কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
অনেকদিন ধরেই মনের মধ্যে ইচ্ছে ছিল যে সুন্দরবনে বেড়াতে যাব। কত লোক কী সুন্দর ওখানে বেড়াতে যায়, সমুদ্রের মধ্যে স্টীমারে করে ঘোরে, বনজঙ্গল দেখে, নানা জীবজন্তুর দেখা পায়; এমনকি শুনেছি, ভাগ্যে থাকলে সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও দেখতে পায় কেউ কেউ।
তা আমারও সেইরকম সাধ হয়েছিল সুন্দরবনে যাবার। কিন্তু কী করে যাব? একা একা তো আর যেতে পারব না। কারও সঙ্গ ধরতে হবে। বন্ধুবান্ধবদের একে তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কেউ আমার সঙ্গে যেতে রাজি আছে কিনা। কিন্তু সবাই এত ব্যস্ত যে কেউ যেতে রাজি হচ্ছিল না।
এমন সময় একদিন আমারই এক আত্মীয় আমাকে পরামর্শ দিলেন, “তুমি এক কাজ করো, যেসব ট্যুর কোম্পানি সুন্দরবনে বেড়াতে নিয়ে যায়, তাদের সঙ্গে ঝুলে পড়ো। তারাই তোমাকে সুন্দরবন ঘুরিয়ে আনবে।”
শুনে খুব মনে ধরল কথাটা। পরের দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন খবরের কাগজ আর পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে কয়েকটা ট্যুর কোম্পানির ফোন নম্বর যোগাড় করে ফোন করতে লাগলাম। এই করতে করতে একটা কোম্পানি থেকে জানতে পারলাম, তারা পরের সপ্তাহেই সুন্দরবনে যাবার বন্দোবস্ত করছে। জায়গাও খালি আছে।
ব্যস, আর আমায় পায় কে? সঙ্গে সঙ্গে বুকিং করে দিলাম, আর প্রস্তুতি নিয়ে পরের সপ্তাহেই বেরিয়ে পড়লাম তাদের সঙ্গে।
ধর্মতলা থেকে বাসে করে গড়খালি। সেখান থেকে ট্যুর কোম্পানির লঞ্চ ধরলাম। লঞ্চটা বেশ বড়োসড়ো। প্রায় চল্লিশজন একসঙ্গে যাচ্ছি। খুব মজা হচ্ছে। জঙ্গল দেখছি, মাঝে মাঝে নদীর ধারে ছোটখাটো নানা জীবজন্তু আর কুমিরও চোখে পড়ছে। কিন্তু বাঘ কই?
সেদিনটা কেটে গেল। রাত্রে লঞ্চেই শোয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু ঘুম আর আসে না। আমাদের লঞ্চটা ছিল একটা খালের মধ্যে। সেখানে জল খেতে আসা জানোয়ারের ডাকে চমকে চমকে উঠছি। তারপর মাঝরাতে হঠাৎ এক ভয়ংকর ডাক শুনতে পেলাম। লঞ্চের সারেং বলল, “খুব সাবধান। বাঘ এসেছে জল খেতে। কেউ কোনও শব্দ করবেন না। বাঘটা সাঁতরে চলে আসতে পারে। এসে লঞ্চ থেকে মানুষ তুলে নিয়ে চলে যাবে।”
ভয়ে সবাই আধমরা হয়ে নিঃসাড়ে পড়ে রইলাম যে যেখানে ছিলাম। তবে তার মধ্যেও আমি মনে মনে ভাবছিলাম, কাল সকালে আমি খালের পাড়ে যাব। এই বাঘটার সঙ্গে আমায় দেখা করতেই হবে।
সকালে ঘুম ভাঙার পর উঠে জলখাবার খেয়ে আমাদের গাইডকে বললাম আমার মনের ইচ্ছা। সে তো শুনেই আঁতকে উঠল। বাকি সকলেই বারবার বারণ করতে লাগল। কিন্তু আমি কারও নিষেধ শুনলাম না। একটা ছোট নৌকোয় করে তীরে গিয়ে উঠলাম। তারপর সাবধানে জঙ্গলে ঢুকতে লাগলাম।
যাচ্ছি, যাচ্ছি। গরান, গেঁওয়া, সুন্দরী গাছের বাহার। নানারকম পাখির ডাক। হঠাৎ ঘ্রাউম করে এক বিকট গর্জন। বনের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল মস্ত একটা বাঘ। দেখেই বুঝতে পারলাম, এই সেই বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। কী সুন্দর দেখতে ! তবে সত্যি বলছি, একটুও ভয় পাইনি।
বাঘটা আবার একটা গর্জন ছেড়ে বললে, “এইবারে তোকে বাগে পেয়েছি।”
আমি কঁকিয়ে উঠে বললাম, “বাগে না বাঘে ?”
বাঘটা বোধহয় ঠিক ধরতে পারল না কথাটা। বিরাট এক হাঁ করে বলল, “ওসব চালাকির কথা বলে পার পাবি না। আজ আমি জমিয়ে তোর মাংস খাব।”
শুনে তো ভয়েই হাত পা ঠান্ডা। তবু কোনরকমে জিজ্ঞেস করলাম, “তা পেমেন্ট কীভাবে হবে? ক্যাশে না পেটিএমে?”
এইবার বোধহয় একটু ঘাবড়ে গেল বাঘটা। বলল, “মানে?”
বললাম, “মানে ক্যাশ তো নিশ্চয়ই সঙ্গে নেই। তা মোবাইল আছে কি? আর পেটিএম অ্যাকাউন্ট? নাহলেও অন্তত ক্রেডিট কার্ডটা আছে তো? তাহলে অন্তত ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার করা যাবে। নইলে কিন্তু খুব মুশকিল।”
ব্যস্, সেই শুনে কাঁচুমাচু মুখ করে বাঘটা সেই যে পগারপার হয়ে গেল, আর তার লেজের ডগাটাও দেখা গেল না। তারপর অনেক খুঁজলাম। বনের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মেরে বারবার দেখার চেষ্টা করলাম যে, গেল কোথায় বাঘটা? কিন্তু নাঃ, তার আর পাত্তাই নেই!
অগত্যা আবার খালের ধারে ফিরে এসে দলের সঙ্গে যোগ দিলাম। তারপর লঞ্চে করে ফিরে এলাম কলকাতায়।
আসতে আসতে ভাবছিলাম, আহা রে! আধুনিক জীবনের হালচাল কিছুই জানা নেই বাঘটার। হবেই তো, জঙ্গলে থাকে কিনা! ও বেচারা কী করে আর জানবে যে এখন কোনকিছু পেতে গেলেই তার মূল্য দিতে হয়! বিনা পয়সায় কিছুই পাওয়া যায় না!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন