bibidho-ghonchur-sange-kathopokathan

ঘঞ্চুর সঙ্গে কথোপকথন
রম্যরচনা
পবিত্র সরকার

ঘঞ্চুর দু-বছর হয়ে গেল। এখনও সে কথা বলতে শুরু করেনি বটে, কিন্তু আমরা তার জন্যে মোটেই ভাবছি না। তার চোখমুখ হাত-পা এত কথা বলে যে আমরা তাতেই ব্যতিব্যস্ত এবং খুশি। তা ছাড়াও ‘দে-দে-দে-দে’, ‘টা-টা-টা’, ‘তাই-তাই-তাই’, ‘ঈ-ঈ-ঈ’ ইত্যাদি প্রচুর শব্দ সে উচ্চারণ করে, আমরা সেগুলোকে বাক্য বলে ধরে নিই। তাছাড়া তার মা তাকে একটি প্লাস্টিকের বর্ণপরিচয় কিনে দিয়েছে, মাঝে মাঝে সেটির পাতা খুলে সে যা বলে তা আমাদের কাছে ‘ঙ্কু, ঙ্কু, ঙ্কু, ঙ্কু’ ইত্যাদির মতো শোনায়। তা আমাদের কানে মধুবর্ষণ করে। তার বাবা বলে, “প্রথমে ছেলেটা বাংলা বলবে বলে মনে হয় না, মনে হয় জার্মান দিয়ে শুরু করবে।” ওর মা বলে, “জার্মান কেন, শেষ যেখানে ছিল সেই ইজরায়েলের হিব্রু দিয়েও শুরু করতে পারে।” আমার দুটোর কোনওটাই মনে হয় না। সেদিন আমাকে আমার টুপিটা হাতে দিয়ে বলল, ‘ঙ্গাও’। এটাকে আমার বাংলা ‘নাও’ বলে ভাবতে ইচ্ছে হল, কিন্তু প্রথম ‘ঙ্গ’ আমাকে বেশ ঘাবড়ে দিল। ভাবলাম, এ কী! ছেলেটা ভিয়েতনামি বা ফিলিপিন্‌সের তাগালগ ভাষা দিয়ে শুরু করবে নাকি? আমি ভাষার একটু-আধটু কাজ করি বলে জানি, এ হয়তো বাংলাটা একটু দেরিতে ধরবে। কারণ জন্মের পর জার্মানিতে কাটিয়েছে কিছুদিন, তার পর ইজরায়েলে, তার পর মায়ের ল্যাপটপে নানা ইংরেজি কার্টুন দ্যাখে। ফলে বাংলা ভাষা বেছে নিতে একটু দেরি হতেই পারে। আমি ওর মা-বাবাকে পইপই করে বলে দিয়েছি, “ওর সঙ্গে বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষা বলবে না।”

যাই হোক, সে এখন প্রচুর কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের বুঝতে দিচ্ছে না কোন্‌ ভাষা। মনে হয় সব শিশুই কিছুদিন এই খেলাটা খেলে। কথা বলে, কবিতা আওড়ায়, গান গায়, হয়তো একক অভিনয়ও করে, কিন্তু শ্রোতাদের বুঝতে দেয় না কোন্‌ ভাষা—পাছে আমরা তাদের গোপন কথাগুলো ধরে ফেলি। যেহেতু আমার সঙ্গে ঘঞ্চুর মনে মনে প্রচুর কথাবার্তা হয়, আমি বুঝতে পারি, অনেক গোপন কথা থাকে তাদের। তার দাদি তাকে ঘরের টিউব লাইটের পেছন থেকে বেরিয়ে আসা একটা দৈত্যের মতো টিকটিকিকে দেখায়। সে একটু তাকিয়ে ভাবে, ওটা কি কোনো খাদ্যবস্তু? কিন্তু এ কথাটা সে আমাদের ভাষায় আমাদের কাছে বলতে চায় না, ভাবে বাংলা বললেই এরা তাকে ‘বোকা’ বলে ছাপ মেরে দেবে। আমি তার মনের ভাব বুঝে যখন তাকে বলি যে, “হ্যাঁ, আমরা মানুষেরা নানা রকম প্রাণী খাই বটে, কিন্তু সব কীটপতঙ্গ আমাদের খাদ্য নয়।” সে একটু অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকায়, আভাসে বলে, “কেন তুমিই তো আমার মায়ের কাছে বলেছ যে আমার এক মাসি শিশুবেলায় একটা কেন্নো ধরে মুখে দিয়েছিল? বুঝতে পারছি, আমাদের খাদ্য নির্বাচনের স্বাধীনতা তোমরা হরণ করতে চাও। হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি জানি, যত বড় হব ততই আমাদের স্বাধীনতা কমবে। তা শিশুদের অধিকার সম্বন্ধে রাষ্ট্রসংঘ যাই বলুক।”

বাপ রে! একেবারে রাষ্ট্রসংঘ ধরে টান। আমি আর কথা বাড়ালাম না।

আর তা ছাড়া, সে আর একটা প্রসঙ্গ টানল। সেটাও সে আমাদের কাছে গল্প শুনেছে। তার বড়মাসির ছেলে গণেশদাদাদের বাড়িতে এক ফ্ল্যাটে একটি দেড়বছরের ছেলে ডায়াপারহীন প্যান্টে হিসি করে দিয়েছে, সে হিসি গড়িয়ে মেঝেতে পড়েছে, তখন সে নিজের ভেজা প্যান্ট স্মার্টলি খুলে মেঝের সেই তরল পদার্থ মুছতে শুরু করেছিল। সেও তো একটা খুব ভালো কাজ। কোথায় তোমরা এর জন্যে তাকে বাহবা দেবে, না এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে গেলে সারাক্ষণ। তার মহৎ উদ্দেশ্যটাই বুঝলে না।

“আর দাদুন (আমাকে সে পরে তাই বলে ডাকবে, এখন মনে মনে ডাকে), আরও কত ভাবনা আসে মাথার মধ্যে। ওই যে তুমি হাসছিলে টিকটিকেকে আমি খাদ্য ভেবেছি বলে—কিন্তু তুমি ভেবে দ্যাখো, আমার কত কী খেতে ভালো লাগে। মায়ের কামিজের বোতাম আমি প্রাণপণে খাওয়ার চেষ্টা করি, কামড়ে কামড়ে সেগুলোর ভুষ্টিনাশ করে দিই, ক’দিন পরে আর সেগুলোকে বোতাম বলে চেনা যায় না শুধু নয়, বোতামের যা পবিত্র কাজ তাও আর সেগুলো করতে পারে না। তারপরে ধরো ক্রিমের টিউবের মুখ, পেনের ঢাকনা, পাউডারের কৌটো, চিরুনি, চুলের ব্রাশের ডান্ডা—এ সবও আমার খেতে খুব ভাল লাগে। আরে দাঁত দিয়ে আমি পৃথিবীটাকে চেনবার চেষ্টা করি—এটা তোমাদের মাথায় ঢোকে না।”

আমি বলি, “ও, বুঝেছি, তুমি খানিকটা ব্যাকরণ শিং-এর মতো।” সে জিজ্ঞেস করল, “ব্যাকরণ সিং কে? দেশের কোনো হকি খেলোয়াড়?” আমি তৎক্ষণৎ জিভ কেটে বললাম, “আরে না না সে কেউ না। হকি খেলোয়াড়রা তোমার মতো দাঁত ব্যবহার করে না।” সর্বনাশ! আর একটু হলেই দেশদ্রোহের অপরাধ করতে যাচ্ছিলাম। ঘঞ্চু সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ এখনও পড়েনি বলে আমার ব্যঙ্গটা ঠিক ধরতে পারল না, আর আমিও এটা নিয়ে বেশি ঘষ্টাঘষ্টি করতে গেলাম না। আর একটু হলেই ভয়ানক বিপজ্জনক জায়গায় চলে যাচ্ছিলাম।

ঘঞ্চু বলতে লাগল, “কিন্তু যেটা তোমরা তেমন গুরুত্ব দিয়ে দ্যাখো না তা হল আর সব খাবারও আমি বেশ ভালো খাই। বিস্কুট, ডিমসেদ্ধ, পাঁউরুটি-মাখন, ওমলেট, মাছভাত—এ সব আমি খেতে কখনও আপত্তি করি না, শুধু মা-র ল্যাপটপে ছড়ার কার্টুন গান শুনিয়ে দিতে হবে—সে ‘আবোল-তাবোল’ই হোক, বা ছোটদের রবীন্দ্রসঙ্গীতই হোক।”

আমি বললাম “কিন্তু তুমি যে খাওয়ার সময় এক জায়গায় থাকো না, দৌড়ে দৌড়ে বেড়াও, আর তোমার আয়ামাসি বা মাকে তোমার পেছন পেছন দৌড়ে তোমার মুখে সব পুরে দিতে হয়—তার বেলা?”

ঘঞ্চু বলল, “আহা দৌড়টাই তো আমার এক্‌সারসাইজ। আমি তো তোমার মতো মর্নিং ওয়াকে যেতে পারি না!”

“আর তুমি যে মাঝে মাঝে মুখ থেকে খাবার ডেলা করে ফেলে দাও, সেটা?”

ঘঞ্চু বলল, “তার লজিকটা তুমি বুঝতে পারনি? সত্যি তোমাদের কবে যে বুদ্ধি হবে! আরে আমি তখনই খাবার ফেলি যখন আমার আগের গরাসটা পুরো না ফুরোতে তোমরা আর একটা গরাস মুখের মধ্যে ঠেলে দাও। কিংবা আমার পেট ভরে গেছে, তবু জোর করে আর একটা গরাস মুখের মধ্যে ঠুসে দাও। আমি যখন ভালো করে কথা বলতে শিখব তখন পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব, এখন একটু ক্ষমাঘেন্না করে সহ্য করে যাও।”

ঘঞ্চু তাই না থেমে বলতে লাগল, “আর খাওয়ার উলটো ব্যাপারটাই ধরো না কেন—এই তোমরা যাকে ‘পটি’ বলো সেই বিষয়টা। প্রথম প্রথম ভাবতাম, আরেত্তারা! এই প্রসঙ্গটা নিয়ে মা থেকে শুরু করে সব্বাই এত হইচই করে কেন? ‘দু’দিন হল ছেলেটা পটি করেনি’, ‘তিনদিন হল ডায়াপার অকলঙ্কিত’, ‘এবারে ছেলেটাকে পানের বোঁটা দিতে হবে’—এই সব হল্লা শুনে আমার খুব অবাক লাগত। তারপর দেখলাম, ব্যাপারটা খুব মন্দ নয়। তোমরা এখন লক্ষ করবে, দৌড়তে দৌড়তে আমার ব্যাপারটা বেশ আলগোছে হয়ে যায়—তোমরাও লক্ষ কর—আমি হঠাৎ একজায়গায় দাঁড়িয়ে ঠোঁট চেপে হাসির মতো একটা ভঙ্গি করছি, যেটা আদৌ হাসি নয়—পেটে চাপ দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া—তার পর ব্যাপারটা হয়ে গেল তো তোমরাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে, আমিও ঝরঝরে শরীর নিয়ে আবার খেলাধুলায় জমে গেলাম। এখন যখন এ নিয়ে চিন্তা করি তখন ভাবি যে, ব্যাপারটা বেঁচে থাকার একটা মজার অঙ্গ।”

আমি বললাম, “ভাই ঘঞ্চু, তোমাকে আমার মনের কথা খুলে বলি, আমাদের বুড়োদের কাছে ও ব্যাপারটার অশেষ গুরুত্ব। এমনকি কোথাকার কোন্‌ রাজ্যপাল জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কী বললেন সেই ব্যাপারটার চেয়ে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবনায় আমাদের দিনের বেশি সময় কাটে। মিডিয়া অন্য হাজারো বিষয় নিয়ে যতই মাতামাতি করুক না কেন!”

আমি যে কথাটা আমার মনের মধ্যে এতক্ষণ ধরে খচখচ করছিল এবারে সেই কথাটা পাড়লাম। বললাম, “ভাই ঘঞ্চু, সেদিন প্রচণ্ড গরম ছিল, তোমার হয়তো মনে পড়ছে। তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে আমাদের পাশের ঘরে শুয়েছিলে, আমাদের এখানে যেমন শোও। অন্যদিন তুমি দিব্যি ঘুমিয়ে যাও, কিন্তু সেদিন গরমের জন্যে রাত দুটো পর্যন্ত তোমার ঘুম আসেনি। তাই তুমি কাঁদতে শুরু করলে। তখন তোমার মা বাধ্য হয়ে তোমাকে নিয়ে আমাদের ঘরে এল, কারণ আমাদের বুড়োবুড়ির ঘরটা ঠান্ডা ছিল। যেই তোমাকে সুস্বাগতম্‌ বলে আমরা মশারির মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছি—ও মা! তোমার ঘুমটুম কোথায় গেল। তুমি নানারকম কথা শুরু করে দিলে, গান গাইতে লাগলে, মশারি থেকে নেমে অন্ধকারে দৌড়বার উদ্‌যোগ করলে—এ রকম হল কেন বলো দিকিনি?”

ঘঞ্চু মুচকি হেসে বলল, “ওহ, তোমাদের শিশুদের ইচ্ছের স্বাধীনতার ব্যাপারটা আর কবে বোঝাতে পারব! আমার ইচ্ছে হয়েছিল খেলতে, তাই আমি তখন খেলতে, দৌড়তে চাইছিলাম। এ নিয়ে এত ঘাবড়াবার কী ছিল তোমাদের? আর মাকেও দ্যাখো! মা তক্ষুনি ঠেসে শুইয়ে রেখে ঠাশ ঠাশ করে চাপড়াতে চাপড়াতে আমাকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছিল—এ রকম হঠকারিতার কোন মানে হয়? তাই তো ইচ্ছে করে আমি আরও বেশি করে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলাম, যাতে লোকে শুনতে পায়, যাতে ব্যাপারটা রাষ্ট্রসংঘের শিশু-অধিকার দপ্তর পর্যন্ত পৌঁছায়।”

আরে কী সর্বনাশ! এ ছেলেটা দেখি কথায় কথায় রাষ্ট্রসংঘ দেখায়! আমি আর কথা বাড়ালাম না।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : পূর্বপ্রকাশিত, লেখক কর্তৃক পরিমার্জিত লেখা

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *