তৃষ্ণা বসাক
না, একেবারেই ভুল পড়ছেন না। যে সেলাই মেশিনের ওপর ঝুঁকে পড়ে আপনার পাকা চুলের ঠাকুমা, দিদিমা বিছানার চাদর সেলাই করেছেন বা মায়েরা ছিটের কাপড়ের ফ্রক বানিয়ে দিয়েছেন, সেই সেলাই মেশিনের ঘরঘর শব্দের মধ্যে, স্পর্শের মধ্যে স্বমেহনের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন উনিশ শতকের পদার্থবিদরা। সেলাই মেশিনকে বলা হচ্ছে আধুনিক নারীর যৌনযন্ত্রিকা ভাইব্রেটরের পূর্বসূরী। মনে পড়ছে ‘পার্চড’ সিনেমায় কোমরে শাড়ির মধ্যে জড়ানো ভাইব্রেশনে থাকা মোবাইল হঠাৎ বেজে উঠলে হেসে গড়িয়ে পড়ে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার তিন সখি, বলে, ‘আমাদের আর পুরুষের দরকার নেই’!
Elias Howe ১৮৪৬ সালে সেলাই মেশিন আবিষ্কারের পর থেকে বদলে গেল মেয়েদের জগত। সেলাই কলই সেই যন্ত্র যা মেয়েদের ঘর থেকে টেনে বার করে আনল বাইরে কলকারখানায়। নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেশিনের ওপর ঝুঁকে কাজ করতে করতে মেয়েদের শরীর ভেঙ্গে পড়ত। পিঠের ব্যথা থেকে আরও অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। সেই ছবি ধরা আছে দুটি কবিতায়-
Work — work — work,
Till the brain begins to swim;
Work — work — work,
Till the eyes are heavy and dim!
Seam, and gusset, and band,
Band, and gusset, and seam,
Till over the buttons I fall asleep,
And sew them on in a dream! (by Rihana)
কিংবা
Thomas Hood এর সং অফ দা শার্ট-
With fingers weary and worn,
With eyelids heavy and red,
A woman sat in unwomanly rags,
Plying her needle and thread—
Stitch! stitch! stitch!
In poverty, hunger, and dirt,
And still with a voice of dolorous pitch
She sang the “Song of the Shirt.”
…
এত কষ্ট মেনে নিয়েও মেয়েরা সেলাই মেশিনকে আঁকড়ে ধরেছিলেন হয়তো এ তাঁদের স্বাধিকারের প্রথম আলো দেখাচ্ছিল বলে। কিন্তু সেইসময়ের অনেক পদার্থবিদ এই যন্ত্র নির্ভরতাকে যৌনতার নিরিখে দেখতে চেয়েছেন। পা দিয়ে প্যাডল করার সময়, সেই কম্পন যোনিতে ছড়িয়ে যাওয়া, এবং তা থেকে যৌন তৃপ্তি –এইরকম একটা তত্ব তাঁরা খাড়া করতে চেয়েছিলেন।
পশ্চিমী স্বমেহনের তত্ত্বে সায় দিতে যাঁদের মন চাইবে না, তাঁরা এটা নিশ্চয় মেনে নেবেন যে সেলাই কলের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়ে যায় মেয়েদের, এর মধ্যে একটা অবসাদমুক্তির পথ খোঁজেন তাঁরা।
ঊষা সেলাই মেশিনের পুরনো বিজ্ঞাপনে দেখা যায় মা সেলাই শেখাচ্ছেন মেয়েকে ঊষা সেলাই মেশিনে, কপিতে লেখা ‘ট্রেন হার টু বি অ্যান আইডিয়াল হাউজওয়াইফ। বাই হার আ ঊষা সিউয়িং মেশিন।’
‘যখন ছোট ছিলাম, দিদিমা, মা, মায়ের পিসিমা, এমনকি মাসি যিনি বিদেশে থাকতেন, দেশে এলে তাকেও দেখতাম একটা সেলাইকলে সেলাই করতে। অতিপ্রাচীন ঊষা সেলাইকল, পাদানি সম্পন্ন, পা দিয়ে চাপ দিয়ে চালানো চলে, আবার হাতল ঘুরিয়ে হাত মেশিনের মতও চালানো যায়। আমার দিদার মেশিন।… ১৯২০ সালের আশেপাশে কোন সময়ের জিনিস সেটি।
মায়ের আর একটি সেলাই কল ছিল, সেটা সিঙ্গার মেশিন। আমাদের অনতিশৈশবে, ১৯৭৮ সালের বন্যার কথা মনে আছে স্পষ্ট। টানা দু-চারদিন বাড়ি থেকে বেরনো নেই, বৃষ্টির বিরাম নেই… আর সারাদিন ঘরঘর ঘরঘর করে সেলাই করে চলেছেন আমার মা… ওভাবেই এড়িয়ে চলেছেন ডিপ্রেশনের ভেতরদিকটা।
এইসব স্মৃতি জুড়ে জুড়েই আমার মেয়েবেলা ক্রমশ সেলাইকলে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। আমার মন খারাপ হলে সেলাই করতে ইচ্ছে করে। মন ভালো হলেও’
(শ্রী শ্রী অন্নপূর্ণা ভাণ্ডার, যশোধরা রায়চৌধুরী)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে মেয়েদের ঘর থেকে শুধু ঠেলে বার করল তাই নয়, সেই প্রথম মেয়েরা কাজ পেল কলকারখানায়। কারণ ছেলেরা সব যুদ্ধে চলে যাওয়ায় অনেক শূণ্যপদ তৈরি হয়েছিল। আর কারখানার মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে বেশি মেয়েদের চাকরি দিত পোশাক কারখানাগুলো। প্রথম যে নারী আন্দোলন, তা কিন্তু শুরু করেছিল পোশাক কারখানার মেয়েরাই। তাই বলা যেতেই পারে সেলাই মেশিন শুধু মেয়েদের অন্ধকার ঘরে সেলাই দিদিমণি করেই রাখেনি, মুক্তির ইশারাও দিয়েছিল। তাই স্ব মেহনের থেকে স্বনির্ভর শব্দটাই বেশি লাগসই, তাই না?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন