prabandho-abadhanam

অবধানম্—এক বিলুপ্তপ্রায় প্রাচীন ভারতীয় কলা
সুমনা সাহা

ইদানীং অনেককিছুই ভুলে যাচ্ছি, বয়স বাড়ছে, নাকি গ্যাজেট নির্ভরতার ফল, কে জানে! অথচ কয়েক বছর আগেও বহু ল্যান্ডলাইন ফোন নম্বর থেকে আরম্ভ করে, ট্রেনের টাইমটেবল, দূরদর্শনের সপ্তাহভোর অনুষ্ঠান-সূচী—সব কিছু মনে রাখাই ছিল এক্কেবারে জলবৎ তরলং! এখনও চাইলে মনে রাখতে পারি হয়তো, কিন্তু আসল কথাটা হল, এখন আমরা মনে রাখতে চাই না। সব ভার তুলে দিই নানা আল্ট্রা আধুনিক সফট-ওঅ্যার সম্বলিত গ্যাজেট, অ্যাপ ও যন্ত্রের উপর। অ্যালার্ম বাজিয়ে ঘুম ভাঙানো থেকে শুরু করে বিল-পেমেন্টের তারিখ, আত্মীয়স্বজনের বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন এমনকি অতি ব্যক্তিগত সমস্ত অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড পর্যন্ত মনে রাখবার দায় নিশ্চিন্তে তুলে দিই গ্যাজেটের ভল্টে, বিনিময় করি আমার ব্যক্তিগত বার্তা-বিনিময়ের রেকর্ড, ব্যক্তিগত ফটো, ভাল-মন্দ সব তথ্য, মায় আমার ফোনের ব্যক্তিগত যোগাযোগ-তালিকা পর্যন্ত! নচেৎ তারা সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না। তার মূল্যও চোকাতে হচ্ছে ও হবে আগামী দিনে আরও ভয়ঙ্কর ভাবে, সেসমস্ত আমরা বুঝিও, কিন্তু কষ্ট করে মনে রাখার কষ্টটুকু পোহাতে চাই না! আমাদের অনন্ত চাহিদা তুষ্টির জন্য ফোনের স্মৃতিভাণ্ডারের ক্ষমতা ২ জিবি থেকে ১২০ জিবি হয়েও ক্রমশ বাড়ানোর জন্য চলেছে নিরন্তর গবেষণা, ফল আরও উন্নত ফিচারস যুক্ত গ্যাজেটস। সেদিন গুনগুন করে স্কুল-বেলার একটা গান ধরেছি, কর্তা বললেন, ‘কত গান তোমার মুখস্থ?’ হিসেব কষলাম, অজস্র। রবীন্দ্র-নজরুল-অতুলগীতি থেকে হিন্দী-বাংলা সিনেমার গান ও আধুনিক গান, ভজন, ওদিকে কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি থেকে শুরু করে গণ্ডা গণ্ডা ছড়া ও কবিতা…অগুন্তি! ভাবলাম, তাই তো! মানুষের মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা কত জিবি?

কয়েকবছর আগে স্বামী অভেদানন্দজীর সার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে বেলুড়মঠে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান দেখে আক্ষরিক আক্কেলগুড়ুম হয়ে গিয়েছিল। বেলুড়মঠের নির্দেশে প্রথমে ঐ অনুষ্ঠানটি রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পাশেই বিবেকানন্দ সভাগৃহে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, নাম-‘অষ্টাবধানম্’। ব্যাপারটা সম্পর্কে অল্পই জানা ছিল, একজন ব্যক্তিকে আটজন ব্যক্তি পর্যায়ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করবেন এবং তিনি একাই সবগুলির উত্তর দেবেন কোনরকম যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়াই। কিন্তু চাক্ষুষ দেখা যে বিষ্ময় ও শ্রদ্ধা জাগিয়েছে, তা অবর্ণনীয়।

‘অবধানম্’ জিনিসটা কি, জানতে হলে চলুন আজ থেকে চারশো বছর আগেকার এক গ্রামীন চণ্ডীমণ্ডপে। সমবেত গ্রামবাসীদের সম্মুখে বেদীর উপর উপবিষ্ট এক ব্যক্তিই অনুষ্ঠানের নায়ক, ‘অবধানী’। তাঁকে ঘিরে আটজন ‘পৃচ্ছক’, অবধানীকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন এবং তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সরস ভঙ্গীতে সকলের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে চলেছেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। প্রশ্নের বিষয়? একজন ১০ অঙ্কবিশিষ্ট দুটি সংখ্যার গুণফল জানতে চাইলেন, আরেকজন কঠোপনিষদের ১০-২৭ স্তবক আবৃত্তি করতে বললেন, একজন একটি অসমাপ্ত কবিতা ছন্দে মিলিয়ে সম্পূর্ণ করতে বললেন, শর্ত হিসেবে কোনও বিশেষ অক্ষরসমষ্টি বা বাক্যবন্ধ ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেন, আরেকজন কালিদাসের ‘মেঘদূত’ থেকে কোনও বিশেষ পঙক্তির অর্থ জানতে চাইলেন। একজন মাঝেমধ্যে ঘণ্টা বাজিয়ে অবধানীকে সময় জানাচ্ছেন। ঘণ্টা বাজানোর কোনও মাথামুণ্ডু নেই, অবধানীর একাগ্রতা বিঘ্নিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য, যদিও অবধানী নিজের মনে ঘড়ি বসিয়ে রেখেছেন। একজনের ভূমিকা ‘অপ্রস্তুত প্রসঙ্গম্’ উত্থাপন করে সভায় হাস্যরস উদ্রেক ও অবধানীকে অপ্রস্তুত করা। এইসমস্তই অবধানী সুকৌশলে সামাল দেন। কোনও বাধ্যবাধকতা না থাকলেও প্রশ্নের উত্তর পদ্যের ছন্দে দেওয়াই নিয়ম। অবধানীকে একসঙ্গে পৃচ্ছক-এর প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দিতে হয় না, প্রথম পৃচ্ছককে ১০ অঙ্কের সংখ্যার প্রথম তিন অঙ্ক পর্যন্ত গুণফল বলে দ্বিতীয় পৃচ্ছক-এর মুখোমুখি হলেন এবং কঠোপনিষদের ১০-১৩ স্তবক আবৃত্তি করলেন। তৃতীয় পৃচ্ছক-এর জন্য তিনি কবিতার দুটি পঙক্তি রচনা করলেন এবং এইভাবে উত্তর দিতে দিতে সঠিক সময়ে আবার ফিরে এলেন প্রথম পৃচ্ছক-এর কাছে। কাজটি অত্যন্ত কঠিন। অবধানীর কাছে একটুকরো কাগজ বা পেন্সিলও থাকবে না। মানসিক একাগ্রতার সাহায্যে তিনি সমস্ত বিষয় একত্রে মনে রাখেন ও কোনটারই খেই হারিয়ে ফেলেন না। দর্শকদের মধ্যে থেকেও আসে বিক্ষিপ্ত প্রশ্ন। হয়তো কেউ একটি ২০ অংকের সংখ্যা বললেন, ‘পৃচ্ছক’ সেটিকে আরও জটিল করবার জন্য অংকগুলিকে বিপরীত ক্রমে সাজিয়ে দিলেন। এইভাবে বিভিন্ন সংখ্যা সংগ্রহ করে একটি ছক তৈরি করা হল যেটি অবধানী চোখেও দেখবেন না, কিন্তু এমন ভাবে তাঁর মৌখিক নির্দেশে অংকগুলি সাজানো হবে যে অনুষ্ঠানের শেষে মিলিয়ে দেখা যাবে প্রত্যেক স্তম্ভের অংকগুলির সমষ্টি যোগফল অভিন্ন—না দেখলে বিশ্বাস হয় না এমনও সম্ভব!

ভারতের এক প্রাচীন কলা বা বিদ্যা হল অষ্টাবধান—লাঠিখেলা, মার্শাল আর্ট প্রভৃতির মতো এই কলাও এখন বিলুপ্তির পথে। সংস্কৃতে ‘অবধানম্’-এর অর্থ হল—মানসিক একাগ্রতা, সহজ ভাষায় মনোযোগ, ডাক্তারি পরিভাষায় ‘অ্যাটেনশন’। এই কলার প্রদর্শক, ‘কলাবাজ’, বা ‘অবধানী’-র বিশেষ পারদর্শিতা অনন্যসাধারণ একাগ্রতা, একসঙ্গে বহু বিষয়ে সচ্ছন্দে বিচরণ ক্ষমতা (মাল্টিটাস্কিং), যে কোনও বিষয় দ্রুত অনুধাবন করার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং বহু বিষয়ে অগাধ জ্ঞান। অবধানী একই সময়ে তাঁর অখণ্ড মনোযোগকে যেন বহু খণ্ডে বিভক্ত করে (ডিভাইডেড অ্যাটেনশন) একসঙ্গে আটটি বিষয়ে মনঃসংযোগ করবেন এবং তাঁর ক্ষমতা পরীক্ষা করবেন আটজন (অষ্টাবধান), দশজন (দশাবধান), একশোজন (শতাবধান) কিম্বা সহস্রজন (সহস্রাবধান) ‘পৃচ্ছক’, অর্থাৎ, প্রশ্নকর্তা। প্রাচীনকালে এই কলা বংশপরম্পরায় পিতার কাছ থেকে পুত্র লাভ করতেন এবং অগণিত মানুষের চোখের সামনে প্রদর্শন করে জনতাকে মুগ্ধ করে প্রমাণ করতেন, মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই!

শোনা যায় এই কলার উদ্ভব খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে, কিন্তু প্রাচীনতম অবধানমের লিখিত নথিটি ১২০০ খ্রিস্টাব্দের, কণ্ণড়ভাষায় প্রাপ্ত। সাহিত্য-অবধানমের পরম্পরা সংস্কৃত, তামিল, গুজরাটি, হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় প্রচলিত হলেও, এই কলার সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ ঘটেছে তেলেগু ও কণ্ণড়ভাষীদের মধ্যে। এছাড়াও আছে সঙ্গীতাবধান, নৃত্যাবধান ও চিত্রাবধান।

জৈনদের মধ্যে বহু বিখ্যাত অবধানী মুঘল বাদশা ও তাঁর সুবেদারদের কলা প্রদর্শন করতেন। জৈন-সন্ত বিজয়সেন সূরীর শিষ্য নন্দীবিজয়-এর ‘অষ্টাবধান’ প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট আকবর তাঁকে ‘খুশফাম্’ (অত্যন্ত বুদ্ধিমান) উপাধি দেন। জৈন-সন্ত হীরাবিজয় সূরীর শিষ্য ‘শতাবধানী’ সিদ্ধিচন্দ্রও একাদিক্রমে ১০৮ প্রকার দুরূহ বিষয় প্রদর্শন দ্বারা আকবরকে খুশী করে ‘খুশফাম্’ উপাধি লাভ করেন। সিদ্ধিচন্দ্রের প্রতিভায় মুগ্ধ সম্রাট তাঁকে কলা প্রদর্শনের জন্য দিল্লীর দরবারে পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন এবং তিনিও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল পর্যন্ত মুঘল রাজ-দরবারে থেকে যান। সপ্তদশ শতকে, দিল্লীতে আওরঙ্গজেবের শাসনকালে গুজরাটের সুবেদার ছিলেন মোহাব্বত খান। তাঁর আহমেদাবাদের দরবারে ‘অষ্টাবধান’ প্রদর্শন করতেন যশোবিজয় সূরী, যাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ, ‘জৈন তর্ক ভাষা’।

উনিশ ও বিশ শতকে তেলেগুভাষীদের মধ্যে অবধানম্ কলা জনপ্রিয় করে তোলেন দিবাকরলা তিরুপতি শাস্ত্রী ও চেলাপিল্লা ভেঙ্কট শাস্ত্রী। তাঁরা তিরুপতি-ভেঙ্কট-কবুলু নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এঁদের সমসাময়িকদের মধ্যে অবধানম্-এর ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন দ্রুত কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত কোপ্পারাপ্পু। জ্ঞানপীঠ সাহিত্য পুরস্কার-বিজয়ী বিশ্বনাথ সত্যনারায়ণ ছিলেন তিরুপতির ছাত্র। উল্লেখযোগ্য শতাবধানী তামিল কবি, পণ্ডিত ও স্বাধীনতা সংগ্রামী শেখ থাম্বি পাবালার নাম। ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮ তাঁর সম্মানার্থে একটি পোস্টেজ স্ট্যাম্প ইস্যু করা হয়েছিল। গুজরাটি জৈন কবি, শতাবধানী রায়চাঁদ ভাই-এর প্রতিভায় মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। ব্রিটিশ শাসনকালে প্রথম ভারতীয় জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট, অন্ধ্রপ্রদেশের বিদ্বান অম্বাতি সুব্বারাইয়া চেট্টির নামও ভারতীয় ইতিহাস, সাহিত্য ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদানের সঙ্গে সঙ্গে অবধানী হিসাবেও স্মরণীয়।

বর্তমান অবধানীদের মধ্যে ডঃ মেধসানি মোহন, কবিতা প্রসাদ রল্লাবন্দি (অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারী সংস্কৃতি বিভাগের সেক্রেটারি), শ্রী বাদ্দিপার্তি পদ্মকর, কনগা সুব্বুরাথিনাম, শতাবধানী ডঃ আর গণেশ প্রমুখ বিখ্যাত। ১৮ ফেব্রুয়ারি-২০ মার্চ (২০০৭) পর্যন্ত ৩০ দিন ব্যাপী ‘অপূর্ব পঞ্চসহস্র অবধানম্’ অনুষ্ঠানে ডঃ মেধসানি মোহন প্রদর্শিত কলা সর্বকালের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। অনুষ্ঠান চলাকালীন প্রায় ১০০০ পৃচ্ছকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি অস্পৃশ্যতা, এইডস-রোগ, নারীশক্তি, ইন্টারনেট, কম্প্যুটার, ছাত্রসমাজ ইত্যাদি জরুরি বিষয়বস্তুর উপর বিভিন্ন প্রকার তাৎক্ষণিক-পদ্য পেশ করেছেন, যেমন- শীষ পদ্য, চম্পকমালা, শার্দূলম্, থিতগীত প্রভৃতি। স্বদেশে ও বিদেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি কলা প্রদর্শন করেছেন। ডঃ গণেশ দেশী-বিদেশী প্রায় ১৮টি ভাষায় পারঙ্গম, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ তিনি তাঁর ১০০০ তম অবধানম্ প্রদর্শন সম্পূর্ণ করেছেন। ‘হিউম্যান কম্প্যুটার’ আখ্যা প্রাপ্ত, ‘প্রেক্ষা মেডিটেশ’’-এর উপদেষ্টা, জৈন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক মুনি মহেন্দ্র কুমার বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শতাবধান প্রদর্শন ও ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০-এর উপরে, যার মধ্যে ‘দ্য এনিগমা অব দ্য ইউনিভার্স’, ‘বিশ্ব প্রহেলিকা’, প্রভৃতি বিখ্যাত।

আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতিতে বিশ্ব এই অমূল্য বিদ্যাটি সম্পূর্ণ ভুলতে বসেছে। একবিংশ শতাব্দির কম্প্যুটার যে কাজ করছে, পঞ্চদশ শতাব্দির একজন ‘অবধানী’ সেই কাজে পারদর্শী ছিল। একজন ‘অবধানী’র সাহিত্য, সঙ্গীত, কাব্য, নাট্যশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ, ন্যায় ও আরও বহু বিষয়ে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। অবধানী পিতা নিজ পুত্রকন্যাদের শৈশব থেকেই নানা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় রীতিতে শ্রুত বিষয় স্মৃতিতে ধরে রাখবার প্রশিক্ষণ দিতেন। এখন ভারতের একমাত্র কর্ণাটক ও অন্ধ্রের কয়েকটি স্থান ছাড়া অন্য কোথাও এই কলার চর্চা দেখা যায় না।

আমার এই প্রাচীন কলা প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮, বিবেকানন্দ সভাগৃহে এবং পুনরায় বেলুড় মঠ প্রাঙ্গনে শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮৩ তম জন্মোৎসব উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের অঙ্গরূপে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮-তে এই অনুষ্ঠান হয় । RKMVERI-র সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক, বিদ্বান ডঃ ভেঙ্কটরমণ ভাট, এই কলায় বিশেষ পারদর্শী, ছিলেন ‘অবধানী’-র ভূমিকায়। ১৯ বছর বয়স থেকে তিনি কলা প্রদর্শন আরম্ভ করেন এবং সংস্কৃত ভাষায় প্রায় ১৬০ বার ও কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় ভাষায় প্রায় ১৫০ বার তিনি অষ্টাবধান কলা প্রদর্শন করেছেন। পৃচ্ছকদের মধ্যে নানা বিভাগে অংশগ্রহণ করেছিলেন ডঃ উমেশ নেপাল (নিষেধাক্ষরী), ডঃ বিশ্বনাথ ধিতাল (দত্তপদী), স্বামী বেদার্থানন্দ (সমস্যা), ডঃ গোপীকৃষ্ণ রেঘু (চিত্রকাব্যম্), ডঃ নাগরাজ ভাট (‘অপ্রস্তুত প্রসঙ্গী), ডঃ তন্ময় কুমার ভট্টাচার্য (কাব্যবাচনম্), ডঃ নীরজ কুমার ভার্গব (আশুপদ্যম্), শ্রী সান্তনু আয়াছিত (সংখ্যাবন্ধঃ)।

দুপুর ১-৪ টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানে চোখের পাতা ফেলতেও আফশোস হচ্ছিল! দেখছিলাম, মানুষ কিভাবে হয়ে উঠতে পারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিওয়ালা সুপার-ডুপার কম্প্যুটার। কেবল মনে হচ্ছিল, এই আমাদের ভারতবর্ষ, এই আমাদের ঐতিহ্য! আর আমরা কিনা সর্বস্ব ভুলতে বসেছি! কোন বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ একাগ্র হওয়ার ক্ষমতা, বহু বিষয়ে এককালে মনোযোগ দেওয়া ও নিখুঁত কর্মসম্পাদনের কৌশল— যা এককালে অনায়াস ছিল, অত্যধিক যন্ত্র-নির্ভরতার ফলে সেসব আজ আমরা খোয়াতে বসেছি। শ্রুতি বলেন, ‘সর্বং পরবশং দুঃখম্’, নিরন্তর অত্যাধুনিক গ্যাজেট নির্ভরতার পরিণামে আমরা ক্রমশ ভুলছি অনেক দরকারী ও তথ্য ও কাজের বিষয়, যেগুলো হয়তো কয়েকবছর আগেও অনায়াস ছিল, অনভ্যাসের ফলে এখন তাইই ঝামেলা বলে মনে হচ্ছে এবং কোন কারণে যন্ত্র বিকল হলে, হারিয়ে গেলে অসহায় বোধ করছি, যার থেকে জন্ম নিচ্ছে অস্থিরতা, হতাশা, স্মৃতি-হ্রাস ও নানা মানসিক রোগ। নিজের ব্যক্তিগত তথ্য চুরী হয়ে যাচ্ছে এবং তার থেকে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা ও বিপদের সম্ভাবনা। সাইবার ক্রাইমের নতুন নতুন কলাকৌশল সমগ্র বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। অথচ আমরা চাইলে সম্পূর্ণ যন্ত্র/অ্যাপ/গ্যাজেট নির্ভরতা ছাড়াও জীবন হতে পারে সরল ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও শান্তির। একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের শিখর-স্পর্শী সাফল্যকে জয়মালা অবশ্যই পরাবো, সেইসঙ্গে এটাও ভুলে যাব না যে, আমরা অমৃতের পুত্রকন্যা, অনন্ত ক্ষমতা, অসীম সম্ভাবনা আমাদেরই অন্তরে নিহিত! একবিংশ শতাব্দীর এই ভয়াবহ ‘অ্যাপ’ নির্ভরতার যুগে আমাদের দৈহিক ও মানসিক সর্বাঙ্গীণ শান্তি ও সুস্থতার জন্য নতুন প্রজন্মকে আরও একবার এই প্রাচীন কলার সঙ্গে পরিচিত করাবার একান্ত প্রয়োজন, যা সম্ভব হবে বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাচীন ভারতীয় কলার পুনরুদ্ধার, প্রশিক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *