তৃষ্ণা বসাক
মুনাই টলমল পায়ে সদর দরজায় এসে দাঁড়াল। সে যে বাইরে এসেছে কেউ খেয়াল করেনি। সুযোগ পেলেই সে এখানটায় এসে দাঁড়ায়, রাস্তা দিয়ে যত লোক যায়, সবাইকে হাত নেড়ে ডাকে। বিজয়া বলেন কোনদিন কে এসে তুলে নিয়ে যাবে। বড় ছেলেমেয়েগুলোকে বলেন ওর ওপর নজর রাখতে, যথাসম্ভব চেষ্টাও করে তারা, কিন্তু কোন ফাঁকে সে বেরিয়ে যায় কে জানে। শুধু যদি গিয়ে বাইরের পইঠেয় বসে থাকত, তাও হত। সে যাবে আর রাজ্যের লোককে ডাকাডাকি করবে। অন্য দিনের তুলনায় হাটবারে এ রাস্তায় লোক চলাচল বেশি। বুধ আর শুক্র হাট বসে রাজারামপুরে। এত বড় হাট আশেপাশের গাঁয়ে বসে না, তাই চারপাঁচখানা গাঁ ভেঙে আসে লোকে। বারাদ্রোণ, একতারা, বেড়ান্দরী। হাটে কতরকম জিনিস, বিশেষ করে এ হাটের গামছার খুব নাম। আর সবচেয়ে ভালো লাগে চুড়ো করে সাজানো ডাল আর নানা শস্যবীজ দেখতে। সিমের বীজ, কুমড়োবীজ। অন্যপাশে মাছের পসরায় গোলগোল থলথলে মতো কী সব। ওগুলো নাকি কচ্ছপের ডিম। একবার মানিনীমাসী নিয়ে গেছিল মুনাইকে কোলে করে। মুনাই তার কোল থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে দেখতে বলে উঠেছিল ‘দে দে কাবো কাবো’ মানিনীমাসী তাকে রাখতেই পারে না, কোনরকমে একঠোঙা কটকটি কিনে হাতে দিয়ে ভুলিয়েছিল। তারপর বাড়িতে এনে বাইরের পইঠেয় বসিয়ে বলেছিল ‘নোনোকে নে আর ঝদি কোনদিন যাই! বামুনের ঘরের মেয়ে, বলে কি না কচ্ছপের ডিম খাবে! মাগো!’
বিজয়া শুনে ঠোঁট শক্ত করে বলেছিলেন ‘শিশু নারায়ণ! ও কি বুঝে বলেছে। তুমি বা ওকে হাটের ভিড়ে নিয়ে গেলে কোন সাহসে? কতবার বলেছি আমাকে না বলে বাচ্চাদের কোথাও নিয়ে যাবে না।’
সেই থেকে মানিনীমাসী আর মুনাইকে সহজে কোথাও নিয়ে যায় না। মুনাই হাজার কান্নাকাটি করলেও সে শক্ত মুখে বলে ‘বাব্বা আর ঝাই! ঝা খাণ্ডার মা। ছেলেপিলেকে যেন মুটোয় পুরে রেকেচে। এ গেরামে তোমার মার মতো যদি মা দেকেছি।’ মুনাইয়ের বয়স এখনও পাঁচ হয়নি, তাই মানিনীমাসীর কথাগুলো সে ভালো বুঝতে পারে না। তবে এটুকু বুঝতে পারে মাকে মানিনীমাসী পছন্দ করে না। মুনাই ভাবে সেও তো পছন্দ করে না মাকে। খালি এটা খেও না, ওখানে যেও না, কেন ইজের পরোনি, কেন চুল আঁচড়ানো নেই, কেন ধুলো ঘাঁটছ সারাদিন? তার খুব কান্না পায় হঠাৎ। বড়দির ফিরতে কত দেরি হচ্ছে! বড়দি ছাড়া তাকে কেউ ভালবাসে না এই বাড়িতে। বড়দি এসেই তাকে কোলে তুলে নেবে, হাত পা ধুইয়ে পরিষ্কার জামা পরিয়ে দেবে, মুখে পাউডার মাখিয়ে কাজল পরাবে, চুল আঁচড়িয়ে টেনে বেঁধে দেবে, দুটো বিনুনি, বিনুনির নিচে লাল ফিতে দিয়ে আবার ফুল করা। বড়দি পারেও কত কী! কী সুন্দর লাল ফিতে পাটে পাটে ভাঁজ করে গোলাপ ফুল বানাতে পারে। মা পারে কিছু? ছাই পারে। যখনই দেখো উনুনের ধারে বসে বাবার জন্যে পরোটা বেলছে। কেন, মুনাইয়ের কি পরোটা খেতে ইচ্ছে করে না? খুব করে। পরোটা চাইলে মা খালি দুধ ভাত খেতে দেবে। বলবে, পরে নাকি কেউ দুধ খেতে দেবে না। যত বাজে কথা। বেশি রেগে গেলে আবার ঠোঁট টিপে বলবে ‘অধিক সন্তানের জননী হওয়া কী যে পাপ’ এর মানে দিদিকে জিগ্যেস করেছিল মুনাই। দিদি বলেছে তারা অনেকগুলো ভাইবোন মাকে দিনরাত জ্বালায়, তাই মা দুঃখে এই কথা বলেছে।
মুনাই চোখ মুছতে মুছতে দেখল বড়দি আসছে হাটের পুকুরঘাটের পাশ দিয়ে। তার ছোট্ট বুকটা আনন্দে ছটফট করে উঠল, তার ইচ্ছে করল এক ছুটে বড়দির কাছে চলে যায়, এই রাস্তাটুকু বড়দির কোলে চড়ে আসে। সবাই দেখুক সে বড়দির কোলে চড়ে আসছে। মা তো তাকে কোলে নেয় না, রাত্তিরে কোল ঘেঁষে শুতে গেলে কেবল বলে ‘একটু শুতে দে, আর পারি না এদের জ্বালায়! সারাদিন তোদের জন্যে খেটে খেটে হাড়মাস কালি করব, আবার রাতের ঘুমটুকুও পাব না!’ চাই না অমন মা! ঠোঁট ফুলিয়ে ভাবল মুনাই। তার তো বড়দি আছে, রাতে এখন থেকে সে বড়দির কাছেই শোবে। বড়দি সারাদিন থাকলে তার কত ভালো। বড়দি স্নান করায়, খাওয়ায়, সাজিয়ে দ্যায়, বিকেলে খাদি মন্দিরে বেড়াতে নিয়ে যায়, আর কত গান শোনায়, বড়দির গানের রেশ সারাদিন তার সঙ্গে থাকে।
বড়দির মতো গুছিয়ে কাজ কেউ পারে না। সকালে তাড়াহুড়ো করে বড়দি মাখম, ডিম সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, ভাত খেয়ে চলে যায়, তখন তাকেও খাইয়ে দ্যায়।
মুনাই ছুটে গেল বড়দির কোলে উঠবে বলে। দেবীও ছুটে এল ভয় পেয়ে। এই রাস্তায় বড় গাড়ি চলে না ঠিকই, কিন্তু একটা জোরে চলা সাইকেল বা ভ্যানের সামনে পড়লেই তো গেল! ছোট্ট মানুষ, টাল সামলাতে পারবে না, আর রাস্তার যা ছিরি, বাসরাস্তার মতো পিচের রাস্তা তো নয়, খোয়া ওঠা, একবার পড়লেই হাঁটুর নুন ছাল উঠে যাবে।
মুনাইকে কোলে তুলে দেবী অন্যমনস্ক হয়ে যায়। এই রাস্তায়ও তো গাড়ি আসত, একটা না অনেকগুলো, শুটিং হত, মাধু মানে মাধুরী সাহা, নায়িকা, সেটা যে তার প্রথম ছবি বোঝাই যায়নি, পাহাড়ী স্যান্যালের সঙ্গে সমানে সমানে অভিনয় করে গেছে। ওই একটা সিনেমা সে দেখেছিল টকি হাউসে গিয়ে। একটা লোক এসে অনেকগুলো পাস দিয়ে গিয়েছিল। সেই তার প্রথম সিনেমা দেখা। সত্যি বলতে কি, সেই শেষ সিনেমাও হলে গিয়ে। তারপর মাঝে মাঝে ইস্কুল মাঠে পর্দা টাঙিয়ে যে সিনেমা দেখানো হয়, সেখানে দু’একবার দেখেছে সে। লব কুশ, বিল্বমঙ্গল। সেসব কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগে দেখতে।
‘সুরের ভুবন’ সিনেমাটা যে খুব ভালো হবে, তা শুটিং দেখেই বোঝা গেছিল। গ্রামের লোক ভেঙে পড়ত শুটিং দেখতে। তারা মাধুর অভিনয় দেখে ফিসফিসিয়ে বলত ‘হবে না, বাঙাল মেয়ে তো, ওরা হচ্ছে জার্মানের জাত’। ইতিহাস বইতে জার্মানদের কথা পড়েছে দেবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইহুদি নিধন। লোকে কেন বাঙালদের জার্মান বলে কে জানে? ওরা তো ইহুদি। যারা বারবার দেশ হারায়। দেশ হারা, ভিটে ছাড়া বলেই তো অত জেদ কিছু করে দেখানোর। তার মতো মা আর ঠাকুমার রাঁধা গরম ভাত ঘি দুবেলা খেয়ে কিছু করা যায় কি? কিচ্ছু হবে না তার। কিচ্ছু না।
মায়ের জেদে এ গ্রামে মেয়েদের স্কুল খুলেছিল। মায়ের জেদ আর শ্যামাপিসির অক্লান্ত চেষ্টায়। সেই স্কুলের প্রথম ছাত্রী ছিল পাঁচ জন। দেবী, পাশের গাঁ কঙ্কপুকুরের কাঁড়ারদের তিনটে মেয়ে, আর যতীন হালদারের বোন জবা হালদার। সেই স্কুল ক্লাস এইটের বেশি বাড়ানো গেল না কিছুতেই। পড়াই বন্ধ হয়ে যেত দেবীর। আবার সেই মায়ের জেদ। দেবী ক্লাস এইটে হাজিপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি হল। সেই শুরু তার বাসে যাতায়াত।
প্রতিবার যখনই সঙ্কট এসেছে, মা এমন বিপত্তারিণী হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দেবী টের পায়, মাও আস্তে আস্তে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, তার জীবনের আশা যেন নিভে আসছে। হবে নাই বা কেন? এখন এই মুনাইকে নিয়ে তারা মোট নজন ভাইবোন। ক্রমাগত সন্তান ধারণ করতে করতে, সন্তানের জন্ম ও লালন করতে করতে ফুরিয়ে যাচ্ছেন বিজয়া। আর খাওয়া দাওয়াও তো সেভাবে পান না। তারা ন’ভাই বোন মিলেই সব খেয়ে নেয়, আর তাদের চেয়েও বেশি খায় মনে হয় বাবা। বাবা-অন্ত প্রাণ দেবীর কেমন মন খারাপ হয় ভাবলে। বাবা বরাবর সকালে উঠে চা দিয়ে মুড়ি আর মাখা সন্দেশ খায়, আর তখন ডেকে ডেকে তাদের ভাই বোনদের খাওয়ায়। কিন্তু সে কখনও দেখেনি মার জন্যে বাবা কিছু এনেছে আলাদা করে, বা বলেছে, এটা তোদের মা খেতে ভালবাসে।
মা বাবাকে ডাকে বড়বাবু, আপনি বলে। ‘বড়বাবু আপনি কি এখন চা খাবেন?’ ‘বড়বাবু এখন কি আপনার চানের জল বসাব?’ বাবা কিন্তু মার নাম ধরে ডাকে। বিজয়া। আর তুমি করে। অল্পই ডাকে, কিন্তু ডাকলে বিজয়া বলেই। দেবী ভাবে সম্পর্কটা আসলে কী? একজন উঠোনে দাঁড়িয়ে, আর একজন বারান্দায়?
মাধু বলেছিল, ওর বাবা নাকি কোথায় হারিয়ে গেছে। শাঁখারিটোলায় একটা সোনার দোকানে কাজ করত, এছাড়া সোনার দোকানের ধুলো ঝাঁট দিয়ে সোনা সংগ্রহ করত বছরের এক দিন। ঢাকায় দাঙ্গা লাগলে সে আর নাকি ফেরেনি। মা এক কাকার সঙ্গে তাকে নিয়ে অনেক ভাসতে ভাসতে এদেশে এসেছে। আহিরীটোলায় একটা ঘুপচি ঘরে থাকত তারা। মাধু তাকে চুপিচুপি বলেছে সেই কাকা নাকি রাতে তার মার সঙ্গেই শুত। একদিন বেলায় মা স্নানে গেলে তার বুকে হাত দিয়ে বলেছিল ‘গোলাপ তো ভালই ফুটসে’। মা এলে বলতে মা অমনি তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে, একটা মন্দিরে পড়ে থাকত তারা। সেখানে অজয় সরখেলের মা তাকে দেখে ছেলেকে বলে, ‘পরের সিনেমায় নিতে পারিস একে। উদবাস্তু মেয়ে, কিন্তু সুন্দর চেহারা।’
মুনাই বড়দির কোল থেকে ছটফটিয়ে নেমে এসে বলল ‘বড়দি, আমি একটা গান পারি, শুনবি?’ বলে সে দেবীর সম্মতির অপেক্ষা না করে কচি গলায় গাইতে শুরু করে-
‘ম্লান আলোকে ফুটলি কেন গোলকচাঁপা ফুল/ ভূষণহীনা বনদেবী কার হবি তুই দুল?’
দেবীর বুকে মৃদু ব্যথার মতো ঢুকে আসে গানটা। শুটিঙের শেষ দিনে এই গানটাই নন্দীদের পুকুরঘাটে বসে মাধুকে শুনিয়েছিল সে। সেইদিন পাহাড়ী স্যান্যালের শুটিং ছিল না। দেবী মনখারাপ করে ভেবেছিল আর কোনদিন মানুষটার সঙ্গে দেখা হল না তার। তখনি ঘাটের মাথায় এসে দঁড়িয়েছিলেন পাহাড়ী, তাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন চণ্ডীমণ্ডপে, সেখানে কাকে দিয়ে যেন একটা অদ্ভুত বাক্স মতো জিনিস আনিয়েছিলেন, তার মধ্যে চাপিয়েছিলেন একটা গোল চাকতি। অমনি তাদের রাজারামপুরের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল এক স্বর্গীয় সুরমূর্ছনা- ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে/ আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে।’
সেই অনুভূতির কথা ভাবলে আজো গায়ে কাঁটা দ্যায় দেবীর। লতা মঙ্গেশকর। খুব ছোটবেলায় গরিফায় এঁর একটা গান শুনে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরে লাল দুপাট্টা মলমল কা’ সেই লতা মঙ্গেশকর নাকি বাঙালি নন, মারাঠি, কিন্তু ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে’ শুনে সে কথা কে ধরতে পারবে? সেদিন ওই গোল চাকতি, যাকে বলে রেকর্ড, তার ওপরের কাগজের ঢাকায় তাঁর ছবি দেখে তার মুগ্ধতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। সাদা শাড়ির আঁচল দিয়ে গা ঢাকা, দুটো মোটা মোটা বিনুনি বুকের ওপর দিয়ে নেমে এসেছে, শ্যামলা গোলগাল শান্ত মুখ। দেখে চমকে উঠেছিল। এ তো অবিকল সে। তার মতোই শ্যামলা, গোলগাল, শান্ত মুখ, তার মাথাতেও তো এত চুল। সেইদিন থেকেই সে লতাকে গুরু মেনেছে। পোশাকে আশাকেও সে লতাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। ওইরকমই মোটা দুই বিনুনি হয় তার, কোন সাজগোজ নেই, শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে গা ঢাকা, তবে সে সাদা শাড়ি একদম পরতে পারে না। সাদা তার দু’চক্ষের বিষ। তাছাড়া তাদের এই গ্রামের দিকে সাদা শাড়ি পরলে নিন্দে হবে। বলবে বিয়ে না হতেই বিধবার বেশ! বিয়ের কথায় দেবীর কী যেন মনে পড়ে গেল। কলেজে স্নিগ্ধা বলে একটা মেয়ে আছে, মাঝে মাঝেই কলকাতায় ওর মামার বাড়ি বেড়াতে যায়, সেখানে অনেক সিনেমা দেখে, গানের জলসা দেখে, সিনেমার ম্যাগাজিন পড়ে। সে পরশু বলেছে লতা মঙ্গেশকর নাকি বিয়ে করেননি। খুব ছোটবেলায় বাবা মারা যাবার পর এগারো বছরের মেয়ে সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। প্রথমদিকে নাকি সিনেমায় পার্ট করেছে, তারপর আস্তে আস্তে গানের জগতে আসে। মা, চার বোন আর এক ভাইয়ের বিরাট সংসার। আশা, ঊষা, মীনা আর হৃদয়নাথ। স্নিগ্ধা বলেছিল, লতা মাকে খুব ভালবাসে। শুনতে শুনতে বুকের মধ্যে উথালপাথাল করছিল দেবীর। তাদেরও তো খুব অভাবের সংসার। বাবা গানের টিউশনি করে কত সামান্য উপার্জন করে। প্রায়ই ধার করতে হয় এদিক ওদিক। যদিও গ্রামে আর টাউনেও শিবেন্দ্র খুব শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, এমনকি বাসে পর্যন্ত টিকিট কাটতে হয় না অধিকাংশ দিন, তবু দেবীর চারপাশে কেমন এক দুঃখের ছায়া ঘিরে থাকে। মা একা আর কত পারবে? সে চলে গেলে কে দেখবে এই ভাইবোনগুলোকে? বিশেষ করে এই মুনাইকে? সে ঠিক করে, সেও লতার মতো কোনওদিন বিয়ে করবে না, মা বাবা ভাই বোনকে দেখবে। সংসার চালাবে। গান গেয়েও যে সংসার চালানো যায়, তা তো লতাই দেখিয়ে দিয়েছে। সে হঠাৎ মুনাইকে বুকে চেপে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দ্যায় তাকে। ‘আমি কোনদিন বিয়ে করব না রে মুনাই, কোনদিন তোকে ছেড়ে যাব না’ মুনাই কী বোঝে কে জানে, সে আনন্দে বড়দিকে আরো জড়িয়ে ধরে।
বুঝবে না কেউ বুঝবে না
শিবেন্দ্রর যে ভাইটি কুঁকড়াহাটিতে থাকে, তার ছোট ছেলের অন্নপ্রাশন আজ। খোকো যেতে পারবে না, তার আজ একটা চাকরির পরীক্ষা আছে। ঠাকুর ঠাকুর করে যদি হয়ে যায়। মেজ বিজু চারদিন আগে চলে গেছে। একটা ছুতো পেলেই হল। ইস্কুল কামাই করে বসে থাকবে। বছরের মধ্যে কতবার সে নৈহাটি পালায় তার ঠিক নেই। দেবীর পরে বিনতা, কালো, দাঁত উঁচু বলে শিবেন্দ্র ওকে পছন্দ করেন না। বিনতা, বিন্তি সেটা জানে ভালো ভাবে, তাই সে বাবার থেকে একটু দূরে দূরে থাকে। তাকে দেখতে ভালো নয়, বড়দির মতো গানের গলাও তার নেই। এজন্যে সে একটু গুটিয়ে থাকে যেন। কেউ লক্ষ্য করেনি কী ভালো নাচে সে। একদিন দেবী গাইছিল ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ বেণুকার সুর, কে সেই সুন্দর কে?’ বিন্তি খিড়কি পুকুরধারে গিয়ে কাঁদছিল। কারণ সকালে বাবাকে চা দিতে গিয়ে প্লেটে চা চলকে পড়ে গেছিল, বাবা চেঁচিয়ে উঠে বলল ‘বিজয়া, কতবার বলেছি কেলেন্দিটাকে দিয়ে চা পাঠাবে না।’
দেবীর গান শুনে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে এল বিন্তি, এই ক্লাস এইটেই সে শাড়ি ধরেছে। আসলে বিজয়া আর আগের মতো জামা সেলাই করে দিতে পারেন না, তাই শাড়িই পরতে হয় বেশি বিন্তিকে। দেবীও এইটের পর থেকে শাড়ি ধরেছিল, হাজিপুর গার্লসের নাইন থেকেই ইউনিফর্ম শাড়ি, লাল পাড় সাদা শাড়ি। দু’খানা শাড়ি ছিল তার। ফকিরচাঁদ কলেজে ভর্তি হবার পর সেই শাড়ি আর লাগে না। বিন্তি সেগুলো পরে। সেই লাল পাড় সাদা শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে সে নাচতে শুরু করল। ‘আমি যার বরষার আনন্দ কেকা/ নৃত্যের সঙ্গিনী যামিনী রেখা/ যে মম অঙ্গে কাঁকন কেয়ূর, কে সেই সুন্দর কে?’ দেবী গান গাইতে গাইতে অবাক হয়ে দেখল, নাচের ছন্দে ছন্দে কালো দাঁত উঁচু মেয়েটা কখন যেন অপরূপা হয়ে উঠেছে, তার চোখ মুখে কি আকুতি, কোন সুন্দরের প্রতীক্ষা করছে তার সেই অসুন্দর বোন? তার গলাটা একটু কেঁপে উঠল। তার মনেও কি কোন সুন্দরের প্রতীক্ষা আছে? সে বুঝতে পারে না। সেই যে কয়েক বছর আগে মাধু, মাধুরী সাহা এসেছিল, সে তার কানে কানে কত কথা বলেছিল, কে শুটিংর সময় ইচ্ছে করে তাকে জাপটে ধরেছিল, কে তার বুক ছুঁয়ে দিয়েছিল, সে বলেছিল, মেয়েমানুষের কোথাও শান্তি নেই বুঝলি, বিশেষ করে এই ফিল্ম লাইনে, সব হায়নারা ওত পেতে আছে। তারপর সে গলা নামিয়ে যেন কোন গোপন কথা বলছে, দেবীকে বলেছিল ‘রজনীমাসী কি বলেছে জানিস, বলেছে, শরীর হচ্ছে তোর জমানো টাকা, সেই টাকা ভাঙিয়ে খেতে হবে। তাই হিসেব করে চলিস মাধু, বেহিসেবী হয়েছিস কি তোকে ঝেঁটিয়ে আস্তাকুঁড়ে ফেলবে। তখন সোনাগাছিতেও জায়গা হবে না।’
দেবী অবাক হয়ে বলেছিল ‘সোনাগাছি কী গো?’
মাধু গালে হাত দিয়ে বলেছিল ‘তুই তো অবাক করলি দেবী! এই গাঁয়েও তো আছে রে। তোদের কাওরা পাড়ায়। আরে সারা দুনিয়ায় আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় সারা দুনিয়াটাই সোনাগাছি।’
দেবী তাও বোঝেনি। কাউকে জিগ্যেস করতেও সাহস হয়নি। একবার একটা গালাগাল শিখে এসে বাড়িতে বলতে, মা উঠোনে পড়ে থাকা নারকেল ডেগো দিয়ে পিটিয়ে তো ছিলই, তার ওপর মুখে গোবর পুরে দিয়েছিল। দেবী বমি করে করে হাল্লাক হয়ে গেছিল। কোনও বাজে কথা শুনলেই তার মুখে গোবরের স্বাদ উঠে আসে। সোনাগাছি যে একটা বাজে কথা –একথা আন্দাজ করতে পেরে কাউকেই জিগ্যেস করতে পারেনি সে।
বিন্তির নাচ দেখে তার মনে কীসের যেন বেদনা উথলে উঠল। কী যেন পায়নি সে। নাকি কোন রহস্যের খুব কাছে চলে এসেছে তার মন? একটা ঘটনা ঘটেছে কদিন আগে। কলেজের ফাংশন হয়েছে, সেখানে সে গান গেয়েছিল। গানটা গাওয়ার সময় একটু অপরাধবোধ হয়েছে তার। তার গুরুর গান না গেয়ে এই প্রথম সে অন্য কারো গান গাইল। আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা।’ গাওয়ার পর খুব নামডাক হয়েছে তার। কিন্তু খুব সমস্যাও হচ্ছে। কলেজ যাতায়াতের পথে ছেলেরা তাকে দেখলেই বলছে –‘ওই যে ছোট্ট পাখি চন্দনা যাচ্ছে’। এমনিই স্বভাব লাজুক দেবী, এতে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কলেজে যাওয়াটাই তার একটা বিড়ম্বনা হয়ে গেছে। তার ওপর সেদিন লজিক ক্লাসের পর, ক্লাসরুম যখন একেবারে ফাঁকা, সবাই এখন নদীর ধারে গিয়ে বসে, দেবী কোথাও যায় না, বিজয়া পই পই করে বলে দিয়েছেন, অনেক লড়াই করে তোমাকে পড়তে পাঠালাম এতদূর, আমার মুখ পুড়িও না। এমন কিছু করো না, যাতে পরের বোনগুলোকে আর না পড়তে পাঠান বড়বাবু। তাই অফ পিরিয়ডে সে ক্লাসেই বসে থাকে। সেদিনও জানলার ধারের একটা বেঞ্চে বসে ছিল। নদীটা এখান থেকে দেখা যায়। দেখতে দেখতে সে গুনগুন করছিল ‘বাদল কালো ঘিরল গো, সব নাও তীরে এসে ভিড়ল গো’ সত্যি নদীর বুকে কালো মেঘ নেমে এসেছে, মেঘ তো নয়, যেন কৃষ্ণের বিস্তৃত বক্ষপট। নদী যেন রাধার নীল আঁচল। তার ওপর ঝুঁকে এসেছে মেঘ। মনটা কেমন উদাস হয়ে গেছিল দেবীর। ও বুঝতে পারেনি, কখন যেন সেই ছেলেটা ওর সামনের বেঞ্চে এসে বসে, ওর দিকে কী একটা বাড়িয়ে দিয়েছে। দেবী চমকে তাকিয়ে দেখল রফিকুল। রফিকুল একটা গোলাপ ফুল ওর দিকে বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে কেমন নরম ঝালর। কোন ছেলের চোখ এত নরম হতে পারে? বাবা আর দাদা সবসময় তিরিক্ষি। বাবা যদিও তাকে খুব ভালবাসে, কোথাও কারো বাড়ি কিছু খেতে দিলে পকেটে পুরে নিয়ে আসে শুধু তার জন্যে, তাকেই একমাত্র হাতে ধরে গান শেখায় বাবা। কিন্তু বাবার সবকিছুর মধ্যেই একটা ভীতিপ্রদ ব্যাপার। আর দাদা খোকো, সে কেন জানি, খুব ঈর্ষা করে তাকে। ছোটবেলায় তো কথায় কথায় মারত। এখন মারতে পারে না, কিন্তু যাবতীয় খাটনির কাজ চাপায় তার ওপর। জামাকাপড় কাচা, ইস্ত্রি করা, গার্গলের জল করে দেওয়া। একদিন বলেছিল জুতো পালিশ করে দিতে। শুনে বিজয়া ভয়ানক রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘মেয়েরা হচ্ছে দুর্গার অংশ, কখনো তাদের দিয়ে জুতো পালিশ করাবে না, পা টেপাবে না। মেয়েদের গায়ে পা দেবে না’ বিজয়া বারবার বলেন ভাই বোন হচ্ছে দাঁত আর জিভ। জিভ সারাক্ষণ দাঁতকে মুছে সাফ রাখে, অথচ দাঁত এত বেইমান, সুযোগ পেলেই জিভকে কামড়ে দ্যায়।
দেবী আশ্চর্য হয়ে গেল। ফুল, ঠাকুরের পুজোয় ছাড়া সে যেখানে দেখেছে সেটা খাদি মন্দির। নামেই মন্দির, সেখানে কোন দেবতার পুজো হয় না। সারাদিন নানান কর্ম যজ্ঞ চলে। সুতো কাটা। দাতব্য চিকিৎসা। রাস্তা সাফাই। সেখানে গেট দিয়ে ঢুকেই মস্ত গোলাপ বাগান, শীতে গাঁদা ছাড়াও আরও কত মরশুমি ফুল ফোটে, অত নাম জানে না দেবী। তাকে মুগ্ধ করে দ্যায় গোলাপ। বইয়ের পাতার বাইরে সেই প্রথম গোলাপ দেখেছে দেবী। কিন্তু তা ছেঁড়ার কথা কখনো মনে হয়নি। খুব দুষ্টু ছেলেরাও, যারা সারা পাড়ার বাগানের ফলমূল চুরি করে খায়, পুজোর ফুল চুরি করে, তারাও কখনো খাদি মন্দিরের ফুল ছেঁড়ে না। তবে খাদি মন্দিরের সেই দিন আর নেই। আগের মতো অত লোক থাকে না। চরকা চালানোর শব্দে সারা গ্রাম জেগে থাকত, এখন দু’তিনটে বড়জোর। বিনয় ঠাকুরের শরীর পড়ে গেছে। ওদের ভেতরে ভেতরে নাকি অনেক অশান্তি। দেবী অত জানে না। তাকে গান গাইতে ডেকেছিল একবার গান্ধী জয়ন্তীতে, সে গিয়ে রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, গেয়ে এসেছে। বাবাকেও ডেকেছিল, বাবা যায়নি। বলেছিল ‘সবসময় আমার সঙ্গে গাইলে, তোর তো কোনদিন একা গান গাইবার সাহস হবে না’ আসল ব্যাপারটা যে তা নয়, দেবী তা বুঝতে পারে। বিনয় ঠাকুর এই অঞ্চলের অঘোষিত রাজা, খাদি মন্দিরেও তাঁর অনেক অবদান আছে, বাবার সঙ্গে তিনি মৌখিক ভদ্রতা যথেষ্ট করেন। কিন্তু গানের প্রকৃত সমঝদার তিনি নন। যেবার গান্ধী এসেছিলেন হাজিপুরে, গান্ধীর সভায় গান গাওয়ার জন্যে বাবাকে ডেকেছিলেন বিনয় ঠাকুর । তখন দেবী একরত্তি শিশু। বাবা অনেক যত্নে দেশ রাগের ওপর একটা গান বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন ওঁকে শোনাবেন বলে। বিনয় ঠাকুর শোনেননি। তাঁর সারাদিন একটা যন্ত্রের মতো চলে। বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, অপমানিত হয়েছিলেন। দেবী বুঝতে পারে শিল্পী মানুষের মনটা একটা চারাগাছের মতো। উৎসাহ, সহানুভূতি, প্রশংসা না পেলে, তা একা একা মরে যায়। আর যত্ন ভালোবাসায় লকলকিয়ে বাড়ে।
রফিকুলের বাড়ানো গোলাপ দেখে সে অবাক হয়ে বলে উঠেছিল ‘আমার জন্যে? গোলাপ? কেন?’
রফিকুল চোখের পাতা মাটির দিকে নামিয়ে বলেছিল ‘আপনি যে কিন্নরকণ্ঠী। আপনার গলায় সাত সুর পোষা পাখির মতো খেলা করে। আপনার ছোট্ট পাখি চন্দনা শুনে আমি একটা কবিতা লিখেছি, পড়বেন?’
দেবীর দিকে অনুমতির জন্যে তাকাল রফিকুল। ছেলেরা যে কোন ব্যাপারে মেয়েদের অনুমতি নেয়, সেটাও প্রথম দেখল দেবী। সে অভিভূতের মতো ঘাড় নাড়ল। রফিকুল সসংকোচে পকেট থেকে একটা কাগজ বার করল, বঙ্গলিপি খাতার লাইন টানা পৃষ্ঠায় লেখা।
দেবী পড়ছিল –
‘ও আমার গানের পাখি,
তুমি মোর সুরের সাকী
আমার এই মন পেয়ালা
গানে গানে ভরবে নাকি?
তুমি মোর সুরের দেবী
নিশিদিন তাহাই ভাবি
চরণে ঠাঁই মিললে
এ জীবন পূর্ণ সবই।’
দেবী পড়ছিল, পড়তে পড়তে তার মন তোলপাড় করছিল। কিন্তু ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছিল। সে বলে ফেলল ‘গুরুচণ্ডালী দোষ আছে যে অনেক।’ তারপর সে কাগজটা রফিকুলকে ফিরিয়ে বলল ‘আপনি রাখুন। শুদ্ধ করে লিখে দেবেন।’
রফিকুল লজ্জায় মরে গিয়ে বলল ‘আমার এই দোষটা বড় হয়, তবে বানান ভুল পেলেন কি?’
আরেকবার কাগজটা ধরে ভালো করে দেখল দেবী। নাহ বানান ভুল নেই একটাও। হাতের লেখাও মুক্তোর মতো। গুরুচণ্ডালী দোষের কথা না বললে চলছিল না? সে কবিতার কীই বা বোঝে? বাবা যদিও অনেক রাত অব্দি জেগে লেখে ডায়েরিতে। এক পুরনো ছাত্র, এখন কলকাতায় মস্ত চাকরি করে, সে এনে দ্যায় ডায়েরি প্রতিবার। সেই ডায়েরিতে বাবা দিনলিপি লেখে, তাতে জমা খরচের হিসেবই বেশি, মানে কত টাকা কার কাছে পায়, কত টাকা কার কাছে ধার আছে, বাজার বাবদ কত খরচ হল। দেবী একদিন বাবার বিছানা তুলতে গিয়ে খুলে দেখেছে, সেই ডায়েরিতে ধারের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। তা বাড়ারই কথা। তারা এখন মোট নয় ভাই বোন। আর দিদিও তো আছেন। এছাড়া অতিথি লেগেই আছে। আর আছে বারোমাসের ছাত্র ছাত্রীরা। তবে রবিবার ছাড়া তাদের জলখাবার দেওয়া হয় না আর। চা বিস্কুটেই সারা হয়। যদিও সে নিয়ম প্রায়ই শিথিল হয় বাবার জবরদস্তিতে। অনেকেই মাঝে মাঝে মিস্টি বা শাক সব্জি নিয়ে আসে। তখন তাদের কিছু পাঠাতেই হয়।
জমা খরচ ছাড়াও, বাবা ছোট ছোট করে দিনলিপি লেখে। অধৈর্য দু’এক শব্দের লেখা নয়, বেশ খুঁটিয়ে লেখা। কোথায় গেছে, কাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কী কথা হল, সব। আর লেখে গান। এমন শব্দ চয়ন, যাতে সুর দিয়ে গাওয়া যায়। সেই গান যে কবিতার থেকে আলাদা তা দেবী বোঝে। আরও বোঝে এই জন্যে যে গরিফার বড়মাসীর ছেলে তাকে আজকালকার কিছু কবিতা শুনিয়েছে। একটা পত্রিকা দিয়ে গেছে। তাতে সেও একটা কবিতা লিখেছে। পত্রিকার নাম নবসূর্য। সব কবিতার মধ্যেই খিদে, কান্না, অভাব। পড়ে কষ্ট হয়েছিল দেবীর। সে যে গান গায় তার মধ্যে তো এসব নেই। ভাতের অভাব, কাপড়ের অভাব, যা আজকাল সে বুঝতে পারে সংসারে। মা কীভাবে চালায় এই সংসার, শুধু গানের টিউশনি নির্ভর, তাদের তো এক ছটাক জমিও নেই কোথাও। চাল ডাল সব কিনে খেতে হয়। তরিতরকারি, মাছ, ডিম সবই। পেছনে পুকুরটা তাদের নিজস্ব, সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরা হয় আলেকালে। হাটের মাছই ভরসা। সব্জির বাগান করলেই করা যেত। কিন্তু কারো ওসব গা নেই। উঠোনে আম আর পেয়ারা গাছ ছাড়া একটা বক ফুল গাছ, বেসন বা চালগুঁড়ি দিয়ে বড়া খাওয়া। আর টালির চালে লতিয়ে ওঠা লাউ, কুমড়ো। কিন্তু সে তো হঠাৎ পাওয়া, তার ভরসায় এই এত বড় পরিবার, যার দুবেলা খেতে চব্বিশটা পেট, তার চলে কি? বাবা ডায়েরি লেখা ছাড়াও আর একটা জিনিস লেখে জানে দেবী। তা হচ্ছে ছোট চিরকুট, যাকে বলা যায় হাতচিঠি, ‘আমার পুত্রকে পাঠাইতেছি। অনুগ্রহ করিয়া ওর হাতে পঞ্চাশটি টাকা দিবেন’ পুত্রের নাম বদলে যায়, যদিও যায় একজনই। দাদা তো কখনোই যাবে না। মেজভাই প্রায়ই নৈহাটি চলে যায়, সেজর একটু সাহেবি হাবভাব। যাবার মধ্যে রইল নভাই। সে খুব শান্ত স্বভাব, মা বলে অষ্টম গর্ভের সন্তান, বিরাট কিছু করবে। অনেক ব্যাপারেই সে মায়ের ভরসা। ছোট্ট ঠাকুরঘরে আলো ঢুকত না, লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়তে অসুবিধে হত, সে একটা টালি বদলে এক ফালি কাচ কোথা থেকে যোগাড় করে লাগিয়ে দিয়েছে, এখন ঠাকুরঘর আলো ঝলমল করে। চালে কুমড়োলতা তুলে দেওয়া, কিংবা কোথায় সস্তায় চাল পাওয়া যায়, তার সন্ধান করা –এসবই এই অষ্টম গর্ভ দিয়ে হয়। তাকেই বাবা বেশি পাঠায় চিরকুট দিয়ে। সে মুখে কিছু বলে না, কিন্তু দেবী দেখেছে ফেরার পর সে খিড়কি পুকুর ধারে বসে বসে মুখ গুঁজে কাঁদে। তার অপমানবোধ বড় তীব্র, কিন্তু মা বাবা ভাই বোনের কষ্টও সে উপেক্ষা করতে পারে না।
দেবী ভাবে তার কোন গানে কি এই কষ্টগুলো ধরা আছে? গানের ভাষায় কষ্ট আছে। সে বিরহের কষ্ট, দেখা না হওয়ার কষ্ট। দেবী ভেবে দেখল রফিকুলের জন্যে তার কোন কষ্ট হচ্ছে না সেভাবে। কিন্তু ওর প্রেম স্বীকার না করার কষ্টও তো আছে। তার ওপর রফিকুল একটা কথা বলেছিল, সেটা দেবীর মাথায় ঘুরছে। রফিকুল বলেছিল ‘আপনি ছোট্ট পাখি চন্দনা গানটা অপূর্ব গেয়েছেন। কিন্তু ওটা তো আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান, আপনি শুধু লতার গান গাইবেন, শুধু লতার। আর আরও পরে আপনার নিজের গান হবে। আমি সে গানের কথা লিখে দেব। তখন দেখবেন সবাই আপনার গান গাইছে।’
দেবী ভেবেছিল রফিকুল বুঝি ঠাট্টা করছে। কই না তো? ওর চোখে জ্বলন্ত বিশ্বাস দেখল সে।
বিন্তির ডাকে তার ঘোর ভাঙল ‘ও বড়দি, আজ তোমার গানে মন নেই কেন গো? আমার নাচ কেমন হল? যাও, তুমি তো কিছু দেখইনি।’
দেবী একটু লজ্জা পেয়ে গেল। কিন্তু সে তো সবার বড়দি, তাই গম্ভীর গলায় বলল ‘গান, নাচ এসব কি মানুষকে শোনাবার দেখাবার জন্যে? এসব ঠাকুর দেখে। ওই গানটা শুনিসনি অঞ্জলি লহ মোর, সঙ্গীতে।’
বিন্তি অমনি আবদার করল ‘ওই গানটা জানি আমি, তুমি একটু গাও না, লক্ষ্মী বড়দি।’
‘আজ তুই গা দেখি একটা গান।’
বিন্তি কিছুতেই গাইতে চায় না কারো সামনে, অনেক জোরাজুরির পর সে গাইল ‘কেন বঞ্চিত হব চরণে, আমি কত আশা করে বসে আছি পাব জীবনে না হয় মরণে।’
দেবী স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সেই গানের সামনে। বিন্তির গলার রেঞ্জ খুব বেশি না, গলায় কাজ নেই তেমন, যাকে বলে ফ্ল্যাট গলা, কিন্তু কি দরদ! ওইটুকু মেয়ে এই গানের ব্যথা তুলে আনল কী করে? নাকি ও নিজেকেই গাইছে, নিজের কালো কুরূপ নিয়ে লোকের তাচ্ছিল্য, উপেক্ষার যন্ত্রণা এভাবে নিঙড়ে দিচ্ছে গানে? দেবী তার থেকে বয়সে ছোট বোনের কাছে একটা মূল্যবান শিক্ষা পেল সেদিন। গান শুধু গলা দিয়ে গাইলে হয় না, হৃদয় দিয়ে, সমস্ত শরীর মন দিয়ে গাইতে হয়।
মাকে নিয়ে নভাই এগিয়ে গেছে, ওর হাতে একটা বড় ব্যাগ, পেছন পেছন সেজ বোন ললিতা। ডাক্তারখানা স্টপেজ থেকে বাসে জেটিঘাট, সেখান থেকে লঞ্চে কুঁকড়োহাটি। দেবী মুনাইকে কোলে নিয়ে শেষে বেরল। ওর কাঁধে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। নকাকিমা দু’বছর আগে ‘দিয়েছিল। এর মধ্যে একটা সোনার আংটি আছে, এটা বাবা রূপশ্রী জুয়েলার্স থেকে বাকিতে কিনেছে, দেবী জানে। দেবী পেছন ফিরে বিন্তিকে বলল ‘দরজাটা লাগিয়ে দে বিন্তি, কাল বিকেলেই চলে আসব আমরা। সাবধানে থাকিস।’
বিন্তি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল কিছু না বলে, ওর চোখে জল টলটল করছিল।
ও পলাশ ও শিমুল
একটু মোটা মোটা করে আলু কুটছিলেন বিজয়া। ভাজা হবে। আর কয়েকটা পরোটা। বড়বাবু দু’দিনের জন্যে করঞ্জলি সঙ্গীত সম্মেলনে গেছেন। ওখানে তাঁকে সম্বর্ধনা দেবে। ছাত্র ছাত্রীরা নেই, বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আজ সন্ধেয় দেবী বলেছে সবাইকে পরোটা করে খাওয়াবে। ও কলেজ কম্পিটিশনে গান গেয়ে ফার্স্ট হয়ে তিরিশ টাকা আর এক হাঁড়ি রসগোল্লা পেয়েছে। আসার সময় বাজার থেকে ময়দা কিনে এনেছে, আজ রাতে পরোটা, আলুভাজা, আর রসগোল্লা। দুটো রসগোল্লা নারায়ণকে দিয়ে এসেছে, দুটো দিদির ঘরে মিটশেলফে ঠেকাঠেকি হবার আগে। এরপর তো হরির লুট হচ্ছে। যে যেমন ইচ্ছে তুলে খাচ্ছে, রাত অব্দি একটাও থাকবে কিনা সন্দেহ। এই ভয় করেই দেবী বিজয়াকে একটা জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। নইলে তাঁর কপালে কিছুই জুটবে না। আর বিজয়াও তেমন, ছেলেমেয়েরা চাইলে নিজের মুখের জিনিস ধরে দেবেন। আজ তিনি বিনা প্রতিবাদে প্রথম রসগোল্লা খেয়ে নিয়েছেন। বুকের মধ্যে তাঁর আনন্দের ঝরণা নেমেছে। মনে হচ্ছে এ তাঁরই রোজগার। সবচেয়ে খুশি মুনাই। সে বুঝতে পেরেছে তার বড়দি আজকের আনন্দের কারণ। তাই তার গর্বের সীমা নেই, সে সারা উঠোন হাততালি দিয়ে ঘুরছে আর বলছে ‘তাই তাই তাই মামারবাড়ি যাই মামা দিল দুধকলা দুয়ারে বসে খাই, মামী এল ঠেঙ্গা নিয়ে পালাই পালাই।’
উঠোনে উনুন প্রায় ধরে এসেছে। বিজয়া বললেন ‘মুনাই ওপরে উঠে এসো। জ্বলন্ত উনুন’
মুনাই সাধারণত মায়ের কথায় পাত্তা দ্যায় না, তার ধারণা মা তাকে ভালবাসে না, সেজন্যে সে ইচ্ছে করেই মায়ের কথা শোনে না। আজ কিন্তু একবার ডাকতেই সে সুড়সুড় করে উঠে এল। বিজয়া তাকিয়ে দেখলেন তাকে, তাঁর চার মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে লাবণ্যময়ী মুনাই, তার মুখে ঝামরে পড়েছে চুল, কোঁচকানো অবাধ্য চুল, দেবীর মতোই, দেবীর মতোই মুনাইও গানপাগল। উনুন ধরে গেলে অন্তু রান্নাঘরে তুলে দিয়ে গেল। বিজয়া বললেন ‘কেন রে? ভূষণ আসেনি? ‘
‘না মা। জানে বাবা থাকবে না।’
বিজয়া আস্তে করে বলেন ‘এরা যেন গন্ধ পায় বড়বাবুর। অন্যদিন তো সকাল বিকেল দুবেলা আসে।’
যে কথাটা বিজয়া মুখে বললেন না, বড়বাবু থাকলে ভূষণ জানে, চা বিস্কুট, রুটি তরকারি বাঁধা তার। কাউকে খাইয়ে সে কথা মুখে বলতে তাঁর রুচিতে বাঁধে। ক্ষমতা থাকলে গ্রামের সবাইকে পাত পেড়ে খাওয়াতেন তিনি। কিন্তু ঈশ্বর সে ইচ্ছা কি পূরণ করবেন?
তবে এরাও বুঝদার মানুষ নয়। বোঝে না বিজয়া কী প্রাণপাত করেন দুটো ভাত ছেলেমেয়েদের মুখে তুলে দেওয়ার জন্যে। গ্রামের আর পাঁচটা চাষাভূষো বাড়ির মতো নন তাঁরা, যে সকালে এক সানকি পান্তা আর পেঁয়াজ দিয়ে ছেলেমেয়েদের বসিয়ে দেবেন, কিংবা, দুপুরের ভাত জল দিয়ে রাখলে বাসি তরকারি দিয়েই সবাই খেয়ে নেবে রাতে। এ বাড়ির খাওয়াদাওয়ার লপচপানি খুব। সকালে টিফিনে আটা ময়দা, রাতেও তাই। কণা মানে দেবী খুব ভাত খেতে ভালবাসে, ওর জন্যে দুপুরের ভাত রেখে দেন। শীতকালে অবশ্য রুটিই খায় সে, একটু দুধ আর পাটালি দিতে হয়।
স্মৃতিকণা তুলসীতলায় প্রদীপ দেখিয়ে উঠে আসছিলেন। এবার ঠাকুরঘরে তিনি নারায়ণকে শীতল দিয়ে শয়ন করাবেন। তার আগে ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার প্রার্থনা গায়। ‘দীনবন্ধু করুণাসিন্ধু দীনজনের নিকটবন্ধু জ্ঞান ভক্তি দাও হে মোদের
দাও গো মোদের কৃপাবিন্দু।’
এই গানটি বড়বাবুর লেখা আর সুর দেওয়া। তিনি সন্ধ্যায় ঠাকুরের সামনে গাইবার জন্যে এই গান বেঁধেছেন, কিন্তু এই গানই তিনি পাশের ছোট্ট গ্রাম জামতলির মসজিদে বসেও গেয়ে এসেছেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে, সঙ্গে খালেদ ছিল বাঁশি নিয়ে। এসব ভাবলে বুক ধড়ফড় করে বিজয়ার। দেবী বড় হয়েছে। মুসলমানের সঙ্গে ওর এত গা ঘেঁষাঘেঁষির দরকার কী? বিজয়া বেশ জোরেই বলেছিলেন তাঁর আপত্তির কথা। বিয়ের কুড়ি বছর পরেও যদি তিনি তাঁর নিজস্ব কথাগুলো বলতে না পারেন, তাহলে আর কবে বলবেন? বড়বাবু যথারীতি শোনেননি, সারা জীবনে তিনি একবারই বাড়ির মেয়েদের কথা শুনেছিলেন আর সেই শোনার ধাক্কায় তাঁর জীবনটা আমূল বদলে গেছে। কোথায় কলকাতার ঝলমলে সংস্কৃতির জগত, ফিল্মে গান করার কেরিয়ার আর কোথায় এই রাজারামপুরের বদ্ধ কুয়ো। এতদিন পরেও এখানে থাকতে মাঝে মাঝে দম বন্ধ লাগে তাঁর। তাই মাঝে মাঝেই নানা নতুন কর্মকাণ্ড করে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চান। কখনও হস্তশিল্প প্রদর্শনী, কখনও ফ্লাওয়ার শো, কখনও বা সারা গ্রামকে নিয়ে পুরনো কেল্লার ধারে বনভোজন। যদিও এইসব হুল্লোড়ে তিনি সরাসরি থাকেন না, শুধু মাথাটা দেন, বাকিটা তাঁর ছাত্ররাই সামলায়। কিন্তু এই জামতলি গ্রামটি আর তার ছোট্ট নির্জন মসজিদটি তাঁকে বারবার টানে। সেই যে একবার পড়ন্ত ফাল্গুন বিকেলে আজানের ধ্বনি শুনে সেই গ্রামটিকে আবিষ্কার করেছিলেন খালেদের সঙ্গে গিয়ে, সেই থেকে এখানে বারে বারেই আসেন তিনি।
বিজয়া নিয়ম চালু করেছেন সন্ধে হবার আগেই সবাইকে বাড়ি ঢুকতে হবে, তারপর খিড়কি পুকুরঘাটে হাত পা ধুয়ে দিদির সঙ্গে প্রার্থনা সেরে কিছু খেয়ে পড়তে বসতে হবে। শিবেন্দ্রর পছন্দ হয়েছে ব্যাপারটা। তিনি বুঝতে পেরেছেন বিজয়ার উদবেগের কারণ, সন্ধের অন্ধকারে গ্রামের চরিত্র একদম বদলে যায়। পঞ্চার চপের দোকানের পেছনে চোলাইয়ের ঠেক, জুয়োখেলা – সবই হয়, আর একটা ঠেক বসে কাওরাপাড়ায় শান্তির বাড়ি। এই দ্বিতীয় ঠেকেই জনসমাগম বেশি, উঠতি বয়সের ছেলেদের মাথা খায় শান্তি। তার চোখের চাউনি, শাড়ি পরার কায়দা, সাপের ফনার মতো বিনুনির দোলন –পুরুষকে পাগল করে দ্যায়। সে বিজয়ার এখানে কিছুদিন কাজ করেছিল, তাই তিনি হাড়ে হদ্দ জানেন শান্তিকে। এসব কারণেই রাজারামপুরের সন্ধেকে বড় ভয় পান। তাঁর কড়া নির্দেশ সন্ধে নামার আগে ঢুকতে হবে সবাইকে। কিন্তু শুধু ফিরলেই তো হল না। ওদের বেঁধে রাখার মতো তো কিছু চাই। তাই শিবেন্দ্র এই গান রচনা করলেন। পশ্চিম দেশে গান নিয়ে কত গবেষণা হয়। গান দিয়ে নাকি মারাত্মক খুনীর মন বদলে দেওয়া যায়।গান শুনলে সেরে যায় দুরারোগ্য অসুখ। এখানে গানবাজনাকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। গান গায় মানেই নিষ্কর্মার ঢেঁকি। আর কিছু করতে পারে না তাই গান গাইতে এসেছে। গান গায় মানেই তার চরিত্রের দোষ আছে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে কে আর কালোয়াতি গানের কদর বোঝে? গান শিখতে পাঠানোর উদ্দেশ্য যাতে মেয়ে দেখতে এলে পাত্রপক্ষকে একখানা গান শুনিয়ে খুশি করতে পারে, তাহলে মেয়েটার একটা হিল্লে হয়। ভর্তি করতে এসে মেয়ের বাপ বলে যায় ‘ও মেস্টর, একখানা ঠাকুরের গান শিইকে দিও আমার আভারানিকে।’ আভারানি হারমুনি ধরতে গিয়ে রিড ভেঙে ফেলে আর কি। শিবেন্দ্র হারমনিয়াম ধরাবারই পক্ষপাতী ছিলেন না। প্রথমে খালি গলায় সেধে গলা সুরে বসাতে হয়, সঙ্গে তানপুরা থাকলে ভালো। সুরটা ধরে রাখার জন্যে। কিন্তু গ্রামের লোকের হারমনিয়াম যন্ত্রটির প্রতি কী যে আকর্ষণ। শিবেন্দ্র এই হারমোনিয়ামে না শেখালে একজনও তাঁর কাছে শিখতে আসবে না। সরস্বতীকে যখন তিনি পেটের জন্যে রাস্তায় গাওয়াচ্ছেন, তখন আর কোন নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকলে চলে না। তাঁর ডোয়ারকিনের হারমনিয়ামের ওপর এই চাষাড়ে আঙুলগুলো যখন কোদাল চালাবার মতো চষে বেড়ায়, বুকের পাঁজরে ধাক্কা লাগে। অনেকদিন ভেবেছেন, ছাত্রছাত্রীদের জন্যে লোকাল দোকান থেকে একটা ছোট হারমোনিয়াম বানিয়ে নেবেন। কিন্তু পেটের বালাই বড় বালাই। মাসের পনেরোদিনের মধ্যে টিউশনির টাকা শেষ হয়ে যায় শুধু পেটে খেতে, বাকি পনেরো দিন চলে ধারের ওপর। ভায়েরা মানুষ হয়ে সরে পড়েছে যে যার সংসারে। মেজ, আর নভাই মস্ত সরকারি চাকরি করে, সেজভাই শ্বশুরের চাষবাস সম্পত্তি দেখাশোনা করে। ছোটটাই যা যাত্রাপালা করে বেড়ায়, ছোটজাতের মেয়েকে বিয়ে করেছে, দুই মেয়ে তার, তার অভাব থাকলেও, বউ মনে হয় আয়াগিরি করে সামলে নেয়। ভায়েরা আসে, থাকে, বউদির হাতের রান্না খেয়ে ধন্য ধন্য করে চলে যায়, ভুলেও এক পয়সা ঠেকায় না। তবে তারা পুজোয় মা আর বউদিকে নিয়ম করে শাড়ি দ্যায়। তিনি শুনেছেন বিজয়া নাকি তাদের বলেছে ‘আমাকে না দিয়ে কণাকে দিও ঠাকুরপো। বড় হয়েছে, কলেজে যায়, পাঁচটা মেয়ের পাঁচরকম দেখে ওরও ইচ্ছে হয়। আমি তো অনেক খেলাম মাখলাম এ সংসারে।’
সেই থেকে বিজয়ার বদলে দেবীকে দ্যায় শাড়ি। কিন্তু বছরে একটা শাড়ি দিয়ে কি এই সংসারের বিরাট ফুটো ঢাকা যায়? তাই সম্প্রতি তিনি দলিল কপি করার কাজ করছেন। শাসমলবাবু মস্ত উকিল, তিনি দেন কাজ, সেগুলো বাড়িতে এনে গভীর রাতে করেন, কেউ জানতে পারে না। মুক্তোর মতো হস্তাক্ষর তাঁর, এতদিনে কাজে আসছে।
শিবেন্দ্রর সেই গান ‘হে বন্ধু করুনাসিন্ধু ,দীনজনের নিকটবন্ধু’ গাইছিল ছেলেমেয়েরা। পুজো শেষ হয়ে গেলে স্মৃতিকণা ময়দা মাখবেন, বিজয়া ভাবলেন একটু বেশি করে মাখতে বলবেন, তাহলে বাসি পরোটা থাকলে একটু গরম করে সকালে ছেলেমেয়েরা খেয়ে নিতে পারবে। রোজ এতজনের চারবেলার খাবার চিন্তা করা যে কী ভয়ানক, এ মানুষকে একেবারে ভেতর থেকে মেরে রেখে দ্যায়। কতদিন ভাবেন, বিকেলে বসে একটু খবরের কাগজখানা দেখবেন, কি একখানা বই পড়বেন, নজা তাঁকে খুব ভালবাসে, সেবার এসে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত বইখানা রেখে গেছে, তার সঙ্গে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি, পড়ার সময় নেই। এই গ্রামে আবার বিকেলটুকুও নিজের মতো থাকার জো নেই। কেউ না কেউ এসে হাজির হবে ‘অ জেঠিমা কী করচ গো?’ বলে। এদের এই বিকেলে পাড়া বেরাবার সময়। এদের সঙ্গে কথা না বললে এরা বাইরে গিয়ে বলবে ‘গেঁজা আপিমের দোকানির বউয়ের কি অংকার!’ আবগারি দোকান কবে উঠে গেছে, তবু গ্রামের লোকের স্মৃতি থেকে তা যেতে চায় না। ঠেস মেরে কথা বলার হলেই সেই প্রসঙ্গ টানে তারা।
আলুগুলো জল ঝরিয়ে একটা থালায় তুলে রাখতে রাখতে বিজয়া মুনাইকে বলেন
‘ধেই নেচেছে রাঙা পায়/ ঘাগরা কিনে দ্যায় না মায়/ আসুক তাঁতি, বুনুক সুতো/ ঘাগরা কিনে দেব রে পুতো।’
মুনাই খিলখিলিয়ে হেসে মার পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরেকটু হলেই বিজয়া বঁটির ওপর মুখ থুবড়ে পড়তেন।বিজয়ার শরীরে আর আছে কী? মুনাই বলতে নেই, বেশ নাদুসনুদুস। সে কতদিন পরে মাকে একলাটি পেয়ে খুব খুশি, মার পিঠের ওপর দুলতে দুলতে সে বলে ‘মা তুমি খুউউউব ভালো। আর একবার বলবে ছড়াটা, বড়দিকে শোনাব।’
‘বড়দি জানে।’
‘না, তুমি আবার বলো’
‘ধেই নেচেছে রাঙা পায়/ ঘাগরা কিনে দ্যায় না মায়/ আসুক তাঁতী বুনুক সুতো/ ঘাগরা কিনে দেব রে পুতো।’
হঠাৎ সবুজ কেম্বিসের পর্দা সরিয়ে কে যেন ঢুকে আসে উঠোনে। বিজয়া দেখেন ধুতি পাঞ্জাবি পরা একটি ছেলে।
ছেলেটিকে দেখলে ভালো ঘরের মনে হয়। কিন্তু কেমন করে হাঁটছে, যেন খোঁড়া, চোখেও কি কম দেখে? মুনাই বলে ‘কে গো তুমি, বন্ধু? করুণাসিন্ধু দীনজনের নিকটবন্ধু?’
‘আজ্ঞে আমার নাম সুকোমল, সুকোমল ভট্টাচার্য। মাস্টারমশাই আছেন?’
ও ঝর ঝর ঝর্ণা
অনেক দূর দিয়ে একটা জাহাজ যাচ্ছে। শীতকাল বলে বাতাস খুব পরিষ্কার। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জাহাজটা। জাহাজ নাকি একটা আস্ত শহরের মতো। বাড়িঘর, হোটেল, দোকানপাট সব কিছু আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ওখানে গানবাজনা করারও খাসা ব্যবস্থা আছে। দেবী ভাবছিল এমন একটা জাহজে ভেসে যেতে পারলে বেশ হত। সংসারের এত অভাব থেকে বেঁচে যেত। শুধু মুনাইকে নিয়ে যাবে। অমনি মায়ের ক্লান্ত মুখটা তার সামনে ভেসে ওঠে। মায়ের কপালের ভাঁজটা এখন স্পষ্ট বোঝা যায়। মাকে ফেলে সে কী করে যাবে? সারাজীবন খেটে খেটে হাড় কালি করা মায়ের কি তার কাছ থেকে এটাই প্রাপ্য? না, মাকে সে ফেলে যেতে পারবে না। আর দিদি? সত্যি বলতে কি, অনেক বড় হবার পর সে জেনেছে এই মহিলা তার নিজের ঠাকুমা না, দাদুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। তাঁর তো এই পরিবারের সঙ্গে কোন রক্তের সম্পর্কই নেই। তাঁর একটি সন্তান জন্মের তিন মাস পরেই মারা গেছে। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্র পড়েছে দেবী। সেখানে মৃণাল বলেছিল মা হবার যন্ত্রণাটুকু পেলাম, মা হবার মুক্তিটুকু পেলাম না। দিদি, শ্রীমতী স্মৃতিকণা দেব্যা হচ্ছেন সেইরকম এক নারী, মা হবার মুক্তি তিনি পাননি। তিনি তাঁর মুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেছেন, পরের ছেলেকে নিজের করে নিয়ে। বালিগঞ্জে তাঁর বাপের বাড়ি, ভায়েরা কেউ নামকরা উকিল, কেউ ডাক্তার, কত চেষ্টা করেছে তাঁকে নিয়ে যেতে। তিনি যাননি। কীসের জন্য পড়ে রইলেন এখানে? দুপুরে একটু বড়ির ঝাল বা পলতা পাতার বড়া দিয়ে একমুঠো ভাত, রাতে অনেকদিনই তিনি একটা বাতাসা দিয়ে জল খেয়ে শুয়ে পড়তে চান, কিন্তু মা জোর করে দুধ রুটি খাওয়ান, কিংবা এক একদিন পরোটা আর সাদা আলুর তরকারি করে দেন। মা আর দিদি, সম্পর্কে যাঁরা শাশুড়ি বউমা, তাদের সখ্য দেখার মতো। মাকে নিয়ে গেলে, দিদিকে রেখে যাওয়া যাবে না। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না। অমনি বিন্তির মলিন মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিন্তির সঙ্গে কেউ ভালো করে কথা বলে না। গায়ের রঙ কালো, দাঁত উঁচু, এটাই ওর অপরাধ? বাবা, দাদা, অন্য ভাইরাও সুযোগ পেলেই ওকে ফাই-ফরমাশ খাটায়। বিন্তিকে ফেলে গেলে ও বেচারি মরেই যাবে।
একদিন রাতে কলঘরে যেতে গিয়ে দেখেছিল বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে। ও সেই রাতে খোলা আকাশের নিচ দিয়ে পা টিপে টিপে উঠোন পেরিয়ে পর্দার আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখেছিল হারিকেনের সামনে ঝুঁকে পড়ে বাবা তন্ময় হয়ে কী যেন লিখে যাচ্ছেন। তাঁর একপাশ ফেরা মুখ কী নিঃসঙ্গ। একটু পরে তিনি ডায়েরি কলম বন্ধ করে বাঁশিটা তুলে নিলেন। কী করুণ আর মধুর সুর ছড়িয়ে গেল চরাচরে। এই রাগটা চেনে দেবী। দেশ। এই রাগে গানও সে শিখেছে। ‘পথ ছাড়ো ওগো শ্যাম কথা রাখো মোর।’ বাঁশিতে সেই রাগটাই বাজাচ্ছেন। আর এমন সে সুর, মনে হচ্ছে সে আর রাজারামপুরে নেই, কত অচেনা পাহাড়, নদী উপত্যকা, অরণ্যে সে ছড়িয়ে যাচ্ছে, একাকী বিচরণ করছে অনন্ত আকাশে। সেদিন সে বুঝতে পেরেছিল, শিবেন্দ্র কত বড় মাপের একজন শিল্পী, সংসার যার শেষ বিন্দুটি অব্দি শুষে নিতে চায়। তার মধ্যে এইটুকু তিনি নিজের জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছেন। শিবেন্দ্র কি কোনদিন জাহাজে চড়েছেন? তিনি যদি জাহাজে চড়ে সমুদ্রে যেতে পারতেন, তাহলে নিশ্চয় তাঁর সুরে সমুদ্রের ঢেউ মিশে যেত, মিশে যেত শঙ্খচিলের কান্না, মৎসকন্যার গান। দেবীও সেই মহাজাগতিক সুরের মধ্যে নিজের ছোট বাঁশিটির সুর মিলিয়ে দিতে পারত। না, বাবাকে ফেলে দেবী যেতে পারবে না। বাবা তার হাতের চা ছাড়া খেতে চান না আজকাল। তার ইস্ত্রি করে দেওয়া পাঞ্জাবি পরেন, শীতকালে গলা ভালো রাখার যষ্টিমধু থেঁতো করে দেবীই দ্যায়। দেবীর মনটা আর এক সমুদ্রের ধারে চলে গেল। তার গানের দেবী তো আরব সাগরের ধারে থাকেন। তিনি তো একা মা ভাই বোনদের টেনে চলেছেন, স্বার্থপরের মতো একা বাঁচেননি। দেবীও সবাইকে নিয়েই বাঁচবে। ‘স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগত হতে/ সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।’
দেবী অবাক হয়ে ভাবে, তার বাবাও তো শিল্পী, গানের টিউশনি সম্বল করে তিনি কত কষ্টে এই সংসার টেনে চলেছেন, আর সেই গান গেয়েই লতা মঙ্গেশকরের কত অর্থ, ভুবনজোড়া নামডাক। তার কারণ লতা যে সিনেমায় গান করেন, তাও আবার হিন্দি সিনেমায়। দেবী শুনেছে এই হিন্দি সিনেমায় তাবড় তাবড় ব্যবসায়ীরা টাকা ঢালেন, এমনকি যে টাকাকে বলা হয় কালো টাকা, সেই টাকাই ঢালা হয় হিন্দি সিনেমায়। সেই কালো টাকা দিয়ে তৈরি সিনেমায় গান গেয়ে নিজেকে আপাদমস্তক সাদা শাড়িতে মুড়ে রাখেন যিনি, তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায়? কিন্তু দেবী কী করবে? সে পড়াশোনাতেও খুব ভালো, অঙ্ক ছাড়া অবশ্য। অঙ্ক তার একদম ভালো লাগে না। ইংরেজি, লজিক, সাইকোলজি, সবেতেই সে ভালো, বিশেষ করে ইংরেজি পড়তে তার খুব ভালো লাগে। খুব ছোট থেকেই সে পাঁচুগোপাল মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়েছে, রেন অ্যান্ড মার্টিনের গ্রামার মাস্টারমশাই গুলে খাইয়েছেন, তাছাড়া পড়ার পরে তিনি কত ইংরেজি গল্পের বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতেন, কোথাও বুঝতে না পারলে বাংলায় বুঝিয়ে দিতেন- এইভাবে রাজারামপুর গ্রামে বসে দেবী যেরকম শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে শিখেছে, তা কলকাতার নামী স্কুলের ছেলেমেয়েরাও পারবে না। দেবীর সঙ্গে খোকোও তো পাঁচুগোপাল মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়েছে, কিন্তু ওর তেমন মাথা নেই, শেখার ইচ্ছেও নেই, ঠেলেঠেলে এতটা এসেছে। একটা জায়গায় ওর জন্যে চাকরির চেষ্টা করছেন বাবা, দেবী জানে। খোকো চাকরি পেলে সংসারের অনেক সুরাহা হয়, সবাই সেই দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। তাকে নিয়ে কেউ তেমন ভাবে না। কেউ আশা করে না দেবী চাকরি করে এই সংসারের দায়িত্ব নেবে। কিন্তু সেদিন সে যখন গানের পুরস্কারের টাকা দিয়ে ময়দা, মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরল, তখন মার চোখে একটা গর্ব আর আনন্দের পাশাপাশি আশার ঝিলিকও দেখেছে দেবী। মা কিছু বলেনি মুখে যদিও। কিন্তু দেবী বুঝতে পেরেছে, সে রোজগার করলে, মার খুব আনন্দ হবে। সেটা সংসারের জন্যে নয়, শুধু তার মেয়ে এটা করছে এই জন্যে। সবাই বলে দেবী ইচ্ছে করলেই স্কুলে মাস্টারি করতে পারে। মেয়েদের পক্ষে এর থেকে সম্মানের পেশা আর নেই। আর স্কুলে কত ছুটি। তার স্কুলের বড়দি অনুরাধা ব্যানার্জি, তাকে বলে রেখেছেন, মাঝে মাঝে গিয়ে দেখা করতে। হয়তো চেষ্টা করলে স্কুলে সে ঢুকেই পড়তে পারে, কিন্তু গান, তার গানের কী হবে? সে যে চায় তার গান সবাই শুনুক। তার নিজের গান। তার খুব কান্না পায়। তার মনে হয় সে যদি মাধুরী সাহার মতো রিফিউজি হত, তাহলে সে ঠিক পাহাড়ী স্যান্যালের সঙ্গে একাই দেখা করে এতদিনে সিনেমায় গান গেয়ে ফেলত। এই যে মা ঠাকুমা ভাই বোন এত মায়ার বাঁধন, মুখের সামনে গরম ভাত, ঘি জুটে যাওয়া, একটু হাঁচি দিলেই অমনি মা লবঙ্গ গোলমরিচ তালমিছরি ফুটিয়ে পাঁচন বানিয়ে মুখের সামনে ধরছে- এতে ভেতরের আগুনটা কেমন নিভে যায়। মা এইজন্যেই বলে সংসারী মানুষ হচ্ছে উটের মতো, কাঁটা খেয়ে জিভ গাল ছড়ে রক্ত পড়বে, তবু ছাড়তে পারবে না, খেয়েই যাবে। এইজন্যেই তো লতা মঙ্গেশকর বিয়ে করেননি। কিন্তু স্নিগ্ধা সেদিন কী সব উল্টোপাল্টা বলল! ও আবার কলকাতা থেকে নতুন খবর এনেছে। খুব কম বয়সে নাকি কাকে যেন ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন লতা, একটা মন্দিরে। সেই ছেলেটি ওকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেই ধাক্কায় লতার নাকি এত জেদ। সে ফিসফিস করে বলেছিল ‘দেখবি সব বড় মানুষদের জীবনে একটা আঘাত থাকবেই। ধাক্কা না খেলে কেউ বড় হয় না। এখন দেখ না, কত লোক লতার প্রেমে পাগল! হবে না, কত টাকা, কানে দেখবি সবসময় হীরের দুল। এই তো আমাদের এখানে সলিল চৌধুরী। দেখবি লতার বেশি বাংলা গান সলিল চৌধুরীর সুরে কথায়।’
খুব রেগে গিয়েছিল দেবী লতার বিয়ের কথা শুনে, দুদিন কথাই বলেনি স্নিগ্ধার সঙ্গে। মনে হচ্ছিল তার ঈশ্বরীর গায়ে স্নিগ্ধা ইচ্ছে করে কাদা ছেটাচ্ছে। পরে সে ভেবেছে, ছোটবেলায় কত ভুল করে লোকে, স্নিগ্ধা তো একটা কথা ঠিকই বলেছে। যন্ত্রণা ছাড়া বড় হওয়া যায় না। দেবীর জীবনে কি সেরকম কিছু আছে? ভালো খাওয়া ভালো পরা –এসব নিয়ে তার তেমন কিছু সমস্যা নেই। আর মা আর দিদি এমনভাবে ঘিরে থাকে, দুঃখ তার কাছে পৌঁছয় না। তবু কী যেন একটা অভাব তাকে ঘিরে ফেলছিল। সে গুনগুন করে গাইতে লাগল-
‘যারে, যারে উড়ে যারে পাখি, ফুরালো প্রাণের মেলা… আর কেন মিছে তোরে বেঁধে রাখি?’
এই গানটা হিন্দিতেও হয়েছে। ‘যারে যারে উড়ে যারে পঞ্ছি’ নাহ, আর জানে না দেবী। হিন্দি শিখতে হবে তাকে। শক্ত কিছু না। সে তো সংস্কৃতে কত নম্বর পেত। একই তো হরফ। কিন্তু উচ্চারণটা ঠিক করতে হবে। হিন্দিতে গান গাইতে গেলে হিন্দি উচ্চারণ ঠিক না করলে হবে না। লতা নাকি বাড়িতে উর্দু মাস্টার রেখে উর্দু শিখেছেন। আসলে হিন্দি গানের কথায় অনেক উর্দু শব্দ যে। শকিল বদায়ুনি, হসরত জয়পুরি, মজরুহ সুলতানপুরি, শৈলেন্দ্র এদের প্রবণতা উর্দু শব্দ ব্যবহারের। দেবী ভাবছিল, হিন্দি উচ্চারণ সে শিখবে কী করে? উর্দুর মাস্টারই বা সে কোথায় পাবে? এসব শেখার জন্যে তো তাকে বোম্বাই না হোক, অন্তত কলকাতা যেতে হবে। কলকাতা গিয়ে সে থাকবে কোথায়? আজ গিয়ে দিদির সঙ্গে কথা বলবে ভাবল একবার। দিদির বাপেরবাড়ি তো বালিগঞ্জে। দিদি বিধবা হবার পর তারা এসে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। দিদি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। সেই রাগে তারা কোন যোগাযোগ রাখে না। সে তো বহুবছরের কথা। দিদির পরিচয় দিয়ে সে যদি সেখানে যায়, তাহলে তাকে তারা থাকতে দেবে, এমন ভাবাই মূর্খামি। দিদির সেই ভাইয়েরা বেঁচে থাকলেও তাদের বয়স হয়েছে, সংসারের রাশ নিশ্চয়ই তাদের ছেলেমেয়েদের হাতে। সেখানে দেবী গিয়ে দাঁড়ালে সবাই আকাশ থেকে পড়বে। কবে কোন মেয়ে এবাড়ি থেকে বিয়ে হয়ে অজ পাড়াগাঁয় গিয়ে পড়েছে, তার কথা কেই বা মনে রাখবে? ভাবতেই তার মনটা ভারি বিষণ্ণ হয়ে যায়। সেও বিয়ে হয়ে গেলে হয়তো কিছু বছর পরে এরকমই হবে। তার খোঁজ করতে এলে কেউ চিনতেই পারবে না। ‘কে দেবী?’ দেবী ভাবল, মেয়েদের জীবনটা এই নদীর মতো, উৎসের কাছে তার খোঁজ করতে গেলে কেউ চিনতে পারবে না। আর সব নদীই কি উৎস থেকে মোহনায় পৌঁছতে পারে? কত নদী তো মাঝপথে হারিয়ে যায়। ‘যে নদী মরুপথে হারাল ধারা, জানি হে জানি সেও হয়নি হারা।’
দেবী কি হারিয়ে যাবে?
হঠাৎ তার মাথায় একজনের নাম ঝলকে ওঠে। সেই মানুষটি তো বলে গেছিলেন বড় হয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তিনি তো একজন সঙ্গীত শিল্পীও। দেবীর কী ভাষা শেখা দরকার, ফিল্মে গান গাইবার জন্যে কার কাছে তালিম নেওয়া দরকার, সবই তিনি ছকে দিতে পারবেন। ফিল্ম লাইনটাও তো ওঁর পুরো হাতে। দেবী এটা ভেবে খুব নিশ্চিন্ত বোধ করল। মনে হল সে যেন একটা বিরাট কাজ করে ফেলেছে। সে একদিন স্নিগ্ধার সঙ্গে গিয়ে পাহাড়ী স্যান্যালের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু উনি কি তাকে চিনতে পারবেন? এতগুলো বছর চলে গেছে। না চিনতে পারুন, দেবী নাহয় অচেনা হয়েই গান গাইবার সুপারিশ করবে। এরকম তো কত লোকেই করে। মাধু, মাধুরী সাহা বলেছে তাকে। স্টুডিওর সামনে কত লোক হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সেও নাহয় সেরকম করবে। সে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবে। পাহাড়ী স্যানালের গাড়ি এসে থামবে। দেবী ছুটে যাবে। ‘চিনতে পারছেন আমাকে? আমি সেই দেবী, রাজারামপুরের দেবী। বাবার নাম শিবেন্দ্র ভট্টাচার্য। আমাদের বাড়িতে আপনারা শুটিং করেছিলেন। মনে নেই আমাকে আপনি প্রথম গ্রামাফোনে গান শুনিয়েছিলেন, লতা মঙ্গেশকরের গান? আমার গান শুনে আপনি আমাকে কলকাতায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। আমার বাবা রাজি হননি। উনি সিনেমার গান একদম পছন্দ করেন না। আসলে নিজে গাইতে পারেননি তো। মানে আমার ঠাকুমা, নিজের ঠাকুমা নয় কিন্তু।’
পাশে দাঁড়ানো একটা পুলিশ গোছের কেউ ওকে ধাক্কা দিয়ে সরাবে ‘আরে লেড়কি, বড়বড় করতে যা রহে হো। হঠো!’
পাহাড়ী কিন্তু ওকে হাত তুলে বলবেন ‘আহা বলতে দাও ওকে। খুকি, তুমি কী বলছিলে যেন। কত বছর আগের কথা এসব?’
দেবী বলবে সমস্তটা। কিচ্ছু বাদ দেবে না। শেষে বলবে ‘বাবা মত দিলেন না দেখে আপনি আমাকে বলেছিলেন, বড় হলে আমার সঙ্গে এসে দেখা করো। আমি চলে এসেছি। একটা কিছু না করে দিলে এখান থেকে নড়ব না। আপনার বাড়ি থাকতে দেবেন? নইলে সেই মাধু…’
‘মাধু!’ পাহাড়ীর গলায় বিস্ময়। ‘মাধু কে?’
দেবী বলবে ‘মাধুকে চেনেন না? সিনেমায় আপনার মেয়ে হয়েছিল, মাধুরী সাহা, ওরা রিফিউজি। সবাই বলে বাঙাল মেয়েদের জেদ খুব। আপনি দেখবেন, আমিও খুব খাটব, আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না তো?’
এইসব কথা কি আদৌ বলতে পারবে দেবী? সে তো লজ্জায় মুখ তুলেই চাইতে পারবে না। তখন পাহাড়ী স্যান্যাল হাসতে শুরু করেছেন। ‘মাধু, মাধুরী সাহা? তার বাড়ি গিয়ে থাকবে? তাহলে তো তোমাকে স্বর্গে যেতে হয় গো। নাকি নরকে? সে তো বিষ খেয়ে মরেছে তিন মাস আগে। বড্ড উড়তে শিখেছিল তো। আমাকে দেখেও না চেনার ভান করত। তারকেশ্বরের আলুর ব্যবসায়ী, তিন তিনটে কোল্ড স্টোরেজের মালিক, ঝন্টু বেরা পেট করে ছেড়ে দিয়েছে। ঝন্টু বেরা নাকি কথা দিয়েছিল ওকে বিয়ে করবে, ওর পরের ছবিটায় টাকা ঢালবে। মাগি বিশ্বাস করেছিল সেসব কথা। সাধে কি বলে বাঙাল! এই ফিল্ম লাইনে ওরকম কত কথা হাওয়ায় ওড়ে, কত মন্দিরে কত সিঁদুর পরানো হয়, কত মালা গাঁথা হয়। সিনেমার সেট সাজানো যেমন। রুপোলী পর্দাকে যেমন বিশ্বাস করতে নেই, তেমনই এইসব কথাকে। বিশ্বাস করেছ কি মরেছ। মাধুটাও মরল। মেয়েগুলো এমন বোকাই হয়। সিঁদুরের লোভ বড্ড ওদের। এদিকে মিসেস সেনকে হিংসে করে সবাই, আরে ভদ্রমহিলার ব্রেনটা দেখ? কাছে ঘেঁষতে সাহস নেই কারো। খবর পাওনি? পাবে কি করে? থাকো তো সেই অজ পাড়াগাঁয়ে। কী যেন নাম… রাজারামপুর। সেখানে তোমার বাবা রাজা, বাঁশ বনে শেয়াল রাজা! হা!হা!হা!’
অপমানে কেঁপে ওঠে দেবী। সত্যি অপমানের চেয়ে কল্পিত অপমান আরও মারাত্মক! কিন্তু এ কেমনধারা কল্পনা করছে সে? পাহাড়ী স্যান্যাল এরকম ভাষায় কথা বলতেই পারেন না। অবশ্য মাধু একবার বলেছিল, যে লোকটা সিনেমায় খুব ভালো মানুষের পার্ট করে, জানবি সে অনেকসময়ই একটা পাক্কা শয়তান হয়। আর যে ভিলেন, সে হয়তো আসলে খুব ভালো লোক, তার অনেক দানধ্যান। না না, ইনি এমন হতেই পারেন না, কিন্তু এটা কী শুনল দেবী? মাধু, মাধুরী সাহা আত্মহত্যা করেছে? তার থেকে সামান্যই বড় হবে, একুশ বাইশের বেশি বয়স হতেই পারে না। এখন নিশ্চয় আরও সুন্দর দেখতে হয়েছে। কত কী গল্প করত সে, আরও নাম করবে, আরও টাকা, কোন কোন দোকান থেকে শাড়ি কিনবে, কোথা থেকে গয়না, একটা মস্ত ফ্ল্যাট কিনবে নিউ আলিপুরে। মাকে নিয়ে থাকবে। নাহ বিয়ের কথা কিছু বলেনি তো! বরং বলেছিল ‘রজনীমাসী কি বলেছে জানিস, বলেছে, শরীর হচ্ছে তোর জমানো টাকা, সেই টাকা ভাঙিয়ে খেতে হবে। তাই হিসেব করে চলিস মাধু, বেহিসেবী হয়েছিস কি তোকে ঝেঁটিয়ে আস্তাকুঁড়ে ফেলবে। তখন সোনাগাছিতেও জায়গা হবে না।’
হিসেব করে চলার কথা বলেছিল তো, তাহলে কেন বেহিসেবী হল সে?
‘কী ভাবছেন এত একা একা বসে? আপনিও কি কবিতা লেখেন নাকি?’
চমকে পেছনে ফিরে দেখে, রফিকুল। সে খুব লজ্জা পেয়ে যায়। এতক্ষণ কী সব ভুলভাল ভাবছিল সে। যেন সিনেমা দেখছিল। কী করে এরকম ভাবতে পারল সে! রফিকুল আবার বলল ‘বাড়ি ফিরবেন না? আজ কিন্তু কম বাস চলবে’ কথাটা শুনেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে যায় দেবী আর অমনি ওর কোলের বই খাতা ঘাসের ওপর পড়ে যায়। রফিকুল ব্যস্তভাবে কুড়িয়ে দ্যায়, বলে ‘আপনার হাতের লেখা মুক্তোর মতো।’
দেবী দেখে রফিকুল এই কদিনে লজ্জা কাটিয়ে উঠেছে। দিব্যি টকাটক কথা বলে সে। আর তাকে যত রাজ্যের লজ্জা গ্রাস করেছে, যেন কোন গোপন কাজ করছিল, ধরা পড়ে গিয়ে বাক্যহারা হয়ে গেছে দেবী। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ‘হ্যাঁ যাব তো, এই একটু বসে ছিলাম, বেশ লাগছিল। ওই জাহাজটা দেখছিলাম।’
ভাদ্র মাস। কিন্তু আজ সেই পচা গরমটা নেই, বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, রোদের তাত কম, রফিকুল জাহাজটা দেখছিল।
তারপর বলল ‘বিজয়া সম্মিলনীতে গান করবেন তো?’
দেবী বলল ‘দেখি।’
বলে হাঁটতে থাকে সে। রফিকুল একটু দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে।
‘শুনুন না, এত তাড়া কীসের?’
‘এই তো আপনি বললেন বাস কম।’
‘আমি আপনাকে সাইকেলে করে দিয়ে আসব, চিন্তা করবেন না।’
দেবী এত অবাক হল যে খানিকক্ষণ কোন কথা খুঁজে পেল না। সাহস কম নয় তো ছেলেটার! প্রথমে তো কথাই বেরোত না মুখ দিয়ে। আর এখন সাইকেলে চাপাতে চাইছে। সে একটা ছেলের সঙ্গে সাইকেলে চেপে গ্রামে ফিরবে?
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রফিকুল আবার বলল ‘আমি আপনাকে খাদি মন্দির স্টপে নামিয়ে দেব, ওখান থেকে হেঁটে চলে যাবেন, কেউ দেখতে পাবে না।’
দেবী ঠোঁট কামড়ে ভাবছিল। রফিকুল বলল ‘অত ভাবতে হবে না। চলুন চলুন, যেতে যেতে কথা হবে।’
দেবী বলল ‘কিন্তু আপনি কী করে খাদি মন্দির চিনলেন? আপনার বাড়ি তো সর্ষে ছাড়িয়ে শিবানীপুর না কোথায়।’
‘কেন যেতে নেই আপনাদের ওখানে? একবার গেছিলাম। খাদি মন্দির।’
‘আমাদের বাড়ি গেলেন না কেন?’
‘ইচ্ছে হয়েছিল খুব। কিন্তু ভয় হল।’
‘কেন? ভয় কীসের?’
‘আমি মুসলমান তো।’
‘আমার বাবাকে আপনি জানেন না। আমার বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রের নাম খালেদ। খালেদদা অপূর্ব বাঁশি বাজায়। মাঝেমাঝেই বিকেলে খালেদদাকে নিয়ে বাবা একটা ছোট মসজিদে যায়। ওদের নামাজ হয়ে গেলে ওখানে বসে ভজন গায়।’
রফিকুল অবাক হয়ে গেল শুনে। তার অভিজ্ঞতায় এমন লোকের কথা শোনেনি সে। ভারি লোভ তার এমন সব লোকের সঙ্গে মেশার। কিন্তু যখন দেখে তার খাওয়া জলের গ্লাস আলাদা করে রাখা হচ্ছে, তখন সব ভাললাগার সুর কেটে যায়।
তবু ভীষণ ভালো লাগছিল এই সাইকেল যাত্রা। এক অপূর্ব স্বাদে ভরে যাচ্ছিল মন। নদীর ধার দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাবে এই সাইকেলটা। আচ্ছা সাইকেলটা যদি জাহাজের ওপর গিয়ে বসে।
হঠাৎ একটা মস্ত লরি ঝড়ের মতন সামনে এসে পড়ল। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল দেবী।
যারে যারে উড়ে যারে পাখি
বাড়ি এসে দেখল বাবা আর একজন কে বসে বাইরের ঘরে।এখনও বেশ বিকেল আছে। অন্যদিন অনেকে এসে যায়। আজ এত ফাঁকা কেন? দেবীর মনে পড়ল, ওহ, আজ তো বাবার গানের ক্লাস থাকেই না বাড়িতে। আজ তো বাবা কুলপি যান, ফেরেন অনেক রাতে। আজ কোন কারণে যাননি। কিন্তু কী কারণ হতে পারে? হাজার ঝড় বৃষ্টিতেও টিউশন বন্ধ করেন না শিবেন্দ্র। বাস বন্ধ থাকলে ভ্যানে যাবার চেষ্টা করেন। সেই কুলপিতে জমিদার বাড়ির বিরাট একটি ঘরে গান শেখার ব্যবস্থা। এই পরিবারের জ্ঞাতি গুষ্টি মিলিয়ে দশটি মেয়ে শেখে, এর পরে আর একটি উকিলের বাড়ি তিনজনকে শিখিয়ে শেষ বাস ধরেন শিবেন্দ্র। এই এতগুলি টিউশন না যাওয়ার পেছনে নিশ্চয় খুব বড় কোন কারণ আছে। তাহলে কি বাবার শরীর খারাপ? এতখানি জীবনে বাবাকে কোনদিন অসুস্থ হতে দেখেনি দেবী। কালো পাথরে কোঁদা তাঁর শরীর, শীত গ্রীষ্ম, রোগ কিছুই ছুঁতে পারে না। বলতে নেই, তিনি খানও প্রচুর, আর সেই অনুপাতে পরিশ্রমও করেন। তাঁকে দেখে শরীর খারাপ মনে হল না। বেশ হেসে হেসে কথা বলছেন আগন্তুকের সঙ্গে। কে ছেলেটি? চেনে চেনা মনে হলেও চিনতে পারল না দেবী। শিবেন্দ্র ওকে দেখে বললেন ‘হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে আয়। গান শোনাতে হবে।’
এ ব্যাপার নতুন নয়। কোন অতিথি এলে দেবীর গান শোনানোর ফরমাশ হয়। দেবী মনের মধ্যে একটা গানের সুর খুঁজতে খুঁজতে ভেতরে এল। কী গাইবে? আজ মুনাই বাইরে তার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল না। মানে সে খেলতে গেছে, কার সঙ্গে গেল? কেন ছাড়ল মা? সে না থাকলেই মুনাইকে দেখার কেউ থাকে না। এত বড় বাড়ি, এতগুলো লোক, অথচ মেয়েটার চুল আঁচড়ানো হয় না, জামা পাল্টানো হয় না, বসে যে একটু খাইয়ে দেবে, এই ধৈর্যও কারো নেই। অবশ্য মাকে দোষ দেওয়া যায় না, দিনদিন মা এইসব কাজ থেকে সরেই গেছে। বিছানা তোলা, আলনা গোছানো, ভাইবোনদের দেখাশোনা, এসব দেবীই করে। কিন্তু সে তো সবসময় বাড়ি থাকে না। তার পরের দুই বোন বিন্তি আর তুলি – এরা স্কুলে গেলেও গ্রামের স্কুল, বাড়ি থেকেই দেখা যায় স্কুলের পাঁচিল। তারা তো কেউ একটু মুনাইকে দেখতে পারে। দেবীর মনে হয় মুনাই একটা দেবশিশু। ওকে ঠিকমতো দেখাশোনা করলে ও বড় হয়ে একজন মস্ত মানুষ হবে। এত কম বয়সেই ওর কেমন বুদ্ধি। গান শুনলেই তুলে নেয় টপ করে। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেমন নাচতে শিখেছে। ওকে দেখলে দেবীর বুকের ভেতরটা কী যে করে। ওদের চারবোনের মধ্যে মুনাইকেই সবচেয়ে সুন্দর দেখতে। কী মায়াকাড়া মুখ। ঝামুর ঝুমুর চুলগুলো সবসময় মুখে এসে পড়ছে। বাড়ি ফিরে দেবীর প্রথম কাজ ঐ চুলগুলো আঁচড়িয়ে টেনে দুটো বিনুনি করে দেওয়া। আজ সদর দরজার সামনে মুনাইকে দেখতে না পেয়ে খুব মন খারাপ হল দেবীর। কার সঙ্গে গেল কে জানে! মানিনীমাসীর সঙ্গে বাইরে যাবার ঝুলোঝুলি করলেও সে ওকে আর নিয়ে যায় না মার ভয়ে। এক হতে পারে, সামনের রামপদ হালদারের বাড়ির ছোট বউ নিয়ে গেছে। এ সময় ওরা সারাদিনের পর শাড়ি কেচে চুল বেঁধে খাদিমন্দিরের কলে জল আনতে যায়। অনেক বউ ঝি জড়ো হয় গ্রামের, অনেকক্ষণ গজালি করে সন্ধে নামার মুখে ওরা ফেরে। কোলে করেই নিয়ে যায় মুনাইকে, বাসরাস্তাও নয়। কিন্তু দেবী চায় না ওদের সঙ্গে যাক মুনাই। সব বউগুলো একজায়গায় হলেই তো যত আজেবাজে গল্প, শাশুড়ির নিন্দে, নইলে বর রাতে কী করে, কে মদ খেয়ে এসে মারধোর করে এইসব। কোন ভালো আলোচনা নেই। মুনাইকে নিয়ে গিয়ে কেবল বলবে ‘ও নোনো, একটা শোলোক বল না’ মুনাই ওদের সঙ্গে যায় তেঁতুলের লোভে। মস্ত তেঁতুল গাছ আছে ওদের। সেই তেঁতুল জরানো খেতে পাবে বলে মুনাই যেতে চায় ওদের সঙ্গে। ছোট মানুষ, অত তেঁতুল খেলে জ্বর হবে না? খুব রাগ হচ্ছিল মার ওপর, বিন্তির ওপর, তুলির ওপর। তুলির গায়ের রঙ খুব ফর্সা আর সে ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট হয় বলে, নিজেকে একটা অন্য কিছু ভাবে। সংসারের কুটোটি ভেঙে দুখানা করে না। উপরন্তু বিন্তিকে দিয়ে নিজের জামা এমনকি ইজের পর্যন্ত কাচাতে চায়। সংসারের কাজ না করুক, মুনাইকে তো একটু দেখে রাখতে পারে। মাথায় দাউ দাউ রাগ নিয়ে ভেতরে এল দেবী।
কিন্তু ভেতরে এসে সে দেখল মুনাই উঠোনে মাদুরে বসে আপন মনে খেলছে আর তুলি ওর চুল বেঁধে দিচ্ছে। দেখে ভালো লাগাই উচিত ছিল দেবীর, কিন্তু ওর বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা কষ্ট হল। মুনাই বাড়িতেই ছিল, কিন্তু বড়দির জন্যে সে দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়নি, এমন কখনো হয়নি, দেবী নিজেকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করল এই ভেবে যে মুনাই ছোট মানুষ, ওর কি আর সময়ের জ্ঞান আছে? কারো কাছে আদর পায় না, তাই তুলি যে ডেকে চুল বেঁধে দিচ্ছে, এতেই ও আরো সব ভুলে গেছে। দেবীর, কোন কারণ নেই, চোখে জল এল। সে ঘর থেকে একটা ধোয়া শাড়ি জামা আর গামছা নিয়ে খিড়কি পুকুর ধারে চলে গেল। তাদের বাড়ির ভেতরেই কল পায়খানা আছে, যা গ্রামে কারো বাড়িতেই নেই। তবু দেবী পুকুরেই স্নান করতে বা গা ধুতে ভালো বাসে। খিড়কিপুকুরে গা ধুতে ধুতে আকাশে তারা ফুটতে দেখল দেবী। সে ভাবছিল তাদের সাইকেলের সফরের কথা। হঠাৎ পেছন থেকে বিন্তি ডাকল ‘ও বড়দি, বাবা তোমায় ডাকছে’ ইস, দেবী ভুলেই গেছিল বাবা ডেকেছিল সেই কখন। সে তাড়াতাড়ি করে সাবানের বাক্স নিয়ে পুকুর থেকে উঠে এল। শাড়ি পরে বাইরের ঘরে যাবে, মা বলল ‘খেয়ে যা, সাবু মাখা রেখেছে দিদি।’ সাবু মাখা বলেই দাঁড়িয়ে গোগ্রাসে খেয়ে নিল দেবী। খুব খিদে পেয়েছিল। খালি পেটে কি গান গাওয়া যায়?
পর্দা সরিয়ে বাইরের ঘরে আসতেই বাবা গম্ভীর গলায় বললেন ‘আয়। এত দেরি করলি কেন? সুকোমল তো আবার ফিরবে এতটা। অন্ধকার হয়ে গেছে। বেচারি একটা চোখে…’
দেবী চমকে তাকাল। যে ছেলেটি বসে আছে, তার বসার ভঙ্গিটি ঠিক আর পাঁচজনের মতো নয়। তার বাঁ হাতটি বাঁকা, মোটা কাচের আড়ালে বাঁ চোখটি ঘোলা, বোঝা যায় দৃষ্টি নেই তাতে। এতক্ষণে বুঝল কেন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল ওকে। সেই যেদিন সে প্রাইজের টাকায় ময়দা মিষ্টি কিনে এনেছিল, বাবা ছিল না বাড়িতে, সেদিন এই ছেলেটাই পরদা সরিয়ে উঠোনে এসে বাবার খোঁজ করেছিল।
দেবী কিছু না বলে ছেলেটাকে দেখছিল। কেমন মায়া হচ্ছিল ওর। ওর জন্যে এই প্রায় অন্ধ ছেলেটিকে অন্ধকার গ্রামের পথে হেঁটে ফিরতে হবে ভাবতেই তার অপরাধবোধ হচ্ছিল। সে ছেলেটিকে বলল ‘কিছু মনে করবেন না। আমার জন্যে আপনার দেরি হয়ে গেল।’
ছেলেটি কিছু বলার আগেই শিবেন্দ্র বললেন ‘অত আগড়ম বাগড়ম না বকে গান কর। ও তো ফিরবে।’
দেবী কিছু না ভেবেই হারমনিয়াম নিয়ে গাইতে শুরু করল ‘ও বাঁশি, কেন হায়, আমারে কাঁদায়’
শিবেন্দ্র একটু কি বিরক্ত? আধুনিক গান তিনি পছন্দই করেন না। হেমন্তের সম্পর্কে বলেন ‘ওইসব রাংতা’ কিন্তু তিনি লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কে কিছুই বলেন না। একবার লতার গলায় ‘না যেও না, রজনী এখনো বাকি’ শুনে তিনি নিচুস্বরে বলেছিলেন ‘তারসপ্তকে অত লাবণ্য, কোমল মা-টা কেমন ছুঁইয়ে নিল’ সুকোমলের সমস্ত শরীর এই বাঁশির মতো বেজে উঠতে চাইছিল, কিন্তু তার মন যে খবর পায়, শরীর তা পায় না। ক্লাস ফোরে পক্স হয়ে তার চোখ হাত পা সব গেছে। স্কুল ছেড়ে দিতে হল। গানের গলা আর সুরের বোধ শুধু নিতে পারেনি এই অসুখ। স্কুল ছাড়লেও পড়া বন্ধ হয়নি তার। বাড়িতে মেজদার কাছে পড়েছে সে। এইভাবেই বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ নিয়েছে, সঙ্গীত, সিনেমা, নাটক সারা পৃথিবীতে কোথায় কী ঘটছে জানতে বাকি নেই তার। ম্যাট্রিক দেবার পর মেজদা কলকাতায় চলে গেলে তার খুব মন খারাপ হয়েছিল। বাবা আর বড়দা তো আগে থেকেই থাকে কলকাতায় বাসা ভাড়া নিয়ে। সেন্ট্রাল এভিনিউর কাছে সেই বাড়ি, মেজদা চলে যাবার পর ছোট ভাইও চলে গেল। তাকে নিয়ে যাওয়া হল বাধ্য হয়ে। কারণ সে একদম মায়ের কথা শোনে না, ইস্কুলে যাবার নাম করে সারা দিন গুলি খেলে আর ঘুড়ি ওড়ায়। কলকাতায় গিয়েও সে শুধরোয়নি। ইস্কুল পালিয়ে সে নাকি টালিগঞ্জে স্টুডিও পাড়ায় গিয়ে নায়ক নায়িকাদের অটোগ্রাফ নেয়। সুকোমল ভাবে সে এক স্বপ্নের জগত বুঝি। সে কানা খোঁড়া বলে কখনোই যেতে পারবে না কলকাতা? মোটে তো একঘণ্টার পথ এখান থেকে। কলকাতায় গেলে সে তার গানের জগতটাকে খুঁজে পেত। এখানে গ্রামে কতটুকু শেখার সুযোগ? ছোট থেকে সে বাবার সঙ্গে যাত্রা করে। বেশির ভাগই অন্ধ বালকের পার্ট। তার গান শুনে চোখের জল রাখতে পারে না কেউ। কিন্তু এই গ্রামদেশ বড় ছোট জায়গা। এখানে প্রতিভা গুমরে গুমরে মরে। কেউ বোঝেই না কিছু। সারাদিন খালি গুলতানি আর এর ওর হাঁড়ির খবর ঘাঁটা। এই মানুষটা অন্যরকম। কত নাম শুনেছে এঁর। এতদিনে আসতে পারল। আর এই মেয়েটি, এ কি কিন্নরী? এই গানটা তো লতা মঙ্গেশকরের। কী নিখুঁত গাইল মেয়েটি, কত দরদ দিয়ে। গান শেষ হবার পর কথা বলতে একটু সময় লাগে শিবেন্দ্ররও। তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙে তিনি গম্ভীর গলায় বলেন ‘গাইতে বললেই কেন যে তোদের এইসব গান মনে পড়ে? কত যত্ন করে রাগগুলো শেখালাম।’
দেবী জানতই বাবা একথা বলবে, প্রথম গানটি গাইতে গাইতেই সে ঠিক করে নিয়েছে পরের গানটা। সে সঙ্গে সঙ্গে ধরল ‘পানিয়া না ভরনে যাউ সখি অব/ মোহন মুরলিয়া না বজে যমুনা তীর।’
অদ্ভুত একটা আবেশ ছড়িয়ে যায় চারদিকে। মনে হয় এই অখ্যাত রাজারামপুর গ্রামটা মুছে গেছে, সুকোমল বসে আছে এক উজ্জ্বল জ্যোতির্মণ্ডলে। সে ঘোরলাগা গলায় বলে ‘দেশ দেশ!’
গান থামার অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত কেউ কথা বলতে পারে না। দেবীর গানের একটা মেজাজ এসে গেছে, সে এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গেয়ে যেতে পারে এইভাবে। কিন্তু এই ছেলেটিকে অনেকটা পথ যেতে হবে, তাই সে তৃতীয় গানে না গিয়ে চুপ করে বসে রইল। শিবেন্দ্র শেষে বললেন ‘এবার তুমি না উঠলে মুশকিলে পড়বে, তোমার বাড়ি তো বোলসিদ্ধি।’
বোলসিদ্ধি! দেবী ভাবল, মাঝখানে তো বারাদ্রোণ গ্রাম পড়ে। এতখানি রাস্তা এ বেচারা একা যাবে কী করে?
সুকোমল সেটা যেন বুঝতে পেরেই বলল ‘আমাদের গ্রামের বলাইদা এসেছে একটা কাজে খাদি মন্দিরে। ওর সঙ্গে ফিরব। পাঁচ বাটারির টর্চ আছে সঙ্গে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমার হাঁটতে কোন অসুবিধে হয় না।’
দেবী নভাই অন্তুকে ডেকে বলল ওকে খাদি মন্দির অব্দি এগিয়ে দিতে। যাবার আগে শিবেন্দ্রকে নিচু হয়ে প্রণাম করে সুকোমল। শিবেন্দ্র বলেন ‘তাহলে তুমি রবিবার রবিবার সকাল করে এসো। সকালেই তোমার সুবিধে হবে।’
‘হ্যাঁ মাস্টারমশাই। এই রবিবার মেজদা আসবে না। সামনের রবিবার আসবে। তখন কথা বলতে পারব।’
শিবেন্দ্র এর উত্তরে কেমন খাপছাড়াভাবে বলে উঠলেন ‘চাটার্ড পরীক্ষার জন্যে তৈরি হচ্ছে তো? খুব কঠিন পরীক্ষা শুনেছি। তবে বোলসিদ্ধি গ্রাম তো পণ্ডিতদেরই গ্রাম। তোমাদের বংশ জানো তো, মহা নৈয়ায়িকদের বংশ। বিরজাপ্রসাদ বাবু, মানে তোমার বাবা অবশ্য ইংরেজি আর অ্যাকাউন্টেন্সিতে অত্যন্ত মেধাবী, সাহেবদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে চাকরি করা কি মুখের কথা?’
সুকোমল গর্বিত মুখে বলল ‘মার্টিন বার্ন কোম্পানির চাকরি তো গেছিল স্বদেশী করতে গিয়ে। বাবা ওখানকার চিফ অ্যকাউন্টেন্ট ছিলেন। ’৪২ সালে গান্ধীজির ডাকে একদিন রাস্তায় হাঁটলেন। পরের দিন অফিসে গিয়ে দেখেন টেবিলে বরখাস্তর চিঠি। সাহেবকে সেই চিঠিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘কেন আমাকে বরখাস্ত করা হল?’ সাহেব বললেন ‘আস্ক গান্ধী’। তারপর তো এই গ্র্যান্ড হোটেলে।’
গলা ফাটিয়ে হাসেন শিবেন্দ্র ‘আস্ক গান্ধী! সাহেবের রসবোধ আছে। ওই একই সময়ে আমার মেয়ের জন্ম, জানো তো, আর ওর যখন তিন বছর বয়স, গান্ধী একবার কুঁকড়োহাটি থেকে হাজিপুরে এসেছিলেন। তখন আমাকে বিনয় ঠাকুর ডেকে বলেছিলেন একটা গান শোনাতে হবে বাপুকে। উনি নিশ্চয় রামধুনের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু আমার মন চাইল আমি নতুন একটা গান বাঁধি। এতবড় মানুষটা আসছেন। সমস্ত দেশকে যিনি একসঙ্গে বাঁধার চেষ্টা করছেন। আমি একটা গান বেঁধেছিলাম এই দেশ রাগের ওপর। কিন্তু গানটা গাইতে পারলাম না’ বিষণ্ণতা ফোটে শিবেন্দ্রর মুখে। ‘কেন? গাইতে পারলেন না কেন?’
‘এত লোক হয়েছিল সে সভায়। গান্ধীজীর জন্যে সবাই অপেক্ষা করছিল অধীর হয়ে। তাঁর আসতে দেরি হয়েছিল। তখন আর গানের সময় ছিল না। আসলে তুমি গান শিখতে চাও তো, তাই বলে রাখি, গান জিনিসটার স্থান অনেক পরে দেখবে। আগে এইসব চাল ডাল রাজনীতি। লোকের চাকরি গেলে বা পয়সার টানাটানি হলে দেখবে সবার আগে গানের মাস্টারকে ছাড়ানো হয়’
সুকোমল কেমন বিষণ্ণ মুখে চলে যাচ্ছিল। ওর যাওয়া দেখে দেবী বুঝতে পারছিল হাঁটতে বেশ অসুবিধেই হয় ওর। তবু এত কষ্ট করে এসেছে গান শিখবে বলে। গানের যদি কোন দামই না থাকে, তাহলে কি এমনটা হতে পারত? আর কি আশ্চর্য ঘটনা, সুকোমলের বাবা আর শিবেন্দ্রর জীবন একটি মানুষের সূত্রে গাঁথা। তাঁর নাম গান্ধী!
আমি চলতে চলতে থেমে গেছি
সেই যে বিজু পুজোর সময় নৈহাটি চলে গেছিল, ফিরল রাস পূর্ণিমার আগে আগে। সে এত দেরি কখনও করে না। বিজয়া খুব চিন্তা করছিলেন। তাঁর তাড়নায় দেবী স্নিগ্ধাকে বলেছিল তার বাবাকে বলে একটা ফোন করাতে সেজমামার জুটমিলে। সেই ফোনে জানা গেল বিজু ওই মিলে অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে ঢুকেছে, প্রতিদিন হাতে কিছু পায়, তিন মাস পর পাকা হলে মাস মাইনে পাবে। আনন্দের হিল্লোল পড়ে গিয়েছিল বাড়িতে। খোকোর সরকারি চাকরির চেষ্টা হচ্ছে খুব, কিন্তু সে এখনো চাকরি পায়নি, বিজু ম্যাট্রিকটাও দেয়নি, তার ওপর উড়ুঞ্চুড়ে, ওকে নিয়ে বিজয়ার দুর্ভাবনার শেষ নেই। শিবেন্দ্র গম্ভীর গলায় বলেছিলেন ‘শেষ পর্যন্ত চটকল!’
বিজয়ার বাবা স্কুল মাস্টার ছিলেন, কিন্তু ভায়েরা সবাই চটকলে। সে নিয়ে শিবেন্দ্র বরাবর তাচ্ছিল্য দেখিয়ে এসেছেন। বিজয়ার ভায়েরা এলে যত্ন আত্তির কোন অভাব হয় না, সাধ্যের অতিরিক্ত খরচই করে থাকেন শিবেন্দ্র। কিন্তু তাঁর আচরণে তাঁর সংস্কৃতির অহঙ্কার গোপন থাকে না। বিজয়া ভাবেন, ভায়েরা তো এর ওর কাছে ছেলেকে দিয়ে টাকা ভিক্ষের চিরকুট পাঠায় না। আত্মসম্মানই যদি না থাকে তবে কীসের সংস্কৃতি? তার ওপর তাঁর পরিবারে মেয়েদের অবস্থান এত খারাপ নয়। বিয়ের পর থেকে তিনি শুধু হাঁড়ি ঠেলছেন আর সন্তানের জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন। কে বলবে তিনি ক্লাস ফোরে বৃত্তি পাওয়া মেধাবী মেয়ে? বিয়ের পরেও তো তিনি কত কী করতে পারতেন। রাজারামপুর তো অজ পাড়াগাঁ নয়। এখানে, বিদ্যুত নেই, কিন্তু বিদ্যুতের চেয়েও আলোদায়ী খাদি মন্দির আছে। সেখানে তিনি কি একটা কাজে লেগে যেতে পারতেন না? চরকা কাটা, নারী শিক্ষা, কোন একটা কাজ? শ্যামার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গ্রামে গ্রামে তিনিও মেয়েদের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বেলে দিতে পারতেন। তার কিছুই না করে, তিনি শুধু সন্তানের জন্ম দিয়ে গেলেন। এতগুলি সন্তান কী খাবে, কী করবে-তার কোন ঠিক নেই। বিজু চাকরি পেয়েছে শুনে বুকের মধ্যে একটু ভরসা পেয়েছিলেন। সে যখন হঠাৎ করে ফিরে এল, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল। যে ছেলের খবর না পেয়ে তিনি পাগল হতে বসেছিলেন, তাকে চোখের সামনে দেখেও তিনি খুশি হতে পারলেন কই? গ্রাম্য প্রাকৃত নারীর মত তিনি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন না যদিও, ওরা হাত মুখ ধুয়ে কিছু মুখে দিলে, তিনি এসে বললেন ‘কী রে বিজু, এখন ফিরে এলি যে? এই যে শুনলাম তিন মাস পরে চাকরি পাকা হবে, এখন হুট করে চলে আসা কি ঠিক হল?’ বিজু উত্তরে চুপ করে আছে দেখে তাঁর কেমন সন্দেহ হল। ‘কী রে? ছেড়ে দিয়ে আসিসনি তো? ঝগড়া করে এসেছিস নাকি?’ এবারও বিজু কোন উত্তর দিল না। পাশ থেকে সন্দীপ বলল ‘ও মাসীমা, আমি বলছি শোন।’
সন্দীপ, বিজয়ার বড়দির ছেলে, বিজুর সঙ্গে এসেছে। বিজুই ধরে নিয়ে এসেছে বলা যায়। সে ভেবেছে, সঙ্গে কাউকে নিয়ে গেলে তাকে কম কথা শুনতে হবে। কারণ তাদের মা বিজয়া, গ্রামের আর পাঁচটা মহিলার মত নন। তাঁকে কেউ কখনো চেঁচিয়ে কথা বলতে শোনেনি। খুব নিচুস্বরে কথা বলেন, সেই কথাই ছেলেমেয়েরা অক্ষরে অক্ষরে মানে। এমন তাঁর ব্যক্তিত্ব। বাইরের লোকের সামনে তিনি কখনোই ছেলেমেয়েদের বকবেন না। তাঁর আত্মসম্মানবোধ প্রখর। সেই বিজয়ার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তিনি তাও সামলে নিয়ে সন্দীপকে বললেন ‘তুই কেন বলবি? আমি ওর মুখ থেকেই শুনতে চাই।’
বিজু দেখল মার মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। সে বিছানায় উঠে বসে বলল ‘রাগ করো না মা, চটকলের কাজ আমার পোষাবে না। প্রচণ্ড খাটনি বলে নয়। খাটতে আমার ভয় নেই। কিন্তু যাদের সঙ্গে কাজ করি, তাদের মুখের ভাষা এত নোংরা, সারাক্ষণ বাজে আলোচনা, কাজ শেষ হলেই আমাকে নিয়ে মদের ঠেকে নিয়ে যেতে চায়।’
স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন বিজয়া। তাঁর মানুষ করার মধ্যে কি তাহলে ভুল থেকে গেল? ছোট থেকেই ওদের কড়া শাসনে মানুষ করেছেন তিনি। একবার দেবী বাইরে থেকে একটা গালাগালি শিখে এসেছিল, ওকে নারকেলের ডেগো দিয়ে মেরেই ক্ষান্ত হননি, ওর মুখে গোবর পুরে দিয়েছিলেন। এ বাড়ির মধ্যে সবসময় ছেলেমেয়েরা গান করে, নাচ করে, আবৃত্তি করে, এমনকি উঠোনে স্টেজ বেঁধে নাটকও করে। কিন্তু বাইরের পৃথিবীটা তো এমন নয়। তিনি নিজে গরিফার মেয়ে, তিনি জানেন কলকারখানার পরিবেশ বাড়ির পরিবেশ থেকে একদম আলাদা। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের তাই ওখানে কাজ করতে অসুবিধে হয়। সেই সুযোগে চটকল ভরে গেছে বিহার থেকে আসা মজুরে, যাদের বাঙালিরা খোট্টা বলে ঠাট্টা করে। এরা খাটতে যেমন পারে, তেমনি এদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে বাঙালির মতো কোন বায়না নেই। তাঁদের মতো নিম্নবিত্ত বাঙালি পরিবারেও সাধারণ দিনে যতগুলি পদের রান্নাবান্না হয়, তা দেখলে এদের চোখ কপালে উঠবে। এরা দরকার হলে ফুটপাথে শুয়ে পড়তে পারে, লংকা পেঁয়াজ দিয়ে ছাতু মাখা খেয়ে কাটিয়ে দ্যায়, রুটির সঙ্গে ডাল জুটলেই মনে করে খুব ভালো খাওয়া। তারা যেমন গালাগাল খেতে পারে, তেমনি উলটে দিতেও পারে। সেখানে তাঁদের বাড়ির ছেলে কীভাবে মানিয়ে নেবে? কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন বিজু পারবে। ও তো সুযোগ পেলেই নৈহাটি চলে যায়, সেখানে অনেক বন্ধুও হয়েছে তার, যারা কেউ কেউ চটকল শ্রমিক পরিবারের ছেলে, আর তাঁর ভাইরাও তো আছে। সেই বিজুও পারল না? তিনি যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, তাঁর ছেলে একটা চাকরি পাবে, বড়বাবুর কাছে চেয়েচিন্তে সংসার চালানোর গ্লানি থেকে তাঁর মুক্তি ঘটবে। তা আর হল কই?
তিনি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। বিজুও কথা খুঁজে পায় না। সন্দীপ বলে ওঠে ‘চিন্তা করো না ছোট মাসীমা। বড়দির বিয়ে হয়ে গেলে ওকে আবার একটা চটকলে ঢুকিয়ে দেবে মামা। আসার সময় কথা হয়েছে।’
বিজয়া চমকে ওঠেন ‘দেবীর বিয়ে! কী বলছিস কী?’
‘সে কি গো! মেসোমশাই তো মামাকে চিঠি লিখেছে। বোলসিদ্ধি গ্রামের এক ছেলের সঙ্গে বড়দির বিয়ের কথা চলছে। ছেলে নাকি যেমন পড়াশোনায়, তেমনি অপূর্ব দেখতে। চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ছে। আবার একটা ফার্মে চাকরিও করে।’
বিজয়ার কানে এসব কিছু ঢুকছিল না। তিনি যেন জলের অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মেয়ের বিয়ে, অথচ তিনি কিছু জানেন না! দেবীকে নিয়ে তাঁর আশা সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। তিনি যে মনে মনে ঠিক করেছিলেন, দেবী গ্র্যাজুয়েশনটা করলেই ওকে যেভাবে হোক, কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন, তাঁর শাশুড়ি স্মৃতিকণার সঙ্গে তাঁর কথাও হয়েছে, স্মৃতিকণার বড় ভাইয়ের ছেলে হঠাৎ একদিন এসেছিল, হাজিপুরে একটা বড় হোটেল তৈরি হচ্ছে, সেই কাজটা নাকি সে করছে, পরমেশ। সেদিন পরমেশকে দেবীর কথা বলেছেন, দেবী সেদিন কলেজে ছিল, তাই ওর গান শোনাতে পারেননি, কিন্তু সে যে অসাধারণ গায়, পাহাড়ীবাবু যে ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, এ কথা সবিস্তারেই বলেছেন স্মৃতিকণা। আর পরমেশ সব শুনে বলেছে, ফিল্ম লাইনে অনেক চেনাশোনা তার। এমনকি খুব শিগগির হয়তো সে ফিল্ম প্রোডাকশনে টাকা লগ্নি করবে। দেবীকে সে প্লেব্যাক করার ব্যবস্থা করে দেবে।
স্মৃতিকণা বাস্তববাদী মানুষ। এ কথা শুনে তিনি বলেছেন ‘কিন্তু এখান থেকে তো রোজ যাতায়াত সম্ভব নয়, কলকাতা শহরে একা মেয়েমানুষ থাকবে কোথায়?’
পরমেশ অমনি বলেছে ‘এ কি একটা চিন্তা করার মতো কথা হল? আমাদের অত বড় বাড়ি, সে তো তোমারই বাড়ি।
সেখানে থাকবে। আর একা যদি ছাড়তে না চাও, তবে তুমিও থাকবে সঙ্গে। তোমার নিজের বাড়ি।’
সেই কথায় স্মৃতিকণার ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। ছোট পুকুরে যদি গঙ্গার ঢেউ এসে লাগে তাহলে যেমন আলোড়ন হয়, তেমনি মনে হয়েছিল। তাঁর বাড়ি! কবে কোন কোন কৈশোরে ছেড়ে এসেছিলেন, তারপর একবার হয়তো গেছেন, তবু বুকের মধ্যে একদম স্পষ্ট সব। লাল টকটকে মেঝে, খড়খড়ি দেওয়া জানলা, তিনতলা বাড়ি, ছাদে বা বারান্দায় দাঁড়ালে বালিগঞ্জ স্টেশন স্পষ্ট দেখা যায়। এদিকে সরোজনলিনী সেলাই স্কুল, দোতলায় তাঁর ঘরের লাগোয়া একটা ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়ালে একটা কদমগাছ, বর্ষায় তার পাগল করা গন্ধ। ওপাশে একটা মহিলা পরিচালিত ক্যান্টিন, নানারকম খাবারের সুগন্ধ ভেসে আসে। শুধু তো দেবীর গানের নয়, তাঁরও তো ঘরে ফেরা। সব মুছে গেল বড়বাবুর স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তে!
কথা হচ্ছিল স্মৃতিকণার ঘরে বসে। অন্য ঘরগুলোর তুলনায় এই ঘরটি ছোট হলেও, সবচেয়ে পরিপাটি। তক্তপোষের ওপর পরিষ্কার চাদর টান করে পাতা। আলনায় সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা কাপড়। তাঁর সাদা থান, শেমিজ ওপরের স্ট্যান্ডে, নিচে দেবীর কাপড়। দেবী এখন এই ঘরে শোয়। এই ঘরটির মধ্যে এমন একটা চোখের আর মনের আরাম পাওয়া যায় যে ছেলেমেয়েরা সুযোগ পেলেই এই ঘরে এসে বিছানা ধামসায়। স্মৃতিকণা বিরক্ত হন, তবে তিনি রাতে সমস্ত বিছানা ঝেড়ে ধোয়া চাদর পাতেন। তাঁর কাছে থেকে থেকে দেবীও তাই শিখেছে। কোন নিভৃত আলাপের জন্যে বিজয়া এই ঘরটাই পছন্দ করেন। আজ বিজু আর সন্দীপ আগে থেকেই এখানে বসে আছে, বিজয়া তক্তোপোশের এককোণে বসে। মেঝেতে স্মৃতিকণা জলচৌকিতে বসে জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটছিলেন। তিনি সেখান থেকেই বললেন ‘শিবেন্দ্র সারাজীবন একবারই আমার কথা শুনেছিল, সে এখানে চলে আসা। সে কথা শোনার ফল তো দেখলে। দোকানটাই থাকল না। এই বিয়ে নিয়েও আমি কিছু বলব না। তুমি ভেবে দেখো বউমা। আমাদের সামনে যে দুটো রাস্তা আছে, সে দুটো কি ভারে সমান?’
বিজয়া দিশাহারার মতো তাঁর শাশুড়ির দিকে তাকালেন। কী দুটো রাস্তা আছে, মাথায় ঢুকছিল না তাঁর।
স্মৃতিকণা বললেন ‘দুটো রাস্তা। এক হচ্ছে মেয়েকে একেবারে অনিশ্চয়ের পথে গান গাইবার জন্যে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া। আমার ভাইপো, বড় হয়ে যাবার পর তাকে আমি প্রথম দেখলাম। কত বছর আমি যাইনি বলো তো? বাড়িটা আদৌ আছে কিনা, সেটাই তো আমরা জানি না। পরমেশের কথার ভরসায় পাঠানো। নৈহাটি ছাড়া এ তল্লাটের বাইরে কখনো কোথাও যায়নি দেবী, এটা মনে রেখো। আরেকটা হচ্ছে, শিবেন্দ্র যেমন বলছে, এই ছেলেটির সঙ্গে দেবীর বিয়ে দিয়ে দেওয়া। যতদূর শুনছি, এই সম্বন্ধ যেচে এসেছে। ছেলে খুব ভালো, দেখতে সুন্দর। তাছাড়া, ওদের খুব বনেদি বংশ। এখন পয়সা নেই ঠিকই, কিন্তু ওরা মৃত্যুঞ্জয় তর্করত্নের বংশ, এই তল্লাটে ওদের সবাই একডাকে চেনে।’
বিজয়া আহত পাখির মতো চান শাশুড়ির দিকে। স্মৃতিকণার কথায় স্পষ্ট, কোন রাস্তাটা বেছে নিতে হবে। এই গ্রামদেশে, এই দরিদ্র ঘরে, এতগুলো ভাইবোন যেখানে, সেখানে মেয়েকে গানের লাইনে দাঁড় করানোর স্বপ্ন দেখাই বাতুলতা, জানেন বিজয়া। কিন্তু তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, তাঁর মেয়ের বিয়ে, সারা পৃথিবীর সবাই সব জানল, তিনি জানলেন না?
কখন যেন দেবী এসে দাঁড়িয়েছে। দরজায় পিঠ দিয়ে ও দাঁড়িয়ে আছে, যেন একটা করুণ রাগিনীর মতো। ওকে দেখে বিজয়ার বুকের মধ্যে একটা সুর গুনগুন করে। কী যেন গানটা, দেবী তুলেছে কিছুদিন হল। লতা মঙ্গেশকরের গান। ‘কী যে করি বলো এত আশা লয়ে/ বোবা হয়ে মরি এত ভাষা লয়ে?’ সুরটা এক চাপা কষ্টের মতো ঘরটা ছেয়ে ফেলে ক্রমশ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন