সুমনা সাহা
গত বছরের গোটাটাই মাস্ক পড়ে আর করোনার আতঙ্কে প্রায় ঘরে বসেই কেটে গেলেও একেবারে শুরুটা নেহাৎ মন্দ হয়নি! লকডাউন আরম্ভ হয়েছিল মার্চ মাসের শেষের দিকে, কিন্তু বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে আমরা সপরিবার রাজস্থান বেড়াতে গিয়েছিলাম ভায়া দিল্লী এবং দিল্লীতে কাটিয়েছিলাম আস্ত তিনটে দিন। সকাল বেলা পুরনো দিল্লীর নস্ট্যালজিক খাওয়াদাওয়ার সন্ধানে রিক্সা করে গিয়েছি ‘পরাঠা গলি’। পরোটা খেয়ে রওনা দিয়েছি বিখ্যাত ‘জালেবিওয়ালা’-তে জিলিপি খেতে। বেশ ঠাণ্ডা তখন। রবিবারের সকাল। দোকানপাটের ঝাপ বেশীরভাগ বন্ধ। হালকা কুয়াশা ঝুলে আছে ঘোমটার মত গলির মাথায়। হঠাৎ দেখি, একটা জামা গায়ে দেওয়া নাদুসনুদুস কুকুর। বড়লোক জাতের পোষা কুকুর নয়, নেড়ি কুকুর। পরে দেখলাম পথে যত কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, সবার গায়ে জামা। তার মানে কোন প্রেমিকের কাজ, ভালোবেসে শীতবস্ত্র পরিয়েছে পথের অবোলা প্রাণিগুলোকে। ওদের গরমজামার দরকার হয় না। ভগবান ওদের প্রকৃতির ঋতুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য বেশী করে লোমের আস্তরণ দিয়েছেন। কিন্তু ভালোবাসার পাত্রকে আত্মবৎ সেবা করে ভক্ত আনন্দ পায়। আমাদের আশেপাশে মানুষ ছাড়াও একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে সহাবস্থান করে কাক, শালিখ, চড়াই, পায়রা, কুকুর, বেড়াল, গরু, ছাগল, কাঠবেড়ালী, ইঁদুর ও আরও অনেক প্রাণি। এরাও তো আমাদের নিকট প্রতিবেশীই। অথচ এদের কথা আমরা কতটুকুই বা ভাবি?
মাদারস ডে, রোজ ডে, বুক ডে, কিম্বা ভ্যালেন্টাইন ডে-র মত আমাদের এই প্রতিবেশীদের ভালমন্দের কথা ভাববার, সমস্ত বিশ্বজুড়ে পশুপাখিদের স্বার্থ দেখবার, তাদের অধিকার সুরক্ষিত করবার জন্যেও কয়েকটি দিন ধার্য করা হয়েছে। বিশ্ব প্রাণিদিবস ও বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস এমনই দুটি দিন। প্রথমটি ইংরাজি অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে এবং দ্বিতীয়টি মার্চ মাসের ৩ তারিখে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। ওয়র্ল্ড অ্যানিমাল ডে-র ভাবনা প্রথম ভেবেছিলেন একজন জার্মান পরিবেশবিদ, পশুপ্রেমী, ‘Mensch Und Hund’ (Man and Dog) নামের একটি পত্রিকার লেখক, সম্পাদক ও প্রকাশন, হাইনরিখ জিমারম্যান। [২৪ মার্চ, ১৯২৫ তিনি বার্লিন-এর স্পোর্ট প্যালেসে প্রথম বিশ্ব প্রাণিদিবস-এর অধিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড ও চেকোস্লোভাকিয়া থেকে প্রায় ৫০০০ মানুষ। জিমারম্যান চেয়েছিলেন, Patron Saint of Animals, আসিসি-র সেন্ট ফ্রান্সিস-এর ‘feast day’-র দিন, ৪ অক্টোবর এটি হোক, কিন্তু নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু হাইনরিখ হাল ছাড়েননি, প্রতি বছর উৎসাহ নিয়ে প্রচার করে গেছেন এবং অবশেষে মে, ] ১৯৩১ ইটালির ফ্লোরেন্সে, বিশ্ব প্রাণি-সুরক্ষা সংস্থা আয়োজিত এক সমাবেশে সর্বসম্মতিক্রমে অক্টোবর ৪ বিশ্ব প্রাণিদিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়।
ইউনাইটেড নেশানস জেনারেল অ্যাসেম্বলি-র (UNGA) ৬৮ তম অধিবেশনে (২০ ডিসেম্বর, ২০১৩) ৩ মার্চ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস রূপে স্থির করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নির্ধারিত হয় দিনটি।
ওদের কাছে আমাদের ঋণ:
সভ্যতার সূচনা পর্বে নগর ছিল না, ছিল কেবল বন, উপবন, অরণ্য, মরুভূমি, তৃণভূমি, সমতল ভূমি। মানুষ ও পশু খাদ্যের জন্য পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ একসময় বনের পশুকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত দাস করে তুললো, আর নিজে হল প্রকৃতির রাজত্বে প্রভু। প্রকৃতির বুকে হেন কোন প্রাণি নেই, যাকে ব্যবহার করতে মানুষ ছেড়েছে, গরু-মোষ-ভেড়া-ছাগল-শূকর পালন করে দুধ, মাংস, চামড়া, খুড়, শিং, লোম; হাঁস-মুরগি পাখি পালন করে আমরা সংগ্রহ করি ডিম, মাংস; হুলের জ্বালা সইবার ভয়ে বনের মৌমাছির জন্য ঘর গড়ে দিয়ে বলি, ‘এসো মধু দিয়ে পূর্ণ করো আমাদের স্বাদ ও স্বাস্থ্য’, রেশমকীটের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিই রঙিন মোলায়েম সিল্ক-সুতো, ঘোড়া-গাধা-উটকে দুমুঠো খেতে দিয়ে জন্মের শোধ বোঝা [বওয়াই] বইতে বাধ্য করি, তাদের চামড়া দিয়ে জুতো বানাই, হাড়গোড়, নাড়ীভুঁড়ি কিছুই ব্যবহার করতে ছাড়ি না।
জগতের প্রাচীন সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা, আজ থেকে প্রায় ১০,০০০ বছর আগে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে বিস্তৃত হয়েছিল, বর্তমানে যেস্থানে আধুনিক ইরান, ইরাক, তুর্কি, সিরিয়া প্রভৃতি দেশগুলো। সভ্যতার ঊষালগ্নে, মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হল, তখন থেকেই গম, বার্লি, মটর, মসুর ইত্যাদি বীজ ছড়িয়ে এবং বনজ উদ্ভিদকে ঘরোয়া কাজে লাগানোর জন্য চাষ শুরু হয়েছিল, সেভাবেই দুধ, মাংস প্রভৃতি খাবারের জন্য এবং পশুর লোমশুদ্ধ চামড়া বস্ত্র হিসাবে, জিনিসপত্র সঞ্চিত রাখতে ও তাঁবু হিসাবে ব্যবহার করার প্রয়োজনে ঐ একই সময়ে বন্য পশুকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করাও আরম্ভ হয়েছিল।
প্রায় ২০,০০০-১০,০০০ বছর আগে বাইসন প্রজাতির এক অতিকায় প্রাণি ইউরোপ ও এশিয়ার সাব-আর্কটিক তুন্দ্রা অঞ্চলে বসবাস করত। এদের থেকে আকারে অনেক ছোট ও অনেক কম শক্তিশালী দুটি প্রজাতির শিকারি প্রাণি এদের মেরে ফেলত। একটি হল নেকড়ে, দ্বিতীয়টা মানুষ। সত্যিই এই দুটি প্রজাতির প্রাণির মধ্যে আশ্চর্য মিল! এরা দলবদ্ধ হলে সব অসাধ্য সাধন করতে পারে। উভয় প্রাণির সমাজই পরিবারভিত্তিক, পরিবারে একজন পুরুষ ‘কর্তা’, এবং একজন নারী তার পরের পদাধিকারিনী। দলের সদস্যদের প্রতি এরা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে, কিন্তু বহিরাগতদের প্রতি ‘হাইলি সাসপিশিয়াস্!’ পরিবারের সকলেই নবজাতককে সাবধানে রাখে এবং উভয় প্রজাতিই দলের অন্যান্য সদস্যদের নিজেদের ভালোমন্দ মেজাজ অভিব্যক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে। মানুষ আর নেকড়ে, একরকম, ভাবা যায়? উভয়েই উভয়ের বন্ধুত্বে লাভ, এটা হৃদয়ঙ্গম করেছিল। বহু বিদেশী রূপকথায় মানব শিশুর নেকড়ে মায়ের কাছে মানুষ হওয়া এবং পালছুট নেকড়ে শিশুর মানব-পরিবারে বেড়ে ওঠার গল্প আছে। মানুষের বুদ্ধি, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আর অস্ত্রের প্রয়োগ নেকড়ের কাছে ঈর্ষণীয়, অন্যদিকে নেকড়ের দৌড়ানোর ক্ষমতা ও হিংস্রতা মানুষের নেই। দুজনে জোট বেঁধেছিল স্বার্থে, বড় শিকার ধরব, ভাগ করে খাব। আজকের যত পোষা কুকুর, শিয়াল, হায়না সবাই আদতে ঐ আদিম নেকড়েরই বংশধর।
ছাগল ও ভেড়া সম্ভবত প্রথম গৃহপালিত প্রাণি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মুরগি পালনও শুরু হয় ১০,০০০ বছর আগে। পরে মানুষ ক্রমশ আরও বড় বড় প্রাণি পোষ মানাতে আরম্ভ করে, যেমন ষাঁড়, ঘোড়া প্রভৃতি ভারবাহী পশু। এভাবেই মানুষ ক্রমে গরু-ছাগল-ভেড়া-হাঁস-মুরগি-ঘোড়া-উট প্রভৃতি প্রাণিদের পোষ মানাতে আরম্ভ করে।
‘বন্যেরা বনে সুন্দর’-প্রবাদ আছে, স্বাধীন বনের পশু বা পাখিকে ঘরের অনুগত বন্দীতে পরিণত করা সহজ কাজ নয়। তবে তৃণভোজী প্রাণিদের পালন সহজতর যেহেতু তারা নিজেরাই চরে খেতে পারে, সে তুলনায় দানা শস্য খাওয়া প্রাণি, যেমন-মুরগি-পালন, অপেক্ষাকৃত ঝামেলার, যেহেতু শস্য আমাদের চাষ করে পেতে হয়। আবার একসময় যে উদ্দেশ্যে কোন পশুকে গৃহপালিত করা হয়েছে, কালে সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। সেকালে শিকারের প্রয়োজনে মানুষ কুকুর পুষত। পশু-শিকার নিষিদ্ধ হওয়ায় অসংখ্য প্রজাতির শিকারী-কুকুর এখন নেহাৎই বাড়ির আদরের পোষ্য। মানুষ বহু বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় উপকারী বন্য প্রাণির মধ্যে কতগুলো ‘দরকারি’ অভ্যাস বিকশিত করে তুলেছে, যেমন-তার উগ্র স্বভাবকে মেরেধরে শান্ত করে ফেলা, তাকে বদ্ধ পরিবেশে প্রজননে বাধ্য করা, কোনও প্রাণির রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করার ক্ষমতাও তাকে গৃহপালিত পশু হিসাবে বেছে নেওয়ার আগে বিশেষ ভাবে বিবেচ্য হতো। এইভাবে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে একই প্রজাতির বন্যপশু ও গৃহপালিত প্রাণির মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়ে যায়। তাদের স্বভাবে যেমন পরিবর্তন আসে, দেখতেও অন্যরকম হয়ে যায়। বহু যুগ আগে বনমোরগের ওজন কিলোখানেক হত, এখন পোলট্রিতে পালিত ‘চিকেন’ সাত/আট কিলো ওজনেরও হয়। ডিম পাড়ার সংখ্যাও অনেক কম ছিল বনের স্বাভাবিক পরিবেশে, এখন কৃত্রিম ওষুধ প্রয়োগ করে একটি মুরগি থেকে বছরে আদায় করে নেওয়া হয় প্রায় ২০০ টি ডিম! ঘোড়া এতই স্বাধীনচেতা প্রাণি যে, এদের বশে এনে পিঠে চড়বার স্যাডল ও রাইডার পরাতে রীতিমত কালঘাম ছুটে যায়। তার ঐ বিদ্রোহকে দমিত করে তাকে ‘শিক্ষিত’ করে তোলার পদ্ধতিকে ট্রেনারদের ভাষায় বলে ‘ব্রেকিং’, ঘোড়ার জেদ ভেঙে দেওয়াই বটে!
চীনের পুরাতাত্ত্বিক গবেষকরা খ্রিষ্টজন্মের ২৮৫০ বছর আগেকার রেশম কীট বম্বিক্স মোরি থেকে উৎপন্ন প্রাচীনতম সিল্কতন্তু-র সন্ধান পেয়েছেন মাটির নিচে পোঁতা একটি বেতের ঝুড়িতে। প্রাচীন গ্রীসের অধিবাসীরা খড় দিয়ে বোনা উলটানো ঝুড়িতে মৌমাছির যাতায়াতের একটা ছিদ্র রেখে মৌচাক গড়ে দিত, সংগ্রহ করত মধু ও মোম। পরে ১৯ শতাব্দীর একজন পাদরি ল্যাংস্ট্রথ কাঠের বাক্সে মৌমাছি প্রতিপালনের সুন্দর কৌশল আবিষ্কার করলেন।
ঘোড়া ও গাধার মতই আরেক ভারবাহী পশু লালমোহনবাবুর ‘আশ্চর্য জানোয়ার’-উট! বন্য উটের দুটি প্রজাতি, দক্ষিণ আমেরিকার লামা ও আলপাকা, যার মধ্যে আকারে অপেক্ষাকৃত বড় লামা ভারবহনে ও লোমশ আলপাকা লোমের (উল) জন্য উত্তর আফ্রিকা, মধ্য প্রাচ্য ও ভারতে কদর পেয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে দুটি বড় দিক, জমি চাষ (লাঙ্গল দেওয়া) ও গাড়ি টানা—এদুটিতে উট অক্ষম। উট প্রতিপালনে আমেরিকার উদাসীনতা তার একটা কারণ।
সম্ভবত ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরবে উট প্রতিপালন শুরু হয় এবং মূল্যবান পন্যসামগ্রী উটের পিঠে চাপিয়ে ভারত, মেসোপটেমিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক আদানপ্রদান আরম্ভ হয়।
বনের আগুন ও আমাদের লোভী মনের আগুন:
১৯২০ সালের পরবর্তী সময় থেকে মোটর গাড়ি জনপ্রিয় পরিবহন মাধ্যম হয়ে ওঠার ফলে অস্ট্রেলিয়া গৃহপালিত উটের একটা বড় অংশ ছেড়ে দেয়। এইসব ছেড়ে দেওয়া, বলা ভাল, তাড়িয়ে দেওয়া উটেরা বন্য (ফেরাল ক্যামেল) হয়ে যায় এবং দ্রুত হারে প্রজনন করে। ফলে ১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরল জনবসতি এলাকায় বিচরণকারী ১৫০০০/২০০০০ উটের সংখ্যা ১৯৮৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩০০০, অর্থাৎ, ২০ বছরে প্রায় দ্বিগুন। ২০০১-২০০৮ সালে এই সংখ্যা হয় প্রায় ৬ লক্ষ। বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই জনন হার কমানো না গেলে তা বিপজ্জনক। বংশবিস্তার-নিয়ন্ত্রণে ‘ফেন্সিং’ পদ্ধতির কার্যকারিতা অতি ধীর। অস্ট্রেলিয়ার ঐ সমস্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়ের অভিযোগ, এই সমস্ত বন্য উট যথেচ্ছ গাছপালা ও জল খেয়ে খাদ্য ও জলসংকট সৃষ্টি করছে, সুতরাং এদের মেরে ফেলা হোক। গত বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে বৃষ্টি কম হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবে ঐ সমস্ত শুষ্ক মরু অঞ্চলে জলকষ্ট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
সরকারী নির্দেশে উটের সংখ্যা হ্রাস করবার জন্য ৮ জানুয়ারি ২০২০ থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিরল জনবসতি এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে উট মেরে ফেলা শুরু হয়েছে এবং ধীরে ধীরে ১০০০০ উট মেরে ফেলা হবে বছর শেষ হওয়ার আগে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামে, যেন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড! বলার অনেক কিছু আছে, আবার নেইও, মানুষের জীবনের সুরক্ষা নাকি পশুর? কোনটা গুরুত্বপূর্ণ? সে প্রশ্ন তো আছেই। ২০১৩ সালে বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘উট নিধন যজ্ঞ’-এর ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক লিন্ডা সেভেরিন বলেছিলেন, “ইটস নট সামথিং দ্যাট উই এনজয় ডুইং, বাট সামথিং দ্যাট উই হ্যাভ টু ডু।”
আমাজন রেইন ফরেস্ট-কে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়, বিশ্বের প্রতি ১০ টি প্রাণির মধ্যে একটির বাস এখানে। শুকনো ডালপালার ঘর্ষণে স্বাভাবিক ভাবেই বনে আগুন লেগে যায়, একে দাবানল বলা হয়। কিন্তু আমাজনের জঙ্গলে হাজার হাজার বছর ধরে স্বাভাবিক ভাবে কখনও আগুন লাগেনি, এর গাছপালা, পশুপাখি তাই বনের আগুনে অভ্যস্তই নয়, একথা বলেছেন ন্যাশনাল ইন্সটিট্যুট অব আমাজোনিয়ান রিসার্চ, ব্রাজিল-এ (INPA) জীব-বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী উইলিয়াম ম্যাগনুসন। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলে আগুন লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাজনের বন আলাদা। এখানে খুব সামান্য সাময়িক আগুন লাগলেও তা নিচের অংশে লাগে এবং বৃষ্টি শীঘ্রই সে আগুন নিভিয়ে দেয়। তবে বনের নির্দিষ্ট অঞ্চলে পরিকল্পিত ভাবে আগুন লাগানো হয় কৃষিজমি তৈরি করার জন্য। গত বছর (২০১৯) এভাবেই ব্রাজিলের রেইনফরেস্টের প্রায় ৯০০০ স্থানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমে পেরু, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ের জঙ্গল গ্রাস করে। হাজার হাজার প্রাণির জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সমগ্র ইকোসিস্টেমের উপর এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে। পশুচারণ ভূমি ও কৃষিজমি সংগ্রহের জন্য মানুষের অসঙ্গত ও অন্যায্য লোভকেই এর জন্য মূলত দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমাজনের জঙ্গল যেন প্রখর সূর্যের তাপে পৃথিবীর মাথায় ছাতা ধরে রেখেছে। আগুনের হলকা ঐ ছাতাকে পুড়িয়ে দিয়েছে, এর প্রভাবে সূর্যের তাপ সরাসরি প্রবেশ করবে এবং সমগ্র ইকোসিস্টেমের এনার্জি-ফ্লো পরিবর্তিত হয়ে যাবে, ফলস্বরূপ খাদ্য-শৃঙ্খল বিঘ্নিত হবে।
সাহিত্যে মানুষ ও প্রাণি পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা:
আগে গ্রামের প্রত্যেক ঘরেই গোয়ালঘর থাকত, পুকুরে হাঁস চড়ত, আঙিনায় মুরগি দানা খুঁটে খেত। সবাই মিলে একটি পরিবারের মতোই মিলেমিশে থাকা হত। পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার অভাব ছিল না। বাড়িতে পোষ্য প্রাণিদের বাড়ির সদস্যদের মতোই নাম ধরে ডাকা হত। দূরত্ব বাড়তে শুরু করল নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে। সেই জমিজমা-পুকুরসহ বাড়ি নেই, মানুষ এখন হাইরাইজ ফ্ল্যাটে, এক ছাদের নিচে হাজার পরিবার, আর গৃহপালিত পশু এখন বাণিজ্যিক খামারে, এক ছাদের নিচে হাজার হাজার প্রাণি। তাদের ডায়েট মাপা, ওষুধ মাপা, তারা এখন শুধুই মানুষের প্রোটিন খাদ্য। গোডাউনে রাখা চাল-গম-আলুর মত বস্তা বোঝাই হয়ে মফস্বল ও আধা মফস্বল কেন্দ্রগুলোর পোলট্রি থেকে মুরগি আসে শহরের বাজারে, সব চলে যায় মানুষের উদর-গহবরে। প্রাচীন ভারতে বহু প্রাণির মাংস খাওয়া হত। হিন্দুরা গরুর মাংস খেত কি না, এই নিয়ে বেদ-উপনিষদ-পুরাণ সব শাস্ত্র ঘেঁটে নানা মুনি নানা মত খাড়া করতে চেয়েছেন, কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট—অসুস্থ, গর্ভবতী, পাঁচ-নখ (বাঘ, সিংহ জাতীয়), এক-ক্ষুর (ঘোড়া) ও দুগ্ধবতী গাভীর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। অর্থাৎ সমাজ-রক্ষকরা পশুদের স্বার্থের কথা ভাবেননি, তা নয়।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বুড়ো আংলা’ শিশু মনে আমাদের প্রতিবেশী গাছপালা ও হরেক পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা এঁকে দেওয়ার অব্যর্থ সাহিত্য। পাখির বাসায় ইঁদুর, গরুর গোয়ালে বোলতা, ইঁদুরের গর্তে জল, বোলতার বাসায় ছুঁচোবাজি রেখে আসা মায়াদয়াহীন দুরন্ত ‘রিদয়’-এর হৃদয়বান ‘হৃদয়’ হয়ে ওঠার অপূর্ব ছবি-লেখা।
বুদ্ধ-জীবনেও দেখি এক রাজহংসের প্রাণ রক্ষার জন্য তিনি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত! যিশুখ্রিস্ট ভেড়াপালন করতেন। আমাদের শ্রীকৃষ্ণ তো গোয়ালা পরিবারে গরুড় রাখালি করেই বড় হলেন! সর্বজীবে এক চৈতন্যসত্তার অনুভবে স্থিত শ্রীরামকৃষ্ণও ইতর জীবজন্তুর কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। ঘোড়া সুস্থ না হলে সেই ঘোড়াগাড়িতে তিনি ভ্রমণ করতে কুণ্ঠিত হতেন, ঘোড়াকে ছোটার জন্য মারলে তিনি অসহায় ভাবে ছটফট করতেন, বলতেন, “আমাকে মারছে!”
একবার ভক্ত নবগোপাল ঘোষের স্ত্রী নিস্তারিণী দেবীকে তিনি এক সন্তানবতী বিড়াল-জননীকে সঠিক যত্নে লালন করবার জন্য নিজের ঘরে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। বিড়ালের যত্নআত্তি সম্পর্কে নিশ্চিন্ত করে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে শেষ পাড়ানির কড়িটি চেয়ে নিয়েছিলেন।
রামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলের ‘হাইকোর্ট’, ‘সংঘমাতা’, ‘ভক্তজননী’ শ্রীশ্রীমা সারদাও ইতর জীবের প্রতি ভালোবাসা ও সেবার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী রাধারানীর পোষা বেড়ালকে দেখলেই ব্রহ্মচারী সন্তান জ্ঞান মহারাজ লাঠিপেটা করে তাড়াতেন। মা তার জন্য এক পোয়া করে দুধের ব্যবস্থা করেহিলেন, মায়ের পায়ের কাছে সে নির্ভয়ে শুয়ে থাকত। চুরি করে খাবার খেলেও মা রাগ করতেন না, বলতেন, “চুরি করা তো ওদের ধর্ম, বাবা, কে আর ওদের আদর করে খেতে দেবে?” জয়রামবাটিতে মা গরু-বাছুরের সেবা করতেন অতি যত্নে। পোষা চন্দনা পাখিটিকে মা ঠাকুরের প্রসাদ খেতে দিতেন এবং তার মৃত্যু হলে মানুষের মত শ্রদ্ধাসহকারে নদীতীরে তার দেহের সৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দও তাঁর শেষবেলার দিনগুলিতে রাজহংসী, ছাগল ‘মটরু’, ‘বাঘা’ কুকুর এইসমস্ত পোষ্যবর্গ নিয়ে শিশুর মত মহানন্দে থাকতেন।
ইদানীং মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে নানা পশুপ্রেমী সংস্থা। সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ‘অবোলা’ জীবের দাবীদাওয়া। সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’, অবনীন্দ্রনাথের ‘বুড়ো আংলা,’ আনা সোয়েলস-এর ‘ব্ল্যাক বিউটি’, চলচ্চিত্রে ‘Finding Nemo’, ‘Charlotte’s Web’, ‘The Fox and the Hound’, ‘Babe’, ‘Shark Tale’, ‘Chicken Run’, ‘Marmaduke’, ‘Free Birds’ ইত্যাদি বিখ্যাত। সাহিত্যিক হেনরি বেস্টন-এর সুন্দর ভাবনা, ‘দ্য আদার নেশনস’-এ প্রাণিত হয়ে গঠিত হয়েছে পেটা (পিপল ফর দ্য এথিকাল ট্রিটমেন্ট অব দ্য অ্যানিমালস)। এছাড়া আছে World Animal Protection-এর মত নানা সংগঠন ও সংস্থা যারা পশুপাখিদের সুখসুবিধার জন্য কাজ করছেন। এই ধরনের সংস্থাগুলোর প্রধান কাজ হল প্রোটিন চাহিদা মেটানো বা অন্যান্য প্রয়োজনে (রেশম, মধু সংগ্রহ কিম্বা ভারবহনে) পশুদের উপর অযথা নির্যাতন না করা হয়, তাদের না খেয়ে না মরতে হয়, পশুরোগের চিকিৎসা করা এবং সার্কাস, সিনেমা বা অন্যান্য বিনোদনের জন্য যেন কোনও প্রাণির উপর অত্যচার না করা হয়; তারাও যেন মানুষের মত একইরকম অধিকারে এই গ্রহে বাস করতে পারে—এইসমস্ত দেখভাল করা। এই গ্রহে মানুষ-পশুপাখি-গাছপালা সবাই নিজস্ব অধিকার সহ বাঁচতে পারি— আমাদের প্রত্যেকের উপরেই এই দায়িত্ব বর্তায়।
মানুষ ও তার পোষ্য-সহবাসী প্রাণিটির মধ্যে আত্মিক সম্পর্কের জীবন্ত এক ছবি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’-এর একটি দৃশ্য উল্লেখ করে এই নিবন্ধের ইতি টানব। জাতপাত, ছুঁৎমার্গ ও জমিদার- শোষিত প্রজা নিয়ে তৎকালীন গ্রামবাংলার শতচ্ছিন্ন সমাজের এক আদর্শ প্রতিনিধি, হতদরিদ্র গফুর জোলা তার বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে চাষের সহায়ক পোষা ষাঁড় মহেশকে নিজের ছেলে বলে মনে করে, নিজে অভুক্ত থেকেও মহেশের মুখে খাবার তুলে দেয়। এমনকি মেয়ে আমিনাকে আড়াল করে ঘর ভেঙ্গে পড়ার বিপদকেও অগ্রাহ্য করে নিজের ঘর ছাওয়া খড় টেনে মহেশের মুখে ধরে। সে যে ‘অবোলা জীব!’ শেষমেশ অনাহারে মারা যায় মহেশ। সেই করুণ কাহিনী পাঠকের চোখে জল আনে। মহেশ মারা গেলে গফুর কাঁদতে কাঁদতে ‘নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে’ মুখ তুলে যা বলে, মানুষ যদি সেই কান্না শোনে, তবেই সভ্যতার অগ্রগতি রক্ষা পাবে—“আল্লা! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চ’রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ করো না।”
আমাদের স্বার্থপূরণের জন্য যেন পশুর প্রতি আমাদের আচরণ ‘পাশবিক’ না হয়, তাদের বুঝিয়ে দিতে পারি , ‘ভালবাসি তোমাদের’, প্রকৃতি তথা সভ্যতার সুস্থতার জন্য এটুকু বড় প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
1. Worldanimalday.org.uk Archived from the original, The Origin Of World Animal Day (PDF) on 2018.09.29.
2. Blog of Natasha Daly, Editor/Writer of National Geographic.
3. Article by Morgan Erickson Davis.
4. https://news.nationalgeographic.com by Sarah Zeilinski.
5. www.historyworld.net
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
আগেই পড়েছিলাম আবার একবার পড়লাম কত তথ্য সমৃদ্ধ