নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। জলে ধোয়া লালমাটি দুর্গের পাথুরে নালা দিয়ে বয়ে চলেছে। শাহজাদা দানিয়েল ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে জ্বরের জন্য কিছুটা রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। অপার্থিব সুদর্শন সে। তার গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। সেই রং এতটাই উজ্জ্বল যে তার দেহের নীলাভ শিরা উপশিরার আভাস চামড়ার উপর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়। একজন বাঁদী তার সামান্য ফোলা পায়ের পাতা দুটিতে তেল মালিশ করে দিচ্ছে। শাহজাদার গায়ে সামান্য জ্বর আছে। এই জ্বর এখন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। সম্রাট আকবরের প্রিয় কনিষ্ঠপুত্র দানিয়েল এখন দাক্ষিণাত্যের শাসক। আকবরের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধযাত্রায় সঙ্গী হতে হয়েছিল দানিয়েলকে। যুদ্ধ দানিয়েলের অপছন্দ। সে কবিতা লিখতে ভালবাসে।
দানিয়েলের জন্ম আজমীর শরিফে, এক বিখ্যাত পীরের দরগায়। আর সে বেড়ে উঠেছে গুজরাটের এক হিন্দু রাজবাড়িতে। তার পিতা সম্রাট আকবর সে সময় যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। শিশু দানিয়েলকে পীরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত ও শুভ মনে করে তিনি যুদ্ধে সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেখেছিলেন তাঁর এক বন্ধু-স্থানীয় হিন্দু রাজবাড়িতে। সম্রাটের এক খাস দাসীর গর্ভে জন্মেছে দানিয়েল। দাসীটি ইরান থেকে এসেছিল। সে সুন্দরী এবং শিক্ষিতা। দিল্লীর দাসীর হাট থেকে তাকে কিনে আনেন আকবরের দরবারের এক আমীর এবং তারপর তিনি আকবরকে সেই দাসীটি ভেট পাঠান। অসামান্য সুন্দরী সেই নারী আকবরের মন জয় করে নেয়। আকবর এমন কিছু খাস দাসীকে নিকাহ্ করেছেন, তাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে। দাসীপুত্র হলেও দানিয়েল আকবরের খুব প্রিয়।
বিশেষত অলৌকিক শক্তিধারী পীরের দরগায় জন্ম হওয়া পুত্রের নামও তিনি দিয়েছিলেন পীরের নাম অনুযায়ী। দানিয়েল শেখ। আকবরের অনেক আশা তাঁর এই কনিষ্ঠ পুত্রটিকে নিয়ে। নানা কারণে উদ্ধত সেলিম ও মুরাদের সঙ্গে তাঁর আজকাল কিছুটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। খুব অল্প বয়স থেকেই আকবর তাঁর পুত্রদের মানসবদারের পদ দিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রত্যেকের অধীনে দুর্গ ও হাজার হাজার সৈন্য এবং একজন দুজন করে আমীর। দানিয়েলের অধীনে সাত হাজার সৈন্য ও আমীর আবদুর রহিম খান এ খানানকে নিযুক্ত করেছিলেন আকবর। তিনি কিছুটা দানিয়েলের অভিভাবকের মত সবসময় তার পাশে থাকবেন, এমনটাই ব্যবস্থা করে রেখেছেন আকবর।
যুদ্ধজয়ের পর থেকে প্রায় ছ’বছর একটানা এই আহম্মদনগর দুর্গে বাস করছে দানিয়েল। তাকে এখানকার প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়েছেন পিতা। দানিয়েলের তিনটি প্রিয় জিনিস হল ঘোড়া, বন্দুক ও সুরা। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে তার যকৃত এখন প্রায় অকেজো। শরীরের জোর ভয়ানক কমে গেছে, তবুও সুরাপানে তার এখনও রয়েছে তীব্র আসক্তি।
দানিয়েল উপুর হয়ে শুয়ে একটা পালকের কলম দিয়ে সাদা চামড়ার উপর ফারসিতে কবিতা লিখছে। সে এখন কয়েকটা হিন্দি লোকগীতি অনুবাদ করছে। কবিতা লিখতে লিখতে বিছানার উপর চোখ পড়ল তার। বিছানায় তাকিয়ার পাশেই আছে দানিয়েলের প্রিয় বন্দুকটা। তার নাম দানিয়েল দিয়েছে ‘ইয়াকা উ ঘনাজা।’ ফারসি এই কথার অর্থ হল ‘মৃতদেহের বাক্স’। শাহজাদা ক্ষীণ গলায় তার বন্ধু ফারসি কবি খাবুশানি’কে ডাকল। খাবুশানি পাশের ঘরেই ছিল। সে শাহজাদাকে অনুবাদে সহায়তা করছে।
কয়েকটা হিন্দি লোকগীতি ফারসিতে অনুবাদ করেছে দানিয়েল, কিন্তু সুরা ছাড়া কি কাব্যচর্চা চলে? গলা যে শুকিয়ে কাঠ! দানিয়েল হাততালি দিতেই, তার ক্রীতদাস মুর্শিদ এসে দাঁড়ালো। আকবরের হুকুমে দানিয়েলকে সুরা দেওয়া এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। দানিয়েল তাকে বলল, “যেখান থেকে পারো আমাকে সুরা এনে দাও! এই বন্দুকের নলে ভরে লুকিয়ে খানিকটা আনো, এখনই সুরা না খেলে আমি প্রাণে মারা যাব। তবে খবরদার! দেরি করলেই কিন্তু গর্দান যাবে।”
মুর্শিদ শাহজাদার ঘরের বাইরে এল। তাকে এখন খুব সাবধানে কাজ করতে হবে। আবদুর রহিম খানকে শাহী ফরমান দিয়েছেন সম্রাট, কিছুতেই যেন শাহজাদাকে একফোঁটাও সুরা দেওয়া না হয়। শাহজাদার ঘরের বাইরে গুপ্তচর আছে। তারা দিল্লিতে সরাসরি সম্রাটের কানে সেই কথা তুলবে। দুর্গে বসবাসকারী প্রায় সবাই সম্রাটের খাস লোকজন।
বাইরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টি হল আল্লার আশীর্বাদ। তবুও মুর্শিদ একেবারেই বৃষ্টি পছন্দ করে না। সে দুর্গের একটা খোলা অংশ থেকে হাত বাড়িয়ে বন্দুকের নলে খানিকটা বৃষ্টির জল ভরে নিল। তারপর খুব ভালো করে নেড়ে জলটুকু ফেলে দিল। এখন মদ পাবে কী করে সে? আবার বেশি দেরিও করা যাবে না। দুর্গের বাইরের দিকে দিল্লি থেকে আনা ক্রীতদাসদের একটা দল বসে বসে তাস খেলছে। এদের হুকুম করার লোক এখন অনুপস্থিত। কারণ, আবদুর রহিম খান এখন দিল্লিতে গেছেন।
মুর্শিদ দাসদের কাছ থেকে বহুকষ্টে খানিকটা সুরা সংগ্রহ করলো। কিছুতেই কেউ দিতে চায় না, সবারই তো প্রাণের ভয় আছে! সম্রাটের নিষেধ মোটামুটি এখানে সবারই জানা। এবার বন্দুকের বারুদ পরিষ্কার করে নিয়ে তাতেই লুকিয়ে সুরা ভরে নিল সে। শাহজাদার ঘরের বাইরের পাহারারদারেরা একমাত্র শাহজাদার বন্দুকে হাত দেবে না। শাহজাদাও তাই বন্দুকের ভেতরই মদ আনতে বলেছিলেন তাকে। কিছুটা বারুদ ও লোহার মরচে বন্দুকে থেকে গেল, মুর্শিদ তাড়াতাড়িতে সেটা আর পরিষ্কার করতে পারল না। সেদিন বিষাক্ত মদটুকু খাবার পরেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন শাহজাদা। দুদিন পরে বত্রিশ বছর বয়সে শাহজাদা দানিয়েলের মৃত্যু হল। মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিণতি হল মুর্শিদের। তার উভয় সঙ্কটের কথা কেউ বুঝল না। দানিয়েলের হুকুম তামিল না করলেও তার নিস্তার ছিল না, আবার অন্যদিকে ছিল সম্রাটের আদেশ। আবদুর রহিম খানের নির্দেশে, দিল্লির রাস্তায় মুর্শিদের জীবন্ত শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে হত্যা করা হল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন