কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
-বাবারা, আমাকে দিবি না খাবারএর প্যাকেট ?
সন্দীপ অবাক হয়৷ বৃদ্ধা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে৷ রাকাকে ফিসফিসিয়ে বলে
-আমাদের প্যাকেট নেই আর? ঠাকুমা কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে৷ দেওয়া যাবেনা প্যাকেট একটা?
আসলে “সোপান” স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আজ খাদ্যবিতরণের কর্মসূচী চাঁদপুর ঝুমুর গ্রামে৷ এজায়গার আসল নাম সর্দারপাড়া কিন্তু সবাই চেনে ঝুমুর গ্রাম নামে৷ এখানে বসত করে প্রায় একশো জনের পরিবার সবারই পেশা ঝুমুর গান৷
অতিমারীর সময় বড় অর্থকষ্টে আছে৷ গান শুনবে কে এখন? প্রাণের তাগিদ যে বড় অনেক৷
চাল, ডাল, আলু, চিনি, তেল, সয়াবিন, বিস্কুট, সাবান সমস্ত প্যাকেট দেওয়া হয়ে গেছে, পড়ে আছে একটাই প্যাকেট৷ প্রাপক নেই এখনও পর্যন্ত৷ বৃদ্ধা তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে সেই ঠিকানাহীন প্যাকেটের দিকে৷
রাকা বলে -না রে সন্দীপ বুড়ীর নাম লিস্টে নেই৷ স্লিপ যারা নিয়েছিল সবাই নিয়ে গেছে৷ একটা পড়ে আছে৷ যদি কেউ স্লিপ নিয়ে আসে এ প্যাকেট যে তার৷ কিভাবে দিই বলতো?
-আমাদের এক্সট্রা আনা হয়নি রে প্যাকেট? সন্দীপ প্রশ্ন করে৷
-না রে, এজন্যই তো পরশু স্লিপ দিয়ে গেছিলাম৷ তুইও তো ছিলিস মনে নেই৷ আমারও কষ্ট হচ্ছে এই রোদে ঠাকুমা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে৷ হয়ত খুব দরকারও ওনার৷ কিন্তু …
সন্দীপ হাত নেড়ে বুড়ীকে বসতে বলল৷
-পরশুদিন স্লিপ দিয়েছিলাম পাওনি? স্লিপ অনুযায়ী তো মাল এনেছি৷ একজন আসেনি৷ যদি আসে স্লিপ নিয়ে এখন কেউ, এ প্যাকেট যে তার ঠাকুমা৷ পরশুদিন বিকালে স্লিপ নাও নি কেন?
-বাবা, বুড়ো মানুষ বিকালে আর বের হই না৷ চোখে কম দেখি যে…
-তোমার বাড়ীর কাউকে পাঠাতে৷ কেউ নেয়নি তো স্লিপ?
-না বাবা৷ আমার বাড়ীতে আমিই একা৷ রতনের বাবা মরে গেল গো বিনা চিকিৎসায়৷ বড় ভাল গাইতো রতনের বাবা৷ মেডেল পেয়েছিল কত৷ এখন আমার চেয়ে চিন্তে চলে…
-কেন তোমার ছেলে?
-রতন দিল্লীতে কাজ করতে গিয়ে আর ফিরল না৷ সবাই বলে মরে গেছে রোগে৷
বুড়ী চোখের জল মোছে৷
-তোমার নাম?
-তরুবালা দাসী৷
সন্দীপ, অলক, মিতালী, রাকা মুখ চাওয়াচায়ি করে৷ ইশারায় কথা হয়৷
মাতব্বর গোছের গ্রামের মাথা যোগেন সর্দারকে ডাকে সন্দীপ৷ কেউ আর বাকী আছে নাকি জানতে চায়৷ যোগেন বলে সবাই মোটামুটি নিয়ে গেছে বাবুরা৷
-কিন্তু এই ঠাকুমা৷ ইনি স্লিপ নেননি তো?
-হ্যাঁ৷ তরু পিসির কথা মাথায় ছিল না একদম৷ আপনারা দিয়ে দিন তরু পিসিকে৷ ভুলে গেছিলাম পিসির কথা, না হলে স্লিপ তুলে রাখতাম ..
যোগেন সর্দার মাথা চুলকায়৷
একটা স্লিপ তৈরী করে যে প্যাকেটটা পড়ে আছে তা বুড়ীকে তুলে দিতে আর কতক্ষণ …
বুড়ী প্যাকেট নিয়ে ফোকলা দাঁতে হাসে৷
-দাঁড়া বাবারা, প্যাকেটটা রেখে আসি৷ যাস না আমি আসছি৷
বুড়ী আবার বেশ কিছুক্ষণ পর ভরা ব্যাগ নিয়ে ফেরে৷
-ও ঠাম্মা, তুমি ঝুমুর গান জানো? রতনের বাবার কাছে শেখনি গান? শোনাও না একটা…
রাকার অনুরোধে বুড়ি হাসে …
বোধহয় ঘোলাটে চোখে স্মৃতির অতলে ডুব দেয়৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর শুরু করে
“শাল তলে বেলা ডুবিল দিদি লিলো লো
ও লিলাক দিদি লিলো লো, লিলো লো, লিলো লো
আরে লুধুরার লদীতে বান পড়িল দিদি
ও দিদি লিলো লো, লিলো লো, লিলো লো
শাল তলে বেলা ডুবিল…”
শালগাছের তলায় ঠাকুমার গান শুনতে থাকে শহরের নাতি নাতনীরা৷ হাততালি দেয় ৷
-দারুণ গলা ঠাম্মা তোমার৷ অলক বলে ওঠে৷
তরুলতা লজ্জা পায়৷
-রতনের বাবা শিখিয়েছিল, ভুলে গেছি কত গান …
তরুলতা ব্যাগ থেকে দুটো চালকুমড়ো বার করে ৷
-বাবারা, নিয়ে যাও বাড়ীতে৷ আমার ঘরের চালে হয়েছে৷ রতনের বাবার লাগানো…
সন্দীপ মিতালি নিয়ে নেয় ঠাম্মার দেওয়া চালকুমড়ো৷
তরুবালার মুখে খেলা করে তৃপ্তির হাসি৷ এটাই বোধহয় শহুরে ভাষায় রিটার্ন গিফ্ট৷ তরুলতা ওদের যাওয়ার সময় হাত নাড়তে থাকে৷
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন