onubad-thagini

ঠগিনী
মূলকাহিনীঃ আলবার্তো মোরাভিয়া-র “ইমব্রগলিও”
অনুবাদঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

লেখক পরিচিতি এবং গল্পের সারাংশ

মোরাভিয়ার “লা ইমব্রগলিও”(ইংরিজি করলে হবে দ্য হোক্স)। প্রথম প্রকাশ ১৯৩৭ সালে বমপিয়ানি থেকে।

ইতালিয়ান কথাসাহিত্যিক আলবার্তো মোরাভিয়ার এই গল্পটি প্রকৃত অর্থেই একটি সার্থক বহুমাত্রিক কাহিনী। এক দিকে এটি তাঁর হাতের তেলোর মত করে চেনা বিশ শতকের রোম শহরের মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের এক অনুপম কথাচিত্র, অন্যদিকে রয়েছে নারীপুরুষের সম্পর্কের সিম্বায়োটিক ও প্রিডেটরি এই দুটি দিক নিয়ে পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ। একই সঙ্গে মানুষের দৈহিক, আর্থিক ও মানসিক চাহিদা এই তিনের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রেম-এর এক পশ্চিমী বস্তুবাদি ব্যাখ্যা হিসেবেও দেখা যায় কাহিনীটিকে। আর সবার ওপরে গল্পের শেষ অবধি পৌঁছেও কিন্তু এর তিনটে প্রধান চরিত্রের মধ্যে কে যে প্রতারক আর কেই বা প্রতারিত সে বিষয়ে কিন্তু একটা প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়। “অন্তিমে অতৃপ্তি” বজায় রাখবার এই সুক্ষ্ম মুন্সীয়ানাই গল্পকার হিসেবে মোরাভিয়া-র সার্থকতা।

অর্থ ও সঙ্গ এই দুইয়ের লোভে, এই দুই রকমের অভাবে ভোগা দুই নারীর, নিজের নিজের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করবার জন্য একটা কমবয়েসি, একাকিত্বে ভোগা তরুণের ইমোশনকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করার কাহিনী হিসেবে এর বাংলা নামকরণে স্ত্রীলিঙ্গের ব্যবহার করেছি। “ঠগিনী” নামটা ব্যবহার করবার আর একটা কারণ হল এ গল্পের চুম্বকসারের সঙ্গে, ১৯৩৭ উত্তর যুগে লেখা সুবোধ ঘোষ মশাইয়ের “ঠগিনী” গল্পের আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া।


Picture courtesy : Wikipedia

মূল গল্পের অনুবাদ

জিয়ানমারিয়া বারগিগলি ছেলেটা একটু বেশিই লাজুক। তার জন্য তার কাঁচা বয়স খানিকটা দায়ী, আর খানিকটা দায়ী তার কল্পনাশক্তি। কখনো কখনো এই লাজুক ভাবটাকে ঢাকবার জন্য একরকম জোর করেই সে বেজায় চালাকচতুর হাবভাব দেখিয়ে বসতো। কখনো কখনো আবার, আদতে সে যা নয় তেমন একটা চরিত্র হিসেবে নিজেকে অন্যের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা শুরু করতো সে, আর তারপর, যে কোন পেশাদার অভিনেতার মত, অভিনীত চরিত্রটার যাবতীয় হাবভাব, আবেগ-অনুভুতি সবকিছুকেই নিজের বলে নিজের কাছেই চালিয়ে দিত সে। তাতে হিতে বিপরীতই হতো অবশ্য, কারণ অভিনয় ব্যাপারটাতে সে কোনকালেই বিশেষ দক্ষ নয়। রোমে এমনই একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো সেবারে। সে গল্পই বলবো।

বাড়ি ছেড়ে সে তখন সদ্য রোমে এসেছে। থাকে একটা মেসবাড়িতে। বন্ধুবান্ধব দূরস্থান, কথা বলবার মতন সামান্য দু-একটা লোকের সঙ্গেও আলাপ হয়নি। প্রায় সপ্তাহখানেক এইভাবে কাটাবার পরে একদিন, একরকম মরীয়া হয়েই সে ঠিক করে ফেললো, মেসবাড়ির অন্তত একজন মেম্বারের সঙ্গে এইবারে সে আলাপ করে ফেলবেই।

প্রতিজ্ঞাটা করে ফেলবার পর এইবারে আলাপের পাত্রপাত্রী নির্বাচনের পালা। খানিক ভেবেচিন্তে জিয়ানমারিয়া ঠিক করলো, মেসবাড়ির আর এক ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সানটিনা নামের মেয়েটাই আলাপ করবার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। মেয়েটার সঙ্গে প্রতিদিনই খাবার ঘরে দেখা হয় তার। সরাসরি গিয়ে কথা বলে ফেলতে হবে প্রথমে। একটু লজ্জা হয়তো লাগবে, কিন্তু সে লাগুক গে। সেটা কাটাতে হবে। তারপর, আলাপটা হয়ে গেলে পরে কদিন নয় হালকামতো একটু প্রেমও করা যাবে মেয়েটার সাথে। নইলে আর পুরুষমানুষ কী হলো!

প্রতিজ্ঞা করবার পর তিনচারদিন কেটে গেল। আলাপ আর হয় না। লজ্জা বড় দায় যে! তবে, এই কদিন খাবার ঘরে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে তার ওপর বেশ একটা টান হয়েছে জিয়ানমারিয়ার। দিনরাত কেবল তার চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে, আর কেমন করে প্রথম আলাপটা করে ফেলা যায় তার হাজারো ফন্দিফিকির ঘোরাফেরা করে মাথার মধ্যে। ঘুম-টুম তখন তার মাথায় উঠেছে। মেয়েটাকে দূর থেকে দেখলেও দম বন্ধ হয়ে, জিভ শুকিয়ে, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে একাকার অবস্থা হয়। তবে ফ্যান্টাসির জগতে জিয়ানমারিয়া বেজায় সাহসী নায়ক। কল্পনায় মেয়েটার স্পর্শসুখ সে তখন একরকম নিয়মিতই পাচ্ছে ।

তা এইভাবে আরো কয়েকদিন যাবার পরে একদিন সন্ধেবেলা অতীষ্ঠ হয়ে গিয়ে সে ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসলো যে সেদিন মাঝরাত্রের ঘন্টা পড়বার আগেই সানটিনার সঙ্গে আলাপটা সে সেরে ফেলবেই।

সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলবার পর সেদিন সন্ধ্যাবেলা সে সাজগোজে একটু বিশেষ নজর দিলো। সারাটা বিকেল তার কেটেছে সোফায় শুয়ে শুয়ে আন্তর্জাতিক আইনের কেতাব পড়ে আর সিগারেটের পর সিগারেট ধ্বংস করে। খানিক বাদে প্যাসেজ থেকে রাতের খাবার ঘন্টার শব্দটা ভেসে আসতেই সে তাড়াতাড়ি আইনের বইটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল। তারপর লাফ দিয়ে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের মুখটা বিশেষ পছন্দ হচ্ছিল না তার। কেমন যেন একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব। তাছাড়া ত্রূটিও রয়েছে অনেক। চোখের কোণে কালি, যেন রাত্রে ঘুমটুম হয়নি বিশেষ। কপালের ওপরে খাড়া খাড়া চুলের গোছা—হাজার ক্রিম লাগিয়েও সেগুলোকে বশে আনা যায় নি। কপালে, ঘাড়ে, গালে অজস্র ব্রণ। গালেরগুলো অবশ্য নতুন ওঠা দাড়ির আড়ালে খানিক ঢাকা পড়েছে। কিন্তু তাতেও কি সব দোষ ঢাকে! এই ব্রণগুলোই হচ্ছে সবচেয়ে বিশ্রি।

তবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের মুখটাকে তার বেশ আকর্ষণীয়ই মনে হতে শুরু করল। চোখের দৃষ্টি বেশ উজ্জ্বল। চকচকে চোখদুটোর মধ্যে যেন বেশ একটা রহস্য লুকিয়ে আছ। ঠোঁটের কোণে যে একটা বেশ আকর্ষণীয় কড়া হাবভাবের ভাঁজ পড়েছে। ভুরুদুটো, একটু হলেও বেশ বনেদি ঢংয়ে ওপরের দিকে বাঁকানো।

আরো কিছুক্ষণ আয়নাচর্চা করবার পর সে পরিষ্কার বুঝতে পারলো আজ ভাগ্য সদয়। কারণ, ব্রণগুলোকে বেশ ছোটছোট আর মোলায়েম বলেই ঠেকছে। গালের একটামাত্র বড়োসড়ো ব্রণ ছাড়া বাকিগুলো তো খেয়াল করে না দেখলে বোঝাই যাচ্ছেনা প্রায়!

বেশ কিছুক্ষণ ধরে এইভাবে নিজের মুখের তদন্ত শেষ করে সে পোশাক বদলাতে শুরু করল। থাকবার মধ্যে তার সম্বল মোটে দুখানা স্যুট। একটা ছেয়ে রং-এর। সেটা দিনের বেলার জন্য। অন্যটা নীল রঙের ইভনিং স্যুট। জিয়ানমারিয়া অতএব আরশোলার গন্ধ ভরা বিরাট কাবার্ডটা খুলে তার নীল রং-এর ইভনিং স্যুটখানা বের করে এনে বিছানার ওপরে যত্ন করে মেলে রাখল। এরপর ওয়ার্ডরোব থেকে বেরলো একজোড়া পুরোন, শক্তপোক্ত জুতো, আর আলমারির ড্রয়ার খুলে বের হল তার সবেধন নীলমণি একজোড়া সিল্কের মোজা।

গায়ের জামাকাপড় খুলে ফেলে আয়নার দিকে তাকাল জিয়ানমারিয়া। নিজের নগ্নতায় অভ্যস্ত হতে এখনো তার দেরি আছে। তার দৃষ্টিতে তাই লজ্জা আর তীব্র আকর্ষণ মেশা, যেন উদোম গা কোন মেয়ের দিকে দেখছে। একটু বাদেই দৌড়ে গিয়ে দরজার পেছনের হুকে আটকানো শার্টটা টেনে নিয়ে গায়ে দিয়ে ফেলল তাড়াতাড়ি। শার্টটা মাত্র একদিনের বাসি। এখনো পরা যায়।

জামাকাপড় পরা শেষ হলে, এইবারে প্রসাধনের পালা। মুখ ধোবার বেসিনের সামনে দুটো জলভরা বড়োসড়ো জাগ আর চিনেমাটির দুখানা ফুলকাটা সবুজ বাটি রয়েছে। সকালবেলা হাত ধুতে গিয়ে সাবানের টুকরোটা কোথায় যেন পড়ে গিয়েছিলো। বেসিনের নীচে এদিক সেদিক খুঁজতে গিয়ে হাতে ঝুলকালি লাগাই সার হলো, সাবান পাওয়া গেল না। অতএব ঠাণ্ডা জলে হাতদুটো এমনিই ঘষে ঘষে ধুয়ে নিয়ে জলের পাত্রে মাথাটা ডুবিয়ে দিল সে। তারপর চুলে খানিকটা ক্রিম লাগিয়ে যত্ন করে আঁচড়াতে শুরু করল। কিন্তু ভেজা, হালকা চুল, ক্রিম মাখবার ফলে দলা পাকিয়ে গিয়ে তার ফাঁকে ফাঁকে মাথার চামড়া দেখা যাছিল, যেন এখানে ওখানে টাক পড়া শুরু হয়েছে। অতএব ফের নতুন করে একবার আঁচড়াবার চেষ্টা। কিন্তু ততক্ষণে ভেজা চুল একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে সজারুর কাঁটার মতো খাড়া খাড়া হয়ে উঠেছে। খানিকক্ষণ তাদের বশে আনবার ব্যর্থ চেষ্টা করে জিয়ানমারিয়া ফের জলের গামলায় মাথা ডুবিয়ে ফের একদলা ক্রিম লাগালো মাথায়। এইবারে আর চিরুণি নয়। হাত দিয়ে চেপে চেপে চুলগুলোকে ভালো করে বসিয়ে নিয়ে তার ওপরে তোয়ালেটাকে পাগড়ির মতন করে বেঁধে নিল সে। তারপর সেই অবস্থাতেই শার্টের গলায় ইস্ত্রি করা কলারটা আটকাতে বসল। সে কলার আবার কিছুতেই আটকবে না! খানিক চেষ্টা করতে তার ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে গিয়ে একেবারে কুঁকড়ে মুকড়ে একশা। দলা পাকিয়ে সেটাকে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আর একটা কলার বের করে আনলো জিয়ানমারিয়া। এটাই তার শেষ সম্বল। এটাও নষ্ট হয়ে গেলে আর কিছু করবার নেই।

দু নম্বর কলারটা অবশ্য এক চেষ্টাতেই বেঁধে নেয়া গেল। তারপর টাইয়ের গিঁটটা দিতেদিতেই শোনা গেল ডিনারের দ্বিতীয় ঘন্টা বেজে উঠেছে বাইরে। লজ্জাটা ফের একবার তেড়েফুঁড়ে উঠছিলো তার। সেটাকে কোনমতে চাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি করে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজার আয়নাতে দেখে মাথায় ভারতীয় রাজপুত্রদের পাগড়ির মত তোয়ালেটা জড়ানো রয়ে গিয়েছে। এক টানে সেটাকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্যাসেজে পা বাড়ালো জিয়ানমারিয়া।

একটা পুরোন প্রাসাদটাইপের বাড়ির চতুর্থ তলাটা জুড়ে এই মেসবাড়ি। রোমের আর পাঁচটা মেসবাড়ির সঙ্গে তার বিশেষ তফাৎ নেই। সেই একইরকম পুরোনকালের সব আসবাব, রান্নাবান্নার গন্ধ আর বিষণ্ণ নির্জনতা ছড়ানো রয়েছে চারপাশে। তবে একটা ক্ষেত্রে এই মেসবাড়িটা অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। এখানে এত বেশি অলিগলি রয়েছে যা আর কোন মেসে নেই। নিচু নিচু, অন্ধকার সব লম্বা লম্বা করিডোর গোলকধাঁধার মতন ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। তাদের সবগুলোই প্রায় একইরকম দেখতে।

আজ ঘর থেকে বের হয়ে গোটা দুই বাঁক নিয়েই জিয়ানমারিয়া বুঝতে পারল, সে পথ হারিয়েছে। ডাইনিং রুমের দরজাটা সবুজ রঙ করা আর কাচ লাগানো, শুধু এইটুকুই তার মনে ছিলো। অতএব, খানিক বাদে একটা লম্বা করিডোর পার হয়ে ঠিক সেইরকম একটা দরজা দেখতে পেয়ে, টাইটা একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে বেশ গম্ভীর মুখ করে সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ঢুকে দেখে সেটা ডাইনিং রুম নয়! ঘরের ঠিক মাঝবরাবর একটা পার্টিশান। তার ওপর থেকে একগাদা মেয়েদের পোশাক এলোমেলো ঝুলছে। আর পার্টিশানের গায়ে হেলান দিয়ে সানটিনা তার দিনের বেলার পোশাকটা মাথার ওপর দিয়ে খুলে ফেলবার জন্য টানাটানি করে চলেছে। হাত আর মুখ তার ঢাকা পড়ে গেছে কাপড়ের নিচে। গায়ে একটা সবজেটে পেটিকোট। তাতে হলুদ রঙের লেস আর গোলাপি স্ট্র্যাপ।

জিয়ানমারিয়া হাঁ করে শরীরটাকে দেখছিলো। হাড় বের করা কাঁধ আর ঢুকে থাকা পেটের সঙ্গে একেবারেই বেমানান দুটো বড় বড়ো কালো স্তনবৃন্তের আভাস দেখা যাছে পেটিকোটের আড়াল থেকে। বিশ্রি পা দুখানা লম্বা, কালো মোজায় ঢাকা। বগলে ঘন কালো চুল।

“কে রে ওখানে?” জামাকাপড়ের মধ্যে থেকে বেশ কড়া একটা গলা ভেসে আসতে জিয়ানমারিয়ার চেতনা ফিরল। “কেউ না, কেউ না” বলে বিড়বিড় করতে করতে দৌড়ে বেরিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। করিডোর ধরে চলতে চলতে তার বারবার মনে হচ্ছিল, এ মেয়েটাকেও যদি বশে আনতে সে না পারে তাহলে সে একেবারে কোন কম্মেরই নয়। ভাবতে ভাবতেই ডাইনিং রুমের সামনে এসে পৌঁছে গেল সে। ফের সেই গম্ভীর, আত্মবিশ্বাসী যুবকের ভান করতে করতে নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকবার পালা। কিন্তু কপাল মন্দ। খুলতে গিয়ে দরজাটা প্রথমে গেল আটকে, আর তারপর একেবারে হঠাৎ করেই একেবারে দুম করে খুলে গেল তার হাতের ধাক্কায়। কাচের প্যানেলগুলো ঝনঝন করে উঠতে ডাইনিং হলের সবগুলো চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। বেশ লজ্জা পেয়ে গেলেও, যেন কিছুই হয় নি এমন একটা ভান করতে করতে জিয়ানমারিয়া গিয়ে নিজের টেবিলে বসলো।

এ ঘরটা বেশ লম্বা। উঁচু ছাদ। দেয়ালের ধার ঘেঁষে পরপর খাবার টেবিল। একপ্রান্তে বড় একটা টেবিলের ওপর প্রচুর থালাবাটি আর ন্যাপকিন সাজানো। আর আছে লাল রিবনে বাঁধা দুট্টো ছোট ছোট ফলের টুকরি। তার খানিক পেছনে একটা দেয়ালের গায়ের গর্ত দিয়ে পেছনের রান্নাঘর থেকে খাবার পাঠানো হয় এপাশে। ডিনার চলাকালীন মেসের ম্যানেজার নীনা লেপারি ওই টেবিল আর দেয়ালের মাঝামাঝি এলাকায় ঘোরাফেরা করতে করতে গোটা হলটার দিকে নজর রাখেন। জিয়ানমারিয়ার টেবিলটা তাঁর ঠিক সোজাসুজি হওয়াতে মাঝেমাঝেই দুজনের চোখাচোখিও হয়ে যায়। মহিলা বিধবা। ত্রিশের কোঠায় বয়স। বেশ লম্বা। চোখদুটি বড় বড় ও শান্ত। শরীরে কিঞ্চিৎ মেদ জমেছে বটে কিন্তু তাতে আলগা একটা সৌন্দর্য এসেছে চেহারায়। শেষ যৌবনের লাবণ্য ও বয়সোচিত গাম্ভীর্য এই দুই মিলে একটা আলাদা আকর্ষণ আছে তাঁর ব্যক্তিত্ত্বে। জিয়ানমারিয়া যখন এসে টেবিলে বসলো তখন তিনি হাতা দিয়ে বাটিতে বাটিতে ধোঁয়া ওঠা স্যুপ ঢালছেন।

টেবিলে বসে সে একবার গোটা ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নিল। সানটিনা আর তার মা বাদে বাকি সব মেম্বারই এসে গিয়েছেন। এই মেসের মেম্বারের সংখ্যা বেশি নয়। এক নববিবাহিত দম্পতি আছেন। তাঁরা কথা কম বলেন, হাসেন বেশি। আছেন এক বৃদ্ধ কেরাণীবাবু। তিনি সকালবিকেল কেবলমাত্র সেদ্ধ মুরগি ছাড়া নাকি অন্য কিছুই খাননি কখনো। মাঝে মাঝে গর্ব করে এ যাবত কত লক্ষ পাখি তাঁর উদরস্থ হয়েছে তার হিসেব দেন। এ ছাড়া আছেন দুই বয়স্থা ইংরেজ মহিলা। তাঁদের পায়ের কাছে একটা ছোট পোষা কুকুর। তার সামনেও একটা প্লেট আছে। আর, সবশেষে বলতে হয় সেনর নেগ্রিনির কথা। বয়স্ক মানুষ। একা থাকেন। সানটিনাদের সঙ্গে তাঁর বেশ ভাবসাব আছে। খেতে খেতে সবাই একে অন্যের সঙ্গে বেশ উঁচু গলায় কথা বলছিলেন। মেসের খাবারের স্বাদ থেকে শুরু করে সেদিনের খবরের কাগজের কেচ্ছা, কিছুই বাদ যাচ্ছেনা সেই আলোচনার থেকে।

সানটিনাদের দেরি দেখে জিয়ানমারিয়ার একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো। আর কোথাও নেমন্তন্নে চলে যায় নি তো! নেগ্রিনিকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে হয়তো, কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েই সেই লজ্জাটা ফের চাগিয়ে উঠলো তার। বেশ কয়েকবারই কিছু বলবার জন্য মুখ খুলেও কোন শব্দ বের হলো না তার। শেষমেষ তিতিবিরক্ত হয়ে সে ঠিক করলো, এক থেকে দশ অবধি গুণবে, আর তার মধ্যে সানটিনারা না এলে নেগ্রিনিকে সে গিয়ে জিজ্ঞাসাটা করেই ফেলবে এবারে।

এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ—-এইবারে একটুক্ষণ থেমে থেকে সে ফের একটু টেনে টেনে গুণতে শুরু করলো, ছয়—-সাত—-আট—আর ঠিক সেই সময় ঝনঝন শব্দ করে দরজাটা খুলে সানটিনা আর তার মা ঘরের ভেতরে ঢুকে এল। সবার দিক তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে মেয়েটা হাঁটছিলো আগে আগে। তার বড়ো বড়ো ঠেলে ওঠা চোখ, পরণে সস্তা রেশমের নীল পোশাকের খসখস, নিচু কপাল, লোভী হাবভাব, পাউডার মাখানো চকের মত সাদা মুখ, চড়া লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট, এই সবকিছুই জিয়ানমারিয়ার চোখে বেজায় আকর্ষণীয় ঠেকছিল সেই মুহূর্তে।

নিজেদের টেবিলে গিয়ে বসে, মায়ের সঙ্গে কথা বলবার ভান করতে থাকলেও তার দৃষ্টি কিন্তু বারবার ঘুরে যাচ্ছিল জিয়ানমারিয়ার দিকেই। আর, সেটা খেয়াল করে ছেলেটার বুকের দুরদুর আর থামে না! বারবার চোখের সামনে ঘুরেফিরে আসে সেই সবুজ পেটিকোট , আর তার ভেতরে—-

খাওয়াদাওয়ার শেষাশেষি পৌঁছে দেখা গেল, দু’তরফের চোখাচোখি তুঙ্গে পৌঁছেছে। মেয়েটা মাঝে মাঝে আবার তার দিকে চোখ ফেলে হাসে আর চোখের কোণের ইংগিতে মাকে দেখায়। ভাবখানা এমন যেন ‘ইচ্ছে তো আছে, কিন্তু কী করি বলো, মা রয়েছে যে সঙ্গে!’

ইতিমধ্যে ডিনারের প্রধান পদগুলো শেষ হয়ে গেছে। বাকি রয়েছে কেবল চিজ আর ফল। এমনসময়, যে দুটো মেয়ে টেবিলে টেবিলে খাবার দেয় তাদের একজন একটা প্লেটে করে বিরাট একদলা হলদেটে চিজ এনে জিয়ানমারিয়ার সামনে রাখলো। নেহাত জিয়ানমারিয়ার চোখে তখন সেই বড়ো বড়ো চোখ আর পাউডারমাখা মুখটা একেবারে জুড়ে বসেছে। নইলে প্লেটটা তার সামনে রাখতে রাখতে মেয়েটার মুখের চাপা হাসি, আর ঘরভরা বাকি লোকজনের হঠাৎ একেবারে চুপ করে যাওয়াটা তার নজর এড়িয়ে যাবার কথা নয়। অন্যমনস্কভাবে শুকোনো চিজের দলাটা থেকে একটা টুকরো কেটে নিয়ে সে মুখে পুড়লো। একটুখানি চিবিয়েই দেখে জিনিসটা আদৌ চিজ নয়, সাবানের ড্যালা। নিজের জিভের ওপরে ভরসা হচ্ছিল না তার। ছুরি দিয়ে হলদের দলাটাকে খুঁটে খুঁটে পরীক্ষা করছে এমন সময় শোনে সানটিনা বলছে, “কি, চিজটা খেতে ভালো?” সঙ্গেসঙ্গে গোটা ঘরটা ফেটে পড়লো হাসিতে। জিয়ানমারিয়ার মুখ তখন লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে সাবানের ফেনা। একবার নিজের প্লেট, আর একবার হাসিভরা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে নিয়ে সে বললো, “হ্যাঁ—ভালোই—মানে—এটা তো সাবানের মতো খেতে—-“

“সাবান—-মানে!!” মেয়েটা অবাক হবার ভান করলো, “ধুৎ , সে কী করে হবে? ওটা তো চিজ।”

এইবার সেনর নেগ্রিনি কথা বললেন, “ না। ওটা সাবানই বটে। কোন রসিকতাকেই বেশি লম্বা করা উচিৎ নয় সানটিনা। আর আপনাকে বলি সেনর বারগিগলি, জিনিসটাকে দ্বিতীয়বার চাখবার চেষ্টা না করাই ভালো। করলে পরে জীবনেও আপনার জিভ থেকে ওই স্বাদটা আর যাবে না।“

জিয়ানমারিয়া ততক্ষণে একটা জল দিয়ে কুলকুচো করছে আর রুমাল দিয়ে মুখের ভেতরটা ঘষছে বারবার। রাগে, অপমানে মাথাটা তার জ্বলে যাচ্ছিলো। এইজন্যেই তবে মেয়েটা বারবার তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছিলো সেই তখন থেকে! সব তাকে ফাঁদে ফেলে বোকা বানাবার কারসাজি!

“দুর্বুদ্ধিটা কার?” ম্যানেজার মহিলার শান্ত গলার শব্দ পেয়ে চোখ তুলে চাইল জিয়ানমারিয়া। এভিজে নামের কাজের মেয়েটার সামনে ভ্রূকুটি করে দাঁড়িয়ে আছেন নীনা লেপারি। ভয় আর হাসি দুটোই চাপতে চাপতে এভিজে জবাব দিল, “মিস সানটিনা আমায় দিতে বললেন যে! বললেন সব দায়িত্ব তাঁর। আমার কী দোষ?”

নীনা চোখ ঘুরিয়ে সানটিনার দিকে চাইতে সে সঙ্গে সঙ্গে বললো, “হ্যাঁ। দোষটা আমারই। আসলে আমরা সবাই মিলে একটা মজা করতে চাইছিলাম। তবে আমার স্থির বিশ্বাস, সেনর বারগিগলি এতে কিছু মনে করেন নি। এক মেস-এ থাকি আমরা সবাই। এ- তো একটা পরিবারের মতো। নিজেদের মধ্যে একটু রঙ্গরসিকতা—-” বলতেবলতেই এমন মিষ্টি করে জিয়ানমারিয়ার দিকে ঘুরে চাইল সে যে সেই এক দৃষ্টিবাণেই অনভিজ্ঞ ছোকরার সব অপমান টপমান গলে জল। ।

“না না, আমি কিছু মনে করি নি,” মুখ থেকে একরাশ সাবানের ফেনা ছিটতে ছিটোতে কবুল করলো সে। তারপর নিচু গলায় যোগ করল, “তবে, সাবানটা খুব বাজে। বিশ্রি স্বাদ।“

“আরে ভাই, সাবান তো সাবানই হবে,” নেগ্রিনি ফুট কাটলেন। চারপাশের হাসিঠাট্টার আওয়াজ ততক্ষণে কমে এসেছে। শ্রীমতি নীনাও ব্যাপারস্যাপার দেখে আর কথা বাড়ালেন না। শুধু এভিজেকে দুচারটে কড়া কথা শুনিয়ে ফিরে গেলেন নিজের কাজে। একটু বাদে সানটিনা তার চেয়ার থেকে এইদিকে ঝুঁকে জিয়ানমারিয়াকে বলে, “ফলের কোর্সটা যদি আমাদের টেবিলে এসে বসে খান তাহলে বুঝব সত্যিই কিছু মনে করেন নি। মা, একটু সরে বসো তো! সেনর বারগিগলি আসছেন আমাদের টেবিলে।”

মুখ থেকে সাবানের স্বাদ তখনও যায় নি তার। জিয়ানমারিয়া অতএব প্রথমে একটু ইতস্তত করে তারপর বাধ্য ছেলের মতো মাথাটি নিচু করে উঠে এসে সানটিনাদের টেবিলে বসল। দেখা গেল ঘরের সকলেই তাতে খুশি হয়েছে। নেগ্রিনি তো খুশিতে ব্রাভো, ব্রাভো করে উঠলেন। বলেন, “এই তো দৃঢ় চরিত্রের লক্ষণ!”

সানটিনার মায়ের বছর পঞ্চাশেক বয়স হবে। শরীরের তুলনায় মাথাটা বেশ বড়। সারা মুখে লাল, সাদা, গোলাপি—হাজারো রঙের ছোপ। সম্ভবত সারা জীবনে যত মেক আপ করেছেন তার অবশিষ্টাংশ চামড়ার নিচে ঢুকে গিয়ে পাকাপোক্ত ছোপ তৈরি করেছে। জিয়ানমারিয়াকে চওড়া একটা হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করে তিনি সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন। সে খেয়াল করলো, দাঁতগুলোতে বাদামি ছোপ আর বেশ কয়েকটা দাঁত সোনা বাঁধানো।

“দুষ্টু মেয়ে আপনার সঙ্গে একটু রসিকতা করছিলো,” চশমার ফাঁক দিয়ে সানটিনার দিকে কটমট করে তাকিয়ে নিয়ে তিনি বললেন, “এ মেয়েকে শাসণ করা আমার সাধ্যের বাইরে। সবসময় দুষ্টুবুদ্ধি কিলবিল করছে মাথায়। এবারটার মতো মাপ করে দিন সেনর বারগিগলি। যাক গে, রোমে আপনি কী করছেন ? পড়াশোনা?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি আইন পড়ছি। এবারেই ফার্স্ট ইয়ার,” ফলের টুকরি থেকে একটা ট্যাঞ্জেরিন তুলে নিয়ে ছাল ছাড়াতে ছাড়াতে জিয়ানমারিয়া বললো।

“উকিল হবেন?”

“আজ্ঞে না। ডিপ্লোম্যাট হবার ইচ্ছে আছে।“

“আহা! ডিপ্লম্যাসি! দারুণ পেশা। আমার এক তুতো ভাই একসময় ডিপ্লম্যাট ছিলো। আমাদের একই পদবি—রিনাল্ডি। চেনেন নাকি?”

“আজ্ঞে না। চিনি না।“

“আচ্ছা মা,” সানটিনা হঠাৎ বলে উঠল,” গতবার ওস্টিয়াতে সেই যে সেইকমবয়েসি ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো, মনে আছে? তিনিও কিন্তু ডিপ্লোম্যাট। কী যেন নাম বলেছিলো? কলিওনি?”

“পিয়ের লিওনি,” মেয়ের ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে মা এবারে ফের জিয়ানমারিয়ার দিকে মনোযোগ দিলেন, “চেনেন নাকি? কমবয়েসি ছোকরা। মুখে ভ্যানডাইকমার্কা দাড়ি রয়েছে।”

জিয়ানমারিয়াকে এবারেও স্বীকার করতে হলো যে এই কূটনীতিকটিকেও চেনে না। তবে না চিনলেও তার কোন সমস্যা ছিলো না সে মুহূর্তে, কারণ কথাবার্তার সংকোচ তার ততক্ষণে একেবারেই ঘুচে গেছে। শ্রীমতীও রিনাল্ডি ক্রমাগত এটা ওটা বকবক করেই চলেছেন। জানা গেছে মাত্রই মাসদুয়েক হল তাঁরা এই মেসে এসে উঠেছেন। এখানে ঘরগুলো নাকি বেজায় অন্ধকার, বিছানাগুলো তাঁদের কাছে ভয়াবহ, তবে হ্যাঁ, খাবারদাবার ভালো।

সানটিনার দিকে চোখ রেখে কথার স্রোতে কান ভাসিয়ে জিয়ানমারিয়া হাতের ফলটার দিকে মন দেবার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তাতে ফল বিশেষ হচ্ছিলো না। কারণ, ওপরে মাথা নিচু করে আখরোটের খোলা ছাড়াতে ব্যস্ত থাকলে কী হবে, টেবিলের নিচে নিজের পা দিয়ে ক্রমাগত তার পায়ের ওপর খুঁচিয়ে যাচ্ছিলো সানটিনা। একেকবার পায়ের ছোঁয়া লাগে আর জিয়ানমারিয়ার হৃৎপিণ্ডটা যেন ডানা ঝটপট করে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যেন মেসবাড়ির ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করা খাটে ঠাণ্ডা চাদরের নিচে তাকে চার হাতপায়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে সানটিনা। জিয়ানমারিয়া বুঝতে পারছিলো, এইবারে তার জীবনে প্রথম প্রেম আসছে। খালি পেটে মদ খেলে যেমনটা লাগে অনেকটা সেইরকম ঠেকছিলো তার। বেশ একটা নেশা নেশা ভাব!

তা সেই ভাবকুয়াশার মধ্যে থেকে হঠাৎ যেন কার গলা ভেসে এল, “আমার নাম নেগ্রিনি। মহাশয়ের পরিচয়?”

জিয়ানমারিয়া চোখ নামিয়ে দেখল, একটা কালো রোমশ হাত তার দিকে বাড়িয়ে ধরা রয়েছে।

“আমার নাম বারগিগলি,” উঠে দাঁড়িয়ে হাত মেলাতে মেলাতে জবাব দিল সে। লোকটাকে দেখতে বিশেষ সুবিধের নয়। লিভারের রোগির মতন হলদেটে চামড়া। লাল লাল চোখ। মাথায় টাক। কানদুটো একেবারে ছোট ছোট, গোল, আর দেখতে একেবারে মানুষের নাভির মত। তুলনাটা মনে আসতেই বেজায় একটা অস্বস্তি শুরু হল জিয়ানমারিয়ার মধ্যে।

জুত করে একটা চেয়ারে বসে নেগ্রিনি একটা সোনার সিগারেট কেস বের করে খুলে ধরলেন। সবার সিগারেট জ্বালানো হয়ে গেলে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে শ্রীমতী রিনাল্ডি নেগ্রিনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিস্টার বারগিগলি ডিপ্লম্যাট হবার জন্য রোমে এসেছেন।”

ভদ্রলোক শুনে খুব একটা উচ্ছসিত হলেন না। বলেন, “অথবা, বলুন ডিপ্লোম্যাট হবার স্বপ্ন দেখছেন। হতে পারবেন কিনা সে পরের কথা।”

“অর্থাৎ?” একটু রেগে উঠেই বললো জিয়ানমারিয়া।

“না, মানে রোমের ফুটপাথে যে কোন একটা গাছ ধরে ঝাঁকালে দশবারোটা হবু ডিপ্লোম্যাট ঝরে পড়বে কিনা। স্বপ্ন তো সবাই দেখে, কিন্তু, বলুন দেখি, কতজন শেষমেষ ডিপ্লোম্যাট হতে পারবে? বেশির ভাগই তো সরকারী দফতরের কেরাণী হয়েই মোক্ষলাভ করে। তাই বলছিলাম আর কি!”

জিয়ানমারিয়া একটু চুপাচাপ থেকে ঠাণ্ডা গলায় বললো, “কেরাণী হবার জন্য আমি রোমে আসিনি। ডিপ্লোম্যাট আমি হবোই।”

“আহা রে! আপনার সৌভাগ্য কামনা করছি। তবে বলি কি, ডিপ্লোম্যাট বনবার জন্য প্রধান যে যোগ্যতাটা লাগে সেটা আপনার আছে কি?”

“যোগ্যতা—মানে?”

“মানে এই এটা—“তর্জনি আর বুড়ো আঙুল ঘষে টাকার মুদ্রা করে দেখালেন নেগ্রিনি, “লিরা, লিরা, বুঝলে ছোকরা, বেশ মোটা রকম রেস্ত পকেটে না থাকলে ওসব স্বপ্ন না দেখাই ভালো।”

মুখ চোখ লাল করে জিয়ানমারিয়া জবাব দিল, “সে আমাদের যথেষ্ট আছে। ফ্লোরেন্সের দিকে জমিদারী আছে আমাদের।”

“আরে বাঃ বাঃ,” বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন নেগ্রিনি, “তাহলে তো কাউন্ট বারগিগলি, আমার আর কোন কিচ্ছু বলবার নেই। সব যুক্তির সেরা যুক্তি দিয়ে দিয়েছ যে! টাকাপয়সা যখন আছে—”

শ্রীমতি রিনাল্ডি এইবারে শুকনো গলায় নেগ্রিনির উদ্দেশ্যে বললেন, “সে তো আছেই। তুমি না জানলেও রাস্তার ভিখিরিটা অবধি জানে যে বারগিগলিরা হলো আরজোর সবচেয়ে ধনী পরিবার। এখন ওঠো সব। ডাইনিং হল যে ফাঁকা হয়ে গেল।”

আগে আগে নেগ্রিনি আর মিসেস রিনাল্ডি নিচুস্বরে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন। পেছন পেছন খানিকটা দূরত্ব রেখে জিয়ানমারিয়া আর সানটিনা। হঠাৎ তার হাত ধরে টেনে ফিসফিস করে সানটিনা বলে, “আমার ঘরে একবার চলুন, আপনাকে একটা জিনিস দেবো।”

জিয়ানমারিয়ার মনের অবস্থা তখন সঙ্গীন। করিডোর দিয়ে পা টিপে টিপে সানটিনার ঘরের সামনে এসে পৌঁছোতে মেয়েটা পেছন ফিরে একবার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে নিঃশব্দে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল। তারপর জিয়ানমারিয়াকে আগে আগে ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে নিজে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

“মা জানতে পারলে কেলেংকারি হবে আজ,” আলোর সুইচ টিপতে টিপতে বলছিলো সানটিনা। আলো জ্বলতেই জিয়ানমারিয়ার চোখে পড়লো, পার্টিশানের ওপরে সেই সবুজ পেটিকোটটা ঝুলছে। টেবিলের ওপরে একটা রগরগে মলাটের ডিটেকটিভ বই পড়ে ছিল। সেটা তুলে নিয়ে দেখতে দেখতেই পার্টিশানের পেছনে একবার ঢুকে গিয়ে প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বেরিয়ে এল সানটিনা। হাতে একটা ফুলের ডাঁটি। সেটা জিয়ানমারিয়ার হাতে দিয়ে বলে, “একটা ভীষণ বোরিং ছেলে কদিন ধরেই ঘুরঘুর করছে। সে একগাদা এই ফুল দিয়ে গেল। ছেলেটাকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। সাবান নিয়ে আজ যা বিচ্ছিরি ব্যাপার করেছি আমি আপনার সাথে তার জন্য এই ফুলটা দিয়ে ক্ষমা চাইলাম। আসুন, কোটের বাটনহোলে পরিয়ে দিই।” বলতে বলতে জিয়ানমারিয়ার বুকের কাছে এসে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে ফুলটা সে তার কোটে আটকে দিল। পাউডার আর সেন্টের সঙ্গে শরীরের গন্ধ মিশে একটা তীব্র সুবাস ভেসে এল জিয়ানমারিয়ার নাকে। গলা দিয়ে একটা অব্যক্ত শব্দ বের করে হাত দিয়ে মেয়েটার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে আনলো সে। মেয়েটাও জিয়ানমারিয়ার গলা জড়িয়ে ধরলো দু হাত দিয়ে। তারপর অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল তারা।

হঠাৎ তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মেয়েটা বলে, “হে ভগবান, সর্বনাশ হল যে! মা আসছে। যদি টের পায়?” বলতে বলতেই দরজা খুলে জিয়ানমারিয়াকে একরকম ঠেলেঠুলেই বের করে দিল সানটিনা। বলে, “তাড়াতাড়ি পালাও এবারে—”

জিয়ানমারিয়া এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, “কই, কেউ নেই তো বাইরে! চলো চলো তোমারে ঘরে গিয়ে—এক মিনিটের জন্য—”

এই নিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে তর্কবিতর্ক চললো কিছুক্ষণ। তারপর মেয়েটা বলল, “শোন, এখন আর কিছু করা যাবে না। মার সঙ্গে এক্ষুণি একটা বল-এ যাবো আমি। ফেরার পথে মাঝরাতে তোমার ঘরে আসবোখন একটুক্ষণের জন্য। দরজাটা খুলে রেখো, যাতে চুপচাপ ঘরে ঢুকে পড়তে পারি এসে। ঠিক তো?”

জিয়ানমারিয়া উত্তেজনায় বোবা হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ফের কথা ফুটল যখন, সানটিনা ততক্ষণে চলে গেছে।

মাত্র কয়েকঘন্টার অপেক্ষা যে কতো লম্বা হতে পারে সেটা জিয়ানমারিয়া সেই সন্ধ্যেয় প্রথম টের পেলো। বিছানায় খানিক এপাশ ওপাশ করে অবশেষে উঠে পড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। এ করিডোর ও করিডোর ধরে উদ্দেশ্যহীন এলোমেলো হেঁটে যদি খানিকক্ষণ সময় কাটে।

করিডোর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। আলো কম। কোট র‍্যাকগুলো ফাঁকা। খানিক হাঁটাহাঁটি করে ফিরে আসবার জন্য পা বাড়িয়েছে, তখন তার চোখে পড়লো, ডানহাতি একটা ঘরের ভেজানো দরজার ওপরে লেখা রয়েছে “অফিস”।

কোটের পকেটে হাত দিয়ে জিয়ানমারিয়া টের পেলো সেদিনই পাওয়া মেসের বিলটা সেখানে রাখা। “ভালো। ভাড়াটা মিটিয়ে দেয়া যাক বরং,” এই ভেবে বিলটা বের করে নিয়ে সে দরজায় টোকা দিল।

ভেতর থেকে একটা মিঠে গলায় জবাব এলো, “আসুন।” জিয়ানমারিয়া দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে এল। ঢালু ছাদের ছোট ঘর। সুন্দর করে সাজানো। জানালায় উজ্জ্বল পর্দা। সোফার গায়ে গোলাপ ছাপ নকশা। তার ওপরে অনেকগুলো রংবেরং-এর তাকিয়া। আগুনজ্বলা ফায়ারপ্লেস ঘিরে আরামকেদারা সাজানো আছে কয়েকটা। ঘরের মালকিন আগুনের পাশে দরজার দিকে পিঠ করে একটা টেবিলের সামনে বসে ছিলেন। পরণে কালো পোশাক। হাতে একটা বই। জিয়ানমারিয়া লজ্জা লজ্জা গলায় বললো, “ভাড়ার টাকাটা দিতে এসেছিলাম।” ভদ্রমহিলা ঘুরে বসলেন। নাকটা শুধু একটু বড়ো। তা বাদে ভারি সুন্দর মুখখানা। “এত তাড়ার কী আছে?” মৃদু হেসে তার হাত থেকে কাগজটা নিতে নিতে নীনা বললেন, “সবে তো এক সপ্তাহ হলো এসেছেন—আরে দাঁড়িয়ে কেন? বসুন, বসুন—”

একটা নিচু ডিভানে এসে বসলো জিয়ানমারিয়া। ঢাকনা আর কুশনগুলো সরিয়ে নিলে এটাই নিশ্চয় মহিলার রাতের বিছানার কাজ করে। সেখানে বসে, আর ঘন্টা দুতিন বাদেই এই ভদ্রমহিলা এই ঘরে ঠিক কী অবস্থায় থাকবেন তার একটা ছবি তার মনে বারবার ভেসে উঠছিলো। খোলা বিরাট শরীর—বিছানায় উঠতে যাচ্ছে সবে—

বিলটা দেখে নিয়ে তাতে প্রাপ্তিস্বীকারের ছাপ্পা মারছিলেন নীনা। জিয়ানমারিয়া নিজের অজান্তেই তাঁকে দেখতে দেখতে ওয়ালেট খুলে পাঁচশো লিরা বের করে এনে তাঁর হাতে দিল। মহিলা টাকাটা একটু পরীক্ষা করে নিয়ে ঢুকিয়ে রেখে কয়েকটা মুদ্রা ফেরৎ দিলেন তার হাতে। হাবভাবে মনে হচ্ছিল, জিয়ানমারিয়া আরো একটু বসে গেলে খুশিই হবেন বোধ হয়। অতএব জিয়ানমারিয়া বসেই রইলো। মহিলার কথাগুলো তার এ কান দিয়ে ঢুকে ও কান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। চোখের সামনে ভাসছে শুধু সানটিনার মুখ। ভদ্রমহিলা তখন জিজ্ঞাসা করছেন, “আপনি আমাদের সঙ্গে আরো কিছুদিন আছেন তো মিঃ বারগিগলি?” ঠিক সেই সময়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সানটিনার দুটো ঠোঁট। অমনি সারা গায়ে একটা কাঁপুনি উঠে এল তার। কাঁপুনিটা ভদ্রমহিলার চোখ এড়ায় নি। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আগুনটাকে নেড়েচেড়ে কয়েকটুকরো কাঠ তাতে ফেলে দিলেন তিনি। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, “আপনার পরিবার কোথায় থাকেন?”

“বাবা মারা গিয়েছেন। মা আর ভাইয়েরা আরজোতে থাকেন।”

“আহা বাবা নেই। আমার কিন্তু তোমার মায়ের জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে। বেচারার ওপর এতগুলো ছেলেমেয়ের দায়িত্ব পড়লো এসে! তুমি কি সবার বড়ো?”

“হ্যাঁ।”

তিনি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমাকে বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে তোমার মায়ের যে কতো কষ্ট হচ্ছে সেটা আমি বুঝি।”

জিয়ানমারিয়ার চোখের সামনে তখন সেই সানটিনাসহ সবুজ পেটিকোটটা ভেসে উঠেছে। ফের তার শরীরটা একবার কেঁপে উঠলো। ভদ্রমহিলা সেটা নজর করে উঠে এসে তার কপালে হাত দিতে দিতে বললেন, “গায়ে হাত দিলাম বলে কিছু মনে করো না। কিন্তু, গা তো তোমার বেশ গরম দেখছি!”

“আমার—গা গরম?” বলতে বলতেই জিয়ানমারিয়ার খেয়াল হল, কথাটা মিথ্যে নয়। কারণ ভদ্রমহিলার হাতটা তার কপালে বরফের মত ঠাণ্ডা ঠেকছিলো। তিনি ততক্ষণে ড্রয়ার খুলে একটা থার্মোমিটার বের করে ফেলেছেন। সেটার দিকে চোখ যেতেই জিয়ানমারিয়া ছটফটিয়ে উঠে বলে, “না না জ্বর টর কিছু—মানে শরীরটা একটু দুর্বল ঠেকছে এই যা—ওসব থার্মোমিটার টিটার আর—আ—আমি বরং শুয়ে পড়ি গিয়ে। ভালো করে একটা ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’খন।”

থার্মোমিটার হাতে ভদ্রমহিলা তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটু অপ্রসন্ন গলায় বললেন, “ঠিক আছে। তবে, তুমি চাইলে আমি তোমায় ঘর অবধি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।”

“না না, ধন্যবাদ। তার দরকার হবে না। আমি নিজেই চলে যাবো,” বলতে বলতে একছুটে বাইরে চলে এসে জিয়ানমারিয়া জোর পায়ে হাঁটা দিল। পেছন থেকে মহিলার গলার স্বর ভেসে আসছিলো, “শুয়ে পড়ো গিয়ে। একটু বাদে আমি এক গেলাস গরম লেমোনেড দিয়ে আসব। খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নিজের ঘরে ফিরে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জিয়ানমারিয়া। ভদ্রমহিলা বেজায় স্নেহময়ী। পারলে তাকে বিছানায় শুইয়ে জামাকাপড় ছাড়িয়ে একেবারে ঘুমটাও পাড়িয়ে দিয়ে যাবার প্রস্তাব দিতেন আজ। ঘরে শুয়ে শুয়ে এইভাবে সময় কাটানো একটা সমস্যা বটে, কিন্তু ওরকম স্নেহের গুঁতো সহ্য করবার চেয়ে এ-ই ভালো। ঘড়ি দেখলো একবার জিয়ানমারিয়া। মাঝারাতের এখনো দু ঘন্টা বাকি। উঠে একটা আইনের বই খুলে বসলো সে। কিন্তু তাতে কি আর মন বসে! বইয়ের পাতায় পাতায় অক্ষরের বদলে কেবল সানটিনার মুখটা ভেসে ওঠে যে!

খানিকক্ষণ এহেন পড়াশোনা চলবার পর দরজায় মৃদু একটা শব্দ পাওয়া গেল। নিশ্চয় নীনা ম্যাডাম লেমোনেড নিয়ে আসছেন। সেবাটা পাবার কথা ভেবে একটু আনন্দই হচ্ছিলো জিয়ানমারিয়ার। দৃশ্যটাকে আরও একটু করুণ করে তোলবার জন্য চুলগুলো এলোমেলো করে নিয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে নিলো সে।

একটু বাদেই দুহাতে তার চোখ টিপে ধরে চেনা খসখসে গলায় আওয়াজ এলো, “টুকি! কে বলো দেখি!”

“সানটিনা! এত তাড়াতাড়ি! কেমন করে এলে?” জিয়ানমারিয়ার হৃৎপিণ্ড দপদপ করতে শুরু করলো।

“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, বলো? কী করেছি জানো? মাকে বললাম, মাথা ঘুরছে। বাড়ি যাবো। তা, মায়ের থেকে ছাড়ান পেলাম তো সেই ফুল দেয়া ছোকরা এসে সঙ্গ নিলো। বলে, তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি। তারপর এখানে এসে খালি ঠেলেঠুলে আমার ঘরের ভেতর ঢুকতে চায়। একেবারে জন্তু একটা। উঃ। কী কষ্টে যে ছাড়ান পেয়েছি—”

এইসব কথাবার্তা চলতে-চলতেই জিয়ানমারিয়া তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। জড়িয়ে ধরে প্রথমে ঠোঁটে চুমু, তারপর ঘাড়ের পাশে চুমু, তারপর কাঁধে চুমু খেতে খেতে স্ট্র্যাপদুটো নিচু করতে যেতেই মেয়েটা শরীর আঁকিয়েবাঁকিয়ে সরে গিয়ে বলে, “না না, তুমিও সবার মতন হয়ে যেও না। তুমি তো আলাদা—আমি টের পাই—”

“আরে—হলোটা কী? আপত্তি কীসের?”

“না না, আমায় বলতে বল না। আমি পারবো না—”

“পারবে না? কেন পারবে না?”

“সে শুনলে তুমি আর কোনদিন আমার দিকে ফিরেও চাইবে না গো।”

এইবার জিয়ানমারিয়ার মাথা গরম হয়ে গেল। কাঁহাতক আর সহ্য হয় মানুষের! মেয়েটার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, “চোপ! ফিরে চাইব না কী করব সেসব আমি বুঝে নেবো। এখন বলো—”

হঠাৎ মেয়েটা শান্ত হয়ে গেল একেবারে। বড়োবড়ো চোখদুটো মেলে জিয়ানমারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “শুনলে তুমি আমায় ঘেন্না করবে।”

“উঁহু। ঘেন্নাটেন্না কিচ্ছু করবো না। এখন বলো—”

“জানি। তবু ভয় লাগে—”

দুজনে পাশাপাশি সোফায় বসে ছিলো। জিয়ানমারিয়ার পা সানটিনার পোশাকের নিচে ঢাকা। সানটিনার পা দুটো মেঝেয় ছোড়ানো আইনের কেতাব আর কাগজপত্রের ওপরে। জিয়ানমারিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে ফের এক রাউন্ড চুমু শুরু করবার জন্য ঠোঁট এগোচ্ছে এমন সময়য় দরজায় ফের টক টক করে দুটো টোকার শব্দ হলো। সানটিনা ওমনি লাফ মেরে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলে, “নিশ্চয় মা। সন্দেহ করে চলে এসেছে। আজ আমার কপালে–”

জিয়ানমারিয়া মাথা নেড়ে বললো, “ওটা তোমার মা নয়। নীনা ম্যাডাম এসেছেন।”

“ওই বুড়ি আবার কী চায় এখানে?”

কাবার্ডের দরজা খুলে ধরে জিয়ানমারিয়া বললো, “সেসব পরে বলছি। আগে এখানে ঢুকে পড়ো।”

সানটিনা বাধা দিয়ে ঝগড়া করবার জন্য তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু জিয়ানমারিয়ার তখন সেসব দেখবার অবসর নেই। হাতের ডানাদুটো ধরে তাকে একরকম ঝুলিয়ে নিয়ে কাবার্ডে ভরে চাবি লাগিয়ে ফিরে এসে ঘরের দরজা খুললো সে। হ্যাঁ, নীনাই বটে। হাতে একটা প্লেটের ওপর এক গ্লাস লেমোনেড বসানো।

“লেমোনেডটা নিয়ে এলাম। এছাড়া আর কিছু দরকার থাকলে বলো,” কথা বলতে বলতেই ভদ্রমহিলার চোখদুটো গোটা ঘরটাকে তন্ন তন্ন করে দেখছিলো। খানিক পরে তাঁর দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো সোফার ওপরে। জিয়ানমারিয়া দেখে, সেখানে সানটিনার গোলাপি ক্লোকটা রাখা রয়েছে।

“আর কিছু—দরকার—মানে—” জিয়ানমারিয়া তোতলাচ্ছিলো।

“কম্বল দেবো আর একটা?” বলতে বলতে নিচু হয়ে বেডকভারের তলাটায় একবার হাত বুলিয়ে নিলেন তিনি।

“ না না। কম্বল তো অনেকগুলো আছে!”

“ঠিক আছে। লেমোনেডটা খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো তা হলে,” বলতে বলতেই, লজ্জায় কাঁচুমাচু জিয়ানমারিয়ার পাশ দিয়ে, যেন কিছুই দেখেন নি এমন ভাব করে বের হয়ে গেলেন নীনা।

দরজাটা বন্ধ হতেই কাবার্ডের মধ্যে থেকে দুপদাপ শব্দ শুরু হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে সেটা খুলতেই সানটিনা হুড়মুড় করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপরে। এই সুযোগে তাকে নিয়ে একেবারে বিছানায় ফেলবার ইচ্ছে ছিলো জিয়ানমারিয়ার, কিন্তু সানটিনা তখন ক্ষেপে লাল হয়ে আছে, “ওই বুড়ি তোমার ঘরে মাঝরাত্তিরে কেন এলো?”

উত্তরে জিয়ানমারিয়া লেমোনেডের গ্লাসটা দেখিয়ে দিলো। সানটিনার গলায় হিংসের আভাস পেয়ে তার বেশ মজা লাগছিলো।

“হুঁ। ওসব বাহানা আমি কিছু বুঝি না? ও দেখতে এসেছিলো তোমার ঘরে আর কোন লোক আছে কি না,” বলতে বলতে বিছানার এক কোণে গিয়ে বসে সে ফের বলে, “ভাবো তো, এত রাতে একটা লোকের ঘরে একলা একটা মেয়ে। তোমাকে চেনা দূরস্থান তোমার গোটা নামটাও তো আমি এখনো জানিনা!”

অতএব জিয়ানমারিয়া তার নাম বললো, তারপর আবার তাকে গোটাকয় চুমু খেল। তারপর কাঁধের স্ট্র্যাপটা নামাতে যেতেই আবার সেই এক কাণ্ড। সানটিনা এবারে বিছানায় একেবারে উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদে আর বলে, “এ অসম্ভব। তুমি জানো আমি কে?”

জিয়ানমারিয়া বেশ বিরক্ত হয়ে বললো, “জানি জানি। তুমি সানটিনা রিনাল্ডি। তোমার মায়ের সঙ্গে—”

“ও আমার মা নয়। ওর নাম আইদা কোকানারি। ও আর নেগ্রিনি মিলে আমায় দিয়ে পুরুষ ভুলিয়ে টাকা রোজগার করে।”

“পুরুষ ভুলিয়ে—মানে—”

“মানে তোমার মত কোন হাঁদাগঙ্গারাম বাচ্চা ছেলে বা কোন বিপত্নীক লোকের নাগাল পেলে আমি গিয়ে তার সাথে প্রেম করি আর নানা ছুতোয় টাকা হাতাই। বেশ খানিক দোয়ানো হয়ে গেলে পরে আস্তানা বদলে একেবারে উধাও হয়ে অন্য কোন শহরে গিয়ে উঠি ফের। এইবারে তোমায় ফাঁদে ফেলা হয়েছে। কিন্তু—আমি-আমি রাজি নই। তুমি আলাদা—তুমি ভালো লোক। তাছাড়া আমিও এই ভালোবাসার খেলা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ওদের আমি ঘেন্না করি—ঘেন্না করি–”

শরীরটা থরথর করে বারবার কেঁপে উঠছিলো সানটিনার। খানিক বাদে মুখ তুলে বলে, “কী, খুব ঘেন্না লাগছে, তাই না? হে ভগবান–”

ঘৃণা নয়, নিছক শারীরিক টানও নয়, একটা নতুনতর ও অনেক বেশি শক্তিশালী আবেগকে এই প্রথম অনুভব করছিলো জিয়ানমারিয়া। করুণা! বেচারা সানটিনা। কোন গরীব ঘরের মেয়ে কে জানে! কোকানারি আর নেগ্রিনির খপ্পরে পড়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে—

খানিক বাদে নিচু গলায় তার মুখ দিয়ে শুধু বের হলো, “না না ঘেন্না করবো কেন?” বলতে বলতে তার ঠোঁটদুটো নেমে এল মেয়েটার গালের পাউডারের ওপর, “শয়তানদুটোর হাত থেকে তোমাকে বাঁচাতে হবে। কী করতে হবে শুধু সেটা বলে দাও।”

“তো—তোমায় আমি বিশ্বাস করতে পারি তো? আমার নিজের ভাইয়ের মতো—”

“উঃ, পারো, পারো। এবার বলো— ”

সানটিনার দুচোখে জল টলটল করছিলো। বলে, “প্রিয়তম, আমি যা বলবো, তুমি তাই করবে? তাহলে–”

এইসময় মেসবাড়ির পাশের গির্জায় ঘন্টাটা বেজে উঠলো। অন্ধকার ঘরের মলিন বিছানায় মুখোমুখি বসে সেই কর্কশ শব্দ শুনলো ছেলেমেয়েদুজন। আর তারপরই লাফ দিয়ে উঠে পড়লো সানটিনা।

“চলে যাচ্ছো? কিন্তু বললে না তো কী করতে হবে আমায়—“ গোলাপি ক্লোকটা তার কাঁধে জড়িয়ে দিতে দিতে ছেলেটি বললো।

“কাল বলবো। আজ কোকানারির আসবার সময় হয়ে গেছে—” বলতে বলতে জিয়ানমারিয়ার সন্ধানী হাতদুটোকে ঠেলে সরিয়ে দিলো সে। সেটাই স্বাভাবিক। একটু আগে ভাই বলে ডেকেছে যে! জিয়ানমারিয়াও তার চুমুটাকে একটু উঁচুতে তুলে ঠোঁটের বদলে সানটিনার কপালে নিয়ে বসালো।

সানটিনা চলে যাবার পর খানিক চুপচাপ বসে থেকে জিয়ানমারিয়া এসে শুয়ে পড়লো। মাথার মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো তার। খানিক বাদে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখলো , সানটিনার ঘরের সামনে সে আর নীনা দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করে থাকতে বলে সাবধানে তালা খুলে তিনি ঘরে ঢুকলেন। ঘরের ভেতরটা প্লাস্টিকের টবে ভর্তি। তাদের কয়েকটাতে মাটি বোঝাই করা আর বাকিগুলোতে উজ্জ্বল ফুল ফুটেছে। বাইরে আকাশে মেঘ। তাতে বিদ্যুতের আনাগোণা। ঘরের ভেতরের আলোআঁধারীর মধ্যে খনিকটা জায়গা উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সেইখানটাতে দুটো অন্ধকার মূর্তি একটা আলোকিত বিছানাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, আলোকিত বিছানাটিতে শুয়ে আছে সানটিনা। দাঁড়িয়ে থাকা লোকদুটো নেগ্রিনি আর কোকানারি। কোকানারি বাইরে যাবার পোশাক পরে আছেন। নেগ্রিনির গায়ে একটা মলিন শার্ট আর ফুলকাটা নাইটগাউন। দুজনে মিলে সানটিনাকে বিক্রি করার ব্যাপারে আলোচনায় ব্যস্ত। সানটিনা হাসি হাসি মুখে তাঁদের আলোচনা শুনছে। জিয়ানয়ারিয়ার ইচ্ছে করছিলো দালালদুটোকে তাড়িয়ে মেয়েটাকে বাঁচায়। কিন্তু একলা সে দুজনের সঙ্গে লড়বে কী করে? সাহায্যের জন্য নীনার দিকে ঘুরে সে দেখে তিনি তার পাশে নেই। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল পেতে তাতে থরে থরে টাকা গুণে গুণে সাজিয়ে রাখছেন। জিয়ানমারিয়ার ডাকে কোন সাড়াই দিলেন না নীনা। এমন সময় এক ক্ষয়াটে চেহারার বুড়ো কেরাণী ঘরের মধ্যে ঢুকে এলো। জিয়ানমারিয়া বুঝতে পারলো, এর কাছেই বিক্রি করা হবে সানটিনাকে। নেগ্রিনি আর কোকানারি চাদর তুলে তুলে সানটিনার পা দেখাতে শুরু করলো বুড়ো খদ্দেরকে। জিয়ানমারিয়া এইবারে ছুটে গিয়ে সানটিনাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরল। সানটিনাও জড়িয়ে ধরেছে তাকে। গাঢ় আলিঙ্গনের ফাঁসে জিয়ানমারিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। প্রাণপণে শ্বাস নেবার চেষ্টা করতে করতে একসময় হাঁসফাঁস করে জেগে উঠে দেখে ঘুমের মধ্যে নিজের বালিশটাকে জড়িয়ে ধরে আছে সে। হঠাৎ তার তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখের সামনে বালিশের গায়ে ফুটে উঠলো সানটিনার মুখ। উন্মাদের মত সে চুমু খেতে শুরু করলো বালিশের গায়ে। লালায় ভিজে উঠল বালিশ। দাঁতের আঘাতে ওয়ার ছিঁড়েখুঁড়ে গেল। অবশেষে ঘামে ভেজা শরীরে উঠে বসে আলো জ্বালালো সে। ঘড়িতে দেখাচ্ছিল রাত তিনটে। তেষ্টা পাচ্ছিলো। টেবিলের ওপর থেকে লেমোনেডের গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে তারপর খালি পায়ে রাতপোশাক পরেই ঘর ছেড়ে করিডোরে বের হয়ে এলো সে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে একের পর এক নির্জন করিডোর পেরিয়ে সানটিনার সেই সবুজ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এক যুক্তিবুদ্ধিহীন আবেগে তার কাচের গায়ে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে সে প্রতিজ্ঞা করলো, “কাল আমি তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করবোই। যে কোন মূল্যে।“

********

পরের দিনটা ছিল রবিবার। ঠাণ্ডা, মেঘলা একটা দিন। সকালে উঠে প্রি-মিলিটারি ট্রেনিং-এ যেতে হয়েছিল জিয়ানমারিয়াকে। সারা সকালটা জুড়ে ড্রিল আর রাইফেলের নিশানাবাজি সেরে ক্লান্ত হয়ে দুপুরবেলা মেসবাড়িতে ফিরে সটান খাবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো সে। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। শুধু তার খাবারটা টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখা। একলা একলা খাওয়া সেরে ফলের বাস্কেট থেকে একটা আখরোট নিয়ে জাঁতি দিয়ে কাটছে এমন সময় নীনা এলেন। পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “রাতে ঘুম ভালো হয়েছিলো?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। ধন্যবাদ।”

মহিলা শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। মুখে কিছু না বললেও তাঁর চোখ যেন বলছিলো, তুমি একটা ছোট্ট ছেলে মাত্র। আমি তোমায় স্নেহ করি। আমি দেখবো যাতে আমার বাড়িতে তুমি নিজের বাড়ির ছোঁয়া পাও। খানিকক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর একটা মুখবন্ধ খাম তার হাতে দিয়ে বললেন, “মিস রিনাল্ডি সকালবেলা বেরিয়ে যাবার আগে এই চিঠিটা তোমার জন্য রেখে গেছেন।” চিঠিটা রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন নীনা। তাড়াতাড়ি খামটা খুলে জিয়ানমারিয়া দেখে নীনা লিখেছে, “রোমের বাইরে যেতে হচ্ছে হঠাৎ করে। তবে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব। লুঁ গোতেভের-এর কাছে ইলেক্ট্রা কাফে-র রেড রুম-এ বিকেল পাঁচটায় আমার জন্য অপেক্ষা করবে।”

চিঠি পড়া শেষ করে জিয়ানমারিয়া প্রথমেই ফাঁকা ডাইনিং রুমের মধ্যে ধেই ধেই করে খানিক নেচে নিলো। তারপর ঘরে পৌঁছে ঘড়িতে চারটের সময় অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তবে ওই দেওয়াই সার। ঘুম ভেঙে গেল তার সাড়ে তিনটেরও আগে। জেগে উঠেই খেয়াল হল, আর একটু পরেই সানটিনার সঙ্গে দেখা হবে! ঊঃ, কি আনন্দ! তাড়াতাড়ি স্নান সেরে চুলে ক্রিম মেখে, ব্রণগুলোকে ফের একবার দেখেটেখে নিয়ে খুশি খুশি মেজাজে মেস ছেড়ে রওনা হল সে। শীতের সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে ততক্ষণে। রাস্তার দুপাশে অতিকায় সব মোমবাতির মত দাঁড়ানো পাতাহীন গাছগুলোর ডালপালার ফাঁক দিয়ে ধেয়ে যাওয়া হিমেল বাতাসে মাঝেমাঝেই টুপি উড়িয়ে নিচ্ছিল পথচারীদের। সেইসব দেখতে দেখতে জিয়ানমারিয়া এসে পৌঁছে গেল ইলেক্ট্রা কাফের দরজায়।

রেড রুমটা কাফের একেবারে শেষ প্রান্তে। এ ঘরে খদ্দের বিশেষ কেউ নেই। মিনিট দশেক সেখানে অপেক্ষা করবার পর সানটিনা এল। পরণে উজ্জ্বল রং-এর একটা ওভারকোট। মাথায় ছোট্ট একটা টুপি পেছনে হেলিয়ে বসানো। মেরুদণ্ড ঝুঁকিয়ে হাঁটছে। চোখেমুখে তীব্র হতাশার ছাপ। এসেই কোন কথা না বলে চুপাচাপ জিয়ানমারিয়ার টেবিলে বসে সিগারেট ধরালো সে। তারপর ওয়েটারকে ডেকে একটা ব্র্যান্ডি আনতে বলে মাথা নিচু করে বসে রইল। ঠোঁটে ঝোলানো সিগারেটের নীল ধোঁয়া তার চোখে গিয়ে লাগছিল। দুটো হাত দিয়ে হাঁটুর ওপরে আস্তে আস্তে কিল মারছিলো সে।

কয়েক মিনিট এইভাবে চলবার পর জিয়ানমারিয়া বলল, “কী হল?” তারপর আরও একটু সাহস সঞ্চয় করে বলল, “এত দুঃখ কীসের?”

ঠোঁট থেকে সিগারেটটা সরিয়ে সানটিনা বলল, “আমি আর পারছিনা। বেঁচে থাকবার সব ইচ্ছে আমার ঘুচে গেছে। এখন মরলে বাঁচি।”

“কিন্তু গতকাল তো—”

“গতকাল তো গতকাল ছিল,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিল সানটিনা, “কিন্তু আজ বুঝতে পারছি এই জীবন থেকে আমার আর মুক্তি নেই। এদের খপ্পর থেকে বের হওয়া–”

“কিন্তু কাল রাত্রে তো বলছিলে আমি একটু সাহায্য করলেই—”

“হ্যাঁ, বলেছিলাম বটে। কিন্তু সে তো কথার কথা। তুমি একটা বাচ্চা ছেলে। কতটুকু সাহায্য করতে পারবে তুমি আমায়, বলো? তাছাড়া আমাদের চেনাপরিচয়ই বা আর কতটুকু?”

জিয়ানমারিয়া বললো, “চিনতে চাইলে মানুষ মানুষকে একদিনেই চিনে নেয়। আর না চাইলে দশ বছরেও চেনা হয় না। আর তাছাড়া, আমাকে বাচ্চা ছেলে বলাটাও ঠিক হবে না। আমি কিন্তু–”

তার কথাটা শেষ হবার আগেই সানটিনা ফের এলোমেলো বকতে শুরু করে দিলো,“না না, কিছু কিছু জিনিস আছে যা আমি কোনদিনই তোমার কাছে চাইতে পারবো না। কোনমতেই না। আর চাইলেও বা তুমি–”

“দিতে পারবো না, তাই ভাবছো তো? অন্তত একটাবার চেষ্টা করে তো দেখো! আগে থেকেই আমায় দিয়ে হবে না সেটা ধরে নিয়ে লাভ কী বলো?”

“না না, আমি জানি, আমি জানি, তুমি পারবে না।”

“ঠিক আছে । কিন্তু অন্তত একটাবার আমাকে পরীক্ষা করে তো দেখো!”

সানটিনা আবার পাশ থেকে তার দিকে তাকালো। আভেন থেকে বের করে আনবার সময় কেকটার দিকে পাকা রাঁধুনি যেমন দৃষ্টিটা দেয় সেইরকম চোখের দৃষ্টি তার। তারপর বলল, “হাজার তিনেক জোগাড় করতে পারবে?”

“হা–হাজার তিনেক—কী?”

“লিরা। লিরা, বোকারাম! ও তোমার সাধ্যের বাইরে। এইবারে বুঝলে তো কেন আমি শুধু শুধু তোমায় কিছু বলতে চাইনি? অবশ্য একটা রাস্তা আমার সামনে এখনো খোলা রয়েছে। বেশ সরল রাস্তা—”

“রাস্তা—মানে?”

তিক্ত একটা হাসি ফুটে উঠল সানটিনার মুখে, “সহজ ব্যাপার। বিশেষ কোন খরচও নেই। ছোট্ট একশিশি ঘুমের ওষুধ। আজ রাতে তার সবটা একসাথে খেয়ে নেবো। ব্যস। কাল সকালে সব জ্বালাযন্ত্রণার শেষ। এই বলে টেবিলে রাখা ব্র্যান্ডির গ্লাসটা এক চুমুকে খালি করে দিয়ে সে ফের বললো, “চলো ওঠা যাক।”

জিয়ানমারিয়া তার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, “শিশিটা কোথায়?”

হাতের ব্যাগটা সাবধানে চেপে হরে সানটিনা বললো, “এই তো এখানে—না না, বাড়িতে, বাড়িতে—”

“তোমার ব্যাগটা আমায় দাও।”

“না।”

“দাও বলছি!”

“না। ব্যাগে হাত দেবে না তুমি।”

“সানটিনা শোনো–”

খানিক টানাহ্যাঁচড়ার পর ব্যাগটা হাতছাড়া হতে সানটিনা ফের তার চেয়ারে বসে পড়ে বলল, “বুনো জন্তু একটা! আমার কবজিটা মুচড়ে দিয়েছো একেবারে।”

জিয়ানমারিয়া ততক্ষণে ব্যাগ হাতড়ে একটা “ভেনোরাল”-এর শিশি বের করে এনেছে। সেটার ঢাকনা খুলতে খুলতে সে বললো, “এইবারে এই ঘুমের ওষুধগুলোকে দিয়ে আমরা এই টবের পামগাছটাকে ঘুম পাড়াবো, কেমন?” বলতে বলতে পাশে রাখা একটা টবের মাটিতে শিশিটা উপুড় করে দিল সে।

সানটিনা নীরবে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। হঠাৎ বললো, “এইভাবে নাটক করে কী লাভ? ওষুধের দোকানে গিয়ে কি আরও একশিশি ওষুধ কিনতে পারব না আমি?”

“তিন হাজার লিরা তোমার ঠিক কেন দরকার সেটা আমায় একটু বুঝিয়ে বলবে? যদি বুঝি যে দরকারটা সত্যি তাহলে তার ব্যবস্থা কিছু একটা হবে।”

মিথ্যে বলছিলো জিয়ানমারিয়া। অত টাকা তার কাছে নেই। আর, একবারে অত টাকা জোগাড় করবার কায়দাও তার জানা নেই। সানটিনা তার দিকে একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে তাকিয়ে নিয়ে বললো, “সব কথা খোলাখুলি বলতে একটু লজ্জা লাগছে। তবু-”

“আমার কাছে আর তোমার কীসের লজ্জা? বলো শুনি–”

“হ্যাঁ, বলতে তো আমাকে হবেই। শোন, আমার একজন সত্যিকারের মা আছেন। তাঁর অবস্থা ভালো নয়। শরীরও খারাপ। ট্রিয়েস্ট-এর কাছে একটা স্যানেটোরিয়ামে তাঁকে রেখেছি। সেখানে না রাখলে মা বাঁচবেন না। এইবারে বুঝলে তো, নেগ্রিনিদের খপ্পর থেকে কেন আমার বেরোবার উপায় নেই? টাকা আমি কিছু জমিয়েছি। তার সঙ্গে হাজার তিনেক যদি আরো পাই তাহলে সে টাকাতে অন্তত একটা বছর মায়ের খরচ চালিয়ে নিতে পারবো। আর ততদিনে কাজকর্মও কিছু একটা খুঁজে নিতে পারবো হয়তো। কিন্তু অত টাকা আমায়ে দেবে কে? এইভাবে আমি আর চলতে পারছি না, বিশ্বাস করো–”

অনেক কষ্টে চোখের জল আটকে জিয়ানমারিয়া ফের প্রশ্ন করলো,“মায়ের কী হয়েছে?”

“যক্ষ্মা। কাশির সাথে রক্ত ওঠে আজকাল।”

জিয়ানমারিয়া খুব তাড়াতাড়ি চিন্তা করছিল। তার কাছে দু হাজার মতো লিরা আছে। বাকি এক হাজার কার কাছে চাওয়া যায়? বাড়িতে চাওয়া যাবে না। একে তো টাকা আসতে সময় লাগবে অনেক। তার ওপরে হাজারগণ্ডা ব্যাখ্যা দাও—সে অনেক ঝক্কি।

“কিছু কমে চালাতে পারবে?”

“না। দরকার ওই তিন হাজারই। তবে ভেবো না। আমার রাস্তা আমি ঠিকই খুঁজে নেবো। তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না।”

কথাগুলো জিয়ানমারিয়ার মধ্যে পরোপকারের ইছেটাকে আরও চাগিয়ে তুললো। রোমে সে যে সামান্যক’জন মানুষকে চেনে তাঁদের তালিকাটা একবার মাথার মধ্যে ঝালিয়ে নিচ্ছিল সে। সানটিনা নিঃশব্দে চেয়ে ছিলো তার মুখের দিকে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই ম্যাটিয়া কাকার কথাটা মনে পড়ে গেল জিয়ানমারিয়ার। বাবার কীরকম তুতো ভাই হয় লোকটা। নাকি টাকার কুমীর। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়েস। যৌবনে বেজায় উচ্ছৃংখল জীবন কাটাবার ফলে কী এক অসুখ হয়ে বিয়েশাদিও হয়নি। আজকাল নাকি বাড়ি থেকেই বের হয়না মোটে।

“টাকাটা কবে লাগবে তোমার?”

লোভী হাসিটা অনেক চেষ্টা করেও শেষমেষ চাপতে পারলো না সানটিনা। হাসি হাসি মুখেই জবাব দিলো, “যখন তুমি জোগাড় করতে পারবে।”

“না না , ওরকম বললে হবে না। ঠিক করে বলো, কখন তোমার টাকাটা চাই।”

“আজ রাতে কিংবা কাল সকালে যদি সম্ভব হয়—”

“আজ রাত্রেই পেয়ে যাবে। এখন চলো।”

টেবিলের ওপর একটা ছোট অংকের লিরার নোট রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল জিয়ানমারিয়া। তার হাবভাবে বেশ একটা পুরুষ পুরুষ চাল জেগে উঠেছে।

“এখুনি উঠবে? আর একটুখানি বসলে হতো না?” সানটিনা পেছন পেছন আসতে আসতে বলছিলো।

“উঁহু। আগে তোমার টাকার জোগাড়টা দেখতে হবে তো? নাকি?”

সানটিনা এইবারে আর কোন কথা বললো না। পথে বেরিয়ে নদীর ধারে একটা নির্জনমতো জায়গায় এসে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ে জিয়ানমারিয়া সানটিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে “একটা চুমু দাও আমায়!”

সানটিনা অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টায় তার বুকে ধাক্কা দিতে দিতে বললো, তুমিও সেই অন্যদের মতই টাকার বদলে আমায় নিয়ে ফুর্তি করতে চাইলে? আচ্ছা, কেউ কি আমায় একটু সম্মান দিতে পারে না?”

জিয়ানমারিয়া নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। সত্যি কথাই বলেছে মেয়েটা। আর দশটা লোকের মত সে-ও তো উপকারের বদলে ফুর্তিই লুটতে চাইছে একটু। সানটিনাকে ছেড়ে দিয়ে নদীর ধারের রেলিং-এ ভর দিয়ে সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার পেছনে তখন ঘন হয়ে এসেছে মেয়েটা। অন্ধকারের মধ্যে তার গলা ভেসে আসছিলো, “রাগ করলে? সত্যি বলছি, আমি তোমায় ভালোবাসি গো। একবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যেতে দাও, তারপরে তোমার কাছেই তো ফিরে আসবো আমি।” কেমন যেন ভাঙা ভাঙা গলাটা। কথাগুলোর মধ্যে একটা কৃত্রিম আদুরে ভাব মেশানো। নিচে টাইবারের ছুটন্ত জলের দিকে তাকিয়ে সানটিনা তখনও বলে চলেছে, “আবার অন্য সমাধানটাও কত সহজ , বলো? রেলিং টপকে ওই জলের মধ্যে টুপ করে ডুবে যাওয়া। ব্যস, সব দুঃখ শেষ।”

জিয়ানমারিয়া মাথা নেড়ে বললো, “না। ওতে কোন সমস্যারই সমাধান হয় না। ভেবে দেখো তো, ওতে লাভটা কী হবে? বেঁচে থাকাটা কতো আনন্দের ব্যাপার?” বলতে বলতেই সে অনুভব করছিলো, এতবড় একটা সত্যিকথা সে আগে কখনো বলেও নি, ভাবেও নি।

ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। মেয়েটার হাড় বের করা শুকনো উরুকে ছুঁয়ে ছিল তার উরু। খানিক বাদে তার হাতে টান দিয়ে জিয়ানমারিয়া বললো, “চলো, যাওয়া যাক তবে।”

ব্রিজের গোড়ায় পৌঁছে দুজনের পথ চললো দু দিকে। সানটিনা ফিরে গেল মেস-এ আর জিয়ানমারিয়া নদীর উল্টোপাড়ে তার কাকার বাড়ির দিকে রওনা হল।

কাকার বাড়ি ঠিক দশ মিনিটের হাঁটাপথ। পুরোন বনেদি বাড়ি। সিং দরোজার দুপাশে দুটো মার্বেলের তৈরি ধূলোমলিন, বৃষ্টির জলের দাগ ধরা মূর্তি, পেশিবহুল হাতে মাথার ওপর একটা ব্যালকনিকে ধরে রেখেছে। দরজা পেরোতেই একটা ঝোপঝাড়ে ভরা উঠোন। তার একপাশে খানিক দূর থেকে ফোয়ারার জল ঝরবার শব্দ আসছে। উঠোন পেরিয়ে বাড়ির সদর। সেখান থেকে লাল কার্পেট বিছানো চওড়া সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় উঠে এল জিয়ানমারিয়া। জানালাওয়ালা একটা করিডোর পেরিয়ে দরজার সামনে গিয়ে ঘন্টা বাজাতে দরজা খুলে দিল ধূসর সুট আর সাদা টাই পরা মাঝবয়েসি একজন ক্লান্ত চেহারার কর্মচারী। তার পরিচয় শুনে ভেতরে এনে বসিয়ে বলল, “দাঁড়ান, গিয়ে দেখি কাউন্ট বাড়িতে আছেন নাকি।” খানিক বাদে ভেতরে ডাক পড়লো তার। গোটাছয়েক লাল পর্দা আর কালো আসবাবে সাজানো ঘর পেরিয়ে সাত নম্বর ঘরটাতে পৌঁছে কাকার দেখা মিলল। সরু পিলার দিয়ে ঘেরা উজ্জ্বল রঙের ঘরটাতে একটা মন্দির মন্দির ভাব আছে। ঠিক মাঝখানে, যেখানটায় দেবতার বেদি থাকবার কথা সেইখানটাতে একটা চৌকো মার্বেলের টেবিল পেতে ম্যাটিয়া কাকা বসে ছিলেন। ওপরদিকে বাঁকানো নাক, পরণে ধূসর সুট আর উজজ্বল টাই। বাটনহোল-এ ফুল লাগানো। মুখে বেশ একটা ঝগড়াটে ভাব। বয়সের বেশি ছাপ পড়েনি সেখানে। পাশে কালো পোশাক পরা এক বৃদ্ধা। ভাইপোকে দেখে দুহাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন কাকা, “আরে—ভাবো দেখি, তোমার সঙ্গে দেখা! ভাবো একবার—”

বলতে বলতেই কোটের ল্যাপেলের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা একটা মনোকল চোখের ওপরে আটকাবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কাকা। বারকয়েকে চেষ্টায় সেটাকে লাগিয়ে নিয়ে বৃদ্ধার সঙ্গে জিয়ানমারিয়ার আলাপ করিয়ে দিলেন তিনি। ভদ্রমহিলা রোমের এক রাজকন্যা।

“বছরদুয়েক আগে আমার যে ভাইটি মারা গেল, এ তারই বড়ো ছেলে, বুঝলে এডিথ?” ওর মা জন্মেছিলেন সিয়েনার সাভেলিদের বংশে, মানে ওই যে যাতে লরা সাভেলির জন্ম—গতবার যার সাথে লুইজি কারপেনার বিয়ে হল—”

বৃদ্ধা অবশ্য এসব বংশপরিচয়ের ধারাবিবরণীতে বিশেষ কান দিচ্ছিলেন না। তবে কাকা তাতে দমবার পাত্র নন। এক নিঃশ্বাসে জিয়ানমারিয়ার বংশগৌরবের হিসেব দেয়া শেষ করে অবশেষে তার দিকে ফিরে তিনি বললেন, “ তা হঠাৎ করে কাকাকে মনে পড়লো যে? আসবার আগে একটা ফোন কল অবধি করলে না, একেবারে সটান ঘাড়ে এসে পড়লে যে? আহা, অপূর্ব। দেখো এডিথ, দেখো। আজকালকার ছেলেদের সহবতের দশাটা দেখো। ভদ্রতা টদ্রতার আশা এদের কাছে না করাই উচিৎ। আচ্ছা বলো তো , আমরা কখনো আগে খবর না দিয়ে হুট করে কোন দূরসম্পর্কের কাকার বাড়িতে এসে উঠেছি? নাঃ। সে যুগে এমন কথা ভাবাই যেত না। তা, ওহে ভাইপো, এসেই যখন পড়েছো, তখন কিঞ্চিৎ চা আর কেক না হয় খেয়েই যাও।“

ভদ্রমহিলা অবশ্য দেখা গেল কাকার সঙ্গে একমত নন। হেসে বললেন, “ভালোই করেছ চলে এসে। নিজের কাকার সঙ্গে অত ভদ্রতা দেখাবার কী আছে? আর ম্যাটিয়া, এইভাবে ওর চলে আসা দেখে আমার মনে হছে ছোকরা বেশ সাদাসিধে আছে। ওর বয়সে তুমি যেমন একটা খুদে ভণ্ড ছিলে সেরকম নয়।”

শুনে কাকা অট্টহাসি হাসলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “ঠিক ঠিক। তা ওহে ছোকরা, রাজকুমারী যখন তোমার পক্ষে তখন আমার আর কিছু বলবার নেই। তা, মা, ভাইবোনেরা কে কেমন আছে?”

“আজ্ঞে সবাই ভালো আছে।”

“চমৎকার। তা তোমার খবর কী। পড়াশোনা কিছু হচ্ছে, নাকি শুধুই ফুটবল দেখে দিন কাটাচ্ছো?”

“না না, আমি আইন পড়ছি। এখনো অবধি ফুটবল মাঠে যাইইনি।”

“বেশ। তা থাকা হচ্ছে কোথায়?”

“হামবোল্ট মেস-এ।”

“হামবোল্ট মেস? সেটা আবার কোথায়? নামই শুনি নি কখনো! এডিথ, তুমি শুনেছো?”

বৃদ্ধা এবারে একটু রেগে গিয়ে বললেন, “কেন বারবার ছেলেটার পেছনে লাগছ বলো তো? হামবোল্ট নিঃসন্দেহে ভালো মেস।”

“হা হা। ভালো কথা। চলো তাহলে আমি গিয়ে ওই হামবোল্ট মেসেই উঠি! তুমিও চলো না এডিথ–” বলতে বলতে এক মুহূর্তের জন্য থেমেই প্রসঙ্গ পালটালেন কাকা, “কিন্তু তুমি ছোকরা তোমার হঠাৎ উদয় হবার কারণটা বললে না তো? ভালোবেসে আমায় দেখতে আসোনি নিশ্চয়। ধান্দাটা কী?”

“কারণ একটা আছে কাকা।” কিন্তু সেটা একটু গোপনে বলতে চাই।”

“দেখলে এডিথ, আমি কেমন ভালো মনস্তত্ত্ববিদ? উত্তেজিত গলায় বৃদ্ধার দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়েই জিয়ানমারিয়ার দিকে ঘুরলেন তিনি, “শোন হে। আমি আর এডিথ হলাম গিয়ে হরিহর আত্মা। আমায় যা বলবে তা এর সামনেই বলতে পারো।”

জিয়ানমারিয়া একটু ইতস্তত করছিলো। তারপরে তার খেয়াল হল মহিলা এতক্ষণ তার পক্ষেই কথা বলেছেন। আলোচনার সময় তিনি থাকলে সুবিধেই হয়ে যেতে পারে। গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে সে বললো, “কাল রাতে কয়েক বন্ধু মিলে তাসের জুয়ো খেলছিলাম–” ডাহা মিথ্যে গল্পটা খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেলবার চেষ্টায় ছিলো সে। কিন্তু কাকা হাত তুলে মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “কোন খেলা?”

“আজ্ঞে পোকার। তাইতে হাজারখানেক লিরা ধার হয়ে গেছে। টাকাটা কালকেই ফেরৎ দিতে হবে। তাই আপনার কাছে ধার চাইতে আসা। বাড়িতে চিঠি লিখেছি। সেখান থেকে টাকাটা এলেই আপনাকে ফেরৎ দিয়ে যাবো। দেরি হবেনা—-”

বলতে বলতেই কাকার চোখের দৃষ্টি দেখে মাঝপথে থেমে গেল সে। সে দৃষ্টিতে রাগ আর কৌতুক একসঙ্গে খেলা করে চলেছে। খানিক বাদে হো হো করে হাসতে শুরু করলেন তিনি। বলেন, “কী দারুণ গল্প! পোকারের জুয়া—হাজার লিরা ধার, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে শুধতে হবে! বিশ বছর আগে এইরকম সব নভেল বের হতো বাজারে। হ্যাঃ। বিশ বছরের পুরনো বস্তাপচা থিম! আর আমি কিনা ভাবছিলাম ভাইপো আমার চালাকচতুর ছোকরা হবে!”

এডিথও হাসছিলেন। তবে তিনি কাকার মতো গোটা গল্পটাই অবিশ্বাস করছেন কিনা, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। জিয়ানমারিয়ার তো লজ্জায় চুলের গোড়া অবধি লাল হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। অনেক কষ্টে ফের মুখ খুললো সে, “আ-আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করছেন না?”

কাকা হাসি থামিয়ে বললেন, “ঠিক ধরেছো। এক্কেবারে বাজে গল্প ফেঁদেছ, বুঝলে? আয়নায় নিজের মুখটা একবার দেখগে! এক রাত্রে জুয়োয় হাজার লিরা হারবার জন্য যে রকমের মুখ হতে হয়, তোমার মুখ একেবারেই সে জাতের নয় হে খোকা! কী বলো এডিথ?”

বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন, “উঁহু। জুয়ো নয়, তবে এর মুখ দেখলে মনে হয় শুধু একটা ব্যাপারেই হাজার লিরা এ নষ্ট করতে পারে,” বলতে বলতে তাঁর অভিজ্ঞ, প্রাচীন দৃষ্টি দিয়ে জিয়ানমারিয়াকে আদর করছিলেন তিনি। অনেকটা ঠিক মেসম্যানেজার নীনা লেপারির মতো।

কাকা আবার শুরু করলেন, “এইসব উল্টোপাল্টা গল্প বানাবার চেয়ে যদি বলতে হাজার লিরা তোমার দরকার, তা সে যে কারণেই হোক না কেন, সে কিন্তু অনেক ভালো হত। ছ্যা ছ্যা। আমি তো ভাবতাম আজকালকার ছেলেছোকরারা বেশ খোলামেলা, বুদ্ধিমান।”

জিয়ানমারিয়া তখন মরীয়া। জেদি মুখ করে বললো, “আচ্ছা তবে নাহয় ধরুন তাই। হাজার লিরা ধার চাই আমার। দেবেন?”

কাকা মাথা নেড়ে বললেন, “আরে, দেব একথা আবার বললাম কখন? হাজার লিরা! অত টাকা যদি আমার থাকতো তাহলে তো আমি বড়লোক হয়ে যেতাম হে! দিনকাল যা খারাপ পড়েছে! তাছাড়া আজ তো আবার রবিবার। ব্যাংক বন্ধ। তুমি বরং রাজকুমারীকে একবার বলে দেখো। উনি তো দেখছি তোমায় বেশ পছন্দই করে ফেলেছেন। যদি ওঁর হাতব্যাগে টাকাটা থাকে তাহলে-”

জিয়ানমারিয়া হাসিকান্নাভরা চোখে বৃদ্ধার দিকে তাকাতে তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে কাকাকে মুখঝামটা দিয়ে বললেন, “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে ম্যাটিয়া। নইলে এইভাবে কেউ রসিকতা করে? আমার কাছে থাকলে আমি অবশ্যই টাকাটা এক্ষুণি দিয়ে দিতাম ওকে। কিন্তু ওই যে, দিনকাল যা পড়েছে, হাজার লিরা এখন অনেক টাকা—”

জিয়ানমারিয়া বুঝলো এখানে আর থাকলে তাকে নিয়ে এইসব রঙ্গরসিকতাই হবে। টাকা আর পাওয়া যাবে না। উঠে দাঁড়িয়ে সে শান্ত গলায় বললো, “আচ্ছা , আমি এখন চলি তাহলে কাকা। অসময়ে বিরক্ত করবার জন্য দুঃখিত।”

“আরে না, না, তাতে কী হয়েছে হে!” বলতে বলতে কাকাও উঠে দাঁড়ালেন।

পিছু ফিরে সে বের হয়ে আসবার আগে, হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে এডিথ বললেন, “আমি এই সামনেই সাত নম্বর পিয়াজা কাম্পিতেল্লিতে থাকি। একদিন ওখানে এসো। আর, তোমার কাকাকে খারাপ ভেবো না। লোকজনের সঙ্গে একটু আধটু বদরসিকতা করা ওর স্বভাব। আর কে জানে, হয়তো আজ এই হাজার লিরা তোমায় দিতে অস্বীকার করে উনি তোমায় কোন বোকামো করবার হাত থেকে বাঁচিয়েই দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস ব্যাপারটার মধ্যে কোন মেয়ে জড়িত। ঠিক কিনা?”

“গোড়াতেই ও কথাটা না বলাই তোমার ভুল হয়েছে হে !” কাকা ফুট কাটলেন, “অবশ্য টাকাটা আমি তা হলেও তোমাকে দিতাম না, সেটাও ঠিক।” এই বলে মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে জিয়ানমারিয়ার সঙ্গে তিনি খানিকদূর এসে ফিরে গেলেন ফের।

রাগে আর অপমানে মুখ লাল করে নিজের কোট আর টুপি তুলে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে পথে বের হয়ে এলো জিয়ানমারিয়া। কিন্তু কাকার বাড়ি থেকে যত মেসবাড়ির দিকে এগোচ্ছিলো সে ততই সেই রাগ আর অপমানের জায়গা এসে দখল করছিলো তীব্র একটা লজ্জা। মেয়েটা নিজের মুক্তির জন্য তার ওপরে ভরসা করেছিলো। বড় মুখ করে তাকে আশ্বাসও দিয়ে এসেছিলো সে। এবারে সে ফিরে গিয়ে কী বলবে তাকে?

সারাদিন ধরে আবেগের এহেন নাগরদোলায় ওঠাপড়ায় ক্লান্তি এইবারে গ্রাস করছিলো তার মনকে। দিনের শুরুতে নিজেকে সে ভেবেছিলো একজন শক্তিশালী পুরুষমানুষ; দিনের শেষে এসে সেই ভুল তার ভেঙে গেছে। নিজেকে ভারী দুর্বল একটা ছোট ছেলে বলে মনে হচ্ছিল তার। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মেসে এসে পা রাখতেই ডিনারের ঘন্টা পড়লো। শব্দটা তার স্নায়বিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিল আরও। কাজের মেয়েটা মহাসুখে ঘন্টা পিটতে পিটতে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সেই শব্দ তার চোখের সামনে ডাইনিং রুমের ছবিটা ফুটিয়ে তুলছিলো। নেগ্রিনি তার জুয়ারির চকমকে হাসি মুখের কোণে ঝুলিয়ে তার সঙ্গে রসিকতা করবে। কোকানারি, মাসকারা-পোড়া চোখ নিয়ে তাকে ঘুরে ঘুরে দেখবে, আর তাদের পেছনে ব্যর্থ আশা চোখে নিয়ে কৌতুহলী মুখে বারবার উঁকি মারবে সানটিনা, ইশারায় জানতে চাইবে—

ছবিটা চোখের সামনে ফুটে উঠতেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল জিয়ানমারিয়া। আজ ডাইনিং রুমে রাতের খাওয়া খেতে যেতে পারবে না সে। খাবারটা ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলবার জন্য একটা কাজের মেয়ের খোঁজে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনেই মেস ম্যানেজারের অফিস দেখে তার দরজায় গিয়ে টোকা দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে একটা হুড়োহুড়ির শব্দ এলো। কাপড়জামার খসখস, মেজের কাঠের তক্তার ওপর খালি পায়ের ছুটোছুটির আওয়াজ চললো কিছুক্ষণ। তার পর ভেতর থেকে সেই মিঠে গলার শব্দ ভেসে এলো, “আসুন।”

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে জিয়ানমারিয়া দেখে নীনা আজ তাঁর রোজকার সেই কালো পোশাকটা পরে নেই। তার বদলে একটা ফার দেয়া পিংক রঙের হাউস কোট পরে আছেন। মুখে সংকোচের রাঙা ভাব। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অন্তর্বাস, প্রসাধনের টুকিটাকি, হাত দিয়ে হাউসকোটের সামনেটা ধরে থাকা এই সবকিছু থেকে বোঝা যাচ্ছিলো তিনি পোশাক বদলাচ্ছিলেন। জিয়ানমারিয়া হঠাৎ খেয়াল করলো, সেই সামান্য এলোমেলো আর লজ্জা পাওয়া অবস্থায় তাঁকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। “অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম আপনাকে,” লজ্জা লজ্জা গলায় জিয়ানমারিয়া বললো, “মানে আমি শুধু বলতে এসেছিলাম, আজ রাতে আমি ডাইনিং রুমের বদলে নিজের ঘরে বসে খেতে চাই।”

বেশ খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন নীনা। যেন তার ভেতরের কষ্টটার ছাপ পরিষ্কার পড়তে পারছেন তার চেহারায়। গালে তখনো তাঁর সেই সংকোচের লালিমাটুকু লেগে আছে। খানিক বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, “কেন? শরীর ভালো লাগছে না?”

জিয়ানমারিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। বুকের এত ভার সে আর একলা বইতে পারছিলো না। বললো, “শরীর আমার ভালোই আছে,” আর তার পরেই কান্নায় আটকে আসা গলায় বললো, “আমার মন ভালো নেই। আমি আজ কারো মুখ দেখতে চাই না।”

“মন খারাপ? কেন? বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?”

“না, অন্য কারণ আছে,” একটু কড়া গলাতেই জবাব দিলো সে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, কারো মুখ দেখতে না চাইলেও সেই উষ্ণ ঘরটা ছেড়ে যেতে তার এতটুকুও ইচ্ছে করছিল না তখন। তারপর তার মুখ দিয়ে নিজে থেকেই বের হয়ে এলো, “আমার অনেক টাকা চাই।”

“টাকার জন্য মন খারাপ? কেন, কাল ভাড়া দিয়ে হাতের টাকা কম পড়ে গেছে? ভাড়ার টাকাটা তাহলে নাহয় ফেরৎ নিয়ে নাও। পরের সপ্তাহে একসাথে দিয়ে দিও। ”

কী করবে জিয়ানমারিয়া? এঁকে সব কথা খুলে বলবে? সেই ভাবতে ভাবতেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো, “না। ওর চেয়ে অনেক বেশি টাকার দরকার আমার।”

হঠাৎ নীনা তার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “কতো টাকা চাই তোমার? আমার সাধ্যের মধ্যে হলে আমি খুশি হয়ে তোমায় ধার দিতে পারি টাকাটা।”

তাঁর শান্ত, কালো চোখের দিকে তাকিয়ে জিয়ানমারিয়ার হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। ধরা গলায় বললো, “এক হাজার লিরা।”

নীনা একটু চিন্তাগ্রস্ত চোখে তার দিকে তাকিয়েই রইলেন। তাই দেখে জিয়ানমারিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে বলল, “আপনি খুব ভালো। কিন্তু। বুঝতে পারছি অতোটা টাকা ধার দেয়ার উপায় আপনার নেই। বাদ দিন সেসব কথা। আমি বরং চলি।” এই বলে পিছু ঘুরতে যাবে সে এমন সময়, যেন তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো হেঁটে এসে তার হাতটা এসে ধরলেন তিনি। তারপর হাতটা তুলে তার মুখে মাথায় বুলোতে বুলোতে বললেন, “টাকাটা পেলে তুমি সত্যিই খুশি হবে?” তারপর যেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিলেন তিনি, যেন আগুনের ছ্যাঁকা লেগেছে হাতে।

“ইনি—আমায় ভালোবাসেন—” হঠাৎ করেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল জিয়ানমারিয়ার কাছে। তার জন্য মহিলার চিন্তা, তাকে একটু সেবা, একটু আদর দেবার অবিরত চেষ্টা, তার অপমানে তাঁর রেগে ওঠা, এই সবকিছুরই অর্থ তার কাছে তখন দিনের আলোর মতই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কী করবে সে ভেবে পাচ্ছিলো না। কিন্তু তারপরেই তার তারুণ্যের সুতীব্র আত্মকেন্দ্রিকতাসঞ্জাত বোধ, এই হঠাৎ পেয়ে যাওয়া সুযোগটাকে চিনে নিতে ভুল করলো না। গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সে বললো, “হ্যাঁ। আমি খুব খুশি হবো,’’ নিজের সাহস দেখে সে নিজেই ভয় পেয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু তারপর ফের শান্ত গলায় সে যোগ করলো, “কারণ টাকাটা আমার সত্যিই দরকার।”

একটাও কথা না বলে নীনা টেবিলের কাছে ফিরে গিয়ে একটা ড্রয়ার খুললেন। কিন্তু তারপরেই পরিণত ব্যাবসায়ীর মনটা জেগে উঠলো তাঁর। ড্রয়ারের মধ্যে হাতটা রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, “টাকাটা ফেরৎ দিতে পারবে তো?”

মুখটা লাল হয়ে উঠলো জিয়ানমারিয়ার। “আমি এক্ষুণি আসছি”, বলে নীনা কিছু বলবার আগেই এক ছুটে তাঁর ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে একটা ছোট ব্যাগ থেকে তার বাবার স্মৃতিচিহ্ন কটা দামি কাফলিংক আর রত্ন বসানো বোতাম নিয়ে এসে নীনার হাতে দিয়ে বললো, “এগুলোর দাম তিন-চার হাজার লিরা হবে। আপনি এগুলো বন্ধক রেখে দিন। টাকা ফেরৎ দিয়ে ছাড়িয়ে নেবো।”

তার রাগি মুখটার দিকে চেয়ে একটু হাসলেন ভদ্রমহিলা। তারপর তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বললেন, “পাগল গোঁয়ারগোবিন্দ কোথাকার। আমি কি তাই বলেছি নাকি? ওসব ছাড়াই আমি তোমায় টাকাটা ধার দেবো। এই নাও, টাকাটা ধরো, আর জিনিসগুলো ফেরৎ নিয়ে যাও।”

জিয়ানমারিয়া টাকাগুলো পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে হঠাৎ খুশিয়াল হয়ে বললো, “ওগুলো এখন আপনার কাছেই রেখে দিন। পরে টাকা শুধে ফেরৎ নেবো। আর, আমি মত বদলেছি। খাবারটা আমি ডাইনিং রুমেই খাবো আজকে। আপনাকে অনেক, অনেক ধন্যবাদ,” কথাগুলো বলতে বলতেই মুখ ঘুরিয়ে ডাইনিং হলের দিকে রওনা দিলো সে।

হাঁটতে হাঁটতেই মানিব্যাগটা বের করে নিজের সম্বল দু হাজার লিরার নোটদুটোর সঙ্গে নীনার দেয়া টাকাটা একসঙ্গে করে নিয়ে বড়ো বড়ো পদক্ষেপে খাবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো সে। খাওয়াদাওয়া তখন মাঝপথে। তাকে দেখেই নেগ্রিনি নিজের চেয়ার থেকে একগাল হেসে বললেন, “গুড ইভনিং, গুড ইভনিং—” জিয়ানমারিয়া তার কোন উত্তর না দিয়ে সোজা নিজের টেবিলে গিয়ে বসলো। কোকানারি তার দিকে তাকিয়ে সোনাবাঁধানো দাঁতগুলো বের করে একগাল হাসি ছুঁড়লেন। জিয়ানমারিয়া দেখেও দেখলোনা। তার চোখ তখন স্থির হয়ে আছে সানটিনার দিকে। চোখাচোখি হতেই আস্তে করে ঘাড়টা নেড়ে সংকেত দিলো, টাকাটা জোগাড় হয়েছে। সানটিনাও মৃদু ঘাড় নেড়ে হাসলো একটু। এইবারে নিশ্চিন্ত হয়ে খাওয়া শুরু করলো জিয়ানমারিয়া।

নীনা সেরাত্রে খাবার ঘরে একবারও আসেন নি। জিয়ানমারিয়ার অবশ্য সেদিকে খেয়াল ছিলো না। তার সব মনোযোগ তখন কেবল সানটিনার দিকে। খাওয়া শেষ হতে একে একে বোর্ডাররা বিদায় নিলেন। ঘরে রইলো শুধু সে আর সানটিনারা তিনজন। “সারা সকাল কোথায় ছিলে বলোতো? কোথাও নেমন্তন্ন ছিলো নাকি?” কোকানারি জিজ্ঞাসা করলেন।

“না। আমার প্রি-মিলিটারি ট্রেনিং ছিলো আজ।”

খানিক বাদে কথা বলতে বলতে তারা আবার সেই করিডর ধরে হাঁটছিলো। আগে আগে নেগ্রিনি আর কোকানারি আর পেছনে তারা দুজন। এক ফাঁকে টাকাটা সানটিনার হাতে গুঁজে দিয়ে জিয়ানমারিয়া বললো, “এই যে তোমার তিন হাজার লিরা। এবার আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।”

টাকাটা হাতে নিয়ে মেয়েটা নিচু গলায় বললো, “ধন্যবাদ।” ছেলেদের মতো একটা ধূসর বুকখোলা জ্যাকেট আর সাদা রেশমের শার্ট পরেছিলো সে। পাতলা শার্টের নিচে তার অন্তর্বাসহীন ছোটছোট তীক্ষ্ণ বুকদুটো হাঁটার তালে তালে দুলছিলো। নেগ্রিনিরা বাঁকের আড়ালে চলে যেতেই জিয়ানমারিয়া সানটিনার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো, “একটা চুমু দাও এখন।”

সানটিনা তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বললো, “এখন নয়। পরে। তোমার ঘরে,” বলতে বলতে হালকা পায়ে দৌড়ে করিডোরের বাঁকের মুখে হারিয়ে গেলো সে।

সেই রাতে দীর্ঘ সময় ধরে তার সোফায় বসে অপেক্ষা করেছিলো জিয়ানমারিয়া। প্রহরে প্রহরে গির্জার ঘন্টাটা একেকবার বেজে চলেছিলো, আর অপেক্ষায় থাকা তরুণটি অধৈর্য, রাগ আর হতাশার ধাপগুলো এক এক করে পেরিয়ে এসে, তার প্রেমিকার না আসবার অজস্র কাল্পনিক ব্যাখ্যা তৈরি করবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে শেষে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিলো। বালিশে মুখ গুঁজে , সকলের অলক্ষ্যে নিজের পৌরুষের ছদ্মবেশকে খুলে ফেলে শিশুর মত বারবার অন্ধকারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলো, “কেন এলেনা তুমি সানটিনা?”

ঘুম ভাঙলো গালে, মাথায় একটা নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে। শান্ত, নরম গলায় কেউ তাকে ডাকছিলো। চোখ খুলে, শাটারের ফাঁকফোকড় দিয়ে ঢুকে আসা অজস্র রৌদ্রশলার আলোআঁধারীতে সে দেখলো, সানটিনা নয়, নীনা এসেছেন তাকে ডাকতে। তাড়াতাড়ি একটা শার্ট টেনে নিল সে খালি গায়ের ওপর।

“এত বেলা অবধি ঘুমোচ্ছ যে? দশটা বেজে গেছে যে!” বলতে বলতে অভ্যস্ত হাতে ঘরের বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে বিছানার ধারে এসে বসে নীনা শান্ত গলায় বললেন, “এইভাবে তোমার ঘরে আমি আসতাম না। কিন্তু কাল একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটে গেছে, সেই খবরটা দিতেই আসা। সানটিনা নামের মেয়েটা কাল রাতে মেস ছেড়ে পালিয়ে গেছে। একটা কালোমতন ছেলের সঙ্গে কদিন ধরে ঘোরাঘুরি করছিলো। তার সঙ্গেই কাল রাতে একটা গাড়িতে করে পালিয়েছে। সঙ্গে নেগ্রিনির সব টাকাপয়সা আর মিসেস রিনাল্ডির সব গয়নাগাঁটিও নিয়ে গেছে নাকি। ”

জিয়ানমারিয়া যেন স্বপ্নের মধ্যেই প্রশ্ন করলো, “কিন্তু তা কী করে হবে? সে তো–”

“যতটুকু বোঝা গেছে, ওই মহিলা ওর মা নয়। ওর নাম কোকানারি। এককালে বেশ্যাবৃত্তি করতো। নেগ্রিনি ছিলো ওদের সহকারী,” নীনা ঠাণ্ডা গলায় বলে চললেন, “তিনজনে মিলে ঘুরে ঘুরে নানান জায়গায় মেয়েটার টোপ দিয়ে লোক ঠকানোর ব্যবসা করতো। ওই কোকানারি আর নেগ্রিনি চিৎকার করে করে যা সব বলে চলেছে তার থেকেই এই সব জানতে পারলাম। বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা ওদের শেখানো অস্ত্রই ওদের ওপরে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু, যতই কাঁদুক আর গালাগাল দিক, পুলিশে যেতে কিছুতেই রাজি নয় ওরা। সম্ভবত পুলিশে গেলে ওদের সব কীর্তিকলাপ ফাঁস হয়ে যেতে পারে সেই ভয়ে। তবে সে যাই হোক আমি ওদের আজ দুপুরের আগেই মেস ছাড়বার নোটিশ দিয়ে দিয়েছি।” বলতে বলতে জিয়ানমারিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ চোখ রেখে কিছু প্রতিক্রিয়ার খোঁজ করছিলেন যেন নীনা।

চুপ করে বসে ছিলো জিয়ানমারিয়া। সব কথা ফুরিয়ে গিয়েছে তার। হঠাৎ করে তার মনে হচ্ছিলো এক রাতেই সে অনেকটা বড়ো হয়ে গিয়েছে। সানটিনার জন্য তার অন্ধ, জটপাকানো কামনার আবরণটা ভেঙে পড়ে রয়ে গেছে কেবল একটা হিমশীতল শূন্যতার অনুভুতি। গোটা ব্যাপারটা এইবারে তার চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিচ্ছিলো। কিন্তু নিজের ভুলটা বুঝতে পারা ছাড়া সে উপলব্ধির আর কোন তাৎপর্যই সে বুঝতে পারছিলোনা সেই মুহূর্তে।

নীনার শান্ত গলার শব্দে তার এলোমেলো চিন্তার সুতোটা ফের ছিঁড়ে গেল। তিনি বলছিলেন, “মেয়েটা আর সবকিছুর সঙ্গে কাল তোমাকে আমার দেয়া সেই হাজার লিরাটাও নিয়ে গেছে, না?”

জিয়ানমারিয়ার মাটিতে মিশে যাবার ইচ্ছে হচ্ছিলো। মাথা নিচু করে সে জবাব দিলো, “হ্যাঁ, কিন্তু টাকাটা আপনাকে আমি ঠিক ফেরৎ দিয়ে দেবো, দেখবেন!”

“টাকা দিয়ে কী হবে আমার?” খানিকটা তিক্ততা অনুযোগ মেশানো গলায় বললেন নীনা। জিয়ানমারিয়া মাথা তুলে দেখলো, বেদনার্ত মুখে আস্তে আস্তে মাথাটা ঝাঁকাচ্ছেন তিনি, যেন বলতে চাইছেন, “তুমি এত নির্বোধ কেন? আমায় বুঝতে পারছো না?” ধীরে ধীরে গত রাত্রের বন্ধক রাখা জিনিসগুলো পোশাকের পকেট থেকে বের করে পাশের টেবিলে রেখে জিয়ানমারিয়ার কাছে ঘন হয়ে এলেন নীনা। তাঁর ভারী বুকদুটো তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো বারবার। হঠাৎ, ছাইচাপা আগুন থেকে বের হয়ে আসা লকলকে অগ্নিশিখার মতো, তার আশাভঙ্গের সমস্ত দুঃখকে উড়িয়ে দিয়ে্‌, পাশে বসে থাকা শান্ত, অনুগত নারীটির প্রতি তীব্র প্যাশনের আগুন জ্বলে উঠলো জিয়ানমারিয়ার সারা দেহে। নিজে জানতো না, কিন্তু আসলে এঁকেই তো চেয়েছে সে। সানটিনা নিজে থেকে যখন এগিয়ে এসে গ্রাস করলো তাকে তখন সেই আবেগে ভেসে গেলেও নিজেরই অজান্তে সানটিনার বিকৃত, মোটাদাগের আবেগের মধ্যে অনভিজ্ঞ কিশোরটি আসলে খুঁজতে চেয়েছিলো এই মমতাময় স্নেহকেই। ধীরে ধীরে তাঁর গায়ে হাত ছোঁয়ালো সে। থরথর করে কেঁপে উঠলেন নিঃসঙ্গ মহিলাটি। তারপর দু চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে নীচু হয়ে এলেন তরুণটির শরীরের ওপর। দুটো ঠোঁট অন্য দুটো ঠোঁটকে খুঁজে নিল।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *