রাখী আঢ্য
সরস্বতী পুজোয় সেজেগুজে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছিল নিধি। সিগন্যালে চোখ পড়তেই দম বন্ধ হয়ে এলো ওর। কে রাস্তা পার হয়? সৌম্যদা না? হ্যাঁ সৌম্যদাই। হাত তুলে ডাকতে গিয়েও হাতটা নামিয়ে ফেলে নিধি। আগেরবারের মতো সৌম্যদা যদি তাকে চিনেও না চেনার ভান করে তাহলে? সে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে তার কাছে।
-“এই নিধি কি হলো কি? রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?” সুপর্ণা চেঁচিয়ে ওঠে নিধির কানের কাছে। একটু অপ্রস্তুত হেসে জোর করেই যেন সপ্রতিভ হয়ে নিধি বললো, ‘কই কিছু হয়নি তো, চল এবার আমরা স্কুলে যাই।’ তখনই কাঁধের উপর একটা হাত, সেই পরিচিত, ভরাট
পুরুষালি গলায় জিজ্ঞাসা, ‘ নিধি কেমন আছিস?’
নিধির সারা শরীর জুড়ে এক মুহূর্তের জন্য যেন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল, এই গোটা পৃথিবীতে সময় যেন কয়েক লহমার জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।
-‘নিধি,কি হলো?’ সৌম্য নিধির কাঁধটা আর একবার ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো। একটু চমকে গিয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললো, সারা শরীরে এইবার যেন রক্ত প্রবাহ শুরু হলো। নিজের এই অবস্থা লুকোতেই যেন ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো, ‘ আরে সৌম্যদা না? কেমন আছো তুমি? কবে এলে দুর্গাপুর থেকে?’
-‘ গতকাল রাতে। তোরা এখন সবাই মিলে বাচ্চাদের মত সেজেগুজে স্কুলে ঠাকুর দেখতে চললি নাকি? এ বছর তো তোরা উচ্চ মাধ্যমিক দিবি, আর কবে বড় হবি?’ সৌম্য হাসতে হাসতে বললো।
নিধির মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। এই এক দোষ সৌম্যদার। তাকে এখনো বাচ্চাই মনে করে। কেন সে বুঝতে চায় না যবে থেকে সে ভালবেসেছে সৌম্যদাকে, সে যে বড় হয়ে গেছে। নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে বলে কি তাকে পুঁচকে ভাবতে হবে?
-‘ কিরে? তোকে বাচ্চা বললাম বলে রাগ করলি?’ সৌম্য হাসতে হাসতে বললো। তারপর একটু সিরিয়াস মুখ করে বলল,’ এখন তোরা ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিস যা তবে তোর সাথে আমার কথা আছে, তুই কখন ফ্রি থাকবি আমাকে জানাস।’
প্রেমকে আয়োজন করে আনা যায় না, তা অবাধ্য, অনাহুত অতিথির মতোই চলে আসে। আর সেই অতিথিই তখন সারা ত্রিভুবন জুড়ে থাকে। কোনদিকে তাকাবার অবসর দেয় না।
সৌম্যদার কাছ থেকে কথাগুলো শোনার পর থেকেই নিধির অবস্থা এমনই হয়েছিল। কখন যে স্কুলে গেলো, ঠাকুর দেখলো তার বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি মনে। শুধু এই চিন্তাই ছিল কোন সময়টা এমন হবে যখন তার সৌম্যদাকে ডাকা যায়। ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা হয়ে এলো, সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনির আওয়াজে যেন স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরলো। সময় যে লঘুপদে চলে যাচ্ছে। তাকে এবার তো জানাতেই হবে। ফোনটা বের করে কম্পিতহস্তে ডায়াল করলো ডায়েরিতে লিখে রাখা নম্বরগুলো।
আগেরবার ফোনে কথা বলার মুহূর্তটা চকিতের জন্য তার স্মৃতিতে এলো। কিছু ঘটনা, স্মৃতি, মান অভিমান…এইসব কথা মনের ভেতর ঘোরাঘুরি করতে করতেই সৌম্যদার গলা শোনা গেল, “হ্যালো”…
-“হ্যালো সৌম্যদা, আমি নিধি বলছি। তুমি আজ সন্ধ্যা সাতটায় আসতে পারবে? কি দরকার বলছিলে…”
কথা শেষ হবার আগেই সৌম্য উচ্ছ্বাসের সাথে বলে উঠলো, ” আরে নিধি তোর কাছে আমার ফোন নাম্বারটা ছিল সেটাই তো আমার মনে ছিল না। ফোনেই বলে দিচ্ছি। তোর দিদি সুরভীর সাথে আমাকে একবার যোগাযোগ করিয়ে দিবি? ও আমার উপর রাগ করে সমস্ত কন্টাক্ট বন্ধ করে বসে আছে| তুই ওকে গিয়ে প্লিজ একবার আমার কথা বল। হ্যালো, হ্যালো নিধি… শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা, হ্যালো…”
না, নিধি শুনতে পাচ্ছে না, দোতলার বারান্দা থেকে একবার নীচের দিকে তাকিয়ে রেলিংয়ের উপর উঠতে গিয়েও থমকে গেলো, কান্নার দমকে শরীর কেঁপে উঠল। ফিরে আসার আগে ফোনটা শুধু উপর থেকে ফেলে দিলো নীচে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন