রাজশ্রী বসু অধিকারী
পুরনো টিনের গেটটা খুশীর কাতরানি ছড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে চুপ করে যায়। অনেকদিন পর ওকে কেউ একটানে এভাবে খুলে ঠেলে ঢুকল। এ বাড়ীর সবাই জানে বেশী টানাটানি করলে পিলার থেকে খুলে আসতে পারে জং ধরা টিনের চাকতি।
মউয়া লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছিল ভেতর দিকে। আকাশে হঠাৎ ঘোলাটে মেঘের জমায়েত। সন্ধ্যে নাগাদ ওদের ঝরে পড়ার প্ল্যান হয়েছে। সেই আগমনীর পূর্বাভাষ দিতে ঝোড়ো হাওয়া হঠাৎ হঠাৎ বয়ে যাচ্ছে উঠোনময়। উড়ছে দড়িতে মেলা ভাইটুর পাজামা, সোনামামীর পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ী, সন্তুমামার ফুটো গামছা। চেনা মানুষের গন্ধ পেয়ে প্রাণহীন সুতোর জিনিসগুলোও যেন নেচে কুঁদে মাথা গা বাড়িয়ে আদর করতে চাইছে।
মউয়া এগিয়ে যেতে গিয়েও বাধা পায়। ডানহাতের বারান্দার কোণের ঘর থেকে কোমর ভাঁজ করে খুড়খুড়িয়ে এগিয়ে আসছে, ও কে? ময়লাটে থান, বড়িস্য বড়ি গুটুলী পাকানো চুল, কালো কুচকুচে মুখ হাত পা। কোঁচকানো গালে মুখে, ফোগলা হয়ে যাওয়া থুতনীতে পান্তুয়ার চেয়েও মিষ্টি হাসি। সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেই মানুষটি। আর কী করে এগোবে মউয়া?
“ক্যান? অত ছোটনের কী হইল? অ্যাদ্দিন পর আইলা, এট্টু বইস্যা খাইয়্যা মাইখ্যা যাও গিয়া…।”
“দিদাআআ… কতদিন পর তোমাকে দেখলাম… দিদা… দিদা গো… এই দ্যাখো আমার বুকের ভেতরটা কেমন করছে, দ্যাখো না…!”
কালো কুচকুচে পান্তুয়ার মত রসের প্রস্রবণটিকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে মউয়া। নিজের বুকে চেপে ধরে দু’পাক ঘুরিয়ে দেয় বনবন বনবন…।
“আরে আরে করস কী মাইয়া, ছাড় ছাড় ছাড়ান দে আমারে… অঃ হ রে… ছুড়ি স্যায়না হইল বিয়া বইল, ছাওয়ালপনা গ্যাল না… অ বিমলা দ্যাখসে তর মাইয়ার কাম… কোমর ভাইঙ্গল আমার…” বুড়ি অবিশ্রান্ত বকর বকরের সাথে সাথে নিবিড় ভালবাসায় আরো বেশী করে জড়িয়ে ধরে নাতনীর গলা। বেশ কিছুক্ষন নেচে কুঁদে দিদাকে কয়েক পাক ঘুরিয়ে মাটিতে নামায় শ্রান্ত মউয়া।
সোজা আর বড় ঘরের দিকে এগোনো হয় না। দিদার আঁচল ধরে বারান্দার কোণের গুমটি ঘরে এসে ঢোকে ও। থেবড়ে বসে পড়ে ভাঙাচোরা সিমেন্টের মেঝেয়। সাড়ে চোদ্দহাজার টাকার ব্রান্ডেড জিনস এ মেঝের ধুলোর স্পর্শ পায়নি কখনও।
বসেই একরাশ বিস্ময়, “দিদা? তুমি চিতই পিঠা করেছো? ইশশ… এই তো খেজুর গুড়ের ঝোলা আর নারকেল কোরানো… কখন করলে দিদা এতসব? আর ওই যে মাটির সরা? ঢিমে আঁচে সরার ভেতরে বুঝি চাপানো আছে চালের গুঁড়ো? এইবার ফুলকো ফুলকো চিতই নামবে? কিন্তু আজ তো পৌষ সংক্রান্তি নয় দিদা? তাহলে? এগুলো সব আমার জন্য? তুমি জানতে আমি আজ আসব?”
ছেলেমানুষের মত প্রশ্ন করেই যেতে থাকে মউয়া, ভারত সরকারের ট্রম্বে অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের একজন সম্ভাবনাময়ী বিজ্ঞানী, যে কিনা কিছু অফিসিয়াল কাজে কলকাতা এসেছিল গত পরশু, আর মাত্র একটা ফোন কলে পাগল হয়ে আজ ছুটে এসেছে জলপাইগুড়ি জেলার এই প্রত্যন্ত নূতনহাট গ্রামে।
“হ, জানতাম ত। তগো কুনো খবর কি আমার কাছে না জানা থাকে? ভুইল্যা গ্যাছস নাকি? তোর ছুডমামায় দাদুর পকেট মাইর্যা তরে সিনামা নিয়া গ্যালে আমি ক্যামন ধইর্যা ফ্যালতাম? অহনে খা দেহি। গরম গরম খাইয়া ফালা… ঝোলা গুড়ে ডুবায় ডুবায় খা, নাইরকেল দিয়া খা…। বোম্বাইতে এইসব কে বা কইরা দিবে তরে!”
মাটির সরা থেকে গরম চিতই পিঠা তুলে নিয়ে নাতনীর হাতের এনামেলের থালায় দিতে দিতে সহসা স্নেহে চোবানো আক্ষেপের সুর লাগে দিদার গলায়, “বিমলিডারে কত কইলাম মাইয়াডারে অতদূরে বিয়া দিসনা দিসনা। তা শোনল আমার কথা? অ্যাখন কাইন্দা মরে, বচ্ছরকার দিনে অ্যাকোবার মাইয়াডার মুখ দ্যাখবার পায় না। সে হইল গিয়া মায়, তার কষ্ট হগগলের থিক্যা বেশী …।”
মউয়া মুখভর্তি পিঠে নিয়ে জোরে হাসতেও পারেনা। দিদাকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না যে বিয়ে না করলেও ওকে ওখানেই থাকতে হত। ওটাই ওর কাজের জায়গা। দিদা বিয়েটাকেই দোষ দেবে নাতনী দূরে থাকার জন্য। আসল ব্যথা অন্য জায়গায়। বড় মেয়ের ঘরে এই প্রথম নাতনী। মাকে যতটা পেয়েছে তারও চেয়ে বেশী বোধহয় দিদার বুকে পিঠেই মানুষ হয়েছে মউয়া। তাই দিদার মনখারাপ মায়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়, জানে ও। মুখের পিঠে শেষ করে দু’আঙুলে করে খানিকটা ঝোলাগুড় চেটে নিয়ে বলে, “আচ্ছা দিদা, তুমি এই পিঠে করতে বসলে তো চারপাশে ভীড় জমে যেত। আজ কাউকে দেখছি না তো? তোমার গুনের ছোটছেলে? ও তো কেবল আমার ভাগে ছোঁ মারত। সে কোথায়? আর বুকু মাসী? আসেনি আজ? তাহলে এত নারকোল কে কোরালো?”
এত প্রশ্নের ঝড়ে দিদা বিপর্যস্ত।
“আসে হগগলেই। যাবেডা আর কোথায়? এই পাঁচ কাঠার মায়া ছাইড়া তর দাদু যাইতে পারল না আইজ অবধি! তো বাকীরা কই যাইব!”
দিদার কথা শেষ হতে না হতে ঘরে এসে ঢোকে বুকুমাসী। মউয়ার মায়ের পরের বোন। সেই একইরকম গোড়ালী পর্যন্ত সুতির ছাপা ইস্ত্রী করে পড়া, শাড়ীর রঙের সঙ্গে ব্লাউজের কোন দূরতম মিল পর্যন্ত নেই। চুলে একটা নিরভিমান বিনুনী, যেন থাকলেও হয়, না থাকলেও ক্ষতি নেই। কে বলবে যে বুকুমাসী প্রায় ষাটের কাছাকাছি হতে চলেছে! চিরদিনের মতই সোজা সরল থেকে গেছে। এসেই সোজা মউয়ার পাশে বসে পড়েছে।
“অই দ্যাখ, আইয়া পড়ছে তর বুকুমাসী, গন্ধ পাইছে মনে লয়…” দিদা হাসে ।
এখনও দিদার হাসিটা কী সুন্দর! মউয়া মনে মনে ভাবছিল। আমরা কেউ দিদার এই মুখশ্রীটা পুরোপুরি পেলাম না। মউয়ার ছোটবেলার স্মৃতিতে যুবতী দিদার স্মৃতি ঘুরে ফিরে আসে। কষ্টিপাথরে কোঁদা সে এক অনবদ্য মুখশ্রী, যাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে একঢাল মেঘের মত পিঠছাপানো চুল। ওর চিন্তার জাল কেটে যায় বুকুমাসীর কথায়।
“আঃ মা তুমি থাম তো! মৌ আসবে আর আমি ও বাড়ী বসে থাকব! কী যে বল না! এই দ্যাখ মৌ, কী এনেছি তোর জন্য। তোর সবচে প্রিয় জিনিস…” হাতের ঝোলা ব্যাগ থেকে একখানা মাটির হাঁড়ি আর দুটো প্লাষ্টিকের কৌটো বের করে মেঝের ওপর রাখে বুকু।
“এতসব কী এনেছো? আর, তুমি জানলেই বা কেমন করে যে আমি আসছি আজ? স্ট্রেঞ্জ! আমি তো ফোন করতেও সময় পেলাম না!”
“আরে বাবা এতসব আবার কী! এই দ্যাখ, ক্ষীরদই। এটা পেলে তো তোর আর ছাড়াছাড়ি নেই। জানি না আমি! আর এখানে একটু কচুর শাক আছে। ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক। খাবি তো? আর এটাতে সর্ষে নারকোল দিয়ে মানকচুবাটা। তোর জন্যই তাড়াতাড়ি করে বাটলাম… এবার যেন খাব না খাব না করিস না।”
“খাব না মানে? তুমি আমার প্রাণের মনের জিনিসগুলো এনে দিয়েছো বুকুমাসী… সবগুলোই তো আমার খুউব প্রিয়। কিন্তঊউউউ পিঠের সঙ্গে দইটা খাই কী করে বল তো? এত সব খেয়ে আমার শরীরটাই না খারাপ হয়ে যায়। সেটা তো হতে দিলে চলবেনা বল?”
বুকুমাসী গম্ভীর হয়ে যায়। উঠে দাঁড়ায় খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে, “মা, ওর খাওয়া হয়ে গেলে আমার কৌটোগুলো গুছিয়ে রেখো। আমি পরে এসে নিয়ে যাব।”
“এবাবাআআ বুকুমাসী তুমি তো রেগে গেলে। আচ্ছা বাবা আমি এখুনি খাচ্ছি। এই দই তো ওখানে পাওয়াও যায়না। দিদা একটা চামচ দাও তো।”
“চামুচ তো নাই, এইটা ল…” একটা পেতলের ছোট হাতা এগিয়ে দেয় দিদা।
বুকুমাসীর হাসি আবার ফিরে আসে। সে চিরদিনই এইরকম। কাউকে কিছু খেতে দিলে সে না করল তো ব্যস, বুকুমাসী হয় কাঁদতে বসবে নয়তো মুখ ভারী করে বসে থাকবে। তাকে খুশী করার রাস্তাটাই হল চুপচাপ একপেট খেয়ে নেওয়া। মউয়া একহাতা দই তুলে নিয়ে মুখে পুরে দেয়। দিদা উঠে কোথাও বাইরে গিয়েছিল। এবার এসে মাসী বোনঝির মাঝখানে বসে। কাঁপা কাঁপা হাতে নাতনীর মাথায় হাত বোলায়, “মনি, অ্যাকোটা কথা কই তোমারে। মন দিয়া শুন।”
“উঃ দিদাআ দইটা খেতে দাও আরাম করে। পরে বলবে কাজের কথা…।”
বুকুমাসী হাসছে। দিদা তবুও বোঝাতে ছাড়ে না।
“তুমি অ্যাখন আর ছুডটি নাই। যা করবা ভাল কইর্যা ভাইবা চিন্তাইয়্যা করবা। কুন অবস্থাতেই ভাইঙ্গা পড়বা না।”
এবার মউয়া মাথা ঝাঁকায় সেই ছোট্টবেলার মতই, “আচ্ছা দিদা, এসব কঠিন কঠিন কথা কেন শেখাচ্ছো এখন? এই তো এলাম এইমাত্র। আগে সব কিছু ভাল করে খেয়ে নিই… তারপর পুরো বাড়ীটা ঘুরে দেখি একবার… তাছাড়া তুমি তো আছই। আমি পরে শুনব এসব…” আবার মন দিয়ে দই খেতে থাকে মউয়া। বুকুও মাথা নাড়ে ওর পক্ষেই।
“ঠিকই তো মা, কেন এখুনি ওকে এসব বলতে বসেছো? থাক না এসব কথা, ও তো থাকছে কয়েকটা দিন…”
“তুই চুপ যা বুকি। মাথার চুল পাকল তবু বুদ্ধি পাকল না তর। তুই আমি চিরকাল থাকুম অর লগে? অরটা অরে বুইঝ্যা লইতে হইব না? তুই জানস না তর বুইনরে? হেয় কি সহজে কিছু বোঝনের মানুষ? তারে লইয়া তো মনি আমার একসা হইয়া গ্যাল গিয়া… যতদিন পারছি আমি সামলাইছি, অ্যাখন…”
“আঃ মা, তুমি চুপ করবে একটু? মৌ তো আর বাচ্চা নেই। যেটা ভাল হবে ও সেটাই করবে। দেখ না টুকুকে ও ঠিক সামলে রাখতে পারবে। ওর কাছেই টুকু জব্দ।”
“পাইরলেই ভাল মা। আমার প্যাডের মাইয়ারে আমার থিক্যা আর ক্যাডা ভাল চিনবে! মনি আমার হাইরা না যায়… ছুড থিক্যা তো ফ্যাল করে নাই কুনদিন। এইবার টুকুমাসীরে সামলাইতে না পারলে অর না মাথাডা খারাপ হইয়া যায়।” দিদা অবিশ্রান্ত বলে যেতে থাকে যা আক্ষরিক অর্থে মউয়ার কানে কথা নয়, বিলাপ হয়েই পৌঁছায়।
টুকুমাসী অসুস্থ। হঠাৎ করেই ফোন পেয়েছিল ও। গত পরশুদিন। এর আগে মুম্বই থেকে লোক পাঠিয়ে টুকুমাসীকে নার্সিংহোমে রেখে পনেরো দিন ট্রিটমেন্ট করিয়েছে। তারপর একজন গভর্নেস রেখেছিল গুগল সার্চ করে। সে ছিল প্রায় দু’মাস। টুকুমাসীকে রীতিমতো সুস্থ সবল করে তারপর সে বিদায় নিয়েছিল। মউয়া অতদূর থেকে নিজে তো আসতে পারে না। ফোনে খবর নেওয়া, অনলাইনে লোক ঠিক করা, লোক পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, এসব ছাড়া পার্সোনালি তো আর কিছু করা সম্ভব হয় না ওর পক্ষে। যেটুকু দূর থেকে করা যায় তাই করে।
বহুবার নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু টুকুমাসী যাবে না। কিছুতেই নড়বে না নিজের ঘর ছেড়ে। সন্তুমামা এই বাড়ীতেই থাকে। সে দেখাশোনা করে না তাও নয়। কিন্তু সেই সব দেখা এবং শোনার মধ্যে মিশে থাকে অনেকখানি অমনোযোগের ধূলো যাকে চোখে দেখা যায় না, শুধু আঙুলের ডগায় লেগে খিঁচ খিঁচ করে। মউয়া এইবাড়ীতে মানুষ। ও জানে এই মাটির গহীনে লেগে থাকা রক্তের দাগের চরিত্র। ও জানে এই মাটির বুকের ভেতরে কোন কোন আঘাতে কতখানি কাঁপন লাগে। সেই কাঁপুনি এতদূরে গিয়েও ও এড়িয়ে যেতে পারে না।
পরশু সন্তুমামার ফোনটা পেয়েই ডিসাইড করে ফেলেছে, এবার আর কিছুতেই টুকুমাসীকে এখানে রেখে যাওয়া যাবে না। সে আবার অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে আর উল্টোপাল্টা ওষুধ খেয়ে নিজের অবস্থা অনেকটাই খারাপ করে ফেলেছে। বার বার কেই বা হাসপাতাল নার্সিংহোম দৌড়োদৌড়ি করে! কাউকে দোষও দেওয়া যায় না। মউয়ার মনে হয়েছে টুকুমাসীকে এবার একজন থেরাপিস্ট দেখানো দরকার। কিন্তু ইটস আ লংটার্ম প্রসেস। ওখানে নিয়ে গিয়েই করাতে হবে। মুম্বাইতে পলাশের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। তারও একই সাজেশান। সব দিক চিন্তা করে মউয়া অন রোড ছুটে এসেছে জলপাইগুড়ি।
কিন্তু বাড়ী ঢুকেই যে এভাবে টুকুমাসীরও আগে দিদাকে বুকুমাসীকে দেখতে পাবে এটা ওর চিন্তায় ছিল না। ও জানে বহুদিন থেকেই এখানে টুকুমাসী, সন্তুমামা, সোনামামী এরাই শুধু থাকে। কিন্তু তাদের সবার আগেই দিদাকে দেখতে পেয়ে ও আনন্দে যাকে বলে আত্মহারা হয়ে গিয়েছে। এটা ওর কাছে একটা আশাতীত আনন্দ। বারান্দায় দইয়ের হাঁড়ি কোলে নিয়ে বসে ক্ষীরদইয়ের স্বাদে মজে যেতে যেতে চোখ বুজে ফেলেছিল ও। একটু আগে অতগুলো চিতই পিঠে খেয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, তারপরেও দইটা খেতে একটুও ভার লাগছে না। বরং এরপর কচুর শাকটা টেষ্ট করবে বলেই ভেবে রেখেছে। এতবছর পরে এইসব ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া খাবারের স্বাদ পেয়ে মউয়া যেন ভুলতে বসেছে ও কী জন্য এসেছে, কতখানি তার গুরুত্ব।
নড়বড়ে হয়ে আসা কাঠের খুঁটিতে ভর দিয়ে কে জানে কতক্ষন বসেছিল মউয়া। চমক ভাঙে সম্মিলিত গলার আওয়াজে। সন্তুমামা ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে ডাকছে, “মৌ এই মৌ এখানে মাটির ওপর বসে আছিস কেন? এই কোণের ঘর যত আবর্জনার পাহাড়, কে জানে সাপখোপ কী আছে না আছে!”
সোনামামীও সমস্বরে চেঁচাচ্ছে, “কখন এলে? কী গো! এখানে বসে আছ কেন ঘরে না ঢুকে! এবাবাআআ জামাকাপড় সব তো ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেল। ওঠো ওঠো…”
সোনামামীর পাশে দাঁড়ানো মউয়ার ড্রাইভার। তার হাতে ধরা ব্যাগ স্যুটকেস। সে বেচারা কী করবে বুঝতে পারছে না। ধীরেসুস্থে রাস্তার ওপর পজিশন বুঝে গাড়ীটা পার্ক করে ম্যাডামের মালপত্র পৌঁছে দিতে এসেছে সে। এরপর ফিরে যাবে বুকিং করে রাখা হোটেলে। তারপর কাল আবার ফিরে যাওয়া। সেরকমই কথা হয়েছে। এখন ম্যাডামকে এভাবে দেখে সে যায় কী করে! শুধু সন্তুমামার দিকে তাকিয়ে বলে, “ইয়ে সব কাঁহা রাখখে হাম? ইধারই ক্যা?” ময়লা স্তূপ হয়ে থাকা বারান্দাটার দিকেই ইঙ্গিত করে সে।
“আরে রামো রামো, ইয়হা ক্যায়সে রাখোগে সামান? ওহি ঘরকে অন্দর লে চলো ভাইয়া” সন্তুমামা টুকুমাসীর ঘর দেখিয়ে দেয়।
এতসব কথার মধ্যে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল মউয়া। আবার সেই ভাঙা ঘরটার মধ্যেই এগিয়ে যায়।
“আরে আরে ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?” পেছন থেকে বাধা দেয় সন্তুমামা।
“দিদা আছে তো এখানে… বুকুমাসীও এসেছিল একটু আগে… কত কী খেলাম যে আমি… দাঁড়াও আসছি। দিদাকে বলেই চলে আসব।” মউয়া ভেতরে পা বাড়ায়। সোনামামী এসে হাতটা ধরে ফেলে ওর, “তুমিও কি পাগল হলে মৌ? ওদিকে যেও না। ও ঘরটায় কেউ যাইনা আমরা।”
“কিন্তু দিদা? দিদা তো আছে এখানে… এই তো দ্যাখো দ্যাখো দিদার পায়ের ছাপ। বোধহয় ঘরে ঢুকে গেছে, একটু আগেই তো ছিল।”
পুরু হয়ে থাকা ধুলোর মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া পায়ের ছাপ আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকে মউয়া।
আর তখনই ঠিক উল্টোদিকের ঘর থেকে টলোমলো পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে টুকুমাসী। সে আজ প্রায় চারদিন পর বিছানা থেকে উঠলো। আগের মতোই একগাল হাসি দিয়ে ডাকে। হাসিটা একই আছে, শুধু দু’পাশের গালের হাড়গুলো উঁচু হয়ে জেগে আছে নদীর চড়ার মত।
নড়বড় করতে করতে টুকুমাসী এসে জড়িয়ে ধরে মউয়াকে, “আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিস তো? যাব আমি এবারে। সত্যিই যাব তোর সঙ্গে। ডাক্তার দেখিয়ে, বেড়িয়ে ফিরব। তবে তার আগে দাঁড়া মায়ের একবার পার্মিশন নিয়ে নিই।”
আবার টলোমলো পায়ে ওই ভাঙা ঘরটার ভেতরে ঢুকে যায় টুকুমাসী। ধুলোর ওপরে স্পষ্ট হয় পায়ের দাগ। পেছন থেকে টুকুমাসীকে দেখে মউয়ার মনে হয়, দিদা, বুকুমাসী আর মায়ের আদল যেন বড্ড বেশী মেলানো মেশানো টুকুমাসীর মধ্যে। সেই কতদিন আগে থেকে একে একে তিনজন পাড়ি জমিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে, সে এমন অজানা কোন মহাদেশ যাকে শত বিজ্ঞান সাধনাও আজও আবিষ্কার করতে পারেনি, আজও শুধু অন্তরের গোপনতম কন্দরে আশা নিরাশার দোলাচলে আকুলতম লালন করে যাওয়া। চলে গিয়েও যেন আজও ওরা ঘিরে আছে সব দিক দিয়ে। আজও সেই চিতই পিঠা ক্ষীরদই আর কচুর শাকে মিশে থাকে মা মাসি দিদার হাতের ছোঁয়া। সেই স্বাদের শেষ বিন্দুটা রয়ে গেছে টুকুমাসীর মধ্যেই। এটাকেই যতদিন সম্ভব বজায় রাখা যায় সেই চেষ্টায় এত দৌড়ঝাঁপ।
জিনসের পকেট থেকে বাজতে থাকা মোবাইলটা বের করে কানে চাপে মউয়া। ওপারে পলাশ।
“হ্যাঁ, রীচড সেফলি। এসেই একটা দুর্দান্ত স্বপ্ন দেখছিলাম জানো। কিন্তু তুমি আমাকে আর ঘুমিয়ে পড়তে দিও না। আমি স্বপ্ন চাই না। আমি শুধু টুকুমাসীকে ভাল করে তুলতে চাই। আমার পাশে থেকো।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন