rannaghar-ruskin-bond-er-recipe-theke

রাস্কিন বন্ডের রেসিপি থেকে
পূর্বা মুখোপাধ্যায়

“It is always the same with mountains. Once you have lived with them, for any lenghth of time ,you belong to them. There is no escape.” – Ruskin Bond.

ল্যান্ডওর। একটা ছোট্টো পাহাড়ী শহর। মুসৌরি আর ল্যান্ডওর পাশাপাশি দুই বন্ধু। একসময় এটা ছিল অ্যামেরিকান ক্যান্টনমেন্ট। তারপর ব্রিটিশেরা এল। ক্যাপটেন ইয়ং আর আর মিস্টার শোর ঠিক করলেন মুসৌরিতে আলু চাষ করবেন। এবারে স্থানীয় লোকেরা বলল, পাহাড়ের বেশ ওপর দিকে গেলে অনেক জমি, আলো হাওয়া, চাষবাষ ভালো হবে। তা দুই অফিসার উঠছেন আর উঠছেন। কিছুতেই আর জায়গা পছন্দ হয় না। চার হাজার ফুট ছাড়িয়ে ওক আর রডোডেন্ড্রনের সারি। ছ’হাজার ফুটে দেবদারু। দারুণ আবহাওয়া। শীতল। মন এমন খুশি হয়ে উঠল যে আলু চাষ মাথায় উঠেছে তখন। তার বদলে একটা ছোট্টো শিকার ঘর তৈরি করে ফেললেন। সেখানে তখন বিশেষ বসতি নেই। ভাল্লুক, লেপার্ড, হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। বছর দুই বাদে ক্যাপটেন ইয়ং যখন কলোনেল হলেন এখানে পাকাপাকি বাড়িই বানিয়ে ফেললেন। নাম দিলেন মুলিংগার, আয়ারল্যান্ডে তাঁর বাড়ির নামে। আস্তে আস্তে অনেকেই এলেন। ১৮৩০ সালে ল্যান্ডওর আর মুসৌরি শৈল শহর হিসেবে পরিচিতি পেল। যদিও রাস্কিন বন্ড বলছেন এর নাম হওয়া উচিৎ ছিল মাউন্ট আলু। রাস্কিনীয় রসবোধ।

রাস্কিনের ছোটোবেলা এখানেই কেটেছে। একসময়ের ররমরমা। সেই সময়ের মানুষজন। কেবল ট্যুরিস্ট স্পট নয়। বাবার মৃত্যুর পরে গ্র্যানির কাছেই থেকেছেন। সহজ, অনাড়ম্বর জীবন। ছোটোবেলায় তাঁর গ্র্যানি কথায় কথায় প্রবাদ বাক্য আঊড়াতেন, বলতেন – “Eating and drinking shouldn’t keep men from thinking.” বাড়ির মেনু ছিল দুপুরে ভাত আর সবজি, রাতে রুটি, কখনো মাটন আর চিকেন। তার মধ্যেই ছিল স্যাভয় বেকারি। ল্যান্ডওরের বেকারি ছিল বিখ্যাত। অনেক পাহাড়ী শহরেই যেমন হয়। পাশ্চাত্য প্রভাব। পাহাড়ী পথে মাথায় বাক্সো নিয়ে ফেরি করত কেক-বিস্কুট-পাঁউরুটি। একজন বেকার কিন্তু ল্যান্ডওরেই থেমে থাকে নি। জনৈক অ্যামেরিকান মহিলাকে বিয়ে করে পাড়ি দিলে বিদেশে। সানশাইন বেকারি থেকে বান কিং অফ মন্টানা হয়ে গেল সে। তারপর থেকে অনেকেই সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করল। তাতে অবশ্য ল্যান্ডওরের ভাঁড়ারে টান পড়ে নি।

আর ছিল চার্লভিল রোডের ওপর রিভিয়েরা। ভীড় হত খুব। পয়সা না থাকলে নব্য যুবকেরা দাবী করত – স্যুপে মাছি পড়েছে বা আইসক্রীমে। ওয়েটারেরা ছিল রসিক, বলত, ও সাঁতার কাটতে এসেছে স্যর, একটু বিনোদন আর কি! পাহাড়ের বাঁকে, পাকদন্ডীর ধারে ধারে, পাখির গানে এইসব গল্প আজও লেখা আছে। সে সময়ের মানুষ আজ আর নেই। কিন্তু যারা সেই সময়ের ছিটেফোঁটাও পেয়েছিলেন, যেমন রাস্কিন বন্ড, আমাদের জন্যে সাজিয়ে রেখে দিয়েছেন, মনের খাদ্য, স্বপ্নের মেনু, কল্পনার রেসিপি।

সেইসব রেসিপি বিখ্যাত হয়ে আছে রাঁধুনির নামে, মিসেস গ্রে’র স্ট্যু, মিসেস রিডলের স্টেক, মুডির পুডিং ইত্যাদি। আজ সেই সব রেসিপি থেকেই কয়েকটি দিলাম। এই রেসিপিগুলো সে সময়ের ভাষায়, উপাদানে, ওজনের ইউনিটে লেখা। আজ বুঝতে অসুবিধে হয়। সময়ের সাথে সাথে কিছু জিনিসপত্রও ব্যবহার হারায়। তাই রেসিপিকে নিজের মতো করা আছে। রাস্কিন বন্ড অবশ্য বলেছেন – যে কেউ নিজের মতো বানাতেই পারে, তবে তা উৎরেছে কি না বলতে পারবেন রাস্কিন বন্ড, চেখে দেখে।

বাটার কুকিজ


মিসেস ডোনাল্ডের রেসিপি অনুযায়ী অবশ্য সুগার কুকিজ। খুব সহজ। ডিম লাগবে না। ওভেনেও দিতে হবে না। সব মিলিয়ে মিনিট চল্লিশেকেই হয়ে যাবে ১০-১২ টা কুকিজ। মাখন নিন আধা কাপ। নুন ছাড়া মাখন হলে ভালো। নইলে রোজের আমুল বাটার হলেও চলবে।ভালো করে ফেটান। তারের হুইস্ক বা হ্যান্ড ব্লেন্ডার। বেশ মোলায়েম হলে আধা কাপ গুঁড়ো করা চিনি মেশান। আবার ভালো করে ফেটান যতক্ষণ না হাত টন্‌টন্‌ করছে আর চিনির দানার খস্‌খসে ভাব উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চাদের এই কাজটা দেওয়া যায়। মাঝে মাঝে একটু চেখে দেখে অবশ্য ওরা। তবে মিক্সি বা ব্লেন্ডারে কাজটা ঠিক মনের মতো হয় না। এবার এক কাপ ময়দা। একটা কাঠের স্প্যাটুলা দিয়ে মেশান। আটা মাখার মতো করে মাখবেন না। আলতো হাতে মেশাবেন। কিছুটা কাজু কুচি করে শুকনো খোলায় ভেজে রাখুন সোনালী করে। কিছুটা চকোলেট ছোটো ছোটো টুকরো করে রাখুন। সেগুলোও মিশিয়ে দিন। মাখাটা মোলায়েম হলে গোল করে একটা চাপা দিয়ে আধ ঘন্টা রেখে দিন। ততক্ষণে একটা বেকিং ডিশ রেডি করুন। আর গ্যসে একটা তলা ভারী পাত্র বসিয়ে গরম হতে দিন। এমন পাত্র নেবেন যার ভালো ফিট হয় এমন ঢাকা আছে। আজকাল যেসব নন স্টিক প্যান উইথ লিড পাওয়া যায় সেরকম। এবার মাখা ময়দাটা থেকে বাতাসার আকারে ও সাইজে কুকি গড়ুন আর বেকিং ডিশে সাজান। বেশ অনেকটা করে গ্যাপ রাখবেন কুকিজের মাঝে, নইলে লেগে যাবে। একটা ডিনার প্লেটের সাইজের বেকিং ডিশ হলে বড় জোর আটটা কুকিজ। এবার গরম হয়ে যাওয়া প্যানে একটা স্ট্যান্ড রেখে তার ওপরে বেকিং ডিশটা বসিয়ে চাপা দিয়ে একদম কম আঁচে মিনিট তিরিশ রাখুন। দেখবেন কুকিজের পাশ বেশ লাল হয়ে এসেছে আর কুকিজের গন্ধে আপনার রান্নাঘর ছাড়িয়ে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। কফি বা চা রেডি করুন। কুকিজ একদম রুম টেম্পারেচারে আনুন। পাখা চালিয়ে ঠান্ডা করবেন না যেন আবার। যে ক’টা খাবেন খান, বাকি বয়ামে ভরে রেখে দিন। আর দোকানে গিয়ে এক গাদা দাম দিয়ে কুকিজ কিনতে হবে না, গ্যারান্টি।

চীজ বল


ল্যান্ডওরের স্পেশালিটি মিসেস অ্যান্ডারসনের চীজ বল যদি খান তা হলে আর কিছু মুখে লাগবে না। ১০০ গ্রাম মাখন আর এক কাপ জল আঁচে বসান। তেলে জলে ঠিক মিশ খায় না জানি, মাখনে জলেও না, একটু ভেসে ভেসে থাকবে তাও কিছুটা মিলমিশ হবে একসময় একসাথে জ্বলতে জ্বলতে। এবার গ্যাস থেকে নামিয়ে তাতে মেশান এক কাপ ময়দা। ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে আবার আঁচে বসান আর ক্রমাগত নাড়তে থাকুন। একসময় দেখবেন ধার থেকে ছাড়তে শুরু করেছে মিশ্রন। আবার নামান আগুন থেকে। একটু ঠান্ডা হতে দিন। এবার আধা কাপ গ্রেট করা চীজ আন্দাজমতো নুন আর গোলমরিচ মেশান। নুন বুঝে দেবেন , কারণ চীজে নুন থাকে, মাখনেও। আর মোজারেলা-টেলা নয়, পাতি আমুল বা ব্রিটানিয়ার প্রসেসড চীজ হলেই হবে। শেষে তিনটে ডিম ভালো করে ফেটিয়ে চীজ-ময়দার গোলাটায় মেশান। লিকুইড, অনেকটা তালের বড়ার গোলাটা যেরকম হয় সেরকম হবে। চামচে করে ছোটো ছোটো গোলা গরম তেলে ফেলুন। দেখবেন টুপুটুপু হয়ে ফুলে উঠছে। ও হ্যাঁ, তেল গরম হলে আঁচ কমিয়ে দেবেন, নইলে ওপরটা পুড়ে কালো হয়ে যাবে। আর ডুবো তেলে ভাজতে হবে। সস দেবেন, টমেটো সস। এই বর্ষায় বিকেলে কফির সাথে, ট্রাই করুন অবশ্যই, আর দুজনে প্ল্যান করুন নেক্সট ট্রিপ, পাহাড়ে, দেরাদুন, মুসৌরি। আর একটা ভারী ইন্টারেস্টিং রেসিপি আছে ল্যান্ডওরের মিসেস ক্লেমের – চীজ জিলিপি। একবার করব, আর জানাবো আপনাদের।

স্প্যানিশ রাইস


এবার একটু পেট ভরা ভাত হোক। ভারতে থাকব আর ভাত খাবো না, হয়? তবে সে সময়ের ব্রিটিশ বা অ্যাংলো তো। সেই ভাতেও একটু ফরেন টাচ থাকবে না, তা হয় না। আর ভেতো বাঙালির মতো ভাত ডাল মাছের ঝোল হাত দিয়ে মেখে চেটেপুটে খাব তা ওসব চেয়ার টেবিলে তখন ভাবাও যেত না। কাঁটা-চামচ, ডিনার প্লেট, ন্যাপকিন, সাথে একটু ফ্রাই-টাই, স্যালাড এসব আর কি। কিন্তু চট জলদি হতেও হবে। সারাদিন রান্নাঘরে চাপাটি পাকানো সে সব মেমসাহেবদের চলত না। রান্নাবান্না সেরে ক্লাবে গিয়ে একটু রাম্মি টাম্মি খেলা, একটু গসিপ, ছাতা মাথায় দিয়ে মার্কেটে গিয়ে লেস-টেস কেনা, এসবও করতে হয়। কাজেই আগের দিনের বেঁচে যাওয়া ভাত দু কাপ। সাথে একটু সেদ্ধ চিকেন বা বেকন। একটা বড় পেঁয়াজ স্লাইস, লম্বা লম্বা, ৩-৪ টে টমেটো কুচি , ক্যাপসিকাম কুচি, আর নুন গোলমরিচ। ডিম সেদ্ধও রাখতে পারেন ২-৩ টে, সেদ্ধ করে কেটে ফালি করা বা আধখানা করা। প্রথমে সেদ্ধ চিকেন পেঁয়াজ দিয়ে সামান্য তেলে সাঁতলে রেঁধে নিন। বেকন হলে তেল লাগবে না, ওর ফ্যাটেই হয়ে যাবে। ক্যাপসিকাম দিন।এবার টমেটো দিন আর একদম গলে ঘেঁটে যাওয়া অব্দি রাঁধুন। সেদ্ধ ভাত দিন। নুন গোলমরিচ দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নামান। এই ভাত যেন একদম গলা টাইপ না হয়। একটু সাদা ঝরঝরে ভাত হবে। কারণ এই মাখা ভাতটা একটা গ্রীসড প্যানে ছড়িয়ে ওপর থেকে আধা কাপ গ্রেট করা চীজ দিয়ে মিনিট দশেক ওভেনে সেঁকে লাল লাল করে নিন। পরিবেশনের আগে ডিম সেদ্ধ সাজিয়ে দেবেন। চট জলদি পেট ভরা সুখাদ্য, সুষমও বটে।

কফি পুডিং- মধুরেণ সমাপ্যেৎ


এটা গোরা সাহেবরাও মানত। ল্যান্ডওরে দুধওয়ালাদের রমরমা ব্যবসা ছিল। পাহাড়ী জায়গায় দুধ খুব প্রয়োজনীয়। ছানা, চীজ, মাখন, মিষ্টি সবেতেই দুধ লাগে। তারপর হট চকোলেট, শেক, কফি ইত্যাদি তো আছেই। আর পুডিং। রাস্কিন বন্ডের কথায় এই দুধওয়ালাদের দুধ হত ভিন্ন ভিন্ন কোয়ালিটির। আর তা মূলতঃ জল মেশানোর কারণে। বন্ডের বাড়ির দুধে যে জল মিশত তা ভিক্টর ব্যানার্জির জিঞ্জারব্রেড বাড়ির কলের। পেছনের জানলা থেকে তা দেখে মিচকি মিচকি হাসছেন যখন ভিক্টর তখন তিনি জানেনও না যে তাঁর বাড়িতে যে দুধ সাপ্লাই হবে তাতে জল মিশবে প্রমোদ কাপুরের বাড়ির বাগানের কল থেকে আর যা দেখে প্রমোদ কাপুরও বেশ হাসছিলেন আর কি…

কফি পুডিং বানাতে গেলে দুধ লাগবে দুই কাপ। ফোটাতে বসান। ততক্ষণে ৩ টেবিল স্পুন কর্ফ্লাওয়ার ওয়ান ফোর্থ কাপ জলে গুলে রাখুন। আর একটা বাটিতে দুই টি স্পুন কফি দুই টি স্পুন জলে গুলে রাখুন। দুধ ফুটে উঠলে আধা কাপ চিনি মিশিয়ে কিছুক্ষণ ফুটতে দিন যতক্ষণ না চিনি সম্পূর্ণ গুলে যাচ্ছে। এবার কফি গোলাটা মেশান। ভালো করে নাড়িয়ে দিন। এবার ফুটন্ত দুধে কর্নফ্লাওয়ার গোলা ঢেলে খুব ভালো করে সমানে নাড়তে থাকুন। ঘন হবে কিন্তু দানা বাঁধবে না। গ্যাস বন্ধ করুন। একটা পুডিং-এর পাত্র ভালো করে তেল বা মাখন মাখিয়ে রাখুন। মিশ্রনটা ঢেলে দিন। ফ্যানের তলায় ঠান্ডা হতে দিন। এসময় একদম নাড়াচাড়া করবেন না, ভেঙে গিয়ে বিশ্রী দেখতে হয়ে যাবে। দু চামচ চকোলেট গ্রেট করে পুডিং-এর ওপরে ছড়িয়ে দিন। ঠান্ডা হলে ফ্রীজে ঢুকিয়ে দিন। মিনিমাম দু ঘন্টা রাখুন ফ্রিজে। তারপরে কেটে কেটে দিন সবাইকে। নিমেষে ফুরুৎ হয়ে যাবে, কথা দিলাম।

ল্যান্ডওর তার আগের গরিমায় আর নেই হয় তো। নতুন ঢেউ এসে লেগেছে। “তবু তো কজন আছি বাকি।“ লক্ষ্মী ত্রিপাঠীর বাড়ির চিকেন ইন গার্লি সস, ভিক্টর আর মায়া ব্যানার্জির বাড়ির খাওসোয়ে, নন্দু জোহরের চিকেন ইন হোয়াইট সস, কিরণ কাপুরের দম পখতের গন্ধ এখনো ভেসে বেড়ায় ল্যান্ডওরের বাতাসে। বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে দেখা হয়ে যায় ব্রিগেডিয়ায়র যাদবের সাথে; তিনি বলেন চলে যাবেন এবার, আর মন টিঁকছে না। আর একটা পুরোনো বাড়ি খালি হয়ে যাবে। তারপর হয়তো এক সন্ধ্যায় দেখা করতে আসবে সস্ত্রীক বিশাল ভরদ্বাজ। ওরা মাঝে সাঝেই আসে, থেকে যায়। মুসৌরি –ল্যান্ডওরের মেঘে ঠিকানা লেখা আছে। গ্র্যানির কথা মনে পড়ে রাস্কিন বন্ডের। খেতে এখনো ভালোবাসেন তিনি, গণেশ সইলি রাঁধেন ভালো, রাস্টি খান। আর তারপর ভেবে নিয়ে জীবনের সারকথা লিখে রাখেন, আমাদের জন্য –
“Red roses for young lovers, French beans for long lasting relationships.”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *