অনুভা নাথ
চারিদিকে ধূ ধূ সাদা। যেন মনে হচ্ছে, এক লহমায় কেউ শুষে নিয়েছে পৃথিবীর অন্য সমস্ত রং। কিছু সামান্য ক্ষয়াটে ধূসর গাছ সেই তীব্র ঠান্ডার মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার অসম চেষ্টা করে চলেছে। আন্দ্রেই তার মাথার ওপর ভারী হেলমেটটি সরিয়ে ঢাউস চশমার ওপার থেকে চোখ কুঁচকে সামনে দেখার চেষ্টা করল।
কিছুক্ষণ আগেই তাদের বাহিনী ভ্যাকুয়াম বোম্ব ব্যবহার করে ইউক্রেনের এই শহরটাকে ছেঁড়া কাঁথার মতো বানিয়ে ফেলেছে। আন্দ্রেই তার অভ্যস্ত পায়ে বন্দুক হাতে দশ ইঞ্চি পুরু বরফের ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগল। বাঁদিকে ওই কাঁটা ঝোপটার আড়ালে কী একটা যেন নড়ছে। তীব্র তুষারপাতের মধ্যে আন্দ্রেই দেখল ঝোপের পেছনের সাদা চাদরের বরফে টাটকা চাপ চাপ রক্ত। একটু দূরেই মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা ইউক্রেনিয় সেনাকে দেখা গেল। আন্দ্রেই নিজের চোয়াল শক্ত করে সামনে এগিয়ে গেল। কুড়ি-পঁচিশ বছরের তরুণ, তার ডান হাতে তখনও বন্দুক ধরা আর বাঁ হাতে ধরা মোবাইল। ছেলেটির চোখে মৃত্যুর ভয়ের থেকেও প্রকট হয়ে উঠছে অন্য কোনও ব্যথা। সে মৃদুস্বরে শেষবারের মতো “মা” শব্দটি উচ্চারণ করল, তারপরই তার দেহটি নিথর হয়ে গেল। আন্দ্রেই একমুহূর্ত চুপ করে দাঁড়াল তারপর তরুণ সৈন্যের মোবাইলটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিজের আস্তানায় ফিরে এল।
“ইভান, আমি পোল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছে গেছি, হে ঈশ্বর,আমার হাঁটার ক্ষমতা নেই। তুমি নিজের যত্ন নিও। আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।”
“মা, তুমি সাবধানে থাকবে, আমি ভাল আছি। হসপিটালে তুমি খুব দ্রুত সেরে উঠবে। আমরা আবার ক্রিসমাসে খুব আনন্দ করব। পরম করুণাময় ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করবেন।”
“মা, জানো, রাশিয়ার সৈন্যদের আমাদের মতোই দেখতে, অনেক সময় ওরা আর আমরা একই রকম করে কথাও বলি। ইউনিফর্ম ছাড়া ওদের দেখলে তুমি বুঝতেও পারবে না ওরা বিদেশী।”
মৃত ইউক্রেনিয় তরুণ সৈন্যের হোয়াটস্ অ্যাপ মেসেজে তার মায়ের সঙ্গে টুকরো কথাগুলো আন্দ্রেই এর সেনা ছাউনির সকলেই পড়ল।
আন্দ্রেই এর যুদ্ধক্লান্ত চোখদুটো নিজের অজান্তেই ভরে উঠল নোনতা জলে। তারা ঠিক করল, বৃদ্ধাকে তারা তাঁর মৃত ছেলের হয়ে উত্তর দেবেন।
সুদূর, পোল্যান্ডের কোনও এক শহরের হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অসুস্থ, বিদ্ধস্ত বৃদ্ধা তাঁর ষাট বছরের কুঁচকে যাওয়া দুহাতের চামড়ার মধ্যে সেলফোনটি ধরে ছেলের মেসেজের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর ছানি পড়া দু’চোখ ছাপিয়ে নেমে আসছিল কান্না।
একসময় সিস্টার এসে ওঁকে জিজ্ঞেস করলেন
-একি, আপনি কাঁদছেন কেন?
বৃদ্ধা অশক্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন
-আমার ছেলে উত্তর দিয়েছে, সে ভাল আছে, চিন্তা করতে বারণ করেছে।
সিস্টার উজ্জ্বল হেসে বললেন
-আপনি তো গতকাল থেকে ছেলের খবর পাওয়া যাচ্ছিল না বলে চিন্তায় ছিলেন। এখন তো যোগাযোগ হল, তবে কাঁদছেন কেন?
বৃদ্ধা কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে সিস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সেই ফাঁকা দৃষ্টিতে কোনও যন্ত্রণা নেই, কষ্ট নেই, খেদ নেই। বৃদ্ধা তাঁর হাতে ধরা মোবাইলটি নিজের বুকের ওপর জড়িয়ে ধরে ধীর ধীর উত্তর দিলেন
– ইউক্রেনের ভাষায় মা কে “মাতে” বলা হয়। ইভান আমায় কখনও “মাতে” বলত না, ও সেই নামটাকে ছোট করে “মা” বলত। আর আমাকে ও সবসময় ক্যাপিটাল লেটারে লিখত।
সিস্টার বিস্ফারিত চোখে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-লিখত মানে?
বৃদ্ধা অশ্রুসজল চোখ ও কান্নায় ভেঙে পড়া কণ্ঠে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন
-ইভানের কী হয়েছে, যে উত্তর দিচ্ছে সে কে আমি জানি না, জিজ্ঞেসও করব না তাকে। সে একজন মাকে স্বান্তনা দিতে চায়,এটাই তার স্বান্ত্বনা হোক।
দিনের শেষ আলোয় সাদা বরফের মধ্যে দুটি যুদ্ধরত দেশ, রাশিয়ার আন্দ্রেই আর ইউক্রেনের ইভান যেন সেই চিরন্তন, শাশ্বত মাতৃত্বের কাছে এক হয়ে গেল। এত বিদ্বেষ, এত ধ্বংসের পরও একজন মা তাঁর সন্তানদের শুভকামনায় বুকে ক্রশ আঁকলেন, জয় হল মনুষ্যত্বের।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন