পার্থ দে
“মা, তোমার সঙ্গে কথা ছিল,” বেতের দোলনাটায় দুলতে দুলতে শ্রেয়া অর্থপূর্ণ চোখে তাকালো প্রমিতার দিকে।
বারান্দার বাইরে লবণহ্রদের বৃষ্টিভেজা গাছপালা আর নির্জন রাস্তাঘাট। সামনের রাস্তায় তাঁর তেরো বছরের নাতি আর্চি সাইকেল চালাচ্ছে। হাতের মোবাইল স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে প্রমিতা একবার অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকালেন। পরক্ষণেই মোবাইলের ক্যান্ডি ক্রাশ গেমে মনোনিবেশ করলেন।
শ্রেয়া বিরক্ত হয়ে বলল, “উফ, মা, আর য়ু লিসনিং? আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই তোমাকে জানাতে চাই।”
প্রমিতা জানেন তাঁর মেয়ে বরাবর এভাবেই কথা বলে। সে কোনো আলোচনার ধার ধারে না। কোনো বড় সিদ্ধান্তের সামনে এসে দাঁড়ালে এভাবেই তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ডেকে তার সিদ্ধান্তটুকু শুধু জানিয়ে দেয়। জেদি মেয়ের মুখের উপর মা-বাবা হিসেবে প্রমিতা বা সুবিনয় কোনোদিনই কিছু বলতে পারেননি। উচ্চমাধ্যমিকের পর বিজ্ঞান শাখা ছেড়ে কলা বিভাগ পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে এভাবেই জানিয়েছিল। তারপর স্নাতকোত্তর শেষ করে শ্রেয়া ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর বসার ঘরে তাঁকে ডেকে সহপাঠী অমর্ত্যকে বিয়ে করার কথা ঘোষণা করেছিল। সেদিন প্রমিতা আপত্তি করেননি, আপত্তি করার কারণও ছিল না।
“দিদুন, সাচ আ রোম্যান্টিক ওয়েদার, চলো তোমাকে আমার সাইকেলে চাপিয়ে ঘুরিয়ে আনি,” সামনের বৃষ্টিস্নাত রাস্তা থেকে আর্চি হাঁক পাড়লো। ওর মুখে ঝকঝকে হাসি। সুবিনয় এমন করে হাসতো, সেদিকে তাকিয়ে প্রমিতার বুকটা ভরে উঠল। তিনি মোবাইল স্ক্রিনে একসারি কমলা জেলির ক্যান্ডি ভেঙে দিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, “আমি আসছি সোনা!”
“মা, ইউ আর ইনকরিজিবল! স্টিল প্লেয়িং ক্যান্ডি ক্রাশ!” দোলনায় বসা শ্রেয়া চুল ঝাঁকিয়ে বলল, “এনিওয়ে, আমার যা জানানোর, জানিয়ে দিচ্ছি! আয়াম গেটিং ডিভোর্সড। অমর্ত্যকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি।”
প্রমিতা এবারও কোনো উত্তর দিলেন না। মোবাইল স্ক্রিন থেকে মুখ তুললেন না। তাঁর কানের কাছে পাগলা ঘন্টির মতো সমানে বেজে চলেছে শব্দটা— গেটিং ডিভোর্সড! বিবাহবিচ্ছেদ! বিচ্ছেদ যে কি কষ্টের তিনি জানেন। তাঁর এই কন্যাটি এত নির্মম, এত নির্মোহ, এত নির্দয়— সে আসলে বোঝে না বিচ্ছেদ কী বস্তু! শ্রেয়ার বয়স এখন তেতাল্লিশ, বিয়ে হয়েছে মাত্র পনেরো বছর, স্বামী সন্তানে ভরা সংসার, অথচ এখনই…
তিনি জানেন বিচ্ছেদ কী জিনিস, বিচ্ছেদ কী বেদনাময়!
তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়সে ‘গেম ওভার’ হয়ে গিয়েছিল। সেই খেলা-শেষের অনুভূতি যে কি বেদনাময় তিনিই জানেন। আজ সাতষট্টিতে পৌঁছেও তিনি সেই বেদনা বয়ে বেড়ান। ঘরের আনাচেকানাচে সুবিনয়ের গন্ধ। তাঁর জামাকাপড়, বইপত্র, কলম-চশমা, ফেলে-যাওয়া স্মৃতিতে শুধু সুবিনয় আর সুবিনয়! প্রমিতার মাথার মধ্যে পাগলা ঘন্টি বাজছে। বেজেই চলেছে! তিনি বিড়বিড়িয়ে নীরেন চক্কোত্তির কবিতার পংক্তি আউড়ান, ‘তবু ডাকি। আজও ডাকি। আসবে না জেনেও তাকে ডাকি।’
প্রমিতা তাঁর ক্যান্ডি ক্রাশের বন্ধু অমর্ত্যকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করলেন, “অমু, লেভেল ফিফটিনটা একটু সামলে খেলো। ভয় নেই, আর্চি আর আমি তোমার সঙ্গে আছি।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন