prabandho-meyeli-yantro-purushali-yantro

মেয়েলি যন্ত্র, পুরুষালি যন্ত্র
তৃষ্ণা বসাক

‘নারীর ভিতর দিয়ে বিচিত্র রসময় প্রাণের প্রবর্তনা যদি পুরুষের উদ্যমের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়ার বাধা পায় তাহলেই তার সৃষ্টিতে যন্ত্রের প্রাধান্য ঘটে। তখন মানুষ আপনার সৃষ্ট যন্ত্রের আঘাতে কেবলই পীড়া দ্যায়, পীড়িত হয়। … যক্ষপুরে পুরুষের প্রবল শক্তি মাটির তলা থেকে সোনার সম্পদ ছিন্ন করে আনছে। নিষ্ঠুর সংগ্রহের লুব্ধ চেষ্টার তাড়নায় প্রাণের মাধুর্য সেখান থেকে নির্বাসিত…। এমন সময় সেখানে নারী এল, নন্দিনী এল, প্রাণের বেগ এসে পড়ল যন্ত্রের ওপর।’
‘সেইজন্য আমার ধারণা এই যে মেয়েরা যদি বা কান্ট হেগেল পড়ে তবু শিশুদের স্নেহ করিবে এবং পুরুষদের নিতান্ত দূর ছাই করিবে না। কিন্তু তাই বলিয়া শিক্ষা প্রণালীতে মেয়ে পুরুষে কোথাও কোন ভেদ থাকিবে না, এ কথা বলিলে বিধাতাকে অমান্য করা হয়। বিদ্যার দুটি বিভাগ আছে। একটা বিশুদ্ধ জ্ঞানের, একটা ব্যবহারের। যেখানে বিশুদ্ধ জ্ঞান সেখানে মেয়ে-পুরুষের পার্থক্য নাই, কিন্তু যেখানে ব্যবহার সেখানে পার্থক্য আছেই। মেয়েদের মানুষ হইতে শিখাইবার জন্য বিশুদ্ধ জ্ঞানের শিক্ষা চাই, কিন্তু তার উপরে মেয়েদের মেয়ে হইতে শিখাইবার জন্য যে ব্যবহারিক শিক্ষা তার একটা বিশেষত্ব আছে এ কথা মানিতে দোষ কী?’

এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের। তিনি কি পশ্চিমী তত্ত্বেরই প্রতিধ্বনি করেছিলেন? তাঁর ‘চোখের বালি’র বিনোদিনীর কথাকে বিহারীর যেমন মনে হয়েছিল ‘ছাপাখানার প্রতিধ্বনি?’ আসলে পশ্চিমী সভ্যতায় যন্ত্র, এমনকি ছোটখাটো কলকব্জাকেও ধরা হয় পুরুষালি। কারিগরি জ্ঞান, শক্তি ইত্যাদি হচ্ছে পৌরুষের প্রতীক, অন্যদিকে সংবেদন শীলতা, সামাজিক সম্পর্ক, লালন পালন এসবকে ধরা হয় মেয়েলি। শুধু তাই নয়, বাড়িতে যে গ্যাজেটগুলি ব্যবহৃত হয়, তার পর্যন্ত একটা লিঙ্গ তালিকা তৈরি হয়েছে।
যেমন ক্লীবলিঙ্গ গ্যাজেট- রেডিও, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, কফি মেকার, রেফ্রিজারেটর।
এর মধ্যেও রকমফের আছে। গাড়ির রেডিও পুরুষালি, আবার দপ্তরের রেডিও মেয়েলি! রেফ্রিজারেটরকে নিউট্রাল ধরা হলেও তার মধ্যে আবার পুরুষ নারীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান! বিয়ারের তাক পুরুষালি আর স্যালাডের তাক মেয়েলি। সে কি পুরুষের বিয়ার-প্রিয়তা আর মেয়েদের ডায়েট- খেপামির কথা ভেবেই?

ভয়ানক মেয়েলি যন্ত্র- ওয়াশিং মেশিন, হেয়ার ড্রায়ার। এখানে মনে পড়ে যাচ্ছে কেতকী কুশারী ডাইসনের উপন্যাস ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’-র এক পুরুষচরিত্র তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কে বলেছিলেন ‘ক্লারা ইজ ডুইং হার ওয়াশিং অ্যান্ড ড্রাইং’। যদিও তাঁর স্ত্রী দুজনেরই জামাকাপড় কাচছিলেন!
ভয়ানক পুরুষালি যন্ত্র- কম্পিউটার, ডিভিডি প্লেয়ার, স্টিরিও।

কম্পিউটারেরও আবার ভাগাভাগি আছে, ডেস্কটপ পুরুষ, ল্যাপটপ মেয়ে। এইটা ঠিক করা হয়েছে ওজন, বহনযোগ্যতার ভিত্তিতে। ভারি চেহারার ডেস্কটপ তাই ছেলে, আর হালকা ল্যাপটপ মেয়ে। অর্থাৎ এখানেও একটা স্টিরিওটাইপিং রয়েছে। ধরেই নেওয়া হচ্ছে মেয়েরা হালকা এবং আকর্ষক চেহারার হবে।
কোন যন্ত্রটিকে নারী, কোনটিকে পুরুষ বলা হবে তা ঠিক করা হয় কতগুলি নিরিখে। যেমন-
বিশেষজ্ঞতা- কার যন্ত্রটি সম্পর্কে বেশি জ্ঞান, কে এর লেটেস্ট আপডেট নিয়ে ওয়াকিবহাল? কার এই বিষয়ে আগ্রহ বেশি? কে এটি সারাতে পারবে? যন্ত্রটি কি অত্যন্ত নতুন ও জটিল? তুলনামূলক ভাবে সহজে ব্যবহার করা যায়, এমন যন্ত্রকে মেয়েলি ধরা হয়।
অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হচ্ছে নো-হাউ জিনিসটা একান্তভাবে পুরুষের একচেটিয়া।
যন্ত্রের চেহারা ও আওয়াজ- বিশাল, কালো এবং বাক্সের মতো চেহারার যন্ত্রকে ধরে নেওয়া হয় পুরুষ। এই নিয়ে একটি মেয়ে বলেছিল মাইক্রোওভেন একইসঙ্গে পুরুষ ও নারী। তার আছে পুরুষের মতো গোবদা চেহারা আর নারীর মতো রন্ধনপটুতা। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল মেয়েটি কিন্তু উল্টোটা ভাবতেই পারেনি, অর্থাৎ নারীর মতো গোবদা চেহারা আর পুরুষের রন্ধনপটুতার কথা! হিন্দি সিনেমার গানে যেমন নারী চেহারার স্টিরিওটাইপিং আছে ‘পাতলি কোমরিয়া, গোরিয়া, তিরছি নজরিয়া’ সেরকম গোবদা, কৌণিক আকারের ভারি যন্ত্র মানেই পুরুষালি, আর হালকা পাতলা ছিমছাম যন্ত্র হলেই তা নারী। এই ফরমুলায় ভারি চেহারার টেবিল কম্পিউটার ছেলে, আর হালকা ল্যাপটপ মেয়ে। বক্স টিভি ছেলে, আর আধুনিক দেওয়ালজোড়া ফ্ল্যাট টিভি মেয়ে। আগেকার কালো গোবদা হেড মাস্টারমাশাই সুলভ গম্ভীর ল্যান্ড ফোন পুরুষালি, আর হালের স্লিক স্মার্ট ফোন মেয়েলি। যশোধরা রায়চৌধুরীর স্মৃতিকথা ‘হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা’-য় রয়েছে গোবদা কোলাব্যাঙের মতো কালো সাবেক টেলিফোনের কথা, যেটি অবশ্যই পুরুষ যন্তরের আওতায় পড়বে। আমাদের মনে পড়তে পারে পুরনো, সাদা- কালো বাংলা সিনেমায় এই কালো গোবদা টেলিফোন বুকে চেপে নায়িকার কত গোপন কথা, কত অশ্রুপাত, কত প্রেমের গান। সেই যে ‘জানে কেয়া তুনে কহি’ –বিখ্যাত প্রেমের গানের মাধ্যম ছিল এই কালো পুরুষালি টেলিফোনই।

শুধু চেহারা নয়, যন্ত্রের আওয়াজও তার লিঙ্গ নির্ণায়ক। খুব জোর আওয়াজ হলে ধরে নেওয়া হয় সে ছেলে। যেমন স্টিরিও-র আওয়াজ। আবার কফি মেকারের মিহি আওয়াজ একে মেয়েলি তকমা দ্যায়। পুরুষ আর মেয়েদের গলার আওয়াজের তফাত নিয়ে খুব মূল্যবান পর্যবেক্ষণ আছে লীলা মজুমদারের। সেটা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। ‘চাকরেদের কথা বলি। বিশেষ করে মেয়ে-চাকরেদের। রোজ চার-পাঁচটে ট্রাম গাড়ির আধখানা বোঝাই করে যাওয়া-আসা করে। অনেক দূর থেকে একটা গুনগুন শব্দ শোনা যায়, যেমন কোন পুরুষ-ভরা গাড়ি থেকে শোনা যায় না। বড্ড ভালো লাগে। পুরুষদের গানের গলা ভালো হতে পারে, কিন্তু ভিড়ের গলা!!’ (মেয়ে-চাকরে, খেরোর খাতা, লীলা মজুমদার) সাধারণ গাড়ি থেকে পুরুষকণ্ঠের খ্যাঁক খ্যাঁক আওয়াজ আসত বলে জানিয়েছেন লীলা মজুমদার।
কে বেশি ব্যবহার করে- গ্যাজেটটি কে ব্যবহার করে তার ওপর তার লিঙ্গ পরিচয় ঠিক হয়। যেমন ওয়াশিং মেশিন বা হেয়ার ড্রায়ার। যদিও এখন ওয়াশিং মেশিন প্রচুর ছেলেরাও ব্যবহার করছে, তবু ওয়াশিং মেশিন এখনও মেয়েলি। আমরা বিজ্ঞাপনগুলো লক্ষ্য করলেও দেখব এইসব পণ্যের বিজ্ঞাপনে মেয়েরাই মডেল। এবং প্রায় প্রতিটি কপিতে একটা কথা থাকবেই- এই ওয়াশিং মেশিনটি মেয়েদের গৃহশ্রম অনেক কমিয়ে দিয়েছে। যেমন ওয়াশিং মেশিন, তেমনি প্রেসার কুকারের বিজ্ঞাপনেও কোনদিন কোন পুরুষকে দেখা যায়নি। এই নিরিখে প্রেসার কুকার একান্তই একটি মেয়েলি যন্ত্র। এর বিজ্ঞাপনের কপিগুলো খেয়াল করুন –
একদম আদি যুগের একটি বিজ্ঞাপনে দুটি নারীর ছবি পাশাপাশি। একজন সাবেকি বাসনপত্র নিয়ে ক্লান্ত, অন্যদিকে আরেকজন প্রেস্টিজ প্রেসার কুকারে রান্না করছে হাসিমুখে।–
কপিতে লেখা- ক্রিয়েটস দা এক্সট্রা লেজার ইউ নিড।
কিংবা আরও সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনের জিংগল-
‘যদি বউকে সত্যি ভালোবাসো/ আজই প্রেস্টিজ মিনি নিয়ে এসো’
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রেসার কুকারের চেহারাকেও করা হল স্লিক এবং সেক্সি। একটি নতুন মডেলের প্রেসার কুকারকে নারী শরীরের আওয়ার গ্লাস শেপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখানো হল একটি বিজ্ঞাপনে।
আর এখন তো অনেক ইলেক্ট্রনিক প্রোডাক্টও মেয়েদের ব্যবহারের জন্যে দেখনদারিতে বদল আনা হয়েছে। যদিও ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি খরচ করে, তবু দেখা গেছে এই পণ্যগুলি ৪০ শতাংশ বিক্রি হয় মেয়েদের কাছে। তাই অস্বীকার করার কোন জায়গাই নেই যে মেয়েরা একটা সম্ভ্রমযোগ্য ক্রেতা, এবং এই কারণে তাদের জন্য বানানো গ্যাজেট ক্রমশই আরো স্টাইলিশ আর রংচঙে হয়ে উঠছে। অনলাইন কেনাকাটায় তারাই সংখ্যা গরিষ্ঠ। আর তাদের কথা ভেবেই ইলেকট্রিক পণ্য করা হচ্ছে গোলাপি রঙের এবং জেল্লাদার। ChicBlvd নামে একটি কোম্পানি আছে যারা শুধু মেয়েদের জন্যেই ইলেক্ট্রনিক পণ্য বানায়। আবার The Vista, California-based company, যার পত্তন দুই নারীর হাতে, তাদের নতুন ইয়ারফোন আর আই পডের কেস পাওয়া যাচ্ছে বাবল গাম আর পমিগ্রেনেট পার্পল রঙে, আর তার ওপর আবার লাগানো থাকে Swarovski ক্রিস্টাল।
এ অবশ্য আমরা অন্য পণ্যের বেলাতেও দেখেছি। আদি যুগে ছাতা ছিল বিরাট কালো, গেরেম্ভারি টাইপ। যাকে বলা হত দাদুর ছাতা। এক গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা পাবার আবশ্যিক যোগ্যতা ছিল শিক্ষকের বাঁকানো হাতলওলা ছাতা থাকতে হবে, যাতে স্কুল পালানো ছেলেদের ঘাড় ধরে টেনে আনা যায়। মেয়েদের ছাতাও ছিল কালো কাপড়ের, শুধু তা একটু বেঁটেখাটো ছিল। চাকুর মেয়েদের ট্রেডমার্ক ছিল এই বেঁটে কালো ছাতা। বাধ্য হয়ে, সংসারের প্রয়োজনে চাকরি করা মেয়েদের জীবনে সেসময় শৌখিনতার জায়গা ছিল না। মনে পড়ে ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় ছেঁড়া চপ্পল টেনে টেনে নীতার হেঁটে যাওয়া? পরে ছাতায় রঙ এল, লম্বা ছাতার বদলে এল ফোল্ডিং ছাতা, যা সহজে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়। আজো বেশিরভাগ পুরুষ অদম্য অধ্যাবসায়ে কালো ছাতা ব্যবহার করে চলেছেন কেন জানি না।
যদি এরকম একটা টেবিল বানানো যায় ?

বৈশিষ্ট্য পৌরুষ নারীত্ব
দর্শন – বিশাল, কালো, কৌণিক অনেক বাটন, ইনডিকেটর গোলালোকোণ, হালকা সুন্দর বহনযোগ্য
ইউজেবিলিটি- শেখা কঠিন, বিশেষজ্ঞতা লাগে শেখা সহজ, কমন সেন্স লাগে
আওয়াজ- নয়েজি, অ্যাগ্রেসিভ সাইলেন্ট, পারকোলেটিং
কারিগরি দিক- জটিল সহজ
অভিনবত্ব- নতুন উদ্ভাবন পুরনো, পরিচিত, আরকেইক
ব্যবহার- বিনোদন, স্ট্যাটাস সিম্বল ধোয়ামোছা, রান্না, প্রসাধন

এইভাবে আমাদের ব্যবহারের সব গ্যাজেটকেই এরকম মেয়েলি, আর পুরুষালি – আলাদা আলাদা খোপে ভরে ফেলাই যায়। তবে তেষ্টা পেলে মেয়েরা ‘পুরুষালি’ বিয়ারের তাকের দিকে কি হাত বাড়াবে না? নাকি ছেলেরা ‘মেয়েলি’ স্যালাডের তাক থেকে স্যালাড তুলে খাবে না? ‘মেয়েলি’ ল্যাপটপে তো দিব্যি টকাটক কাজ করে যাচ্ছে ছেলেরা আর গাড়ির ‘পুরুষালি’ রেডিও শুনতে শুনতে ড্রাইভ করতে কোথাও আটকাচ্ছে না আজকের মেয়েদের!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *