micro-story-kholas

খোলস
নীলা নাথদাস

দারচিনি গাছের নিচে পড়েছিল খোলসটি। রেখারই নজরে এসেছে প্রথমে। তবে, এত নিখুঁত তার রূপ যে সাপ ভেবে ভুল করে সা-প, সা-প বলে চিৎকার জুড়ে দিল ও। সঙ্গে সঙ্গে নিখিল, সদ্য কাজে যোগ দেওয়া যমুনা দৌড়ে এল। তারপর, যথারীতি রেখার বুদ্ধির উপর টিপ্পনী কেটে ঠাট্টা, বিদ্রুপ চলল নিখিলের। আসলে, ওকে হেনস্থা করতে পারলে, নিখিল খুব যে খুব খুশি হয়, সেটা ভালই জানে রেখা। এইযে যমুনা নামের নতুন কাজের মেয়েটি, নিখিলের বলা নানা মন্তব্য শুনে ফিকফিক করে হাসছে সেটাও নিখিল রেলিশ করছে, তা অপাঙ্গে যমুনার দিকে নিখিলের তাকানো দেখেই টের পেল রেখা। সেদিন, পুজোর চাঁদা চাইতে আসা ক্লাবের ছেলেদের সামনে ওকে শরণার্থী বলে অপমান করেছে নিখিল। দোষের মধ্যে হাতজোড়া ছিল বলে চাঁদার টাকাটা দিতে একটু দেরী হয়েছিল। চোখের জল সামলে নিয়ে কোনরকমে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল ও। কি করবে, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাছাড়া, ছেলে, মেয়ে দুজন বড় হয়ে গেছে, ওরাই বা কি ভাববে! ভাগ্যিস দুজনেই কলেজ-হোস্টেলে থাকে, তাই মায়ের এই অপমান ওরা দেখতে পায়না এখন। প্রথম থেকেই অদ্ভূত আচরণ এই মানুষটির। পাত্রী নির্বাচনের সময়ও নিজের স্বভাবকেই জাহির করেছে। পাত্রী হিসেবে দেখতে গিয়েছিল রেখার দিদিকে, কিন্তু শেষে রেখাকে বিয়ে করবে বলে গোঁ ধরল। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা উপায় না দেখে তাতেই সম্মত হন। বিয়ে হওয়ার পর বেশ কিছুদিন ভালই কাটে। অরিণ আর অর্জিতা দু বছরের ব্যবধানে জন্মায়। কিন্তু, ওদের বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেখা টের পাচ্ছিল, ওর সাথে নিখিলের সম্পর্কের সুতো আলগা হয়ে যাচ্ছে। এখনতো ভালবাসা কর্পূরের মত উবে গিয়েছে মনে হয়। তার জায়গা নিয়েছে টিটকিরি আর ব্যঙ্গোক্তি। আজকাল, ও অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে নিখিলকে। কে জানে অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে কিনা। যদি তা না হয় তবে রেখার প্রতি এত অনীহা কেন? তবে কি……। নাহ, এখন বাড়িতে অল্পবয়সী মেয়ে যমুনা রয়েছে, তেমন কিছু চোখেতো পড়েনি। তবে, যমুনা রেখার বড় বাধ্য। ওরকম মেয়ে নয়। নিখিলের কথা শুনে মজা পেয়ে হেসেছে হয়ত। নিজেকে আশ্বস্ত করতেই, সাপের খোলসের কথা মনে পড়ল রেখার। বাড়ির ভিতর যখন খোলস পাওয়া গেছে, তার মানে সাপও আছে। যমুনা দেখেই বলেছে ওটা বিষধর সাপের খোলস, শাঁকিনির হতে পারে। শুনেই খুব ভয় হয়েছে রেখার। রাত-বিরেতে না দেখে কেউ মাড়িয়ে দিলে আর রক্ষে নেই। ভাবতেই শিউরে ওঠে রেখা। সন্ধ্যেবেলায় তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দেখাতে গিয়ে খুব সাবধানে পা ফেলে ও। সবাইকে সাবধান করে দেয়। রাতে বিছানায় শুতে গিয়ে খাটের তলা, বিছানা,বালিশ পরীক্ষা করে দেখে সাপ লুকিয়ে আছে কিনা। আগামীকাল, কোন সাপুড়েকে ডেকে সাপটাকে খুঁজে বের করতে হবে। একটা সাপ? নাকি দুটো বা ততোধিক? মা বলতেন, সঙ্গী ছাড়া সাপ থাকেনা। নানা চিন্তার ভীড়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে রেখা। নিখিল কখন সিগারেট খাওয়া শেষ করে ঘরে এসেছে কিংবা আসেনি তা জানেনা ও। ঘুমের মধ্যে ময়াল সাপের স্বপ্ন দেখে। বিশাল মোটা পেট নিয়ে ওদের উঠোনে শুয়ে আছে। এত মোটা কেন পেট? তবে কি সাপটা ওর কাছে খাবার খেতে আসা নেড়ি কুকুর লালুকে খেয়ে ফেলেছে? ঘুমের মধ্যে নেয়ে ঘেমে অস্থির হয় রেখা। তৎক্ষণাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। তখনই হাসির আওয়াজ পেল রেখা। কেউ হাসছে, মৃদু হাসি, নারী কন্ঠের। কে হাসে এত রাতে? অন্ধকারে বিছানা হাতড়ে দেখে নিখিল বিছানায় নেই। সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে হাসির শব্দ লক্ষ্য করে যমুনার ঘরের কাছে এসে পড়ে রেখা। দরজায় কান পাতে। হাসি থেমে গেছে। এবার ফিসফিস করে কথোপকথন চলছে। ওর অনুমান অমূলক নয়। নিখিল আর যমুনা কথা বলছে। যমুনা কেমন আদুরে গলায় কথা বলছে! এতো কাজের লোক যমুনা নয় যেন। রীতিমত উচ্ছল রমণী। আর নিখিল? ওর বলা শব্দ শুনে ঘৃণায় আর সেখানে দাঁড়াতে পারলনা রেখা। ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে উঠোনের দিকে চোখ পড়ে ওর। জ্যোৎস্নাধোঁয়া উঠোনে বড় একটি শঙ্খিনীকে দেখতে পায় ও। অলসভাবে শুয়ে আছে। অজান্তে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল, হাতের চেটো দিয়ে মুছে নেয় রেখা। আর ভয় নয়। ঢের হয়েছে। এবার সাপকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর পালা। পেয়ারা গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে রাখা লাঠিটা তুলে নেয় রেখা। একে মারতেই হবে। তা নাহলে, এর বিষে জর্জরিত হতে পারে পুরো পরিবার। সাপটির মাথা লক্ষ করে দমাদম বাড়ি মারে ও। যমুনার ঘরের যাবতীয় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। আকাশে চাঁদ হেলে। চাঁদের মরা আলোয় আলুলায়িত কেশ এক রমণীকে অলৌকিক দেখায়। থ্যাঁতলানো সাপ নিস্তেজ হয়ে উঠোনে পড়ে থাকে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *