prabandho-rahasye-ghera-jagannath

রহস্যে ঘেরা জগন্নাথ বিগ্রহ

বৈশাখী ঠাকুর



হিন্দু দেবদেবীর আসরে জগন্নাথ মূর্তির রয়েছে কিছু অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য —- ব্যতিক্রমী তো বটেই, একটি বিশেষ ধরণের মূর্তি এটি। পূর্ণাঙ্গ হাত-পা-কান-ঘাড়— কিছু নেই। যেটুকু শরীর তা নাভি দেশ পর্যন্ত। যেটুকু হাত শরীরে লাগানো হয়েছে তাও কানের ঠিক তলা থেকে, প্রকান্ড বেমানান চোখ, ভ্রু নেই, বিরাট চার চৌকো মাথা। দেখলেই মনে হয় একটি কাঠের গুঁড়িকে রঙ চং করে চোখ মুখ এঁকে দেওয়া হয়েছে। হিন্দু দেব দেবীর যে অসংখ্য মূর্তি হয়েছে ভয়ঙ্কর / ভয়ঙ্করী বা মঙ্গলময় / মঙ্গলময়ী তা যে রূপেই হোক না কেন, প্রতিটি মূর্তিতে শিল্পীর পটুতা লক্ষ্য করা যায়। এমন কি শিবলিঙ্গ, যেটা সেরকম কোন অর্থে মূর্তি নয়, সেটির গঠনেও পটুতা লক্ষ্যনীয়। জগন্নাথ মূর্তির মধ্যে ফুটে উঠেছে আদিম যুগের রেখাঙ্কন ভঙ্গি। অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল মূর্তিটির কাঠের এবং নিম কাঠের। নিমকাঠে পোকা ধরে না, যেজন্য এই কাঠের ক্ষয়প্রাপ্তি সময়সাপেক্ষ। নিমকাঠের ব্রাহ্মণত্বের অধিকার নেই, যেমন রয়েছে বট, অশ্বত্থ, বেল, ডুমুর বা পিপুল গাছের। হিন্দু বিগ্রহ সাধারণত হয় পাথরের বা মাটির। জগন্নাথ মূর্তি গঠনের আগে অপর কোন হিন্দু বিগ্রহ কাঠের হয়েছে, এরকম নজির পাওয়া যায় না।

হিন্দু বিগ্রহের পূজা প্রভৃতি আচার-অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদেরই একাধিপত্য, কিন্তু জগন্নাথের পূজা এবং আচার-অনুষ্ঠানে এক প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে শবর বা শাওড়া নামক আদিম উপজাতি। এই শবররা জগন্নাথের দয়িতা (প্রিয়জন) এবং আত্মীয় হিসেবে স্বীকৃত। পূজার আচরণ বিধিও সাধারণ হিন্দু আচরণ থেকে স্বতন্ত্র। জগন্নাথদেব সারাদিনে সাতবার খাদ্য গ্রহণ করেন এবং সাতবারে ৫৬ রকমের উপাদেয় খাদ্য দ্রব্য তাঁকে নিবেদন করা হয়ে থাকে। সূর্যের ঊষালগ্ন থেকে বিগ্রহের সম্মুখে চলে কর্মব্যস্ততা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পোশাক পরিচ্ছেদ পরিবর্তন, সুগন্ধি জলে স্নান, দন্তমঞ্জন, বিগ্রহের দিবানিদ্রা, রাত্রে নিদ্রার পূর্বে দেবদাসী কর্তৃক সংগীত এবং নৃত্য পরিবেশন (বর্তমানে এই প্রথা নিষিদ্ধ) —এরূপ কর্মকান্ড কোন হিন্দু বিগ্রহ পূজায় সাধারণতঃ দেখা যায় না। ব্যতিক্রম অবশ্য শ্রীকৃষ্ণ পূজা, তাও এত ব্যপক ভাবে নয়।

পূজাবেদীতেও জগন্নাথ মূর্তি একক নয়, চতুর্ধা মূর্তির কল্পনা করা হয়েছে। একই বেদীতে পাশাপাশি বলভদ্র, সুভদ্রা, জগন্নাথ এবং সুদর্শন পূজিত হচ্ছে। সুদর্শন কাপড়ে মোড়া একটি কাষ্ঠখণ্ড; শ্রীসুদর্শন অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্র। প্রতিটি মূর্তিই অসম্পূর্ণ। মাথা ও মুখের গঠনে তিনটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, পার্থক্য রয়েছে গায়ের রংও। ছোট্ট সুভদ্রা মূর্তিতে হাত দুটো নেই। তা যাই হোক, হিন্দু দেবদেবীর বিরাট আসরে এরকম আর কোন বিগ্রহ মূর্তির কল্পনার কথা জানা নেই।

তা এমন বিগ্রহের উৎস তাহলে কোথায়? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে ওড়িশা অর্থাৎ ওড্রদেশ আসলে ওড্র নামক অধিবাসীদের দেশ। ঐতিহাসিক যুগে আমরা ওড়িষ্যার বহু আদিবাসী গোষ্ঠীর কথা জ্ঞাত হই যার মধ্যে শবর গোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। বহু বিদগ্ধ ব্যক্তি ওড়িষ্যার ইতিহাস এবং জগন্নাথ মূর্তি সম্বন্ধে সঠিক ধারণায় পৌছনোর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন এবং করছেন। ফলে, মূর্তিটি কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন মতের সৃষ্টি হলেও ইদানীং কালে বিদ্বজন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দিগন্তের কুয়াশাজালে অনেকখানি ভেদ করেছে।

আদিম জনজাতির মধ্যে শাওড়ারা কিছু অমার্জিত দেবমূর্তি তৈরি করে থাকে। মূর্তিগুলি হয় কাঠের এবং এগুলির খোদাইকার স্থুল, অমার্জিত এবং বিকলাঙ্গ। শাওড়ারা বিকলাঙ্গ মূর্তি তৈরি করে কেন? সেই প্রসঙ্গে একটি লোকগাথা আছে—-

“রমনগিরি পাহাড়ে একদিন মহাপ্রভু কিট্টুং একটি পাথর ভেঙ্গে ফেলেন। পাথরটি ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে আগুন বেরিয়ে আসতে থাকে। ছিটকানো পাথরের টুকরো থেকে কিট্টুং -এর মাথা এবং শরীরের বাম দিক যথেষ্ট আঘাতপ্রাপ্ত হয়। শুধু তাই নয়, আগুনের তীব্রতা এত বেশী ছিল যে তাতে কিট্টুং-এর মাথা এবং পা দুটো পুড়ে যায়। খঞ্জ এবং বিকলাঙ্গ হয়ে কিট্টুং তখন থেকে ওইখানে অধিষ্ঠানে করতে থাকেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আগুন আবিষ্কার হওয়ার ফলে শাওড়ারা কিট্টুং-এর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে স্থির করে যে, পূজার্চনার জন্য তারা কিট্টুং -এর ঐরূপ বিকলাঙ্গ মূর্তি গঠন করবে।“

তাঁর মধ্যে কিট্টুংশ্রেষ্ঠ হচ্ছে উইউংসুন। শাওড়া কিংবদন্তীতে উইউংসুন ব্যতীত আরও কয়েকটি প্রভাবশালী কিট্টুং-এর কথা বলা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রতাপশালী হল দুই ভাই এবং এক বোন, যারা সর্বত্র এবং সর্বক্ষণ একসঙ্গে থাকে —–রাম্ম, বিম্ম এবং সীতাবোই। অবতার হিসাবে এই উপকথায় রয়েছে জগন্নাথ কিট্টূং-এর কথা আর রয়েছে পুরীর দেবতা হিসেবে মানজোরাসুম কিট্টুং। মানজোরাসুমের প্রতিকৃতিতে দেখা যায় তিনটি মূর্তি—- দুটি পুরুষ এবং স্ত্রী মূর্তি এবং কোন মূর্তিই পূর্ণাঙ্গ নয়।

এর অভ্যন্তরীণ কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন, আদিম উপজাতি অধ্যুষিত ওড়িশায় কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। রোগটিকে ভয়ের চোখে দেখা খুবই স্বাভাবিক। একটি সুস্থ সবল মানুষ রোগের কোপে পড়ে বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে থাকে— হাত পায়ের আঙুল খসে যাচ্ছে, নাক কানের লতি খসে পড়ছে, মানুষ রূপান্তরিত হচ্ছে এক বীভৎস চেহারায়। এই রোগের নিরাময়ের সাথে সূর্যের যেমন একটা সম্বন্ধ রয়েছে তেমনি নিমেরও একটা যোগ রয়েছে। এই রোগের নানান বিধানের মধ্যে একটি হল— নিমগাছের তলায় অনাবৃত অবস্থায় বারো বছর অতিবাহিত করা। ডাঃ সি আর মিত্র তাঁর ”নিম” গ্রন্থে (Neem :Indian Central Oilseeds Committee, 1963) বলেছেন, “কুষ্ঠরোগের ক্ষেত্রে চালমুগরার আনুষঙ্গিক হচ্ছে নিম।“ এই অনুষঙ্গেই অনেকে মনে করেন নিমকাঠের তৈরি ওই অসম্পূর্ণ জগন্নাথ মূর্তির জয়যাত্রা শুরু।

এখন রীতিবিরুদ্ধ এরূপ এক মূর্তিকে হিন্দু দেবদেবীর সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু কাঠখড় পোড়ানোর প্রয়োজন আছে। ফলে চালু করতে হয়েছে নানা কিংবদন্তী, রূপকথা এবং অতিকথা। হিন্দু শাসক এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় এই কাহিনী সমুদয়ের পরিকল্পনা, রচনা এবং বহুল প্রচলন শুরু করেছে মূর্তিটিকে বিষ্ণু মূর্তি বা কৃষ্ণের মূর্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায়। স্বীকার করতে হবে এদের এই প্রচেষ্টা ফলবতী হয়েছে। উপাখ্যানগুলি এক একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রচার ভঙ্গির প্রতিফলন।

যেহেতু জগন্নাথের নাভিস্থলে “ব্রক্ষমণি” বস্তুটি বুদ্ধের দাঁত না শ্রী কৃষ্ণের অস্থি এই নিয়ে জোর বিতর্ক আছে, দুটি উপাখ্যানই সংক্ষেপে বলা হচ্ছে।

বৌদ্ধ উপাখ্যান

বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর কুশীনগর থেকে ভিক্ষু ক্ষেমাথের বুদ্ধের একটি দাঁত স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কলিঙ্গে নিয়ে আসেন এবং সেটির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের এবং উপাসনার জন্য তৎকালীন কলিঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্তকে উপহার দেন। পরে রাজা গুহশিবের রাজত্বকালে মালবের তৎকালীন রাজা এই পুরানিদর্শনটি হস্তগত করার প্রয়াস করেন। স্মৃতিচিহ্নটির অলৌকিকতার কথা বহুল প্রচলনের ফলে মালবরাজের ন্যায় পাণ্ডুরাজাও আকৃষ্ট হন এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি সামন্তরাজা গুহশিবকে নিদর্শনটি পাটলিপুত্রে নিয়ে যাবার জন্যে অনুরোধ করেন। এদিকে, মালবরাজ ক্ষীরধারা গুপ্তচর মারফৎ দাঁত স্থানান্তকরণের সংবাদ পেয়ে পাটলিপুত্র অভিযানের আয়োজন করেন। পান্ডুরাজার কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ক্ষীরধারা মালবে ফিরে এসে জানতে পারেন যে স্মৃতিচিহ্নটি পুনরায় কলিঙ্গে রক্ষিত হয়েছে। পরাজিত হয়েও নিদর্শনটি সংগ্রহের জন্য মালবরাজ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, এই সংবাদ জ্ঞাত হয়ে রাজা গুহশিব পুরনিদর্শনটি রক্ষার জন্য সিংহলের রাজা মহাসেনার সঙ্গে যোগাযোগ করে সেটিকে সিংহলে প্রেরণ করার ব্যবস্থা করেন কিন্তু সেটি পৌঁছনোর আগেই রাজা মহাসেনের মৃত্যু ঘটে। সিংহাসনে আরোহন করেন তাঁর পুত্র মেঘবর্মা। তিনি নিদর্শনটি সমাদরে গ্রহণ করে অনুরাধাপুরে মন্দির মধ্যে সযত্নে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। পঞ্চম শতাব্দীতে ফা-হিয়েন এটি সিনহলে দেখেছেন বলে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন।

অষ্টম শতাব্দীতে যখন শম্বল রাজা ইন্দ্রভূতি জগন্নাথ মূর্তটিকে বুদ্ধমূর্তি বলে প্রচার করেন, তখন ঘোষণা করা হয়েছিল যে মূর্তির অভ্যন্তরে বুদ্ধের দাঁতটি রক্ষিত আছে।

বুদ্ধের একটি মাত্র দাঁত স্মৃতিচিহ্নরূপে রাখা হয়েছিল, এবং সেটি প্রথমে কলিঙ্গে, অতঃপর চতুর্থ শতাব্দীতে সিংহলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সুতরাং, অষ্টম শতাব্দীতে সম্বলরাজ ইন্দ্রভূতির এরূপ ঘোষণা ধোপে টেকে না।


হিন্দু উপাখ্যান

নীলমাধব— জারা নামক শবরের নিক্ষিপ্ত শরে দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয়। শবদাহ কার্য সম্পন্ন হবার পর দেখা গেল কৃষ্ণের হৃদয় পিঞ্জরটি আগুনের দাহিকা শক্তি অগ্রাহ্য করছে। এমতাবস্থায় দেহাস্থিটি দ্বারকায় সমুদ্রবক্ষে নিক্ষেপ করা হল। অনুতপ্ত জারা শবর সমুদ্রের কূল বরাবর দেহাস্থিটির গতি অনুসরণ করে ওড়িষ্যার পুরীতে এসে পৌঁছোয় এবং সমুদ্রতীর থেকে সেটা সংগ্রহ করে জঙ্গল মধ্যে পূজা করতে থাকে। ইতিমধ্যে জলে ভাসতে ভাসতে দেহাস্থিটি নীলপাথরে রূপান্তরিত হয়েছে। জারা শবরের পর তাঁর বংশধরেরা এর উপাসনা করতে থাকে। নীলপাথরটি নীলমাধব নামে পরিচিতি লাভ করেছে। কয়েক শতাব্দী পরে মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ভারতবর্ষে বিষ্ণু উপাসনার প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক হন। কিন্তু কোথা থেকে বিষ্ণুর অকৃত্রিম বিশুদ্ধ মূর্তি পাওয়া যাবে? স্বপ্নে দেখলেন নীলমাধবকে। রাজা তখন নীলমাধবের সন্ধানে ভারতবর্ষের চতুর্দিকে দূত পাঠান। ব্রাহ্মণ পুরোহিত বিদ্যাপতিকে পূর্বাঞ্চলের অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ওড্রদেশে জঙ্গলের মধ্যে শবরদের দেশে পৌঁছলে, শবর সর্দার বিশ্ববাসুর গৃহে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সেখানে নানা ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে দিয়ে গিয়ে (এত স্বল্প পরিসরে সব বলা সম্ভব নয়) অবশেষে শবরকন্যা ললিতাকে বিয়ে করেন এবং নীলমাধবকে দর্শন করেন। দর্শন করে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে বার্তা পাঠান।

কালক্ষেপ না করে সৈন্য-সামন্ত সমভিব্যাহারে ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলমাধবকে নিজ রাজ্যে নিয়ে আসার জন্য অভিযানে বেরিয়ে পরেন। বিদ্যাপতির নির্দিষ্ট স্থানে নীলমাধবের দর্শন না পেয়ে শবরপল্লী অবরোধ করে সর্দার বিশ্ববাসুকে গ্রেফতার করলে ইন্দ্রদ্যুম্ন আকাশবাণী শুনলেন, “শবরকে ছেড়ে দাও, সে আমার সেবক। নীলাদ্রির অপর একটা মন্দির নির্মাণ কর, দারুব্রহ্মরূপে আমি উপস্থিত হলে, সেখানে আমায় স্থাপন করবে।“

মন্দির নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হলে, দারুব্রহ্মরূপী নীলমাধবকে কোথায় পাওয়া যাবে এই চিন্তায় রাজা বিষণ্ণ হয়ে পড়েন এবং প্রাণত্যাগের সংকল্প করলে তিনি ফের স্বপ্নাদেশ পান, “সমুদ্রের বাঙ্কিমুহান (চক্রতীর্থের নিকট) নামক স্থানে পরদিন প্রাতঃকালে, দারুব্রহ্মরূপে ভাসতে ভাসতে আমি উপস্থিত হব।“

পরদিন স্বপ্ন নির্দেশিত স্থানে, দারুব্রহ্ম দৃষ্ট হলে রাজা সেটিকে তীরভূমিতে তোলার চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু ব্যর্থ হলেন। সেইসময় আবার দৈববাণী শোনেন, “আমাকে তীরভূমি থেকে তোলার জন্য শবর সর্দার বিশ্ববাসু এবং ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতিকে অনুরোধ কর।“

একদিকে বিশ্ববাসু অপর দিকে ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি হাত লাগালে কাষ্ঠখণ্ডটি অনায়াসে তীরভূমিতে তুলে আনা সম্ভব হল। অতঃপর মূর্তি গঠনের প্রচেষ্টা। ইন্দ্রদ্যুম্ন বহু শিল্পীকে আহ্বান করলেন কিন্তু দক্ষ সূত্রধরদের কুড়াল দারুখন্ডে দাগ কাটতে পারল না। তখন স্বয়ং বিশ্বকর্মা অনন্ত মহারানা নামে এক বৃদ্ধ শিকারির বেশে এসে একুশ দিনের শর্তে মূর্তি তৈরি করে দেবার আশ্বাস দেন। কিন্তু শর্ত থাকে মন্দিরের অভ্যন্তরে একুশ দিন কেউ প্রবেশ করতে পারবে না এবং মন্দিরের দরজা থাকবে বন্ধ। রানী চিন্তিত ও ধৈর্যহারা হলে তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য রাজা দরজা খুলে ফেলেন। সেই বৃদ্ধকে খুঁজে পাওয়া গেল না কিন্তু দেখলেন তিনটি অসম্পূর্ণ মূর্তি তৈরি হয়েছে। প্রতিজ্ঞা পালনে ত্রুটির জন্য ইন্দ্রদ্যুম্ন অনুশোচনা করতে থাকেন এবং অবশেষে প্রাণ বিসর্জন দেবেন বলেই স্থির করেন। সেই সময় পুনরায় দৈববাণী হয়, “কলি যুগে আমি এইরূপ ধারন করতে চাই। আমার হাত-পা-অবয়ব দৃশ্য না হলেও অনুরাগী ভক্তদের সেবা, পূজা, বন্দনা, প্রভৃতি গ্রহণ করব।“

এই বাণী শুনে রাজা কৃতার্থ হলেন। মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে কেন্দ্র করে এই উপকথার শুরু এবং শেষ।

এই সবের পেছনে যে গূঢ় কারণটি রয়েছে বলে আমাদের মনে হয়— সাম্রাজ্য বিস্তার এবং রাজত্ব রক্ষার জন্য প্রত্যেক রাজাকেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণের সহযোগিতা নিতে হয়। কূটনীতি ব্যর্থ হলেই নিতে হয় অস্ত্রের নীতি। রাজ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন সেনা সামন্তের এবং তা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে সাধারণ মানুষদের মধ্যে থেকে। ওড়িষার আদিম জাতিরা সঙ্খ্যায় ছিল যেমন গরিষ্ঠ তেমনি এরা ছিল অত্যন্ত সাহসী এবং পরাক্রমশালী। এই উপজাতিরাই ছিল রাজার বর্মবিশেষ। সৈন্য সংগ্রহের জন্য এদের নির্ভর করতে হত শবর, মুন্ড্রা, ওড্র ইত্যাদি আদিবাসীদের ওপর। এই সব উপজাতিদের পরাক্রমশীলতার নিদর্শন রয়েছে বিভিন্ন পুরাণ ছাড়াও অশোকের কলিঙ্গ অভিযানের মধ্যে, খরবেল প্রভৃতি নৃপতিদের রাজ্য বিস্তারের মধ্যে। স্বাধীনচেতা শবরদের রাজানুগত করার জন্য যে কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছিল, তা হল শবরদের দারুদেবতাকে স্বীকার করে নিয়ে সেটার যথাযথ মর্যাদা দেওয়া। স্বীকার করে নিতে হয়েছিল জগন্নাথ পূজায় তাদের অংশগ্রহণের অধিকার। ব্রাহ্মণ দূতের শবরকন্যাকে পাণিগ্রহন, বিগ্রহটিকে পূজা করার শর্ত মেনে নিতে বাধ্যকরণ প্রভৃতি বিষয়গুলি কূটনীতির অঙ্গ এবং অতিকথাগুলির সারমর্মও তাই।

তথ্য সূত্রঃ
K.C.Mitra— The cult of Jagananattha
H.K.Mahtab—- History of Orissa
N.Patnaik—- Cultural Tradition in Puri
R.K.Das—– Legends of Jagannath Puri
Verrier Elwin—– Tribal Myths of Orrissa

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *