novel-nona-jol-5-of-5

নোনা জল
অনিন্দিতা গোস্বামী

ছাব্বিশ


বুধনাথের কাজটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। যদিও অন্য উপজাতিগুলোর ভাষাও প্রায় একই রকম, বহু শব্দই প্রায় এক। তবু তাদের কাছে ঘেঁষাই ছিল প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। আর এই কাজটায় তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে সুরমাই। মেয়েটার মধ্যে এমন একটা ব্যাপার আছে যে ওর সামনে এসে শত্রুপক্ষের তীরও থমকে যায়।

বুধা খুব সন্তর্পণে শুরু করল অন্যান্য উপজাতিদের সঙ্গে মিশবার প্রক্রিয়া। আর একটি উদ্দেশ্যও ছিল বুধার মনে। যদি তারই মতো কেউ মিশে গিয়ে থাকে অন্য কোনো উপজাতিদের মধ্যে। তবে ভাববিনিময় অনেক সহজতর হয়। সুরমাই তাকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেত। দেখিয়ে দিত অন্যান্য উপজাতিদের শিকারের এলাকা। শিখিয়ে দিত কীভাবে গাছের ডালে ঝুলে পড়ে পাতার আড়ালে থেকে বাঁচাতে হয় নিজেকে। কী তাদের মধ্যে বশ্যতা স্বীকার করবার ভঙ্গী। মুখ দিয়ে একটা বন্ধত্বপূর্ণ শব্দ বার করে একডাল থেকে ঝুলে সুরমাই বুধাকে নিয়ে চলে যেত অন্য ডালে। লিচোর মধ্যে আপোসের কোনো মনোভাবই নেই। সে উগ্র। অন্য উপজাতিদের সঙ্গে মেলামেশায় তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে তার নিজের জাতিকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে। যুক্তির কাছে, পরিস্থিতির কাছে হার মেনে আকাচাপানের কথা তাকেও মানতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত, কিন্তু মন থেকে সে মানতে পারেনি ব্যাপারটা। তাই সে এই কাজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে সুরমির ওপরে।

বুধনাথ সারাদিন অবাক হয়ে দেখে এই ছোট মেয়েটিকে। কী মিষ্টি, কী মিষ্টি। ছোট মানে বুধনাথের থেকে সে বয়সে যে খুব বেশি ছোট তা নয়, কিন্তু ওর সারল্যের জন্য ওকে ওর বয়সের থেকে অনেক কম দেখায়। এরা বিয়ে করে বেশ বেশি বয়সে। লিচো বোধ করি প্রায় তারই বয়সী। সে তুলনায় সুরমি বেশ কিছুটা ছোট তো বটেই। ওর হাবভাবও অনেকটা নিষ্পাপ শিশুর মতো, মায়াও যে প্রেমের আর এক ধরনের প্রকাশ তা প্রথম ওকে দেখে টের পায় বুধনাথ। কেমন যেন সারাদিন দুঃখী দুঃখী থাকে মেয়েটা। কথা খুব কম বলে আর একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই কেমন যেন বুকের মধ্যে নেতিয়ে পড়ে। ওর উন্মুক্ত শরীরে উদ্যত কাম নেই। আছে মমত্ব। প্রথম প্রথম বুধার কিছুটা অস্বস্তি হত, কিন্তু তারপর একদিন সে আবিস্কার করল এক আশ্চর্য আনন্দ। যে আনন্দ সে কখনও পায়নি, কোনোদিন পায়নি। ওকে স্পর্শ করতেই এক অপার্থিব আলো যেন ছড়িয়ে গেল বুধনাথের সারা শরীরে।

সে কিছুদিনের মধ্যেই যোগাযোগ করে ফেলল জঙ্গলের বিভিন্ন দলের মধ্যে। এদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা সহজ হল এই কারণেই যে এদের মধ্যে ভাষাগুলো প্রায় একই রকমের আর এরা এই মুহূর্তে সকলেই ভীত ওই লালমুখো সাদা ভূতগুলোর জন্য। সকলেই শঙ্কিত জঙ্গল ছেদন সম্পর্কে, সকলেই নিজের অস্তিত্বের সংকটে ভোগা ছোট ছোট এক-একটা দল। সকলেই বুঝতে পারছিল সংঘবদ্ধ না হলে ওই শক্তিশালী শত্রুদের সঙ্গে লড়া যাবে না। বুধা একটা কাজের কাজ করতে পারল। বিভিন্ন গোষ্ঠীর আকাচাপানদের মধ্যে বসে একটা আলোচনার ব্যবস্থা করল সে। ওই আলোচনা তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা শিকারের এলাকা দখল নিয়ে যে-লড়াই তা বন্ধ করে এই জঙ্গলের ওপরে তাদের দখল কায়েম রাখার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করল। সকলেই লাকাকে নেতা হিসাবে মান্য করতে চাইল। এবং বুধনাথকে পরামর্শদাতা। খুব দ্রুত আকা বেওয়া উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল বুধনাথ। বুধনাথের বুদ্ধিতে লাবিরিন্থ দ্বীপ হয়ে উঠল আন্দামানি উপজাতিদের একটা শক্তিশালী ঘাঁটি।

সকাল সকাল ডুঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে পড়ত বুধনাথ। সঙ্গে কোনোদিন থাকত লিফে, কোনদিন পিচার। আর সুরমি থাকত রোজ। খুঁজতে খুঁজতে বুধনাথ একদিন দেখা পেয়ে গেল সাদলুর। বুধনাথকে দেখে সাদলুর একেবারে জড়িয়ে ধরল বুকের মধ্যে, বলল, আমাকে মেরেই ফেলত এরা, শুধু এরা খবর পেয়েছে আকা বেওয়ারা তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাই আমাকেও বাঁচিয়ে রেখেছে এরা। তবে সবসময় কড়া পাহারায় রাখে আমাকে।

বুধনাথ হেসে বলল, পাহারাদার আমারও আছে তবে তারা খুব কড়া নয়। যে কোনো ভাবে হোক কিছুটা ভালোবেসে ফেলেছে আমাকে ওরা। ওই যে ডুঙ্গিতে বসে আছে মেয়েটিকে দেখছ, ও আর ওর দিদির মস্ত ভূমিকা আছে এতে।

সাদলুর হেসে বলল, বুধনাথ নারীসঙ্গের কপাল তোমার চিরকালই ভালো। এই জলজঙ্গলও তোমাকে নিরাশ করেনি।

বহুদিন বাদে তার পূর্বজীবনের মতো সাদলুর পিঠে চাপড় মেরে হো হো করে হেসে উঠল বুধনাথ। তবে প্রয়োজনীয় কাজটাও অনেক সহজ হয়ে গেল সাদলুরকে সঙ্গে পেয়ে। যে বুধনাথকে একসময় কেউ পুছতই না, তাকে এরা প্রায় নেতার আসনে বসানোয় সেও যেন অনেক বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠল আগের চেয়ে।

একদিন জঙ্গলের মধ্যে লিচো গলা টিপে ধরল বুধনাথের। খুব বেশি কাজ বেড়ে গেছে না তোমার? নাও তোমার ওপর এমনিই খাপ্পা আমি ওকে আরও লেলিয়ে দেব তোমার ওপরে।

বুধনাথ বলল, আমার অপরাধ?

লিচো বলল, সারাদিনে একটু কথা বলারও সময় পাও না বুঝি তুমি?

মুচ্‌কি হেসে বুধনাথ বলল, দিনের থেকে রাতের কথাই আমার বেশি পছন্দ।

লিচো বুধনাথের বুকে একটা ধাক্কা মেরে বলল, দরকার নেই। আমি নাওকে বিয়ে করব, আকাচাপান কে বলে দেব কাল। চমকে উঠল বুধনাথ, এই তো স্বাভাবিক, স্বজাতিতে বিয়ে করবে ওরা। তবে বুধনাথকে একথা বলার অর্থ কী? তবে কি বুধনাথকে বিয়ে করবে এমনই ভেবেছিল লিচো? খানিক দ্বন্দ্ব নিয়ে চুপ করে থাকল বুধনাথ। বিবাহের বন্ধন চিরকালের বন্ধন। তবে কি এই জঙ্গলেই চিরকাল কাটিয়ে দেবে সে? কিন্তু এছাড়া আর উপায়ই বা কী? তবু উত্তরে মুখে কিছু না বলে মাথা নিচু করে উল্টো দিকে হাঁটা দিল বুধনাথ।

মাথা নিচু করে সে ঢালের দিকে হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে কী মনে করে সে পিছন ফিরে দেখল লিচো মাথা উঁচু করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে, আর তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। মন্দিরগাত্রে পাথর কুঁদে তৈরি করা অপ্সরার মতো ওই মূর্তিবৎ চিত্র যেন বুধার পা দুটোকে আটকে দিল মাটির সঙ্গে। কিন্তু সে এগিয়ে গেল না, ফের হাঁটা দিল জলের দিকে। তার বুকের ভেতরটা কে যেন ধোপানির কাপড়ের মতো মোচড়াচ্ছিল, কিন্তু তবু সে যেন মানতে পারছিল না সারা জীবনের মতো সে দুই হাত দিয়ে কচ্ছপের খোলের মধ্যে থেকে পোড়া মাংস তুলে চিবিয়ে খাবে, তার সন্তানও কপিবৎ উলঙ্গবাহার হয়ে লাঙ্গল দুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াবে জঙ্গলময়। মনে নেওয়া আর মেনে নেওয়ার মধ্যে যে দুস্তর তফাত তা বুঝতে বুঝতে সে ছোট ছোট নুড়ি তুলে ছুড়ে মারছিল সমুদ্রের জলের দিকে। সে ভাবছিল, পবনপুত্র হনুমান তুমি কেমন করে পার হয়েছিলে উত্তাল সমুদ্র এক লাফে!

হঠাৎই তার মনে এল এক বুদ্ধি। সে লাফ মেরে উঠে পড়ল সেখান থেকে, তারপর দ্রুত পায়ে চলল আকাচাপানের কাছে। কিন্তু তারও আগে নাওকে বুকে চেপে ধরতে হবে তার। নাওকে ছাড়া এ কাজ কিছুতেই করা সম্ভব হবে না।

সে জঙ্গলের আনাচেকানাচে খুঁজে বেড়াতে লাগল নাওকে। কিন্তু হদিশ করতে পারল না। অবশেষে শরণাপন্ন হল সুরমাইয়ের। সে আর কারোর গতিবিধি জানুক না জানুক এটা ঠিক জানে মেয়েটা ঘুরে বেড়ায় সমুদ্রের ধারে ধারে, আনমনে কী খোঁজে, কী দেখে। সুরমাইয়ের দেখা পাওয়া গেল সহজেই। তাকে সেকথা জানাতেই সে বুধার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল নির্দিষ্ট পথে। কে কখন কোথায় থাকে, কখন কোথায় কী শিকার পাওয়া যায়, কোন মাছ জলের ওপরে ভাসে, কোন মাছ পাওয়া যায় জলের গভীরে, কোন মেঘে বৃষ্টি নামে, কোন মেঘে ঝড় হয়, কখন কেঁপে উঠবে মাটি, কখন ঢেউ উঠবে বড় হয়ে সব এ মেয়ের নখদর্পণে। তবু সে সবসময় এমন ভাবে থাকে যেন সে কিছুই জানে না। এরা সবাই যদি ক্ষত্রিয় হয় তবে এ মেয়ে নির্ঘাত বৈষ্ণবী। তৃণাদপি সুনীচেন মৃদুনা কুসুমাদপি। কোন কাজে তার সাহায্যে চাইলে সে নিশ্চুপে তা করে দেবে, একবারও মাথা তুলে প্রশ্ন করবে না, কেন? কী হবে? এদিনও সে জিজ্ঞাসা করল না বুধা কেন খোঁজ করছে নাওয়ের। শুধু আঙুল দিয়ে দূর থেকে সে দেখিয়ে দিল নাওকে এবং বলে দিল আজ নাও ভালো কোনো শিকার পায়নি, পিঠের ওপর ঝুলছে একটা গোসাপ। নেহাত দায়ে না পড়লে এরা গোসাপ ভক্ষণ করে না। তাই নিশ্চয়ই নাওয়ের মেজাজ খারাপ আছে, বুঝে শুনে কথা বোলো। তারপর বলল, আমি এই ঝোপের মধ্যেই রইলাম। আমি তোমাদের কোনো কথা শুনব না, শুধু বিপদ বুঝলে সুরমাই বলে একবার ডেকো।

ঘাড় ঝাঁকাল বুধা, হুম ডাকব। তারপর এগিয়ে গেল।

আজকাল বুধা যেন ঠিক নিজেকে বোঝে না। সুরমাইয়ের কোমলতাই কি তাকে বেশি টানে, নাকি লিচোর অপ্রতিরোধ্য রাজসিক আকর্ষণ। যত দিন যাচ্ছে তার যেন মনে হচ্ছে সুরমাইয়ের কোলে মাথা দিয়ে দু’দণ্ড শুয়ে থাকতে পারলে বড় শান্তি পাওয়া যেত। বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল মাঝে মাঝে। সে নাওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল আরজুম, তোমার মতো ধনুর্ধর থাকাতে আমাদের যুদ্ধ জয় সুনিশ্চিত। এমন স্তুতিতে কাজ হল বেশ, নাও ভুরু কোঁচকাতে গিয়েও মৃদু হেসে ফেলল, বলল, আর ধনুর্ধর, জঙ্গল ক্রমে কমে আসছে, সঙ্গে শিকারও কমে আসছে জঙ্গলে। এই গোসাপ খেলে পেটে বড় ব্যথা হয় কিন্তু না খেয়েই বা উপায় কী বলো, কিছু না খেলেও তো তেতো বমি উঠবে গলা দিয়ে। বুধা বলল, হ্যাঁ সেই জন্যই তো তোমার কাছে আসা, জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে তোমাদের যদি সত্যিই চলতে হয় তবে জঙ্গল তোমাদের বাঁচাতেই হবে। সাহেবেরা এ জঙ্গল তোমাদের একটুও রাখবে না। এখানেও হয়তো নীল চাষ করাবে ওরা কয়েদিদের দিয়ে। তারপর জাহাজ ভর্তি করে পাঠাবে নিজেদের দেশে। অতএব ওদের এখান থেকে তাড়াতে না পারলে তোমাদের নিস্তার নেই।

নাও বলল, এ আর তুমি নতুন কথা বললে কী? এই জন্যই তো ভেবেচিন্তে আকাচাপান তোমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন অন্য দলের লোকেদের সঙ্গে কথা বলার। তবে তুমি কাজ করছ ভালোই। আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছি ব্যাপারটা মন্দ না। একসঙ্গে লড়তে পারলে আমাদের সুবিধাই হবে।

বুধানাথ বলল, হুম। শুধু তাই নয়, আমরা যে মিলিত হতে পেরেছি এই ভাবনাটাই ওদের ভয় পাইয়ে দেবে। তবে আমি আজ যে কথাটা বলতে এসেছি, বড় যুদ্ধে যাবার আগে আমরা যদি মাঝসমুদ্রে ওদের একটা জাহাজ দখল করতে পারি তবে খুব সুবিধা হয়। একটা জাহাজ মানে কিন্তু আমাদের এক হাজার জনের শক্তি। নাও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কথাটা খারাপ না, কিন্তু খুব কঠিন। ওরা জাহাজে সবসময় বন্দুক উঁচিয়ে থাকে। আগে আগে আমাদের কত ছেলেকে ওরা এমনি এমনি মাছ শিকারের সময়ই মেরে দিয়েছে।

বুধনাথ বলল, সেটাও একটা ভাববার বিষয়, বড় যুদ্ধে যাবার আগে অনাবশ্যক শক্তিক্ষয়ও আমাদের উচিত হবে না হয়তো। আমি আরও একটা কথা বলি তোমাকে, আমি যদি তোমাদের চাষবাস শেখাই আপত্তি আছে তোমাদের? বনজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে খাদ্য সংগ্রহের কষ্টটুকু তবে তোমাদের করতে হয় না।

নাও বলল, চাষবাস? সে কি সহজে হয়? না না আমরা আমাদের আদি জীবিকা কখনও ছাড়ব না। জঙ্গলই আমাদের মা, সে আমাদের ঠিক খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে। চাষবাস করতে গেলে আমরা ঠিক মারা পড়ব। আমাদের গায়ে বাইরের বিষ নেই বলে সাপের বিষও আমাদের রক্তে ওঠে না। নইলে কি জঙ্গলে আমরা টিকে থাকতে পারতাম।

কথাটা ঠিক। বুধা দেখেছে সাপে কামড়ালে এরা একটা বাঁধন দেয় ঠিকই কিন্তু তেমন কিছু হয় না এদের। এরা বাইরের নুন তেল কোনো কিছু খায় না বলেই হয়তো। প্রথম প্রথম নুন তেল ছাড়া খাবার খেতে বুধনাথের বেশ অসুবিধা হত তবে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আসলে সমুদ্রে নোনা জলে বসবাসকারী মাছ বা প্রাণীগুলো এমনিতেই কিছুটা নোনা। সে হাঁটতে হাঁটতে যুদ্ধের ছক সাজাতে লাগল মাথার ভেতরে। নাওয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বটা তার ভীষণ জরুরি ছিল। যাক নাওয়ের রাগ অনেকটাই কমেছে। এবার সে আকাচাপানের কাছে যুদ্ধের প্রস্তাব পাড়বে। সাদলুরের সঙ্গেও তার তেমনটাই কথা হয়েছে।

জরুরি ভিত্তিতে একটা আলোচনা বসানোর কথা বলতে হবে আকাচাপানকে। সাজিয়ে ফেলতে হবে চক্রব্যূহ রচনার ছক। ভেতরে ভেতরে ভীষণ রকম উত্তেজিত বোধ করছিল বুধনাথ। নেতা হবার স্বাদ যেন তার চারিয়ে যাচ্ছিল মাথার ভেতরে। যদিও এরা তাকে নেতা বলে ঘোষণা করে না কোনো সময়। এমনকি এখনও কিছুটা সন্দেহ রয়েই গিয়েছে এদের মধ্যে। তবু বুধনাথের কথা এরা যথেষ্ট মান্য করে। এরা নিজেদের জাতির ভেতরে ছাড়া কাউকে নেতা বলে মানে না ঠিকই তবে বুধনাথ বুদ্ধির জোরে আপনাআপনিই পদহীন নেতা বনে গিয়েছে। দ্রুত পা চালিয়ে সে যাচ্ছিল আকাচাপানের ঝুপড়ির দিকে।

বুধনাথের সব কথা মন দিয়ে শুনলেন আকাচাপান। তারপর বললেন, তিনি সকলের সঙ্গে আলোচনা করে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন। সবার আগে এ ব্যাপারে তিনি আলোচনা করবেন তাঁর স্ত্রী বোরোর সঙ্গে। মেয়েদের স্থির বুদ্ধি যে কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে খুব সহায়ক হয়।

যতটা উৎসাহ নিয়ে এসেছিল বুধনাথ, তা যেন একটু নিভে গেল। আসলে সে এই মুহূর্তে মনটা সরিয়ে রাখতে চাইছিল লিচোর থেকে। যথাসম্ভব নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছিল অন্যরকম কাজে। ভেবে পাচ্ছিল না লিচোর চোখের দিকে কী করে তাকাবে সে।

ঘন কালো মেঘ করল চারিদিকে। সকাল থেকে যেন আঁধার সরে না। সূর্যের দেখা নেই। আজ আর জঙ্গলে বেরবে না কেউ, সমুদ্রে তো যাবেই না। যে কোনো সময় ফুলে উঠতে পারে ঢেউ। এরা সারাদিন আজ আর কেউ খাবে না। এরা যখন যা পায় তাই খায়, খাবার জমিয়ে রাখে না এ সময়ের জন্য। এ ব্যাপারে এদের অনেকবার সতর্ক করেছে বুধনাথ, কিন্তু এরা শোনে না। মেজাজ বিগড়ে আছে বুধনাথের। তারই বিধি বাম। কোনো একটা কাজ সে উৎসাহ নিয়ে আরম্ভ করার মুখেই বাধা পড়ে। রাগ হল তার আকাচাপানের ওপরেও। কী দরকার ছিল শুধু শুধু আলোচনাটা দেরি করানোর। এমন নয় যে আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করা যেত। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে কাজে বাধা পড়তই।

বেলা গড়াতেই ঝুপড়ির সামনে এরা রজনের মশাল পুঁতল। তারপর সেটাকে ঘিরে চারপাশে গোল হয়ে বসল মেয়েরা। মেয়েদের ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল ছেলেরা। তারপর শুরু করল গান আর নাচ। এখনও গানের কথাগুলো খুব একটা ধরতে পারে না বুধনাথ তবে মনটা তার মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। সুর তাকে আমূল পাল্টে দেয়। ঘুরে ঘুরে নাচছিল ছেলেরা, দুলে দুলে গাইছিল মেয়েরা। দলের সবচেয়ে শক্তসমর্থ ছেলে নাও ধনুকে তীর প্রতিস্থাপন করে এগিয়ে গেল গোলের মধ্যে, তারপর রজনের আগুনে তীর গরম করে ছুঁড়ল আকাশের দিকে। তাদের বিশ্বাস এবার মেঘ কেটে যাবে আকাশের। আলো প্রবেশ করবে জঙ্গলে। তখন আবার শিকারে যেতে পারবে সবাই।

সত্যিই পরদিন সকালে মেঘ সরে গিয়ে আলো ফুটল আকাশে। আনন্দে উল্লাস করে উঠল সকলে। মুখের কাছটা হুকের মতো বাঁকানো লম্বা সরু গাছের ডাল নিয়ে হই হই করে কাঁকড়া ধরতে চলে গেল ছেলেপিলের দল। ঝাঁঝরি নিয়ে মাছ ধরতে গেল মেয়েরা, একটু বয়স্ক লোকগুলো বেরল ফলমূল আর শূকর শিকারে। আনন্দ যেন আর তাদের ধরে না। মেঘকে এরা খুব ভয় পায়। খুব ভয় পায় বিলিকুকে। বিলিকু মানে অপদেবতা। বিলিকু মাথা ঝাঁকালেই তো উত্তাল হয়ে উঠবে সমুদ্র। আজ ওরা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা প্রথম ফলটা দেবে বিলিকুকে। সুরমি তাকে বলছিল এসব কথা। মেয়েটা যখন গল্প বলে চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে তার। কী ভালো যে লাগে বুধনাথের ওর কাছ থেকে ওদের গল্পগুলো শুনতে।

সুরমি বলছিল ফল দেবার সময় একটা মন্ত্র বলতে হয়, জানো।

কী মন্ত্র?

মিমিকানবো এফোং।

তার মানে কি রাগ কোরো না বিলিকু?

বিস্ময়ে আরও বড় হয়ে উঠেছিল সুরমির চোখ, হুম! তুমি কেমন করে জানলে?

চোখ নাচিয়েছিল বুধনাথ, ওই তো! তারপর সুরমির চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলেছিল, আমি সব জানি।

সকলেই সেদিন আনন্দের মেজাজে। আকাচাপানের স্ত্রী বোরো তার ঘরের কোণ থেকে বের করেছে কাঠের পাত্রে ফেনানো মধুর পানীয়, আগুন জ্বালিয়ে তার ওপর কাঠের মাচায় চার পা বেঁধে ঝুলানো হয়েছে শুয়োর। শুয়োর মানে ‘রা’য়ের মাংস ওদের অতি প্রিয়। ওই আগুন ঘিরে ওরা ওলে লে লে করে শুরু করেছে নাচতে। একটু একটু করে মাংস সেদ্ধ হয়ে যখন চর্বি গলে গলে পড়বে আগুনে ওরা দুটো কাঠি দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে মাংস। আকাচাপান সকলের সামনে ঘোষণা করলেন বুধনাথের দেওয়া যুদ্ধের পরিকল্পনা। প্রস্তাব মনমতো হল সকলেরই। এমনকি নাওয়েরও। তখন আকাচাপান আর মিমি ঘোষণা করলেন আরও একটি আনন্দ প্রস্তাব। নাচ থামিয়ে মুহূর্তকাল থমকে দাঁড়াল সকলে।

আকাচাপান বললেন আমরা যখন অন্য সব গোষ্ঠীর সঙ্গে এক হয়ে লড়ব তখন তাদের মধ্যে আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাসটা অনেক বেশি সুদৃঢ় করা দরকার। বুধনাথ এখনও আমাদের কাছে বাইরের লোক। সে ক্ষেত্রে লিচোর সঙ্গে আমি বুধনাথের বিবাহ প্রস্তাব পেশ করছি। এই মন্ত্রণা আমাকে স্বয়ং তোমাদের মিমিই দিয়েছেন। তোমরা জানো বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনায় তার সিদ্ধান্তকেই আমরা শেষ কথা বলে মেনে নিই। বুধনাথ যেহেতু আমাদের হাতে বন্দি তাই বুধনাথের সম্মতির এক্ষেত্রে প্রয়োজন নেই। আমি প্রথমেই লিচোর মতামত চাইব। সকলে একসঙ্গে হর্ষধ্বনি করে উঠল। লাফিয়ে উঠল দুই হাতে তালি দিয়ে। কোমর উঁচু করে নাচিয়ে নিল পিছন। লিচো মাথা নিচু করে পিছন ঘুরে দাঁড়াল। সকলে বুঝল লিচোর সম্মতি আছে। আর একবার চিৎকার করে উঠল সকলে। নাও বাঁকা হাসি হেসে বলল, আকাচাপানের গায়ে এখন বাইরের বাতাস লেগেছে। সেই বাতাস ঝড় না হলেই হয়। বিলিকু ক্ষেপে উঠলে আমরা বাঁচব না কেউই। বিলিকু কিন্তু সবই দেখেছে।

বোরো চেঁচিয়ে উঠল জোরে, নাও, আকাচাপানের অসম্মান করিস তুই? তোর সাহস তো কম নয়? তার ওপরে কথায় কথায় বিলিকুর নাম টানছিস? তুই আগে আমাদের পুরো কথা শোন।

পিচার বলল, মাহে তুমি তোমার কথা বল। তোমাদের এই প্রস্তাব আমার খুবই ভালো লেগেছে। সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, আমাদেরও, আমাদেরও ভালো লেগেছে। লিচোর সঙ্গে বুধনাথের জুড়ি মানাবে খুব।

আকাচাপান বললেন, আমাদের গোষ্ঠীর প্রথা মেনে লিচোর সঙ্গে যাবে সুরমাইও, তবে লিচোর অনুমতি ভিন্ন বুধনাথ কখনোই মিলিত হতে পারবে না সুরমাইয়ের সঙ্গে। এ প্রস্তাবে কি সুরমাইয়ের সম্মতি আছে? এ ব্যপারে সুরমাইয়ের অসম্মতি জানাবার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। এ প্রথার অন্যথাও হয়।

লিচো বলল, সুরমি তুই একদম না বলে দে, আমি জানি পিচার তোকে পছন্দ করে। বুধনাথের তো তাকতই নেই। এই জঙ্গলে ও আজ আছে তো কাল নেই। তুই একবার লুকের জন্য কত ব্যথা পেয়েছিস। আবার কেন কষ্ট পেতে যাবি?

সুরমাই চুপ করে রইল দিদির কথায়। আকাচাপান ফের প্রশ্ন করলেন, সুরমাই তুমি তোমার মত জানাও।

সুরমি খুব ধীরে মৃদু ভাবে জবাব দিল, আমি সম্মত।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে ছিল বুধনাথ। তার মাথাটা কেমন ভোঁ ভাঁ ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছু চিন্তা করবার মতো অবস্থায়ই ছিল না সে। কিছু বোঝার আগে পিচার আর দলবল তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে আরম্ভ করল। রজনের আলোয় মায়াবী হয়ে উঠল বনতল। আকাচাপান বললেন, একই সঙ্গে আমরা নাওয়ের বিয়েও দিতে চাই জিরাকের সঙ্গে। নাও, তোমার আপত্তি আছে?

নাও বলল, কিছুমাত্র না। জিরাক দলের অন্যতম কর্মঠ মহিলা।
জিরাকের সম্মতি চেয়ে আকাচাপান তাকালেন তার দিকে। জিরাকও পিছন ঘুরে সম্মতি জানাল।

ঠিক হল পূর্ণচন্দ্র তিথিতে সম্পন্ন হবে বিবাহ উৎসব। জ্বলবে রজনের আলো, হবে কচ্ছপ ভক্ষণ, নাচ, গান, আর মধু এবং কাঁচা সুপুরির নেশা।

নতুন করে ঝুপড়ি তৈরির কাজ শুরু হল নব দম্পতিদের জন্য। শুরু হল মধু সংগ্রহের কাজ। বুধনাথ কেমন যেন আবেগ উপচানো তরল পাত্রের মধ্যে টলটল করতে লাগল দিনরাত। তার জীবনে যা ঘটছে তা কি সত্যিই ঘটছে, না সে স্বপ্ন দেখছে! স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে বুধনাথের। তবে তার থেকে থেকে একথাও মনে হচ্ছে তার দু’পায়ে যেন শেকলের বেড়ি পড়ল যা কেটে বেরনো সহজ নয়। এই জীবনকেই সম্পূর্ণ রূপে মেনে নিতে মনকে প্রস্তুত করতে শুরু করল বুধনাথ। এদের ভালোবাসার যেন কোনো প্রতিদান হয় না, এমন ভালোবাসা জীবনে কোনো দিন তো সে পায়নি কারও কাছে!

সাতাশ


মহা সমারোহে সম্পন্ন হল বিবাহ উৎসব। স্বর্ণলতার নরম বিছানায় শুলো বুধনাথ আর লিচো। সুরমাই গিয়ে শুয়ে পড়ল তার মায়ের কাছে। বুধনাথ লিচোকে স্পর্শ করতেই লিচো ডানা-মেলা পাখির মতো উড়ে বসল বুধনাথের বুকের ওপর। বুধনাথের খুব ভালো লাগে একটা ব্যাপার। এরা শিকারি জাত, কিন্তু এরা পাখি শিকার করে না। এখানকার পায়রাগুলোও অদ্ভুত, অনেক বড়, অনেকটা মুরগির মতো আর বহুবর্ণ, যেমন অদ্ভুত লিচোর কবোষ্ণ স্তনভার। বুনো গন্ধে মাতোয়ারা আর পেলব। তবু কেমন যেন আনমনা লাগছিল বুধনাথের। কেবলই সুরমাইয়ের কথা মনে পড়ছিল। উল্লাসমুখর খেলায় লিচোর কাছে বারবারই পিছিয়ে পড়ছিল বুধনাথ।

সকাল হতেই গরম মধুর পাত্র নিয়ে টুটুনেহ্‌র জন্য হাজির সুরমাই। টুটুনেহ্‌ মানে তো জামাইবাবু। এই সুরমাইয়ের অবস্থান নিয়ে ভীষণ রকম দ্বিধায় বুধনাথ। যে সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা হয় না সেই সম্পর্কের দিকেই বুঝি মন তীব্র বেগে ধায়। কিন্তু শিকারি পাখির চোখ লিচোর। সুরমাইয়ের আঙুল স্পর্শ করতেও যেন ভয় পেল বুধনাথ, শুধু চোখের আদরে মনে মনে বলল, আমার ছোট রানি!

ঝাঁসির রানির কথা জানে বুধনাথ, তাই লিচোকে সে দায়িত্ব দিতে চায় মেয়েদের বাহিনী সুসজ্জিত করবার কাজে। তীর চালনায় দক্ষ লিচো বুধনাথকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে, মেয়েদের ব্যাপারটা নিয়ে বুধনাথ যেন আর না ভাবে। পাথরের অস্ত্র নিক্ষেপে তার দলের মেয়েরা সিদ্ধহস্ত।

দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল বুধনাথের বনবাসের, এই গভীর জঙ্গলে, দেশ পরিজন সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে থাকতে কাল মাস সনের হিসেব গুলিয়ে গেছে বুধনাথের। তবু জঙ্গলের রঙের পরিবর্তন দেখে টের পায় সে বছর ঘুরল। পাখি ফিরে গেল, পাখি উড়ে এল, গাছে গাছে নতুন বোল ধরল। যুদ্ধ পরিস্থিতির তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল গোষ্ঠীতে। ছোট্ট একটা ডুঙ্গি নিয়ে সে আর পিচার ঘুরতে লাগল জলে-জঙ্গলে। শুরু হল ধনুকে চর্বি মাখানো, গাছের গুঁড়ির আঁশ থেকে ছিলার তন্তু তৈরি, পাথরে ধার দেওয়া। সঙ্গে তো আছেই ফলমূল সংগ্রহ, মৎস্য শিকার। চারিদিকে ব্যস্ততা। কিছু লোহা সংগ্রহ অবশ্যই দরকার, তীরে লোহার ফলা লাগাতে পারলে আর চিন্তা নেই।

বুদ্ধি দিল সাদলুর। বহু কয়েদিকে আদিবাসীরা মেরে ফেলার পর পুঁতে দিয়েছিল মাটির নীচে। তাদের খুঁড়ে বার করো। তাদের হাতে পায়ে পরানো আছে লোহার শিকল। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সত্যিই বেশ কিছুটা পাওয়া গেল লোহা। লুকিয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে গিয়ে তারা মারো বন্দর এলাকা থেকে সংগ্রহ করে আনল আরও কিছু টুকরো লোহার কলকব্জা। সাহেবের রসুইখানার তাঁবু থেকে রাতের আঁধারে চুরি গেল কিছু লোহার ছুরি-কাঁচি। বুধনাথের তৎপরতায় সমস্ত গোষ্ঠীর আকাচাপান আর এরজুম, মানে শিকারি দলনেতাদের নিয়ে লাবেরিন্থ দ্বীপে ডাকা হল সভা।

ঠিক হল বর্ষার আগেই শানানো হবে আক্রমণ। চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা হবে বন্দর এলাকা। তারপর অতর্কিত আক্রমণে দখল নেওয়া হবে সাহেবদের ঘাঁটির। আর এই সম্পূর্ণ কাজটিই করতে হবে রাতের অন্ধকারে এবং সূর্য ওঠার আগেই। ভোর শব্দটা এদের অভিধানে নেই। এরা শুধু জানে সূর্য ওঠে আর সূর্য অস্ত যায়। ঠিক হল তৈরি করতে হবে আরও অনেক ডুঙ্গি। সুপুরি গাছের গুঁড়ি চেঁছে খোল তৈরির কাজে আর দেরি করলে চলবে না।

আজকাল বুধনাথের খুব আপসোস হয় ফেলে আসা বন্দুকটার জন্য। সে সৈন্যবাহিনীতে কাটিয়েছে অনেকদিন। যুদ্ধের খুঁটিনাটি বেশ কিছু আন্দাজ আছে তার। যদি জিততে পারে, এই দ্বীপের রাজা হবে সে। সেই পাদ্রি সাহেবের কাছ থেকে শোনা গল্পটার মতো। তারপর সে এদের চাষবাস শেখাবে, রান্নাবান্না শেখাবে। এতদিন সে সবার কথা মেনেছে, এবার তার কথা এরা মানবে সবাই। এক রাজার দুই রানি, ক্ষতি কী? রাজা দশরথের তো তিন রানি ছিল। স্বপ্ন যেন মাথার মধ্যে জাল বিস্তার করে বুধনাথের, সেই স্বপ্নের জালে আটকে যায় জলের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া ঝাঁক ঝাঁক রঙিন মাছেরা।

কিন্তু এই গরম আর নোনা বাতাসে এখনও যেন শরীর জ্বলে পুড়ে যায় বুধনাথের, বিশেষ করে যে দিন চর্বি যুক্ত শুয়োর কিম্বা কচ্ছপের মাংস খাওয়া হয়। গরম থেকে বাঁচতে এরা সারাদিন সারা গায়ে মাটি লেপে থাকে। বুধনাথের ভালো লাগে না। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, আহা যদি চন্দন থাকত তবে সে যেন লেপে দিত সুরমির গায়ে। মেয়েটা যে কী ভালো। ওর সঙ্গে সারা দিনে আজকাল আর কথা বলার সুযোগই পাওয়া যায় না। সারাদিন এত কাজ আর রাতে লিচোর সঙ্গে উৎসব উদযাপন। মেয়েটার যেন ক্লান্তি নেই শরীরে, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ তরঙ্গের মতোই তার যেন অফুরন্ত যৌবন। কিন্তু বুধনাথের যেন ক্লান্তি লাগে মাঝে মাঝে। চোখ যেন খুঁজে বেড়ায় সুরমিকে। কিন্তু চট করে মেয়েটার কোথাও দেখা পাওয়া যায় না। বুধনাথ এদিক ওদিক থেকে ডুঙ্গি নিয়ে ঘুরে ঘুরে খেয়ে দেয়ে এলে সে কাঠিতে বেঁধানো কটা মাছ পুড়িয়ে পাতার ওপর রেখে টুক করে যায় পালিয়ে।

সে ডাকে, সুরমি!

সুরমি এসে দাঁড়ায় খুঁটিতে হেলান দিয়ে, কী?

কী করছ?

চোখ দিয়ে ডাক দেয় সে, দেখে যাও।

উঠে যায় বুধনাথ, দেখে পাথর ঘষে ঘষে ধারালো ভোঁতা এত্ত অস্ত্র বানিয়েছে সে। বিস্ময় যেন আর ধরে না বুধনাথের। মেয়েটি এত চটপটে, যে কাজ করতে অন্যের সারাদিন যায়, সেই কাজ সে করে ফেলে ক্ষণিকেই। বুধনাথ সুরমির পিঠের কাছে গিয়ে ঘন হয়ে পিছন থেকে দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, একবারও আসো না কেন আমার কাছে!

বড় বড় চোখের পাতা তুলে সুরমি বলে, তোমার সময় কই? তোমার কত্ত কাজ। অভিমান ভরে বুধনাথ বলে, তবু মাঝে মাঝে তো আসতে পারো।

সুরমি হাত দিয়ে কোমর থেকে বুধনাথের দু’হাত সরিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায় বনের মধ্যে, বলে আসব।

বুধনাথ পাতা থেকে তুলে তুলে পোড়া মাছগুলো খেতে খেতে হাঁটতে থাকে পিচারের সন্ধানে। এই তাচোল মাছগুলো খেতে খুব ভালো লাগে বুধনাথের। এ কথা ঠিক খেয়াল রাখে সুরমি। এখানে কত্ত রকমের মাছ। কাচের মতো স্বচ্ছ নীল জলে তরতরিয়ে ভেসে বেড়ায়, নিয়ুরি, কারাবোলা, ফেনো, খারাইন, তাচোল, জিকার, তেলেবো, সব মাছ তাকে চিনিয়েছে সুরমাই। সে গরম মাছে কামড় দিতে দিতে মনে মনে বলে, মৃত্যুর পরেও বুঝি চোখ দুটো খোলা থাকবে আমার, কারণ অপেক্ষাতেই জীবন বাঁধা পড়ে গেছে আমার। কবে যে লিচো অনুমতি দেবে সুরমাইকে স্পর্শ করবার, আদৌ কোনোদিন দেবে বলে মনে হয় না বুধনাথের। তারপর একা একাই হাসে, ভাবে মজনুভাইয়ের সঙ্গ করে বেশ উন্নতি হয়েছে তার, সে ও শায়েরি বলতে লেগেছে। আহা কতদিন গান গায়নি সে, গুনগুন করে ওঠে যেন সুর তার ভেতরে।

সার দিয়ে ডুঙ্গি উল্টোনো থাকে প্রবাল-পোকা দ্বীপের ওপরে। যাতে পোকার খয়েরি রঙের সঙ্গে মিশে থাকে গাছের গুঁড়ির রং। তবু উদ্বেগে ঘুম আসে না বুধনাথের, যদি ওয়াকার সাহেবের চেলাচামুন্ডার নজরে পড়ে তো রক্ষা নেই। ওই ডুঙ্গির পথ ধরে এগিয়ে এসেই হয়তো হানা দেবে তাদের দলের ওপরে। অথচ না শুকিয়ে নিলেও তো উপায় নেই। ঘন জঙ্গলের ভেতরে তেমন রোদ আসে না।

তাছাড়া এরা তো তার সব কথা শোনে না। এরা খুব অস্থিরমতি আর উগ্র। এখনও পর্যন্ত নাওই তাদের আসল নেতা। তাছাড়া গোষ্ঠীগুলো প্রয়োজনের খাতিরে সংঘবদ্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেখ না দেখ এরা নিজেদের মতো করে আক্রমণ করে শত্রুদের। এরা বোঝে না মূল যুদ্ধের আগে এরা যত বেশি সংঘর্ষে যাবে সাহেবদের সঙ্গে, সাহেবরা তত বেশি জেনে যাবে এদের আক্রমণের ধরন। শত্রুকে নিজেদের দুর্বলতা চিনিয়ে দেওয়া যেমন বুদ্ধিমানের কাজ না, ঠিক তেমনি জোরের জায়গাও না।

লিচো সারাদিন দাপিয়ে বেড়ায় যুদ্ধের আয়োজনে অথচ সন্ধ্যে না হতেই অঘোর ঘুমে কাদা। এরা প্রত্যেকেই প্রায় তাই। যখনকার কাজ তখন, চিন্তাভাবনার বালাই নেই ওদের। এরই মধ্যে থেকে সুরমি যে কী করে সব রকমে আলাদা হল কে জানে। লিচোর দুর্ভেদ্য প্রাচীর পেরিয়ে বুধনাথ টের পায় জেগে আছে সে ও। বুধনাথের মনটা আজ বড় বিষণ্ণ। বুধনাথ আর সাদলুর এদের এত করে বোঝানোর চেষ্টা করছে, কয়েদিরা তোমাদের শত্রু নয় শত্রু আসলে তোমাদের সাহেবরা। সাহেবের নির্দেশে কয়েদিরা বাধ্য হয় গাছ কাটতে, তথাপি হড্ডার কাছে একটা গোষ্ঠীর প্রায় দুশো জন মতো আদিবাসী অতর্কিতে আক্রমণ করে প্রায় আড়াইশো জনের মতো কয়েদিকে হত্যা করেছে, কয়েদিরা আর কত দিক থেকে মার খাবে। কিছুতেই এরা পার্থক্যটা বুঝতে পারছে না। কেউ গাছ কাটছে মানেই তারা এদের শত্রু। নির্দিষ্ট দিনেও যে এরা কী করবে কে জানে। এপাশ ওপাশ করে বুধনাথ, আর চাটাইয়ের ওপরে উঠে বসে তার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে সুরমি। ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে ভালো করে টের পাওয়া যায় না প্রায় কিছুই, তবু এটুকু টের পাওয়া যায় যে পরস্পর তারা জেগে আছে, কিন্তু দেওয়ালে ঝোলানো লোহার ফলা যুক্ত তীরের কথা চিন্তা করে তারা একে অপরের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস পায় না কেউই।

সেদিন ভোর রাতে সামান্য তন্দ্রা এলে লিচোর গোঁ গোঁ গোঙানিতে তন্দ্রা ছুটে গেল বুধনাথের। সে উতলা হয়ে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে লিচো, কী হয়েছে?

লিচো জানায় তার পেটে যন্ত্রণা করছে।

অন্ধকার হাতড়ে সুরমি চলে যায় জঙ্গলের দিকে, বুধনাথ শুধায়, কোথায় যাচ্ছ?

সুরমাই জবাব দেয়, তোলোদু আনতে, ওকে জলে দিয়ে খাওয়াতে হবে।

উদ্বিগ্ন বুধনাথ লিচোকে বলে, এখনও ভালো করে আলো ফোটেনি, ও একা পারবে অতটা পথ যেতে? বলে সে উঠতে গেলে তার হাত টেনে ধরে লিচো, বলে ওর সঙ্গে মিমি যাবে, তুমি বসো। সুরমাই চলে যেতেই লিচো আদুরে গলায় বুধনাথকে বলে আমি রোজ সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে ওই আথিরেনেপেমিয়া থানে বসে চান করতাম জানো। ও কিছু না দেখো, ব্যথা কমে যাবে। জানো ওই পাথরে বসে স্নান করলে তাড়াতাড়ি বাচ্চা আসে পেটে। দেখো মিমি কাল ঠিক সেই বিধানই দেবে। আমাদের বাচ্চা আছে এই মেফুলুতে, চিতল মাছের মতো ঝকঝকে মেদহীন পেটের ওপর হাত বোলায় লিচো, বলে এই মাসে তো আমার ঝিল্লি দেখা যায়নি। কী আনন্দ যে হবে আমাদের বাচ্চাটা জন্মানোর সময়, ততদিনে সব লাওগুলো মরে যাবে চারপাশে।

প্রমাদ গোনে বুধনাথ। সামনেই যুদ্ধের কাল। লিচোর ওপরে যে সে অনেক দায়িত্ব দিয়েছে। তাছাড়া সে-ও তো ব্যস্ত থাকবে নানা কাজে। বুধনাথের দ্বিধা দেখে লিচো বলে, চিন্তা কোরো না যুদ্ধ আমি ঠিক সামলে দেব। জঙ্গলের মেয়েরা পেটে বাচ্চা নিয়ে সব কাজ করতে পারে। ওতে তাদের কিছু এসে যায় না। বরং কাজকম্মের মধ্যে থাকলে প্রসবে যন্ত্রণা কম হয়। বলে সে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল বুধনাথের গলা। আনমনা বুধনাথও আস্তে করে ঠোঁট ঠেকাল লিচোর কপালের ওপর। লিচো বলল, উঁহু ওখানে নয় নেরেটে খাও, বলে সে গভীর নিটোল নাভীর চারপাশে আঙ্গুল বোলালো, তারপর বলল, আরে কাঁকড়ার মতো এইখানটাই তো আঁকড়ে আছে সে! বলে হাসতে হাসতে দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সামলে নিল লিচো।

পুরো ব্যাপারটাতেই কেমন যেন থম্‌ মেরে গেল বুধনাথ। তার ঠিক কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছিল না। প্রথম সন্তান আসার খবরে তার তো খুব খুশি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু ঠিক তেমন খুশি তো তার ভেতর থেকে আসছে না। কেন? অধিক ব্যস্ততার কারণে কি? সে কি খুশির থেকেও চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছে বেশি? যদিও এরা অন্তঃসত্ত্বার দেখভাল করে অতি যত্নে। তথাপি আসলে সন্তান ধারণ নিয়ে এরা উদ্বেগে থাকে প্রথম থেকেই। কারণ এরা বিয়ে করে বেশ বেশি বয়সেই। তাই লিচোর খুশিটা সহজেই অনুমান করতে পারে বুধনাথ।

যদিও নেত্রীর স্থান থেকে সরতে চায় না লিচো, তবু বুধনাথের পরামর্শেই লিচোকে সরিয়ে জিরাককে নেত্রী পদে বসায় বুধনাথ। বলে খুব প্রয়োজন না হলে যুদ্ধে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই লিচোর। যদিও কারও নির্দেশ সহজে মানবার পাত্রী নয় লিচো, তবু বুধনাথের এই নির্দেশ লিচো সানন্দে মেনে নেয়।


আটাশ


এর মধ্যে ঘটে গেল আরো একটি বিচ্ছিরি ঘটনা। যদিও ঠিক হয়েছিল বিক্ষিপ্ত ভাবে যখন যারা পারবে সাহেবদের আক্রমণ শানাবে। কিন্তু আবারও ভুল করল আদিবাসীরা। এবার প্রায় পনেরোশো আদিবাসীর একটা গোষ্ঠী ভরদুপুরে আক্রমণ করল কয়েদিদের। দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অনেক কয়েদি সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ হারাল। মুখ শুকিয়ে গেল বুধনাথের। এ কাদের নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে সে! এরা সরল। অন্যায় এরা না বুঝেই করে। কিন্তু অতিসারল্য নির্বুদ্ধিতারই লক্ষণ। যে উৎসাহ নিয়ে সে শুরু করেছিল কাজ সে উৎসাহ যেন তার ধীরে ধীরে মরে আসছে। এরা এত স্থুল যে নতুনত্বের চমক কেটে যেতেই বুধনাথের সূক্ষ্ম মনে আর নাড়া লাগছে না কিছুতেই।

কিছুদিন ধরে কিছুই ভালো লাগছে তার। আশ্চর্যের বিষয় এই, সবচেয়ে খারাপ লাগছে তার লিচোকে। তার ওই উঁচু হয়ে ওঠা উদর, নগ্ন দেহে যোনিদেশে সামান্য পাতার আস্তরণ। কোনো কোনো সময় তাও থাকে না। অসহ্য হয়ে উঠছে বুধনাথের কাছে। লিচোর দিকে যেন তাকাতেই ইচ্ছে করে না তার। তার যেন কেবলই মনে হচ্ছে এক খণ্ড কাপড়ে লিচোকে ঢেকে দিতে পারলে সে বাঁচে। শুধুমাত্র একখণ্ড কাপড়ের জন্যই তার সাহেবদের শিবির দখল করা উচিত। কিন্তু কই, সুরমাইকে তো খারাপ লাগে না। তারও তো গাত্রবর্ণ কালো। তবু সে যখন তার ঝকঝকে সাদা দু’সারি দাঁত বের করে হাসে যেন মহামায়ার রূপ খেলে যায় তার ভেতরে।

বুধনাথের মন যে খারাপ তা বেশ টের পেয়েছে সুরমাই। একদিন বলল, চলো জলের ধারে গিয়ে বসি। গল্প শুনবে? মাহে আমাকে কত্ত গল্প বলে জানো। ছেলেমানুষের মতো সুরমাইয়ের বুধনাথকে ভোলানোর এই প্রক্রিয়া খুব ভালো লাগে বুধার। বলে, বলো বলো, কী কী গল্প বলে তোমায় মাহে। সুরমাই বলে, বলো তো আমরা এলাম কোথা থেকে? কেমন করে তৈরি হল এই পৃথিবী?

কী করে আবার, স্বয়ং নারায়ণ সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবী, হাঁটতে হাঁটতে সুরমাইয়ের হাত ধরে বুধনাথ। ব্রহ্মা আর সরস্বতীর সন্তান মনুই হল আমাদের আদি পিতা।
সুরমাই বলে, তাই! কী জানি তুমি তো অনেক কিছু জানো, তালে হতেও পারে, কিন্তু আমার মাহে একটা অন্য গল্প বলে।

বুধনাথ সুরমাইয়ের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর বড় বড় চোখের দিকে দেখে, তারপর বলে, বলো দেখি তোমার মাহে কী বলে শুনি।

সুরমাই বলে, আমরা হলাম গিয়ে মাইদিক আর তার স্ত্রী কাতের সন্তান। অনেক অনেক দিন আগে মাইদিক নামে একটা লোক একা একা গাছে গাছে ঘুরে বেড়াত, শিকার করত আর গান গাইত। সে ছিল খুব একাকী। কেউ ছিল না তো আর। একদিন সে মনের দুঃখে একা বসে বসে মাটি দিয়ে অনেকটা তারই মতো দেখতে একটা পুতুল বানাল এবং ঝুপড়িতে রেখে দিয়ে শিকারে চলে গেল। শিকার সেরে জঙ্গল থেকে গুনগুন করতে করতে ফিরল ডেরায়। হঠাৎ তার মনে হল তার গান শুনে কে যেন হাসছে। সে থমকে গেল, ফের গান ধরল, দেখল, হ্যাঁ সত্যিই তো কেউ হাসছে। সে ওই মাটির তৈরি পুতুলটার কাছে ঝুঁকে পড়ে দেখল সেই পুতুলটিই হাসছে। মাইদিক থাকতে আরম্ভ করল তার সঙ্গে। কাদা দিয়ে তৈরি করেছিল বলে মাইদিক তার নাম দিল কাত মানে মাটি।

বুধনাথ হেসে বলল। বেশ গল্প।

কথা বলতে বলতে সমুদ্রের ধারের বদলে তারা চলে এসেছিল গভীর জঙ্গলে। বুধনাথ বলল, আমি তোমার মতো গল্প বলতে পারি না তবে আমি তোমাকে গান শোনাতে পারি। নিচু হয়ে আসা একটা গাছের ডালের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে সুরমাই বলল, শোনাও।

বুধনাথ বলল, উঁহু এই সব গান ওরকম গাছের ডালে বসে শুনতে হয় না।

তবে কীভাবে শুনতে হয়?

মাটিতে পা মুড়ে বসে।

লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে পড়ল সুরমি। তারপর ঠেস দিয়ে বসল গাছের গায়ে। বুধনাথও বসল গাছে হেলান দিয়ে, তারপর সুরমাইকে হাত দিয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ধরল পদাবলী কীর্তন। আজো শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্যাম সোহাগিনী রাধারানী। আত্তবত। ওই না বেশে আইস তুমি, ওই না বেশে আইস তুমি। দাঁড়ায়ে রয়েছি আমি। তুয়া বঁধু লাইবার তরে। আমার হৃদয় মাঝে, বিচিত্র পালঙ্ক আছে। তুমি তাতে রাখিও চরণ। আমি ভাসিব ভাসিব। তোমারে লইয়া আমি ভাসিব ভাসিব। শ্যাম সোহাগিনী রাধারানী। আত্তবত। কতদিন পরে সে গান গাইছে। তার চোখ দিয়ে নামছিল জলের ধারা। যে শরীর রাধার নাম ধরে, সে শরীর এতদিন বন্দুক ধরল কীভাবে? কীভাবে চোখের সামনে দেখল এত রক্ত, এত ক্ষয়, এত মৃত্যু। বাবু হয়ে বসে গাইছিল বুধনাথ। গাইতে গাইতে সে বাহুর বেড়ে সুরমিকে টেনে নিল কোলের ওপরে। বুধনাথের হাঁটুর ওপর দিয়ে ধনুকের মতো বেঁকে উঠল সুরমাইয়ের পিঠ। উঁচু হয়ে উঠল টিলা পাহাড়। মাথা ঝুঁকে পড়ল বুধনাথের দুপায়ের মাঝে।

বুধনাথ মুখ নিচু করে সুরমির মুখের কাছে মুখ এনে ডাকল, রাধে!

সারা নিল সুরমি, উম্‌?

বুধনাথ বলল, যেই রাম সেই কৃষ্ণ, গাত্রবর্ণে কিবা এসে যায়। ভাবই হল আসল। ভাব হরণ আর ভাব গ্রহণ। তবু ইচ্ছা করে তোমার অঙ্গে চন্দনের প্রলেপ এঁকে দি। বলতে বলতে বুধনাথ তার ডান হাত সুরমির মাথার নীচে দিয়ে বাঁ হাত দিয়ে আরও একটু ঠেলে দিল গোল কৃষ্ণবর্ণ কোনা ফলের মতো সুউত্থিত সুরমির স্তনভারকে। কেঁপে উঠল সুরমি। যেন আরও নেতিয়ে পড়ল মেয়েটা কাদার তালের মতো। বুধনাথ তাকে নিজের প্রাণের মধ্যে মিশিয়ে নিল যেন। যেন এক অপূর্ব সুর ছড়িয়ে গেল বুধনাথের শরীরের প্রতিটি তন্ত্রীতে। যেন এক অত্যুজ্জল আলোর ভেতরে প্রবেশ করল সে। যেন মহাসমুদ্রের ভেতর থেকে নিদ্রিত নারায়ণ চক্ষু মেলে বললেন, বুধনাথ আজ তুমি পুরুষ হলে। এতদিন তুমি যে নারীসঙ্গ করেছ সেখানে তুমি ছিলে দাতা, আজ তুমি নিজের বুকের মধ্যে গ্রহণ করেছ প্রকৃতিকে। একই অঙ্গে নর ও নারী উভয়ের প্রকাশই প্রকৃত পুরুষের লক্ষণ। সাধারণ মানুষ হয় দাতা নয় গ্রহীতা। যে এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে সেই সচ্চিদানন্দকে টের পায়। তুমি ভাগ্যবান বুধনাথ। এক জীবনের এত কষ্টের ফল তুমি একদিনে অতিক্রম করেছ।

উঠে বসে বুধনাথ বলল, আর কোনো ভয় নেই জানো সুরমি। সামনে যুদ্ধ, যা হবার তাই হবে। তাতে আমার বিন্দুমাত্র বুক কাঁপবে না আর।

ভুরু উঁঠিয়ে সুরমি বলল, কী আবার হবে? তোমাকে মারবে এমন সাধ্যি আছে কারো? আমি যতক্ষণ এই মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব, ততদিন কেউ তোমার নখের ডগাটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারবে না। দেখলে না কতদূর থেকে ভাসতে ভাসতে তুমি কেমন আমার কাছটিতে এসে ঠেকলে, তোমার সাঙ্গোপাঙ্গরা সবাই মরে গেল কিন্তু কই তুমি তো মরলে না।

হঠাৎ কেঁপে উঠল মেদিনী। ভয়ার্ত চোখে সুরমি বলল, থিজিট! কী হচ্ছে বুঝতে ক্ষণিক সময় নিয়ে বুধনাথ সুরমিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল, ভূমিকম্প!

ঠক্‌ঠক্‌ করে কাঁপতে কাঁপতে সুরমি বলল, ভূতের নাচন শুরু হয়েছে, ভূতের নাচন, এই এত্ত বড় হয়ে উঠেবে ঢেউ। আর কেউ বাঁচব না আমরা, আর কেউ বাঁচব না।

মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল মাটি। বুধনাথ সুরমির থুত্‌নি ধরে তুলে বলল, ধুর পাগলি, অত ভয় পেতে আছে! কিন্তু সুরমাই কোনো কথা বলল না। পিঙ্গল হয়ে গেল তার মুখ। সে ছুটে পালিয়ে গেল সেখান থেকে।

অকস্মাৎ টুটে যাওয়া স্বপ্নের মতো বিস্বাদ হয়ে গেল বুধনাথের মন। সে-ও চলতে চলতে স্মরণ করল, নারায়ণ, নারায়ণ।

ঊনত্রিশ


ব্রিটিশ জাতিটা সৌখিন। যে কোনো অবস্থাতেই তাদের জীবনাচরণের মধ্যে থাকে একটা পারিপাট্যের ছাপ। ডক্টর ওয়াকারের তাঁবু-ছাউনির জীবনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সঙ্গে খাদ্যপানীয়ের প্রাচুর্যও ছিল চোখে পড়ার মতো। কোম্পানি ডক্টর ওয়াকারকে রাজা বানানোয় কোনো কসুর করেনি। রোজ সন্ধ্যেয় চেতন অবচেতনের মাঝপথে এসে জেমসের হাত থেকে খসে পড়ত পানপাত্র। আর সেই নিঃশব্দে এসে প্রবেশ করতেন মা মেরির এক মূর্ত প্রতিরূপ। নেশার ঘোরে চিৎকার করতেন ওয়াকার, আঃ চলে যাও, চলে যাও। আর যন্ত্রণা দিও না আমাকে। আমাকে পশু হয়েই থাকতে দাও। ব্রিটিশ গুলাগ। ফ্লোরেন্স ইউ আর জাস্ট আনবিলিভেবল। তুমি স্বর্গের দেবী হয়ে নরকে বাতি জ্বালাতে আসো। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি তুমি যে নরক দেখেছ এ নরক তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। তাই তুমি এলে না তাই না? তোমাকে এত করে ডাকলাম। না না, না এসে ভালোই করেছ, করমর্দনের জন্য আমার এই হাত তো আমি তোমার হাতের মধ্যে তুলে দিতে পারতাম না। স্খলিত ওয়াকার যখন সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়তেন ঘুমে, বেহালাবাদন বন্ধ করত পিটার। কার্ড দিয়ে জুয়াচুরির খেলা চালাতেন দুই গোরা অফিসার, এই সাড়বিহীন অফিসার দ্বয়ই কখনও বা ঘুমন্ত কয়েদির মুখে কাপড় বেঁধে তাদের পশ্চাদ্দেশ নিয়ে কাটাকুটি খেলতেন যৌন তাড়নায়। যাদের লোলুপ দৃষ্টি সর্বদাই জঙ্গলের ইতিউতি খুঁজে বেড়াত কোনো নগ্ন আদিবাসী মহিলা, কিম্বা কখনও ওয়াকার ঘুমিয়ে পড়লে অধস্তন পিটারের প্রতি তাদের যৌনাঙ্গ প্রদর্শন করে বলতেন, দে না দে না পিটার এখানে বেহালা বাজিয়ে। সারাদিন ওয়াকারকে তাতিয়ে রাখতেন এরা। ওয়াকারের ভেতরে ক্রোধের আগুন এরা কখনও নিভতে দিতেন না। কিন্তু দুদিন হল কড়া পানীয়তেও ওয়াকারের আর ঘুম আসছে না। জংলিরা যে ভাবে ক্ষেপে উঠেছে তাতে এখানে আর কাজ করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। জঙ্গল সাফ করে দিলে বাঘ তো লোকালয়ে হানা দেবেই। পিটারও আর বেহালা বাজাচ্ছে না দু’দিন ধরে। সকলেরই যেন আতঙ্কে ঘুম ছুটে গেছে।

তাঁবুর ভেতরে হাত পিছমোড়া করে পায়চারি করছিলেন জেমস ওয়াকার। —স্যার! ডাকে চমকে তাকালেন ওয়াকার। হাত চলে গেল পাশে রাখা আগ্নেয় অস্ত্রের ট্রিগারে। পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল পিটার। স্যার পাগলা জোনাকির গান ধরেছে।

—হোয়াট? প্রথমে মাগুর মাছ তারপর জোনাকি?

—ইয়েস স্যার।

পিঙ্গল হয়ে গেল ডক্টর জেমস প্যাট্টিসন ওয়াকারের মুখ। তিনি তাঁবুর বাইরে এসে দূরবিনে চোখ রাখলেন। কিন্তু বিস্তৃত সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের মাথায় জ্বলা ফসফরাসের আলো ছাড়া কিছুই চোখ পড়ল না। তিনি মৃদু ধমকের সুরে পিটারকে বললেন, পাগলাকে আফিং খাইয়ে দাও। হি ইজ ভেরি মাচ অ্যানয়িং, বলে তিনি তাঁবুর ভেতর চলে গেলেন। রাত শেষ হয়ে আসছে। এবার একটু ঘুমানোর চেষ্টা করা দরকার।

শেষ মুহূর্তে নাওয়ের সিদ্ধান্তের তারিফ না করে পারেনি বুধনাথ। ছেলেটার বুদ্ধি আছে। নাও বলেছিল, খবর কোনো ভাবে যদি ছড়িয়েও যায় সাহেবেরা চোঙা ধরে চোখ রাখবে সাগরে। সাহেবদের সাগরের পথ অনেক বেশি চেনা জঙ্গলের থেকে। তাই আগে ভাগে গিয়ে কয়েদি শিবিরের কাছাকাছি কোনো জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ছোট্ট দ্বীপ রস। তারই কাছে কয়েদি শিবির। মাঝখানে পরিখার মতো একফালি সমুদ্র। ঠিক হল তিন ভাগে ভাগ হয়ে তিন দিক থেকে তারা ঘিরে ফেলবে শিবিরটিকে। ডুঙ্গি নিয়ে এগোনোর ছক সাজানো হল, তিন তিন এক। ঠিক হল সুরমাই, মিমি সহ আর দু’চার জন মহিলা থাকবে জঙ্গলের ভিতরের ঝুপড়িতে বাচ্চা কাচ্চাগুলোকে নিয়ে। এই প্রস্তাবে মনে মনে খানিক নিশ্চিন্ত হল বুধনাথ। যাক বাবা, তার সুরমিকে তো কোনো ভাবে শত্রুর তীরের মুখে পড়তে হবে না। লিচো যুদ্ধে যাক তার এ-ও ইচ্ছে ছিল না। একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা যুদ্ধ করবে এ যেন তার বিবেকে বাধছিল। হাজার হোক বাচ্চাটা তো তার। কিন্তু লিচোর নেতৃত্বদান এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছা এমন প্রবল যে তাকে রুখবে কে!

যুদ্ধের জন্য যাবতীয় ভয় সহ কেমন যেন একটা ভালোও লাগছে বুধনাথের। কতদিন পরে সে জঙ্গলের বাইরে বেরবে। তার মতো কিছু মানুষের দেখাসাক্ষাৎ পাবে। তবু ঝুপড়ির পিছনে সুরমি যখন তার হাত চেপে ধরল তখন চোখে জল চলে এল বুধনাথের। চোখ ছাপানো জল নিয়েও পরিবেশ হালকা করতে দুষ্টু মিষ্টি হেসে সুরমি বলল, আমি তোমার জন্য কোনখানটায় বসে অপেক্ষা করব বলো তো? ওই পাথরটায়, জলে পা ডুবিয়ে যে পাথরে বসে থাকলে বলে— কথা না শেষ করে দাঁত দিয়ে নখ কাটে সে।

ফিক্‌ করে হেসে ফেলে বুধনাথও, ভুরু তুলে বলে, থাকলে? কী হয়? বাচ্চা আসে পেটে? বলে নিজের তর্জনী দিয়ে সুরমির গালে একটা টোকা দেয়।

সুরমি দুহাত দিয়ে বুধনাথকে ঘুরিয়ে পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, এবার যাও। একথা জানলে লিচো আমার আর রক্ষা রাখবে না।

ডুঙ্গি প্রস্তুত হল পরপর। পারে এসে দাঁড়ালেন মিমি সহ যারা রইলেন ঝুপড়িতে তারা সকলেই। সুরমিও এসে দাঁড়াল মিমির পিছনটিতে। মিমি একটি মাটির পাত্রে পবিত্র জল নিয়ে ছিটিয়ে দিতে দিতে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন, রোয়াবাথ চানাম চেরস এত্থেকাম ওলাবার বেথাইচেম। ডুঙ্গিগুলো প্রথম সমুদ্র যাত্রা করছে, যেন কোনো ঝড়ের মুখে না পড়ে। অন্যসময় রজনের বাতি জ্বালিয়ে নেয় তারা ডুঙ্গিগুলোতে কিন্তু এখন পথনির্দেশক সামনের ডুঙ্গিটি ছাড়া কোনো ডুঙ্গিতেই বাতি জ্বালানো হল না। কূল ছেড়ে জলে ভাসল আন্দামানের সুপ্রাচীন আদিবাসীদের রণতরী।

ছপ্‌ ছপ্‌ ছপ্‌ ছপ্‌। রাতের অন্ধকারে এগোচ্ছিল ডুঙ্গিগুলো। সবার আগে একটা ডুঙ্গি, যেখানে সবচেয়ে দক্ষ ধনুর্ধর ও তার দুজন সঙ্গী। আর ডুঙ্গি বাইছে আরও একজন। তার পিছনের সারিতে তিনটি ডুঙ্গিতে সার সার তীর-ধনুক উঁচিয়ে আদিবাসীর দল। তারও পিছনের সারিতে একজন ধনুর্ধর আর ধারালো ও ভোঁতা পাথরের অস্ত্র নিয়ে মেয়েরা।

আলো ফুটবার আগেই দুটি দল নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে ডুঙ্গিগুলো কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ল শিবির থেকে কিছুটা দূরে ঘন জঙ্গলের ভেতরে। সেই দিনটা বিশ্রাম। প্রচুর কলা আর মিষ্টি আলু সেদ্ধ করে নিয়ে এসেছিল তারা। মাছ বা মাংস আনেনি। যাতে গন্ধ না ছড়ায়। আর একটি দলের একটু পরে যোগ দেবার কথা হল জলযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে। ডুঙ্গিতে হেলান দিয়ে ওরা অপেক্ষা করতে লাগল সম্মুখসমরের। রাত্রি শেষ প্রহরে যখন তন্দ্রায় ঢুলে পড়বে বন্দুকধারী রক্ষী সিপাই তখন তারা গুটি গুটি এগিয়ে যাবে শিবিরের দিকে এবং অতর্কিতে হানা দিয়ে তারা দখল নেবে সেনা শিবিরের। সবার আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব দেওয়া হল বুধনাথকে। যেহেতু অঞ্চলের গলিঘুঁজির খোঁজ সে জানে। ওর ঠিক পিছনেই থাকবে নাও আর লাকা।

শুলেন বটে, কিন্তু ঘুম এল না ডক্টর জে ওয়াকারের। দু’দিন আগেই যে বিশাল একটা আদিবাসীর দল অতর্কিত আক্রমণে মেরে ফেলে দ্বিশতাধিক কয়েদিকে তখন পাগলটা নাকি গান গেয়ে গেয়ে বলেছিল, সে এত এত মস্ত মস্ত কালো কালো মাগুর মাছকে জলে ভেসে আসতে দেখেছে এই দিকে। তার মানে ও আদিবাসীগুলোকেই আসতে দেখেছিল। অতএব জোনাকির কথাটাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে এলেন তাঁবু ছেড়ে, ঘুম থেকে টেনে তুলে কয়েদিদের দিয়ে শিবিরের চারিদিকে তৈরি করে ফেললেন ব্যারিকেড।

আঁধার ঝুঁঝকি হতেই ওদিক থেকে জঙ্গল ছেড়ে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে শিবিরের দিকে এগোতে লাগল বুধনাথেরা। কিছুদূর এগোতেই বুধনাথের চোখ পড়ল শিবির ঘিরে দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে দাঁড়িয়ে আছে হাতে পায়ে শিকল বাঁধা কয়েদিরা। ওদের ঢাল তৈরি করে বন্দুক হাতে গোরা সেপাইরা। এপাশে তীর আর ওপাশে বন্দুকের নলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলির পাঁঠার মতো ঠকঠক করে কাঁপছে কয়েদিরা। মুহূর্তে কী যেন হয়ে গেল বুধনাথের, এদের সঙ্গে কতগুলো দিন কাটিয়েছে বুধনাথ। বুধনাথকে দেখে পাগলা মজনু চিৎকার করে উঠল, বাঁচা, বুধা বাঁচা। সেই যে ফাঁসির দৃশ্য দেখার পর ঠাস্‌ হয়ে পড়েছিল কবি তারপর থেকেই তার মাথাটা কেমন উল্টোপাল্টা। কখন কী বলে তার ঠিক নেই।

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল বুধনাথের। বুধা ঘুরে গিয়ে সবাইকে বলল, দাঁড়াও কেউ তীর মেরো না। এখন তীর ছুঁড়লে সব কয়েদিরা মারা যাবে। গোরা সেপাইদের কিছু হবে না। আদিবাসীরা অতশত বোঝে না। ওরা তখন ছিলা টেনে ছাড়ার অপেক্ষায়। চিৎকার করে উঠল নাও, ঠিক যুদ্ধের মুহূর্তে তুমি অস্ত্র আটকাতে বলছ? ওই যে মাহে ওর বন্ধুরা ওকে ডাকাডাকি করছে। আমি বলেছিলাম না আকাচাপান বাইরের লোককে বিশ্বাস করার শাস্তি তুমি পাবে। আমি এরজুম। আমার কথা কেউ অমান্য কোরো না, ছোঁড়ো তীর। সঙ্গে সঙ্গে আবদ্ধ ক্রোধ যেন মুক্তি পেল গতিতে। নাওয়ের নির্দেশ পালন করল সকলে।

ঠিক মুহূর্তটি চেনে বুধনাথ। সে চিৎকার করে বলল কয়েদি ভাই শুয়ে পড় তোমরা। সঙ্গে সঙ্গে সাষ্টাঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়ল কয়েদিরা। তাদের দেখাদেখি গোরা সেপাইরাও নির্দেশ দিল, লাই ডাউন। ঝাঁকে ঝাঁকে তীর লক্ষ্যশূন্য হয়ে গোঁত্তা খেয়ে গিয়ে পড়ল মাটিতে অথবা ছাউনির গায়ে। চিৎকার করে উঠলেন আকাচাপান, বেইমান, বলে ধনুকে তীর প্রতিস্থাপন করলেন বুধনাথকে লক্ষ্য করে। পিছন থেকে ছুটে গেল লিচো, বুধাকে আগলে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়াল সামনে। নাই মারো মাহে, ওকে নাই মারো। ওর বাচ্চা আমার পেটে নড়ে।

লাকা থমকে গেলেন ক্ষণকাল। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষণকালের দাম অনেক। আবার্ডিন কয়েদি শিবিরের দিক থেকে গর্জে উঠল আদিবাসীদের দিকে তাক করা বন্দুকের গুলি। রাউন্ডের পর রাউন্ড। ছত্রভঙ্গ আদিবাসীকুল পালানোর অবকাশও পেল না, লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। চিৎকার করতে থাকল বুধনাথ, স্টপ ফায়ারিং। সাহেব স্টপ ফায়ারিং, দে আর ইনোসেন্ট পিপল।

যখন একজন আদিবাসীর দেহও আর মাটির ওপর উত্থিত রইল না, তখন ক্ষণকালের জন্য বন্ধ হল গুলিবর্ষণ। জলভরা চোখে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল বুধনাথ। দাঁড়িয়ে রইল লিচোও। এবার ওদের দিকে এগিয়ে এলেন ডক্টর জেমস ওয়াকার স্বয়ং। ট্রিগার আঙ্গুলে ঠেকিয়ে বললেন, ব্রেভো। ইউ হাভ ডান আ ব্রিলিয়ান্ট জব ফর আস। একটা ভীষণ ভালো কাজ করেছে তুমি। ওই মানুষখেকো আদিবাসীগুলোকে জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। তুমি তাদের সবগুলোকে তাড়িয়ে একসঙ্গে জঙ্গলে বাইরে নিয়ে এসেছে। তোমার সাজা মকুব হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলে তোমার পদোন্নতিরও ব্যবস্থা করবে আমি। তবে আর একটু ছোট্ট কাজ।

অবরুদ্ধ কণ্ঠে বুধনাথ বলল, ওরা মানুষ খায় না স্যার, ওরা কলা খায়, কাঁকড়া খায়। এমনকি ওরা আপনাদের মতো শখে পাখি শিকারও করে না, প্রয়োজন না পড়লে গাছ কাটে না। ওদের জায়গা আপনারা কেড়ে না নিলে ওরা আপনাদের কিছুই বলত না।

বাঁকা ঠোঁটে হাসলেন ওয়াকার সাহেব, ও রিয়েলি ইউ আর সো কাইন্ড টুওয়ার্ডস দেম। ডোন্ট ওরি মিস্টার বুধনাথ, তোমার আর তোমার স্ত্রীর কোনো সমস্যা হবে না এখানে। তোমরা খুব যত্নে থাকবে। অ্যান্ড দেন ইউ ক্যান গো টু দ্য মেনল্যান্ড। কিন্তু ওই যে বললাম, আর একটু কাজ, আর কোন কোন দিক থেকে আসবে ওরা, আজই কি আক্রমণ করবে? না কি পরে? সব জানো তুমি, তোমাকে সব বলে দিতে হবে না হলে একটা ট্রিগারের চাপে তুমি আর তোমার স্ত্রীও ওই ওদের মতোই, হা হা মাটিতে শুয়ে পড়বে।

—সো ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম। জলদি বলো আর কোন কোন দিক থেকে ওরা আসছে। ঠক্‌ ঠক্‌ করে কাঁপতে কাঁপতে লিচো বলল, আমি বলছি সাহেব, বলে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল শিবিরের পশ্চিম প্রান্তে।

অকুতোভয় পিচার কিন্তু তখন দলবল নিয়ে বীরবিক্রমে প্রায় শিবিরের দখল নিয়ে নিয়েছে। তীর ছুড়তে ছুড়তে এবার তারা এগোচ্ছিল ওয়াকার সাহেবের তাঁবুর দিকে। মুহূর্তে পিছন ঘুরে গিয়ে ট্রিগার টিপে দিলেন ওয়াকার, আঃ বলে মাটিতে পড়ে গেল পিচার। লিচো আর বুধনাথকে দেখে পিচারের চোখ থেকে তখনও যেন বিস্ময় সরেনি। দুচোখ চিপে বন্ধ করে নিল বুধনাথ। লিচো ছুটে গিয়ে নিচু হয়ে বসল পিচারের মাথার কাছে, তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ওয়াকার সাহেব বললেন, ডোন্ট ক্রাই মাই ব্ল্যাক লেডি, আমি না মারলেও ওকে মরতেই হত। কোম্পানি ওকে ছাড়ত না। আই অ্যাম অলসো আ সারভেন্ট অব কোম্পানি।

অন্য দিকে সাদলুরের নেতৃত্বে আর একটি আদিবাসী গোষ্ঠী আটলান্ট পয়েন্ট থেকে আসছিল আবার্ডিনের দিকে। নৌরক্ষী বাহিনীর যুদ্ধজাহাজ চারলোটের থেকে আদিবাসীদের ওপর শুরু হল গুলিবর্ষণ। অফুরন্ত অস্ত্রভাণ্ডারের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হল সামান্য বাঁশ-কাঠের তৈরি তীর ধনুক। চালকবিহীন ডুঙ্গিগুলো মৃতদেহের ভারে গেল উল্টে। তাড়া করে ফেরা নৌবাহিনীর সৈনিকরা পা রাখল মাটিতে। আজ বুঝি তাদের বিজয় উল্লাসের দিন।

মুষ্টিমেয় বন্দি আদিবাসীদের নিয়ে রাখা হল একটি তাঁবুতে। ওয়াকার সাহেব এসে তাদের বুঝিয়ে গেলেন ভয়ের কিছু নেই। কোম্পানি আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে চিন্তাভাবনা করছে। প্রয়োজন শুধু একটু সহযোগিতা। সাহেবের নির্দেশে বুধনাথকে বুঝিয়ে বলতে হল সে কথা। যন্ত্রের মতো কথাগুলো উগরে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বুধনাথ। ঠিক কী ঘটে গেল তা যেন তার অসাড় মাথায় ঢুকছিল না। আজ বুধনাথের জন্য রক্ষা পেয়েছে এতজন কয়েদির প্রাণও। তারা বার বার জয়ধ্বনি দিতে লাগল বুধনাথের নামে। বুধনাথের চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল কালো রক্ত নদীর স্রোতে। সার সার মৃতদেহগুলোকে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে জড়ো করে রাখা হচ্ছিল জাহাজের ডেকের ওপরে। মাঝসমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হবে ওগুলোকে। কূলের কাছে ফেললে মৃতদেহগুলো পচে গলে ফিরে আসতে পারে তীরে। গন্ধ ছড়াতে পারে কয়েদি শিবিরে।

পরদিন ওয়াকার সাহেব স্বয়ং অভিনন্দন জানাতে এলেন বুধনাথকে। এই জাহাজেই তোমার কলকাতা যাবার বন্দোবস্ত পাকা হয়ে গেল। সুবেদার পদে উন্নীতও করা হবে তোমাকে। আনন্দের কথা এই যে, আমিও অব্যাহতি পাচ্ছি এই নরক থেকে। আমিও শীঘ্রই ফিরে যাব কলকাতাতে।

খুশি হবার বদলে সচকিত হয়ে উঠল বুধনাথ, বলল, কিন্তু স্যার যাবার আগে আমি আর এক বার জঙ্গলে যেতে চাই।

ওয়াকার সাহেব বললেন, হোয়াট? জঙ্গলে? এত দিন জঙ্গলে থেকেও তোমার সাধ মিটল না। আর ইউ আ পোয়েট?

সাহেবর ঠাট্টার কোনো জবাব না দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বুধনাথ বলল, জঙ্গলে আমার আত্মীয়রা রয়ে গেল যে।

সাহেব বললেন, নো নো বুধনাথ। জঙ্গল এখন আর তোমার জন্য নিরাপদ নয়। তুমি ওদের আত্মীয় মনে করলেও তারা কখনোই আর তোমাকে আত্মীয় মনে করবে না। লস্‌ অফ আ রেস। একটা জাতি ধ্বংস হয়ে গেল প্রায় জাস্ট ফর ইয়োর ক্রেডিট। কিছু মহিলা কিছু শিশু দিয়ে তো আর একটা জাতি রক্ষা হবে না। সব পুরুষরাই তো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছে মোটামুটি।

বুধনাথের হাত চেপে ধরল লিচো, বলল, না যাও জঙ্গলে। কেউ না কেউ নির্ঘাত তীর ধনুক নিয়ে বসে আছে আমাদের জন্য। মেরে দেবে।

বুধনাথ বলল, কিন্তু সুরমাই?

লিচো বলল, সুরমাই ঠিক থাকবে মিমির কাছে। জঙ্গলে কেউ খুঁজে পাবে না ওদেরকে। সাহেবরা যদি সত্যিই হোম তৈরি করে আদিবাসীদের জন্য তখন না হয় আমরা আবার ফিরে আসব এখানে। তখন আমি জঙ্গলে গিয়ে ঠিক খুঁজে আনব সুরমিকে আর মিমিকে।

কিন্তু ততদিনে যদি, কথা শেষ করতে পারে না বুধনাথ। তার গলা বুজে আসে।

লিচো বলে, কিছু হবে না, জঙ্গল আমাদের মায়ের মা, জঙ্গলই রক্ষা করবে ওদেরকে।

ভোঁ দিল জাহাজে। দ্বীপ ছেড়ে জল কেটে এগোতে লাগল মূল ভূখণ্ডের দিকে। ছুটে গিয়ে দাঁড়াল বুধনাথ ডেকের রেলিং ধরে। কার যেন তার জন্য অপেক্ষায় থাকার কথা! ওই তো, ওই তো কে যেন দাঁড়িয়ে আছে পাথরের ওপরে। ওই পাথরটাই কি? নাকি ওটা গাছ! যত দূরে যাচ্ছে জাহাজ, সব কেমন লেপ্টে যাচ্ছে, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বুধনাথের ইচ্ছে করছে জলে ঝাঁপ দিতে। ইচ্ছে করছে সে সাঁতরিয়ে চলে যায় তার সুরমির কাছে। কিন্তু কিছু কিছু ইচ্ছেকে বুকের মধ্যে লালন করতেই ভালো লাগে। নিশ্চিত সুখ ত্যাগ করে অনিশ্চিত উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়বার শক্তি থাকে ক’জনের? সেই ফাঁক বা ফাঁকিটুকুর নামই তো বিরহ।

দিগন্তবিস্তৃত নীল জলরাশির মধ্যে স্মৃতির মতো ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে সবুজ দ্বীপমালা। এক অজানা ইতিহাস।

অপস্রিয়মাণ জাহাজের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুরমি। সূর্য ডোবে। সূর্য ওঠে। জলের পোকা ভেজা বালির ওপর কিছু পদচিহ্ন রেখে নেমে যায় জলে। ছোট্ট ডুঙ্গি নিয়ে ভেসে পড়ে সুরমি। ওই লাও বোটগুলো কোথায় যায়?

নিজেদের সীমানার বাইরে তার না আছে দিকচিহ্ন না আছে ঠিকানা। সে ডুঙ্গি নিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যায় আরও গভীর সমুদ্রের দিকে। তারপর ঢেউয়ের ধাক্কায় ওলটপালট খেতে খেতে ডুঙ্গি সুদ্ধ সে-ও তলিয়ে যায় সাগরে।

অনেক অনেক দিন পরে হয়তো একটা প্রস্তরখণ্ড হয়ে সে মাথা তুলে দাঁড়ায় জলের ওপরে। যে পাথরের নাম ইচ্ছাপূরণ।

….

(এটি কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। লোক মুখে প্রচলিত একটি সামান্য ঘটনার ওপর নির্ভর করে এই কাহিনির বিন্যাস। গল্পের প্রয়োজনে ঘটনাপঞ্জীর কালক্রমে সামান্য অদলবদল ও মূল চরিত্রের কাল্পনিক নাম ব্যবহার করা হয়েছে।)

।। সমাপ্ত ।।








এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *