short-story-aprotyashita-anuvuti

অপ্রত্যাশিত অনুভূতি
ফরহাদ হোসেন



‘ভাইজান, আপনার লগে একজন দেখা করতে আইছে।’

কাজের মেয়ে রেহানার কথায় ঘুরে তাকাল সায়েম। প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে বলল, ‘কে?’

‘চিনি না।’

‘নাম কী?’

‘নাম জিগাই নাই।’

‘মাকে বল। মা কোথায়?’

‘তারে কমু ক্যান। সে আইছে আপনের লগে দেখা করতে। তাছাড়া খালাম্মার শইলডাও ভালা না। বাতের ব্যাথায় কাইত—শুইয়া আছে। প্রেসারটাও হাই মনে অইল।’

সায়েম হেসে দিল। ‘প্রেসার হাই তুই বুঝলি কীভাবে?’

‘বোঝন যায়। আইজ তার মিজাজ অত্যধিক খারাপ। তার প্রেসার যত হাই, মিজাজ তত খারাপ। ভাইজান, কী করুম?’

‘ঠিক আছে যা, লোকটাকে বসতে বল, আমি আসছি।’

রেহানা ফিক করে হেসে দিল। ‘লোক না ভাইজান। মেয়েলোক। চান্দের লাহান ফুটফুইট্যা একটা মাইয়া। কইল, আপনার লগে দেখা করতে চায়।’

সায়েম ভ্রু কুঁচকে তাকাল রেহানার দিকে। তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে হেঁটে গেল ড্রয়িং রুমের দিকে।

ড্রয়িং রুমে ঢুকেই সায়েম লক্ষ করল, সোফার এক কোণায় কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে একজন তরুণী। মায়াকাড়া চেহারা। মুখটা মলিন। তরুণীকে দেখে সায়েম যারপরনাই অবাক হলো। সে কাছে এগিয়ে যেতেই তরুণী উঠে দাঁড়াল। তরুণীর গায়ে একটা কালো চাদর। এই গরমের মধ্যে সে গায়ে চাদর পড়ে আছে কেন?

সায়েম বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘সুমি! তুমি?’

সুমি আয়ত চোখে তাকাল সায়েমের দিকে। মাথা নেড়ে মৃদূ কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘এতদিন পর মনে পড়ল? কোথায় হারিয়ে গেলে বলতো?’

সুমি নিশ্চুপ।

‘একটিবার বলেও গেলে না। এভাবে কিছু না জানিয়ে হুট করে চলে গেলে… আশ্চর্য!’ বলে চলল সায়েম।

সুমি এবারও চুপ করে রইল।

‘একবার তো যোগাযোগও করলে না।’

‘পরীক্ষার ব্যস্ততা ছিল। আর আপনার ফোন নাম্বারও আমার কাছে ছিল না।’ মৃদূ কণ্ঠে বলল সুমি।

‘রীতা ভাবীর কাছে চাইলেই পেতে।’

‘লজ্জায় চাইনি। কী মনে করবেন। তাছাড়া, তার সাথে দেখা হয়েছিল মাত্র একদিন, অল্প সময়ের জন্য। আশেপাশে অনেক মানুষ ছিল—কথা বলার অবকাশ ছিল না।’ এটুকু বলেই সুমি হাঁপিয়ে গেল। তার পানি পিপাসা পেয়েছে। সে তাকাল এদিক ওদিক।

‘তোমাকে এত পেল লাগছে কেন সুমি? তুমি কি অসুস্থ?’

সায়েমের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুমি বলল, ‘আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারেন? সম্ভব হলে একটা বিস্কিট জাতীয় কিছু যদি থাকে ভালো হয়।’

সায়েম অবাক চোখে তাকাল সুমির দিকে। কেমন মলিন হয়ে আছে ওর মুখখানি। সে বলল, ‘তুমি একটু বসো—আমি এক্ষুণি আসছি।’

কালক্ষেপণ না করে সায়েম ভেতরে চলে গেল এবং প্রায় সাথে সাথেই ফিরে এলো বরফশীতল এক গ্লাস পানি আর কিছু কুকিজ নিয়ে। আসার সময় রেহানাকে বলে এলো দু-কাপ চা আর কিছু নাস্তা পাঠিয়ে দিতে।

পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খানিকটা পানি খেয়ে একটা কুকি নিয়ে কামড় দিল সুমি।

একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল সায়েম, ‘কী হয়েছে সুমি?’

‘আমি প্রেগন্যান্ট!’

‘প্রেগন্যান্ট? বলো কী?’

সুমি মাথা নাড়ল।

সায়েম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। তার হিসেব মিলছে না। মাত্র তিন মাস আগেই সুমির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। ওর বড় ভাইয়ের বিয়ের সময়। সায়েমের বড় ভাই মিলনের সাথে বিয়ে হয়েছে সুমির খালাত বোন রীতার সাথে। রীতাদের গ্রামের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হয়েছিল। মাদারীপুরের একটি অজগ্রাম। সেখানে গ্রামের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন, বাড়ি ভর্তি লোকজন। আনন্দ-ফূর্তি। গানের অনুষ্ঠান। তিন-চারদিনের আয়োজন। গায়ে হলুদ, কাদামাটি খেলা আরও কত কী। রাতে ছেলে মেয়েদের আলাদা আলাদা শোবার আয়োজন করা হলেও কিছু অল্প বয়সী তরুণ-তরুণীরা গাদাগাদি করে একঘরে থাকার ব্যবস্থা করে নিল। সারারাত হৈচৈ করে প্রায় শেষ রাতের দিকে সবাই ঘুমাতে যায়। সম্পর্কের কারণেই হোক আর ভালোলাগা, প্রথম দিন থেকেই সুমির সাথে সায়েমের ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। সায়েম বাইশ বছরের যুবক আর সুমির উনিশ। খুনসুটি আর দস্যিপনা সবই চলল।

ফিরে আসার আগের রাতের ঘটনা। বিয়েবাড়ির সব ঝামেলা শেষ করে সবাই যখন ঘুমাতে গেল তখন দেখা গেল সায়েম আর সুমির থাকার জায়গা নেই। ওরা দুজন সিদ্ধান্ত নিল সারারাত না ঘুমিয়েই কাটাবে। এমন রাত হয়তো আর নাও আসতে পারে—কে জানে। ওরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল বাড়ির উঠোন পেরিয়ে একটু অদূরে। সেখানে একটা ছাওনির মতো জায়গা। সেখানেই দুজন বসে পড়ে। চলতে থাকে নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা, দুষ্টুমি আর খুনসুটি।

প্রচন্ড শীত পড়েছিল সেই রাতে।

সুমি তার চাদরের এক পাল্লা বাড়িয়ে দিল সায়েমের দিকে। সায়েম সুমির বাড়িয়ে দেয়া চাদরের এক অংশ নিজের গায়ের ওপর দিয়ে দুজন জড়সড় হয়ে বাকী রাতটা কাটিয়ে দেয়ার জন্য তৈরী হয়ে গেল। অল্প সময়ের মধ্যেই একে অপরের শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে লাগল দুজনে। সায়েমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে সুমি। যেন একে অপরের শরীর থেকে শুষে নিতে চাইছে পরম উষ্ণতা। সুমির শরীর থেকে উৎসারিত হচ্ছে এক মোহময় সুগন্ধ। সেই আকর্ষণে নিজের অজান্তেই সায়েম মাতাল হয়ে ঢলে পড়তে চাইছে সুমির শরীরের উপর। মদমত্ত শীতের দাপটে দুই শরীরের উষ্ণতা এক-একবার এক হতে চাইছে আবার বিচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে পরের মুহূর্তে।

সায়েম একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে দেখে সুমির দিকে। আধো আলো ছায়াতেও দেখা যায় সুমির ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি।

সেদিনের রাতের পরে সুমির সাথে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না সায়েমের। সুমির কথা তার মনে হয়েছে প্রায়ই কিন্তু কোনভাবেই যোগাযোগ করা হয়ে উঠে নি। একবার তার বড় ভাইয়ের বাসায় যেয়ে কথা প্রসঙ্গে রীতা ভাবীকে জিজ্ঞেস করেছিল সুমির কথা।

রীতা ভ্রূ কুঁচকে অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘কী ব্যাপার, হঠাৎ সুমির খবর নেয়া হচ্ছে কেন? ঘটনা কী?’

‘কোনো ঘটনা নেই ভাবী। তোমাদের বিয়ের সময় দেখা হলো। এত গল্প হলো, কথা হলো, তারপর হঠাৎ করেই উধাও—তাই একটু জানতে চাওয়া। তুমি আবার উলটাপালটা কিছু ভেবে বসো না।’

‘আমি কিছুই ভাবছি না। সুমি আসলে ব্যস্ত ছিল ওর পরীক্ষা নিয়ে। ওর ফোন নাম্বার নেই তোমার কাছে?’

সায়েম না সূচক মাথা নাড়ল। এরপরে রীতা আর কোনও কথা বলেনি। সায়েমও লজ্জায় ফোন নাম্বারটা চায়নি রীতার কাছে। এরপর সুমির কথা ওর মাথা থেকেও প্রায় চলেই গিয়েছিল। আজ হঠাৎ করে এভাবে সুমিকে দেখে সায়েম ভীষণ অবাক হলো। কিন্তু ওর মাথায় একটা ব্যাপার কিছুতেই ঢুকছে না। সুমির বিয়ে হলো কখন? রীতাও তো কিছু জানাল না। রীতার আপন খালাতো বোন সুমি। গ্রামে থাকে তাতে কী? তাই বলে জানাবে না?

‘আশ্চর্য তোমার বিয়ের খবরটা কেউ জানাল না। এনিওয়ে, কংগ্রাচুলেশন্স!’ আক্ষেপের কণ্ঠে বলল সায়েম।

সুমি চকিতে তাকাল সায়েমের দিকে একবার। তারপর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মৃদূ কণ্ঠে বলল, ‘আমার বিয়ে হয়নি।’

‘ওয়েট অ্যা মিনিট। তুমি বলছ তুমি প্রেগন্যান্ট। আবার বলছ তোমার বিয়ে হয়নি। এসবের মানে কী সুমি?’

সুমি চুপ করে রইল।

‘বিয়ে হয়নি, তাহলে… তুমি প্রেগন্যান্ট হলে কী করে? হু ইজ দ্য ফাদার?’ প্রশ্নবোধক চিহ্ন একে সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সায়েম।

সুমির চোখের দিকে তাকিয়ে সে আবার বলল, ‘সরি, এটা একান্তই ব্যক্তিগত প্রশ্ন, এভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হয়নি…’

‘আপনি!’ সায়েমের মুখের কথা শেষ হবের আগেই সুমি উত্তর দিল।

সায়েম চমকে তাকাল সুমির মুখের দিকে। মুহূর্তেই মুখ অন্ধকার হয়ে গেল তার। শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল ঠান্ডা এক স্রোত। এসব কী বলছে সুমি?

অস্বস্ত্বিকর নীরবতা নেমে এলো কিছু সময়ের জন্য।

সায়েমের মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা আবারো। তাদের মধ্যে যা যা ঘটেছিল সব।

সায়েম মরিয়া হয়ে বলল, ‘কিন্ত, সেটা কী করে সম্ভব? আমরা তো মাত্র একটি রাত এক সঙ্গে কাটিয়েছি। অল্পকিছু মুহূর্ত… হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল…’

‘একটি রাতই কি যথেষ্ঠ নয়?’ বলেই সায়েমের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল সুমি। উত্তরের প্রতীক্ষায়।

সায়েম কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। চোখ সরিয়ে নিলো।

‘যাই হোক, আমি আপনাকে কোনো ঝামেলায় ফেলতে আসিনি।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল সুমি। ‘আমি অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি… কিন্তু তার আগে বিষয়টা আপনাকে জানানো দরকার, তাই এভাবে আমাকে আসতে হয়েছে।’

সায়েম ধরে নিলো সুমি হয়তো অ্যাবর্শনের কথা ভাবছে। সে মনে মনে খুশিই হলো। যদিও তার দ্বিধা কাটছে না তারপরেও এমন অপ্রত্যাশিত ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি মিটে যায় ততই ভালো। সুমির বাকী কথা না শুনেই সায়েম তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘ভেরী গুড ডিসিশন। আই রেস্পেক্ট ইয়োর ডিসিশন।’

সুমি অবাক চোখে তাকাল। ‘সত্যি বলছেন?’

‘অবশ্যই। এটা একান্তই তোমার ব্যাপার। সিদ্ধান্তটা তোমাকেই নিতে হবে।’

‘আমি বাচ্চাটা রেখে দিতে চাই।’

সায়েমের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। সে ঢোক চিপে কোনওরকমে বলল, ‘মানে? কী বলছ তুমি? তোমার বিয়ে হয়নি অথচ বাচ্চার মা হবে, এটা কী কেউ মেনে নেবে? ভুলে যেও না, এটা ইউরোপ, অ্যামেরিকা নয়।’

‘জানি।’

‘তাহলে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছ?’

সুমি চুপ করে রইল।

‘তোমার বাড়ীর কেউ জানে? কেউ কিছু বুঝতে পেরেছে?’ জিজ্ঞেস করল সায়েম।

‘এখনও কেউ কিছু বুঝতে পারেনি।’

‘যখন জানবে?’

‘মুখ দেখাতে পারব না। আর সে কারণেই আমি পালিয়ে এসেছি ঢাকায়। বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে, রীতা ভাবীর জন্যেও খারাপ হবে। তার পারিবারিক সম্মান, ভাবমুর্তি নষ্ট হবে।’

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সায়েম বলল, ‘এতই যখন বুঝো তাহলে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছ? নাকি আমাকে ফাঁসাতে চাও?’

সুমি আহত দৃষ্টিতে তাকাল সায়েমের চোখের দিকে। মৃদু কণ্ঠে বলল ‘না।’

‘তাহলে কেন এসেছ? আমার কী করার আছে? নিশ্চয়ই বলবে না, আমাকে বিয়ে করুন।’

সুমি আবারও আহত হলো সায়েমের কথায়। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমি আপনার কাছে করুণা চাইতে আসিনি। একবার তো বলেছিই আমি আপনাকে কোনো ঝামেলায় ফেলতে আসিনি। শুধু জানাতেই এসেছিলাম আর…’

‘আর?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সুমি বলল, ‘আমার একটা উপকার করবেন?’

‘কী উপকার?’ ইতস্তত কণ্ঠে বলল সায়েম।

‘আমার একটা থাকার জায়গা দরকার। আমি এক বেডরুমের একটা বাসা পেয়েছি, কিন্তু একা বলে ভাড়া নিতে পারছি না। আমি বলেছি আমার হাজব্যান্ড বিদেশে থাকে, কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে।’

সায়েম চোখ বড় বড় করে কথা শুনছে সুমির। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

‘যদি সম্ভব হয়, বাসাটা নেবার ব্যাপারে আমাকে একটু হেল্প করবেন?’

‘তুমি এসব কী বলছ সুমি? তোমার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘আপনাকে কিছুই বুঝতে হবে না। শুধু একদিন আমার সঙ্গে যাবেন। বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করবেন, তারপর চলে আসবেন।’

‘ব্যাস, এটুকুই?’

সুমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

‘তারপর, তোমার যখন বাচ্চা হবে, সবাই যখন জানতে চাইবে বাচ্চার বাবা কোথায়, কী বলবে তুমি?’

‘বিদেশে চলে গেছে—ছুটি পাচ্ছে না, তাই আসতে পারছে না।’

সায়েম হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাল। তার মাথায় এখনও কিছুতেই একটা কথা ঢুকছে না, একজন অবিবাহিতা মেয়ে হয়ে সুমি কেন এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

সুমি তাকিয়ে আছে সায়েমের মুখের দিকে—উত্তরের অপেক্ষায়।

সায়েম অস্থিরভাবে পায়চারী করছিল এর মাঝে হঠাৎ করেই কলিংবেল বেজে উঠল। সে একবার বাইরের দিকে তাকাল। একটু পরে আবারও বাজল। রেহানা কী করছে কে জানে। এসময়ে আবার কে এলো? সে নিজে যেয়েও খুলে দিতে পারে কিন্তু কেন যেন তার যেতে ইচ্ছে করল না।

দরজার কাছে কথা শোনা যাচ্ছে। রেহানা দরজা খুলে দিয়েছে। নারী কণ্ঠ। কিছুক্ষণের মধ্যেই নারী কণ্ঠের মেয়েটি ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে সায়েমের পাশে এসে দাঁড়াল।

অসময়ে মেয়েটিকে দেখে সায়েম বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘কী ব্যাপার লাবনী, তুমি এসময়ে? তুমি আসবে বলোনি তো?’

‘কেন আমাকে কি সময় নির্ধারণ করে আসতে হবে নাকি?’ বলেই লাবনী তাকাল সুমির দিকে। তারপর সায়েমের দিকে ঘুরে বলল, ‘মনে হচ্ছে আমি সত্যিই অসময়েই চলে এসেছি। অ্যাম আই ইন্টারাপটিং সামথিং?’

সুমি তাকাল সায়েমের দিকে। তারপর মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি বরং যাই।’ বলেই সুমি দ্রুত ড্রয়িংরুম থেকে বের হয়ে গেল।

সায়েম দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে কিছুক্ষণ তারপর হঠাৎ করেই দৌড়ে বের হয়ে গেল ড্রয়িং রুম থেকে।

সায়েম গেটের বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখল, সুমি একটা সিএনজিতে উঠে বসেছে। ও দূর থেকে একবার ডাকল নাম ধরে, সুমি কিছু শুনল কিনা বোঝা গেল না। সে একবারের জন্যেও ঘুরে তাকাল না। সায়েম দৌড়ে গেল কিন্তু ততক্ষণে সিনএনজি ব্যস্ত রাস্তার ভিড়ে হারিয়ে গেছে।

সায়েম ফিরে আসতেই লাবনী জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়েটি কে? এভাবে চলে গেল যে?’

সায়েম উত্তর না দিয়ে সোফায় বসে পড়ল চিন্তিত ভঙ্গিতে।

‘মেয়েটি কে?’ আবারও জিজ্ঞেস করল লাবনী।

‘আমাদের আত্মীয়। ভাবীর খালাত বোন।’

‘তোমার কাছে কী? কেন এসেছিল?’

‘কী আশ্চর্য তুমি এত প্রশ্ন করছ কেন?’ হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল সায়েম। ‘মানুষের প্রয়োজন থাকতে পারে না?’

সায়েমের এভাবে হঠাৎ প্রতিক্রিয়ায় অবাক হয়ে তাকাল লাবনী। কিন্তু আর কিছু না বলে সেও চুপ করে বসল সায়েমের পাশে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে ঘড়ি দেখে বলল, ‘যাও, রেডি হয়ে আসো।’

‘কেন?’

‘কী আশ্চর্য, ভুলে বসে আছ? আজকে না আমাদের মুভি দেখতে যাওয়ার কথা?’

সায়েম মাথার দুপাশে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে বলল, ‘আজকে থাক। আমার মাথাটা কেমন ধরে আছে, মাইগ্রেন শুরু হবে।’

‘কী বলো সায়েম?’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল লাবনী। ‘বন্ড সিরিজের লাস্ট মুভি, ‘নো টাইম টু ডাই’, এক সপ্তাহ আগে প্লান করেছি। আমার সব বন্ধুরা যাচ্ছে। এখন তুমি যাব না বললে হবে?’

‘আহা তোমাকে তো যেতে নিষেধ করছি না। তুমি যাও না ওদের সঙ্গে। আমার শরীরটা ভাল্লাগছে না। প্লিজ!’

সায়েম এমন ভাবে প্লিজ বলল, যার মানে হতে পারে, তুমি আমার সামনে থেকে এখন যাও। সায়েমের মনটা উত্তেজিত এবং অস্থির হয়ে আছে। সুমির আজকে হঠাৎ এভাবে আসা এবং সব কিছু জানার পর ওর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সে ঠিক মতো কিছু ভাবতে পারছে না। সুমির শরীরে তার রক্ত—এটা ভাবতেই কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে তার মন। সায়েম রোবটের মতো হেঁটে চলে গেল তার ঘরে। লাবনী বসে রইল বোকার মতো।

সুমি তার বান্ধবী, রুবীর বাসায় উঠেছে। সে ফিরে যেতেই রুবী জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলল সায়েম ভাই?’

‘বলল, অ্যাবরশন করে ফেলতে।’

‘সেটা যে সম্ভব নয়, বলেছিলি?’

সুমি চুপ করে রইল।

‘তোর ফোনটা দে তো।’

‘কেন?’

‘দিতে বলছি দে।’

একরকম জোর করেই সুমির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে রুবী নেড়ে চেড়ে কিছুক্ষণ দেখে আবার ফিরিয়ে দিল সুমিকে। তারপর বলল, ‘এখন কী করবি?’

‘জানি না।’

‘জানি না, বললে তো হবে না। অ্যাবরশন ইজ নট অ্যান অপশন, সেটা তার জানা দরকার।’

‘জানলেই বা কী করতে পারবে সে? ওর তো কোনো দোষ নেই। ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।’

‘মানলাম, কিন্তু তার দায় তো সে এড়াতে পারে না।’

সুমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। কীইবা তার বলার আছে।

অনুশোচনা একটি গভীর আবেগ।

সুমি চলে যাবার পর থেকেই সায়েম অনুশোচনায় ভুগছে। একধরণের অপরাধবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। এর পরিত্রাণ কী, তার জানা নেই। এখন সুমির সঙ্গে সে কীভাবে দেখা করবে? সুমির অভ্যন্তরে যে প্রাণটি বড় হচ্ছে, সেখানে তারও কিছু অংশ আছে। সুমিকে দেখার জন্য ওর মনটা হুহু করে উঠল।

এক সপ্তাহ চলে গেছে। সায়েম মরিয়া হয়ে রীতা ভাবীর সঙ্গে দেখা করল।

সুমিকে নিয়ে রুবি এসেছে ডাক্তারের কাছে। রুটিন চেকআপ। সুমির ইউটেরাসে টিউমার আছে। প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হচ্ছে। সার্জারি করা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। শুধু টিউমার রিমুভ করা যাবে না, ফেলে দিতে হবে ইউটেরাসটাও। তার মানে সুমি আর মা হতে পারবে না কোনওদিন। শুধুমাত্র এই একটি কারণেই, সুমি তার বাচ্চাটাকে রেখে দেবার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে।

রুবির কাছে ফোন রেখে সুমি গেছে ডাক্তারের রুমে। সায়েমের ফোন বেজেই চলেছে। অগত্যা রুবি ফোন ধরতেই সায়েম হরহর করে বলে চলল। সে দেখা করতে চায়। রুবি তার পরিচয় দিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলল তাকে। রুবির কাছে থেকে ঠিকানা নিয়ে সায়েম ফোন কেটে দিল।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। প্রচন্ড মনখারাপ নিয়ে বসে আছে সুমি। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখ ভিজে এলো। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেল সুমি। রুবি বাসায় ফেরেনি এখনো। অগত্যা সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল, এবং অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সামনে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে।

‘তুমি?’ বিস্ময় কাটছে না সুমির।

‘হ্যাঁ, আমি। অবাক হয়েছ বুঝি?’

সুমির চোখ ছল ছল করে উঠল। মুখে কিছু বলতে পারল না।

‘চলো, বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করে আসি।’ বলেই পরম যত্নে সায়েম হাত বাড়িয়ে দিল সুমির দিকে।

সুমির খুব ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিছু কিছু আবেগ লুকিয়ে রাখা যায় না—লুকিয়ে রাখতে নেই।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *