পায়স।
দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ
রন্ধন করিয়া হইল হরষিত মন।”
একই সময়কালে রচিত চণ্ডীদাসের পদে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পরে নন্দের মিঠাই বিতরণের উল্লেখ আছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ শচীমাতা পুত্রকে খেতে দেন প্যাঁড়া, সরপূপী, অমৃতখণ্ড, কর্পূরীপিঠা, পদ্মচিনি প্রভৃতি মিষ্টান্ন। আবার ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে কালকেতুর বউ ফুল্লরার কাছে পিঠেপুলি খাওয়ার আবদারের কথা আছে—“মনে করি সাধ খাইতে মিঠা/ক্ষীর নারকেল তিলের পিঠা।”
প্রাচীন বঙ্গে শারদীয়া দুর্গোৎসব ছিল রাজা-রাজরা ও জমিদারদের উৎসব। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাতে কাজ পেত, ভরপেট খেতে পেত, কিন্তু সে ছিল ‘বাবুর বাড়ির পুজো’। গরীবের প্রাণের উৎসব ‘মকর সংক্রান্তি’। পৌষের শেষ দিনটি সংক্রান্তি, কিন্তু অগ্রহায়নের শেষ থেকে মাঘের শেষ পর্যন্ত শীতের সমগ্র ঋতু জুড়েই চলে ফসল ঘরে তোলার আনন্দ-উৎসব।
পৌষ-পার্বণকে ঘিরে পল্লীবাংলার প্রতিটি পরিবারে যে বিপুল আনন্দ, উত্সাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায় তা বাংলার অন্য কোনো উত্সবে দেখা যায় না। মকর সংক্রান্তির পনেরো-কুড়ি দিন আগে থেকেই ঘরে ঘরে উৎসবের ধুম পড়ে যায়। ঐ দিন ভোরে স্নান করে নতুন পোশাক পরে পিঠে খাওয়ার রীতি। আবহমান কাল ধরে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাদ্য তালিকায় পিঠে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের বাড়িতে পিঠে-পুলির আয়োজন করা হয়। নারকেল, তিল, পোস্ত, দুধের চাঁছি ইত্যাদি দিয়ে যেমন, তেমনই ক্ষেতে ওঠা নতুন আলু, ফুলকপি, মসুর ডাল এসবের পুরও ঠেসে দেওয়া হতো পিঠের পেটে, তৈরি হতো হরেক রকমের ‘পুরপিঠে’। ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর বর্ণনায় স্বামীদেবতাকে পিঠে খাওয়াতে স্ত্রীর আকুলতার বিবরণ—“কামিনী যামিনীযোগে শয়নের ঘরে/স্বামীর খাবার দ্রব্য আয়োজন করে/ আদরে খাওয়াবে সব মনে সাধ আছে/ঘেঁসে ঘেঁসে বসে গিয়া আসনের কাছে/মাথা খাও, খাও বলি পাতে দেয় পিটে/না খাইলে বাঁকামুখে পিটে দেয় পিটে।”
পিঠে খাওয়ার সুখও ধরা আছে ছন্দে—“এই মুগের ভাজা পুলি মুগ্ধ করে মুখ/ বাসি খাও, ভাজা খাও, কত তার সুখ।” রয়েছে পিঠে প্রস্তুতি পর্বের আয়োজন—“তাজা তাজা ভাজা পুলি, ভেজে ভেজে তোলে/সারি সারি হাঁড়ি হাঁড়ি কাঁড়ি করে তোলে/কেহ বা পিটুলি মাখে কেহ কাঁই গোলে।” কয়েক দশক আগেও সংক্রান্তির আগের দিন সারাদিন, সারারাত ধরে পল্লীবাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতো ঢেঁকিতে চাল কোটার শব্দ। নবান্ন উত্সবে মেতে উঠত সমস্ত গ্রাম। ‘পথের পাঁচালি’র ইন্দির ঠাকরুণের স্মৃতিতে বিভূতিভূষণ রেখেছেন সেই নস্ট্যালজিয়া—“পৌষ-পার্বণের দিন ঐ ঢেঁকিশালে একমণ চাল কোটা হইত-পৌষ-পিঠার জন্য—চোখ বুজিয়া ভাবিলেই ইন্দির ঠাকরুণ সেসব এখনও দেখিতে পায় যে!” এখন চাল গুঁড়ো করবার মেশিন এসে গেছে, তাই ঢেঁকিতে চাল কোটার চল নেই বললেই চলে।
‘অতিথি দেবো ভব’ নীতিতে মনেপ্রাণে বিশ্বাসী বাঙ্গালির অন্তঃপুরের কথা কবি ঈশ্বর গুপ্ত বলেছেন—
আলু তিন গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।
গড়িতেছে-পিঠেপুলি, অশেষ প্রকার॥
বাড়ি বাড়ি নেমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার ধন্য তোর খেলা॥”
মুসলমানদের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানেও পিঠে তৈরির রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। তবে “পান পানি পিঠা, এই তিনই শীতে মিঠা”—এই প্রচলিত প্রবচন থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, গুড় লভ্য হওয়ার কারণে শীতকালই পিঠে তৈরির জন্য শ্রেষ্ঠ।
অঞ্চলভিত্তিতে ও নানা উপাদান বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে পিঠের অনেকরকম নাম পাওয়া গেছে, যেমন–ভাপা, ঝাল, ছাঁচ, ছিটকা, চিতই, খোলাজালি, চুটকি, চাপড়ি, চাঁদ পাকন, সুন্দরী পাকন, ছিট, প্রভৃতি পিঠার সঙ্গে পাওয়া যায় সরভাজা, পুলি পিঠা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, মেরা পিঠা, মালাই পিঠা, মুঠি পিঠা, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীর কুলি, গোকুল পিঠে, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, নকশি পিঠা, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জেলাফি, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা, সন্দেশ পিঠা, দুধরাজ, ফুলঝুরি পিঠা, ফুল পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, সেমাই পিঠা, সরল পিঠা প্রভৃতি। বিবিয়ানা পিঠাকে জামাই ভুলানো পিঠাও বলা হয়, অপূর্ব কারুকার্যখচিত এ পিঠা তৈরীতে বিবি (কনে) কে অনেকরকম পারদর্শিতার পরিচয় দিতে হয় বলেই হয়তো এমন নামকরণ।
প্রসঙ্গত বলি যে, আনন্দের উৎসব সব দেশের সব মানুষের প্রাণে। নতুন ফসল উঠলে নিজের ভোগের আগে মানুষ ভাবে অপরকে দেওয়ার কথা—হিন্দু নবান্ন নিবেদন করে ভগবানকে, মুসলমান সিন্নি চড়ায় তার আল্লা তালহার উদ্দেশ্যে, খ্রিস্টান ধন্যবাদের আয়োজন সাজায় দয়াময় গড-এর জন্য। উপকরণের তফাৎ, নামের ভেদ, মনের ভাব অভিন্ন। ভারতে নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দ উৎসব গ্রামবাংলায় যেমন নবান্ন, অসমে ভোগালি বিহু, কাশ্মীর উপত্যকায় সায়েনক্রাত, মহারাষ্ট্রে তিলগুল, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় পোঙ্গাল, কেরালায় ওনাম, উত্তর প্রদেশ ও বিহারের কিছু অংশে খিচড়ি, গুজরাটে উত্তরায়ন, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশে মাঘী উৎসব, সাঁওতাল ও গারো (মান্দি) আদিবাসীরা পালন করেন সোহরায় ও ওয়ানগাল্লা উৎসব।
চীন দেশেও নবান্ন উৎসব পালিত হয়। নতুন ফসলের উৎসব চুংচু নামে পরিচিত। এটি আগস্ট মুন ফেস্টিভাল নামেও বিখ্যাত। আমেরিকা, ইংলন্ড ও ইউরোপের অনেক দেশে নতুন ফসল ঘরে তোলার খুশিতে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য ভোজের আয়োজন করা হয়, যব বা ভুট্টা সিদ্ধ ও ঝলসানো টার্কির (বন মোরগ জাতীয় বড় পাখি) মাংস এই ‘থ্যাঙ্কস গিভিং’ অনুষ্ঠানের প্রধান মেনু। চার্চ সাজানো, নাচ-গান প্রভৃতিও এই উৎসবের অঙ্গ। নেপালে এই উৎসবের নাম কইয়াগরাত পূর্ণিমা। গ্রীসে এই উৎসবের নাম থেসমসফোরিয়া। রোমানদের নবান্ন উৎসবের নাম সেরেলিয়া। প্রতিবছর ইংরাজি অক্টোবর মাসের ৪ তারিখ রোমে নবান্ন উৎসব পালিত হয়ে থাকে। ইহুদীদের মধ্যে খ্রিস্ট জন্মেরও কয়েক হাজার বছর আগে থেকে নতুন ফসল কাটার উৎসবের প্রচলন রয়েছে, যার নাম পেসাস ও শুক্কত।
নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দ প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়, ‘ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।’ অগ্রহায়ণ মাসে কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলায় ফসল পাকতে আরম্ভ করে। তাই আগে অগ্রহায়ণ (অগ্র=প্রথম, হায়ণ=মাস) মাসেই নতুন বছর আরম্ভ হতো। বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে নবান্ন, আর তাকে ঘিরে হিন্দুর বারো পূজার প্রচলন আছে। হিন্দু পরিবারে নতুন অন্ন যেমন পিতৃপুরুষ ও দেবতাকে নিবেদন করা হয়, তেমনই তার ভাগ থেকে কাক প্রভৃতি প্রাণীও বঞ্চিত হয় না। হিন্দু লোকবিশ্বাসে কাকের মাধ্যমে ঐ খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’। সকলকে উৎসর্গ করার পরে, এবং আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করার পরেই গৃহকর্তা পরিবারবর্গ সহ নতুন গুড় সহযোগে নতুন নবান্ন গ্রহণ করেন। ‘তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা’, ঔপনিষদিক এই আদর্শের প্রতিফলন ভারতের সর্বত্রই বিরাজিত। প্রকৃতি-প্রেমিক কবি জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠে এই বাংলা প্রকৃতির মাঝে আবার ফিরে আসার আকুতি ধ্বনিত হয়েছে, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। হৈমন্তী প্রকৃতি কবির বর্ণনায় অপরূপ, ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল,/ প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে/ পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে।’
শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাসঙ্গিনী জগজ্জননী মা-সারদা বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটি গ্রামের কন্যা। ভক্ত ও শিষ্যদের পৌষপার্বণে নিজহাতে পিঠে তৈরি করে খাইয়েছেন। একবার পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে মা পিঠে তৈরি করেছেন। মায়ের স্নেহের ভক্ত-সন্তান বিভূতি, আদর করে যাকে মা ‘কালোমানিক’ ডাকতেন, ছুটিছাটা পেলেই তিনি জয়রামবাটি আসেন মাতৃদর্শনে। সেবারও তাঁর আসবার কথা জেনেই মা তাঁর জন্য পিঠে তুলে রেখেছেন। কিন্তু কোনও কারণে তাঁর আসতে বড্ড দেরি হচ্ছে। মা রোজই একবার করে পিঠেগুলো ভেজে তুলে রাখেন, যাতে করে বিভূতি এসে পৌঁছানো পর্যন্ত নষ্ট না হয় ও সে পিঠের ভাগ পায়। কারণ সে এসে পড়লে মনে হবে, ‘আহা খেতে পেল না!’ তখন তো আর বাজারে ফ্রিজ আসেনি! অবশেষে চারদিন পরে বিভূতি এলেন এবং পিঠের ভাগ পেলেন (শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে, ৪র্থ খণ্ড)। পিঠের কথা ভাবলেই মনে আসে শ্রীশ্রীমায়ের এই অযাচিত স্নেহের ঘটনাটি, ‘পিঠে’-র রূপ ধরে যা রামকৃষ্ণ-সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে আর আমাদের জন্য এভাবেই বুঝি তুলে রাখা আছে মাতৃস্নেহের অমৃত!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন