সন্দীপা
ঋতু জানত অর্ক আর কোন দিনই ফিরবে না। আট মাস আগে যেদিন দু’দিনের অফিসের কাজের নাম করে গেল, সেদিনই জানত। কিন্তু জানতে পারা আর বুঝতে পারার মধ্যে একটা তফাৎ আছে। এমনকি যখন অর্ক ফোন বা মেসেজের যোগাযোগও বন্ধ করেছে, তখনও ঋতুর জানাটা বোঝায় পরিবর্তিত হয়নি। তার জন্য সময় লেগেছে আরও বেশি।
তবে সেসব পুরনো কথা। আজকের কথা আলাদা। এই রাত দীর্ঘপ্রতীক্ষিত। তিলে তিলে গড়েছে ঋতু এই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা, অর্ক ফিরবে তার কাছে, আট মাস পর।
রোজকার মত কাল রাতেও ঘুম আসেনি ঋতুর। গাঢ় অন্ধকার থেকে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসা আকাশের রং দেখেছে। তারপর কখন যেন জুড়িয়ে এসেছে চোখ। ঘুম ভাঙল সকাল এগারোটা। ঘুম জড়ানো চোখেই ল্যাপটপটা টেনে নিয়েছিল। তারপর তো স্ক্রিন জুড়ে একের পর এক ছবি আর অস্তিত্বের পরতে পরতে মিশে থাকা স্মৃতির ভিড়। খিদে নেই, ঘুম নেই, ক্লান্তি নেই, কেবল স্মৃতির অতলে ডুবসাঁতার। ভালবাসার ছবি জুড়ে জুড়ে তৈরি করা কোলাজে সেজে উঠল ল্যাপটপের স্ক্রিন সেভার। অর্ক এটা দেখলে কী বলবে? খুশি হবে? চশমার আড়ালে ওর উজ্জ্বল চোখদুটোতে উপচে পড়বে খুশি? খুব খুশি হলে ওর হাসিটা ছেলেমানুষের মত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ওই হাসিটা দেখবে বলেই তো…
ল্যাপটপের কাজ শেষ করে এবার ঘর। চাদর পাল্টে, পর্দা বদলে ঘরটাকে ঝকঝকে করে তুলতেই রাত দশটা বেজে গেল। ব্যস্ত হয়ে ওঠে ঋতু, সময় হয়ে এল তো প্রায়! দেরী না করে ঢুকে পড়ে স্নানের ঘরে। শহরতলির অলিগলি পেরিয়ে, দু’কামরার এই নিরিবিলি অ্যাপার্টমেন্ট ওদের যাবতীয় খুনসুটি, মান-অভিমান, ঝগড়া আর ভালবাসাবাসির সাক্ষী। অর্ক ফিরবে আজ। দীর্ঘ বিরহ শেষে আবার এখানেই দেখা হবে দুজনের।
সময় নিয়ে স্নান করে ঋতু। যত্ন করে সাজে হাল্কা প্রসাধনে। আয়নায় নিজেকে ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখে। রোগা হয়েছে, গাল দুটোও ভেঙেছে। চোখের নীচে জমাট অন্ধকার। অর্ক ছুঁলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ঋতু জানে। আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা! আজ কোন বাঁধন, কোন মাপের অনুশাসন মানবে না ঋতু। একসঙ্গে অনেকটা হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে জানলার পাশের সোফাটায় বসে। পাশেই ছোট্ট টেবলটায় রাখা আছে বাকি রসদ।
সারা দুপুর বৃষ্টি পড়েছে আজ। এখনও বাতাসে জলের গন্ধ লেগে। জানলার গ্রিল ছোঁয়া নারকেল পাতায় ঝুমঝুম চাঁদের কুচি। চাঁদটাও যেন আজ একটু বেশিই সোহাগী, মেঘের কোলে আধশোয়া এক আহ্লাদী। “আবার এমন ভাবেই গল্প করব আমরা সারা রাত।“ ফিসফিস করে ঋতু। “তোমার দু’হাতের বাঁধনে ঘন হয়ে কান পাতব তোমার বুকের স্পন্দনে। আমাদের ঘিরে থাকবে না বলা যত কথা। স্কুলছুট হজমিগুলি, কাগজের নৌকো আর প্রথম প্রেমের গল্প। কথা বলবে নৈশব্দ, আঙুলের আলিঙ্গনে কথা বলবে আঙুল, ঠোঁটের আলিঙ্গনে ঠোঁট। ‘ইয়ে রাতে, ইয়ে মৌসম, নদী কা কিনারা, ইয়ে চঞ্চল হাওয়া…‘ দূর থেকে ভেসে আসবে ভুলে যাওয়া চেনা সুর। আজ নিজেকে তোমাতে মিশিয়ে নেব, তুমি জানতেও পারবে না।“ আবেশে শিথিল হয়ে আসে ঋতুর শরীর।
কারা যেন বেল বাজাচ্ছে, নাম ধরে ডাকছে ঋতুকে। ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়। শোরগোল বাড়ছে বাইরে। ছিটকিনি আলগা করাই আছে, ঋতু জানে এখুনি ঢুকে আসবে ওরা। তারপর আসবে পুলিশ। সোফায় পড়ে থাকা ঋতুপর্ণা দত্তের প্রাণহীন শরীরটা নিয়ে যাবে, যেটার পেট চিড়লেই পেয়ে যাবে ওর যাবতীয় নির্ঘুম রাতের জমিয়ে রাখা সব ঘুম। পাশের টেবলেই পেয়ে যাবে ঘুম জমানোর খালি কৌটো, হুইস্কির গ্লাস, ঋতুর ল্যাপটপ আর ফোন। ওগুলোও নিয়ে যাবে ওরা। ঋতুর কাজ এখানেই শেষ, বাকিটা ওরাই করবে। আর তার পরেই, ঋতু জানে, অর্ককে এখানে আসতেই হবে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন