prabandho-mritshilper-tin-prajanmo

মৃৎশিল্পের তিন প্রজন্ম
নন্দিনী নাগ

মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি এয়ারপোর্টের দুই নম্বর টার্মিনাল ধরে চলার পথে দুপাশে চোখে পড়বে শিল্পবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এদেশের নানা প্রদেশের শিল্পকর্মগুলির প্রতিরূপ।খুব বেশি তাড়া না থাকলে যাত্রীরা ১.২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তাটা হাঁটতে পারেন এই নমুনাগুলোর রসাস্বাদন করতে করতে। সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি পর্যটকদের এদেশের শিল্পসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করাটাও এই প্রদর্শনীর একটা বড় উদ্দেশ্য। এই প্রকল্পটির পরিকল্পনা এবং রূপায়নের কৃতিত্ব পুরোপুরি শ্রীযুক্ত রাজীব শেঠীর,পদ্মভূষণ প্রাপ্ত এই শিল্পী (সিনোগ্রাফার) এশিয়ান হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সেইসঙ্গে ডিজাইনার এবং আর্ট কিউরেটর।

এই শিল্পকর্মগুলোর দিকে একঝলক তাকিয়ে যেসব ব্যস্ত যাত্রীরা চলে যান, তাদেরও থামতে হয় আর মুগ্ধতার সাথে সাথে বিস্মিত হতে হয়, যখন তাদের সামনে চলে আসে একটা জলজ্যান্ত স্টুডিওর প্রতিরূপ।

মাটির তৈরি এই স্টুডিওটি একজন মৃৎশিল্পীর,যার ভেতরে দৃশ্যমান ছড়ানো ছিটানো নানা শিল্পকর্ম,তার কোনোটা সম্পূর্ন, কোনোটা অসমাপ্ত। রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ প্রতিরূপ, রয়েছে অসম্পূর্ণ মাটির প্রতিমা,মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে শিল্পীর কাজের নানা জিনিসপত্র। ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত শিল্পী টুলে উঠে দেবীপ্রতিমার চক্ষুদানে ব্যস্ত, তাঁকে কাজে সাহায্য করছে তাঁর বালকপুত্র, আর মেঝেতে বসে খেলায় মগ্ন ছোট্ট একটি মেয়ে। একটি শব্দ না ব্যবহার করেও এই ‘স্টুডিও’ এর রিলিফটি একটি সুন্দর গল্প শোনায়, তিন প্রজন্মের তিন শিল্পীর গল্প,বলাবাহুল্য মৃৎশিল্পী।

যদিও সাম্প্রতিক কালের এই তিন প্রজন্মের গল্প বলতে বসেছি তবুও আমাদের খানিকটা পেছনে হাঁটতে হবে, যেতে হবে এই শিল্পের উৎসমুখে।

নদীয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল তৈরির খ্যাতি জগৎজোড়া। ‘ঘুর্ণী’ নামের এক অখ্যাত পাড়া পৃথিবীর শিল্পের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে এই মৃৎশিল্পের কারনে। আর এই অতুল্য শিল্পকর্ম প্রথম বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে আঠারোশ একান্ন সালে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে না আসলে ভারতবর্ষ শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতে অনেকটাই পিছিয়ে থাকত একথা বোধহয় অস্বীকার করা যায়না। পাশ্চাত্ত্যের জ্ঞান যেমন তারা এদেশে এনেছিল তেমনই এদেশের বহু প্রতিভার সঙ্গেও বিশ্ববাসীর পরিচয় ঘটিয়েছিল। মৃৎশিল্পী শ্রীরাম পালও তেমন একজন ব্যক্তি যাঁর শিল্পকর্ম বহির্বিশ্বের নজর কাড়ে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে।

লন্ডনের হাইডপার্কে এক অভিজাত শিল্প প্রদর্শনীতে আমন্ত্রিত শিল্পী শ্রীরাম পাল মাটি দিয়ে তৈরি করেন বেশ কয়েকটি ‘রিয়াল লাইফ’ মডেল,যেগুলো এদেশের বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত মানুষের ‘মিনিয়েচার’। এককথায় বলা যায় ‘ওরা কাজ করে’। এই মডেলগুলো এতটাই জীবন্ত ছিল যে উপস্থিত বিচারক এবং দর্শকেরা বলেন, এই পুতুলগুলো দেখেই ভারতের বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে। বলাইবাহুল্য, শ্রীরাম পাল খ্যাতি এবং সম্মান লাভ করেন।

এই ঘরানার পরবর্তী বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন শ্রীরাম পালের ভাইয়ের ছেলে যদুনাথ পাল (১৮২১-১৯২০)। শ্রীরাম পাল ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। যদুনাথ পালের ‘লাইফ-সাইজ’ মডেল গুলো ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল। প্যারিসের প্রদর্শনীতে দর্শকদের অন্যতম মূল আকর্ষণ ছিল যদুনাথ পালের তৈরি ‘রিয়েল লাইফ’ মডেলগুলো। শিল্পী যদুনাথ পালের নাম এখনো শিল্পানুরাগী মাত্রেই জানেন।

এই পরম্পরার অন্যতম বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন বক্রেশ্বর পাল, যাঁর সৃষ্টি এতটাই জীবন্ত ছিল যে আসল নকলের পার্থক্য করা যেতনা। তিনি একটি গোরুর পচাগলা মৃতদেহের মডেল বানিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন,ওই মডেলের সাহায্যে তিনি আকাশ থেকে শকুন নামিয়ে আনবেন। বাস্তবে ঘটেছিলও তাই, ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে তাঁর সৃষ্ট ওই গোরুর শবদেহের ওপর আকাশ থেকে শকুন নেমে এসে বসে। এই কাজের জন্য তাঁকে সম্মানিত করা হয়, মডেলটি গ্লাসগো মিউজিয়ামে যায় এবং তাঁর নামে শংসাপত্র পাঠানো হয়।

বক্রেশ্বর পালের পৌত্র বীরেন পাল,তাঁর পুত্র সুবীর পাল এবং নাতনি সহেলি পালকে নিয়েই এখনকার আলোচনা, যাঁরা শিল্পের এই ঘরানাটিকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যাননি, তাতে সংযোজন করেছেন আরও নতুন মাত্রা আর যথাযোগ্য মর্যাদায় উন্নীত করেছেন তাকে।

নরেন পালের পুত্র বীরেন পাল জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩০ এ। তিনি ছিলেন আরও এক কিংবদন্তী শিল্পী, পিতামহ বক্রেশ্বর পালের কাছে কাজ শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। বীরেন পাল ছিলেন সর্বপ্রথম মৃৎশিল্পী যিনি জাতীয় সম্মানে ভূষিত হন, ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং এর কাছ থেকে পুরস্কৃত হন তাঁর শিল্পকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ। একজন কুম্ভকার চাকা ঘুরিয়ে মাটির জিনিস তৈরি করছে, এই মডেলটি তাঁকে এনে দিয়েছিল রাষ্ট্রপতি সম্মানের বিরল কৃতিত্ব। উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে খৃষ্টীয় মূর্তিগুলো তাঁর নির্মাণ। প্রতিমা নির্মাণে ওরিয়েন্টাল স্টাইল তিনিই প্রথম এনেছিলেন। তাঁর সুকীর্তিগুলো ছড়িয়ে আছে দিল্লি, লক্ষ্ণৌ নানা স্থানে। মাটির মানুষ শিল্পী বীরেন পাল ২০০৮ এ চিরবিদায় নেন এই মাটির পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে।

বিখ্যাত লেখক, কবি বা সঙ্গীতশিল্পীদের সন্তানেরা তাদের বাবা মায়ের মত সবসময় হন না, খুব প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক কিংবা খেলোয়াড়ের সন্তানদের ক্ষেত্রেও কথাটা একইভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু বীরেন পাল আর তার সন্তান সুবীর পালের ক্ষেত্রে যোগ্যতম জিনেরই প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটেছে।

শিল্পী বীরেন পাল এবং ছায়ারানী পালের সুযোগ্য সন্তান সুবীরের জন্ম হয় ১৯৬৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর। তাঁর মৃৎশিল্পী হয়ে খ্যাতির বৃত্তে আসাটাও একটা সমাপতন।

অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা সুবীরকে কেউ হাতে করে না শেখালেও, মাত্র পাঁচ-ছয় বছর থেকেই মাটি দিয়ে পুতুল তৈরি করতে শুরু করেছিল সুবীর,বাড়ির বড়দের দেখে দেখে নিজে নিজেই আয়ত্ত করেছিল সেই কৌশল। তবে নিজের কাঁচা হাতের কাজ সম্পর্কে কুন্ঠা থাকায় সেগুলোকে লুকিয়েই রাখত ও, যাতে বাবার চোখে না পড়ে।

শিল্পী হিসাবে বীরেন পাল তখন খ্যাতির মধ্যগগনে, অনেক বিশিষ্টজনের আসা-যাওয়া তাই লেগেই থাকত তাঁদের বাড়িতে। তেমনই একবার এসেছেন বিশিষ্ট শিল্পী রাজীব শেঠী, ১৯৮২তে লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য ভারতমেলায় প্রতিনিধিত্ব করবার উপযুক্ত মৃৎশিল্পীর সন্ধানে।

সুবীর তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র, রোজকার মত স্কুলে গেছে।

শিল্পী বীরেন পালের বাড়িতে গিয়ে মেঝেতে বসে কথাবার্তা চালানোর সময় হঠাৎই রাজীব শেঠীর নজরে পড়ে গেল চৌকির নিচে লুকিয়ে রাখা বালক সুবীরের তৈরি করা মাটির পুতুলগুলো। সেগুলোকে বার করিয়ে এনে দেখলেন তিনি, জহুরীর চোখ তাঁর, জহর চিনতে ভুল হল না।

ডাক পড়ল বালক সুবীরের, পিতার পরিবর্তে পুত্র নির্বাচিত হল লন্ডনে ভারতমেলায় প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।

সেই প্রথম বিজয় রথের চাকা গড়াতে শুরু করল শিল্পী সুবীর পালের।

১৯৮২র লন্ডন সফরের পর ১৯৮৫তে আবার তিনি নির্বাচিত হলেন আমেরিকা সফরের জন্য আর সেই বছরেই প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন। তবে পুরস্কারটি পাবার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও তিনটি বছর, সাবালকত্ব প্রাপ্তি পর্যন্ত। ১৯৯১তে পেলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, মাটি দিয়ে একটি গ্রামের হাটের মডেল তৈরি করার জন্য। তিনিই সম্ভবত এত অল্পবয়সে রাষ্ট্রপতিপুরস্কার পাওয়ার মত বিরল কৃতিত্বের অধিকারী।

দেশের মৃৎশিল্পীদের মুখ হিসাবে শিল্পমেলায় তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন ২০০০ এ জার্মানি এবং ২০০৭ এ স্পেন সফরে।

ইত্যবসরে তিনি পরিণত হয়েছেন আরও, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সায়েন্স মিউজিয়ামগুলোতে (NCSM) প্রদর্শনের জন্য মডেল তৈরি করেছেন। মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর বিবর্তনের ধারা কিংবা নানারকমের ডাইনোসর আর জীবজন্তুর এমন জীবন্ত প্রতিরূপ আর কে-ই বা তৈরি করতে পারতেন কৃষ্ণনগরের স্বনামধন্য মৃৎশিল্পী ছাড়া! মিউজিয়ামে রক্ষিত এই প্রতিরূপগুলো দেখলে বোঝা যায় ভারত সরকারের ভরসাকে তিনি যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত কাজের মধ্যে রয়েছে অমৃতসরের বিখ্যাত রাণা রণজিৎ সিং প্যানোরামা। ভারত সরকারের উদ্যোগে তৈরি এই মিউজিয়ামটিতে মাটির ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ এর সাহায্যে প্রদর্শিত হয়েছে রাণা রণজিৎ সিং এর জীবন এবং তাঁর ছটা যুদ্ধের ইতিহাস। স্বচক্ষে দেখার সুযোগ না থাকলে গুগলের সাহায্য নিয়ে প্যানোরামাটা ঘুরে আসতে কোনো বাধা নেই।

এইসব অসাধারণ কাজের জন্য ২০১৮ এ শিল্পী সুবীর পাল স্থান করে নিয়েছেন ‘ইন্ডিয়ান বুক অব রেকর্ডস’এ,২০১৯ এ গড়েছেন ‘ইউনিক ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’। ২০১৯ এ ‘লিমকা বুক অব রেকর্ডস’ এ স্থান পাবার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ এবং ‘মিনিয়েচার’ প্রতিরূপ তৈরি করে।

প্রচন্ড অবাক লাগে যখন দেখি , আর্ট কলেজের প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া, মানুষ এবং বিভিন্ন জীবজন্তুর অ্যানাটমি ফিজিওলজির প্রত্যক্ষ কোনো শিক্ষা ছাড়াই এইসব শিল্পীরা কেবল চোখে দেখা এবং নিজেদের অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে বানিয়ে ফেলেন এমন জীবন্ত প্রতিরূপ! এমনই এক চমকে দেওয়ার মত ঘটনা ঘটেছিল প্রথমবার শিল্পী সুবীর পালের স্টুডিওতে গিয়ে।

সন্ধ্যার মুখে একদিন গিয়েছিলাম শিল্পীর বাড়ি লাগোয়া স্টুডিওতে। টানা লম্বা ঘরটার শেষ প্রান্তে দেখলাম ময়লা কাপড় পরা একজন লোক খালি গায়ে উবু হয়ে বসে কিছু একটা করছে। ভঙ্গি দেখে মনে হল স্টুডিও ঝাঁট দেওয়া শেষ করে লোকটা ময়লাগুলো জড়ো করে তুলছে, পাশে একটা ময়লা রাখার পাত্রও দেখেছিলাম সম্ভবত। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়ে যাবার পর আবার ওদিকে চোখ পড়ল, তখনও লোকটাকে একই রকম ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে বোধোদয় হল আমার। কাছে গিয়ে দেখলাম লাইফ সাইজ মডেলটা যেকোনো মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে। আমার অবস্থা দেখে শিল্পী তখন মিটিমিটি হাসছেন। এমন অনেক তাক লাগানো কাজ ছড়িয়ে আছে শিল্পীর স্টুডিও জুড়ে।

সুবীরতনয়া সহেলিও বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারিনী। শিল্পীর একমাত্র সন্তান মেধাবী কন্যাটি এখন তার মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। তবে শিল্পের পরিমন্ডলে বড় হওয়া সহেলিও ইতিমধ্যে মৃৎশিল্পে পারদর্শীতার স্বাক্ষর রেখেছেন। পুজোর সময় মূর্তি তৈরির চাপ যখন থাকে, বাবাকে সাহায্য করে সে ও, আবার কখনো বা নিজের খেয়াল খুশিতে সৃষ্টিতে মেতে থাকে। পরবর্তীকালে বাবা বা ঠাকুর্দার ঘরানাকে ধরে রাখতে সহেলি মৃৎশিল্পকে পেশা হিসাবে নেবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাব এখন সঠিকভাবে কেউই জানেন না, হয়ত সহেলিও নয়, কিন্তু ইতিমধ্যেই সে তার প্রতিভার স্বীকৃতি পেয়ে গেছে আর সেটাও খোদ গিনেস বুক এর পক্ষ থেকে।

তিন লক্ষ চৌত্রিশ হাজার দেশলাইকাঠি দিয়ে তৈরি করা ‘তাজমহল’ এর একটি প্রতিরূপ তাকে এনে দিয়েছে এই বিরল সম্মান। ২০২০র মার্চ মাসে গিনেস কর্তৃপক্ষ কৃষ্ণনগরে এসে মানপত্র দিয়ে গেছে শিল্পী সহেলি পালকে।

জীবনের কাছে আর কি চাওয়ার থাকে একজন মানুষের?

এত সম্মান, দেশে বিদেশে এত খ্যাতি, ভালোবাসা, সুযোগ্য সন্তান-এতসব পাওয়ার পর নিশ্চয়ই একজন মানুষের তৃপ্তি পাওয়া উচিত, বিশেষত একজন শিল্পীর, যাঁর চাহিদাগুলো সাধারণ মানুষের থেকে আলাদারকম হয়। কিন্তু শিল্পী সুবীর পালের সঙ্গে কথা বলে মনে হল তাঁর চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে এখনো অনেকটা ফাঁক থেকে গেছে।

সেই বালক বয়স থেকে শুরু করে শিল্পীজীবনের তিনযুগ কাটিয়ে ফেলে শিল্পী সুবীর পাল একটা স্বপ্ন দেখেন আর সেই স্বপ্নপূরণহেতু তাঁর একটা চাহিদা আছে, চাহিদা না মেটায় ক্ষোভও আছে।

না। অবশ্যই নিজের জন্য কিছু চান না তিনি।

মৃৎশিল্পের এই পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, তাকে উজ্জীবিত করার জন্য তাঁর কিছু পরিকল্পনা আছে, তিনি চান সেগুলোকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ সরকারি তরফে নেওয়া হোক।

কৃষ্ণনগরের একটা পাড়া ঘুর্ণী, তারই কয়েকটা পরিবারে রয়েছে মৃৎশিল্পের উত্তরাধিকার, কয়েক প্রজন্ম ধরে। এই ঘরানা নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি স্বপ্ন দেখেন একটা বড় ওয়ার্কশপ তৈরি করার, যেখানে কাজ শিখতে পারবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আগ্রহী শিল্পীরা, যাতে অন্যান্য শিল্পের মত মৃৎশিল্পেরও বিকাশ হয়, কারন ঘরানা নির্ভরতা ভেঙে অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে তবেই তো এই ভুবনভোলানো শিল্পটির বিলুপ্তি ঠেকানো সম্ভব হবে।

কাঁচা মাটির তৈরী মিনিয়েচারগুলোর জন্য কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের খ্যাতি পৃথিবীজোড়া। এইসব মিনিয়েচারগুলো তৈরি করা খুবই সময় এবং শ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার। তাই এইসব কাজগুলো শিল্পীরা বিক্রি করেন না, দেখার জন্য সাজিয়ে রাখেন। মিনিয়েচার ছাড়াও আছে পুরস্কারজয়ী কাজগুলো, আছে সূক্ষ্ম কাজের এমন কিছু মডেল যেগুলো শিল্পীরা বার বার তৈরী করতে পারেন না। শিল্পী সুবীর পাল তাই চান,সরকারি উদ্যোগে একটি মৃৎশিল্পের মিউজিয়াম তৈরি করা হোক কলকাতায়, যেখানে শিল্পানুরাগী দর্শকেরা দেখার সুযোগ পাবেন এই বিস্ময়কর কাজগুলো।দাবিটি অযৌক্তিক নয় মোটেও, নিউটাউনে মোম-মিউজিয়াম আছে, অথচ এত পুরোনো একটি শিল্প কিন্তু সেদিক থেকে উপেক্ষিত।

কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরের দূরত্ব একশ কিলোমিটার। অথচ রাস্তার বেহাল অবস্থার কারনে এই দূরত্ব পেরতে সময় লেগে যায় চারঘন্টা। বাইরে থেকে আসা শিল্পপ্রেমী মানুষ, যারা মৃৎশিল্পের আঁতুড়ঘরটি নিজের চোখে দেখতে চান, তারা অনেকেই আসতে পারেন না এই খারাপ পরিবহন ব্যবস্থার জন্য। ফলত যে পরিমাণ প্রচারের আলো পড়া উচিত ছিল প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন এই শিল্পটির ওপরে, তা পড়ে না, যোগ্য কদর পায় না শিল্পীরা। সঙ্গত কারণেই ক্ষোভ প্রকাশ পায় শিল্পীর কথায়।

সৃষ্টির উৎস হল আনন্দ আর তার উদ্দেশ্য হল আনন্দ বিতরণ। যদি উদ্দেশ্যই সফল না হয়, যদি সৃষ্টি থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে, তবে স্রষ্টাও তো আনন্দিত হতে পারেন না, থেকে যান অসুখী অতৃপ্ত।

প্রশাসনের তরফে খানিকটা উদ্যোগ নিয়ে নিজভূমে উপেক্ষিত এইসব ক্ষণজন্মা শিল্পীদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিলে, তাদের সৃষ্টিকে সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হলে, তবেই সাধারণ মানুষের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সম্ভব,আনা সম্ভব মৃৎশিল্পের মরা গাঙে জোয়ার। প্রাচীন এই শিল্পটির ফুসফুসে অক্সিজেন যোগাতে যেটা অত্যন্ত জরুরী। নতুবা কয়েকদশক পরে, লোকশিল্পের ইতিহাসে স্থান পাবে এই শিল্পের কথা, গবেষক বা উৎসাহী পাঠক সেই বইয়ের পাতা উল্টে জানতে পারবে, ‘নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ঘুর্ণী নামের এক পাড়ায় একসময় মৃৎশিল্পীরা বাস করতেন। তাঁদের তৈরি ‘রিয়েল-লাইফ ‘ মাটির পুতুল একসময় সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *