binodan-mohamarikale-manusher-prati-biswas

মহামারীকালে মানুষের প্রতি বিশ্বাস আরও বেড়েছে – ঊর্মিমালা বসু
সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অদিতি বসুরায়


অদিতি- ইদানীং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সেলেব্রিটিদের প্রতি সাধারণ মানুষের অভব্য আচরণ খুব আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর আপনাকেও এই ধরনের ট্রোলিং-র মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই। বিখ্যাত মানুষরা কী তবে ফেসবুক- টুইট্যার বর্জন করবেন?
ঊর্মিমালা- ট্রোলিং খুব নিন্দনীয়। যেভাবে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নিয়ে উক্তি করেন লোকজন, তা মোটেও সমর্থনযোগ্য কাজ নয়। আমাকে এই বয়েসে এসে, যে ধরনের অশালীন কথা-বার্তার মোকাবিলা করতে হয়েছে – তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আর একটা কথা বলব, আমি যে ধরনের পরিবেশ ও সামাজিক আবহাওয়ায় বড় হয়েছি – সেখানে সামান্য অশ্লীল কথা-বার্তাকেও বরদাস্ত করা হতো না।ফলে আমি নিজেও এই ধরনের কথা ব্যবহার করি না। কিন্তু, এখন ফেসবুকে, দেখতে পাই, মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে অনায়াসে স্ল্যাং শব্দ ব্যবহার করছে। এই ব্যাপারটা আমাকে হতাশ করে। এবং সেই সব শব্দ নিয়ে ফেসবুক অথরিটির বক্তব্য আমার জানা নেই। অথচ মাত্র কয়েক দিন আগে,একজনকে স্নেহ করে, কমেন্ট লিখেছিলাম, “তোকে পেটাবো” – তক্ষুনি ফেসবুক থেকে আমাকে জানানো হল, এই কমেন্ট নাকি ফেসবুক রুলের বিরোধী। আমার প্রশ্ন হল, তাহলে, এই যে, প্রতিদিন, হাজার হাজার লোকজন, খারাপ কথা লিখে ট্রোলিং করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কী করে অথরিটি কোন রকম পদক্ষেপ নেন না ? তবে আমি অবশ্য ফেসবুক বর্জনের কথা ভাবতেও পারি না। এখানে রোজ কত রকম ছবি – লেখা সামনে আসে। বিশেষ করে, এই করোনা কালে, ফেসবুকের জানলাই আমাকে অক্সিজেন যোগান দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার জন্য – মাঝে মাঝে একটা নতুন শাড়ি পরি – সাজি। বাইরের দুনিয়া বন্ধ হলেও এই সামাজিক মাধ্যমে আকাশ দেখি। তাছাড়া, অন্যরা কে, কেমন আছেন – সে সব খোঁজ পাই। অনেক নতুন জিনিস জানতে পারি। তাই ফেসবুক বর্জনের প্রশ্নই ওঠে না, কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় জন্য। এখনও ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশী।

অদিতি- এই মহামারী চলাকালে তো শিল্পীদের মঞ্চ – অনুষ্ঠান সব কিছু থেকেই দূরে সরে থাকতে হচ্ছে। আপনার কী মনে হয়, এই ঘটনা, ভবিষ্যতে শিল্প-ক্ষেত্রে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে?

ঊর্মিমালা- করোনা কালের সবচেয়ে বড় অন্ধকার দিক এইটা। দীর্ঘদিন মঞ্চ- অনুষ্টান সব ছেড়ে থাকা অসহনীয়। সব দিক দিয়েই শিল্পীদের জন্য, এই সময় একেবারেই ভালো নয়। আর্থিক-পার্থিব-পরমার্থিক ক্ষতি বলা যেতে পারে। আমার কথা বলি। আমি তো চাকরি করি না। শিল্পচর্চা ও মঞ্চ অনুষ্টানই আমার উপার্জনের ক্ষেত্র। গত প্রায় দেড় বছর, সে সব পুরো বন্ধ। তবে আমার আবৃত্তির স্কুল, কথানদীর ছাত্রীরা অনলাইন ক্লাস করছে। তাছাড়াও, মানুষের মুখোমুখি হওয়াটাও একেবারে বন্ধ। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে, দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে দেখা হয়। চেনা মানুষের সঙ্গে মোলাকাত হয়। সেই সব সাক্ষাতের উত্তাপই অন্যরকম।

অদিতি- অনলাইন অনুষ্ঠান তো হচ্ছে। সে অভিজ্ঞতা কেমন ?
ঊর্মিমালা- অনলাইন অনুষ্টান কোন দিক দিয়েই মঞ্চ অভিজ্ঞতার কাছাকাছি নয়। আর্থিক দিক দিয়েও একই কথা বলতে পারি।

অদিতি- আপনাদের সপরিবারে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়েছিলাম আমরা। সেই অভিজ্ঞতা একটু বলেন যদি!
ঊর্মিমালা- আমি এবং জগন্নাথ দুজনেই ভ্যাকসিনের দুটো ডোজই নিয়েছি, করোনা হওয়ার আগেই। গত বছর, আমরা খুবই কড়া নিয়ম মেনে চলেছি। জগন্নাথের ডায়াবেটিস আছে বলে, আরো বেশি করে সাবধানে থাকতে হতো। ওকে ফাঁকা রাস্তাতেও হাঁটতে যেতে মানা করেছি। কিন্তু, বাড়ির ছেলে-মেয়েদের কাজে বেরতেই হতো। তারাও অত্যন্ত সাবধানে থাকলেও আমাদের যখন রিপোর্ট পজেটিভ এলো – একটু চিন্তা হয়েছিল। নানা কোমর্বিডিটি থাকায় জগন্নাথকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। আমার অভিজ্ঞতা বলে, করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে, ভাল হয়ে ওঠা সম্ভব। ভ্যাকসিন নিতে হবে, মাস্ক ব্যবহার করতে হবে এবং সেই সঙ্গে মন, ভাল রাখা খুব দরকার। আমি নিজে সেই সময় অনেক বই ফিরে পড়েছি। মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা পড়লাম নতুন করে। সিনেমা দেখেছি। ওয়েব সিরিজ দেখেছি। অসুখের দিক থেকে মনকে অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছি ক্রমাগত। জগন্নাথ হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে, স্বস্তি মিলেছে। ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে বাড়ির সকলে। আর এই সময়ে দেখলাম, কত মানুষ, আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সেবা করেছেন। বাড়িতে বাড়িতে রান্না খাবার, ওষুধ , প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে এসেছেন। মানবতার এমন রূপ অনেকদিন বাদে, আবার চোখের সামনে এলো। নিঃস্বার্থ ভাবে এগিয়ে আসা, এই সহমর্মিতার হাত মহামারীকেও হারিয়ে দিতে পারে বলে, আমার বিশ্বাস। বহু অল্প বয়েসী ছেলেমেয়েরা যেভাবে এগিয়ে এসেছে, আর্তের হাত ধরতে তা এই অন্ধকার সময়েও আলো দেখালো। এই কারণে মানুষের প্রতি বিশ্বাস, বেড়েই চলেছে।

অদিতি- এই যে দীর্ঘ দেড় বছরের মতো সময়, বাড়িতেই থাকলেন। কীভাবে কাটলো ?

ঊর্মিমালা- সময় থেমে থাকে না। আমি সারাক্ষণ নিজেকে আউডেটেড রাখি। নতুন বই পড়ি, ওয়েব সিরিজ দেখি – এই তো, ফ্যামিলি ম্যান টু দেখা শেষ করলাম। অনেক অনেক বই পড়লাম। ফেসবুকে উঁকি দিলাম। অনেক রাতে, চারদিক নির্জন হয়ে গেলে, আমার নিজস্ব সময় শুরু হয়। তখন আমি, সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলো করে থাকি। এইভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন। এই প্রসঙ্গে, কবীর সুমনের কথা মনে হয় আমার। বাহাত্তর বছরের একজন মানুষ, এই বদ্ধ দিনে নিয়মিত বাংলা খেয়াল নিয়ে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন – তা অনুপ্রাণিত করার মতো বিষয়ই বটে। চারিদিকে এই রকম সব সৃষ্টিশীল মানুষদের দেখেও মন ভালো থাকে।

অদিতি- অনেকেই জানেন না, ঊর্মিমালা বসু নিঃশব্দে মানুষের পাশে দাঁড়ান – অপারগকে পড়ার খরচ যোগানো থেকে আরও অনেক কিছুই তিনি দুঃস্থদের জন্য করে থাকেন। যেখানে সবাই সামান্যতম সাহায্যকেও প্রচারের আলো দিতে উৎসুক, সেখানে আপনি নীরবে কাজ করে যেতে পারেন কী ভাবে?
ঊর্মিমালা- আমি মনে করি না, এসব নিয়ে কিছু বলা উচিত। মানুষের পাশে দাঁড়াতে যে পারি – এতেই নিজেকে ভাগ্যবান মানি। আমার মা বলতেন, ডান হাতের দান যেন বাম হাত জানতে না পারে। আমিও সেটাই মানি। বরং দেখি, আম্ফান বা যশের মতো ভয়ংকর ঝড়ের পরে, কত মানুষ শুকনো খাবার, জামাকাপড়, ওষুধ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে গিয়ে সে সব দিয়ে এসেছেন। আনন্দ হয় খুব।

অদিতি- একেবারে শেষে সেই আবশ্যক প্রশ্নটা করি। আপনাকে দেখে বোঝা যায়, বয়েস আসলে সংখ্যামাত্র। আশ্চর্য সুন্দর রূপ এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এমন মেলবন্ধন সহজে দেখা যায় না। এর রহস্যটা কী?
ঊর্মিমালা- আমি যা, আমি তাই। কোনও ভান বা মেকি আবরণে নিজেকে ঘিরে রাখতে পারিনি। পারিও না। সহজ ভাবে মিশতে ভালবাসি। এইটুকুই। বাকিটা তোমাদের ভালবাসা।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *