বিতস্তা ঘোষাল
“আমার সঙ্গে ডেট করবে?”
“মানে?”
“মানে আমি তোমার সঙ্গে একদিন ডেটিং করতে চাই।”
ডেটিং মানেটা ঠিক কী? চারদিকে শুনি। কিন্তু বুঝি না ঠিক।”
“সম্ভবত আমরা আগে যাকে দেখা করা বলতাম সেটাই।”
“ও। তা দেখা করতে চাইছিস কেন?”
“আমি তোমার মুখ থেকে ‘তুই’ শুনতে চাইছি না।তুমি বলবে আমাকে।”
“কেন?”
“কারণ… আগে একটা চুমু দাও। তারপর বলব।”
“চুমু দেব কেন?”
“সব কিছুর কেন হয় না।”
উত্তরটা পড়ার পর সুনেত্রা ঘড়ি দেখল। পাক্কা দুটো কুড়ি। এত রাত অবধি সে সচরাচর মোবাইলে অনলাইন থাকে না। ঘুম না এলে হয় নিজের লেখা নিয়ে বসে, নয় কিছু বইপত্র পড়ে। আবার কখনো চুপচাপ বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।কত অজানা গ্রহ নক্ষত্র সেখানে। কোটি কোটি সংখ্যায় তারা। ক’জনের নাম আর জানা গেছে তাদের মধ্যে! তারা সে নামের পরোয়াও করে না। নিজস্ব আনন্দে মেতে আছে। প্রতিটার থেকে প্রতিটা কত দূরে! অথচ কেমন সবাই সবাইকে আকঁড়ে রয়েছে। যেন একটু এদিক ওদিক হলেই সব ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মতো। সুনেত্রা অবাক চোখ নিয়ে সেই রহস্যময় অনন্ত শূন্যতাকে দেখে। কিন্তু ক’দিন ধরে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হচ্ছে। অনেক রাত অবধি চ্যাট চলছে। ও প্রান্তের মানুষটিকে সে চেনে, ছোট থেকেই। বয়সে বছর দশেক কিংবা তারও বেশি ছোট হতে পারে। সে তাকে দিদি বলেই ডাকে, আর সুনেত্রাও তাকে ভাই বলে। তার বাবা নাম করা স্বর্ণ ব্যবসায়ী। ছোটবেলায় মা তাদের দোকান থেকে সোনা রুপোর গহনা কিনতে যেত। সেও যেত মায়ের সঙ্গে। তখনো এই ছেলেটি জন্মায়নি। যে বাড়িতে দোকান ছিল তার পিছন দিকে মস্ত বড় বাগান। সেখানে সুনেত্রা নিজের মত খেলত। একটা দোলনা ছিল। তাতে দুলত। ছেলেটি যখন জন্মালো তখন তারা সেই পুরোনো পাড়া ছেড়ে অন্য অঞ্চলে চলে গেছে। শেষ দেখেছিল নিজের বিয়ের অলঙ্কার কিনতে গিয়ে। তখন বাচ্চাটা সবে ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ে। মিষ্টি গোলগাল চেহারার একটা বাচ্চা। দেখলেই গাল টিপে দিতে ইচ্ছে করত।
বিয়ের পর চেনা পাড়া, শহর ছেড়ে চাকরির কারণে প্রায় কুড়ি বছর প্রবাসে কাটিয়ে যখন আবার শহরে ফিরল তখন বাপের বাড়ির কাছেই ফ্ল্যাট কিনে থিতু হল। পুরোনো মুখগুলো অবশ্য ততদিনে সব অচেনা। চারদিকে সাবেকি বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট। পরিচিত মুখের খোঁজে ফেসবুক সার্চ করতে করতে হঠাৎ করেই পিপল ইউ মে নো-তে এই মুখটা দেখে শৈশবের নানা স্মৃতি ক্যামন সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই বাগান, দোলনা, একজন মহিলা যাকে তারা সকলে পিসি ডাকত, দেখলেই বলত, যাসনে যাসনে, রাক্ষস আছে ওখানে, গেলেই ধরে নেবে…। সেই সব কিছু কতটা বদলে গেছে জানার জন্য সুনেত্রা সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। ওপ্রান্ত থেকেও কিছুক্ষণের মধ্যেই একসেপ্ট হল রিকোয়েস্ট। তারপর অল্প অল্প করে শুরু হল গল্প। সে গল্পে ছেলেটি যত না বলে তার থেকে দ্বিগুণ বলে যায় সে।
ছেলেটির নাম দিগন্ত। বয়স ত্রিশের আশেপাশে। বিবাহিত। একটি মেয়েও আছে। অবশ্য এগুলো সবই সুনেত্রা হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি দেখে বুঝেছে। একটি অল্প বয়সী হাসিমাখা মেয়ে তার বরের বুকের কাছে মুখ রেখে সেলফি তুলেছে, আর কোলের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে ছোট্ট মিষ্টি এক বাচ্চা। নিটোল সুখী সংসারের এক চিত্র। এই ধরনের ছবিগুলো দেখতে সুনেত্রা খুব পছন্দ করে।সে তার ডিপিতে বাবার সঙ্গে ছবি রেখেছে বহু বছর ধরে। একটাই ছবি। সেই ছবি মোবাইল পালটে গেলেও স্থির, নিশ্চল, একই। তবে স্টেটাসের ছবি বদলে যায় মাঝে মাঝেই। সেখানে কখনো নিজের, কখনো পরিবারের মানুষদের সঙ্গে ছবি দেয়।
দিগন্ত বলে, “আপনি এত কিছু মনে রেখেছেন কিভাবে আর কেনই বা?”
সুনেত্রা জবাব দেয়, “আমরা যতটুকু মনে রাখতে চাই ততটুকু মনে থেকে যায় চিরদিনের জন্য। আর যেগুলো চাই ভুলে যেতে সেগুলো মুছে দিই মেমরি থেকে। আমি আমার ছোটবেলার সব কিছু মনে রাখতে চেয়েছি, তাই সেগুলো মাঝে মাঝেই রিওয়াইন্ড করে দেখি।”
“আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন। মনে হয় অনন্ত কাল চলুক আপনার কথা। আমি কেবল শুনে যাই।”
“ওমা তাই?” একটা ইমোজি পাঠায় সুনেত্রা।
“না না আসলে এখন মন খুলে কথা বলার লোক কমে গেছে। অধিকাংশ মানুষ কথা বললেই সে কত শক্তি ধরে, রাজনৈতিক নেতাদের কত ঘনিষ্ঠ, কিংবা কার কটা বাড়ি গাড়ি এসব নিয়ে এত বড়াই করে যে কথা বলার ইচ্ছেটা চলে গেছে।”
সুনেত্রা বলে, “তুমি বুঝি এসব ভালবাসো না?”
“না। কী হবে এসব নিয়ে ভেবে! যা আছে তাই নিয়েই আমি ভালো থাকতে চাই।”
“ঠিক।”
দিগন্তের সঙ্গে সুনেত্রার একটা মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় এভাবেই।
তবু কখনো কখনো সেই সম্পর্কের চেনা রসায়ন ভেঙে যায়। অন্য দুটো মানুষ উঠে আসে। তখন আর ধরাবাঁধা সম্পর্ক থাকে না, নিছক বন্ধুত্ব বা তার থেকেও বেশি কিছু তৈরি হয়।
এক্ষেত্রেও তাই হল।
মোবাইল ব্লিঙ্ক করল। দিগন্তের মেসেজ এল। “কী হল? কোথায় গেলে?”
সুনেত্রা লিখল, “আছি, বল।”
আবার বলছো- “বল! আশ্চর্য! আমি তোমাকে বললাম না ‘তুমি’ সম্বোধন করবে।”
“তোর ডিপির ছবিটা কবে সরালি?” সুনেত্রা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লিখল।
সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দিগন্ত বলল, “তুমি আমাকে পছন্দ করো? সত্যি বলো?”
“পছন্দ অপছন্দের কথা উঠছে কেন?”
“উঠছে, কারণ তুমি জানো।”
“কী জানি?”
“এই যে আমি তোমাকে মিস করছি।”
“মিস করছিস? কেন? আচ্ছা আমাকে দুটো কারণ বল মিস করার।”
“সব কিছুর কারণ থাকে না।”
“নিশ্চয়ই থাকে। কারণ ছাড়া কার্য হয় না।”
“তুমি আমার সঙ্গে ডেটে যাবে না?”
“আমার সঙ্গে কোথায় যাবি তুই? আমার নিজেরই কোনো ঠিক নেই কখন কোথায় যাই, কেন যাই, কোথায় থাকি তার।”
“সে সব আমি জানি না। তোমার সঙ্গে একদিন আমি পুরো থাকতে চাই।”
“কেন?”
“বললাম যে এই কেনর উত্তর আমি জানি না। তবে আমি তোমাকে, তোমার ভেতরের তুমিটাকে আবিষ্কার করতে চাইছি।”
“তাই! আমি নিজেই তো জানি না আমার মধ্যে আবিষ্কার করার মতো কিছু আছে কিনা।”
“তুমি প্রসঙ্গ পালটে ফেলতে চাইছ ইচ্ছে করে।”
“বল কোথায় যাবি?”
“যেখানে নিয়ে যাবে।”
“আমি জানি না কোথায় নিয়ে যেতে পারব! তবে আমার সঙ্গে যাওয়ার আগে কতগুলো কথা শুনে নে। তারপর ভেবে দেখ যাবি কিনা!”
“বলো।”
“আমি হয়তো যেতে চাইলাম মুর্শিদাবাদ, সেভাবেই সব ভেবে ঠিক করলাম। কিন্তু দেখা গেল পথ পালটে চলে গেলাম বাঁকুড়া। আবার তুই জেনে গেলি যে আমি অমুক হোটেল বা অমুক জায়গায় থাকব। অথচ দেখা গেল আমি হয়তো সারারাত স্টেশনে, কিংবা রাস্তায় কাটিয়ে দিলাম। এমনকি শ্মশানেও থেকে যেতে পারি।”
“এগুলোর মধ্যে দিয়ে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?” দিগন্ত বলল।
“বিশেষ কিছু না। আমি আমার এই মাথার ব্যামোটির কথা বললাম। তখন যেন দোষ দিস না।” সুনেত্রা হেসে বলল।
“আমি রাজি। কবে যাবে বলো।”
“বলে দেব যেদিন ইচ্ছে হবে।”
“তোমার এখন কী ইচ্ছে করছে?”
“এখন? এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে লং ড্রাইভে যেতে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মাটির ভাঁড়ে এলাচ দেওয়া দুধ চা খেতে। সঙ্গে একটা সিগারেট।”
“তুমি সিগারেট খাও?”
“না। তবে কখনো কখনো ইচ্ছে করে।”
“খেতেই পারো।”
“আচ্ছা চল এবার শুয়ে পড়ি। রাত ভোর হতে বেশি দেরি নেই।”
“হুম। কিন্তু তুমি চলে গেলে আমার একা লাগবে।”
“কিচ্ছু লাগবে না। বউয়ের গায়ে পা তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়। শুভ রাত্রি।“ বলে সুনেত্রা অফলাইন হয়ে গেল।
তারপর চোখে মুখে ঘাড়ে জল দিয়ে একটা চকোলেটের টুকরো মুখে দিয়ে ঘরে আসার মুখে উঁকি দিয়ে দেখল রেহান তার মায়ের পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে। কতবছর হয়ে গেল রেহান আর সে একসঙ্গে এক বিছানায় শোয় না। আভেরী দেবীর ভয় লাগে একা শুতে, স্বামী মারা যাবার পর থেকে ছেলেই তার সঙ্গে শোয় রাতে। এখন তার বয়স অনেক। একা একা বাথরুম যেতে গেলেও পা কাঁপে। রাতের আয়া নেই। ছেলের সঙ্গে থাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি। সুনেত্রা একা থাকা অভ্যাস করে নিয়েছে। আজকাল এমনই অবস্থা হয়েছে পাশাপাশি না থেকে যে রেহান ছুঁতে এলেও অচেনা লাগে। মনে হয় অন্য কোনো পুরুষ তার অমতে তাকে স্পর্শ করছে। এই বিষয়টা নিয়ে সে আর কুড়ি বছর আগের মতো অভিযোগ জানায় না। এখন একা থাকতেই তার ভালো লাগে।
বিছানায় উঠে বালিশের পাশে রাখা বোতল থেকে জল খেল সে। মোবাইল চার্জে বসিয়ে বালিশে মাথা রাখল। তখন বাইরের আকাশটা সবে লাল হচ্ছে।
সারাদিন অফিসের কাজের ফাঁকে দিগন্তের কথা মনে হচ্ছিল সুনেত্রার। ছেলেটার সঙ্গে এ ক’দিনে অজস্র গল্প হয়েছে। একটা ভালোবাসা জন্মেছে। সেই ছোট্ট আদুরে ছেলেটা এত বড় হয়ে গেছে ভাবতেই তার অবাক লাগে। অবশ্য সময় তো থেমে নেই। তার নিজেরটিও কুড়ি হল। যথেষ্ট ম্যাচিওর। একা থাকে। সেভাবে তাকে নিয়ে কোনও সমস্যা তার আজ অবধি ঘটেনি। এটা ঠিক একটুতেই সে উত্তেজিত। বিশেষ করে যদি তাকে স্নান খাওয়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করা হল রেগে বলে উঠবে- “তুমি কি ওখান থেকেও দেখতে পাচ্ছ আমি খেলাম কিনা! যদি না খাই, স্নান না করি চলে আসবে কি? তা তো পারবে না। তাই প্লিজ বিরক্ত কোরো না।”
সুনেত্রার ভয় হয়, সেও এমন কোনও মায়ের বয়সী মহিলার সঙ্গে এভাবে চ্যাট করছে কিনা কে জানে! ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সবই কেমন ভাসা ভাসা। স্টেবিলিটি নেই। তার ছেলের এখনো কোনও বিশেষ বান্ধবী নেই। বললে বলে, “হলেও চিন্তা না হলেও চিন্তা! কী যে চাও তুমি বুঝি না। এই নিয়ে তাই সুনেত্রা আর কথা বাড়ায় না।”
কিন্তু একটা জিনিস সে বোঝে, আজকালকার ছেলেমেয়েরা খুব আনরেস্ট। সম্পর্ক সম্বন্ধে কোনও গভীরতা নেই। শ্রদ্ধা নেই, ভালবাসাও নেই। সব কিছুই যেন রাতারাতি তৈরি হয়, আবার খানিক বাদেই কোনো মেসেজ ডিলিট করে দেবার মতো মুছে দিলেই তার পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। সুনেত্রাকে তার বহু পরিচিত মানুষ বলেছে, জীবনটাকে এভাবেই উপভোগ করা উচিত। একটা স্টেডি সম্পর্ক রেখে যখন যেমন ভাবে যে আসবে তাকে নিয়ে নিজের আশ মিটিয়ে নিতে হয়। সেখানে কে কী করে, কোন পরিবেশ থেকে এসেছে, বয়স কত, এসব কোন ম্যাটার নয়। দু’দিনের এই জীবনে মন খুশি রাখাটাই ক্রমাগত সংগ্রামরত দিনে দরকার। সুনেত্রা আবার এমন সম্পর্কে বিশ্বাসী নয়। তার প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, সম্পর্কের বাইরে থেকেও জীবনকে উপলব্ধি করা যায়। তাতেও একধরনের তৃপ্তি আসে।
অবশ্য দিগন্তের মতো মেসেজ সে এই চল্লিশ ঊর্দ্ধ জীবনে বহুবার পেয়েছে। কাউকে ব্লক করেছে তো কাউকে সযত্নে এড়িয়ে গেছে। ক্রমশ তাদের নামটাও তার মনের ভিতর থেকে মুছে গেছে। তার সবসময়ই মনে হয়েছে এগুলো অল্পবয়সী ছেলেদের একটা আকর্ষণ। বড় কাউকে ডেট করা, একটু শরীরী আলোচনা, সাহস করে একদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া আর তারপর বাড়ি ফিরে সোনা ছেলে হয়ে আবার নিজের সংসারে মেতে থাকা। আর একটা জিনিসও সে লক্ষ করেছে, এই প্রজন্মের মধ্যে অপেক্ষা শব্দটা নেই। তারা সব রাতারাতি হাসিল করতে চায়। এরা তেমনই মুডি হয়। এখনই হাজার হাজার মেসেজ, ভিডিও কল তো পরমুহূর্তেই দীর্ঘ সময় ধরে বেপাত্তা।
এত সত্বেও দিগন্তের লেখা টেক্সটগুলো তার মাথায় ঘুরতে লাগল। ছোট থেকে দেখা একটা ছেলে, যার সঙ্গে তার মুখোমুখি কখনো সেভাবে কথা হয়নি, অথচ খুব ভালো করে চেনা, তাদের বাড়িটা জুড়ে তার ছোটবেলার নানান স্মৃতি জড়িয়ে। সেগুলোই তাকে বেশি অস্থির করে তুলছিল।
সারাদিন মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রইল। দিগন্তকে কেন ভুলতে পারছি না? ক’দিনের কথায় কিভাবে সে এভাবে জড়িয়ে গেল! নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল সে। তবে কি দীর্ঘদিন ধরে একা থাকতে থাকতে তারও মনের মধ্যে একটা শূ্ন্যতা তৈরি হয়েছে? দিগন্তের সঙ্গে কথা বলে সে সেই শূন্য স্থানটা ভরাট করার চেষ্টা করছে? কিন্তু এটা কি ঠিক? এইসব ভাবতে ভাবতে একটা শ্বাস ফেলল সে।
দিগন্ত কাল রাতে লিখেছিল, প্রেম মানে পরিবার ত্যাগ করে অন্য সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া নয়। প্রেম মানে একটা খোলা আকাশ। তার উত্তরে সে বলেছিল, প্রেম হল এক মায়া, যার জন্য কৃষ্ণ রাধাকে চায়, আর পাওয়া হয়ে গেলে ফিরেও তাকায় না। অথচ রাধা কৃষ্ণ দিয়েই প্রেমের কাহিনি রচিত হয়। আসলে প্রেম একটা স্রোত। যা ভাসিয়ে দেয় সব কিছু। তারপর যখন স্থিতি পায় দেখা যায় দু’হাত ভরে কেবল শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই।
দিগন্ত আবার প্রসঙ্গ বদলায়। “তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছ। অস্বীকার করতে পারো না।”
সুনেত্রা বুঝতে পারে না কী উত্তর দেবে! সে দিগন্তকে ভালোবেসেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এ ভালোবাসার সঙ্গে দিগন্ত যে ভালোবাসার কথা বলছে তার কোনও মিল নেই। সে নিজেই তো জানে না ভালোবাসা কী? তার মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হয় – তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা! ভালোবাসা কারে কয়?
দিগন্ত আবার প্রশ্ন করে, “কোথায় গেলে? বলো। উত্তর দাও।”
“সে লেখে, হ্যাঁ, এটা ঠিক আমার তোর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। তার একটা কারণ, আমার আশেপাশের জগতের সঙ্গে বিশেষ করে আমার কর্মজগতের সঙ্গে তুই কোনও অর্থেই জড়িত নোস, তোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি আমার অতীতকে দেখছি। এক অদ্ভুত যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তাকে প্রেম বলতে পারব না।”
দিগন্ত বলে, “তুমি প্রেম বিষয়টাকে ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাচ্ছ।”
“না, তা নয়।” সুনেত্রা লেখে, কথা ঘুরিয়ে জানতে চায়, “তুই কী নিয়ে পড়াশোনা করেছিস?”
“ফিল্ম প্রোডাকশান। চাকরি জীবনের সূচনায় গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তারপর ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবসায়। কিন্তু ভালো লাগে না।”
“কেন ভালো লাগে না? তাহলে চাকরি ছাড়লি কেন?”
“সারাক্ষণ বাইরে থাকা, পরিবারকে সময় দিতে পারছিলাম না। তাছাড়া দেখলাম ওখানে সামনে থেকে যে ঝাঁ চকচকে দুনিয়াটাকে দেখে সবাই, আমিও সেটা দেখেই গেছিলাম, আসলে তার পিছনে গভীর অন্ধকার। সামনে থেকে তুমি বুঝবেও না হয়তো এক্ষুনি যে তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল, তার ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই পিছন থেকে ছুরি মেরে তোমাকে সব জায়গা থেকে আউট করে দিল। তুমি কখন নো হোয়্যার হয়ে গেলে তুমি জানতেও পারলে না। আমি এসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই সরে এলাম। আসলে আমি চাই আনন্দে, শান্তিতে জীবন কাটাতে।”
সুনেত্রা বলে, “সেটাই তো উচিত। যেটায় আনন্দ পাবি সেটাই কর। কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুই গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের আলোটাকে মিস করছিস।”
দিগন্ত বলে, “হ্যাঁ, করি। ভীষণ মিস করি। আমি পরিচালকের খুব কাছের ছিলাম। ফলে বুঝতেই পারছ কাছ থেকে কত কিছু সামলেছি… আচ্ছা এই প্রসঙ্গ বাদ দাও। বরং আমাকে আদর করো।”
সুনেত্রা শেষের কথাটাকে এড়িয়ে গিয়ে বলল, “তোর বোধহয় এখনকার এই জীবনটাকে একঘেয়ে লাগছে। যে উদ্দীপনা, যে মাদকতা আগের কাজে ছিল সেটার বিন্দুমাত্র এখানে নেই, তাই।”
“ঠিক তা নয়। আসলে এখানে কোনও সম্মান দেয় না কেউ। নিজেকে মনে হয় একজন ফালতু মানুষ।”
“আজকের দুনিয়ায় কেউ কাউকে সম্মান দেয় না, নিজের পেশাকে নিজেই সম্মান দিতে হয়। তবেই অন্যরা দিতে শুরু করবে। যে কাজটাই করিস না কেন, তা যেমনই হোক সব সময় ভাববে এর থেকে ভালো কাজ আর কিছু ছিল না। তোদের এত বড় পৈত্রিক ব্যবসা, তুই ছাড়া কে সামলাবে? এটাকে সামনে রেখে নানা ইভেন্ট কর, বিভিন্ন অনুষ্ঠান অরগানাইজ কর, দেখ ক্রমশ নিজেই আলোকিত হয়ে উঠবি। আবার গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে ঢুকে যাবি।” সুনেত্রা বলে।
দিগন্ত বলে, “আমি তোমাকে চাই।”
“এটা তুই আমাকে চাইছিস না। আমার মধ্যে দিয়ে একটা অন্য জগত, যার সন্ধান পাচ্ছিস না তাকে ছুঁতে চাইছিস।”
“এত ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। শুনতেও চাই না।” লিখেই অফলাইন হয়ে গেল দিগন্ত।
সুনেত্রা অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে মোবাইল অফ করে দিল।
অথচ ঘুম এলো না। একটা ছটফটানি তাকে ঘিরে ধরল। পরদিন অফিস এসেও স্বস্তি পেল না সে। একবার ভাবল ফোন করবে। কিন্তু সংযত রাখলো। কয়েকবার মেসেজ লিখল। আবার ডিলিট করল। ভেতরে ভেতরে কী যেন একটা তোলপাড় করে দিচ্ছে তাকে। সে বুঝতে চাইছে, অথচ বুঝতে পাচ্ছে না। এর আগে এমন তো হয়নি। কেউ চুমু দিতে বললে সে মজা করে ইমোজি পাঠিয়ে দিয়েছে। এমনকি ইথার তরঙ্গে কখনো কখনো ভাসিয়ে দিয়েছে মুউহা। কিন্তু সে সবই মুহূর্তের জন্য। তারপর আর তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু আজ কেন সব তেতো লাগছে! কেন বিশ্বাসের জায়গাটা টলে যাচ্ছে! তবে কি কোন সম্পর্কই আসলে সম্পর্ক নয়? কেবল কতগুলো পাগলের প্রলাপ! এভাবেই অস্থিরতা নিয়ে কেটে গেল সারা দিন। দিগন্ত কোনও ফোন বা মেসেজ করল না। সুনেত্রার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। বিরক্ত লাগছে তার নিজের প্রতি। সে নিজেকে বোঝালো, আর কোনো যোগাযোগ সে রাখবে না দিগন্তের সঙ্গে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সব জায়গায় ব্লক করে দেবে দিগন্তকে।
বাড়ি ফিরে একগাদা বাজে সিরিয়াল দেখল শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে বসে। আগে পিছনের কোনও কিছু না জেনেই মনটা অন্য দিকে ঘোরাবার জন্য চেষ্টা করল। আবারও রাত এলো।
দিগন্ত লিখল, “কী করছ?”
সুনেত্রা ঠিক করল উত্তর দেবে না। মোবাইল অফ করে দিতে গেল। অথচ লিখল, “এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?”
“আমার একটা পার্টি ছিল। আর পার্টিতে গেলে আমি ফোন সাইলেন্ট করে রাখি। তোমার কোনও দরকার ছিল? কল দেখলাম নাতো!”
“দরকার! না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল দিগন্ত।” সুনেত্রা লিখল।
“কেন কষ্ট হচ্ছিল? তুমি বলো আমাকে ভালোবাসো। বলো আমাকে মিস করছ?”
দিগন্তের এ প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেবে সে বুঝতে পারে না। বুকের ভিতরটা চিনচিন করে। মনে হয় একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। সে নিজেকে সংযত করে উত্তর না দিয়ে চুপ থাকে।
দিগন্ত বলে, “এরপরেও তুমি বলবে তুমি আমার প্রেমে পড়নি? আমি কিন্তু তোমার প্রেমে পড়েছি।”
সুনেত্রা মেসেজ পড়ে, উত্তর দেয় না। শুধু অফলাইন হয়ে যায়। তার চোখ বেয়ে নেমে আসে জল। কেন এই জল নামছে সেটাও সে বুঝে উঠতে পারে না। শুধু বালিশটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। মনে হয় পাশের ঘরে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রেহানের বুকে। কিন্তু এতদিনের অভ্যাস ভেঙে সেটাও করে উঠতে পারে না। বিছানায় উঠে বসে বালিশের পাশে রাখা ওষুধের বাক্স থেকে স্নায়ু ঠান্ডা রাখার ট্যাবলেট নীরবে খেয়ে শুয়ে পড়ে একা একাই।
এভাবেই কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন। কখনো টেক্সট কখনো নীরবতা ঘিরে থাকে তাদের।
অবশেষে একটা ছুটির দিনে ভিডিও কল করে দিগন্ত। সুনেত্রা বুঝতে পারে না তার শরীর ও মন জুড়ে কী চলছে! কেমন একটা অসোয়স্তি হচ্ছে। বার দুয়েক কল কেটে দেবার পর এক অদম্য আকর্ষণে ফোনটা ধরে। ওপাশে দিগন্তের খোলা বুক। তার সারা শরীর কেঁপে ওঠে। মনে হয় এই প্রথম সে কোনও পুরুষের ঊর্ধাঙ্গের খোলা অংশ দেখছে।
দিগন্ত বলে, “আরে ওভাবে না দেখে দাও চুমুটা।”
সেইমুহূর্তে সুনেত্রার বুকের ভিতর কী যেন একটা ঘটে যায়। তার একবার মনে হয় দিগন্তের আহ্বানে সাড়া দিতে। পরমুহূর্তেই মনে হয় এটা হতে পারে না। সে এক অজানা ভয়ে তাড়াতাড়ি কল কেটে দেয়।
বেশ কিছুক্ষণ পর দিগন্ত লেখে, “সরি। আমি ভীষণ বড় অন্যায় করতে চলেছিলাম। আমার মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় চলছিল। তোমাকে বোঝাতে পারছি না। একদিকে সাংঘাতিকভাবে তোমার সঙ্গ চাইছি, অন্য দিকে মন বলছে এভাবে বউকে প্রতারিত করতে পারব না। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।”
বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলে নেয় সুনেত্রা। তারপর বলে, “কোনও অন্যায় করিসনি তুই। বহুবছর গ্ল্যামার দুনিয়ে থেকে সরে আসার পর নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সামান্য কথাও বলিসনি কাজের বাইরে। হয়তো ভেতরে ভেতরে হাঁফিয়ে উঠেছিলি। আর সেইসময় আমার সঙ্গে গল্প শুরু হল। আমি নই, আমার এই বাহ্যিক আমিটা তোকে প্রচন্ড টানছিল। তুই উপেক্ষা করতে পারছিলি না। অথচ মন থেকে জানিস এটা সম্ভব নয়। এই দুয়ের দ্বন্দ্ব তোকে অস্থির করে দিচ্ছিল।”
“আমি ভেরি সরি। তোমাকে দিদি বলে ডেকেও এই ভুল কী করে করলাম?” দিগন্ত লিখল।
সুনেত্রা বলল, “এভাবে ভাবিস না। আমি কিছু মনে করিনি। বরং এর উল্টোটা হলেই আমার বিশ্বাসের জায়গাটা টলে যেত।”
দিগন্ত বলল, “ভুল বুঝো না। ক্ষমা করে দিও আমাকে।”
সুনেত্রার হঠাৎ মনে হল দমবন্ধ ভাবটা আর নেই। এতদিন বুকের মধ্যে যে চাপটা ছিল এক নিমেষে দূর হয়ে গেছে। নিজেকে ভারমুক্ত লাগছে।
সে বলল, “এই কদিন তুই চুমু চাইছিলি, আমি দিইনি। আজ দিলাম, তোর এই সৎ স্বীকারোক্তির জন্য। খুব ভালো থাকিস।”
এখন অনেক রাত। সুনেত্রা বারান্দায় বসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে, জীবন কত রহস্যময়। আকাশের থেকেও কখনো কখনো বেশি। নইলে কী করে সে মাত্র ক’দিনের কথায় দিগন্তের প্রতি এত আকর্ষণ অনুভব করছিল! প্রতিদিন একটা ঘোরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে সে তার জন্য পাগলের মতো অপেক্ষা করছিল! অথচ একই সঙ্গে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যে প্রতিটা পুরুষই শরীরের বাইরে কিছু ভাবতে পারে না! দিগন্ত অন্তত তাকে আজ সেই ভাবনাটা থেকে মুক্তি দিল। একটু সময় লাগলেও এই সাময়িক ভালো লাগাটা সে নিজের মনের মধ্যে আজীবন যত্ন করে রেখে দেবে। পাহাড় থেকে নেমে আসা সব জলরাশি শেষ অবধি নদী হয় না সুনেত্রা, তাতে জলের কোনও অভিমান করা সাজে না, সে নিজেকেই বোঝালো। তারপর রান্না ঘরে ঢুকে এক কাপ চা বানালো।
তারপর একটা নতুন গল্প লিখতে হবে ভেবে ঘরে ফিরে ল্যাপটপ অন করল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন