স্টুডিওপাড়া
প্রিয়ব্রত দত্ত
দেবাংশু সেনগুপ্ত থেকে দেবাংশুদা, সেখান থেকে দেবাদায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। আমার বেলাতেও আপনি থেকে তুমি অবশেষে তুই-এ আসতেও প্রায় একই সময় লাগল। ওই আলুভাতে থেকে পাঁচমেশালি সবজির তরকারি পর্যন্ত খেতে যেটুকু সময় লাগে আর কি!
তখন প্রোডাকশনের লাঞ্চ মানে এখনকার তুলনায় এলাহি ব্যাপার ছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিচালক, ক্যামেরাম্যান বা সিনেমাটোগ্রাফার (তখনও ডিওপি শব্দটি চালু হয়নি), প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার (যদি তাঁরা শ্যুটিং দেখতে হাজির থাকতেন), নায়ক, নায়িকাদের জন্য বরাদ্দ থাকত স্পেশাল লাঞ্চ মেনু। মানে সরু চালের ভাত, ঘন ডাল (গরমকালে টক ডালও) সঙ্গে আলু ভাজা, উচ্ছে ভাজা, পোড়া পাঁপড় এমন কি মাছ ভাজাও, একবাটি সবজি আর পাঁঠার মাংস (কমপক্ষে চার টুকরো)। শেষ পাতে চাটনি, দই, মিষ্টি। বাকি শিল্পী কলাকুশলীদের জন্যও প্রায় একই মেনু। হয়তো মাছভাজাটা বাদ যেত। যিনি পাঁঠার মাংস খাবেন না, তাঁর জন্য চিকেন, মাছের বা ডিমের ঝোল রেডি থাকত। পরে জেনেছিলাম দেবাংশুদার ইউনিটে সবার জন্যই একই মেনু পরিবেশন করা হতো। দেবাংশুদা শিল্পী কলাকুশলীদের গ্রেড অনুযায়ী লাঞ্চ কিংবা টিফিনের তারতম্য একদম পছন্দ করতেন না।
তখন প্রোডাকশনের লাঞ্চ মানেই পাঁঠার মাংস। এটাই ছিল রেওয়াজ। ‘মাংস-ভাত’ না হলে আলোর খুঁটিগুলো নাকি নড়তেই চাইতো না! পেটে পাঁঠার টুকরো পড়লেই কাজে রাজধানীর গতি। আনুগত্যে আতরের সুবাস। এখন কোনও সিনেমা বা সিরিয়ালের শ্যুটিং-লাঞ্চে পাঁঠার মাংস? ভাবাই যায় না। কোনও রকমে একটা ছোট চন্দনের বাটির মতো পাত্রে দু’টুকরো চিকেন জুটলেই যথেষ্ঠ।
ভাতের ওপর বাটি থেকে পাঁঠার কারি ঢালছি, একথা সে কথার মাঝে দেবাংশুদা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল, “থাকা হয় কোথায়?” আমি বললাম, “কলেজ স্ট্রিট।” শুনে খাওয়া থামিয়ে অবাক চোখে একঝলক তাকাল আমার দিকে।
“সর্বনাশ! তুই তো বীভৎস কাণ্ড করে ফেলেছিস!”
“কে…কেন কী করলাম?”
“গ্রেট… ও তুই এখন বুঝবি না…?” বলে গম্ভীর মুখ করে ফের খাওয়ায় মন দিল দেবাংশুদা।
দেবাংশুদার সিরিয়াস মুখ দেখে আমি কেমন থমকে গেলাম। পাশে জয়দীপও খাওয়া থামিয়ে চেয়ে আছে দেবাংশুদার দিকে। হঠাৎ দেবাংশুদা আমাদের দুজনকে চমকে দিয়ে হাঁক পাড়লেন, “ওরে প্রোডাকশানের কে আছিস, আর এক প্লেট পাঁঠার মাংস দিয়ে যা তো…”
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই তো ডেঞ্জারাস ছেলেরে ভাই…”
কথার মাঝেই একজন আর একবাটি মটনকারি হাতে করে ঘরে ঢুকলেন। তিনি দেবাংশুদার পাতের পাশে বাটিটা নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিলেন। “আরে না না আমাকে নয়… ওই কলেজ স্ট্রিটের কেষ্টঠাকুরকে দে…”
আগের চারপিসে তখনও হাত দিইনি। তার ওপর আরও চারপিস! মন বলছে— জয়গুরু আজ কার মুখ দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম মাইরি! মুখে বললাম, “করছেন কি আপনি, এত কে খাবে?” অথচ জুলজুল করে তাকিয়ে আছি দ্বিতীয় বাটিটার দিকেও।
রীতিমতো ডান হাত চলছে। খেতে খেতে টুকটাক কথাবার্তাও হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না কলেজ স্ট্রিটের বাসিন্দা হওয়ায় আমার বিশেষত্বটাই বা কী? আর তার সঙ্গে আর এক বাটি পাঁঠার মাংসের সম্পর্কটাই বা কোথায়? প্রসঙ্গত বলে রাখি, তখনও কিন্তু এক বর্ণও অ্যাসাইনমেন্ট-এর বিষয় নিয়ে কথা হয়নি। কারণ, আমার কাছে টেপ রেকর্ডার ছিল না। কাগজ-কলমে নোট করতে হবে। সে পর্ব শুরু হবে খাওয়ার পর। আমি জয়দীপকে ভদ্রতার খাতিরে বললাম, “তুই দু’পিস নে।” শুনে দেবাংশুদা বললেন, “পাঁঠার মাংসের ভাগ কাউকে দিতে নেই। এতে পাঁঠার অকল্যাণ হয়। ওরে বাদল আর এক প্লেট মটন দিয়ে যা না বাবা… আমি এখনও আস্ত কচি পাঁঠা মেরে দিতে পারি জানিস!”
মাংসের বাটি হাতে বাদল নামে ছেলেটির পেছন পেছন খটাস খটাস করে খড়ম পায়ে ঘরে ঢুকলো লম্বা, ফর্সা, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা উইগ পরা (পরে জেনেছিলাম উইগ নয়, আসল) স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন একটি ছেলে। পরনে ধুতি, ঊর্দ্ধাঙ্গে উত্তরীয়, কাঁধ থেকে পৈতে ঝুলছে। কপালে তিলক আঁকা। বুকে, গলায় চন্দনের ফোঁটা। দেবাংশুদার পাশের চেয়ারে ধপ বসে পড়ে বলল, “এর পরের শটটা কোথায় নেবে? ঘরের ভেতর না দাওয়ায়?”
দেবাংশুদা ওর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “এর সঙ্গে আলাপ হয়েছে? আমার হিরো। মহাপ্রভু শ্রীমান চৈতন্যদেব।” বলতেই ছেলেটি আমাদের দিকে হাত জোড় করে বলল, “যিশু সেনগুপ্ত।” দেবাংশুদা বলে উঠল, “আমার আবিষ্কার। ভবিষ্যতের সুপারস্টার। মিলিয়ে নিস।” দেবাংশুদার সেদিনের ভবিষ্যতবাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
আমি একটু মাংস মুখে পুরে বললাম, “দারুণ তো, মহাপ্রভুর রোল করছে ‘যিশু’!” শুনে দেবাংশুদার সে কী হাসি। “এইটা সবাই বলে… যিশু, ইনি সান্ধ্য আজকাল থেকে এসেছেন। প্রিয়ব্রত। কমলদা পাঠিয়েছে। তুই অবশ্য কমলদাকে চিনবি না। তোর বাবা চেনে। তোর বাবাদের সব বন্ধু-বান্ধব। মুশকিলটা কী হয়েছে জানিস, ভদ্রলোক কলেজ স্ট্রিটে থাকেন!”
শুনে যিশু চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, “অ্যাঁ…কলেজ স্ট্রিট! তাহলে তো মুশকিল আসান গো!” আমার দিকে তাকিয়ে বলল. “আপনার হয়ে গেল!”
“সবই মহাপ্রভুর ইচ্ছে বুঝলি… জয় জগন্নাথ!” বলে ঢেকুর তুললেন দেবাংশুদা।
এদিকে আমার ভেতর অস্বস্তিটা বেড়েই চলেছে। যিশু তাতে আর একটু ধোঁয়া দিয়ে বলল, “স্টুডিও পাড়ায় খবর করতে আসুন আর নাই আসুন… ওই কলেজ স্ট্রিটের জন্য আপনাকে প্রতি সপ্তাহে এবার থেকে টালিগঞ্জে একবার আসতেই হবে।”
যতটা তৃপ্তি করে পাঁঠার মাংসটা খাব মনে করেছিলাম ততটা আয়েস করে খেতে পারা গেল না!
লাঞ্চ সেরে কাগজ-কলম খুলে বসলাম। যে জন্য আসা, সেই কারগিল আর ক্যাসেট সমস্যা নিয়ে অত্যন্ত বিশ্লেষণাত্ম ও সুচিন্তিত মতামত দিল দেবাংশুদা। আলাপচারিতায় আবিষ্কার করলাম এক অন্য দেবাংশু সেনগুপ্তকে। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, রাজ্যের হাল, ইন্ডাস্ট্রির দুর্দশা সেইসঙ্গে আন্তজার্তিক সমস্যা অর্থাৎ সংসদ থেকে সংষ্কৃতি সব কিছু নিয়ে ভদ্রলোকের যুক্তি ও ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তুখোড় পাণ্ডিত্য!
সব নোট-টোট করে পকেটে নোটপ্যাড ঢোকাতে যাব, দেবাংশুদা বলল, “ওটা আমাকে একবার দে তো, পেনটাও।” দিলাম। পাতা উল্টে উরুর ওপর প্যাডটা রেখে এক দুই তিন চার করে কি সব লিখতে আরম্ভ করল দেবাংশুদা। জয়দীপ মওকা বুঝে নানা অ্যাঙ্গেলে একটার পর একটা ছবি তুলে যাচ্ছে। দু’পাতা লেখার পর প্যাড আর পেন আমাকে ফেরত দিয়ে বলল, “এই বইগুলো আমার দরকার। এনে দিবি প্লিজ?” আমি প্যাডের পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখি মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে লেখা মোট বারোটা বইয়ের তালিকা। “এই বইগুলো একটু খোঁজ করিস তো ভাই। শ্যুটিং-এডিটিং ছেড়ে একদম আর কলেজ স্ট্রিট যেতে পারি না। একে ওকে দিয়ে আনাই। তা তুই যখন কলেজ স্ট্রিটেই থাকিস, বইগুলো তুলে নিয়ে তোর কাছে রাখবি। যখন এদিকে আসবি, তখন সঙ্গে করে নিয়ে আসবি।” আমি মনে মনে ভাবছি এত টাকা আমি পাব কোথায়? লেখা পাতা থেকে চোখ তুলে দেখি দেবাংশুদার হাতে মানিব্যাগ। সেখান থেকে একশো টাকার দশটা নোট বার করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “কমিশন যা হবে তোর। বিলটিল দরকার নেই।” বলে সংযোজন, “আর বলিস না, প্রতি মাসে আমার নয় নয় করে হাজার তিনেক টাকা বেরিয়ে যায় বই-এর পেছনে। আপাতত হাজার খানেক দিলাম। ওতে হবে না জানি। আবার যেদিন আসবি আরও কিছু টাকা দিয়ে দেবো।” কথার মাঝে একজন এসে বললেন, “দাদা শট রেডি।”
উঠে পড়ল দেবাংশুদা। “তোরা আছিস তো… শটটা নিয়ে নি… আজকের মধ্যে দুটো এপিসোড মেরে রাখতে হবে…চলি রে…” বলে অফিস ঘরের বাইরে এসে চোখে রে ব্যানের সানগ্লাসটা লাগাতেই পুরো জ্যাকি চ্যান!
ক্যামেরার শাটার টিপতে শুরু করে দিয়েছে জয়দীপ।
যিশুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের শুরুওয়াত সাংবাদিক-শিল্পীর গতানুগতিক রসায়নে নয়। ক্রিকেটের সূত্রে। যিশু ফার্স্ট ডিভিশন ক্রিকেট খেলত। অলরাউণ্ডার। কোন ক্লাবে খেলত এখন আর মনে নেই। আমি খেলতাম প্রথমে ভবানীপুর পরে মোহনলালে। দ্বিতীয় ডিভিশনে। পরবর্তীকালে দুজনেই বাইশ গজ থেকে বাইশশো মাইল দূরে ছিটকে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন পিচে খুচরো সিঙ্গল নিয়ে যে যার জায়গা পোক্ত করার চেষ্টা করছি। ক্রিকেট অন্তপ্রাণ যিশুর তখনও ব্যাট বলের হ্যাংওভার কাটেনি। আমারও একই দশা। চুম্বক যেমন একে অপরকে আকর্ষণ করে ক্রিকেটের পপিং ক্রিজ আমাদের পাশাপাশি এনে দাঁড় করিয়ে দিল। সেকথায় পরে আসছি। আগে দেবাংশুদার বই নিয়ে বাউণ্ডুলেপনাটা সেরে নিই।
পরদিন অফিসে কমলদাকে চোখ গোল গোল করে গতদিনের ঘটনার কথা বলতে, নির্লিপ্তের মতো বললেন, “আমি জানি। আজই ওই টাকায় যতগুলো পার বই তুলে নিয়ে কালই দেবাংশুকে গিয়ে দিয়ে আসবে। পরের অতগুলো টাকা নিয়ে ঘোরাটা রিস্কি।” আমি বইপাড়া ঘুরে গোটা পাঁচেক বই সংগ্রহ করে পরদিন হাঁফাতে হাঁফাতে গিয়ে হাজির হলাম এনটি ওয়ানে। বইয়ের থলি হাতে নিয়ে ফ্লোরের মধ্যে শ্যুটিং জোনের বাইরে একটা প্রায়ান্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে গলগল করে ঘামছি। শট শেষ হল। যিশু আমাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “দেবাংশুদা ওই যে তোমার বইওয়ালা।” বলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে এগিয়ে এল।
সশব্দে ফ্যান চলতে শুরু করেছে। কারোর কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। আচমকা দেখি দেবাংশুদা কাঁধের তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে আমার দিকে অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে আসছে। কিছুটা এগিয়ে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল। মনিটারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রোডাকশানের লোক পাখার সামনে তিনটে চেয়ার এগিয়ে দিল। বইয়ের থলিটা দোবাংশুদার হাতে দিতে গেলাম। না নিয়ে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এর মধ্যে তোর সব পড়া হয়ে গেল?”
“মানে?”
“বইগুলো পড়েছিস?”
“না তো… আমি পড়তে যাব কেন?”
“সে কি রে… এতগুলো নতুন বই পেলি, একটাও খুলে দেখিসনি?”
“না… ওগুলো তো তোমার বই আমি পড়তে যাব কেন?”
“ওরে যিশু… সাধে বলেছি কলেজ স্ট্রিটের কেষ্টঠাকুর!”
যিশু ততক্ষণে আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বইগুলো বার করে দেখছে। দেখে দেবাংশুদা যিশুকে বলল, “এই যে বাবা মহাপ্রভু পরে শটের স্ক্রিপ্টটা দেখ… ধন্য হই… ওগুলো পরে দেখলেও চলবে।”
যিশুও সুড়সুড় করে ব্যাগের ভেতর বইগুলো পুরে দেবাংশুদাকে ফেরত দিতে গেল।
দেবাংশুদা আমাকে বলল, “অপিসে গিয়ে বইগুলো নিয়ে বোস… শটটা নিয়ে আমরা আসছি।”
লিকার চায়ের হাঁক দিতে দিতে যিশুকে নিয়ে অফিসে ঢুকল দেবাংশুদা। বলল, “শোন… এমন ভুল আর জীবনে করবি না। যে-ই বই কিনতে দিক না কেন। সেটা কিনে আগে নিজে পড়ে নিবি, তারপর যে কিনতে দিয়েছে তাকে দিবি।” বলে বইগুলো এক এক করে দেখতে লাগলেন।
আমি কমলদার নির্দেশের কথা বললাম।
“কমলদার কথা ছাড় তো, ওই কমলদাও বই কিনতে দিলে আগে নিজে পড়ে নিবি তারপর দিবি।”
তারপর থেকে দেবাংশুদার সেদিনের উপদেশ আজও আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলি।
পাঁচটা বই থেকে একটা বই বেছে নিয়ে বললেন, “এই নে, এটা দু’দিনের মধ্যে পড়ে আমাকে দিয়ে যাবি। খুব কন্ট্রোভার্সিয়াল বই, পড়লে চৈতন্যদেব, পুরী, জগন্নাথদেব… পুরো কনসেপ্টটাই বদলে যাবে… লোকটাকে মেরেই ফেলল… পড়… পড়… বইটা পড়।”
কৌতুহলী যিশু আমার হাত থেকে বইটা টেনে নিল।
বইটার শিরোনাম ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’। প্রথম খণ্ড। লেখক ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়। ভেতরে প্রথম পাতাতেই লেখা ‘শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধানের উপর একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ’।
বইটা নিয়ে পরদিন নাচতে নাচতে অফিসে গিয়ে কমলদাকে দেখালাম। পাশের চেয়ারেই বসেন সান্ধ্যর তৎকালীন ইনচার্জ শুভশঙ্কর ভট্টাচার্য। বইটা কমলদার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে পাতা উল্টে বললেন “এটা কিনলে নাকি?” কমলদা সংক্ষেপে গোটা ঘটনাটা শুভদাকে বললেন। শুভদা উত্তেজিত। বললেন, “দুর্ধর্ষ বই। পাণ্ডাগুষ্টির মুখে নুড়ো জেলে দিয়েছিল ওই জয়দেব মুখুজ্জে। লোকটাকে শেষে মেরেই ফেলল।” আমি হাঁ করে শুভদার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শুভদা আমাকে বইটা ফেরত দিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে লাইব্রেরিতে দেমু’র কাছে চলে যাও, ও গোটা ব্যাপারটা বলে দিতে পারবে… এই বইটা তোমাকে মহাপ্রভুর ডিরেক্টার পড়তে দিয়েছে? হেব্বি লোক তো!”
দেমু মানে দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। আজকালের লাইব্রেরিয়ান। এখন রিটায়ার করেছেন। চলন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া। মূলত সত্যজিৎ-গবেষক ও সংগ্রাহক।
দেমুর কাছে জানতে পারলাম ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৯ জুন চৈতন্যদেব ভাবে বিভোর হয়ে গান গাইতে গাইতে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকেছিলেন। সেই প্রথম আর শেষবার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল। তারপর আর চৈতন্যদেবকে দেখতে পাওয়া যায়নি।
খুন বা আত্মহত্যা, চৈতন্যদেবের দেহটা গেল কোথায়? ৪৬২ বছর পর সেই রহস্যের অনুসন্ধানে নেমে যখন গবেষক লেখক জয়দেব মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ বইটির প্রথম খণ্ডে প্রায় প্রমাণ করে এনেছিলেন চৈতন্যদেবকে কারা কিভাবে খুন করেছিল এবং কোথায় দেহ পুঁতে দিয়েছিল, ঠিক তখনই পুরীর আনন্দময়ী আশ্রম থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ডঃ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর মা বিমলা মুখোপাধ্যায়কে। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। আর ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় ও তাঁর মা মারা যান ১৯৯৫ সালে। তার চারবছর পর চৈতন্যদেবকে নিয়ে ধারাবাহিক তৈরি করতে শুরু করে দেবাংশুদা।
বইটা এক রাতেই গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে পরদিনই ছুটলাম এনটিওয়ান। সোজা মহপ্রভুর ফ্লোরে। একেবারে মুখোমুখি দেবাংশুদা। ভূমিকা না করে প্রশ্ন করলাম, “দেবাদা, তুমিও কি তোমার সিরিয়ালে চৈতন্যদেবকে যে হত্যাই করা হয়েছিল সেরকমই দেখাতে চলেছো নাকি?”
প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসল দেবাংশুদা। কাঁধে হাত রেখে বলল, “দেখি মহাপ্রভুর কী ইচ্ছে। কতদূর কী করতে পারি। ওরা ভীষণ ভয়ঙ্কর।” ওইটুকু উত্তরই যথেষ্ট। আমি পেয়ে গেছি আমার এক্সক্লুসিভ। পরদিনই সান্ধ্যতে কমলদা হেডলাইন করলেন, “হত্যা না আত্মহত্যা, চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্যভেদে দেবাংশুর মহাপ্রভু।”
কিন্তু দেবাংশুদার সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল না দেবাংশুদারই ভুলে!
ক্রমশ..
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন