prabandho-banglar-pratham-char-nari-kobi

বাংলার প্রথম চার নারী কবি
পূরবী বসু

বাংলা ভাষার তথা সমগ্র বাংলার আদি নারী কবি বলতে আজো খণা, রামী, মাধবী ও চন্দ্রাবতীকে বোঝালেও কেবল বাংলাদেশ বা পূর্ববাংলার প্রথম নারী কবি কে এ প্রশ্ন করলে এককভাবে এবং অত্যন্ত পরিস্কার ও দ্বিধাহীনভাবে একজন নারী কবিকে শনাক্ত করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি হলেন কিশোরগঞ্জের চন্দ্রাবতী। অনেকের ধারণা, বাংলা সাহিত্যেরই প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী।

কিন্তু নানা সূত্রমতে এই তথ্যটি পুরোপুরি সঠিক নয়। বাংলা সাহিত্যের ১) প্রথম নারী কবি খনা (যদি কেবল কিংবদন্তিতে নয়, বাস্তবেও খনা নাম্নী কোন নারী কবি থেকে থাকেন যিনি পরিবেশবাদী এবং বহু বচন লিখে গেছেন*), ২) দ্বিতীয় নারী কবি চতুর্দশ শতকের রামমণি বা রামী রজকিনী, বিখ্যাত কবি চন্ডীদাস যাঁর প্রেমে উতলা হয়ে জগৎ-সংসার ভুলে গিয়েছিলেন, ৩) তৃতীয় নারী কবি পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক মাধবী (দাসী) এবং ৪) চতুর্থ নারী কবি ষোড়ষ শতকের মঙ্গল কাব্য রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী।

বাংলার প্রথম নারী কবি বলে খ্যাত খনার জন্ম ও কর্মবৃত্তান্ত নিয়ে, তাঁর স্থান-কাল-পাত্র নিয়ে এতো বেশি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে যে আজকাল অনেক গবেষক সন্দেহ পোষন করেন খনার বচনের রচয়িতা খনা নামের কোন বঙ্গ ললনা প্রকৃত অর্থেই একজন রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন কিনা, নাকি এটি কল্পনা এবং লোকজসমাজের সম্মিলিত কন্ঠই খনা নামে আবির্ভূত হয়েছিল।

এমনো হতে পারে, খনা নামের সম্ভবাময় সৃষ্টিশীল এক নারীর অস্তিত্ব ছিল যিনি কিছু প্রাজ্ঞ বচন লিখেছিলেন কিন্তু তার বচনের সঙ্গে এসে মিশেছে গ্রামীণ অন্যনারীপুরুষের এক-ই ধরণের এক-ই ঢং-এর বহু প্রবচণ যা মিলিতভাবে খনার বচন বলেই পরিচিত। বহু অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দ্বারা পরীক্ষিত ওনেক বাণী সম্মিলিতভাবে খনার বচন বলে প্রখ্যাত হয়ে আছে। খনার কালকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায় না। বলা হয় অষ্টম থেকে বার শতকের মাঝখানের একটি সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন জনপ্রিয় পল্লী বচন রচয়িতা বিশেষ করে কৃষি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে। কিন্তু বরাহ, খনার পরম ক্ষমতাধর শ্বশুর একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। খনার শ্বশুর যদি বরাহ হয়ে থাকে এবং তার জন্ম যদি কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে ঘটে থাকে, খনার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তো জন্ম নেবেই। খনার সময়ে বাংলায় বর্ণমালা ও লিখিত সাহিত্য না থাকায় লোকে মুখে মুখেই কবিতা, ছড়া বানাতেন। সাহিত্যের লিখিত ফর্ম ছিল না। ফলে খনার ভাষা পড়ে আমাদের এক হাজার বছরের পুরনো ভাষা মনে না হলেও আমরা বুঝতে পারি প্রজন্মে প্রুজন্মে খনার বচনের ভাষান্তর ঘটেছে, বক্তব্যের তেমন হেরফের না ঘটিয়ে। নিচে কয়েকটি কৃষি সংক্রান্ত খনার বচনের উদাহরণ দিলাম।

যদি বর্ষে মাঘের শেষ

ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।।

দিনে রোদ রাতে জল

দিন দিন বাড়ে ধানের বল।

আউশের ভুঁই বেলে

পাটের ভুঁই আঁটালে

ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা

তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।

ওদিকে এর বাইরে আরো দুজনের কথা এসে যায়। যাঁরা চন্দ্রাবতীরও আগে জন্ম নিয়েছেন। যদিও তাঁর বিষয়ে সব পণ্ডিত একমত নন তবুও তাঁদের অস্বীকার করা যায় না। কারণ, তাঁদেরও কিছু কবিতা, ভণিতা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এই কবিদ্বয়ের নাম রামী ও মাধবী। রামীর আগেও দুই একজন মহিলা কবির ভণিতা পাওয়া যায়, তবে সেগুলো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ নয়।

এই রামীকে আমরা অনেকেই জানি। চতুর্দশ শতকের কবি। আসলেই তাঁর বিষয়ে প্রায় সকলেই অবগত আমরা। তবে, ভিন্নভাবে- তাঁর লিখিত কবিতার জন্যে নয়। রামীর সঙ্গে চণ্ডীদাসের স্মৃতি জড়িত রয়েছে। চণ্ডীদাস–রজকিনীর প্রেমের কাহিনি জানেন না, বাংলায় এমন লোক পাওয়াটা বিরলই বটে। প্রেমের মড়া জলে ডোবে না, এই গান শোনেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। এই গানেই দুচরণ হচ্ছে, চণ্ডীদাস আর রজকিনী, তাঁরাই প্রেমের শিরোমণিগো। হ্যাঁ, এই রজকিনীই হচ্ছেন কবি রামী।

নিরক্ষর রামী (পুরো নাম রামমনি) চতুর্দশ শতাব্দীর কবি বলে পরিচিত। যেহেতু চন্ডীদাস প্রেমিকা রামী নিরক্ষর ছিলেন, তিনি হয়তো মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন যা অন্যেরা পরে বাংলা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কিন্তু তাঁর একটি বা দু’টি মাত্র কবিতা যা পাওয়া যায়, তার ভাষা ঠিক চতুর্দশ শতাব্দীর নয়। বর্ধমান জেলার বাঁশুলী দেবীর মন্দিরে পূজারী চন্ডীদাস। কেউ কেউ বলেন, কবি চন্দীদাস। কেউ বলেন কবি চন্ডীদাস আর বড়ু চন্ডীদাস এক-ই ব্যক্তি এবং তার সঙ্গেই রামীর নাম যোগ করা হয়। দ্বিজ চণ্ডীদাসের সাথেই রজকিনী রামীর প্রেম ছিলো বলে বেশির ভাগ লোকের বিশ্বাস। মানে এই কবি চন্ডীদাস আর বড়ু চন্ডীদাস এক-ই ব্যক্তি বলে মানতেন অনেকে। যেমন আঠারো শতকের গোড়ার দিকের তরুণীরমণ নামের এক কবি। তাঁর ‘সহজ সাধনাতত্ত্ব‘ নামে একটি ছোট গ্রন্থে বড়ু চণ্ডীদাস ও রামীর প্রেম কাহিনির কথাও রয়েছে।

চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে রামীর রচিত একটি গীতিকা আবিষ্কৃত হয়। এ সম্বন্ধে দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে প্রায় দুইশত বৎসরের প্রাচীন হস্তলিপি সম্বলিত একটি প্রমাণ বসন্ত বাবু আবিষ্কার করেছেন যা রামীর রচিত একটি গীতিকা।

কাঁহা গেয়ো বন্ধু চন্ডীদাস!
চাতকী পিয়ারীগণ না পাইয়া বরিষন
না আনেরনাগরে নিয়াস
কী করিল রাজা গৌরেশ্বর!

কোঁথা যাও ওহে, প্রাণ বঁধূ মোর,
দাসীরে উপেক্ষা করি।
না দেখিয়া মুখ, ফাটে
মোর বুক ধৈর্য ধরিতে নারি।
–চন্ডীদাসের মৃত্যু

একটা কথা মনে রাখা দরকার। মধ্যযুগে বেশ কয়েকজন চন্ডীদাস রয়েছেন। কবি চন্ডীদাস, চন্ডীদাস, বড়ু চন্ডীদাস ও দ্বিজ চন্ডীদাস। খুব সম্বভত তাঁরা প্রত্যেকে আলাদা। আবার কোন কোন ঘটনা বা সময়ের বর্ননায় একজনের কথা আরেকজনের সঙ্গে মিশে গেছে।

রামী ছোটবেলা থেকে বাঁশু মন্দিরের সেবিকা। জাতে ধোপা বা রজকিনী। চন্ডীদাসের সঙ্গে রামীর কাম-গন্ধহীন একটি অতি ঘনিষ্ঠ মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রামী ছিলেন নিরক্ষর। তিনি মুখে মুখে যে কবিতা রচনা করতেন, অন্যরা তাঁর হয়ে তা লিখে রাখতেন। একবার গৌড়ের নবাবের আমন্ত্রণে কবি চন্ডীদাস গৌর যান নবাবকে গান ও কবিতা শোনাতে। সেখানে নবাবপত্নী চন্ডীদাসের অনুরাগিনী হয়ে পড়েন। চন্ডীদাসের প্রতি তাঁর প্রেম এতো তীব্র, যে নবাবপত্নী স্বামীকেও তা জানাতে কুন্ঠাবোধ করেন না। ফলশ্রুতিতে গৌড়ের নবাবের আদেশে চন্ডীদাসকে হাতীর শরীরের সঙ্গে বাঁধা হয়। তারপর ছুটন্ত হাতীর সঙ্গে বাঁধা চন্ডীদাসকে অনেকে মিলে কঠিন কষাঘাত করতে করতে হত্যা করা হয়। আর এই নিষ্ঠুর দৃশ্য রামী এবং নবাবপত্নীকে দেখতে বাধ্য করা হয়। নবাবপত্নী সঙ্গে সঙ্গে মূর্চ্ছা যান এবং তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। আর রজকিনী পদ লেখেন “চন্ডীদাসের মৃত্যু”। চন্ডীদাসের মৃত্যু পদটি দীনেশ চন্দ্র সেনের ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত “বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য” গ্রন্থের ২১৭ পৃষ্ঠায় সংযুক্ত করা হিয়েছে। এই ভণিতাযুক্ত গীতিমালা আবিষ্কার করেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ বল্লভ (১৮৬৫-১৯৫২)। এর ভাষা ঠিক চত্তুর্দশ শতাব্দীর ভাষা নয়। এই ভাষা অষ্টাদশ শতাব্দীর ভাষা। যেহেতু রামী নিজে লেখাপড়া জানতেন না, তার মুখে মুখে রচিত পদাবলি অন্যরা লিখে রেখেছেন, ভাষার পরিবর্তন ঘটেছে বেশ খানিকটাই সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। তবে এখন যেহেতু এসব তথ্য নির্ভয়ে প্রাতিষ্ঠানিক তত্বাবধানে সংরক্ষিত আছে এসবের আর পরিবর্তন ঘটবে না। “বঙ্গের মহিলা কবি” গ্রন্থের রচয়িতা যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলেন, “একটি দেশব্যাপি জনশ্রুতি যখন দুই শত বছরের প্রাচীন হস্তলিপি সম্বলিত প্রমান দ্বরা সমর্থিত হইতেছে, তখন তাহা আমরা ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে বাধা দেখিতেছি না।“

ওদিকে পঞ্চদশ শতাব্দীর নারী কবি মাধবী দাসী সম্পর্কেও বেশি কিছু জানা যায় না। তবে কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শোনা যায় তিনি শ্রী চৈতন্যের কাছে পুরীতে দীক্ষা নিয়েছিলেন ১৫০৯ খৃষ্টাব্দে। কিন্তু আসল সত্য হলো ১৫০৯ সালের পরে চৈতন্যদেব প্রথম বারের মতো পুরী যান। তবে সালটা সঠিক না হলেও এটা সত্য মাধবী চৈতন্যের শিষ্যা ছিলেন। নীলাচল বা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের হিসাব রক্ষক বা লিপিকরের নাম ছিল মাহিতি। মাহিতির বোন ছিল মাধবী দাসী। অন্যদলের বদ্ধ ধারণা হিসাবরক্ষক মাহিতির বোন ছিল না মাধবী। একবার চৈতন্যদেব তার এক শিষ্যের বাড়িতে মধাহ্ন গ্রহণ করতে গেলে বাড়ির কর্তা তার ছোটভাই হরিদাসকে দিয়ে মাধবীর কাছ থেকে সুগন্ধি চাল এনে দেন গুরুদেবের জন্যে। সেই ভাত খেতে খেতে চৈতন্যদেব জানতে চান কোথা থেকে এসেছে সে চাল। হরিদাস তা বলতে বাধ্য হয়। হরিদাস একজন মেয়েজাতির মানুষের অন্ন এনে তাকে খাইয়েছে এই অপরাধ চৈতন্যদেব সারাজীবনের জন্যে হরিদাসকে ক্ষমা করতে পারবেন না বলেন। বিষন্ন হরিদাস তখন জলে ডুবে আত্মহত্যা করেন। চৈতন্যদেন পুরী থাকার সময় মাধবী পুরী ছিলেন। পরে মাধুরীকে কাছে থেকে জানার সুযোগ হয় চন্ডীদাসের। মাধবীর জ্ঞান, বুদ্ধি ও ভক্তি দেখে চৈতন্য দেব তাকে দীক্ষা দেন।

“মাহিতির ভগিনীর নাম বোনের নাম মাধবী দেবী

বৃদ্ধা তপস্বিনী আর পরম বৈষ্ণবী’।

নারী বলিয়া জন্মগ্রহণকারী মাধবীর দুঃখ, শ্রী প্রভুর বদনও ভালো করে দেখতে পান না মাধবী। দূঃখ করে বলেন তাই,

যে দেখায়ে গোরা–মুখ সেই প্রেমে ভাসে

মাধবী বঞ্চিত হৈল নিজ কর্ম্মদোষে

তবে মাধবীর সত্যিকার পরিচয় নিয়ে এখনো সংশয় আছে। সময় নিয়েও বিস্তর কথা ওঠে । দীক্ষা নেবার সময় আর চৈতন্যদেবের পুরী যাবার তারিখের হেরফের ছাড়াও বিস্তর কথা ওঠে। কথিত নারী কবি মাধবী প্রকৃতপক্ষে নারী ছিলেন কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ পোষন করে গেছেন স্বয়ং সুকুমার সেন ও বর্তমান কালের সাহিত্য আলোচক সুমিতা চক্রবর্তী। তাঁর নাম বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে লক্ষ্য করা যায়; মাধবী, মাধবী দাসী, মাধব, শ্রীমাধব, মাধব দাস, দ্বিজ মাধব, দ্বিজ মাধব দাস, মাধাই, মাধব ঘোষ, মাধব আচার্য্য। এইরকম বহু নামে মাধবী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় পরিচিত ছিল।

সব কিছু মিলিয়ে নির্দ্বিধায় বলা চলে, যে প্রাচীনতম চারজন বাঙালি নারী কবির মধ্যে বাংলার যে নারী কবির অস্তিত্ব ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে কোনরকম বিতর্ক বা মতভেদ নেই, তিনি হলেন ষোড়শ শতাব্দীর বাংলাদেশের কবি চন্দ্রাবতী। সর্বপ্রথম নারী কবি হিসাবে চন্দ্রাবতীর যে সম্মান, তা অখন্ড বাংলায় খনা, রামী ও মাধবীর মতো কবির সম্ভাব্য উপস্থিতির জন্যে যদি পুরোপুরি নাও জোটে, বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি হিসেবে চন্দ্রাবতীর স্থান সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত, এবং পূর্ব বাংলার বৃষ্টি-ভেজা উর্বর ভূমিতে তা বহুকাল ধরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। ষোড়শ শতাব্দী বা তার আগে চন্দ্রাবতীর মতো উঁচু মাপের নারী কবির আর অস্তিত্ব ছিল না।

ষোড়শ শতকের মনসা মঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের একমাত্র আদরের কন্যা চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬০০)। চন্দ্রাবতীর মায়ের নাম সুলোচনা। বিখ্যাত কবি বাবা দ্বিজ বংশীদাস পদ্মপুরাণ এবং মনসামঙ্গলের রচয়িতা। তিনি ভাসান গানের দল নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতেন। সুকুমার সেন তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের কথায় লিখেছেন, “পূর্ববঙ্গে রচিত বিস্তর মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া গিয়াছে। সে সবগুলির মধ্যে বংশীবদনের কাব্যই শ্রেষ্ঠ। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হইয়াও বংশীবদন কোথাও অযথা পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করিতে চেষ্টা করেন নাই। অপরদিকে, ইহার কাব্য গ্রাম্যতা দোষ হইতে একেবারে মুক্ত।“ উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার কবিত্ব শক্তি লাভ করেছিলেন চন্দ্রাবতী।

চন্দ্রাবতী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ফরিদ আহমেদ “মুক্তমনা”য় লিখেছেন “এই বাংলায় তাঁর উপস্থিতি ঘটেছিল কয়েকশ বছর আগে। চন্দ্রকান্তিময় সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। তবে তাঁর প্রীতিমনোহররূপের জন্য নয়, বরং নিজস্ব প্রতিভার জন্যই আজো প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। শশীকলাময় সৌন্দর্যের এই মানুষটি একজন কবি। নাম চন্দ্রাবতী। কবি চন্দ্রাবতী নামেই সুবিখ্যাত তিনি।“

দ্বিজ বংশীদাস কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখা মনসামঙ্গল ১৫৭৫ সালের দিকে শেষ হয়। কথিত আছে যে, মনসামঙ্গল রচনায় বংশীবদন চন্দ্রাবতীর সাহায্য পেয়েছিলেন। মনসামঙ্গল রচনার সময়ে চন্দ্রাবতীর বয়স কমপক্ষে পঁচিশ ছিল। কুল কুল করে বয়ে যাওয়া টলটলে স্বচ্ছ জলের ফুলেশ্বরীর তীরে অপূর্ব শ্যামল নিসর্গের কোলে বেড়ে ওঠা চন্দ্রাবতী কেবল পরমা সুন্দরীই ছিলেন না, অসাধারণ প্রতিভাময়ী এক কবি ছিলেন। অত্যন্ত স্পর্শকাতর রোমান্টিক মনের অধিকারী ছিলেন তিনি।

তাঁর রচনাগুলির মধ্যে মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা ও রামায়ণ কথা অন্যতম৷ রামায়ন কথা যা তিনি পিতার পরামর্শে বাংলাতে লিখতে শুরু করেছিলেন, এক ভিন্ন ধরণের রামায়ন। এটি মূল রামায়নের অনুবাদ নয়। বরং নারীবাদী দৃষ্টিকোন থেকে লেখা এই রামায়নে সীতার প্রতি অবিচার এবং তার মর্মবেদনা অত্যন্ত দরদের সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে। চন্দ্রাবতীর স্বহস্তে লিখিত রামায়নের পান্ডুলিপিটি এখনো সযত্নে রক্ষিত রয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মৈয়মনসিংহ গীতিকায় তার কথা পাওয়া যায় ৷ তাঁর নিজের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা “চন্দ্রাবতী” শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে৷

দ্বিজ বংশীদাসের মনসার ভাসান গান চন্দ্রাবতীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক স্বপ্নের কল্পনা-সাগরে। পিতার সঙ্গে চন্দ্রাবতী রচনা করেন মনসার ভাসান গান। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে চোখ-জুড়ানো, শান্ত নিরিবিলি নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপূর বিল ঝিল, নদীনালা, পুকুর-দিঘি আর প্রকান্ড বৃক্ষের শ্যামল ছায়ার সবুজ শান্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠেন চন্দ্রাবতী। প্রেম বিরহগাঁথা, বৈষম্য, অবিচার চন্দ্রাবতীর গীতিকা-সাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। রামায়নের বাংলা অনুবাদ ও তিনটি পালা রচনা শুধু নয়, অজস্র লোকগীতি রচনা করেন চন্দ্রাবতী। সাড়ে চার শ’ বছর আগে রচিত তাঁর পালাগান আজো বিভিন্ন আসরে শোনা যায়। পুজা অর্চণায় পাঠ হয় রামায়ন পালা, মলুয়া, দেওয়ান ভাবনা, কেনারাম দস্যু পালা ময়মনসিংহ গীতিকার অন্যান্য গীতিকা। ময়মনসিং গীতিকার আরেকটি উজ্জ্বল সৃষ্টি মহুয়া, নদের চাঁদ ও মহুয়ার সেই বিখ্যাত প্রেম কাহিনী।

চন্দ্রাবতীর জীবনের ইতিহাসটি বড় করুণ। বাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ নামে এক অনাথ বালক৷ জয়ানন্দের বাড়ি সুন্ধা গ্রামে৷ জয়ানন্দ তাঁর মাতুলগৃহে পালিত৷ দ্বিজ বংশীদাসের অনেক রচনায় চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ, দু’জনের-ই রচিত ছোট ছোট অনেক পদ রয়েছে৷ অপরূপা সুন্দরী ছিলেন চন্দ্রাবতী। বাল্যকাল থেকেই বাবার দেখাদেখি কবিতা লেখা শুরু করেন। গানও লিখতেন। শুধু লিখতেনই না, নিজেও গাইতেন। এত সব গুণের কারণে সম্ভ্রান্ত পরিবারের বহু ব্যক্তিই চন্দ্রাবতীকে বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রাবতী সেই ছেলেবেলাতেই মন দিয়ে বসে আছেন জয়ানন্দকে। তাই কারো দিকে আর নজর নেই তার। জয়ানন্দ ছিলেন চন্দ্রাবতীর জনম জনমের সাথী। বাল্যকাল থেকেই পরিচয় তাঁদের। দুজনেই এক সাথে পড়ালেখা করতেন, খেলা করতেন। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে প্রেমের বন্ধনে বাঁধা পড়েছেন দু’জনে। কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে তাদের পারস্পরিক অনুভব। দু’জন দু’জনকে কবিতা লিখে ভালবাসা জানাতেন। আর এভাবেই এক সময় দ্বিজ বংশীদাসের নিজস্ব বিষয়ের বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা শুরু করেন তাঁরা। কবি দ্বিজবংশীর পদ্মপুরাণে চন্দ্রাবতী এবং জয়ানন্দ, দুজনেরই কবিতা রয়েছে। কৈশোর উত্তীর্ন হলে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন শুধু তারা দুজনে নন, পরিবারবর্গ-ও।

জয়ানন্দকে ভালোবেসে তার কাছে হৃদয় সঁপে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ছিলেন চন্দ্রাবতী। তিনি নিজের মতো করেই জয়ানন্দকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু অন্যদিকে জয়ানন্দ যত-ই ভালোবাসুক চন্দ্রাবতীকে, একসঙ্গে বসে যতই কবিতা বা ছড়া বাঁধুক, দ্বিজ বংশীদাসকে তার মঙ্গল কাব্য রচনায় চন্দ্রাবতীর মতোই যত-ই প্রেরণা যোগাক, ছোটখাটো পঙতি দিয়ে সাহায্য করুক তাঁকে (সেসময় এই পদ্ধতি চালু ছিল। গুরু যদি তার গ্রন্থে শিষ্য রচিত কোন কাব্যকণা বা গদ্য খন্ড যুক্ত করেন, শিষ্যের জন্যে হয় সেটা বড়-ই পরিতৃপ্তির ব্যাপার – -সফলতার চিহ্ন।) তার কৌতুহলি হৃদয়, চোখ, কান সর্বদাই ধেয়ে বেড়াতো অন্য দিকে, তার চারপাশে। ফলে এক সময় গ্রামের আরেক সুন্দরী আসমানীকে চোখে ধরে জয়ানন্দের। পত্রমিতালী করে তার সঙ্গে। গান বাঁধে তার রূপের বর্ণনা করে জয়ানন্দ।

আসমানী (ডাক নাম কমলা) ছিলেন স্থানীয় মুসলমান সমাজনেতা বা কাজীর মেয়ে। আসমানীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে জয়ানন্দ আসমানীকে একাধিক প্রেমপত্র লেখেন৷ এক সময় এই ত্রিকোন প্রেমের ফলাফল হয়ে ওঠে মারাত্মক৷ জয়ানন্দের সাথে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা ও প্রস্তাবিত বিবাহের কথা জানা সত্বেও আসমানী তার পিতাকে জানান তিনি জয়ানন্দকেই বিবাহ করতে চান। কিন্তু তাদের ধর্মের ভিন্নতা বিয়েতে বাদ সাধে। এক সূত্র অনুযায়ী, কাজী জয়ানন্দকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসমানীর সঙ্গে তার বিবাহ দেন। ভিন্ন মত অনুযায়ী জয়ানন্দ নতুন প্রেমে এমনি মজেছিল, আসমানীর রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজের ইচ্ছেতেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সে আসমানীকে বিয়ে করেন, এবং সেটা করেন সেই সন্ধ্যাতেই যে সন্ধ্যায় তার বিয়ের কথা ছিল চন্দ্রাবতীর সঙ্গে, যখন বধুসাজে সজ্জিত হয়ে চন্দ্রাবতী তার আগমনের অপেক্ষায় কাল গুণছিল তার পিত্রালয়ে বসে। আর তখনই সংবাদ পান চন্দ্রাবতী, জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র বিবাহ করেছেন৷

প্রথমে তিনি তা অবিশ্বাস করেন। তারপরে উদ্ভাসিত সত্যের র্নিষ্ঠুর ও তীব্র আঘাতে অপমানিত হন। জয়ানন্দের প্রতি চন্দ্রাবতীর একনিষ্ঠ ভালোবাসা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। চন্দ্রাবতীর কোমল হৃদয় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। লুন্ঠিত হয় তার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। এরপর শুরু হয় চন্দ্রাবতীর বিরহবিধুর জীবন৷ তিনি পিতা দ্বিজ বংশীদাসের কাছে দুটি প্রার্থনা করেনঃ – এক ফুলেশ্বরী নদীর তীরে তাঁর আরাধনার জন্যে একটি শিব মন্দির স্থাপন করা হোক, অন্যটি হলো-তাঁর চিরকুমারী থাকার বাসনা। তিনি পিতার কাছে অনুমতি নেন যে সারা জীবন অবিবাহিত থেকে শিবের সাধনা করবেন৷ পিতা কন্যার অনুরোধ মতো দুটি ইচ্ছাই পূর্ণ করেন-

চন্দ্রবতী বলে ‘পিতা সম বাক্য ধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর॥
শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি।
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি’॥
অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
‘শিবপূজা কর আর লেখ রামায়নে’॥

ফুলেশ্বরী নদীর তীরে তাঁর পিতা তার জন্য একটি শিবের মন্দির নির্মান করিয়ে দেন৷ শিবমন্দির স্থাপনের পরে শিবপুজা আর বাংলায় রামায়ন লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন চন্দ্রাবতী। সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ চন্দ্রাবতীর কৈশোরকাল থেকেই ছিল। তিনি বাকী জীবন শিবের উপাসনা ও সাহিত্যচর্চা করে কাটিয়ে দেবেন বলে স্থির করেন।

এদিকে বেশ কিছুকাল পরে জয়ানন্দ বুঝতে পারেন যে, আসমানীর প্রতি তার টানটা ছিল মোহ মাত্র৷ আসমানীর অসামান্য রূপেই কেবল আকর্ষিত হয়েছিলেন জয়ানদ। মনের থেকে তিনি চন্দ্রাবতীকেই প্রকৃত ভালবাসেন৷ জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সঙ্গে কবিতা রচনার অভিজ্ঞতা ও গাছের ছায়ায় বসে কাব্যপাঠের আনন্দ ফিরে পেতে অস্থির হয়ে ওঠেন। স্থির করেন যে চন্দ্রাবতীকে তাঁর মনের কথা জানাবেন। বহুদিন আগে এক সন্ধ্যায় জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিচ্ছেদ হয়েছিল৷ তেমনি আরেক সন্ধ্যায় সেই বিচ্ছেদ মুছে গিয়ে মিলন হবে দুজনার এই আশায় জয়ানন্দ রওনা হলেন পাতুয়ারী গ্রামে৷ জয়ানন্দ যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন তখন সূর্য্যাস্ত হয়ে গেছে। দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষন তখন৷ শিব মন্দিরের ভেতর দরোজা বন্ধ করে সন্ধ্যারতি ও তপজপে নিমগ্ন ছিলেন চন্দ্রাবতী৷ জয়ানন্দ মন্দিরের দ্বারে এসে কয়েকবার ডাকলেন চন্দ্রাবতীকে৷ কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় সেই শব্দ প্রবেশ করল না চন্দ্রাবতীর কানে৷ ব্যর্থ প্রেমিক জয়ানন্দ তখন টুকটুকে লালরঙের সন্ধ্যামালতী ফুলের রস নিঙড়ে মন্দিরের প্রধান দরোজায় ছোট্ট একটি কবিতা লিখে চন্দ্রাবতীর কাছে আকুতি জানান তাদের আবাল্যকালীন প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ক্ষমা করে পুনরায় গ্রহণ করার জন্যেঃ
‘শৈশব কালের সঙ্গি তুমি যৌবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী’॥

কিন্তু অভিমানে, অপমানে জর্জরিত চন্দ্রাবতী মুখ ফিরিয়ে দেখেন না প্রাক্তন প্রেমিককে। মন্দিরে দরজা না খুলে একমনে শিবের ধ্যাণ করতে থাকেন। কোন সাড়া না পেয়ে জয়ানন্দ এই পরিচিত জগতকে চিরবিদায় জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন। না, অন্য কোথাও আর যান না জয়ানন্দ। মন্দিরের পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী নদীতে ডুবেই আত্মহত্যা করেন তিনি।

আরেক ভাষ্য মতে, চন্দ্রাবতীকে এক নজর দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন জয়ানন্দ। পিতার অনুমতি না থাকায় চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে সাক্ষাৎ দিতে পারেননি। এই দেখা না করা বা পিতার সম্মতি না পাওয়া কি চন্দ্রাবতীর আত্মসম্মাণে আঘাত লাগার-ই বহিঃপ্রকাশ? নাকি মনোকষ্ট, অভিমান? নাকি জয়ানন্দ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করায় তখনকার সমাজে তাকে ফিরিয়ে নেবার উপায়হীনতা?

দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে ক্লান্ত জয়ানন্দের প্রস্থানের অনেক পরে মন্দির থেকে বেরিয়ে চন্দ্রাবতী কলসী কাঁখে জল আনতে যান পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী (স্থানীয় নাম ফুলিয়া) নদীতে ৷ ঘাটে পৌঁছেই চন্দ্রাবতী বুঝলেন সব শেষ হয়ে গেছে৷ ফুলেশ্বরীর জলে নিজেকে সঁপে দিয়েই প্রাণত্যাগ করেছেন জয়ানন্দ৷ তার প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে৷ এই অবস্থায় নিজের আবেগ, নিজের অন্তহীন বেদনা ধরে রাখতে পারলেন না চন্দ্রাবতী৷ তিনিও প্রেমিকের সাথে পরলোকে চিরমিলনের আশায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন। অবশ্য অন্যরা বলেন, জয়ানন্দ মারা যাবার পরেও বেশ কিছুদিন বেঁচেছিলেন চন্দ্রাবতী এবং তার স্বাভাবিক মৃত্যু-ই ঘটেছিল পঞ্চাশ বছর বয়সে। আবার কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বংশীদাস-কন্যা চন্দ্রাবতী।

ফলে দেখাই যাচ্ছে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে সবাই একমত নন। এ ব্যাপারেও মতানৈক্য রয়েছে। নয়ানচাঁদ নিজেও তাঁর চন্দ্রাবতী পালাগানে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেন নাই। কারো কারো মতে নদীর ঘাটে জলে মৃত অবস্থায় জয়ানন্দের লাশ ভাসতে দেখে তীব্র অনুশোচনায় চন্দ্রাবতীও ফুলেশ্বরী নদীর জলে ঝাঁপিয়ে জয়ানন্দের অনুগামী হন, তবে সঙ্গে সঙ্গে নয়, কিছু পরে। আবার কারো মতে, জয়ানন্দের জলে ডুবে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কিছুদিন পরপরই মর্মান্তিক আঘাত প্রাপ্ত শোকাবিভূত চন্দ্রাবতী স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। দীনেশ চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন, “প্রবাদ এই যে, প্রেমাহতা চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শিব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদরোগে লীলা সংবরণ করেন।“

ব্রজেন্দ্রকুমার দে তাঁর মঞ্চনাটক ‘কবি চন্দ্রাবতী’-তে দেখিয়েছেন যে, শোক এবং অপমান থেকে বাঁচার জন্য চন্দ্রাবতী নিজেই গিয়ে ফুলেশ্বরীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত যেভাবেই তাঁর মৃত্যু হোক না কেন, মানসিকভাবে গভীর আঘাত পেয়ে তীব্র মনোযাতনায় যে এই অসামান্য প্রতিভাবান বাংলাদেশের প্রথম নারী কবির মৃত্যু হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর মত দুঃখের জীবন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। নিজেকে ধূপের মত পুড়িয়ে তিনি যে কাব্যগাথা, অসাধারণ পালাগান পরিবেশন করে গিয়েছেন তার খবর শহুরে মানুষেরা ভালোমতো না জানলেও গ্রামের মানুষেরা তা ভোলে নি। তাঁদের মুখে মুখে তাঁর জীবনী ভিত্তিক পালাগান গীত ও অভিনীত হয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত। আর এভাবেই দুঃখিনী কবি চন্দ্রাবতী আজো বেঁচে আছেন বাংলাদেশের পল্লীহৃদয়ে – বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিং অঞ্চলে।

১৯১৬ সালে ময়মনসিংহের কবি চন্দ্রকুমার দে প্রথম সেই এলাকার প্রচলিত পালাগান বা গাথাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের উত্সাহে তা পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত পালা ময়মনসিংহ গীতিকা নামেই পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৬ নাগাদ ক্ষিতীশ মৌলিক (প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা) এই ময়মনসিংহের পালাগুলির আরও একটি সম্পাদিত রূপ প্রকাশ করেন। প্রকাশিত হবার পরেই এই গাথাগুলি রসিক সমাজে যথেষ্ট সমাদর লাভ করে। কাব্যগুণ, সহজ সরলতা, বাংলার পল্লীজীবনের রূপ, রস, গন্ধে সমৃদ্ধ এই সকল পালা, বাংলার লোক সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। তবে এগুলো আসলেই কত পুরাতন, সেই সম্পর্কে পণ্ডিতেরা এখনও সহমত পোষণ করতে পারেন নি। লোক সাহিত্য বলা হলেও এই পালাগুলির বিশেষ বিশেষ কবিদের লিখিত রচনা। তাই এগুলি কোন সমাজের সাধারণ সম্পত্তি নয়। লোকমুখে ফিরে ফিরে, সংগ্রাহক, সম্পাদক এবং প্রকাশকদের হাত পড়ে যে এগুলি নিজের প্রাচীনতা ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনেকটাই হারিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন – “বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী; কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বত উচ্ছ্বসিত উত্স, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্ম-বিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি।”

ময়মনসিংহ গীতিকা গুলিতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি সংস্কৃতিই দেখতে পাওয়া যায়। এদের বৈশিষ্ট হল এই যে প্রাচীন বাংলা সাহিত্য প্রধানত ধর্মাশ্রিত ও দেবদেবীকেন্দ্রিক হলেও ময়মনসিং গীতিকবিতার উপর ধর্মের প্রভাব খুবই অল্প। এগুলি অধিকাংশই প্রণয়মূলক। এদের মধ্যে ফুটে উঠেছে পূর্ববঙ্গের সহজ সরল পল্লী-জীবনের অপূর্ব আলেখ্য। এই পল্লী-জীবনের পটভূমিকায় বর্ণিত হয়েছে নায়ক নায়িকাদের প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি, তাদের প্রেম ভালবাসা-বিরহ। এছাড়া তখনকার পল্লীবাংলার দৈনন্দিন সমস্যা, গ্রামীণ জীবনের প্রকৃত অবস্থা এইসব গীতিকাগুলির মধ্যেই আমরা পেয়েছি। ঘণ ঘন সংক্রামক ব্যাধির উৎপাত, বন্যা, ফসল বিনষ্ট, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন হিসেবে শেষ পর্যন্ত হালের গরু, জায়গা জমিন বিক্রি বা বন্ধক দেয়া, তাতেও না কুলালে অবশেষে দেশান্তরী হবার মতো ঘটনা চন্দ্রাবতী লিখে গেছেন তার মলুয়া ও কেনারাম দস্যু পালার ছত্রে ছত্রে। আরো একটি বিষয় উল্লেখনীয় এখানে, আর সেটা হলো কতো অনায়াসে এক-ই কবিতায় হিন্দু ও মুসলমান সমাজে দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দ পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন তিনি, একদিকে দুর্গা পূজা, লক্ষ্মীর ভান্ডারের কথা বলছেন, অন্যদিকে, “দোয়া”, পানি, “ছাওয়াল” এর মতো শব্দ অতি স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে চন্দ্রাবতীরর কাব্যে। ষোড়শ শতাব্দীর এই কবি চন্দ্রাবতীর জীবনই কিংবদন্তী হয়ে “চন্দ্রাবতী” পালায় পর্যবসিত হয়েছে। তাঁর লেখা ‘রামায়ণ কথা’ একটি এমন রচনা যেখানে রামের গুণগানের বদলে সীতার দুঃখ দুর্দশাই তিনি বর্ণনা করেছেন। একজন নারীর দৃষ্টিতে এই মহাকাব্য রচণা স্বাভাবিকভাবেই পণ্ডিত সমাজে অবাঞ্ছিত বলেই তাকে দুর্বল ও অসমাপ্ত সাহিত্য আখ্যা দিয়ে গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছিল।

মলুয়াঃ মলুয়া পালা কবি চন্দ্রাবতীর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। এটি একটি লোককাহিনী। মলুয়া ছাড়াও চন্দ্রাবতী তার পিতা দ্বিজ বংশীদাসের সাথে পদ্মপুরাণের অংশ বিশেষ – অর্থাৎ মনসার ভাসান লিখেছিলেন, তাও ছিল লোককাহিনী। মলুয়ার কাহিনী এরকম। কিশোরগঞ্জ থেকে ২২ মাইল উত্তর-পূর্বে ভাদৈর নদীর তীরে আরালিয়া গ্রামে ছিল মলুয়ার বাড়ি। মলুয়ার স্বামী চাঁদ বিনোদের বাড়ি ছিল আরালিয়া থেকে ৪-৫ মাইল দূরে সুত্যা বিলের পাড়ে। চন্দ্রাবতী চাঁদ বিনোদের গাঁয়ের নাম উল্লেখ করেননি। চাঁদ বিনোদ এবং মলুয়ার প্রেম বিয়ে, বিয়ের পরে দুষমন কাজীর চক্রান্তে জাহাঙ্গীরপুর দেওয়ান বাড়িতে মলুয়ার কয়েক মাস অবস্থান এবং সবশেষে মলুয়ার আত্মহত্যা। কবি চন্দ্রাবতী এ ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করেই লিখেছেন মলুয়া। পালার নিয়ম অনুসারে শুরুতে যথারীতি বন্দনা গেয়েছেন এবং তারপরে লিখেছেন মূল কাহিনী। প্রেমের গভীরতা আমরা দেখি চাঁদ বিনোদের কথায়— উইড়া যাওরে বনের কুড়া, কইও মায়ের আগে। চন্দ্রাবতীর নিজের রচিত বিভিন্ন গীতিকবিতার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকগাথা হলো মলুয়া। পালাগানের বন্দনাটির একাংশ এরকমঃ
জল বন্দুম স্থল বন্দুম আকাশ পাতাল।
হর শিরে বন্দিয়া গাই কাল মহাকাল।।.
তারপরে বন্দিলাম শ্রীগুরু চরণ।
সবার চরণ বন্দিয়া জানাই নিবেদন।।
চার কুনা পৃথিবী বন্দিয়া করিলাম ইতি।
সলাভ্য বন্দনা গীতি গায় চন্দ্রাবতী।।

লক্ষনীয়, তখনো চন্দ্রাবতীর মতো শিক্ষিত, রুচিশীলা নারী যিনি নিজে কাব্য রচনা করেন, পৃথিবীকে গোলাকার না বলে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ‘চার কুণা’ বলে অভিহিত করেছেন।

মলুয়ার পালাঃ “জলপ্লাবন ও দুর্ভিক্ষ” অধ্যায়ে তৎকালীন পল্লীজীবনের দুর্দশা ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। কৃষিনির্ভর গ্রামীন জীবন পরিপূর্ণভাবে প্রকৃতির খেয়ালখুশীমতো পরিচালিত হতো তখন। সংক্রামক ব্যাধি, বন্যা, ফসল বিনাশ, দুর্ভিক্ষ, মানুষের উপায়হীনতা জীবনের অবধারিত অংশ হয়ে গিয়েছিল। মলুয়া পালায় বন্যা ও দুর্ভিক্ষ কেমন করে পল্লীজীবনের সকল আশাভরসা বিনাশ করে দূঃখে আর কষ্টে নিমজ্জিত করে দিত ব্যক্তি জীবন, তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন চন্দ্রাবতী।

দস্যু কেনারামের পালাঃ এই পালাতেও “কেনারামের জন্ম ও নানা কষ্ট” পরিচ্ছেদে ফুটে উঠেছে মানবিক দুর্ভোগের যাতনা। কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে এই সীমাহীন দারিদ্র ও কষ্টের ছবি প্রতিফলিত। গ্রামে মাতৃত্বজনিত কারণে অবেলায় মায়ের মৃত্যু, বন্ধাত্বের জ্বালা ইত্যাদি পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে এই কাব্যে।

রামায়ন কথাঃ পিতার অনুপ্রেরণায় ও নিজের মনোকষ্ট লাঘব করার জন্যে চন্দ্রাবতী রামায়নের বাংলা তর্জমা করতে শুরু করেন। কিন্তু এটি আক্ষরিক অনুবাদ নয়। বরং এই নারী কবি একজন নারীর দৃষ্টি দিয়ে রামায়নকে মূল্যায়ণ করেছেন এখানে। সব ছাপিয়ে সীতার ওপর অবিচার ও তার মনোব্যথা ও ভোগান্তি চন্দ্রাবতীকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। আর তাই তার রামায়ণে সেটি-ই প্রধান বিষয়বস্তু ছিল। চন্দ্রাবতীর বাংলা রামায়ণকে অনেকে দুর্বল এবং অসমাপ্ত বলে সরিয়ে রেখেছিলেন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পাঠে বিস্ময়াভূত নবনীতা দেব সেন বলেছেন যে, এটি দুর্বল বা অসমাপ্ত কোনোটিই নয়। এটি একজন নারীর দ্বারা রচিত কাব্য, যেখানে রামের গুণগান না করে তিনি সীতার দুঃখ ও দূর্দশার দিকটাই বেশি তুলে ধরেছিলেন। যা তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধাচারণ হিসাবে দেখা হয়েছিল। ফলে তিনি অন্য পালার জন্য খ্যাতি পেলেও রামায়ণ রচয়ীতা বা বাংলায় রামায়ন অনুবাদক হিসাবে গুরুত্ব পান নি।

দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণের সাথে মেঘনাদবধের আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর ধারণা মেঘনাদবধ কাব্য রচনার আগে মাইকেল মধুসুদন দত্ত চন্দ্রাবতীর রামায়ন পড়েছেন এবং তারই প্রভাব পড়েছে মেঘনাদবধে। রামের বদলে রাবনকে বড় করে এঁকেছেন তিনি প্রথা ভেঙ্গে দিয়ে, যেমনটি করেছিলেন চন্দ্রাবতী রামের বদলে সীতাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর পূর্ববঙ্গ গীতিকায় মন্তব্য করেন যে, “এই রামায়ণের অনেকাংশের সঙ্গে মেঘনাদবধ কাব্যের আশ্চর্য্য রকমের ঐক্য দৃষ্ট হয়, আমার ধারণা, মাইকেল নিশ্চয়ই চন্দ্রাবতীর রামায়ন গান শুনিয়াছিলেন, এই গান পূর্ব্ববঙ্গের বহুস্থানে প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে।“

অন্যদিকে সুকুমার সেন এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, ঘটনা উলটো। এই গাথাটি প্রাচীন হলেও এর সংগ্রাহক বা সংস্কর্ত্তা মাইকেল পরবর্তী যুগের এবং এর কিছু অংশ মেঘনাদবধ কাব্য থেকে রূপান্তরিত। অথচ দীনেশচন্দ্র সেন একাধিক স্থানে লিখেছেন, আমার ধারণা, মাইকেল নিশ্চয়ই চন্দ্রাবতীর গান শুনিয়াছেন’; ‘আমার বিশ্বাস মাইকেল মৈমনসিংহের কবির রামায়ণটি কোন স্থানে শুনিয়া মহিলা কবির দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন’।“

চন্দ্রাবতী পালাঃ চন্দ্রাবতী পালাটি লিখেছেন নয়ানচাঁদ ঘোষ। এই পালাতেই চন্দ্রাবতীর জীবনের করুণ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই পালাটিই বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক লিখিত প্রমান্য দলিল।

চন্দ্রাবতীর গানঃ চন্দ্রাবতীর গান ময়মনসিংহে সুপরিচিত এবং সুপ্রচারিত। চন্দ্রকুমার দে বলেছেন, “শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন পাইকগণ সাঁজের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নববরবধূকে স্নান করাইতে জলভরণে যাইতেছে, সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর স্নানের সঙ্গীত, ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তাহার সঙ্গীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সঙ্গীত সে কত রকম।“
চন্দ্রাবতীর লেখা পাশাখেলার একটা সঙ্গীত নীচে দেওয়া হলোঃ
কি আনন্দ হইল সইগো রস বৃন্দাবনে,
শ্যামনাগরে খেলায় পাশা মনমোহিনীর সনে।
আজি কি আনন্দ
উপরে চান্দোয়া টাঙ্গান নীচে শীতলপাটি,
তার নীচে খেলায় পাশা জমিদারের বেটি
আজি কি আনন্দ
চন্দ্রাবতী কহে পাশা খেলায় বিনোদিনী
পাশাতে এবার হারিল শ্যামগুণমণি!
আজি কি আনন্দ

চন্দ্রাবতীর রচনা আজ সারাবিশ্বে আলোচিত। পৃথিবীর একুশটি ভাষায় তাঁর লেখা অনুদিত হয়েছে। শুধু তাই নয়। কবি চন্দ্রাবতীর রচনা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে। বিদেশী গবেষকবৃন্দ প্রায়ই আসছেন কবির তীর্থভূমি কিশোরগঞ্জে।

জয়ানন্দের গ্রাম সুন্ধা খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে৷ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর পূর্বদিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূর৷ আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে চন্দ্রাবতীর পূজিত সেই বিখ্যাত শিব মন্দির৷ প্রায় পাঁচশ বছরের দীর্ঘ ব্যবধানে ফুলেশ্বরী নদী বিলীন হয়ে গেছে, কিন্তু তার পাড়ের শিবমন্দির, সংস্কারের অভাবে যত-ই জীর্ণ হোক না কেন, আজো দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর স্মৃতির সাক্ষ্য হয়ে। গত কয়েক বছর ধরে চন্দ্রাবতীর শিব মন্দিরকে ঘিরে বাৎসরিক মেলা বসছে এই বিরল কবিকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে – তাঁকে স্মরণ করার জন্যে। দেশের জ্ঞানী গুণীজনেরা এসে এই মেলাকে সাফল্যমন্ডিত করছেন। ইদানীং তাই দেখা যাচ্ছে নতুন করে চন্দ্রাবতীর কবি প্রতিভার মূল্যায়ন ঘটছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *