মূল রচনা- মার্ক টোয়েন (Samuel Longhorn Clemens) গল্পের নাম ‘Luck’
অনুবাদ- মলয় সরকার
লেখক পরিচিতি
(মার্ক টোয়েন , জন্ম ৩০শে নভেম্বর ১৮৩৫ আমেরিকার ফ্লোরিডায়, মৃত্যু ২১শে এপ্রিল ১৯১০ এ। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, রসস্রস্টা, ব্যবসায়ী, প্রকাশক,ও বক্তা। তাঁকে বলা হয়
‘আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ রসস্রষ্টা’ বা আমেরিকান সাহিত্যের জনক।)
সেটা ছিল লণ্ডনের একটা ভোজের আসর। এটি ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেইসময়ে প্রথম সারির যে দু তিনজন স্বনামধন্য, বহু প্রশংসিত সামরিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজনকে সম্মান জানাতে। বিশেষ কারণে, তাঁর আসল নামটা প্রকাশ করা হচ্ছে না। তাঁকে আমরা লেফটেনেন্ট জেনেরাল লর্ড আর্থার স্কোরসবী বলে সম্বোধন করব। তিনি Y C, K.C.B., ইত্যাদি নানা সম্মানে ভূষিত। চোখের সামনে রক্তমাংসের সেই মানুষটি বসে রয়েছেন, যাঁর কথা আমি বিগত ত্রিশ বছর ধরে, যখন তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হঠাৎ খ্যাতি লাভ করেন, তখন থেকে, অন্ততঃ কয়েক হাজার বার শুনেছি। তিনি নিশ্চয়ই আগামী বহুদিন এই গৌরবের অধিকারী হিসাবে স্মরণীয় থাকবেন।
আমি সেই জীবন্ত দেবতার দিকে খাওয়া দাওয়া ভুলে নির্নিমেষ তাকিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম, কি শান্ত, কি সততার প্রতীক, কি অমায়িক, আত্মভোলা মানুষটি। তাঁর উপরে যেন এক পবিত্রতা মাখা শান্ত স্নিগ্ধতা ছেয়ে রয়েছে। সমস্ত মানুষের গভীর ভালবাসা মাখা শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টি যেন কত অবহেলায় তুচ্ছ জ্ঞান করে কি ভীষণ নির্লিপ্ততায় বসে রয়েছেন।
আমার পাশে বসে ছিলেন আমার খুব পুরানো পরিচিত এক ধর্মযাজক। তিনি যদিও বর্তমানে এই পেশায় আছেন, এক সময়, প্রথম জীবনে তিনি উলুইচ এ মিলিটারিতে সৈনিক স্কুলে প্রশিক্ষক হিসাবে অনেক দিন কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে, তিনি নীচুস্বরে গোপনে আমার দিকে ঝুঁকে, সেদিনের ভোজ সভার উদ্দিষ্ট বীরের সম্বন্ধে বললেন, “সত্যি সত্যি উনি একজন আকাট মূর্খ।”
এই মন্তব্য, হঠাৎ করে, আমার কাছে ভীষণ আশ্চর্যের লাগল। যদি উনি এই কথা নেপোলিয়ন, বা সক্রেটিস, কিংবা সলোমনের সম্বন্ধে বলতেন, তাহলেও হয়ত এর থেকে বেশি আশ্চর্য হতাম না। অথচ দুটো ব্যাপারে আমার ওই যাজকের ব্যাপারে খুব ভাল করে জানা ছিল যে, উনি খুব দৃঢ় ভাবে সত্যবাদী এবং ওনার মানুষ চেনার ব্যাপারে ধারণা খুবই ভাল। কাজেই আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম যে, সারা পৃথিবী ওই ভদ্রলোকের সম্বন্ধে নিশ্চয়ই ভুল ধারণা করেছে এবং তিনি নিশ্চয়ই একজন মূর্খ।
কাজেই, আমি উপযুক্ত সময় খুঁজতে লাগলাম কখন ওনাকে একলা নিরালায় পাওয়া যাবে, যাতে ওনার এই মন্তব্যের কারণটা জানতে পারি।
কয়েকদিন পর সত্যিই সময় এবং সুযোগ পাওয়া গেল এবং উনি আমাকে যা বললেন তা এইরকম-
প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি উলুইচে সৈনিক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত ছিলাম। আমি একটি বিভাগে যুক্ত ছিলাম যখন তরুণ স্কোরসবী প্রাথমিক পরীক্ষা দিয়ে আমার কাছে আসে। আমি লক্ষ্য করলাম বাকী ক্লাশের ছাত্ররা যখন সুন্দর ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল, তখন ও, বলব কি আপনাকে, কিছুই জানে না। দেখতে শুনতে অবশ্য ছেলেটি ভীষণ ভালো, মিষ্টি, চোখ মুখ সারল্যে ভরা, দেখলেই ভাল বাসতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক, যে, সে একটি ছবি বা খোদাই করা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। সে এমন বোকার মত বা মূর্খের মত উত্তর দিল যে, কি বলব! তাকে দেখে আমার মনের ভিতর, ওর প্রতি, কেমন যেন একটা মায়া জন্মাল, এবং আমি স্থির করলাম, ও তো কিছুই পারবে না, এখন আমি না হয় আমার তরফ একটু চেষ্টা করে দেখি, যাতে সহজে কিছু অন্ততঃ শিখিয়ে দেওয়া যায়। আশা করি এতে কিছু দোষ নেই।
আমি তাকে ডেকে আলাদা করে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে দেখলাম, ও সীজারের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানে না এবং এছাড়া অন্য কিছু সম্বন্ধেও কিছু জানে না। আমি বাধ্য হয়ে ওকে জাহাজের ক্রীতদাস নাবিকদের মত প্রচণ্ড ভাবে পরিশ্রম করিয়ে সামরিক শিক্ষা দিতে লাগলাম এবং বাঁধা কিছু প্রশ্ন, যা পরীক্ষার সময় প্রায়ই পরীক্ষকরা জিজ্ঞাসা করেন, সেগুলো শেখাতে লাগলাম। ও কেবলমাত্র সেই ক’টা, তোতাপাখীর মত মুখস্থ করা, প্রশ্নের উত্তর সম্বল করে পরীক্ষা দিতে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার, ও পরীক্ষায় সবার চেয়ে বেশী নম্বর পেয়ে ঊত্তীর্ণ হল আর যারা ওর থেকে হাজার হাজার গুণে সত্যিকারের ভাল, তারা ফেল করল। কেমন আশ্চর্যের মত ভাগ্যের ঘটনায়, যা এক শতাব্দীতে দু’বার হয় কি না সন্দেহ, পরীক্ষকরা, ও যা পড়ে গিয়েছিল কেবলমাত্র সেইটুকুর মধ্যেই প্রশ্ন করেছেন, এবং এর বাইরের থেকে কিছুই জিজ্ঞাসা করে নি।
এর পর পুরো কোর্স চলাকালীনই, ওর উপর আমার একটা কেমন মায়া পড়ে গিয়েছিল, যেমন, বিকলাঙ্গ ছেলে মেয়ের উপর মায়ের হয়। আমি সব সময় ওকে রক্ষা করার চেষ্টা করতাম, আর আশ্চর্যের ব্যাপার, ও-ও ঠিক কেমন করে যেন অদ্ভূতভাবে বেঁচে যেত।
শেষকালে আমি দেখলাম, ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল অঙ্ক। আমি বুঝলাম, ও আর এটা পেরোতে পারবে না। তাই শেষ চেষ্টা করলাম, সাধারণতঃ পরীক্ষকরা যে কয়েকটি প্রশ্ন, বেশি করেন পরীক্ষায়, সেই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর তৈরী করানোর জন্য তাকে আবার প্রচণ্ড ভাবে পরিশ্রম করালাম। শেষে, যা হয় কপালে, বলে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম।
ভাগ্যের কি খেলা! এতেই ও ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে গেল এবং এর ফলে ওর ভীষণ জয় জয়কার পড়ে গেল।
এদিকে আমার প্রায় এক সপ্তাহের মত চোখ থেকে ঘুম চলে গেল। নিজের বিবেকের কাছে দিনরাত্রি নিজেকে অপরাধী লাগতে আরম্ভ করল। এ আমি কি করলাম! আমি তো মাত্র সৌজন্যবশতঃ বা কর্তব্যের খাতিরে ছেলেটিকে, যাতে একটু উৎরে যায়, তার চেষ্টা করেছি। আমি তো স্বপ্নেও ভাবি নি যে ওর এত দুর্দান্ত ভাল ফল হবে। আমার নিজেকে দোষী মনে হতে লাগল। মনে হতে লাগল, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মত, আমি এ কি তৈরী করলাম! একটা মাথা মোটা ছেলেকে এত সম্মান আর দায়িত্বের জায়গায় পৌঁছে দিলাম। এর পর তো যখনই ওকে কোন দায়িত্ব দেওয়া হবে, প্রথম ধাক্কাতেই তো ও ধরাশায়ী হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ বাধল। ভাবলাম, এই যুদ্ধটা তে ভালই হল, এই গাধাটার আসল রূপ ধরা পরার আগেই একে মারা যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। তা না হলে শান্তি আসবে না। কিন্তু খবরে আমার মাথা ঘুরে গেল। দেখা গেল। ওকে প্রকৃতপক্ষে মার্চিং রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। কত ভাল ভাল সুযোগ্য মানুষ এই পদে উন্নীত হতে চুল সাদা করে ফেলে। কে ভাবতে পেরেছিল যে, ওর মত একজন নতুন কাঁচা ছেলের উপর এত দায়িত্ব দেওয়া হবে! আমি তা-ও বিশ্বাস করতাম যদি ওকে কর্ণেট এর দায়িত্ব দেওয়া হত, তা না হয়ে একে বারে ক্যাপ্টেন!! ভাবুন একবার, আমার তো মাথার চুল সাদা হয়ে যাবার জোগাড়।
মনে মনে চিন্তা করলাম, এ আমি কি করলাম ! আমি যে এত শান্তির পক্ষপাতী, কিন্তু এই সমস্ত ব্যাপারের জন্য আমিই তো দায়ী। আমি তখন স্থির করলাম, আমার নিশ্চয়ই ওর পাশে যাওয়া উচিত এবং সাধ্য মত দেশকে বাঁচানো উচিত। তখন আমার সারা জীবনের যা সঞ্চিত অর্থ ছিল, তাই দিয়ে একটা ওই রেজিমেন্টে কর্ণেটের পদ জোগাড় করলাম এবং আমরা যুদ্ধে গেলাম।
সেখানে গিয়ে, বুঝলেন, দেখি অনর্থই অনর্থ। ও তো কোথাও অনর্থ ছাড়া কিছু করে নি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ওর ভুলগুলো লোকে বুঝতে পারত না আর উলটে ওকে প্রশংসা করত। ওরা ওর ভুলগুলোকে একজন প্রতিভাধরের অনুপ্রেরণা বলে মনে করত। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হত, ওর প্রতিটি নতুন ভুল, যা সাধারণ যে কোন মানুষের কাঁদার মত অবস্থা করতে পারত, সেগুলি ওর খ্যাতি যেন বাড়িয়ে তুলত। আমি নিজের মনে বলতাম, একদিন হয়ত এমন হবে যে এর জন্য বড় কোন ইন্দ্রপতন হয়ে যাবে।
স্কোরসবী ক্রমশঃ এক পদ থেকে পরের পদে উন্নতির সিঁড়িগুলো পর পর টপকেই যেতে লাগল। ওর যারা ঊর্ধতন অফিসাররা ছিলেন তাঁদের মৃতদেহের উপর দিয়ে ও এগিয়েই যেতে থাকল। শেষে –এর যুদ্ধে ও একেবারে প্রায় উচ্চতম পদের দরজায় পৌঁছে গেল। আমার মনে হল, আমার হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে পড়বে, কিংবা আমরা শীঘ্রই পাতালে পৌঁছাব।
যুদ্ধটা ভীষণই হয়েছিল। মিত্রশক্তি ভালই লড়াই করছিল। আমাদের রেজিমেন্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছাল। এ সময় একটা ছোটখাট ভুলও মারাত্মক হতে পারত। এই সময়ে গোমুখ্যুটা কি করল জানেন? সেখান থেকে রেজিমেন্ট কে সরিয়ে নিল এবং পাশের একটা পাহাড়ে যেখানে শত্রুর থাকার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই সেখানে আক্রমণ করতে আদেশ দিল। আমি নিজে নিজে বললাম, এই বার তোমার শেষ, এবার তুমি মরবে।
সেখানে আক্রমণ তো হল। কিন্তু গিয়ে কি দেখলাম জানেন, একটা পুরো রাশিয়ান সৈন্যদল, যাদের ওখানে থাকার সম্বন্ধে কোন রকম ধারণা বা সন্দেহই ছিল না, তারা ওখানে বসে আছে। আমরা তাদের উপর আক্রমণ করতেই তারা লেজ গুটিয়ে পালাল, এবং তারা সব ছত্রভঙ্গ হয়ে তছনছ হয়ে গেল । ফলে মিত্র শক্তি ভীষণ সুন্দর ভাবে জয়লাভ করল।
এই ঘটনায় মার্শাল ক্যান রবার্ট হতভম্ব হয়ে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সৈন্যদলের সামনে ঐ যুদ্ধের ময়দানেই স্কোরসবীকে জড়িয়ে ধরে অভিবাদন করে সম্মান জানালেন।
এখানে স্কোরসবীর অনর্থ কি জানেন? ও ডান দিকের জায়গায় বাঁদিক দেখিয়ে ছিল। ব্যস এইটুকুই। ওর কাছে আদেশ এসেছিল ডান দিক চেপে পিছিয়ে আসতে। ও তার জায়গায় ডানদিক -বাঁদিক গুলিয়ে ফেলে বাঁদিক দিয়ে এগিয়ে গেল। এবং এই ভুলের ফলে ও যে সাফল্য পেল তা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও ম্লান হবে না।এবং ইতিহাসের বই থেকেও কখনও মুছবে না।
স্কোরসবী একজন ভীষণ ভাল মানুষ, মিষ্টি স্বভাবের এবং ওকে দেখলেই ভাল বাসতে ইচ্ছা করে, কিন্তু বিপদের সময় কি করে তার থেকে বেরিয়ে আসতে হয়, সেটা ও জানে না। সেটা সর্বৈব সত্য। পৃথিবীর সেরা গাধা একটা। কিন্তু দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ওর সৌভাগ্য যেভাবে ওকে আড়াল করে রক্ষা করে এসেছে, তা আশ্চর্যজনক। ওর সারা জীবন, ও সমস্ত যুদ্ধে ভীষণ সুনামের সঙ্গে কাজ করেছে। প্রকৃতপক্ষে ওর সমস্ত কাজেই ও ভুল এবং অনর্থ করে গেছে, কিন্তু এমন একটিও হয় নি যাতে ওর ক্ষতি বা দুর্নাম হতে পারে।
ওর পোষাকে যত শোভনীয় সম্মান চিহ্ন দেখেছেন, সেগুলি সবই ওর কোন না কোন চরম বোকামীর ফলস্বরূপ। এ সব দেখে কি মনে হয় না, একজন মানুষের জীবনে ভাল কিছু হতে গেলে, তাকে অবশ্যই সৌভাগ্য নিয়েই জন্মগ্রহণ করতে হবে।
তা সত্বেও আমি আবার বলি, আপনাকে সেদিন যা বলেছিলাম ভোজ সভায়, যে, স্কোরসবী একটি চরম বোকা ও মূর্খ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন