micro-story-kheedey

খিদে
রাখি পুরকায়স্থ

“মার ব্যাটাকে, মার মার!”
“চাবকে পিঠের চামড়া তুলে দে!”
কারা যেন চেঁচাচ্ছে। তার পর টানাহ্যাঁচড়া করবার আওয়াজ। তুমুল হইহট্টগোল। চারিদিক থেকে হৈহৈ করে দৌড়ে আসছে লোকজন। বেশ ভিড় জমে গিয়েছে শীতলা মন্দিরের ধারে বড়ো রাস্তাটার পাশে। চা-রুটির যে ঝুপড়ি দোকানগুলো রয়েছে সারি দিয়ে, ঠিক তার সামনে।

গোটা পঁচিশেক মাথার ফাঁক গলে এই এতক্ষণে দেখতে পাচ্ছি- একটা লিকলিকে কালো ছেলেকে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে ফেলেছে উত্তেজিত জনতা। ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে। কতই বা বয়স হবে ছেলেটার, ওই বারো কী চোদ্দ!

“বেজান খিদা পাইসিলো গো বাবু। ভুল হইসে আমার। ছাইড়া দেও না গো আমারে”, কাকুতিমিনতি করছে ছেলেটা।

“চোর কোথাকার! রোজ দোকানগুলোর সামনে ঘুরঘুর করতে দেখি তোকে। চুরি করা এবার আচ্ছাসে বের করছি তোর।“

ছেলেটা কাঁদছে। হাউহাউ করে কাঁদছে। ততক্ষণে ওকে ঘিরে ফেলেছে জনা ত্রিশেক লোক। বেশ কয়েকজন ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। পাড়াগেঁয়ে জীবন বড়োই নিস্তরঙ্গ। রোজ-রোজ কী আর এসব দেখবার সুযোগ মেলে? কয়েকজন দেখছি এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে। এখন ছেলেটার দিকে পিছন ফিরে হাসি-হাসি মুখে সেলফি তুলছে ওরা। মোবাইল ফোন শূন্যে তুলে কয়েকজন ভিডিও করছে গোটা ঘটনাটা।

ছেলেটিকে কেউ মনে হয় ইতিমধ্যেই দু’তিন ঘা দিয়েছে। শুনতে পাচ্ছি, কাঁদতে-কাঁদতে চিৎকার করে ছেলেটা বলছে- “খিদা পাইসিলো গো বাবুরা। দুই দিন খাই নাই।“

একটা কর্কশ গলা ভেসে এল – “কী বললি? খিদে পেয়েছিল? দাঁড়া, আজ তোর খিদে পাওয়া বের করছি।“

একজন দেখছি ভিড় ঠেলে লাঠি হাতে এগিয়ে এসেছে। গলা চড়িয়ে তাকে বলতে শুনলাম- “খিদে-ফিদে কিস্যু না। সব ফালতু বকওয়াজ করছে শালা। ব্যাটা চোর! রোজ রুটি চুরি করে আমার দোকান থেকে। আজ বাগে পেয়েছি তোকে, এত সহজে ছাড়ব ভেবেছিস?”

হঠাৎ কোথা থেকে শোঁ করে বাইকে এসে হাজির টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক। এক লাফে বাইক থেকে নেমেই বুম হাতে এগিয়ে গেল সে। পেছন-পেছন ক্যামেরা ম্যান। কোন চ্যানেল ঠিক বুঝতে পারলাম না। লোকাল চ্যানেলই হবে মনে হয়। ওদের দু’জনের চোখে-মুখে প্রচ্ছন্ন হাসির ঝলক। হবেই তো, ঘুমন্ত গাঁ-গেরামে এমন শকিং নিউজের খুব আকাল কিনা!

ততক্ষণে সমবেত জনতা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। লাথি, কিল, ঘুষির উপর্যুপরি ভোঁতা শব্দগুলো ছাপিয়ে ছেলেটির তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে- “না কইয়া আর কুনুদিন রুটি নিমু না গো বাবু। খিদা পাইলেও নিমু না। আমারে মাইরো না।“

মনে হল জনা পঞ্চাশেক লোক এবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে রোগা ছেলেটার ওপর। দেখলাম, ওর পেটে লাথি…

*****

না, তার পর কী হয়েছে জানি না। অত সময় কই আমার! সকাল থেকে ছেলেটা বায়না ধরেছে ডিম ভরা ইলিশ মাছ ভাজা খাবে। ছেলের মাও তেমনি, বললেন, “যাও না গো বাজারে, ছেলেটা অমন করে বারবার বলছে।“

ছেলের মাকে বোঝানো অসম্ভব, এ-ছেলের কি বায়নার কোনো শেষ আছে? সারাদিন এটা নয় সেটা তো খেয়েই চলেছে! কিন্তু তিনি সে-সব শুনবেন কেন! একটু পর-পর তিনিই তো ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “আহা রে, কী খিদেই না পেয়েছে আমার সোনাটার। দেখ দেখ, চাঁদপানা মুখখানা এক্কেবারে শুকিয়ে গেছে।“ পরক্ষণেই এক বাটি হালুয়া কিংবা এক প্লেট চাউমিন তুলে ধরেন ছেলের মুখের সামনে। পুত্র-স্নেহে অন্ধ হলে যা হয় আর কী!

তা, কী আর করি বলুন! চুপচাপ মেনে নিলেই শান্তি। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই ঠাঁঠা রোদ্দুরে বাজার করে ফিরছিলাম, আচমকা লোকজনের জটলা দেখে খানিক দাঁড়িয়ে দেখলাম। ব্যাস্ অনেক হয়েছে! এখন চটপট স্নান-খাওয়াদাওয়া সেরে অফিস যাব। বড্ড দেরি হয়ে গেছে!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *