travel-lalpaharir-deshe-rangamatir-deshe

লালপাহাড়ীর দেশে রাঙামাটির দেশে
নন্দিনী নাগ

যেখানে হোটেলের নাম ‘কাঁচালঙ্কা’, পর্যটকনিবাসের নাম ‘লালপিঁপড়ে’, সেখানে খাবার থালায় এমন আজব পদ উপস্থিত হলে অবাক হওয়া মানা হ্যায়!

ঘুরতে ঘুরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে ঘড়ির কাঁটা হাঁটা দিয়েছিল, পেটও জানান দিচ্ছিল সকলের। কোভিড বিধি মেনে হাত-মুখ ধুয়ে থালার সামনে বসতেই এসে গেল একেবারে ঘরোয়া খানা। একটু মোটা চালের ভাত, যত্ন করে রাঁধা ডাল তরকারী আর দেশি মুরগীর ঝোল, পাঁপড়ভাজা। এরপরে চাটনি হিসাবে যে জিনিসটি থালার পাশে দিয়ে গেল তার নাম শুনে চমকে উঠলাম। সুমন, আমাদের জঙ্গলমহলের পথপ্রদর্শক, বলল, “খেয়ে দেখুন ম্যাডাম! আগে কোনোদিন খাননি!”

জিনিসটা দেখে তেঁতুলের আচার বলে মনে হচ্ছিল। তেঁতুলের আচার বিহনে কোনো বাঙালি বালিকা বড় হয়ে ওঠে না। অথচ কোনোদিন খাইনি শুনে তাই জিজ্ঞেস করতেই হল, “কিসের চাটনি এটা?”

আসলে আমার মনে শুঁটকিমাছের ভয় ছিল। আসামের শিলচরে এমন আচারের মত দেখতে শুঁটকিমাছের পদ দেখেছি। সে অবশ্য চোখেই, চেখে দেখার ইচ্ছে একদমই নেই। এটা তেমনই কোনো পদ কিনা, সেটা জানতে তাই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“লালপিঁপড়ের চাটনি। এটা এখানে স্পেশাল”

সুমন জবাব দিল।

আমি থমকে গেলাম। এই লালপিঁপড়ের সুবাদেই জঙ্গলমহলের নাম খবরের শিরোনামে চলে এসেছিল কয়েকবছর আগে। পিঁপড়ে নয় অবশ্য, পিঁপড়ের ডিম। আমলাশোলের মানুষ ভাতের অভাবে পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বেঁচে আছেন, তখন এমনটাই জেনেছিলাম। এর বছরদশেক বাদে, জঙ্গলমহলে বেড়াতে এসে নিজে সেই পিঁপড়ের চাটনি খেয়ে জানতে পারছি, এটা একটা ডেলিকেসি, কারন পিঁপড়ে বা পিঁপড়ের ডিমের বাজার বেশ চড়া। এই লাল পিঁপড়ে অবশ্য আমাদের ছা-পোষা চিনিখেকো ঘরোয়া লালপিঁপড়ে নয়, শালগাছের বাসিন্দা এই পিঁপড়েরা বেশ উচ্চবংশীয়। বুঝতে পারলাম, দুদিন ধরে শালগাছের গোড়ায় যেসব সুউচ্চ অট্টালিকা দেখে, উঁইয়ের ঢিবি ভেবেছি, সেই বল্মীকসকল আসলে এইসব পিঁপড়েদেরই নগরী। কিছুক্ষণ আগে রাস্তায় একটা অতিথি নিবাসের নাম দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম। এখন বেশ বুঝতে পারলাম কেন এরা ভালোবেসে অতিথি নিবাসের নাম রেখেছে ‘লালপিঁপড়ে’।

গত দুদিন ধরে আমরা সুমনের তত্বাবধানে ঝাড়গ্রামসহ জঙ্গলমহলে ঘুরছি। আজ ওর কথা মেনেই এখানে লাঞ্চ করা, নইলে এমন একটা জিনিস চেখে দেখার সৌভাগ্য হত না।

ঝাড়গ্রাম জায়গাটা আদিতে ছিল ‘মাল’ রাজাদের রাজ্য ‘ঝাড়িখন্ড’ এর অন্তর্গত। ইতিহাস বলছে, ১৫৭০ এ আকবরের নির্দেশে, রাজস্থান থেকে সর্বেশ্বর সিং চৌহান বাংলা বিজয়ে আসেন। ‘মাল’ রাজাদের পরাজিত করে তিনি জঙ্গল-রাজ্য ‘ঝাড়িখন্ড’ দখল করেন এবং ‘মল্লদেব’ নাম নিয়ে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজ্যের রাজধানীই হল ঝাড়গ্রাম। এরপর আরো চারশো বছর ধরে, আঠারোজন রাজা এখানে রাজত্ব করেন। এখন রাজত্ব গেলেও রাজবংশ তো আছে, এবং তাঁরা এই রাজবাড়িতেই বাস করেন। রাজপরিবারের বর্তমান উত্তরাধিকারী ঝাড়গ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। ইনি বিশেষ নিরাপত্তাপ্রাপ্ত, এঁর নিরাপত্তার কারনে সাধারণ পর্যটকদের এখন রাজবাড়ীর ভেতরে ঢোকা নিষিদ্ধ, যদিও রাজবাড়ীর একতলাটা হেরিটেজ হিসাবে ঘোষিত। একমাত্র যেসব পর্যটকরা ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন থেকে রাজবাড়ির অতিথিনিবাসে বুকিং করে আসেন, তারাই কেবল রাজবাড়ির দ্রষ্টব্যগুলো দেখার সুযোগ পান। আমাদের সে বুকিং ছিল না, তাই আমাদের কেবল বাইরে থেকেই ‘রাজবাড়ি’ দেখে চলে আসতে হল। ইউরোপীয় আর মোগল স্থাপত্যের মিশেলে তৈরি যে রাজবাড়িটি আমরা এখন দেখতে পাই সেটি ১৯৩১ এ তৈরি, অর্থাৎ রাজবাড়ি হিসেবে এক্কেবারে টাটকা। প্রায় ৩৬০ বছরের পুরনো, প্রাচীন রাজবাড়িটা নতুন বাড়ির পেছনে থাকায়, ফটকের বাইরে থেকে তার দর্শন পাওয়ার সুযোগ লাভে বঞ্চিত থাকতে হল। আমাদের ঝটিতি ঝাড়গ্রাম ভ্রমণ শুরু হল এই রাজবাড়ি দর্শন দিয়েই। রাজা থেকেই প্রজায় যাওয়া বিধেয় কিনা।

ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি থেকে অনতিদূরেই সাবিত্রী মন্দির, বেশ পুরনো। লাল বেলে পাথরের এই মন্দিরটিও রাজা সর্বেশ্বর সিং এর তৈরি,রাজপরিবারের পবিত্র মন্দির এটি। রূপোর তৈরি সাবিত্রী দেবী ৩৬০ বছর ধরে পূজিত হয়ে আসছেন। মন্দিরের পেছনে যে পুকুরটি আছে, তাতে প্রচুর প্রত্নসম্পদ পাওয়া গেছিল। মন্দিরের সামনের প্রাঙ্গনে সাড়ম্বরে ইদের উৎসব পালন হয়ে আসছে আরও আগে থেকে। জানলাম মন্দিরের পুকুর থেকেই ইদে ব্যবহৃত শালবল্লাগুলোকে রীতি অনুসারে স্নান করানো হয়। এ নিয়ে এখানকার মানুষের মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই। রামভক্তেরা সম্প্রীতি নষ্ট করার এমন সুযোগ হাতছাড়া কিভাবে করল, সেটা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম চিল্কিগড় রাজবাড়িতে। ‘চিল্কিগড় রাজবাড়ি’ নামটার মধ্যে এমন একটা আলোর ফুলকি আছে যে, নামটা শুনে অবধি দেখার জন্য আমি বড়ই উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু দেখে হতাশই হতে হল। নামে রাজবাড়ি হলেও আদতে এটা জমিদারের বাড়ি। তাতে অবশ্য অসুবিধা কিছু ছিল না, যদি বাড়িটা রক্ষণাবেক্ষণ করা হত। জরাজীর্ণ বাড়িটির ভালো অংশটিতে সরকারি অফিস রয়েছে, আর ভেঙে পড়া অংশটিতে রয়েছে স্থপতিদের আকৃষ্ট করার মতো খিলান আর ছাদের বেশ কিছু সুন্দর কাজ। এই অংশটিতে যেভাবে বট-অশ্বত্থে জট ধরেছে, তাতে মনে হল আগামী দশবছর পরে এর আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। চিল্কিগড় রাজবাড়িটি অবশ্য বেশ কিছু বাংলা চলচ্চিত্রের লোকেশন, দেখে চিনতে পারলাম। মূল প্রাসাদের বাইরে যে শিবমন্দির আছে তা বেশ সুন্দর আছে, তাতে নিয়মিত পূজোপাঠ চলে।

চিল্কিগড় থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম বহুশ্রুত কনকদুর্গা মন্দির দেখতে। সোনার তৈরি এই দুর্গার মূর্তি কিন্তু আমাদের পরিচিত দেবী দুর্গার মূর্তির থেকে একদম আলাদা রকমের দেখতে। কথিত আছে, স্বপ্নে আদেশ পেয়ে ঝাড়গ্রাম রাজপরিবারের রানীমা, তাঁর সমস্ত স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে দেবীর এই সোনার মূর্তিটি তৈরি করান। কনকদুর্গা মন্দিরে যাওয়ার পথটা ভীষণ সুন্দর, দুপাশে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে পায়ে চলা পথ, সেই পথ পৌঁছে দেবে মন্দিরের সামনের খোলা মাঠে। এই পথের দুপাশের জঙ্গলে রয়েছে নানারকম ওষধি গাছ, যাদের গায়ে সাঁটা লেবেল দেখে হাঁটতে হাঁটতেই চিনে নেওয়া যাবে তাদের। যাঁদের গাছে আগ্রহ নেই, তাঁরা চোখ রাখবেন আরও একটু ভেতরে, হঠাৎ করেই চোখে পড়ে যাবে দু-চারটে হরিণ কিংবা হাতী। তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, তারা কেউ জীবিত নয়, নেহাতই মাটির তৈরি, ভ্রমণার্থীদের গভীর জঙ্গলের স্বাদ দেবার জন্য এমন বন্দোবস্ত।

কনকদুর্গার প্রাচীন মন্দিরটি পরিত্যক্ত এখন। মন্দিরের মাঝামাঝি চওড়া এক ফাটল একে সমান দুভাগে ভাগ করে ফেলেছে, তবু নতুন মন্দিরের চেয়ে এই এই প্রাচীন দালানটাই বেশি মন কাড়ে। এর সর্বাঙ্গে প্রাচীনত্বের প্রলেপ, কল্পকথার হাতছানি। শুনলাম দুর্গাপূজার নবমীর দিন বিরাট উৎসব হয়, মেলা বসে এখানে। ভীড় সামলাতে বাইরের গাড়ি,পর্যটকদের তখন প্রবেশ নিষেধ। ভগ্ন কনকদুর্গা মন্দিরের কোল ঘেঁষে আছে একটা ঢালু পথের হাতছানি, যে পথ বেয়ে নেমে গেলে দেখা হয়ে যাবে ছিপছিপে তরুণী ডুলুং এর সঙ্গে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে এঁকে বেঁকে সে চলেছে সুবর্ণরেখা অভিসারে। এখন তাতে হাঁটুডোবা জল হলে কি হয়, বর্ষায় সে গর্ভিণী নারী।

ডুলুং এর পাড়েই বিকেল ফুরোলো সেদিন, ফিরে এলাম অতিথিনিবাসে।

আমরা উঠেছিলাম লোধাশুলির ‘ঝাড়গ্রাম প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ তে। শালের জঙ্গলের উপান্তে নতুন তৈরি হওয়া এই সরকারি আবাসস্থলের ব্যবস্থাপনা বেশ আরামদায়ক, কর্মচারীরাও খুব অতিথিবৎসল। বড়রাস্তার ধারে হলেও, রাত যখন নামে তখন শালগাছের আদরে থাকা এই নিবাসটিকে মনে হয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। বাড়িটির চারপাশে কেটে রাখা শালের লগ আর ঝরা পাতার ওপর বাতাস বয়ে যাওয়ার আওয়াজে বেশ একটা রহস্যময় পরিবেশ। মাঝেমধ্যে হাতিও দল বেঁধে চলে আসে শুনে, অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে থাকা গজরাজদের কল্পনা করে রোমাঞ্চ আরও গাঢ় হয়ে গেল।

পরদিন আমাদের ঝাড়গ্রাম ছেড়ে বাইরে ঘোরার পরিকল্পনা, তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। জঙ্গলমহলের গল্প মানে তাতে রয়েছে ঘাম আর রক্তের গন্ধ। আদিবাসীদের জঙ্গল কেটে আবাদ করা আর জমিদারদের শোষণে সর্বস্বান্ত হয়ে ঘর ছেড়ে আবার নতুন জঙ্গল হাসিল করে বসতি গড়ার কাহিনী ইতিহাস রয়েছে এর পাতায় পাতায়। একসময় শোষণের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল আদিবাসী সমাজ, সিধো-কানহুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিল ব্রিটিশদের বিরূদ্ধে। ফাঁসি হয়েছিল তাদের, তবু গর্জে ওঠার সাহস তাদের অমর করেছে। এই ইতিহাসের কিছুটা সংরক্ষিত আছে লোধাশুলির মিউজিয়ামে, সেইসঙ্গে আছে আদিবাসীদের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য তাদের প্রাত্যহিকতার নানা দিক। এই মিউজিয়াম আমরা আগের দিনই দেখেছিলাম, তবে দ্বিতীয়দিন ঘুরতে ঘুরতে নানা অনুসঙ্গে জঙ্গলমহলের আদি বাসিন্দাদের ওপর রাষ্ট্রীয় শোষণের কথা অনেকবারই মনে পড়ল, তাই ধান ভাঙার আগে এই শিবের গান শোনানো।

এদিন সকালে প্রথমে গেলাম গাডঢ়াসিনি পাহাড়ে, বেশ খানিকটা পথ ট্রেকিং করে পৌঁছাতে হয় চুড়োয়, মন্দির আছে সেখানে। তারপর দেখে নেওয়া গেল তারাফেনী নদী আর ঘাঘরা প্রপাত। তারাফেনীকে স্থানীয়রা বলে রকিং রিভার, পাথরে পাথরে আছড়ে পড়ছে যে ক্ষীণ জলধারাটি, তার শব্দ শুনে জলকে খুঁজে বার করতে হয়। পাথর টাথর টপকে ওপারে গিয়ে জলধারার উৎস সন্ধানে বেশ কিছুটা হেঁটেও খোঁজ মিলল না নদীর উৎসমুখ, হয়ত সে কোনো পাহাড়ি ঝোরা। গাইড বলল, এই বালিকা তারাফেনী, চঞ্চল দুই বেনী দুলিয়ে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে কাঁসাই নদীতে। মাসটা ফেব্রুয়ারী হলেও বেলা বাড়তে সূর্য বেশ প্রখর, তারাফেনীর ঠান্ডা জল চোখে মুখে দিয়ে বেশ আরাম হল।

এরপরের গন্তব্য খাঁদারানী ড্যাম। জল সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা এই জলাধার বেশ সুন্দর। এর চরে পরিযায়ী পাখিদের মেলা বসে গেছে। বাঁধের ওপর দেখা মিলল পসরাসমেত পাথরশিল্পীদের। কাছেই রয়েছে শিমূলগ্রাম, সেখানেই বসবাস কয়েকঘর পাথরশিল্পীর। গ্রামের নামটি যতটা রোমান্টিক, তার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা ততটাই কষ্টকর। দূরের পাহাড় থেকে পাথর ভেঙে এনে, তাকে খোদাইয়ের উপযুক্ত করে তৈরি করে, কড়া রোদ্দুরে সারাদিন বসে, খুদে খুদে বাসনপত্র বা দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করার কাজটি বেশ পরিশ্রমের। তাও যদি সেসব জন্য জিনিসের ভালো বাজার থাকত! কষ্ট করে হলেও শিল্পের এই পরম্পরা এখনও টিঁকিয়ে রেখেছেন কয়েকজন হতদরিদ্র শিল্পী। আমরা অপ্রয়োজনে কয়েকটা জিনিস কিনলাম একজন বৃদ্ধ শিল্পীর কাছ থেকে, তারপর অন্য গন্তব্য।

কয়েকবছর আগে পর্যন্ত বেলপাহাড়ী, বাঁশপাহাড়ী, বুড়িশোল নামগুলো শুনলেই ভয় হত, ভাবতে পারতাম না এসব জায়গায় কখনো পা রাখতে পারব! জনসাধারণের কমিটি নামধারী রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার এসব অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরের মানুষ। এই পথে যেতে যেতে সুমনের মুখে শুনছিলাম সেইসব দিনরাতের বিভীষিকার কাহিনী। সেইসব চড়াই-উতরাই বেয়ে চলছিল আমাদের গাড়ি যে পথে প্রায়ই পড়ে থাকত কমিটির বিচারে প্রাণ হারানো মানুষের মৃতদেহ। বুড়িশোলের জঙ্গলের রাঙামাটির পথ ধরে কিছুটা হেঁটে আসার সময় অদ্ভুত এক অনুভব হচ্ছিল, সুমন বলেছিল, এনকাউন্টারের আগে কিষেণজিকে ওই পথেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

রাজা আসে রাজা যায়, শ্রমজীবি মানুষের জীবন বদলায় না খুব বেশি কিছু। গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় দুপাশের বাড়িঘর গুলো দেখে তেমনই মনে হল। মেয়েরা জঙ্গল থেকে মাথায় করে কাঠ বয়ে আনছে, বা শুকনো শালপাতা জড়ো করে রাখছে জ্বালানী করার জন্য, এ দৃশ্য অনবরত চোখে পড়ছিল। আর ছিল বাবুই ঘাসের দড়ি বানানোর ব্যস্ততা। সাবাই ঘাস বা বাবুই ঘাস থেকে দড়ি বানানো এই অঞ্চলের অন্যতম জীবিকা। শক্ত এই দড়িগুলো দিয়ে খাটিয়া, মোড়া বা চেয়ারের বসার জায়গা বোনা হয়। ঘাসকে শুকিয়ে তা থেকে দড়ি বানানোর পুরো পদ্ধতিটাই চোখে পড়ল রাস্তায় যেতে যেতে। এই কাজে ঘরে ঘরে মহিলারা ব্যস্ত এমনকি বাচ্চা মেয়েরাও হাত লাগিয়েছে। এত পরিশ্রমে বানানো দড়ির দাম কিন্তু খুবই কম পায় এরা, বিরাট একটা বান্ডিল আমরা স্মারক হিসাবে কিনলাম মাত্র তিরিশ টাকায়। বলাবাহুল্য, ফড়ের হাত ঘুরে বাজারে যখন যায় তখন এর দাম চার-পাঁচ গুণ বেশি।

আদিবাসীদের ‘শিকার উৎসব’ বেশ বড় উৎসব। এখন জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর বেশ অভাব আর তাই শিকারও নিষিদ্ধ। তবে রীতিরেওয়াজ তো আর বিসর্জন দেওয়া যায় না। তাই উৎসব পালন করা হয় একটি নির্দিষ্ট জঙ্গলে, মালাবতীর জঙ্গলে। বাইরে থেকে দেখা হল সেই শালের ঘন সবুজ জঙ্গলও। এইপথে যেতে যেতে মাঝেমাঝেই দেখছিলাম মোরগ-মুরগির দলকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে, যেগুলো বনমোরগ নয়, গৃহপালিত। তবে সবজেটে নীল বিরাট পুচ্ছে এদের মধ্যে বেশ একটা ময়ূর-ময়ূর ভাব দেখতে পেলাম। কে জানে এরা কোন প্রজাতির! তবে ভারি সুন্দর।

আমাদের পরের গন্তব্য ছিল কাঁকড়াঝোর, সেখানেই দ্বিপ্রাহরিক আহারের বন্দোবস্ত। পিঁপড়ের চাটনি সহযোগে খাওয়া দাওয়া সেরে জায়গাটা ভালো করে দেখে নিতে বেরলাম। নতুন অনেক হোমস্টে তৈরি হয়েছে এবং আরও হচ্ছে দেখলাম। সপ্তাহান্তিক ছুটি কাটানোর সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। কাঁকড়াঝোর থেকে ঘাটশিলা খুবই কাছে, চাইলে একবারের পরিকল্পনাতেই সবটা ঘুরে আসা যায়।

রাঙামাটির দেশে ঘুরছি যখন, লালপাহাড়ি তো অবশ্য গন্তব্য। ‘লালজলদেবী পাহাড়’কে ঠিক লালপাহাড়ী বলা যায় না তবে পাহাড় যখন আছে তখন তাতে চড়া অবশ্যকর্তব্য। গাইড আর ড্রাইভারসহ আমি উঠলাম পাথর ডিঙিয়ে চুড়োয়। পাহাড়চুড়ায় যে গুহা আছে, সেটি নাকি আদিম মানুষের গুহা, তার ভেতরকার চিত্র থেকে তেমনই প্রমাণ পেয়েছেন ঐতিহাসিকরা। গাইডের বক্তব্য এটা, মিলিয়ে নেবার কোনো সুযোগ ছিল না। কারন পাথর ধ্বসে গুহার মুখ এত সংকীর্ণ করে দিয়েছে যে ভেতরে ঢোকা গেল না, আর এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস জানার জন্য কোনো পুস্তিকা কোথাও বিক্রি হতে দেখলাম না। পাহাড়চুড়া থেকে পাখির চোখে দেখা লালজল গ্রামের চিত্র বেশ সুন্দর। পাহাড়ের মাঝামাঝি একটা মন্দির আছে, বাসন্তী পুজোর দিন কেবল সেখানে পুজো হয়, আর নিচে আছে এক নিঃসঙ্গ আশ্রম,মাত্র একজন আশ্রমিক বাস করেন সেখানে। তাঁর দেখা পেলেও কিছু কাহিনী জানা যেত, তবে তিনি ছিলেন না, ঘরদোর সব খোলা রেখেই লোকালয়ে গেছেন।

ঝাড়খন্ড, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া,মেদিনীপুরের বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে যে বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহল, তার একটা টুকরো একটু চাটনির মতো চেখে সেদিন ফিরে এলাম লোধাশুলির আবাসে। পরদিন পূর্বমেদিনীপুরের হাতিবাড়ি বনাঞ্চল ঘুরে আমাদের ফিরতে হবে কলকাতায়।

মনকে সান্ত্বনা দিলাম, বর্ষায় যখন শালের জঙ্গল ভরে উঠবে সবুজ পাতায়, জঙ্গলের মাটি ঢাকা পড়ে যাবে লতাগুল্মের কার্পেটে, তখন আবার আসব ফিরে। আসতেই হবে আবার এই রাঙামাটি আর সবুজের রাজ্যের সহজসরল সৌন্দর্যের টানে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *