prabandho-sada-kalor-lorai

সাদা কালোর লড়াই : সাহিত্যে ও সমাজে
সুমিত তালুকদার

টম কাকাকে হত্যা করা হয়েছিল। বলা ভালো ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছিল। অপরাধ সে তার প্রভুআজ্ঞা পালন করে নি। সর্বোপরি সে ছিল ক্রীতদাস ও কৃষ্ণাঙ্গ। তাই তার মনিব তার অবাধ্য হওয়ার জন্য চাবুক দিয়ে পেটায়। তার পাশবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে টম কাকা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তার মনিব সাইমন লিগরী বলে – তোর বাইবেলে তো লেখা আছে প্রভুআজ্ঞা পালন করা দাসানুদাসের কর্তব্য, কেন পড়িসনি ? রক্তাক্ত ও অশ্রুসজল কণ্ঠে টম কাকা বলে – My soul ain’t yours! It’s been bought and paid for by One…Ye may kill my body but ye can’t harm my soul. ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান টম কাকার কাতর স্বীকারোক্তি যেন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শ্রীকৃষ্ণ- র বাণীর মতো শোনায়—ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। পার্থিব শরীরের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু হয় না। আত্মা অবিনশ্বর। তাই সাইমন লিগরী তাকে খতম করে স্বর্গের দরজাই তার সম্মুখে উন্মুক্ত করে দিল। ১৮৫২ সালে শ্রীমতী হ্যারিয়েট বীচার স্টো (১৮১১ – ১৮৯৬) লিখিত “আঙ্কেল টমস কেবিন ” (টম কাকার কুটীর)- এর টম কাকার চরিত্রটি আজও প্রাসঙ্গিকভাবে আমেরিকায় গত ২৫ মে ২০২০ ঘটে যাওয়া বর্ণবিদ্বেষের শিকার জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস হত্যাকান্ডকে স্মরণ করায়। তারও শেষ কাতরোক্তি ছিল—আমি শ্বাস নিতে পারছি না (I can’t breathe) যা আজ এক নির্মম বিতর্কিত আপ্তবাক্যে পরিণত। আফ্রিকা ও আমেরিকায় সাদা কালোর সংঘাত নতুন কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নয়। আফ্রো- আমেরিকান ক্রীতদাসদের রমরমা বাজার ছিল আঠারো শতকের ‘ নিউ ইংল্যান্ড ’ খ্যাত আমেরিকায়। দাস ব্যবসা জমে উঠেছিল। টম কাকা ছিল তাদেরই একজন প্রতিনিধি। সুদীর্ঘ সময় পাশবিক নির্যাতন ও শোষণ সহ্য করতে করতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রায় গোটা মার্কিন দেশে, দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধে এভাবেই। বিশেষত আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত দক্ষিণ প্রদেশগুলিতে – ফ্লোরিডা, কেনটাকি, আলবামা, টেনেসি, জর্জিয়া, লুসিয়ানা, ইলিনয়, নিউ অরলিয়ান্স প্রভৃতি স্থানে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। হ্যারিয়েট বীচার স্টো- র আঙ্কেল টমস কেবিন হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীদের জীবনবেদ, ঠিক আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেমন বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা ছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ এবং ‘বন্দে মাতরম’।

অবশেষে আমেরিকার ষষ্ঠদশ রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫) এর হস্তক্ষেপে ও আন্তরিক চেষ্টায় Emancipation Proclamation আইন প্রণয়ন ও বলবৎ করে ১৮৬৩ সালে দাসপ্রথা চিরতরে অবলুপ্ত করেন। তিনিও স্বীকার করেছেন যে শ্রীমতী স্টো-এর ‘টম কাকার কুটীর’ কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল এই দাসপ্রথা বিরোধী ঐতিহাসিক Abolition Movement / American Civil War এ। লিঙ্কন স্টো-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন—Is this the little woman who made this great war? কিন্তু দুর্ভাগ্য, দক্ষিণ প্রদেশগুলির এই আন্দোলনকে সমর্থন, সহযোগিতা ও সহানুভূতি দেখানোর জন্য তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে খুন (assassination) হতে হয়। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও আফ্রো-আমেরিকার সংষ্কৃতি ও জীবনযাত্রায় সাদা কালোর লড়াই ও পারস্পরিক ঘৃণার সম্পর্ক বরাবরই জিইয়ে ছিল। আর তাই জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ছিল সামান্য স্ফুলিঙ্গ-এর আগুন মাত্র। প্রেক্ষাপট ও বাতাবরন আগে থেকেই তৈরি ছিল। হিংসাত্মক ও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ক্রমাগত অবিচার ও অপশাসনে। শুরু হয় লাগাতার Black Lives Matter নামে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে ঐতিহাসিক দাসব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কোলস্টোন-এর মূর্তিকে গলায় দড়ি বেঁধে নামানো হয় এবং তারপর লাথি মারতে মারতে বিসর্জন দেওয়া হয় আভন নদীতে। সুতরাং সহজেই অনুমেয় শ্বেতকায় সমাজের প্রতি বিদ্বেষ ও অসুয়া আজও কতখানি প্রবল ও প্রচন্ড। দাসপ্রথার মতোই ১৯৫৪-১৯৬৮ জুড়ে প্রায় সমগ্র আমেরিকা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল Civil Rights Movement এর ফলে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯২৯-১৯৬৮) তাঁর ইতিহাস খ্যাত সংগ্রাম ও ভূমিকাকে আজও আমেরিকার কালো মানুষেরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। কিন্তু তাঁকেও দুর্ভাগ্যবশত খুন হতে হয় আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো। লক্ষণীয় যাঁরাই কালো মানুষদের পক্ষে কিছু সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চেয়েছেন তাঁরা কোনো না কোনোভাবে গুপ্তহত্যার বলি হয়েছেন। লিঙ্কন এবং মার্টিন লুথার কিংবা জন এফ কেনেডি থেকে সাম্প্রতিক সময়ের জর্জ ফ্লয়েড। এ যেন বর্ণবিদ্বেষ ও জাতি বৈষম্যের খুনোখুনি ও রক্তপাতের এক ধারাবাহিক পরম্পরা। বহু কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়েছে সাদা কালোর লড়াইয়ের সূত্র ধরে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, নোবেল পুরস্কার বিজয়ীনী কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকা টনি মরিসনের ১৯৮৭ সালে পুলিতজার পুরস্কারে ভূষিত উপন্যাস ‘বিলাভেড’। দাসপ্রথার উপর ভিত্তি করে লেখা গল্পের নায়িকা মার্গারেট গারনার ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে পালিয়ে যেতে চায় ওহিও প্রদেশে। কিন্তু মাঝপথে ধরা পড়ে যায়। বংশ পরম্পরায় যাতে তার কন্যা সন্তানরাও ভবিষ্যতে তার মতো ক্রীতদাসী মা হয়ে উঠতে না পারে তারজন্য একে একে নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকে হত্যা করে। বাস্তবিকই এক মর্মস্পর্শী ট্র্যাজেডি। মনে পড়ায় শেক্সপিয়ারের ‘ ওথেলো ‘ নাটকের কৃষ্ণাঙ্গ মুর ওথেলোর স্বহস্তে প্রিয়তমা ডেজডিমোনার নির্মম হত্যাকান্ড।

দক্ষিণ আফ্রিকার বহু গল্প উপন্যাস নাটকেও উপজীব্য বিষয় হিসেবে উপস্থিত সাদা কালোর সংঘাত। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাইজেরিয়ান লেখক ওলে সোয়েনকার ‘ দি ইন্টারপ্রেটারস ’ কিংবা বেন ওকোরির ‘দি ফ্যামিশড রোড’ এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে। বায়েফরা ও য়ুওরুবা, জুলু ও বান্টু উপজাতির মিথ, লোক সংস্কৃতি, কালা জাদু ও ভূতপ্রেত নিয়ে এক অসাধারণ ম্যাজিক রিয়ালিজমের প্রয়োগ লক্ষনীয়। শ্বেতকায়া হয়েও নাদিন গার্ডিমার- এর বহু লেখায় উম্মোচিত হয়েছে কালো মানুষদের করুণ কাহিনী। আমরা বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে যতখানি অবহিত, ডেজমন্ড টুটু সম্পর্কে ততখানি জানি কী? জন্ম জোহানেসবার্গের ট্রান্সভিল-এ ১৯৩১ বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও কালো মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সাম্যের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল খেটেছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন। কালো মানুষের মুক্তি সংগ্রামে তার স্মরণীয় অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। মহাত্মা গান্ধীও দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৮৯৩-১৯১৪ সাল পর্যন্ত অবস্থানকালে তাঁর সত্যাগ্রহ ও অহিংসা আন্দোলনের মাধ্যমে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। আমরা জানি প্রথম শ্রেণীর টিকিট থাকা সত্ত্বেও প্রিটোরিয়া থেকে রেলযাত্রার সময় বলপূর্বক নামিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর অপরাধ কালা আদমি হয়ে তিনি একজন শ্বেতকায় যাত্রীর কামড়ায় ভ্রমণ করছিলেন।

কালা আদমি ও গোরা আদমির সংঘাত ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে যে কতখানি প্রবল ছিল তার জলজ্যান্ত উদাহরণ পাওয়া যায় খুশবন্থ সিংহের ‘ কর্ম ‘ ( Karma ) নামক গল্পটিতে। নায়ক স্যার মোহনলাল নেটিভ হয়েও ইংরেজদের আচার আচরণ, আদব কায়দা অন্ধের মতো অনুকরন করতো এবং তাদের সমকক্ষ হতে চাইত। একদিন রেলযাত্রার সময় বিল ও জিম নামে দুই গোরা সেনার সাথে তার মোলাকাত হয় এবং তাকে চূড়ান্ত হেনস্থা ও অপমান করে গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে এই বলে—Get the nigger out. উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে সাদা কালোর দ্বন্দ্ব প্রকট না হলেও জাতপাতের, শ্রেণীবৈষম্যের, উঁচু নীচুর ভেদাভেদ ও সংঘাত আজও অনিবার্যভাবে বিদ্যমান। শহিদ হতে হয় চুনি কোটাল ও রোহিত ভেমুলাদের। দলিত নিধন চক্রাকারে চলতেই থাকে। বাস্তবিকই বর্ণবৈষম্য ও জাতপাতের লড়াই এক জায়মান প্রক্রিয়া। ল্যাংস্টন হিউজ (১৯০২-১৯৬৭) যথার্থই বলেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘হোয়াট দি নিগ্রো ওয়ান্টস’ নামক বইতে – “প্রথমে আমরা ভদ্রভাবে বাঁচবার মতো রোজগার করতে চাই।….কেরানি, ব্যাঙ্কের কর্মচারী, বাসের কন্ডাক্টর ও ড্রাইভার এসব চাকরিতে একটি নিগ্রোকেও দেখা যায় না। আমরা শুধু লিফটম্যান, ঝাড়ুদার, চাকরানী….কারখানাতেও সেই একই ইতিহাস।” নিঃসন্দেহে এ এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা ও নির্মম সত্যের আত্মবিশ্লেষণ। আমেরিকার সাদা চামড়ার মানুষদের কাছে কৃষ্ণাঙ্গরা আজও লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ও সার্বিক সুযোগ সুবিধা লাভ থেকে বঞ্চিত। তাই দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, ঘৃণা ও বঞ্চনার ফিনিক্স পাখি হয়ে জন্ম নেয় বারবার বিক্ষোভ আন্দোলন। এমনটাই ইতিহাসের নির্মম পরিণতি ও পরিহাস।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *