rannaghar-bangali-jatir-utsav

বাঙ্গালি জাতির উৎসব
মেহেরুন নেসা
(রন্ধনবিদ, বাংলাদেশ)

নববর্ষের উৎসব মানেই খাবার আনন্দ, নাচগান, হাল খাতার নবায়ন। বাঙ্গালি জাতির উৎসব নববর্ষ। একটি জাতির মধ্যে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ থাকতে পারে। কোনো জাতির উৎসব হলে সবাই আনন্দে মিশে যায়। বাংলাদেশে সর্বত্র নববর্ষের উৎসব পালিত হয়। যুগ যুগ ধরে বাংলা বৎসরের প্রথম দিন বাঙ্গালীরা নববর্ষ উৎসব পালন করে আসছে। বাংলা মাসের প্রথম দিন নারীরা সাদা লাল রং এর কাপড় পড়ে মিষ্টি ও ফুল বিতরন করে। তাছাড়া নানা রকম খাবার তৈরী করে যেমন : বুন্দিয়া লুচি, পান্তা ভাত, ভর্তা, ইলিশ মাছের নানা পদ, পিঠা ইত্যাদি। যদিও তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার বংলার এই উৎসব বানচাল করতে চেয়ে ছিল, কিন্তু করতে পারেনি বাঙ্গালী জাতির সংঘবদ্ধতার কারনে।

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে নববর্ষের উৎসব, যা বাঙ্গালী জাতির পরিচয় বহন করে। নববর্ষের উৎসবে নানা খাবারের সাথে ইলিশ মাছ তো থাকবেই। আমি ইলিশ মাছের কয়েক পদের রেসিপি দিলাম এবং ইলিশ পোলাও এর গল্প জানালাম।

রাজকীয় খাবার ইলিশ পোলাও এর উৎপত্তির ইতিহাস জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে প্রায় তিনশো বছর পিছনে। রাজশাহীর পদ্মা নদীর ইলিশ মাছ সকল বাঙ্গালীর মুখে মুখে আজও স্বাদ লেগে আছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে নাটোর জেলায় রাজবংশ হয়। ১৭৩১ সালে নাটোরের রাজা রামকান্ত বগুড়ার জমিদার কন্যা রানী ভবানীকে বিবাহ করে নাটোরের রাজবাড়ীতে নিয়ে আসেন। ১৭ বছর সংসার করার পর রামকান্ত ১৭৪৮ সালে মৃত্যু বরণ করেন। ১৭৪৯ সালে মুর্শিদাবাদের নবাব রানী ভবানীকে রানী করেন। রানী ভবানী একজন দয়ালু, ধার্মিক, বিচক্ষণ ও সাহসী নারী ছিলেন। কৃষকদের কর কমিয়ে দিয়ে ছিলেন। তার রাজত্বকালে রাজস্ব আয় ছিল দেড় কোটি টাকা। তিনি ৭০ লক্ষ টাকা নবাবকে দিতেন এবং বাকি টাকা সাধারন প্রজাদের জন্য খরচ করতেন। তিনি ধর্মীয়, নারী শিক্ষা, বিধাব বিবাহ সহ বিভিন্ন সমাজের প্রগতিশীল কর্ম কান্ডের জন্য মনোনিবেশ করে ছিলেন। তিনি ১৮০২ সালে মৃত্যু বরণ করেন। রানীর ভবানী আমাদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

রানী ভবানী বজরায় পদ্মা নদী পার হয়ে যখন মুর্শিদাবাদ যেতেন তখন তিনি নদীতে বড় বড় ইলিশ মাছ লক্ষ্য করতেন। তখন উনি রান্নার ঠাকুরকে বলেন সরিষার তেল দিয়ে ইলিশ পোলাও করে তার দরবারে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করার জন্য। তখন থেকেই ইলিশ পোলাও এর প্রচলন হয়। ধীরে ধীরে ইলিশ পোলাও এর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বনেদী বাঙালী ঘর ছাড়া ইলিশ পোলাও তেমন ভাবে কেউ জানত না। আমি ২০০৫ সালে একটি টিভি চ্যানেলে ইলিশ পোলাও দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে এটা জনপ্রিয় করতে চেষ্টা করি।

ইলিশ পোলাও

উপকরণ :
ইলিশ মাছ – ১ থেকে দেড় কেজি,
পোলাও এর চাল – ১ কেজি,
পেয়াজ বাটা – আধা কাপ,
আদা বাটা – ২ টেবিল চামচ,
জিরা বাটা – ১ টেবিল চামচ,
ধনেবাটা – আধা টেবিল চামচ,
মরিচ গুড়া – ১ চাচামচ,
দই – ১ কাপ,
বেরেস্তা – ১ কাপ,
এলাচ – ৬টি,
দারচিনি ছোট টুকরা – ৪ টি,
তেজপাতা – ৪টি,
কাঁচা মরিচ – ১৫ টি,
সরিষার তেল – আধা কাপ,
লবণ – স্বাদমত,
চিনি – ২ চা চামচ,
কিসমিস – ২ টেবিল চামচ,
তরল দুধ – ১ কাপ।

প্রস্তুত প্রণালী : ইলিশ মাছ কেটে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। লেজ ও মাথা আলাদা রাখুন। পোলাও এর চাল ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। হাড়িতে চার ভাগের এক ভাগ কাপ তেল গরম করে ২টা এলাচ, দারচিনি ও তেজপাতা ফোরন দিন। চাল, ১ চা চামচ জিরা বাটা ও ১ চা চামচ আদা বাটা দিয়ে ৫ মিনিট অল্প আঁচে ভেজে গরম পানি চালের উপর দিয়ে নেড়ে দিন। লবণ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ফুটে উঠলে নেড়ে দিন। চাল ও পানি সমান হলে অল্প আঁচে রেখে চুলা বন্ধ করে দিন। কড়াইয়ে বাকি তেল গরম করে এলাচ, দারচিনি, তেজপাতা ও কিসমিস দিন। কিসমিস ফুলে উঠলে পেয়াজ বাটা, আদা, জিরা, ধনে, মরিচগুড়া, লবণ ও দই দিয়ে কষান। তারপর ইলিশ মাছ দিয়ে কষিয়ে ১ কাপ দুধ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে কড়াই ঘুড়িয়ে ঢেকে দমে রাখুন ১০ মিনিট। এবার পোলাও নেড়ে চিনিসহ রেরেস্তা ছড়িয়ে দিয়ে ইলিশ মাছ পোলায়ের উপর বিছিয়ে দিন এবং উপরে বেরেস্তা ছড়িয়ে ঢেকে দমে রাখুন ২০ মিনিট। তৈরী হয়ে গেল বাংলাদেশের রাজকীয় খাবার ইলিশ পোলাও।

সরষে ইলিশ

উপকরণ :
ইলিশ মাছ টুকরা – ৫/৬টি,
পেয়াজ কুচি – আধা কাপ,
সরিষা বাটা – ২ টেবিল চামচ,
আদা বাটা – ২ চা চামচ,
হলুদ গুড়া – ১ চা চামচ,
মরিচ গুড়া – ২ চা চামচ,
কাঁচা মরিচ – ৫/৬টি,
লবণ – স্বাদমত,
সরিষার তেল -২ টেবিল চামচ।
প্রস্তুত প্রণালী : মাছ ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। কড়াইয়ে তেল গরম করে পেয়াজ দিয়ে সামান্য ভেজে নিন। তারপর আদা, হলুদ, মরিচ ও ইলিশ মাছ দিয়ে কষিয়ে ১ কাপ পানি ও লবণ দিন। ফুটে উঠলে সরিষা বাটা ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ঢেকে অল্প আঁচে ১৫ মিনিট রাখুন। তারপর নামিয়ে পরিবেশন করুন বাঙ্গালিদের প্রিয় খাবার সরষে ইলিশ।

ইলিশ ভাজা

উপকরণ :
ইলিশ মাছ টুকরা – ৫/৬টি,
লবণ – স্বাদমত,
হলুদ গুড়া – আধা চা চামচ,
মরিচ গুড়া – ১ চা চামচ,
পেয়াজ কুচি – ২ টেবিল চামচ,
কাঁচা মরিচ ফালি – ৫/৬টি,
তেল – পরিমাণমত।

প্রস্তুত প্রণালী : মাছ ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। মাছের টুকরার সাথে হলুদ, মরিচ গুড়া, লবণ মাখিয়ে ২০ মিনিট পরে ফ্রাই প্যানে তেল গরম করে মাছের দুই পিঠ বাদামি করে ভেজে তুলুন। ঐ তেলে পেয়াজ কুচি ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ভেজে তেল ঝরিয়ে তুলে নিয়ে ভাজা মাছের উপর ছড়িয়ে দিন। তৈরী হয়ে গেল বাঙ্গালিদের প্রিয় ইলিশ মাছ ভাজা।


ইলিশ মাছ ভর্তা

উপকরণ :
মাছের লেজের অংশ -১ টি,
মটর শুটি -২ টেবিল চামচ,
পেয়াজ কুচি – ২ টেবিল চামচ,
কাঁচা মরিচ -৪টি,
হলুদ গুড়া – সামান্য,
ধনেপাতা -পরিমাণমত,
লবণ -স্বাদমত,
সরিষার তেল – ২ চা চামচ।
প্রস্তুত প্রণালী : মাছ ধুয়ে সামান্য লবণ, হলুদ ও মটর শুটি আধা কাপ পানি দিয়ে সিদ্ধ করে নিন। মাছ তুলে কাঁটা বেছে নিন। মাছের কিমা ও মটর শুটি বেটে নিন। কড়াইয়ে তেল গরম করে পেয়াজ, কাঁচা মরিচ ও ধনে পাতা ভেজে বাটা মাছের সাথে ভাল করে মাখিয়ে নিন। তৈরী হয়ে গেল ইলিশ মাছ ভার্তা।


এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *