novel-nona-jol-4-of-5

নোনা জল
অনিন্দিতা গোস্বামী

একুশ


মাটির ভাপে সেদ্ধ হচ্ছে মাংস, তাকে ঘিরে মশকরায় বসেছে নাও, পিচার সহ ওরা ক’জন। আজ ওদের শূকর ভক্ষণ উৎসব। আনন্দের দিন। যুদ্ধে জিতেছে ওরা। নাও বলল, সব ন্যাজ গুটিয়ে পালাল কেমন দেখলি, হা হা হা।

পিচার বলল, যা বলেছিস। এদিকে আর কোনোদিন আসার সাহস পাবে না। গাছ কেটে কেটে জঙ্গল সাফ করে দিচ্ছিল সব। কিছু দূর যেতে না যেতেই সব কটা মরবে।

মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে পাতা ঝোপঝাড় দিয়ে আগুন বানিয়ে লতা দিয়ে শুয়োরের পা আর মুখ বেঁধে ফেলে দিয়েছে গর্তে, ওপরে ফের আগুন আর মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুলতুলে চর্বি গলতে শুরু করলে একটু একটু করে খাবে ওরা। একটু দূরে গোল করে নাচছে ক’জন। সেদিকে না গিয়ে লিচো কোমরে হাত দিয়ে গিয়ে দাঁড়াল নাওদের দলের কাছে। বলল, তোদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন কত্তবড় কাজ করেছিস। মেরেছিস তো কটা মেঠো ভূত। তাও যদি সাদা ভূত মারতিস! পিচার বলল, মেঠো ভূতগুলো কি কম নাকি? ওরাই তো আমাদের প্রধান শত্রু, শুধু গাছ কাটে।

লিচো বলল, তাতে কী? ওদের পাঠায় তো ওই সাদা ভূতগুলো। দেখিস না শুধু লাও বোড আসছে আর আসছে।

নাও বলল, কিন্তু সাদা ভূত আমরা মারব কেমন করে? ওদের কাছে তো গুরুম গুরুম যন্ত্র আছে। তবে ওদের মারতে পারলে অনেক বেশি ভালো হত।

লিচো মুখটা বেঁকিয়ে বলল, ওদের মারা তোদের কম্মো নয়, তার জন্য বুদ্ধি দরকার।
নাও বলল, তোর যখন অত বুদ্ধি তবে একটু ধার দে না।

লিচো বলল, আমার বুদ্ধি নিলে তোদের মান যাবে না?

নাও বলল, তা হয়তো যাবে। কারণ তোর বুদ্ধি তো লাও তাড়ানোর নয়, লাও ডেকে আনার। এই কথায় একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে লিচো নাওয়ের দিকে তাকাল, তারপর একটা কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দেখল মাংস সেদ্ধ হয়েছে কিনা, নিশ্চিন্ত হয়ে ধীরে ধীরে মাটি সরিয়ে দিল ওপর থেকে। নাচের দলও ছুটে এসে গোল করে বসে পড়ল ঘিরে। এবার ওরা দু’হাত দিয়ে তুলে তুলে খাবে গরম মাংস, কেউ বা খাবে কাঠিতে বিঁধিয়ে, কেউ বা খাবে ঝিনুকের খোল দিয়ে তুলে।

খাওয়াদাওয়ার পরে ঘরে পাটির ওপর আকাচাপানের পাশে গিয়ে বসল সুরমাই, বলল, মাহে গল্প বলো। গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে মেয়েটা, আর লাকা ভালোবাসে গল্প বলতে। ওরা যখন বসে বসে গল্প করে বাইরে, তখন পাতার বিছানায় সঙ্গী খুঁজে নেয় কেউ বা, সরীসৃপের খসখস সরসর আর পৃথিবীর আদিম মানব-মানবীর মিলনোল্লাস ছড়িয়ে যায় জ্যোৎস্নাপ্লাবিত অরণ্যের বুকে।

বন্যেরা বনে সুন্দর, একথা সভ্যতা জানবে কবে? দুর্ভাগা এই সব প্রাচীন জনজাতির লোককথায় ছড়ানো আছে তো এমনই সব আক্ষেপ। এই সব গল্প যেন বুকের ভেতর থেকে একা একাই বলে যায় লাকা, আর হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে লাকার পেটের কাছে ঘেঁষে বসে সেই সব গল্প শোনে সুরমাই। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়াকাচের অসংখ্য জলছবি। সে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে আটকে পড়া সমুদ্রের স্থির জলের মধ্যে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মাহের বলা সেই সব গল্পগাথা চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, পাতার রং, ডালের বাঁক সব যেন অবিকল ধরা আছে। সে খুব ধীরে ধীরে তর্জনী ঠেকিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায় সেইসব স্বচ্ছ পৃথিবী, কিন্তু জলতল স্পর্শ করবার আগেই আঙুল সরিয়ে নেয়। ভয় হয় তার, যদি ছুঁয়ে দিলেই হারিয়ে যায় সব!

কখনও সুরমাই লাকার বাজুর ওপর সাদা মাটি দিয়ে সাপ আর কাঁকড়ার নকশা এঁকে দিতে দিতে শুধায়। মায়েহ সবসময় এক হাতে কুবি আর অন্য হাতে কেয়োর ছবি এক সঙ্গে আঁকতে হয় কেন? লাকা তার বুড়ো বয়সে জন্মানো আদরের ছোট মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, সে এক মজার গল্প, আসলে ওরা তো আগে সব আমাদের মতো মানুষ ছিল, তারপর ভাগ্যের ফেরে কেউ গেল জঙ্গলে তো কেউ গেল জলে। চোখ বড় বড় হয়ে যায় সুরমাইয়ের। বলে মাহে, বলো না সেই গল্প আমায়।

মাহে বলে ওই গল্প আর কী, একদিন এক বিরাট ভোজসভা। সবাই খাচ্ছে দাচ্ছে, হইহই করে গান গাইছে আর নাচছে। হঠাৎ তাদের মধ্যে কী কারণে বা গেল বচসা বেধে। ব্যাস, এ ওকে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে একজন গিয়ে পড়ল জলে, সে হল কচ্ছপ, একজন আর একজনের হাত দিল কামড়ে, সে হল কাঁকড়া, আর একজন ঝগড়া থামানোর চেষ্টা না করে সুযোগ বুঝে চুপিচুপি কেটে পড়ল জঙ্গলে, সে হল সাপ। সুরমাই দুঃখী দুঃখী মুখ করে ঘাড় নাড়ল, বলল, সেই জন্যই তো মাহে আমি বলি সবাইকে তোমরা নিজেদের মধ্যে গোল কোরো না, ওতে মানুষের ভালো হয় না।

লাকা মেয়ের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল, তোর মতো তো সবাই না রে সুরমি। এই হাতে এদের ছবি আঁকা কেন বল তো, এই গল্পটা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য, তা গল্প তো কেউ শুনতেই চায় না। না বলতে বলতে আমিও প্রায় ভুলতে বসেছিলাম সেসব। তুই এসে টোকা দিয়ে মাঝে মাঝে মাথায় মধ্যে ফিরিয়ে দিস সেসব গল্পদের।

সুরমাই বলে কাক ঈগল সবাই তো আগে মানুষ ছিল, বলো?

মাথা ঝাঁকায় লাকা, হুঁ রে।

আচ্ছা মাহে, নাও, পিচার এরা সবাই যে এত মারপিট করে এরাও কি তবে কেয়ো হয়ে যাবে? সুরমাই তার ঝাঁকড়া চুল কপালের ওপর থেকে সরিয়ে ঘাড় তুলে তাকায় লাকার দিকে।

লাকা উদাস ভাবে জবার দেয়, কী জানি। তবে এও ঠিক সুরমি, তোর মতো মানুষ তো একা এই জঙ্গলে বাঁচতে পারবে না।

শিকারে যাবার আগে ওরা পথের ওপরে গাছের ডাল কেটে আড়াআড়ি করে ফেলে তার ওপরে ছিঁড়ে ফেলে, লতাপাতা। প্রার্থনা করে, হে আমার পূর্বপুরুষ, শিকারের পথে যেন কোনো অশুভ আত্মা আমায় ভর না করে, টেনে না নিয়ে যায় গভীর জঙ্গলে। কারণ শিকার তাড়া করার নেশায় ওরা বেশির ভাগ সময়ই ঢুকে পড়ে গভীর জঙ্গলে কিম্বা অন্য উপজাতির চিহ্নিত শিকার অঞ্চলে, ফলে বেধে যায় ঘোর লড়াই। আর লড়াই মানেই তো তীর বিঁধে মৃত্যু অবধারিত। আজকাল তাই ছেলেপিলে শিকারে বেরনোর আগে ভাঁজ পড়ে আকাচাপানের কপালে। কমতে কমতে তাদের দল ক্রমশই ছোট হচ্ছে। এত ছোট শক্তি নিয়ে লাওদের সঙ্গে লড়া যাবে না। সাদা ভূতের শক্তি অনেক বেশি। জঙ্গুলে মানুষগুলোর আপন গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইটা যদি বন্ধ করা যেত! সবাই যদি একে অপরের কথা বুঝত তাহলে হয়তো কিছুটা সুবিধা হত। বাইরের জগতের পাঁচটা লোককে মেরেই উল্লাস করার মতো স্বল্প বুদ্ধি নিয়ে আকাচাপানের চলে না। বড় কঠিন সময় আসছে। হাত দুটো সামনে ঝুলিয়ে মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে পাতায় ছাওয়া কুটিরের সামনে দিয়ে ঘন ঘন হেঁটে বেড়াতে লাগলেন দু’ হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস বহনকারী, জীবন্ত উত্তরাধিকারী লাকা।

ফের ফের ফের লড়াই। এবার যেন একেবারে তাদের ঝুপড়ির কাছে। হই হই শব্দ পেতেই তীর-ধনুক তুলে নিয়ে এবার নিজেই দৌড়লেন আকাচাপান। এক গাছ থেকে দোল খেয়ে আর এক গাছে পার হয়ে গেল সুরমাই, হাতে কতগুলো তীর-কাঠি নিয়ে। লড়াই তার মোটে ভালো লাগে না, কিন্তু মাহের দিকে যদি কেউ কিছু ছোড়ে, সে তাকে ছাড়বে না। কেউ জানে না, এমন কী মহল্লার লোকও জানে না তার তীরের কী অব্যর্থ লক্ষ্য। তার দিদির বড় দেমাক, ভালো তীর-ধনুক চালাতে পারে বলে। সে মনে মনে হাসে, তার দিদি জানে না সত্য জ্ঞানকে লুকিয়ে রাখতে হয়। জানবে কী করে, তার দিদি তো কখনও আকাচাপানের কাছে বসে গল্প শোনে না, গল্প শুনলে জ্ঞান শিক্ষা হয়। সবাই যা দেখতে পায় না তাও দেখে ফেলা যায় এই একই পৃথিবী থেকে।

লাকার স্ত্রী বোরোর নির্দেশে লিচোর নেতৃত্বে দু’ধার তীক্ষ্ণ পাথরের অস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে পড়ল মেয়েদের দল। বোরো ছোবার আগুনের ধুঁয়ো বানিয়ে দু’বার দুলিয়ে নিল ঝুপড়ির দরজায় ঝুলিয়ে রাখা শূকরের খুলির সামনে। বিপদ বাড়লে আকাচাপান বসেন প্রার্থনায়। কিন্তু আজ লোকবলের প্রয়োজন বুঝে সে তীর ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, তাই তার স্ত্রী বোরো বসল প্রার্থনায়। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে মিনতি করতে লাগল এই বলে যে, দলের সবাইকে রক্ষা করো তোমরা বিপদের হাত থেকে। আমার ছেলেমেয়েদের ছোড়া তীর যেন লক্ষ্যে গিয়ে বেঁধে। আমার দলের একটা মানুষেরও যেন প্রাণহানি না ঘটে।

আকাচাপান অবশ্য বেশিদূর দৌড়তে পারলেন না, তার হাঁফ ধরে গেল। শত্রুর শেষ তিনি আর বেশিক্ষণ দেখতে পেলেন না, এরজুমের পিছে পিছে দৌড়চ্ছে ছেলের দল। আকাচাপান একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে খানিক দম নিলেন। গাছের ডাল থেকে দোল খেয়ে ঝুপ করে লাকার সামনে নামল সুরমাই। বুকে হাত দিয়ে বলল, দম নাও। আর দৌড়তে হবে না তোমায়। লিচো মেয়ের দল নিয়েও গেছে অন্য ধার থেকে। আর নাওয়ের পায়ের দৌড় ওই লাওদের আনা চারপেয়েগুলোর মতো, ওদের শিংগুলো যদি বাঁকাত্যাড়া না হত দৌড়ের বেগ সামলাতেই পারত না, সব গিয়ে সাগরের জলে পড়ত। চিন্তা কোরো না মাহে, নাও, পিচার ঠিক শত্রুগুলোকে ধরে ফেলবে। এ তো মেঠো ভূত, ভয় নেই। ওরা পারবে না আমাদের এরজুমের সঙ্গে।

হাঁপাতে হাঁপাতে লাকা বলল, আজ যে আরও অনেক জন। সুরমাই বলল, হোক, তবু পারবে না। মেয়েরা পাথর ছুড়ছে সাগরের পার থেকে, এই ঘন জঙ্গল, মাটিতে শিকড়ের দাঁত, তাতে কি পথ চেনে ওরা? খেই হারিয়ে ফেলবে। ভুলভুলাইয়াতে হয় সাগরে গিয়ে পড়বে নয় তীর বিঁধে মরবে, নয় তো লতায় জড়িয়ে ফাঁস আটকে মরবে। কিছু নেই ওদের হাতে মাহে, কিছু নেই, আমি গাছের ওপর থেকে দেখেছি। গাছ কাটার একটা কুড়ুল ছিল, তীরের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওই কুড়ুলটাকেই ওরা ছুড়ে ছুড়ে মারছিল, কিন্তু ভারী কুড়ুল আর কতদূর যাবে। তবে তখন আমার একটু ভয় করছিল তোমার জন্য। এখন আর কিছুই নেই ওদের হাতে। তারপর তুমি পিচারকে তো জানো, শত্রুর চোখ বিঁধে ফেলতে সে দড়। তখন তো ওগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সুরমাই বলল, চলো আমরা মধু খুঁজে আনি, যখন যুদ্ধ করে ওরা ক্লান্ত হয়ে ফিরবে তখন ওদের খুব খিদে পাবে। লাকা বললেন, চল সুরমি, সেই ভালো। আজ যখন প্রার্থনায় তোর মিমিই বসেছে, তখন আমরা আজ মধু সংগ্রহেই যাই। বাবা আর মেয়েতে হাঁটতে লাগল ঝোপ লতাপাতা সরিয়ে জঙ্গলের পথে।

আকাচাপান এখন বেশি জঙ্গলে বেরয় না তাই কোন পথে মধু মিলবে তাও প্রায় তার অজানা। সুরমাই টনজোঘি ঝোপের পাতা ছিঁড়ে দিল লাকাকে, তারপর দু’জনে পাতা চিবোতে চিবোতে গিয়ে দাঁড়াল মস্ত বড় মৌচাকের নীচে। দেখল মৌমাছিগুলো উড়ে উড়ে পালাচ্ছে মৌচাক ছেড়ে। সুরমাই বেশ কিছুটা পাতা চিবিয়ে সারা গায়ে মেখে নিল সেই পাতার রস। সেই গন্ধে বাকি মৌমাছিগুলোও ঝিমিয়ে পড়ল। তখন সে তরতর করে উঠে গেল গাছে। আর চাক ভেঙে ফেলল লাকার হাতে, লাকা সুপুরির ডাগরে তৈরি পাত্রে চাক নিতে গিয়েও ওপর থেকে টপ টপ করে গাঢ় মধু গড়িয়ে পড়ল তার মাথা ঘাড় কাঁধ আর খোলা পিঠ বেয়ে। গাছ থেকে লাফ দিয়ে নেমে সুরমাই বলল, মাহে আমি এখন তোমায় খাব। তুমি তো এখন একটা মধু ফল। হি হি।

লাকা মেয়ের মাথায় একটা চাঁটি মেরে কোমর ঝুঁকিয়ে উবু হয়ে দাঁড়াল। সুরমাই নিচু হয়ে বাবার পিঠ থেকে জিভ দিয়ে চেটে চেটে খেতে লাগল মধু। মধু খেতে খেতে সুরমাই বলল, মাহে একটা কথা বলব?

লাকা বললেন, বল না।

সুরমাই বলল, মাহে গাছ কাটার জন্য এত শাস্তি কেন? ওরা তো আমাদের মারেনি।

লাকা খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, গাছই তো আমাদের খাদ্যদাতা, গাছ না থাকলে এ মধু কোথায় পাবি তুই। গাছ না বাঁচালে, জঙ্গল না বাঁচালে আমরা কেউ বাঁচব না। যারা গাছ কেটে ফেলে তারা সবাই আমাদের শত্রু। কেমন আনমনা হয়ে চুপ করে গেল সুরমাই, তারপর বলল, চলো, এতক্ষণে মনে হয় লড়াই থেমে গেছে, ঘরে ফিরে এসেছে সব। যেতে যেতে গাছগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সুরমাই। তার যে সকলের ওপরে মায়া, গাছ লতা পাতা ফুল পাখি, তার দলের লোকজন। এমনকি শত্রুদের ওপরেও। এমনকি সে কাউকে একথা বলতে পারে না, শুয়োরগুলোর গলায় যখন বর্শা বিঁধে যায়, ওই চিৎকারেও বুকটা যেন মুচড়ে ওঠে তার। তারপর সে নিজেই নিজেকে বোঝায়, না না, এরকম কষ্ট পাওয়া খুব নিন্দের, তারা শিকারি, বুনোর জাত। তারা হবে ধীর, সাহসী। এরকম থেকে থেকেই মন কেমন করলে কি চলে!

বাপ-বেটা ঝুপড়িতে ফিরে এসে দেখল কেউ তখনও ফেরেনি। মধু নিয়ে কাঠের পাত্রে ঢাকা দিয়ে যত্ন করে রেখে দিল সুরমাই। তারপর সুপুরি পাতা দিয়ে চাটাই বুনতে বসল পা ছড়িয়ে। পাতা বুনতে বুনতে সে গুনগুন করে প্রার্থনার মন্ত্র বলছিল। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরল লিচো তার দলবল নিয়ে। উদ্‌বিগ্ন আকাচাপান এগিয়ে এলো ওদের কাছে, খবর?

লিচো বলল, খবর ভালো না, একদল মেঠো ভূত পালিয়েছে গভীর জঙ্গলের দিকে। ওদের ধরতে ধাওয়া করেছে নাওয়ের দল, কিন্তু ওদিকে তো জারোয়ারা রয়েছে। ভূত ধরতে গিয়ে যদি ওরা জারোয়াদের মুখে পড়ে তবে তো উল্টে ওরাই বেঘোরে প্রাণ দেবে।

লাকা বড় করে শ্বাস টেনে বললেন, তবু শত্রুর নিধন হবে। জারোয়াদের মুখে পড়লে ভূত প্রেত কেউই বাঁচবে না।

লিচো বলল, তা হবে, তবে আমাদের ছেলেরা মারা গেলে তো আমাদের মস্ত ক্ষতি, আমাদের শক্তি কমে যাবে, তখন তো জঙ্গলের ভাগ নিয়ে লড়াইয়ে আমরা অন্যদের সঙ্গে পেরে উঠব না। মাথা নাড়লেন লাকা, ঠিক কথা। তুই একেবারে আমার মনের কথা বলেছিস। এই জন্যই তো তোকে আমার মাঝে মাঝে এরজুম করে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মেয়েদের ওই পদ দিলে দলের ছেলেরা যদি না মানে।

লিচো বলল, আমার পদের দরকার নেই, শুধু আমার বুদ্ধিটা যদি এরা মানত। সেটাও ওরা মানতে চায় না। তবে নাও অত বোকা না। জারোয়াদের এলাকায় ওরা ঢুকবে না। তাছাড়া শত্রুদলের অনেক লোক মারা গেছে আমাদের দলের ছেলেদের তীরে। পশ্চিম পারে সমুদ্রের ধারে শত্রু আটকাতে বেরবে বালায়ারা। যারা গভীর জঙ্গলে ঢুকেছে, পথ হারিয়ে না খেতে পেয়ে মরবে। ওদিকের জঙ্গলের সব গাছ জারোয়াদের দখলে। শত্রুদের তাড়া করে গভীর জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছে নাও। তবে এবার ওদের ফিরে আসা উচিত। অযথা শক্তিক্ষয় করা উচিত নয়। শত্রুরা বাঁচতে চাইলে দু’-একদিনের মধ্যে এই পথ দিয়েই ফিরতে চাইবে। তখন ওদের ফের আক্রমণ করা যাবে। সূর্য ডুবছে। একটু পরেই অন্ধকারে মাকড়সার জালের মধ্যে আটকে যাবে ওরা, কিছুতেই এত তাড়াতাড়ি ওরা কেউ জঙ্গল থেকে বেরতে পারবে না। ওরা ভিনদেশি, পথ চেনে না। সূর্য উঠলেই ওরা বন থেকে বেরতে চাইবে, তখনই নতুন করে তৈরি হয়ে গিয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। কারণ তখন ওদের সংখ্যা আরও কমে যাবে। আমাদের জয় আরও সহজ হবে।

সুরমাই লাকার পাশ থেকে মুখ বেঁকিয়ে বলল, আহা কী এমন যুদ্ধ, ওদের হাতে তো কোনো তীর-ধনুকই নেই, আর গুরুম গুরুম যন্ত্র তো নেইই। বরং বনের শূকরগুলোর মতো ওরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধ বোলো না, শিকার বলো।

লিচো বোনের দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল, এ সুরমি তোর বড় কথা হয়েছে, আমরা কি ওদের মাংস খাই যে শিকার বলব?

সুরমাই বলল, জঙ্গলে ‘রা’ আর কদিন, তারপর তোমরা তাও খাবে, তোমাদের যা খিদে। সুরমাইয়ের মাথায় ঠাঁই করে একটা চাঁটি মারলেন লাকা। বললেন, হ্যাঁ সেই, আর তুমি না খেয়ে থাকো।

সুরমি বলল, আমার কটা ফল আর মাছ হলেই চলে যাবে।

লাকা মেয়ের মাথায় চুলগুলো হাত দিয়ে ঘেঁটে দিয়ে বললেন, বেশ বেশ। এখন বড়দের সঙ্গে তর্ক কোরো না। বরং এত কষ্ট করে যে ওদের জন্য মধু পেড়ে আনলে, সেটা দাও। আর মিমিকে গিয়ে বলো এবার প্রার্থনা থেকে উঠতে। ছেলেরা এখুনি ফিরবে।

ছোট মেয়ের প্রতি বাবার সোহাগ দেখে রাগে গজগজ করতে করতে হাত পা ধোবার জন্য ছোট ঝর্নার দিকে হাঁটা দিল লিচো।

নাও তার দলবল নিয়ে ফিরে এসে বিস্তারিত বর্ণনা দিতে লাগল আকাচাপানকে। এবং লিচোর পরিকল্পনারই সে পুনরাবৃত্তি করল আকাচাপানের কাছে। গর্বের সঙ্গে জানাল, তারা শুধু শত্রুই মেরেছে, তাদের দলের একটা ছেলেও মারা যায়নি এই যুদ্ধে। খুব আগ্রহভরে নাওয়ের কাছ থেকে সবিস্তারে যুদ্ধের বর্ণনা শুনলেও শেষ মুহূর্তে সুরমাইয়ের কথাটা মনে পড়ে আকাচাপানের ফিক করে হাসি পেয়ে গেল। মিমি উঠলেন প্রার্থনা সেরে।

বাইশ


কাতরাতে কাতরাতে একটা গাছের নীচে বসে পড়ল বুধনাথ। বলল, আমি আর পারছি না মহা, তোরা যা, পালা। সাদলুর, তোর এখনও বাঁচার আশা আছে। যে কোনো পাথরের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে থাক রাতটা। এই জায়গাটা খুব ভয়ঙ্কর, এখান থেকে না পালাতে পারলে আমরা একজনও আর কেউ বাঁচব না। ঝোপজঙ্গলের আড়াল থেকে শুধু ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসছে, যতক্ষণ পায়ে তীর না লাগছে, তোরা ছোট। আমরা কে কোথায় ছিটকে গেছি। কাউকেই তো আর তেমন দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয় আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি আমরা, এখানে আরও ভয়ঙ্কর বুনোরা থাকে। ওহ্‌ আর পারছি না। যতক্ষণ হাতে তীর লেগেছিল তাই নিয়েও ছুটেছি এবার আমি আর বাঁচব না, আমাকে ছেড়ে দিয়ে তোরা এবার এগিয়ে যা।

মহাবীর নীচু হয়ে বসে বুধার বাঁ উরু থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করার চেষ্টা করতে গেল তীর, কিন্তু এ তীর আরো বড় আর গিঁথে গেছে একেবারে মাংসের ভেতর পর্যন্ত। আ আ আ— চেঁচিয়ে উঠতে গেল বুধনাথ। বাঁ হাতে বুধার মুখ চেপে ধরল মহা। তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুধার দাগ কাটা হাফ পাতলুন।

এর থেকে গুলিতে মরা ভালো ছিল, ককিয়ে উঠল বুধা, এর যন্ত্রণা সহ্য করা যায় না। ছেড়ে দে, ছেড়ে দে আমায়, আমায় এবার শান্তিতে মরতে দে। বলতে বলতে নিস্তেজ হয়ে নেতিয়ে পড়ল বুধা। সাদলুর আর মহাবীর দুজনে মিলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বুধার উরু থেকে টেনে বার করল তীর। ফিনকি দিয়ে উঠল রক্ত।

তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বাঁকা চাঁদের জ্যোৎস্না এমন কিছু আহামরি নয়। সব কিছু ভালো করে ঠাহরও হয় না। সাদলুর পরনের পাতলুন খুলে ছিঁড়ে শক্ত করে বাঁধল বুধার ক্ষত। তারপর মহাবীরকে বলল, দাদা আমি সমুদ্রে চললাম। ভোরের আলো ফোটার আগেই তোমরা এখান থেকে পালিয়ে যেও। বুধার যদি জ্ঞান আসে তো ভালো, পারলে বুধাকে কাঁধে নিও, না হলে ফেলেই চলে যেয়ো, মৃত্য যখন আমাদের ভবিতব্য তখন তা মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর গতি কী বলো। ক্যাম্পে ফিরলে ফাঁসিকাঠে গলা দিতে হবে, তাতে হারামি ওয়াকারের জিত। মরবও, আবার ওকেও জিতাব! এ আমি কিছুতেই হতে দেব না। বলতে বলতে অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল সাদলুর।

বুধার পাশেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল মহাবীর। অসংখ্য পাখির ডাক কানে যেতেই ঘুম ভাঙল। আলো ফুটছে একটু একটু করে। টের পেল পায়ের কাছ দিয়ে সরসর করে চলে গেল কিছু একটা। সে দুবার বুধাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকল, বুধা! বুধা! কোনো সাড়া দিল না বুধা, তখনও অচৈতন্য সে। আলো বাড়ছে। সে দেখল তার হাতে পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। বিশেষ করে কাঁধে এসে পড়েছিল একটা আধলা পাথর। সে কাঁধ যেন নাড়াতে পাড়ছে না, বুধার নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখল বুধার শ্বাস পড়ছে, বেঁচে আছে, কিন্তু এখন বুধাকে কাঁধে করে নিয়ে দৌড়নো তার পক্ষে অসম্ভব। দিনের আলোতে বুনো জন্তুগুলো তাকে একা পেলে তার বুক চিরে খাবে। সাদলুর ঠিক ঝোপ বুঝে কেটে পড়ল, ও ঠিক জাহাজের সন্ধানে গেছে। তারও সেই দিকেই যাওয়া উচিত। বার্মাগামী জাহাজের শিকল ধরে যদি কোনো ক্রমে ঝুলে পড়া যায়। সে বুধার মাথাটা একটু সোজা করে দিয়ে বলল, চলি রে। মাফ করিস বন্ধু।

কিছুদূর যেতেই মহাবীরের চোখে পড়ল আরও একদল কয়েদি বেরিয়ে আসছে জঙ্গলের অন্য দিক থেকে। ওদের দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়ে নেচে উঠল মহাবীরের। মহাবীর দেখল ওরা বুদ্ধি করে কুড়িয়ে নিয়েছে ওদেরই দিকে ধেয়ে আসা পাথরের টুকরো। ওরাও হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল মহাবীরকে। দলে ভারী হলে লড়াই করার সুবিধা। সবচেয়ে যেটা আনন্দের, এতক্ষণে তারা জঙ্গল থেকে বেরনোর পথ খুঁজে পেয়েছে। জঙ্গল সবখানেই, তবে এদিকে জঙ্গল একটু হালকা। এই পথ ধরে হাঁটলে সমুদ্রের পাড় পর্যন্ত যাওয়া যাবে। দলবদ্ধ ভাবে সন্তর্পণে ওরা একটু অন্য পথ ধরল কিন্তু ফের ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসতে লাগল তীর। এবার একেবারে অব্যর্থ লক্ষ্যে। বেশিরভাগ তীরই এসে বিঁধছিল কয়েদিদের চোখে।

আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে কোনো পাথর ছোড়ার অবকাশই তারা পেল না। এলোপাথাড়ি দৌড়তে গিয়ে ঘুরপথে তারা কেউ কেউ এসে পড়ল জঙ্গুলে লোকগুলোর লক্ষ্যের আরও কাছাকাছি। বুকে পিঠে অসংখ্য তীরবিদ্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে বেঘোরে প্রাণ দিল প্রায় সকলেই। পালানোর ক্ষমতাও অবশিষ্ট রইল না আর।

বুধনাথের চেতনা ফিরল বেশ কিছুটা পরে। সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি যখন সরাসরি এসে পড়ল তার চোখের ওপরে। তেষ্টায় তখন তার গলা শুকিয়ে কাঠ। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটু এগোতেই দেখল তীর-ধনুক হাতে সার বেঁধে ফিরে যাচ্ছে বুনো শিকারির দল। সে চট করে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল, কিন্তু দূরে তার চোখে পড়ল এক কয়েদির দেহ তীরবিদ্ধ অবস্থায় ছটফট করছে। সে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গলা বাড়াতে যেতেই দূর থেকে একটা তীর এসে বিঁধে গেল তার বাঁ ভুরুর ওপরে। আহ! বলে ফের সে পড়ে গেল। পড়ে যেতে যেতেও ওর কাঁধে এসে বিঁধল আরও একটা তীর। সে ফের উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পালাতে যেতেই দেখল সামনে পাথর হাতে মূর্তিমান কালো যোগিনী। ভয়াল তার রূপ। বুধনাথ মা মা দেবী বলে সরাসরি পড়ে গেল তার পায়ের ওপরে। বলল, বাঁচাও, বাঁচাও আমায় মা। এরা আমায় মেরে ফেলবে। লোকটার কাকুতি মিনতি দেখে হাতের পাথর ফেলে দিয়ে যোগিনী মূর্তি তার টুঁটি চেপে ধরল। তীর-ধনুক হাতে ছুটে এল পিচার। বলল, ব্যাটা এখনও মরেনি? বলে সে পিঠের তূণ থেকে আর একটা তীর বার করে লাগাল ধনুকে। লিচো হাত দিয়ে পিচারকে থামতে বলে ওর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নিয়ে চলল আকাচাপানের কাছে। নাও বলল, এটা কী হচ্ছে? ওকে আমাদের ডেরা চেনাবি?

লিচো বলল, এ দয়া ভিক্ষা চেয়েছে আমার কাছে, এখন আকাচাপানের নির্দেশ ছাড়া একে মারা নিষিদ্ধ।

নাও বলল, আমি তো জানতামই তুই লাও তাড়ানোর বদলে লাও ডেকে আনবি আমাদের ঘাড়ে।

লিচো বলল, সে বিচার আকাচাপান করবে, তুই না।

সকলে চলল লিচোর পিছনে পিছনে। কিছুদূর যাবার পর নাও হাঁক দিয়ে সবাইকে বলল শিকারির দল, এক জনের পিছে পিছে আমাদের সকলের গেলে চলবে না। আমরা তো এখনও নিশ্চিত নই যে কোনো শত্রু আর বেঁচে নেই। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। এ-ও অবশ্য আকাচাপানেরই কথা। চল আমরা অন্য পথ ধরে বন পাহারায় যাই। সন্ধ্যে পর্যন্ত যদি আমরা আর কাউকে খুঁজে না পাই তবে বুঝতে হবে আর ভয় নেই। বিচার এমনিতেও সন্ধ্যের আগে বসবে না। আমি সঠিক ভাবে জানি আকাচাপান নিজে হাতে একে শাস্তি দেবে আর তখন উৎসবটা আরও জমকালো হয়ে উঠবে।

লিচো হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে বুধনাথকে নিয়ে এসে ফেলল আকাচাপানের পায়ে। বলল শত্রু বন্দি করে এনেছি, প্রাণভিক্ষা চাইছিল। মাহে, এবার তোমার বিচার। বুধার চোখের কোণ দিয়ে তখন রক্ত গড়াচ্ছে, সারা গা ক্ষতবিক্ষত। বুধা পা জড়িয়ে ধরল লাকার। প্রভু বাঁচান। আমাদের কোনো দোষ নেই। আমরা যে অসহায়। ওই লালমুখো সাহেবগুলো আমাদের এদেশে ধরে এনেছে। কঠিন মুখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন আকাচাপান। বললেন, দলের ছেলেরা না ফেরা পর্যন্ত বিচার সম্ভব নয়। তবে বিজাতীয়দের আমরা আমাদের এলাকায় বরদাস্ত করি না। মরতে তোমাকে হবেই, না হলে তুমি নষ্ট করে দেবে আমাদের আপন রীতিনীতি। দূষিত করে দেবে আমাদের বনজঙ্গল। এই গাছ পশু পাখি এরাই আমাদের জগৎ। খাদ্যদাতা। তোমরা এদের ধ্বংস করছ। তাই তোমরা আমাদের শত্রু। তোমরা দুষ্টু আত্মা। বুধনাথ ফের কাকুতি মিনতি করে বোঝাতে লাগল ওই সাহেবরা আসল দোষী, ওই সাহেবরা। ওই সাহেবরা তোমাদেরও শত্রু, আমাদেরও। তোমরা চিনতে ভুল করছ।

ভাষা এখানে প্রধান বাধা, তবু হাত পা নেড়ে বুধা আপ্রাণ চেষ্টা করছিল বোঝাতে তার কথা। কিন্তু আকাচাপানের মন নরম হল না, শুধুমাত্র সুরমাইকে ডেকে বললেন, সূর্যাস্তের আগে বিচার সম্ভব নয়, এর অবস্থা খুবই খারাপ। সুরমি বিচার শুরু হবার পূর্বে আর্তের সেবা কর। নচেৎ এ অচিরেই প্রাণ হারাবে।

সুরমি প্রথমে বুধনাথকে চিত করে শুইয়ে জল দিয়ে তার সারা গা হাত পা থেকে ধুলো বালি আর রক্ত পরিষ্কার করল। ওকে সাহায্য করল লিফে। লুকের মা। লুক মারা যাবার পর থেকে সুরমিকে সে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। তারপর ওক গাছের ছাল জলে ভিজিয়ে লাগিয়ে দিল কাটা জায়গাগুলোর ওপরে। সুরমাইয়ের মা বোরো ভয়ে ভয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল পাশে। পাছে তার মেয়েকে যদি ভূতে ধরে! লিচোকে নিয়ে তার ভয় নেই, কিন্তু সুরমি যে তার বড় নরমসরম মেয়ে। নিজে মেয়ের হাতের কাছে এনে দিল থিপ আর তাও গাছের ছাল। সুরমি আর লিফে মিলে তীর বেঁধা ক্ষতের ওপর ওই ছাল লতা জড়িয়ে বেঁধে দিল শক্ত করে। তারপর ধরাধরি করে তাকে শুইয়ে দিল দাওয়ার এক পাশে চাটাইয়ের ওপরে। সারা দিন নিঃসাড় অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল বুধা, একটু বাদে বাদে সামান্য একটু করে জল দিয়ে গেল সুরমি তার মুখে।

সূর্য ডুবতেই ফিরে এল শিকারি ছেলের দল, কিছু কলার কাঁদি আর ফলমূল কাঁধে করে। বলল, সব শত্রুর শেষ এক শত্রু। আকাচাপান একে এতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখার কী প্রয়োজন? মেরে দিলেই তো হয়। হঠাৎ রুখে উঠল লিচো, খবরদার। ওর এখনও ভালো করে জ্ঞানই আসেনি। তারপর কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, গা জ্বরে পুড়ে যায়। আকাচাপান বললেন, তাহলে আজ বিচার বন্ধ থাক। আজ ছেলেরাও লড়াই করে ক্লান্ত। কিন্তু সারা রাত তবে শত্রুকে চোখের পাহারায় রাখতে হবে, সে দায়িত্ব কে নেবে?

লিচো বলল, আমি নেব। সুরমি দিনের ভার নিয়েছে, আমি ভার নিলাম রাতের। তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পার। এর এখন যা অবস্থা তাতে বেশি চালাকি করলে আমার এক হাতই যথেষ্ট।

আকাচাপান যেন কিছুটা স্বস্তি পেয়ে বললেন, বেশ। তবে এখন ওর সারা গায়ে ওই ওক গাছের ছাল ভিজানো জল লেপন কর। আমার পায়ের কাছে এসে যেন কোনো রোগী মারা না যায়, মারতে হলে আমিই মারব।

রাতটা কাটল নিশ্চুপে, দিনটাও। সকলেই কম-বেশি ক্লান্তিতে ঝিমোচ্ছিল এদিক ওদিক। লিচো শ্রান্ত বুধার কপালে বুলিয়ে দিচ্ছিল জলে ভেজা আঙুলের প্রলেপ। কিন্তু তার এক চোখ ফুলে বুজে ছিল, আর অন্য চোখ ভয়ে খুলছিল না। নারীর প্রতি অতি আসক্ত বুধা সম্মুখে অসামান্য রূপসী নগ্ন নারীমূর্তি দেখেও কোনো রকম আগ্রহ বোধ করছিল না চোখ খোলার। আসলে আর্তি যেখানে জীবনের, সেখানে বুঝি অন্য সব আকর্ষণই ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু তার শরীরের তাপ যে কমছে ধীরে ধীরে তা টের পেয়ে লিচো বলল, চোখ বুজে থেকে লাভ হবে না, এবার বিচারে তোমায় বসতেই হবে, হয়তো আজকেই তোমার জীবনের শেষ দিন। নাওরা তোমায় ছাড়বে বলে মনে হয় না। তবু আমি তোমার জন্য মাহের কাছে একবার ক্ষমা ভিক্ষা চাইব। তাতে মাহের মন গলবে কিনা জানি না। সে তো আকাচাপান। আমাদের দলের প্রধান। তাকে সবার কথা ভাবতে হয়। তুমি নিজেই তোমার কথা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করো। কিন্তু বুঝাবে আর কী করে, তুমি তো আমাদের ভাষাই জানো না।

এবার সামান্য চোখ খোলার চেষ্টা করল বুধা। তখনও সে প্রায় মুমূর্ষু। তবে একথা বুঝল যে, যোগিনী তার ওপর প্রীত হয়েছে। হায়, এক কলি গান গাইবার মতোও যদি এখন তার ক্ষমতা থাকত। এখনও যোগিনী তো তার কণ্ঠস্বরই শোনেনি। তার গান শুনে পাড়াগাঁয়ে আজ পর্যন্ত কোন্‌ মেয়ে না মজেছে। বুনোই হোক আর যোগিনীই হোক, মেয়ে তো মেয়েই। মায়ের জাত। ও মনের কোণে টলটল করবেই কোথাও একটা মায়া, তাকে একটু নাড়া দিতে হয় কেবল, এ কথার সারমর্ম বুঝতে পারছে বুধা, এখন কোনোক্রমে ক’টা দিন এদের কাছে থাকতে পারাই নিরাপদ। অন্তত গাছগাছালির ওষুধটুকু তো পাওয়া যাবে। এই অবস্থায় এরা ছেড়ে দিলেও বা সে কোথায় যাবে! না পাবে জঙ্গলে খাবারদাবার, না পারবে সমুদ্র সাঁতরাতে। আর ক্যাম্পে ফিরে গেলে তো এইবার ব্রিটিশ গুলাগ একবার নয়, দশবার ফাঁসি দেবে। অতএব যে-কোনো ভাবে হাতে পায়ে ধরে এদের সঙ্গে মিশে ক’টা দিন কাটাতে হবে তাকে, আর তক্কে তক্কে থাকতে হবে কোনো জাহাজ ভিড়লে তার খালাসির সঙ্গে ভাব জমানোর। আহা, যদি রঙ্গিতলালের দেখা মেলে!

তবে সন্ধ্যের বিচারে এরা যদি তাকে মেরে ফেলা সাব্যস্ত করে তবে তো ল্যাটা চুকেই গেল। ভবলীলা সাঙ্গ হল তার। আহা, বড় সুন্দর এই পৃথিবী, ছেড়ে যেতে যে বড় মন কাঁদে। সে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে ওদের ডাকের, সে বুঝতে পারে বিচারসভা বসার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই।

ছোট মেয়েটা এসে হাত ধরে বসাল বুধাকে। দেখল দাওয়ার সামনে ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করা বেশ কিছুটা জমি। একপাশে গাছের ডালের সঙ্গে বাঁধা রজনের মশাল। একটা গাছের গুঁড়ির তৈরি উঁচু পাটাতনে বসেছিল ওই নেতা মতো লোকটা, যাকে ওরা বলছে আকাচাপান। একটা চোখে ভালো করে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করল বুধা, না এরা যে মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাহেবরা যে গল্প ছড়িয়েছিল ঘোড়ার মাথাওয়ালা মানুষ আছে জঙ্গলে, সেটা ডাহা মিথ্যে। আর এরা যে মানুষ খায় বলে সবাই বলে, সেটাও মনে হচ্ছে না বুধার। কারণ এই দুই দিনে এরা প্রচুর কয়েদিকে মেরেছে। মানুষের মাংস খাবার ইচ্ছে থাকলে এরা মৃতদেহগুলোকে জঙ্গলে ফেলে আসত না। সঙ্গে করে নিয়ে আসত। আকাচাপানকে ঘিরে গোল করে বসেছে এদের দলের সকলে। তবে গোলের একদিকে মেয়েরা, আর একদিকে ছেলেরা। মাঝখানে বসানো হয়েছে বুধাকে।

আকাচাপান তাকে সম্বোধন করে ডাকল, শত্রু!

সম্বোধন শুনেই কিছু না বুঝেই, ইয়েস স্যার, বলে সেলাম ঠুকে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল বুধা। কিন্তু পারল না, টলে গেল। ওকে ধরে ফেলল একজন বয়স্ক মহিলা, যাকে ওরা সকলে মিমি বলে ডাকছে।

আকাচাপানের মুখ দেখে মনে হল বুধার হাবভাব তার পছন্দ হয়েছে। বুধা অবশ্য এমনটা খুব সচেতন ভাবে করেনি। দীর্ঘদিন সে কোম্পানির সেপাই, সেলাম ঠুকতে ঠুকতে প্রায় অভ্যাস হয়ে গেছে। সামান্য একটা পাতার ন্যাঙোট পরে লোকটা বসেছে এমন ভাবে যেন মহারাজা। সামান্য একটু হাসিও পেল বুধার। তবু বুধা হাত জোড় করে কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল, আমার বড্ড ভালো লেগে গেছে তোমাদের। দয়া করে আমাকে প্রাণে মেরো না। তোমাদের সঙ্গেই একটু থাকতে দাও আমাকে। আমি কোথাও যেতে চাই না।

নাও বলল, বাইরের লোককে বিশ্বাস কোরো না আকাচাপান। ঠকতে হবে। ওরা আমাদের মানুষ বলে মনেই করে না। মনেই করে না ওদের অনেক আগে থেকে এই পৃথিবীতে আমরা বাস করছি। ওরা আমাদের মেরে শেষ করে দিতে চায়। সারা পৃথিবীর দখল নিতে চায় ওরা। ওরা এই জঙ্গল আর রাখবে না। সব গাছ কেটে ফেলবে। ওরা প্রকৃতিকে ভালোবাসে না।

বুধা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, না না আমি তেমন লোক না। আমি তো গাছপালা খুব ভালোবাসি। ওই সাদা সাদা লালমুখো লোকগুলো তোমাদেরও শত্রু, আমাদেরও শত্রু, ওরাই আমাদের দিয়ে জোর করে গাছ কাটায়। এখানে ওরা একটা বাড়ি বানাবে, যেখানে ওরা সব আমাদের মতো লোকগুলোকে পুরে রাখবে। আমরা তাই ভয় পেয়ে পালাচ্ছিলাম। তোমাদের আক্রমণ করতে আমরা আসিনি।

আকাচাপান বুধার কথা কী বুঝলেন, কতটা বুঝলেন কে জানে। বললেন, এখন আপাতত সিদ্ধান্ত স্থগিত থাক। লোকটা এখনও অসুস্থ। লোকটাকে আগে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দেওয়া হোক। ততক্ষণে আমরাও কিছুটা ভেবে দেখে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ পাব। তবে এ ক’দিন ওকে খুব চোখে চোখে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে, যাতে ও কোনো ভাবেই পালাবার চেষ্টা না করে, আর পালানোর চেষ্টা করলে বিনা সময় ব্যয়ে ওকে হত্যা করা হবে। এই ক’দিন ওকে পাহারা এবং দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হল লিচোকে। লিচো তীর-ধনুক চালানোয় সিদ্ধহস্ত, পাথর ছুড়তেও দক্ষ, আবার প্রয়োজন হলে ওর ক্ষতের শুশ্রূষা, পথ্য ইত্যাদি দেখভালেও পারদর্শী। ও সম্পূর্ণ সুস্থ হলে পুনরায় বিচার বসবে আবার।

নাও বলল, আমি জানতাম।

লাকা বললেন, কী জানতে?

এই লিচো লাও তাড়ানোর বদলে ডেকে এনে আমাদের ঘাড়ে চাপাবে। একবার তো সাদা ভূতকে ডেকে আনছিল, আমাদের পূর্বপুরুষদের দয়ায় সে বেটা ঘাড় উল্টে মরেছে। লিচো একবার জ্বলন্ত চোখ নিয়ে তাকাল নাওয়ের দিকে। বলল, হুম্‌ দয়াই বটে।

লাকা নিজেদের মধ্যের বিবাদকে ধামাচাপা দেবার জন্য বললেন, আমি নাওয়ের অসন্তোষকে সম্মান করি। বাইরের মানুষদের চট করে বিশ্বাস করা একেবারেই ঠিক না। এখন একে কড়া পাহারায় রাখব আমরা। পরবর্তী বিচার সভাতেই ওকে মেরে ফেলা হবে। এবং সে কাজের ভার আমি নাওকেই দেব।

গজগজ করতে করতে সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেল নাও। বোরো বলল, নাওয়ের রাগটা বড় বেশি বেড়ে যাচ্ছে আকাচাপান। ওর এবার বিয়ের ব্যবস্থা করা হোক। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন আকাচাপান। সভা ভেঙে গেল।

তেইশ


খবর এসে পৌঁছল পেনাল সেটলমেন্ট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট জে পি গ্রান্টের কাছে। একদিনে অর্ধ শতাধিক ফাঁসি! শিউরে উঠলেন সকলে। লজ্জায় ঘেন্নায় শোকস্তব্ধ হয়ে গেল সভ্য ব্রিটিশ নাগরিকগণ। মিস্টার জে পি গ্রান্ট লিখিত অভিযোগ জানালেন উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে। লজ্জা ঢাকতে তৎপর হয়ে উঠলেন লর্ড ক্যানিং। ডক্টর জেমস্‌ ওয়াকারকে কড়া ভাষায় পত্র লিখে দুঃখ প্রকাশ করতে বলা হল কয়েদিদের তথা গভর্নরের কাছে। এই পত্র প্রেরণ করা হল কয়েদিদের জন্য অতিরিক্ত খাদ্য সামগ্রী, পোশাক আশাক সহ পাঠানো বিশেষ জাহাজে। লেখা হল, কয়েদিদের বিশ্বাস অর্জনে এবং তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ওয়াকার। নিজের ব্যর্থতার গ্লানি মুছতে ওয়াকার কয়েদিদের ওপর অযথা হিংস্র হয়ে উঠেছেন। লস অব ম্যান পাওয়ার কোম্পানি কোনো ভাবেই চায় না। এমনকি এই খবরে স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

চিঠি এসে পৌঁছল গোরা ডাক্তার জেমস্‌ ওয়াকারের কাছে। একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে কোম্পানির ছাপ আঁকা লেফাফা খুললেন ওয়াকার। এমনিতেই আরও একানব্বই জন কয়েদি ডিসমিসড্‌। মাথা তাঁর অত্যন্ত গরম। এই ঘন জঙ্গলে প্রাচীরবিহীন অবস্থায় কীভাবে কয়েদিদের আটকে রাখা যায় সেই চিন্তায় তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। মাথামোটা লোকগুলো মরবে তবু কোম্পানির হয়ে কাজ করবে না, অসুখ করলে ওষুধ খাবে না। গ্রান্ট শালা একটা বেজন্মা, সামান্য বচসার শোধ তুলতে ও আমাকে গোরা ডাক্তার থেকে ঘোড়ার ডাক্তার বানিয়েছে। কয়েদিরা আমাকে ব্যঙ্গ করে ঘোড়ার ডাক্তার বলে আমি কি জানি না! কিন্তু চিঠি পড়তে পড়তে চোখ কপালে উঠে গেল ওয়াকারের। খবর কী করে বাইরে গেল? এ নিশ্চয়ই কোনো কয়েদির কাজ। কিন্তু ওগুলো একটাও কি এখান থেকে পালাতে পেরেছে? গ্রান্টের উদ্দেশে মধ্যম আঙুল প্রদর্শন করে ওয়াকার বললেন, নিকুচি করেছে তোর সরির। ওহে বোড়ের দল তোরা নিজেদের প্রয়োজনেই আমার চাকরি খাবি না। আরে, কে আসবে তোদের এই নরকে। নরকে তো শয়তানই থাকে, আমি শয়তান তাই আমি নরকে রয়েছি, ব্যাস মিটে গেল। চিঠির কোনো উত্তর না দিয়ে চিঠিটা বাতাসে উড়িয়ে দিলেন ওয়াকার। তারপর বললেন, আগে শুনেছিলাম বাতাসেরও কান আছে, এখন দেখছি জলেরও কান আছে।

সেদিন সংকর মাছের লেজের তৈরি আরও বড় চাবুক বার করলেন ওয়াকার। সন্ধ্যের মুখে কাজের শেষে সার দিয়ে দাঁড় করালেন কয়েদিদের। জঙ্গলের মধ্যে থেকে উদ্ধার হওয়া বেশ কিছু মৃতদেহ তুলে এনে পরপর শুইয়ে রাখা হয়েছে সামনে। ডক্টর ওয়াকার চাবুকটা দু’বার মাটির মধ্যে চাবকে বললেন, এদের কিন্তু আমি মারিনি, মরেছে বুনোদের তীরে। তবে আমার নামে দোষ গেল কেন? আর ফাঁসির খবরই বা বাইরে গেল কী করে? আমি আজ জবাব চাই। বড্ড বাড় বেড়েছে তোদের। যার খাস যার পরিস তারই ঘাড় মটকাস। বলে সপাং সপাং করে শুরু হল কয়েদিদের পিঠের ওপর চাবুকের বাড়ি।

কয়েদিদের এসব গা সওয়া, আজকাল ব্যথার অনুভূতিও বুঝি লুপ্ত হয়েছে ওদের। ওরা শুধু একটাই কথা বার বার বলতে লাগল, আমি কিছু জানি না স্যার, আমি কিছু জানি না। পুরো দুনিয়াটাই যেন যন্ত্র হয়ে উঠেছে। যে চাবুক খাচ্ছে সেও যেমন যন্ত্রবৎ, যে চাবুক মারছে সে-ও একই রকম যন্ত্র। আসলে অলক্ষ্যে সে-ও চাবুক খাচ্ছে কারও কাছে। যেন সকলেই ধরে নিয়েছে ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট একই ভাবে চলাটাই এখন বিধেয়। প্রসারিত হচ্ছে সভ্যতা, যন্ত্রসভ্যতা। প্রকৃতি গুটিয়ে নিচ্ছে তার অবস্থান ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে। নিজেকে সঙ্কুচিত করতে করতে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে সে।

ওয়াকার সরাসরি চিঠি পাঠালেন গভর্নরকে। জাহাজে করে এল আরও গোরা সৈনিক, এল কামারের হাপর। এল কামার, ছুতার, নাপিত। তৈরি হয়ে এল আরও মোটা আর ভারী লোহার শিকল। তথাপি আরও বেশি সন্দেহপরায়ণ হয়ে উঠলেন ওয়াকার। তিনি কিছুতেই হদিশ করতে পারলেন না এখানকার খবর বাইরে পাচার করছে কে। বিশেষ ভাবে তৈরি করা হল লোহার কলার। লোহার আংটা গলায় পরিয়ে ঝালাই করে আটকে দেওয়া হল, সেখান থেকে লম্বা লম্বা দুটো শিকল টেনে দুপায়ে দুটো আংটা পরিয়ে ঝালাই করে এঁটে দেওয়া হল পা। যাতে তারা দৌড়তে গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কয়েদিদের কর্মঠ হাত দুটো শুধু কোম্পানির চাই। তাই হাত দুটো রইল মুক্ত। রঙ্গিতলাল আবারও সব দেখল। ওয়াকার সাহেব কখনও মাটির দিকে তাকান না। তিনি জানেন তাঁর চলার ছন্দে এমনই জোর যে বুটের নীচে পিষ্ট হয়ে যাবে যাবতীয় সরীসৃপ কিম্বা কীটপতঙ্গ। কিন্তু মস্তিষ্কের বিবর্তনে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীও যে চিনতে পারে তাদের শত্রুকে তা ওয়াকার সাহেব ভুলে গিয়েছিলেন। রঙ্গিতলাল বুঝেছিল তার শত্রু সবাই, সবাই, তবে লালমুখো সাহেবরা অনেক বৃহৎ শত্রু, এরা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায়। এদের সঙ্গে থাকা ঠিক না। এরা যে কোনো দিন জাহাজ থেকে ছুড়ে তাকে মাঝসমুদ্রে ফেলে দিতে পারে। এক সময় তো তাই দিতও তারা, সে গল্পও তাকে সাহেবরাই বলেছে, ওই যে এক-এক সময় টুং টাং তার বাজানো খ্যাপা সাহেব জুটে যায় জাহাজে। তাদের কাছ থেকে নানান রকম গল্প শোনা যায়। জোব্বা পরা গলায় তেকাঠি ঝোলানো ওই সাহেবগুলো অনেকটা তাদের পির ফকিরের মতো।

ওরে বাবা সে কী গল্প। পাল তোলা জাহাজে করে যেতে যেতে সাহেবরা নাকি মাঝে মাঝে মাঝসমুদ্রে যেত আটকে। এক ফোঁটা হাওয়া নেই। জাহাজ যেন আর এগোতেই চায় না। এদিকে জাহাজে খাবার ফুরিয়ে আসছে। বণিকেরা উপায়ান্তর না দেখে প্রথমে জাহাজ থেকে ঘোড়াগুলো দিত জলে ফেলে, তাতে জাহাজের ভার কিছুটা কমত। ঘোড়া, দাস, মশলাপাতি কত রকম জিনিসের সওদা করতে যেত তো তারা। আহা অবলা জীব, জলের মধ্যে হাঁচড়পাঁচড় করে ডুবে মরত। তাতেও জাহাজ না এগোলে পিপে করে দাসদের দিত জলে ফেলে। কে জানে ওই বুনো মানুষগুলো হয়তো কোনো দিন পিপে করে ভাসতে ভাসতেই ওই দ্বীপগুলোতে এসে ঠেকেছে। আবার কোনো কোনো সাহেব বলে এই দ্বীপগুলো নাকি আগে সব বর্মা দেশের সঙ্গে জোড়া ছিল। তখন বুনো লোকগুলো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দিব্যি পথ বানিয়ে আসা যাওয়া করত। তখন শুধু তারাই ছিল এই পৃথিবীতে, তারপর সমুদ্রের জল বেড়ে গেল। মাঝখানের মাটি গেল ডুবে, এই মানুষগুলো আটকে পড়ল সমুদ্রের মধ্যে। আস্তে আস্তে মানুষের কত উন্নতি হল, কিন্তু এই মানুষগুলো সেসবের কিছুই জানতে পারল না। রঙ্গিতলাল রঙ্গ করে সাহেবদের মাঝে মাঝে শুধায়, উন্নতি কারে বলে গো? সভ্যতা? আমার কি উন্নতি হয়েছে? সভ্যতা হয়েছে?

সাহেবরা হেসে বলে, সভ্যতা তো হয় না রঙ্গিত, মানুষ সভ্য হলে সভ্যতা তৈরি করে। রঙ্গিতলাল বলে, তবে তো আমরা সভ্যতা তৈরি করতে পারবই না। তোমরা তো বলো আমরা নাকি সবাই অসভ্য।

সাহেবরা বলে, সেই জন্যই তো আমরা এত চেষ্টা করছি তোমাদের সভ্য করার। জেসাসের শরণাপন্ন হও। শিক্ষার আলো তোমাদের অন্তরে পৌঁছালেই তোমরা সভ্য হয়ে উঠবে।

রঙ্গিতলাল বলে, তার জন্য কী করতে হবে?

সাহেব বলে, পড়াশোনা শিখতে হবে।

রঙ্গিত বলে, পড়াশোনা! ওরে বাবা আমার হেডে অত মাথাই নেই। বলে লাফ দিয়ে সেখান থেকে পালায়। তারপর মস্ত বড় ঝাড়ু নিয়ে জাহাজের ডেকে ঝাঁট দিতে দিতে ভাবে, উঁ, জ্ঞান শিক্ষে হলেই বুঝি সভ্য হয়! পণ্ডিতি ফলানো লোকগুলো বেশি অসভ্য। আমি সাহেবদের দেখছি না, আমাদের গ্রামের পণ্ডিতদের দেখছি না? সব্বাই শুধু দেখ না দেখ আমাদের পিটায়, পণ্ডিতদের লাথি খেতে খেতে আমার পোঁদের হাড় গুঁড়ো হয়ে গেল। হুউম সভ্যতা! বলে লাল খয়েরের পিক সমুদ্রের জলে ফেলে বলে, ওরা ঠিক করে, ওই বুনো মানুষগুলো, দিব্যি আছে জঙ্গলে। তোমাদের ঢুকতে দিলেই তো হয় তোমরা ওদের মেরে ফেলতে না হয় তোমাদের কথাগুলো জোর করে ওদের মগজে ঢোকাতে। তাতে আর কি হত, এই আমার মতো ভাঁড় তৈরি হত। তবে সব মানুষ এক নয়, পির ফকির সাহেবগুলো সত্যিই ভালো বটে।

টুংটুং করে দোতারা বাজাতে বাজাতে ওই জোব্বা পরা সাহেব বলেছিল, বুঝলে রঙ্গিত, সাহেবরা মান দিতে জানে। ওই সামান্য ঘোড়াগুলোকেও মনে রেখে আমরা ওই ল্যাটিচুডটার নাম দিয়েছি হর্স ল্যাটিচুড।

রঙ্গিত ঝেঁটিয়ে কেকের গুঁড়ো, চেরির টুকরো এক জায়গায় জড়ো করতে করতে বলল, কী? জায়গাটার কী নাম দিয়েছ তোমরা? ঘোড়ার লাথি?

সাহেব বলেছিল, বোগাস, ইউ রঙ্গিতলাল, তোমার দ্বারা কিছু হোবে না। তুমি বরং একটা গান শোনো।

রঙ্গিতলাল বলল, তোমাদের ওই ইংরিজি গান আমি কিছু বুঝি না, তুমি বরং তোমার দোতারাটায় টুংটাং ধরো তো, একটা প্রেমের গান ধরি, এই জলজঙ্গলে পড়ে আছি, ওসব জ্ঞানগম্যির বক্তিমে আর ভালো লাগে না বাপু, বউটারে কত দিন দেখিনি। আহা কী সব গান, তবে প্রেমে কি সুখ হত, সজনী, তবে প্রেমে কি সুখ হত, আমি যারে ভালোবাসি, সে যদি না ভালোবাসিত। তবে প্রেমে কী সুখ হত।


চব্বিশ


বুধনাথ বুঝল, ভাষা শিক্ষাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। যদি এদের ভাষাটা বোঝা যায় তবে বোঝা যাবে তাকে নিয়ে এদের মতলবটা আসলে কী। তাকে কি এরা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিতে চায়, নাকি জঙ্গলে ছেড়ে দিতে চায়, না তার বুকের মাংস খুবলে খেতে চায় তাকে সুস্থ করে নিয়ে। শুয়ে থাকার একটা মস্ত সুবিধা এই যে চলাফেরা করা মানুষগুলো ব্যস্ততার ফাঁকে শুয়ে থাকা লোকটাকে সবসময় খেয়ালে রাখে না। ফলে গোপন অনেক কথাও বলে ফেলে তারই সামনে। সেই সুবিধাটুকুই নিয়ে বুধনাথ চুপচাপ শুয়ে শুয়ে খুব মন দিয়ে শুনতে লাগল ওদের কথাবার্তা আর তার সঙ্গে একটু একটু করে লক্ষ করতে লাগল ওদের কাজকর্মগুলো। সে রামায়ণ গান গাওয়ার সুবাদে বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন করার সুবাদে বেশ কিছুটা শ্রুতিধর। চটপট অনেক কথাই সে ধরতেও পারে আবার মনেও রাখতে পারে। তার সঙ্গে আছে এই সেবাপরায়ণা মেয়েদুটো। বড় মেয়েটা বেশ ডাকসাইটে, কথাবার্তার মধ্যে বেশ একটা দাপট আছে তবে এ মেয়ের ক্ষমতা অনেক বেশি। ছোটটি নেহাতই সাদাসিধে। বুধা কিছু বলতে চাইলে মন দিয়ে শোনে আর কিছু বুঝতে চাইলে বোঝানোরও চেষ্টা করে। এ ক’দিনে বুধনাথ এটুকুও বুঝেছে যে-ক’দিন অসুস্থতার ভান করে থাকা যায় তার পক্ষে ততদিনই মঙ্গল। অসুস্থ থাকা অবস্থায় তাকে এরা কিছু করবে না। বরং তাকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করবে আপ্রাণ।

মেয়েদুটো সেবার ছলে যে তাকে কড়া পাহারায় রেখেছে সর্বদা এ কথাও বুঝতে পারে বুধনাথ। তবে তা নিয়ে বুধনাথ অত ভাবিত নয়। আপাতত পালানোর তার কোনো ইচ্ছাই নেই এখান থেকে। কারণ এখান থেকে পালানোটা যে অত সহজ নয় একথা দিব্য বুঝতে পেরেছে সে। পালালে জঙ্গলে না খেতে পেয়েই মরতে হবে, নয়তো অন্য কোনো বুনো উপজাতির তীরে। ব্রিটিশের ভয়ে কোনো জাহাজই যে তাকে তুলে নেবার জন্য এখানে দাঁড়াবে না সে কথা বিলক্ষণ বুঝেছে সে। অতএব নিজেকে ধীরে ধীরে এদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াই হচ্ছে বাঁচবার একমাত্র উপায়। পরের কথা পরে ভাবা যাবে। এখনও মাথাটা ভার হয়ে আছে। বেশি কিছু চিন্তা করতে গেলেই শুধু ঘুম পায়। কী এক পাতার রস এরা গায়ে মাখায় সারাদিন, তাতে শরীরটা ঝিম ধরে থাকে। মধু খাওয়ায়, ফলমূল খাওয়ায়। ধীরে ধীরে একটু একটু করে শরীরটা যেন সেরে উঠছে বুধনাথের। সেটা প্রথম বুধনাথ টের পেল সেদিন যেদিন নারীস্পর্শে কেঁপে উঠল তার শরীর।

দিনটা ছিল অমাবস্যার। ঘোর নিশিতে নিভে এসেছিল রজনের বাতি। জঙ্গলের নিশুতি কেমন হতে পারে সে ধারণা আগে কখনও ছিল না বুধনাথের। হঠাৎ সে টের পেল তার পায়ের কাছে কার যেন হাত। চমকে উঠে বসতে গেল সে, কিন্তু পারল না, মাথাটা টলে গেল, চকিতে একটা হাত ধরে ফেলল তার মাথা, তারপর চওড়া দুটো ঠোঁট যেন বিঁধে গেল তার ঠোঁটের ভিতরে। মুহূর্তে বুধনাথ টের পেল লালার স্বাদে গাঁ, শহর কিম্বা জঙ্গলে কোনো ভেদ নেই। তবে জঙ্গলের বাতাস অনেক তাজা, তাই যে-শ্বাস তার মুখের ওপর এসে পড়ছে তা সতেজ এবং বিশুদ্ধ। যেটুকু শক্তি সঞ্চারিত হতে বাকি ছিল তাও যেন সঞ্চারিত হয়ে গেল বুধনাথের শরীরে। এক চুম্বনের জোরে যেন খাড়া হয়ে গেল বুধনাথ। টের পেল সে সেরে উঠেছে।

সরসর করে ঝুপড়ির পিছনে দিয়ে পার হয়ে গেল কোনো সরীসৃপ। সাপ কিম্বা গিরগিটি। বহুদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা বুধনাথের রক্ত হিল্লোলিত হয়ে নিকষ কালো তটভূমির বুকে মুহূর্তে যেন ছিটকে দিল সমুদ্র সফেন। কী বৈরাগ্য! ফের নেতিয়ে যেতে যেতে টের পেল বুধনাথ, তার মাথাটা যেন ঘুরছে। সে কথা বুঝি টের পেল আগন্তুকও। সে পুনরায় তাও গাছের পাতার রস থুপে থুপে দিতে লাগল বুধনাথের কপালে। বুধনাথ বুঝল, যে এসেছিল তার নাম লিচো। তার যোগিনী মূর্তি ভেসে উঠল চোখের ওপরে। ভয়ে বুক কাঁপতে লাগল দুরু দুরু করে। কী জানি এই অপরাধে সকাল হলেই হয়তো তার কণ্ঠনালী ভেদ করে ঢুকে যাবে তীক্ষ্ণ তীরের ফলা। শীতল শুশ্রূষাতেও তার উদ্বেগ কমল না কিছুতেই। যখন ঘুম এল, অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করেছে।

না, সকালবেলা নিত্যনৈমিত্তিকতার তেমন কোনো অদলবদল ঘটল না বুধনাথের। সে বুঝল রাতের অন্ধকারে ঘটে যাওয়া বিপ্লব টের পায়নি ছাউনিতে অন্য কেউ। শুধু তার দীর্ঘদিনের সিপাহি জীবন যেন ছটফট করছিল নিজেকে সুসজ্জিত করে তুলতে, মার্চে যাবার জন্য। ইচ্ছে করছিল দাড়ি কাটার, ইচ্ছে করছিল টানটান হয়ে বসতে। আগে বাঢ়ে গা, আগে বাঢ়। কিন্তু আশেপাশে আর লিচো নাম্নী মেয়েটিকে সে কোথাও দেখতে পেল না। অগত্যা সে হাতছানি দিয়ে ডাকল ছোট মেয়েটিকে, যার নাম সুরমি অথবা সুরমাই। এতদিনে সে একটু একটু বুঝতে পারে তাদের কথা, এমন কী বলতেও পারে কিছু কিছু। সবচেয়ে বড় কথা, আস্তে আস্তে এদের খুব একটা যেন আগের মতো খারাপও লাগে না তার। চারিদিকে একটা বোঁটকা গন্ধ, দেওয়ালে ঝোলানো শুয়োরের খুলি, প্রথম প্রথম সর্বসময়ের বমন প্রবৃত্তিও কেমন যেন আপনা আপনিই দমন হয়ে গিয়েছে বুধনাথের।

বুধনাথের হাতছানিতে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল ছোট মেয়েটি। চোখে তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। দু’বার ভাবল বুধনাথ, অসুখের ভান করে তার শুয়ে থাকাটাই শ্রেয়, না এবার উঠে বসা দরকার। এমনও হতে পারে মেয়েটি রাতে হয়তো তার সুস্থতার পরীক্ষা নিতেই এসেছিল। তাই ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা অতগুলো লোক টের পেয়েও হয়তো কোনো প্রশ্ন তোলেনি। হয়তো এটাই এদের রীতি! বোঝা না-বোঝার ধোঁয়াশার ভেতরেই বুধনাথ ঠিক করল যা থাকে কপালে, এবার সে উঠে বসবেই। এভাবে শুয়ে শুয়ে আর জীবন কাটানো যায় না। শুয়ে শুয়ে সে আরও একটা জিনিস উপলব্ধি করেছে, এরা সবাই ইংরেজদের শত্রু। আর সে-ও। তবে এদের সঙ্গে ভাব করাটা তার পক্ষে লাভজনকও হতে পারে। আগে সাহেবদের ওপরে তার অতটা রাগ ছিল না, একটা দোনামনা ছিল ভেতরে, হাজার হোক মাহিনা দিত, খেতে পড়তে দিত, গাঁ-গঞ্জে গেলে বেশ একটু খাতিরও পাওয়া যেত, কিন্তু বিনা কারণে তাকে দ্বীপান্তরে পাঠানো, ওয়াকার সাহেবের ওরকম পশুর মতো অত্যাচার, তাকে মনে মনে খাপ্পা করে দিয়েছে সাহেবদের ওপরে। লাকা বলে লোকটা ওদের নেতা। নেতাকে ওরা আকাচাপান বলে। ওই আকাচাপানের কাছে সাহেবদের নামে বিষোদ্গার করলে হয়তো খুশি হতে পারে।

তবে নাও বলে ছেলেটা কিন্তু বুধাকে একেবারে পছন্দ করে না। একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করতে হবে ওই ছেলেটার সঙ্গেও। বুধনাথ হাত মুখ নেড়ে সুরমি বলে মেয়েটিকে বোঝাতে চাইল সে দাড়ি কাটতে চায়, দাড়িতে তার গাল কুটকুট করছে।

মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিক্‌ করে হাসল সুরমাই, তারপর চলে গেল সেখান থেকে, কিছুক্ষণ পরে একটা কাঠের পাত্র করে নীলচে সাদা রঙের মোলায়েম খড়ি মাটির মতো মাটি জলে ভিজিয়ে আর একটা ধারালো ঝিনুক নিয়ে হাজির হল সেখানে। এই রে, ওই ধারালো ঝিনুকে যদি গাল কেটে যায়, তার ওপর দেখবার মতো আয়নাটায়নাও কিছু নেই। বুধার মনের কথা অনুমান করে হাত দিয়ে বুধাকে থামতে বলল সুরমাই নামের মেয়েটি। তারপর নিজেই নাপিতানির মতো দাড়ি চাঁচতে বসল। বেশ মজা লাগল বুধার।

মেয়েটি নিপুণ হাতে দাড়ি চেঁছে মসৃণ করে দিল বুধার গাল। বুধা হাত উঠিয়ে আড়িমুড়ি ভেঙে উঠোনে নামল। ঘন পাতার ফাঁকফোকর গলে এসে পড়া আলোর নকশার দিকে তাকিয়ে বুধার হঠাৎই মনে পড়ে গেল তপোবনের কথা।

বুধাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আকাচাপান নাওকে ডেকে পাঠালেন সমুদ্রের তীরবর্তী এক নির্জন পাথরের ওপরে। তিনি গোপনে সেরে নিতে চাইলেন কিছু জরুরি আলোচনা। আকাচাপানের ডাক পেয়ে নাও এল হন্তদন্ত হয়ে। বলল, বলো মাহে, হঠাৎ ডেকে পাঠালে যে, কোনো বিপদ?

ঘাড় নাড়লেন লাকা, নাহ, নতুন করে আর কী বিপদ হবে আমাদের, আমরা তো সর্বদা বিপদের মধ্যেই আছি।

একটু বিষণ্ণ ভাবে ঘাড় নাড়ল নাও। হুম ঠিক, তবে?

আকাচাপান বললেন, আজ তোর সঙ্গে আমি খুব জরুরি একটা শলা করতে চাই। ওই অচেনা লোকটা কিন্তু খাড়া হয়ে উঠেছে। এখন কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার সময়। বিচার সভায় বসার আগে তোর মতামত আমি শুনতে চাই।

নাও বলল, বাদ দাও মাহে, এই বিষয়টা থেকে আমাকে বাদ দাও। তোমার যা ভালো মনে হয়, করো। আমার কথা তো শেষমেশ তোমরা শুনবে না। শুধুমুধু আমাকে ডেকে পাঠালে কেন? শিকারের বিষয়ে যদি কোনো কথা থাকে তো বলো। হরিণের সংখ্যা কিন্তু জঙ্গলে বেশ বেড়েছে, হরিণের মাংস যদি আমরা খেতে পারি তবে কিন্তু খাবারের সমস্যা আমাদের অনেকটাই কমে যায়।

ঘন ঘন মাথা নাড়লেন আকাচাপান, নাহ না, কখনও না। ও লাওদের ছাড়া জীব, ও আমাদের পেটে সহ্য হবে না। খোরাইয়ে শুরু হবে। যন্ত্রণায় ছটফট করে মরব। কোনো দরকার নেই, তাছাড়া অত সুন্দর দেখতে। সুন্দরকে কখনও মারতে নেই রে নাও।

ঘাড় নাড়ল নাও, হুম ঠিক বলেছ, আমি তো বাচ্চাগুলোকে দেখলেই পাতা খাওয়াই। হাসেন আকাচাপান, হাত বুলিয়ে দেন নাওয়ের মাথায়, বলেন তোর মনেও তার মানে দয়া আছে বল। রাগটা শুধু বাইরের। শোন মাথা ঠান্ডা কর, তোর সঙ্গে আলোচনা না করে তো আমি কোনো কাজ করি না। লোকটা কিন্তু এ কদিন আমাদের সঙ্গে থাকায় আমাদের সব কিছুই জেনে গেছে, এই মুহূর্তে ওকে কিছুতেই বাইরে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। হয় মেরে ফেলতে হবে নইলে চোখে চোখে রেখে আমাদের মধ্যেই আটকে রাখতে হবে। এখন মেরে তো খুব চট করে ফেলাই যায় তবে আমার মাথায় কতগুলো কথা ঘুরছে।

নাও বলল, আমি জানতাম লোকটাকে না মারার জন্য তুমি নানা রকম ফন্দিফিকির আওড়াবে। আমি তোমার মনের কথাই বলে দিচ্ছি, লোকটাকে মেরো না, রেখে দাও। হরিণের মতো লোকটাও দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর। সুন্দরকে মারতে নেই।

আকাচাপান নাওয়ের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ও নাও, নাও, শোন বাবা শোন, অত রাগ করিস না, তুই বললে লোকটাকে আমি নিজের হাতেই মেরে ফেলব। অনেকদিন শিকার করিনি আমি, হাতটা নিশপিশ করে আমার, কিন্তু লোকটাকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তবে মনে হয় আমাদের লাভ আছে। নাও রাগত চোখে আকাচাপানের দিকে তাকিয়ে বলল, কী রকম?

আকাচাপান ফিসফিস করে বললেন, লোকটার বুদ্ধিসুদ্ধি বেশ ধারালো, আমি লক্ষ করে দেখছি বেশ চটপট ও কথা বুঝে নিতে পারে। ওকে দিয়ে যদি আমরা অন্য আকাদের মধ্যে এই কথাটা ছড়িয়ে দিতে পারি যে এসো আমরা নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে এক হয়ে যাই। ওই সাদা লাওগুলোর শক্তি অনেক, আমরা একা এই ক’জনা মিলে কিছুতেই ওদের বিরুদ্ধে লড়তে পারব না।

নাও বলল, অন্য আকারা তো তোমার মতো বোকা না। তারা কেউ ওকে ধারে কাছে ঘেঁষতেই দেবে না, তার আগেই ওকে মেরে দেবে।

আকাচাপান বললেন, দিলে দেবে, তবে তো ল্যাঠা চুকেই যাবে। একবার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কী। ওকে যদি আমারা চোখে চোখে রাখি এই ঘন জঙ্গল থেকে ও কিছুতেই বেরতে পারবে না। এছাড়া আরও গভীর জঙ্গলে গিয়ে ও একবার যা জারোয়াদের তীর খেয়েছে, ওদিকে যাওয়ার ও আর সাহসও করবে না।

নাও খানিকটা বিরক্তি ভরেই বলল, বেশ তোমরা যা ভালো বোঝো। তবে ওকে কিন্তু থাকতে হলে শিকারটা শিখে নিতে হবে। আমরা কেউ ওকে বসে বসে খাওয়াতে পারব না। নিজের খাবার ও যেন নিজে জোগাড় করে নেয়।

আকাচাপান বললেন, হুম তা তো বটেই, তা তো বটেই। তাছাড়া আজ রাতেই একটা সভা ডেকে আমাদের কথা ওকে জানিয়ে দিই এবং ওকে তীর-ধনুক বানানো, ছোড়া এসবের শিক্ষা দিতে আরম্ভ করুক পিচার। নাও পাথর থেকে উঠে চলে যেতে যেতে বলে গেল, হুম।

আকাচাপান তার স্ত্রীর কথা মেনে সেই দিনই বিচার সভা ডাকলেন না। আরও একটা দিন সময় নিলেন নিজের সিদ্ধান্তগুলো বিবেচনা করার জন্য। তারপর ডাকলেন সভা। সুরমাই চুপিচুপি এল বুধনাথের কাছে, বলল, তোমাকে সমুদ্রের ধারে পৌঁছে দিয়ে এলে তুমি পালাতে পারবে? ঘাড় নাড়ল বুধনাথ, উঁহু। মনে মনে বলল তোমাদের ছেড়ে আমার যে এখন আর পালাতেও ইচ্ছে করে না।

সুরমাই বলল, তালে তো মুশকিল, আজ রাতে তো তোমাকে ওরা মেরেও ফেলতে পারে। আমার দিদির অনেক ক্ষমতা, তুমি আমার দিদিকে বলো একটা উপায় বার করতে। বুধনাথ বলল, তুমিই বলো না তোমার দিদিকে, কাল থেকে তো তাকে আমি আর দেখতেই পাচ্ছি না। সে তো অমাবস্যার চাঁদ, তার কি আর অত সহজে দেখা পাওয়া যায়। তবে আমার মন বলছে তোমার দিদি আমায় ঠিক বাঁচিয়ে দেবে।

সুরমাই বলল, হুম আমারও মন তাই বলছে। আমার দিদির অনেক গুণ জানো, সে খুব ভালো তীর-ধনুক চালায়, আবার এই যে দেখছ আমার হাতে গলায় মাথায় সব কড়ি আর ঝিনুকের গয়না, এ সবও আমার দিদির বানানো। নাও তো রীতিমতো ভয় পায় আমার দিদিকে। ও ঠিক একটা উপায় বার করে ফেলবে তোমাকে বাঁচানোর। তবে আমার দিদির আবার রাগও সাংঘাতিক, ওকে যেন তুমি কোনো ভাবে রাগিও না, তাহলে এক নিমেষে তোমার বুকে বর্শা বিঁধিয়ে তোমাকে মেরেও ফেলতে পারে।

বুধনাথ বলল, আর তুমি? তুমি কী পারো?

সুরমাই বলল, আমি তো কিছুই পারি না, আমার কোনো গুণই নেই। তবে তোমাকে আমি কথা দিতে পারি, তোমাকে যদি কেউ তীর মারতে আসে আমি ঠিক গিয়ে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ব।

চমকে উঠল বুধনাথ, তারপর তার মাথায় ওপর হাত দিয়ে বলল, তুমি খুব ভালো, তোমার দিদি যদি হয় অমাবস্যার আলো, তুমি পূর্ণিমার। আমার মন বলছে তোমাদের ভালোবাসার জোরে আমার কিচ্ছু হবে না। বলতে বলতে চোখে জল চলে এল বুধনাথের, সে ধরা ধরা গলায় বলল জীবনে দৌড়তে দৌড়তে পালাতে পালাতে অনেক ঘাটের জল খেয়েছি আমি, জানি না সামনের দিনেও কী আছে, তবে তোমাদের এই মমত্বটুকু যেন আমার পরম পাওয়া। আর কিছু না হোক তোমরা যদি অনুমতি দাও আমি তোমাদের রামায়ণের গান শোনাতে পারি, শোনাতে পারি পদাবলী কীর্তন।

সবটুকু কী বুঝল কী বুঝল না সুরমাই, তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল, বলল, তুমিও না খুব ভালো।

বুধনাথ বুঝল গান কী জিনিস এরা জানে না, তবে গেয়ে শোনালে সুর ঠিক অনুধাবন করতে পারবে। সুরের তো কোনো ভাষা হয় না, দেশ কাল জল স্থল সব পেরিয়ে সুর মানুষকে নাড়া দেবেই। তবে আজ সভায় গিয়েই সে গান ধরবে। বাঁচালে তিনিই বাঁচাবেন, স্বয়ং নারায়ণ।

বিচারে প্রাণভিক্ষা পেল বুধনাথ। যদিও সে নাওয়ের জ্বলন্ত চোখ দেখে আর গান ধরার সাহস পায়নি, এমনকি লিচোকেও কিছু করতে হয়নি। মনে হল আগে থেকেই এদের সব ঠিক করা ছিল। আকাচাপান বললেন, শোনো, আজ তোমার জীবনের শেষ দিন হতে পারত, হল না শুধু একটাই কারণে তা হল তুমি খুব শীঘ্র আমাদের ভাষা রপ্ত করেছ। আমাদের কথা বুঝতে পারছ। তুমি বলিষ্ঠ। চেষ্টা করলে তুমি আমাদের শিকার বা যুদ্ধবিদ্যাও রপ্ত করতে পারবে। তুমি লাওদের সঙ্গে মিশেছ, ওদের সঙ্গে থেকেছ। ওদের অনেক ধরনধারণ জানো, সেগুলোর হদিশ দিয়ে তুমি আমাদের সাহায্য করবে। আবার আমাদের জঙ্গলেরই অন্য উপজাতিদের ভাষা বোঝারও চেষ্টা করবে। ওদের বোঝাতে চেষ্টা করবে আমরা আর পরস্পরের শত্রু থাকতে চাই না। লাওরা আমাদের শত্রু। আমরা একত্রে লাওদের বিরুদ্ধে লড়তে চাই। যারা গাছ কাটে, জঙ্গলের বিনাশ করে তাদের কোনো অবস্থাতেই এই দ্বীপে থাকতে দেওয়া চলবে না। পিচার তোমাকে তীর-ধনুক তৈরি এবং চালনা করতে শেখাবে আর জঙ্গল চিনাবে লিচো আর সুরমাই। জঙ্গলে টিকে থাকা মোটেই সহজ কাজ না, এই সব শর্ত মেনে তুমি যদি টিকে থাকতে পারো তো পারবে, না হলে যে কোনো দিন প্রাণ হারাতে হবে তোমায় আমাদের হাতে।

বুধনাথের যেন মনে হল স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল তার মাথায়। স্বয়ং নারায়ণ বুঝি তাঁর শয়ন কক্ষ সাজানোর ভার দিয়েছেন তাকে। সে নতজানু হয়ে নমস্কার জানালো আকাচাপানকে। বলল, এই আমি মাটি ছুঁয়ে বলছি আমি সর্বতো ভাবে চেষ্টা করব তোমাদের সাহায্য করার। অদ্যাবধি শেখা যা কিছু শিক্ষা আমি চাইলে দিতে পারি তোমাদেরকে। দিতে পারি বহির্জগৎ সম্পর্কে যা কিছু অর্জিত জ্ঞান। লাওরা তোমাদেরও শত্রু, আমারও। ওদের জব্দ করবার যে কোনো ফন্দিফিকিরে শামিল হতে আমি রাজি। তোমরা আমায় প্রাণ ভিক্ষা দিয়েছ, সেবা যত্নে বাঁচিয়ে তুলেছ, তোমরা আমার কাছে প্রাণাধিক। আমি কৃতজ্ঞ, আকাচাপান তুমি আমার অভিবাদন গ্রহণ করো। নাওয়ের ভয়ে আকাচাপান ওপরে বেশি আবেগ দেখানোর সাহস পেলেন না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁর অন্তরটা কেন যেন অকারণেই আর্দ্র হয়ে উঠল। তবে ওপরে কাঠিন্য বজায় রেখে বললেন, বেশ তবে কাল থেকেই তুমি আমাদের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে শুরু করো। তোমার শরীর দুর্বল। তাছাড়া তুমি জঙ্গলে নতুন, তাই প্রথমেই অধিক পরিশ্রম করতে যেও না। ধীরে ধীরে একটু একটু করে এগোও, তুমি আর আমাদের ভয় পেও না, আমরা এখন থেকে কেউ আর তোমার শত্রু নই। আমরা আদিবাসীরা কথার দাম আর মাথার দাম এক বলে জানি।


পঁচিশ


মাথার নীচে দুই হাত রেখে পায়ের ওপর পা তুলে বাঁশঝাড়ের ভিতর শুয়ে ছিল বুধনাথ। শরীরটা তার এখনও বেশ দুর্বল। সামান্য কাজ করতে গেলেই যেন হাঁপিয়ে পড়ছে। পিচার বলে ছেলেটার সঙ্গে বেশ কিছু ভাব হয়েছে আজ। চুই গাছের কাঠ চেঁছে ধনুক তৈরি করা শিখিয়েছে সে বুধনাথকে। প্রথমটায় বেশ ভালোই লাগছিল। নতুন কিছু শিখতে বুধনাথের ভালোই লাগে। কিন্তু ধনুকের গায়ে যখন শুয়োরের রক্ত আর চর্বি মাখাতে শুরু করল ছেলেটা তখন গাটা গুলিয়ে উঠল বুধনাথের। পিচার বলল এতে নাকি ধনুক শক্ত আর নমনীয় হবে। তা হয়তো হবে কিন্তু বুধনাথের নিজ হাতে এই কাজ করা খুবই কষ্টকর। যেমন কষ্টকর হয়েছিল যেদিন দেখেছিল জলের বদলে এরা রক্তের মধ্যে সেদ্ধ করে কচ্ছপের মাংস খাচ্ছে। লিচো তাকে বুঝিয়েছিল এতে নাকি শরীরে তাকত বাড়ে। সে যে বাড়ে তা তো এদের দেখেই মালুম হচ্ছে। এতদিন গাঁয়ে গঞ্জে তার শক্তি নিয়ে বেশ একটু গর্ব ছিল। কুস্তিতে সে অনেক পালোয়ানকে হারিয়েছে, কিন্তু এদের কাছে তার গায়ের জোর তো নস্যি।

তবে তার কিন্তু এই নতুন জীবন মন্দ লাগছে না। সে তো অল্পস্বল্প লেখা পড়া শিখেছে, রামায়ণ মহাভারত পড়েছে, তাছাড়া ওই ফাদার সাহেবের কাছেও শিক্ষা পেয়েছে। সে তো জানে মানুষ একদিন এরকমই ছিল। তারপর ধীরে ধীরে তারা চাষাবাদ শিখেছে, সভ্য হয়েছে। তার যেন মনে হচ্ছে সে কেমন করে হঠাৎ সেই আদিম পৃথিবীতে এসে পড়েছে। তার সেই ফাদারের কাছে গল্পে শোনা না-দেখা পৃথিবীটা চোখের সামনে যেন চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। আর তার সেই স্বপ্নের দুনিয়াকে আরও রঙিন করে তুলেছে এই দুই বোন, লিচো আর সুরমাই। তার কষ্টটা যেন লঘু হয়ে আসছে। অন্তত ওয়াকার সাহেবের নরকযন্ত্রণার থেকে অনেক ভালো।

তবে অস্ত্র তৈরির থেকে অস্ত্রচালনা কিন্তু বেশ কঠিন কাজ। বিশেষ করে শিকার করা। এতদিন সে মানুষের সঙ্গে লড়াই করে এসেছে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বনের পশুরা আত্মরক্ষায় মানুষের থেকে অনেক বেশি দড়। কিছুতেই সে লক্ষ্যভেদটা রপ্ত করতে পারছে না সেভাবে। তার নাকাল অবস্থা দেখে লিচো যখন হেসে কুটোপাটি হয়ে যাচ্ছে তখন সে আরও ঘাবড়ে যাচ্ছে। ছিঃ ছিঃ, সে নাকি বন্দুক চালিয়েছে! আর তীর ধনুক নিয়ে তার এমন নাস্তানাবুদ অবস্থা! নিজের ওপরেই নিজের খুব রাগ ধরছে বুধার।

একদিন পিচারকে সরিয়ে দিয়ে লিচো এল বুধার হাতের অবস্থান ঠিক করতে। তার নগ্ন নিটোল কালো সুউচ্চ বক্ষদেশ যখন বুধার পাঁজর স্পর্শ করল, লক্ষ সিংহ যেন লাফিয়ে উঠল বুধার ভিতরে। আদিম পৃথিবীর নগ্নতা নিয়ে এরা সর্বসময় ঘোরাফেরা করছে তার পাশে, কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই ওদের নিজেদের, কিন্তু বুধার শরীর এমনিতেই থেকে থেকে আনচান করে ওঠে। শুধুমাত্র ভয়ে স্তিমিত করে রাখে সে নিজেকে। কিন্তু স্পর্শসুখের অস্থিরতা যেন আর দমন করা যাচ্ছিল না। অথচ পিচার দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। লিঙ্গ উত্থান তার চোখ এড়াবে না, আর এ খবর সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে নাওয়ের কাছে। তাই সে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল লিচোকে, বলল, মেয়েদের কাছে আমি অস্ত্রশিক্ষা করি না, আমাকে পিচারের কাছ থেকেই শিখতে দাও। অপমানিত লিচো তীর-ধনুক ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল জঙ্গলের মধ্যে।

পিচার বলল, কাজটা তুমি ঠিক করলে না, লিচোর রাগ সাংঘাতিক। কী জানি কী করে বসে।

মনে মনে হাসল বুধনাথ, বলল কিছু করবে না, আমি আছি না তাকে সামলাতে।

এমনিতেই বুধনাথ রসিক মানুষ। মেয়েরা হল রাধার জাত। নারায়ণ পুরুষের মধ্যে রসজ্ঞানের উদ্ভবই করেন শ্রীরাধিকার চরণ ছোঁবার জন্য। আহা কতদিন সে এসব পালাকীর্তন ভুলতে বসেছিল। এই শ্যামল ছায়ায় বুধনাথের শরীরে পুনরায় যেন রসের উদ্রেক হচ্ছে। কী সরল আর নিষ্পাপ এরা। এরা তো আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ধরে। এরাই তবে আসল ক্ষত্রিয়। কেন লোকে এদের শূদ্র বলে? বুনো বলে? এরা হয়তো শাস্ত্র পড়েনি, কিন্তু এরা স্বজ্ঞানে জ্ঞানী। আত্মরক্ষা, নিজের জাতিকে রক্ষা, এর চেয়ে বড় ধর্ম আর কী হতে পারে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, এবং নিজধর্মের দৃষ্টিতেও তোমার ভীত হওয়া উচিত নয়, কারণ ক্ষত্রিয়ের পক্ষে ধর্মযুদ্ধের থেকে বড় আর কোনো কল্যাণকর কর্তব্য নেই। এরা হয়তো গীতা পড়েনি কিন্তু পাপ কী জিনিস এরা জানেই না। এরা শুধু ধর্মটুকুই জানে। এদের কাছে সব যুদ্ধই ধর্মযুদ্ধ। এরা ভগবানের আশীর্বাদপুষ্ট। ভগবান বলেছিলেন না? হে পার্থ! স্বতঃপ্রাপ্ত, উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার সদৃশ এইরূপ ধর্মযুদ্ধ ভাগ্যবান ক্ষত্রিয়রাই লাভ করে থাকেন।

যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম।।

সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্।।

আরে, নিজে নিজেই যেন চমকে উঠল বুধনাথ, তাই তো সত্যে যিনি রাম, দ্বাপরে সেই তো শ্রীকৃষ্ণ। ভগবান নিজেই তো বুঝিয়ে দিয়েছেন গাত্রবর্ণে কিছু যায় আসে না। তাহলে কী করে ঘোর কৃষ্ণবর্ণের জন্য সাহেবরা এদের ঘৃণ্য মনে করল! এমনকি তারাও এদের অচ্ছুত মনে করল? ভুল ভাঙছে তার। যেন সত্যিকারের শাস্ত্রজ্ঞান হচ্ছে তার একটু একটু করে। এরা তাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে সে দায়িত্ব সে পালন করবার চেষ্টা করবে যথাসাধ্য করে। এদের ভালোবাসার দান তাকে দিতেই হবে। তার সাথীরা কে কোথায় জঙ্গলে হারিয়ে গেল, মরে গেল, তাকে তো ভগবান বাঁচিয়ে রেখেছেন নিশ্চয়ই কোনো কর্ম করার জন্য। এদের থেকে বহির্জগৎ সম্পর্কে তার জ্ঞানগম্যি বেশি। অতএব ধীরে ধীরে এদের নেতা হয়ে উঠতে হবে তাকে। না হলে রাজকন্যা লিচোর মন পাওয়া ভার।

আহা কী রূপ। গাঁয়ে গঞ্জে কত রূপসীই তো সে দেখেছে, এমনকি রূপ দেখেছে মেমসাহেবেরও, কিন্তু এ যেন সাক্ষাৎ মা ভবানী। তবে মা ভবানীর অত রূপ তো এক অঙ্গে ধরে না, তাই বহিঃরঙ্গে লিচো তো অন্তরাত্মায় ওই কচি মেয়েটা, যেন পবিত্র জলের ফোঁটা কচুপাতার ওপর সবসময় টলটল করে। বাব্বা, সেদিন লিচোর মান ভাঙাতে কম কসরত করতে হয়নি বুধনাথকে। যেন তেজি গোখরোকে বশ মানিয়ে ঝাঁপিতে পোরার শামিল।

সেদিন শেষমেশ হরধনু ভঙ্গের পণ করে পিচারের সাহায্যে বুধা কিছুটা রপ্ত করেছিল তীর ছোঁড়া, কিন্তু চোখ টাটাতে শুরু করেছিল খুব। ভুরুর ওপরে বেঁধা তীরের ক্ষতটা সারলেও চোখটায় মাঝে মাঝেই যন্ত্রণা বোধ হয়। পিচারকে সে কথা জানাতেই পিচার বলেছিল, আজ তবে থাক। আমি একটু ফলপাকুড়ের সন্ধানে যাই। তুমি বরং খানিক বিশ্রাম নাও। রোজ এই তাত্‌ গাছের এক একটা ফলকে সামনে রেখে তীর ছোড়া অভ্যাস করবে, দেখবে কিছু দিনের মধ্যেই লক্ষ্য স্থির হয়ে যাবে। লক্ষ্য স্থির করতে না পারলে তুমি কিছুতেই শিকার করতে পারবে না।

পিচার চলে যেতেই আনারসের মতো দেখতে কমলা রঙের ঝুলে থাকা কেতকী ফুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুধনাথের মনে পড়ল বালির বস্তা লক্ষ্য করে বন্দুকের গুলি ছোড়ার কথা। প্রথমদিন বন্দুকটা তুলতেই মনে হয়েছিল, বাবা কী ভারী। পরে কুচকাওয়াজের দোল রাখতে এক হাতে অনায়াসে বহন করেছে সে বন্দুক। লক্ষ্য পরিবর্তন হলে স্থির হতে কিছু সময় লাগে বই কি।

পিচারের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে লতাপাতা সরিয়ে বনের পথে পথে লিচোকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল বুধনাথ। নিজেকে কেমন যেন রাজা দুষ্মন্ত মনে হচ্ছিল তার। একেবারে ভয় যে করছিল না তাও নয়। রাগের বশে মা ভবানী হয়তো একখান বর্শাই ছুঁড়ে মারল তাকে লক্ষ্য করে, আর তার বক্ষ ভেদ করে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে হয়তো বিঁধে গেল সেই বর্শার ফলা। তা মা ভবানীর হাতে মরাও ভালো। জয় মা ভবানী বলে সে ইতিউতি তাকাতে তাকাতে এগোচ্ছিল, হঠাৎ বন শেষ হয়ে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে চোখ আটকে গেল তার, আঁতকে উঠল সে। ওখানে বসে কী করছে লিচো! ওখানে তো কোনো মেয়ে যায় না। ও যে ধুপকালা। লাল মাটি! ওই লাল মাটিতে পা ডুবিয়ে রাখলে যে গর্ভপাত হয়ে যায়! তবে কি? পা দিয়ে জল সরিয়ে ঠেলে ঠেলে বুধনাথ দ্রুত গিয়ে পৌঁছল লিচোর কাছে, পিছন থেকে জাপটে ধরল সে লিচো কে।

—লিচো, লিচো, তুমি এখানে এসেছে কেন? এ তো ভালো জায়গা নয়, তুমিই তো একদিন দেখিয়েছিলে আমাকে। ফুঁসে উঠে পিছনে তাকাল লিচো। চোখ তার লাল আর জলে পূর্ণ, মসৃণ কালো ত্বকের ওপর পিছলে যাচ্ছে রোদ, পিছলে গিয়ে পড়ছে জলের ওপরে আর ঝিলমিল তরঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে দূরে।

বুধনাথ ভয়ে ভয়ে শুধাল, তুমি কি— তুমি কি—?

লিচো কোনো উত্তর দিল না কিছুক্ষণ, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না, জানি না, তবে যাতে কোনো সম্ভাবনাও না থাকে তাই আমি বসে আছি এখানে পা ডুবিয়ে। এবার চোখ জলে পূর্ণ হয়ে গেল বুধনাথের। বলল, কেন লিচো, কেন? আমি কি এতই অন্যায় করেছি? তুমি বোঝো না কেন তখন তোমায় আমি সরিয়ে দিলাম। সামান্য তাও পাতার আচ্ছাদন আমার চাঞ্চল্য ঢাকতে অপারগ। তোমার স্পর্শে আমি উন্মাদ হয়ে যাই।

কিছু না বলে পাথরের ওপর থেকে উঠে পড়ল লিচো, জল সরিয়ে ফিরতে গেল পারের দিকে। পাথরটা কিন্তু বেশ কিছুটা জলের গভীরে। বুধনাথ দুই হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল লিচোকে, বলল তোমাকে আর ওই দূষিত লাল কাদার মধ্যে দিয়ে আমি হাঁটতে দেব না। তারপর জল সরিয়ে সরিয়ে সে পাড়ের দিকে না গিয়ে চলতে লাগল ওই জায়গা ছেড়ে অন্য পাড়ের দিকে। পুলকিত শিহরিত লিচো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল বুধনাথের দিকে। ওদের মনেও রইল না দূরদূরান্তে ঝোপের আড়াল থেকে ওদের কেউ লক্ষ করতে পারে। জল সরিয়ে সে চলতেই লাগল, চলতেই লাগল, অনেক দূরে। ঢেউয়ের ধাক্কায় সামান্য টলমল হতে দুহাতে লিচো জড়িয়ে ধরল বুধনাথের গলা। চলতে চলতে সে এসে থামল নীল জলের ভেতরে একটা পাথরের চাতালে, তারপর আস্তে করে লিচোকে শুইয়ে দিল সেখানে। তখন সে অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে, কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে পায়ে ভর দিয়ে পাথরের ওপর উঠে তার ভারী শরীরটা উপুড় করে দিল লিচোর শরীরের ওপরে, তারপর জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল সে। হাঁপাচ্ছিল লিচোও। ওদের দুজনার শরীর দুটো বর্শায় বেঁধা মাছের মতো আটকে রইল, ছটফট করতে লাগল, দুলতে লাগল ঢেউয়ের ওপরে। অভিমানিনীর মান ভাঙছিল তরল নদীর মতো। পুণ্যস্নানে বুধনাথের শরীরে উজ্জীবিত হয়ে উঠছিল নতুন প্রাণ।

এত সবের মধ্যেও কিন্তু বুধার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে পূর্বাশ্রমের কথা। বিশেষ করে ওই পলায়নপর্ব। মজনু ভাইয়ের সঙ্গে তার ভাব হয়ে গিয়েছিল বেশ। লোকটা অত কষ্টের মধ্যেও কেমন শায়েরি বলত, ছড়া কাটত। প্রাণে গান থাকলে তা ফুঁড়ে বেরবেই। ওই দেখ না ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাটির ঢিপি কেমন ভুটভুটায়, নীল সাদা কাদা তোলে, ধোঁয়া তোলে। ভেতরে যে আগুন আছে তা টের পাওয়া যায় সর্বক্ষণ। লোকটা নিজের কাব্যর থেকে গালিবের শেরই বেশি বলত। অবশ্য সবার সামনে বলত না। বিদ্রোহী সিপাহিরা গালিবকে দেখতে পারত না দু’ চক্ষে। মহাবীরের কথা যদি সত্যি হয় তবে লোকটা সত্যিই খুব একটা সুবিধার নয়। যখন যার কাছ থেকে টাকা আদায় হবে বলে জানত তারই গুণগান গাইত। তবু পদগুলো কিন্তু ভারী ভালো। মজনু ভাই যখন আওড়াত, বুধা মন দিয়ে শুনত।

যখন তুমি ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই হা ঈশ্বর,

তো এই আলোড়নের কী প্রয়োজন।

কারা তবে এই পরীর মতো সুন্দরীর দল।

কেনই বা এই মেয়েলি ছলনা!

দুনিয়াদারি নিয়ে এত স্তাবকতা!

চুলের এই ছল কেনই বা এত সুগন্ধময়!

ভ্রমর চোখে কেনই বা এত কটাক্ষ।

কোথা থেকে জন্ম নিয়েছে এই ফুল গাছপালা!

মেঘই বা কী! আর কীই বা বাতাস!

সকলের কথা মন দিয়ে শুনতে শুনতেই এত জ্ঞানগম্যি হলো বুধার। না হলে সে আর কতটুকু জানত। কে বলতে পারে? কার জাদুতে বাঙ্‌ময় হল এত সব। আহা, এ তো যেন তারই কথা। কুড়ুল চালাতে চালাতেও সে থেমে গিয়ে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকত ডালপালা ছড়ানো বৃহৎ গাছগুলোর দিকে।

একাধারে ওই আশিজনের ফাঁসি দেখে হাঁটু থেকে পা কাঁপছিল সবার। সব জোর যেন চলে গেছিল। একে হাতে পায়ে শিকল বাঁধা তাই নিয়ে জঙ্গল সাফ, কুয়ো খোঁড়া, মাটি কাটা, জলা বোজানো, বাড়ি গাঁথা হাজারো কাজ করতে হত সারাদিন। সকাল থেকে সন্ধ্যে, প্রায় একটানা নয়-দশ ঘণ্টা। তার সঙ্গে মিলত কাজ দেখে সাহেবের মন না ভরলে চাবুকের বাড়ি। প্রথমে মহাবীর আর ভঞ্জ কাকা মিলে যুক্তি করল। চারিদিকে ঘুরছে শিকারি কুকুর, কোনো কথা বলবার জো নেই, খবর চলে যাবে সাহেবের কাছে। তবে দল বাঁধবার উপায়? উপায় বের হল, সংকেতে ছড়ানো হবে কথা। এই গভীর জঙ্গলে কেউ একা পালানোর সাহস পায় না। যা করতে হবে দল বেঁধে করতে হবে। সকলে মিলে একসঙ্গে পালালে কেউ না কেউ পালাতে পারবেই। সকলেকেই একসঙ্গে তাড়া করার মতো অত গোরা সৈনিক এখানে নেই।

কিন্তু শেষরক্ষা হল না। তারা একদিন সকালে জঙ্গল কাটার সময় একানব্বই জন একসঙ্গে পালাল। সাহেব টের পেয়েও আটকাতে পারল না প্রায় কাউকেই। তবে সাহেবের গুলিতে মরেছিল অল্প সংখ্যকই, বেশির ভাগই মারা গেল জংলিদের ছোড়া তীরে, কেউ মারা গেল জঙ্গলে পথ হারিয়ে, না খেতে পেয়ে, সাপখোপের কামড় খেয়ে। এক বোধ হয় বেঁচে আছে সে একাই। কে জানে তার মতো আর কেউ আছে কিনা কোথাও বেঁচেবর্তে। সাংকেতিক ভাষা তৈরি করেছিল মজনু ভাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে-ই আর সাহস করে পালাতে পারল না। প্রথমেই মহাবীর হাত করেছিল কামারশালের কামারকে, যে তৈরি করেছিল হাত-পায়ের কড়া। জোড়ের জায়গাগুলো সে এমন দুর্বল করে তৈরি করেছিল যে কুড়ুলের এক কোপেই যেন তা ভেঙে যায়। গাছে কোপ মারার সময়ই সাবধানে পায়েও কোপ মেরেছিল তারা, সামান্য কোপেই কড়া ফাঁক হয়ে গিয়েছিল জোড়ের জায়গা থেকে, উদাস হয়ে ভাবে বুধনাথ, কী জানি সেই কামারের কী হাল করেছে গুলাগ ওয়াকার।








এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *