কিযী তাহ্নিন
আমি রুমালকে কবুতর করে উড়িয়ে দিতে পারি। ডিমকে ছুমন্তর করে সাদা পালকের মুরগি বানিয়ে ফেলতে পারি। আমি ঈশ্বর নই, জাদুকর। এমন কোনো আহামরি জাদুকর নই, আর দশজন যেমন হয়। বিশেষ হওয়ার জন্য মাথায় পাগড়ি বাধি, ঝুলওয়ালা ইয়া লম্বা পাঞ্জাবি পড়ি, আর নাগরা স্টাইলের নকল চামড়ার জুতা। সে জুতায় ফোসকা পরে। সারাদিন ধরে এ শহর, ওই গ্রামে ঘুরে ঘুরে জাদু দেখানোর পরে বাড়ি ফিরে দেখি, পায়ের কোণার ছোট্ট আঙ্গুল পানি জমা হয়ে ফুলে ওঠে কালো আঙুরের মতন। রাত জেগে গরম পানির সেঁক দিয়ে টিপে টিপে সেই ফোসকার রস বের করি। কোনো জাদু দিয়ে ফোসকা সারাতে পারিনা আমি। এমনই সাধারণ এক জাদুকর আমি।
এক কোম্পানির হয়ে কাজ করি, তাদের বায়না মতন নানা জায়গায় যেয়ে জাদু দেখাই। গ্রামের সংসার, আর নিজের খরচ মিটিয়ে যা থাকে তা হলো নামমাত্র ঠনঠনে সঞ্চয়। অথচ আমাকে ভেঙে ভালোই খাচ্ছে কোম্পানি। বিশেষ করে আমার অসুখের পর। আমার এক অসুখ হলো দুই বছর আগে। চোখ দিয়ে পানি পরেনা। আঘাত পাই, কষ্ট পাই একটুও পানি পরেনা। এ তো এক অসুখই বটে। সুখে অসুখে চোখের টসটসে জলই তো মানুষকে কেমন মানুষ করে তোলে। আমার চোখে সেই জলই নেই, খরা। কত ডাক্তার দেখালাম, তারা বলে, চোখের ভেতরে তো কোন সমস্যা নেই।” আর এর পুরো সুযোগ নিলো কোম্পানি।
মালিকের বুদ্ধিতে লাল নীল কাগজে পোস্টার লেখা হলো, “শো এর শেষে থাকবে চমক। এমন জাদুর খেলা কেউ কোনদিন দেখেনি।”
জাদুর শেষ খেলায় আমার কাছে মানুষ আসে, দর্শকের সারি থেকে উঠে মঞ্চে। আমাকে খোঁচা দেয়, আঘাত করে, খামচি দেয়। একবার এক দর্শক তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিলো গুঁতা। তবু আমার চোখ জলশূন্য। দর্শক অবাক। এ কেমন অদ্ভুত অসাধারণ জাদু। আমার জাদুর শক্তি প্রমাণ করার জন্য শেষে এক দুঃখে ডুবুডুবু সিনেমার আবেগী এক অংশ দেখানো হয় পর্দায়, যেখানে মা জঙ্গলে তার মৃতশিশু পুত্রের লাশ খুঁজে পায়। হলের সবাই কাঁদে। কী কষ্ট। আমার চোখ দিয়ে পানি পরে না। চোখের কোণে পানির বিন্দুটুকু জমে না। আমার নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। আমি এক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী, যার চোখে জল জমে না।
কেউ বোঝেনা যে আমি কাঁদি। এই যে শেষ খেলায় খোঁচা মেরে খামচি মেরে সবাই জলহীন জাদুকরের প্রশংসায় ভাসে, হাসে, আমি তখন ব্যথায় কুঁকড়ে কাঁদি। কিন্তু সেই কান্না কেউ দেখতে পারেনা। কারণ চোখ যে খটখটে। কয়টা টাকা বেশি পাচ্ছি এই শেষ খেলার বদৌলতে। জমিয়ে রাখি। মুখ বুঝে সব সহ্য করে নেই। রাত করে বাড়ি ফিরে নকল চামড়ার জুতায় তৈরী কালো পচা আঙুরের মতন পায়ের আঙ্গুল ডলতে ডলতে খুব কাঁদি, জলহীন কান্না। কিছু টাকা তো জমছে। কাল চেয়ারম্যানের বাড়িতে বায়না আছে। আমার খেলা দেখবে বলে বাড়তি টাকা পাঠিয়েছে চেয়ারম্যানের সাহেব। আরো জমুক টাকা। এ জীবনে একবার আসল চামড়ার জুতা কিনবো। তারপর দুনিয়া হেঁটে বেড়াবো। এই জাদুকরের জীবন আর কতদিন। এমন ভাবতেই আনন্দে ঘুম চলে আসে।
চেয়ারম্যানের বাড়িতে খেলা জমে উঠেছে। শেষ খেলা জমজমাট। আমাকে কাঁদবার জন্য কত কৌশল সবার, তবু চোখ দিয়ে পানি পড়েনা। চেয়ারম্যান খুশির চোটে আমার গলায় গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে দেয়। জাদু শেষে সবাই বাড়ি ফিরবে আর ওই সময় দর্শকের সারিতে থাকা নাকে সর্দি জমা বাচ্চা ছেলেটা কেঁদে ওঠে। তার একপাটি জুতা খুঁজে পাচ্ছেনা ভিড়ে কোথাও। “আমার জুতা আইনে দেও” বলে বিকট চিৎকার দিচ্ছে। আর আমার কেমন ধা করে মনে পরে গেল যে আমারও একজোড়া জুতা ছিল। জীবনে একবারই আমাকে জুতা কিনে দিয়েছিল আব্বা। খাঁটি চামড়ার লাল জুতা। অতো অভাবের দিনে অমন জুতা কই পেলো কে জানে। গোসল করতে যেয়ে এক পাটি পরদিনই ভাসিয়েছি নদীতে। আরেকপাটি হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মরে যাই প্রায়। আব্বা বলে, “আরেক পাটি করবি কি হারামজাদা, ঐটাও ফ্যাল, ফ্যাল।” দিলাম নদীতে ভাসিয়ে। এ জীবনে আর অমন জুতো মিলেনি। সুফিয়াকে বিয়ের পর যখন চেপে আদর করতাম, ওর হলদেটে মুখ কেমন রক্ত জমে লাল হয়ে যেত। তেমন লাল রঙের জুতা। আর শালার এই কোম্পানীর নকল চামড়ার নাগরা পড়া ফোসকাওয়ালা পা দুটোর দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে, আমার এক জোড়া লাল চামড়ার জুতা ছিল।
চেয়ারম্যান বাড়িতে জাদু দেখতে আসা সবাই দেখে তাদের জাদুকর কেমন কাঁদছে। চোখ বেয়ে বেয়ে জল, কত খরার পর এমন ভরা বর্ষা। আশপাশ থেকে খেপে ওঠে সবাই, “ভুয়া জাদুকর, ওই তো কাঁদে। হের বলে জাদুর চোখ, পানি পরেনা? ভুয়া।”
আমি ইস্তফা দেই কোম্পানি থেকে। না দিলে ওরাই বাদ দিত। আমার কারণে মানসম্মান সব গিয়েছে ওদের।
মালিক বলে, “তা এখন কী করবা?”
আমি বলি, “দোকান দিবো দোকান।”
“কিসের দোকান?”
আমি বলি, “সেই দোকানে সবার হারিয়ে যাওয়া এক পাটি জুতা পাওয়া যাবে।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন