binodan-bombay-begums

নৈতিকতার আয়নায় নারীর প্রতিবিম্ব দেখাবে ‘বম্বে বেগমস’
ফিল্ম রিভিউ
স্বাতী চট্টোপাধ্যায় ভৌমিক

ওয়েব সিরিজ: বম্বে বেগমস (নেটফ্লিক্স)
পরিচালক: অলঙ্কৃতা শ্রীবাস্তব, বর্ণিলা চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ে: পূজা ভাট, সাহানা গোস্বামী, অম্রুতা সুভাষ, প্লাবিতা বরঠাকুর, আধ্যা আনন্দ, বিবেক গোম্বর, রাহুল বোস, ইমাদ শাহ, মনীশ চৌধুরী, ড্যানিশ হুসেইন।

পর্ব: ছয়টি

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা? কার কাছে বারবার অভিযোগের হাত পাতবে নারী? মানুষ তো দূর, স্বয়ং বিধাতাও যেন তার চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতেই ভালবাসেন। সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকে, যখন নারী সদ্য আলোকপ্রাপ্তা হতে শুরু করেছে সেদিন থেকে নিয়ে আজকের এই ভরপুর নারীক্ষমতায়নের যুগে এসেও তাকে বারংবার ধাক্কা খেতে হয়। কখনও তা পুরুষের কাছে, কখনও আবার নারীর কাছেই। সমাজের কাঠগড়ায় আমরা সকলেই সহযোদ্ধা, কিন্তু ব্যক্তিগত লড়াইয়ের জায়গায় সেই আমরাই আবার একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াই। শারীরিক সক্ষমতার লড়াই, ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, যৌনজীবনের অপ্রাপ্তি, পেশাগত ক্ষেত্রে হতাশা, মানসিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক স্বীকৃতির সংগ্রাম, পারিবারিক জীবনে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জে জেরবার হতে থাকে ঘরে বাইরের প্রতিটা নারী।

তেমনই পাঁচ নারীর গল্প বলেছেন পরিচালকদ্বয়। রানী ইরানী, ফাতিমা ওয়ারসি, লিলি, আয়েশা ও শাই এই পাঁচজন গল্পের পাঁচটি প্রধান মুখ হলেও কাহিনী শুধু এই পাঁচজনের নয়। কাহিনী এদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নওশাদ, আরিজয়, জুরাভার, বৈভব, রন ও দীপক সাংভিরও। তবে এছাড়াও এ গল্প পৃথিবীর সর্বত্র লড়ে যাওয়া আরো অজস্র মেয়েরও।

রানী (পূজা): ছোট্ট শহর কানপুরের মেয়ে রানী। সে স্বপ্ন দেখেছিল ব্যাঙ্কের সিইও হবে। ধাপে- ধাপে ওপরে উঠতে গিয়ে রানীকে হারাতে হয় অনেক কিছু। বদলে সে পায় ক্ষমতা, স্ট্যাটাস আর রয়্যাল ব্যাঙ্ক অফ বম্বের সিইও-এর পদ। রানীর দ্বিতীয় স্বামী নওশাদ তাকে ভালোবাসলেও তার সৎ ছেলে জুরাভার ও মেয়ে শাই রানীকে পছন্দ করে না। বিশেষ করে শাই যেন একটু বেশিই এড়িয়ে চলে। তবে রানী চেষ্টা চালিয়ে যায় ঘরে বাইরে সমানভাবে তাল মিলিয়ে চলতে। তবু তাল কেটে যায় যখন জুরাভারের ভুলে তার গাড়ির সামনে এসে পড়ে বৈভব। রানী ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে। ছেলের ভুল জেনেও বৈভবের মাকে যে কোনও মূল্যে সে কিনে ফেলতে চায়, কারণ তার নিজের সন্মান আর নাম জড়িয়ে আছে ছেলের সঙ্গে। তাকে কিছুতেই সে ময়লা হতে দিতে পারে না। অন্যদিকে মহেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক দুনিয়ার সামনে বেআব্রু হয়ে যাওয়া সত্বেও রানী কিন্তু ভেঙে যায় না। সে জানে তাকে দৌড়তে হবে। তার আধভাঙা সংসারকে জোড়া লাগাতে সে নৈতিকতার ধার ধারে না। মনের জোর আর অদম্য জেদকে সম্বল করে রানী নওশাদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে, কারণ একমাত্র তার কাছেই সে দায়বদ্ধ বলে মনে করে নিজেকে।

বহুদিন পর এই সিরিজ দিয়ে পূজা আবার অভিনয়ে ফিরলেন। এর চেয়ে ভালো সুযোগ সম্ভবত তিনি আর পেতেন না, তার সদ্ব্যবহারও করেছেন তিনি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই। অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে রানীকে রক্তমাংসের চরিত্রে পরিণত করেছেন পূজা।

ফাতিমা (সাহানা): অফিসে রানীর অধস্তন ফাতিমা, সে প্রবল কাজপাগল এক মানুষ। তার স্বামী আরিজয়ও একই ব্যাঙ্কে তারই অধীনে চাকরি করে, এই নিয়ে দুজনের মধ্যে ইগোর সমস্যা থাকলেও ভালোবাসা কখনও সেই ইগোকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয় না। ফাতিমা তার সংসার, আগত সন্তান সবকিছুকে গুরুত্ব দিতে চাইলেও কাজের কারণে পেরে ওঠে না। আরিজয়ের জোরাজুরিতে সন্তানসম্ভবা অবস্থায় একবার চাকরি ছাড়ার কথা ভাবলেও আচমকা রানীর হাত ধরে পদোন্নতি হয় ফাতিমার, যা সে কল্পনাও করেনি। জেদ করে চাকরিতে থেকে যাওয়া আর সেই সঙ্গে গর্ভপাত এই দুই মিলে হঠাৎই যেন এই দম্পতিকে একে অপরের থেকে দূরে ঠেলে দেয়। আরিজয়কে খুশি করতে অবশেষে সারোগেসির মাধ্যমে সন্তানলাভের চেষ্টা করতে ফাতিমা রাজি হয়, কিন্তু কিছুতেই নিজের মনকে উদারতার সেই উচ্চতায় সে নিয়ে যেতে পারে না। জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীই যে শুধু বঞ্চনার স্বীকার হয় তা কিন্তু নয়। জীবনের জটিলতার ফাঁদে পড়ে কখনও কখনও সে প্রবঞ্চকও হয়ে ওঠে। না চাইতেও নিজের জীবনকে জটিল করে তোলে ফাতিমা, জেফের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সে। একদিকে সেই সম্পর্ক যেমন তাকে তৃপ্তি দেয়, তার চেনা দায়িত্ব কর্তব্যের বাইরে গিয়ে দেয় মুক্তির আনন্দ, তেমনই অন্যদিকে আরিজয়ের মুখোমুখি হতে সে ভয় পায়। এমন নয় যে সে স্বামীকে ভালোবাসে না। কিন্তু বিবেকের দংশন ফাতিমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় সর্বত্র। নিজের জীবনের সহজ সরল টুকরো খুশিগুলোর থেকে সে পালিয়ে বেড়ায়। বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠার কাঁটাটা শান্তি দেয় না ফাতিমাকে।

বহু বছর ধরে অভিনয় জগতে থাকলেও কমই কাজ করেন সাহানা। প্রতিবারের মতো অভিনয়ের মুন্সিয়ানায় নিজের সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছেন তিনি।

লিলি (অম্রুতা): পেশায় বার ড্যান্সার হলেও একদা মুম্বইয়ের বারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন সময় লিলিকে দেহ ব্যবসায় নামতে হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই মন থেকে এই পেশাকে সে মেনে নিতে পারেনি। তাই যখন ছেলে বৈভব জুরাভারের গাড়ির সামনে পড়ে মারাত্মকভাবে জখম হয় তখন সেই নিয়ে রানীর সঙ্গে লেনদেনের ব্যবসা করতে সে পিছপা হয় না। ছেলের ক্ষতির বিনিময়ে সে শুধু একটা সম্মানের জীবন চায়। লিলি সমাজের তথাকথিত নিচুতলার মানুষ হলেও তার আত্মসম্মান জ্ঞান প্রবল। সে জানে শরীরী সম্পর্ক স্থাপনে দু’পক্ষের সম্মতি থাকা প্রয়োজন। সুস্থ জীবনের হাতছানি আর অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিলি তার ফ্যাক্টরি শুরু করে, তার মতো মেয়েদের কাছে যা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। লিলির চরিত্রে দ্বন্দ্ব থাকলেও তা একমাত্রিক, উচ্চবিত্ত সমাজের ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার কারণেই হয়ত চরিত্রটি অনেকটা সরলরৈখিক গতিতে চলে।

এর আগে হিন্দিতে কিছু কাজ করলেও খুব পরিচিত মুখ নন অম্রুতা। লিলির চরিত্রে অসাধারণ মানিয়ে গেছেন তিনি। আশা করা যায় এবার ভারতীয় দর্শক তাঁকে নামে চিনবেন।

আয়েশা (প্লাবিতা): ছোট শহর ইন্দোর থেকে রয়্যাল ব্যাঙ্কে চাকরি করতে আসা আয়েশার স্বপ্নগুলো খুব বড় না হলেও পরিস্থিতি তাকে অন্ধকার থেকে টেনে তোলে অপ্রত্যাশিতভাবেই। সেই থেকে স্বপ্ন দেখার শুরু আয়েশার। একদিকে কাজের জায়গায় উচ্চাশা অন্যদিকে নিজের যৌনচাহিদা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা, দুই মিলে আয়েশাকে শান্তি দেয় না। যে মানুষটাকে লক্ষ্য করে সে ওপরে উঠতে চেয়েছিল সেই যখন তার শ্লীলতাহানি করে তখন আতঙ্কে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না আয়েশা। একদিকে আরাধ্য ব্যক্তির প্রতি তৈরি হওয়া আচমকা ঘৃণা অন্যদিকে নিজের অবস্থান বুঝে মুখ না খোলার সিদ্ধান্ত আয়েশাকে দিশাহারা করে তোলে। এর সঙ্গে চলতে থাকে তার চিরকালীন মানসিক দ্বন্দ্ব, কী চায় তার শরীর? চিত্রা নাকি রণ, কাকে বেছে নেবে সে? নাকি এদের কাউকেই না, হয়ত নিজেকেই তার এখনও চেনা বাকি।

আসামের মেয়ে প্লাবিতা এর আগে কিছু ওয়েব সিরিজ ও ছবিতে অভিনয় করেছেন। আয়েশার ভেতরের ভীরু সত্ত্বা ও তার অন্তর্দ্বন্দ্বকে পর্দায় বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্লাবিতা।

শাই (আধ্যা): শাই যতটা না গল্পের চরিত্র তার চেয়েও বেশি এই কাহিনীর বিবেক। তার মনোলগ বাকি চরিত্রগুলোর মনের কথা বুঝিয়ে দেয় গল্পের বিভিন্ন মোড়ে। শাই রানীর সৎ মেয়ে, সে একজন শিল্পীও, কিন্তু এই সবকিছুর থেকেও যেটা অবাক করে সেটা হলো এত কম বয়সেও সে গভীর দার্শনিক চিন্তার অধিকারী। মৃতা মায়ের সঙ্গে তার কথোপকথন এক এক সময় তাকে এবং দর্শককেও অনেক গভীর বিষয়ে বুঝতে সাহায্য করে। আবার একইসঙ্গে বয়সের নিয়ম মেনেই সে হয়ে উঠতে চায় এক পরিপূর্ণ নারী। সেই নারীত্বের আকাঙ্খায় সে স্কুলের স্কার্টে রক্তের চিহ্ন এঁকে রাখে, যদি তার স্বপ্নের নায়ক তাকে নারী বলে চিনে নেয়, যদি সে শাইকে গুরুত্ব দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জামা টেনে শাই নিজের শরীরে নারীত্বের চিহ্ন খুঁজে বেড়ায়, যা তার ভাবনার জগতের সঙ্গে খাপ খায় না। হয়ত সেটাই স্বাভাবিক, আসলে দিনের শেষে তো সে স্কুলে পড়া এক টিনএজ মেয়ে, যার শরীর এখনও প্রস্ফুটিত হয়নি। চিরাচরিত নারীত্বে পৌঁছনোর তেষ্টা এক সময় বিপর্যয় ডেকে আনে শাইয়ের জীবনে। রানীর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরলে হয়ত সে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, তবু সে হাতকে সহ্য করতে পারে না শাই।

অভিনয়ের জগতে একেবারেই নতুন আধ্যার এটি প্রথম কাজ। বয়স অনুযায়ী অত্যন্ত পরিণত অভিনয় করেছেন তিনি।

ক্ষমতার লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যৌনতৃপ্তির খোঁজ, সামাজিকতার ওপরে উঠে নিজের ইচ্ছেকে
গুরুত্ব দেওয়া, নিজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যের চাহিদাকে মেনে না নেওয়া, এই সিরিজের
সবকটি নারী চরিত্র বার বার প্রমাণ করে সামাজিক নিয়ম কানুন মেনে চলার দায় একা শুধু নারীর নয়। তারও পূর্ণ অধিকার আছে ভ্রষ্ট হবার, ভুল করার। বঞ্চনা নেওয়া বা দেওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে সবচেয়ে আগে সে একজন মানুষ, শুধু নারী নয়। প্রেমে-অপ্রেমে, কষ্টে-আনন্দে কিংবা জয়ে বা পরাজয়ে বারবার ধাক্কা খেয়েও ভুল শোধরাতে সে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সারা পৃথিবীর নৈতিকতার ভার সে আর একা নিতে নারাজ। নারীকে দেবীত্বে উত্তীর্ণ করার যে পুরোনো অভ্যাস সমাজ আজও বহন করে চলেছে তার থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে এবার, এ কথা খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় ‘বম্বে বেগমস’।

প্রত্যেক অভিনেতা যথাযথভাবে তাঁদের চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। ফলে ছয়টি দীর্ঘ এপিসোড দেখতে কোথাও ক্লান্তি লাগে না। এই সময়ের চাহিদা মেনে তৈরি এ গল্পের এক অনন্য ক্ষমতা হলো দর্শককে আটকে রাখা। গল্পের আয়নায় কোথাও না কোথাও প্রতিটি দর্শক নিজেকে খুঁজে পাবেন। মূল চরিত্রদের মানসিক টানাপোড়েনে জারিত হবেন দর্শকও। বারবার দর্শককে ভাবাবে ‘বম্বে বেগমস’, কাঁদাবেও, ফেলে দেবে মানসিক দ্বন্দ্বে। তবু ছেড়ে ওঠা যাবে না সিরিজের
শেষ না দেখে।

সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা দেবে এই সিরিজ, এমনকি একাধিকবারও দেখতে বাধ্য করাতে পারে দর্শককে। পাঁচজন নারীর লড়াই ও তাদের নিজের মতো করে জিতে যাবার এ কাহিনী নিঃসন্দেহে প্রেরণা দেবে সমস্ত দর্শকদের।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *