micro-story-nirbandhab

নির্বান্ধব
মারিয়া সালাম

ঘড়ির কাঁটা ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় এসে থেমে যায়। একবেণী, খয়েরি কূর্তি গায়ে তরুণী ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে লাশকাটা ঘরের দিকে। সেখানে হাতুড়ি, বাটালির ঠুকঠুক শব্দ, মাথার খুলি আলগা করার শব্দ। মেয়েটা মনে মনে বলে, আস্তে, আস্তে।

তারপর, পার হয়ে যায় বিশটা বছর। অনুভূতিগুলো কেবলই ম্লান হয়ে আসে, রয়ে যায় হাতের কাছে সেলাই খুলে যাওয়া খয়েরি কূর্তি, রংজ্বলা সালোয়ার, রক্তের দাগ লাগা কুঁচকানো ওড়না আর বন্ধ ঘড়ির কাঁটা।

ফেসবুকে স্টেটাস লিখেই রুহী আয়নার সামনে দাঁড়ালো। হাতের পিঠ দিয়ে অশ্রুবিন্দুগুলো দ্রুত মুছে নিয়ে নিজেকে ভালো করে দেখল একবার।

এই বিশ বছরে কতকিছু পাল্টে গেছে, রুহীর জীবনটাই পাল্টে গেল। অথচ, এই খয়েরি কূর্তি আর একবেণী চুলে রুহীকে এখনও কিশোরীদের মতো দেখায়। যত্ন করে চোখে কাজল পরে নিজেকে আবার দেখে নিল রুহী, ঠিক খালিদের পছন্দের সাজ।

ড্রয়ার খুলে গোল্ডেন ঘড়িটা বের করে আনল কাঁপা কাঁপা হাতে। এখন বিকাল পাঁচটা, কিন্তু হাতের ঘড়িতে বাজে ছ’টা। বিশ বছর আগে আজকের দিনেই ঠিক ছ’টার সময় এ ঘড়ির কাঁটা থামিয়ে দিয়েছিল রুহী, তারপর বিশ বছর এমনই রয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা, বন্ধ।

আজ খালিদের মৃত্যুদিন। আজকের দিনে রুহী খালিদকে হারিয়েছিল। আজ ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর, আজ একটা বিশেষ দিন ছিল, ওদের বাগদানের দিন।

খালিদের প্রিয় রং খয়েরি। রুহীকে খয়েরি কূর্তিটা খালিদই দিয়েছিল আজকের দিনে যেন ও এটা পরে। কূর্তি পরে, হাতে খালিদের দেয়া ঘড়ি পরে রুহী অপেক্ষা করেছিল, খালিদ আর আসে নি। ততক্ষণে হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরে এসে গিয়েছিল খালিদের মৃতদেহ।

ওড়নাটা মাথায় ফেলে রুহী বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। সামনের রিকসাওয়ালাকে হাত নেড়ে বলল, টিকাপাড়া কবরস্থান।

রিকসায় উঠতেই তারেকের ফোন। তারেক ইদানীং রুহীর ফোনে কি একটা অ্যাপ সেট করে রেখেছে, রুহী বাসার বাইরে পা রাখলেই সে টের পেয়ে সাথে সাথেই কল করে।

তারেকের এসব খবরদারি আর ভালো লাগে না রুহীর। ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছে আজ দুইমাস হচ্ছে। এই দুইমাসেই ছোটখাটো সব বিষয়ে তারেকের খবরদারিতে রুহীর দম বন্ধ হয়ে আসে।

মাঝে মাঝে রেগে যাতা বলতে ইচ্ছা হয় রুহীর। বাড়ির লোকের দিকে তাকিয়ে কিছু বলে না রুহী। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাড়ির লোকেরা আটত্রিশ বছরের রুহীর জন্য তাদের ভাষায় একটা যোগ্য পাত্র জোগাড় করেছে, যে অতীতের কথা না ধরে রেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছে। অতএব, রুহীকে সব সহ্য করে নিয়েই চলতে হবে।

বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করতেই তারেকের রাগী রাগী স্বর টের পেল রুহী, কি অবস্থা ?

এইতো

তুমি কই?

একটু বাইরে যাচ্ছি

ও, বাইরে মানে কোথায়? কার সাথে? আর, ফেসবুকে এসব কি লিখেছ? প্লিজ এখনই ডিলিট
কর বা অনলি মি কর।

মানে?

মানে বোঝ না? আমি যদি আমার কোন এক্সকে নিয়ে লিখি তোমার ভালো লাগবে? তাছাড়া, আমার কত পরিচিতরা আছে তোমার ফেসবুকে, তারা কি ভাববে?

আচ্ছা, তোমার মনে হচ্ছে না যে তুমি সব বিষয় এক করে ফেলছ? অন্য কোন এক্স আর একজন মৃত মানুষকে নিয়ে লেখা কি এক? আর, পরিচিতরা কমবেশি সবাই জানে খালিদের বিষয়ে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

আমি এতকিছু বুঝি না, তুমি হয় এটা রিমুভ কর, না হলে আমিই তোমাকে ফেসবুকে ব্লকলিস্টে দিচ্ছি।

ফোন কেটে যেতেই রুহী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্থির হাতে ফেসবুকে ঢুকে চোখ বন্ধ করে নিজের মনে ভাবল কিছুক্ষণ।

তারপর, তারেকের প্রোফাইলে গিয়ে ওকে ব্লক লিস্টে ফেলে লম্বা একটা শ্বাস নিল। শেষ বিকেলের আলো কেটে কেটে ওর রিকসা ছুটে চলল কবরস্থানের দিকে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *