অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
সাগ্নিকের কখনও পুরুলিয়া আসা হয়নি। এই প্রথম সে শুষ্ক প্রকৃতির রুপ দেখছে। শাল সেগুনের বনে হারিয়ে যাচ্ছে সে। পলাশ আর শিমুলের পাতা দেখা যাচ্ছে না। গাছে গাছে মনে হচ্ছে আগুন লেগেছে। অবন্তিকা গাড়ি দাঁড় করিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। সাগ্নিকের ছবি তোলায় চিরকাল অনীহা। কিন্তু অবন্তিকার পাল্লায় পরে ছবি না তুলে উপায় নেই।
দূরে শিমুল গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে একটি অল্প বয়েসি মেয়ে হাত নাড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে সাগ্নিক অবাক হয়ে যায়। অবন্তিকাকে সাগ্নিক ঠেলা দেয় “ দেখো মেয়েটিকে ” ততক্ষনে মেয়েটি খুব কাছে চলে এসেছে গাড়ির। “বাবু তোরা কোথায় যাবি?” অবন্তিকা ইতস্তত করে বলে “এই সামনের জঙ্গলে একটা বাংলো আছে না !”
“অ তোরা বর বউ ওখানে থাকতে এসেছিস?” নতুন বিয়া করলি বুঝি?”
অবন্তিকা আর সাগ্নিক লিভ ইন করে। এই গ্রাম দেশে এই সম্পর্কটা একটু জটিল। এর থেকে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কই সহজ।
“বাবু তোরা ঝুমুর নাচ দেখবি? দেখলে জানাস। আমার বাড়ি ওই যে দূরে মাঠের মাঝে।” সাগ্নিক দেখল দূরে মাঠের মাঝে একটা মাটির বাড়ি দেখা যাচ্ছে। অবন্তিকা হেসে বলল “তোমার নামটা তো জানা হল না !”
“আমার নাম নাচনি মালতী। এই তল্লাটে সবাই জানে। আজ আসি গো, বেলা একটা বাজে। এখনো ভাত বসাইনি। আমার রসিক এখনি মদ গিলে আসবে। ভাত না পেলে লাথালাথি করবে। আর ঘরে না পেলে ভাববে কারোর সঙ্গে আশনাই করছি। বাবু, কম পয়সায় নাচ দেখাব। কিছু টাকা দিয়ে বায়না করবি?”
অবন্তিকা নিজের ব্যাগ থেকে তিনশ টাকা বার করে দেয়। “আজকে সন্ধে বেলায় এসো বাংলোতে।”
“তার থেকে ভালো তোরা সন্ধেবেলায় এই মাঠে আসিস। আসবি?”
সাগ্নিক বলল – “আসব।”
বনবাংলোয় পৌঁছে দুজনেই প্রথমে হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। খিদেও পেয়েছিল দারুন। গরম ভাত, ডাল, বাঁধাকপির ঝোল আর দেশি মুরগির কষা। পেট ভরে খেয়ে দুজনে আদিম খেলায় লিপ্ত হল। শরীর মন শান্ত হলে ঘুমটাও ভালো হয়। কখন আলো ফুরিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে জানে না ওরা। দরজায় খুট করে আওয়াজ হতেই সাগ্নিকের ঘুম ভেঙেছে। কেউ যেন ফিসফিস করে ডাকছে। “বাবু, বাবু।”
দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল সাগ্নিক “ মালতি তুমি এখানে ?”
“দেখলাম তোরা এলি না। তাই আমি ডাকতে এলাম। নাচ দেখবি না? আমার রসিক বসে আছে। ও গাইবে। আমি নাচব। চল তাড়াতাড়ি। তোর বউটাকে উঠা দেখি।”
বনবাংলোর দারোয়ান ছুটে এসেছে “এই পাগলী তুই এখানে কেন? কতবার বলেছি না তুই এখানে আসবি না।”
মালতী হা হা করে হাসছে “আসব, একশবার আসব। বাবুদের নাচ দেখাব। শালা তোর কথা শুনব নাকি?”
মালতী দৌড়তে দৌড়তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
ততক্ষনে অবন্তিকাও উঠে বসেছে। বেশ ভয় পেয়েছে “কে হাসছিল ওরকম পাগলের মতো ?”
সাগ্নিক পুরো ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে দারোয়ানকে বলল “মালতী ওর নাম ! ঝুমুর নাচে বলল। ওই মাঠের ওদিকে ওর কুঁড়ে ঘর। আমাদের সঙ্গে আসার পথে আলাপ।”
দারোয়ান মাথা ঝাঁকাল। “হ্যাঁ বাবু ও মালতী নাচনি। খুব ভালো ঝুমুর নাচত। এই বনবাংলোয় কতবার এসে নাচ করে গেছে। মাত্র ষোল বছর বয়েসে রসিকের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিল। যদিও রসিক তার সংসার ছাড়েনি। রসিকের বউ বাচ্চা সব আছে।
মালতী তো আর বিয়ে করা বউ নয়। মালতী খুব ভালোবাসত তার রসিককে। রসিক গাইত, মালতী নাচত। সমাজ মালতীকে মেনে নেয়নি। সামাজিক মর্যাদা সেভাবে পায় না নাচনীরা। ওই মাঠের মাঝে কুঁড়ে ঘরে থাকত। মাঝে মাঝে রসিক মদ খেয়ে এসে ওকে মারধর করত। সন্দেহ করত। রাতদুপুরে ঝগড়া করত। কিন্তু মালতীর ভালোবাসা কমেনি তাতে। গতবছর রাস্তার উপর রসিকের লাশ পাওয়া গেল। কারা যেন খুন করে ফেলে গেছিল।”
দারোয়ানের দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল “জোয়ান মেয়ে। এই বয়েসে মরদ ছাড়া বুঝতেই পারছেন। সমাজ ঠাঁই দেবে না। কিন্তু যে যখন পারে ভোগ করে চলে যায়। রসিক মারা যাওয়ার পর থেকে মাথাটা গেছে। সন্ধে হলে আগুন জ্বেলে নিজেই গান গায় আর নাচে। ভাবে রসিক এসেছে। যখন যার দয়া হয় খাবার দেয়। রসিকের জন্যও রান্না করে ভাত বেড়ে বসে থাকে। পথে লোক দেখলে নাচ দেখাতে চায়। কপাল, সবই কপাল বাবু।”
অবন্তিকা আর সাগ্নিক চুপ করে বসে আছে। তাদের এখনও সামাজিক স্বীকৃতি জোটেনি। কিন্তু কেউ তাদের কিছু জিজ্ঞেস করে না। যেখানে দারিদ্রতা, অশিক্ষা সেখানেই কি সমাজ প্রভুর আসন পেতে চায়!
ফেরার দিন রাস্তার মাঝে হঠাৎ মালতী এসে হাজির। “ বাবু তিনশ টাকাটা ফেরত দিতে এলাম। তোরা তো নাচ দেখতে এলি না! টাকাটা নিয়ে যা।“
অবন্তিকা বলল “ তুমি টাকাটা রেখে দাও। ফেরত দিতে হবে না।”
“না।” টাকাটা ছুঁড়ে নাচনি দৌড়োতে লাগল। বসন্তের হাওয়ায় ভেসে আসছে মিষ্টি ঝুমুরের অজানা সুর।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন