রুমা মোদক
নেতা, পাতিনেতা, সাংবাদিক, আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধব, সুহৃদ, শত্রু সবার সময়ে অসময়ে উৎপাতে নিরিবিলি বাড়িটা হঠাৎ যেন বাজার হয়ে উঠেছে। এমন ঘটনা পরিচিত পরিবেশে এর আগে আর ঘটতে দেখেনি কেউ, শুনেওনি। অপার কৌতুহল যেন হঠাৎ তেড়ে আসা মুষলধারা বৃষ্টির সাথে নিয়ন্ত্রণহীন বাতাসের মতো নানা প্রশ্ন নিয়ে নানা সম্ভাবনায় সবার নির্বিবাদী ব্যক্তি জীবন তুমুল দুলিয়ে দিচ্ছে। হাট বাজার, চায়ের স্টল, বৈঠকখানা, পার্টি অফিস, গলির মোড়ের আড্ডা সর্বত্র সব কথার মাঝে প্রসঙ্গটি কৌতূহল, ঈর্ষা, অহংকার, আগ্রহের অপরিচিত ঘ্রাণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হয়ে ঠিক দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কোথাও উপেক্ষা করতে পারে না। মূলত অর্ধশতক আগের এ ইতিহাস এতই অপ্রয়োজনীয় যে কারোর খুঁজে জানার তেমন দায় ছিলো না।
প্রায়ান্ধ চোখে তিনি ছবিটার গায়ে হাত বুলান। আজকাল অনেক কিছুই স্পষ্ট দেখতে পান না, চোখে ছানি। তার বোধহয় যতটা বয়সের কারণে পড়েছে, তার চেয়ে বেশি পড়েছে নিরুপায় হতাশায় আর অপেক্ষার অসহায়ত্বে। দুইই বড় নাচার। সহ্যও হয় না, বিপরীতে লড়াও যায় না। দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিতে নিতে একসময় গা সওয়া হয়ে যায়, ঋতুবদলের নিয়মের তীব্র গ্রীষ্ম কিংবা তীব্র শীতের মতোই।
দিনের পর দিন তিনি অপেক্ষা করেছেন। সব আবেগ, ক্ষোভ আর অসহায়ত্বের ঝুলিতে পুরে নিয়ে অপেক্ষা করেছেন। নিশ্চয়ই একদিন সেইদিন আসবে। বুঝি অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে, ছানি পড়া ঝাপসা চোখেও আজ তিনি স্পষ্ট দেখছেন বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টার থেকে মাটিতে পা রাখছেন। স্পষ্ট দেখছেন বত্রিশ নম্বর বাসায় ট্রে হাতে করে চা এনেছিল যে মেয়েটি, সেই মেয়েটির মায়াবী মুখ, পলিমাটির মতো মায়াবী কোমলতা। মেয়েটি এখন দেশের পিএম। মেয়েটি তাকে ডেকেছেন।
তার সারাদিনের কাজে যেন উৎসাহের প্রাবল্যে আনন্দ ঝলমল করে, নৈমিত্তিক কাজগুলো করতে করতে তিনি আপনমনে হাসেন। মিনু টিপ্পনী কাটে, কী হাসো ক্যান, শেলির কথা মনে পড়ছে? তিনি হ্যাঁ না কিছু বলার বাহুল্যে যান না। চুপ করে থেকে নিজেকে এক অনির্বচনীয় স্বস্তির ভেতরে মুড়ে রাখেন। শেলি তার জীবন থেকে আড়াল হয়েছে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। শেলির স্মৃতি অস্পষ্ট না হলেও, সেই স্মৃতির দহনের আঁচ আজ আর নেই।
আজ এই হাসির কারণটা মিনু বুঝবে না। মিনু বুঝবে না তিনি হাসেন তার বিশ্বাসের জয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন এমন দিন আসবে। আসতেই হবে। প্রকৃতি কোন হিসাব বাকি রাখে না। সব ফিরিয়ে দেয়।
বিয়ের পরপর এ নিয়ে মিনুর সাথে বিস্তর ঝগড়াঝাটি হয়েছে৷ ততদিনে ব্যবসাপাতি গুটিয়ে মাস শেষে নিশ্চিত রোজগারের একটা চাকরিতে ঢুকে গেছেন তিনি। ফটোগ্রাফির নেশাটা প্রয়োজনের দুনিয়ায় নেহাৎ অকেজো হয়ে গেছে দুঃস্বপ্নের মতো। আদতে পুরো দেশটাই তখন ঢুকে গেছে একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর। যেখানে কোথাও বঙ্গবন্ধু নেই, আছে কতগুলো সুবিধাভোগী বিশ্বাসঘাতক, বঙ্গবন্ধুর নাম ঘষে মুছে ফেলা বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতক সময়ের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা সে একজন বেখাপ্পা আয়াতুল্লাহ, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা ছাড়া যার আর কোন দোষ ছিলো না। ততদিনে অনেক মাশুল দিয়ে সেও আপোষ করে নিয়েছে বেঁচে থাকার দরকারে৷ চাকরি, বিয়ে। অন্যজীবন। স্টুডিওতে যুদ্ধফেরত বন্ধুদের আড্ডা তখন বিভীষিকা, থিয়েটারের নেশা লক্ষ্যহীন পাগলামি।
একদিন পুলিশ এসে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো স্টুডিওটা। ভাঙা ক্যামেরা, স্ট্যান্ড, পেছনে ফুলের বাগান আঁকা পর্দা, সিঁড়ি আঁকা পর্দা সব তিনি কুড়িয়ে এনে তালাবদ্ধ করেছেন একটা আলমিরায়। এগুলো তার কাছে কেবল কিছু ভাঙাচোরা, ছেঁড়া ফাঁড়া বস্তু নয়। এর পরতে পরতে লেগে থাকা ইতিহাস। কত স্মৃতি এই স্টুডিওর। শেলির সাথে লুকিয়ে দেখা করার স্মৃতি, গভীর রাতে বন্ধুদের একসাথে যুদ্ধে যাওয়ার পরামর্শ সভার স্মৃতি। ফিরে এসে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার স্মৃতি।
যৌবনই তো মানুষের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। স্মৃতিহতের মতো তিনি সব কুড়িয়ে এনে আলমিরায় তালাবন্ধ করে আগলে রেখেছেন যক্ষের ধনের মতো। পরিবারের সবাই একে এখন অহেতুক পাগলামির মতো মেনে নিয়েছে। কদিনই বা বাঁচবে লোকটা। আয়াতুল্লাহ, গড় আয়ু সত্তরের দেশে পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই বোনাস জীবন যার!
একবার তো এসব নিয়ে মিনুর সাথে ছাড়াছাড়ির উপক্রম। কী লুকান আয়াতুল্লাহ সাহেব? কাঠের পুরানো আলমারি, যা খুললেই প্রাগৈতিহাসিক ঘ্রাণ ঘরময় ছড়িয়ে যায়, দুষ্ট ছেলের মতো ঘরময় দাপিয়ে বেড়ায় অনেকক্ষণ। ঘরের অন্যান্য আসবাব ড্রেসিং টেবিল, খাট, আলনা, চেয়ার, টেবিল সব যেন জাপটে ধরে রাখে সেই প্রাগৈতিহাসিক ঘ্রাণ। ঘরে ঢুকে দমবন্ধ লাগে মিনুর। কৌতূহল বেসামাল হয়ে পড়ে তার।
সেই আলমিরাতে কী আছে জানে না মিনু৷ ঠাসা জিনিসপত্র। প্রতিদিন নিয়ম করে একবার খুলবেনই আয়াতুল্লাহ। কী যেন করেন, তারপর আবার বন্ধ করে রাখেন। এই রোজ আলমিরা খোলা, লাগানো এতে কারো কোন সমস্যা হয় না৷ কিন্তু সমস্যাটা হলো এই আলমিরাটা খোলার সময় তিনি দরজায় খিল আটকে নেন আর আলমিরার চাবিটা কিছুতেই হাতছাড়া করেন না।
নব বিবাহিত মিনু কয়েকদিন লক্ষ্য করার পরই ভাবিদের জানিয়েছে ঘটনাটা। ভাবিদের মুচকি হাসিতে আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে আয়াতুল্লাহর পেছনেই পড়েছে। প্রতিদিন দরজা লাগাইয়া আলমিরা খোলে কী দেখেন আপনি? এইটার ভিত্রে কি? আয়াতুল্লাহ হালকা চালে এড়িয়ে যান, আরে আমার স্টুডিওর পুরানা জিনিসপত্র। আয়াতুল্লাহর হেঁয়ালি উত্তর নির্বিবাদে মেনে নেয়ার মতো বোকা মেয়ে নয় মিনু। দরজা বন্ধ কইরা খুলেন ক্যান, পুরানা জিনিসপত্র ফালাই দিলেই পারেন, জমাইয়া রাখছেন ক্যান ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্ন শেষে চাবিটাই চেয়ে বসে আয়াতুল্লাহর কাছে। দেনতো আমারে, দেখি ভিত্রে কি আছে! ছিনতাইকারীর মতো একটানে চাবিটা হাতে নিয়ে নেয় মিনু। যেন হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলে আয়াতুল্লাহ। চাবিটা নেয়ার জন্য আয়াতুল্লাহ ঝাঁপিয়ে পড়ে মিনুর উপর। ধাক্কাধাক্কিতে মিনুর হাত চিরে যায় খাটের কোণায় লেগে৷ একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। হতভম্ব মিনু সেদিন ভাবিদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয় আয়াতুল্লাহর সাথে আর সংসার করবে না সে।
তখনই ভাবিরা শেলির কথা ফাঁস করে মিনুর কাছে। ছোট্ট মফস্বল শহরটাতে চেনা গলির মতোই সবাই সবাইকে চেনে৷ গুটিকয়েক সরকারি কর্মকর্তা, যারা শহরে পরিবার পরিজন সমেত আসে তাদের হাঁড়ির খবরও সবার জানা থাকে। শেলি আর আয়াতুল্লাহর প্রেমকাহিনী সেই সময় ছিল শহরের মানুষের মুখে মুখে। ঘরে ঘরে, উঠানে উঠানে। আড্ডায় আড্ডায়। ভাবিরা সান্ত্বনা দেয় মিনুকে, হয়তো শেলির চিঠিপত্র হবে। তুমি কিছু মনে করোনা। শেলি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ হোসেন সাহেবের মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর ভাগনি৷ শেলির মা বঙ্গবন্ধুর আপন ছোট বোন। এখন কোথায় আছে কে জানে। ওর কি আর আয়াতুল্লাহ কে মনে আছে? বাদ দেও ওর পাগলামি। মন দিয়া সংসার কর। মিনুর ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মুখে পাইপ ধরা এক সফেদ পাঞ্জাবি পরা স্বপ্নবান মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব ঘিরে ঝাপসা হয়ে ওঠে। সারা দেশে নিষিদ্ধ সেই একটা মানুষ, একটা দেশ, একটা পরিবার বেঁচে আছে তার স্বামী আয়াতুল্লাহর স্মৃতিতে বিষয়টা ভীষন ভালোলাগায় আর্দ্র করে তাকে। সে চুপ করে যায়। সেদিন থেকে বিষয়টি নিয়ে আর কিচ্ছু বলেনা মিনু।
আসলেই এক অখ্যাত শহরের অখ্যাত মানুষ আয়াতুল্লাহ। গলির মোড়ে একটা স্টুডিওর ফটোগ্রাফার। স্টুডিও বলাকা। সারাদিন ছবি তোলা পেশা যার, শেলির তাকে মনে আছে কিনা কে জানে! থাকার কারণও নেই। তবে তিনি শেলিকে ভুলতে পারেননি এটা ঠিক। প্রথম প্রেম জীবনে জড়িয়ে থাকে দুর্ঘটনার দাগের মতো। সুসময়ের ফুলের ঘ্রাণ মানুষ ভুলে যায়। জীবনের কোন বাঁকে পুনরায় আবার ঘ্রাণ নাকে এলেই কেবল মনে পড়ে, দুর্ঘটনার ক্ষত প্রাথমিক যন্ত্রণা কাটিয়ে গায়ে লেগে থাকে আজীবন, চাইলেও ভোলা যায় না। শেলি জীবনের সেই অমোচনীয় দাগ।
ঘরে মুরগি মুসাল্লাম আর পোলাও রান্না হয়েছে। আয়াতুল্লাহর বড় ছেলে ফয়সাল নিজে বাজার করেছে। তাকেই ডেকে নিয়ে খবরটা জানিয়েছেন স্থানীয় এমপি। প্রাইম মিনিস্টার আয়াতুল্লাহর সাথে দেখা করতে চান। খবরটা এই নিস্তরঙ্গ পরিবারে যেন ঈদের আনন্দের মতো রং ছড়িয়ে দিয়েছে। মিনু অনেকদিন পর হাত খুলে রান্না করেছে। বাসাময় চাপা আনন্দ। কেউ আনন্দে লাফাচ্ছে না, কিন্তু আনন্দের উত্তাল স্রোত চেপেও রাখা যাচ্ছে না। কেউ মানে আয়াতুল্লাহ, মিনু, বড় ছেলে ফয়সাল, ফয়সালের বউ, ছেলে আর ছোটছেলে নেহাল। মানুষই সাকুল্যে ছয়জন। এই মুরগি মুসাল্লাম রান্নাটা মিনু শিখেছে শাশুড়ি অর্থাৎ আয়াতুল্লাহর আম্মার কাছে। আর আম্মা শিখেছে শেলির আম্মার কাছে।
বিটিভিতে বঙ্গবন্ধুর বিরল সব ভিডিও ক্লিপস দেখানো হচ্ছে। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। আচ্ছা কোথাও কোন কোণে কি শেলিকে দেখা যাচ্ছে? শেলি কোথায় আছে? কেমন আছে? শেলি কি বেঁচে আছে? মিনু টেবিলে খাবার দিয়ে তাড়া দেয় অন্যমনস্ক বসে থাকা আয়াতুল্লাহকে, তাগদা কইরা খান ফয়সালের বাপ। মুরগির রানটা মিনু তার পাতে দেয়। তিনি অনেকদিন পর আয়েশ করে খান। অসাধারণ এই মুরগি মুসাল্লাম এর স্বাদ। আয়াতুল্লাহ ভালোবাসেন বলে শেলির মা মুরগি মুসাল্লাম রান্না করেই তাকে ডেকে পাঠাতেন। আয়াতুল্লাহ অপেক্ষায় থাকতেন কবে চাচী আম্মা রাঁধেন, তাকে ডাকেন৷
এই একটুখানি সময় শেলিকে পাওয়া যেতো বাধাহীন। চাচা-চাচী ছিলেন অসাধারণ মানুষ। খাওয়ার অজুহাত শেষ হলে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিইয়ে যাওয়া বিকালে আয়াতুল্লাহ বারান্দায় বসে গল্প জমাতেন শেলির সাথে। চাচা চাচীর ঘরে রেডিওতে গান বাজতো, ‘যব পিয়ার কিয়াতো ডরনা কিয়া’। পঞ্চাশ বছর আগে মফস্বলের প্রেমিক প্রেমিকারা খোলা বারান্দায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কী রাজ আলাপ করতো এখন আর কিছুতেই মনে করতে পারেন না আয়াতুল্লাহ, তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে না বুঝার ভানে দু’জন দু’জনের হাত ছুঁয়ে দিতেন একটু। শেলির জোড়া ভ্রু আর ঘন পল্লবে ছিলো জোয়ার ভাটা আকর্ষণ, ভেতরের সব শিহরণ সাগরের ঢেউয়ের মতো ফুলে উঠতে চাইতো বারবার। ধীরে সন্ধ্যা নামলে বাধ্য হয়ে উঠে আসতে আসতে প্রতিদিন আয়াতুল্লাহর মনে হতো এমন মধুর সন্ধ্যা বুঝি কখনোই তার নিজস্ব হবে না, এমন সন্ধ্যায় সে কেবলই অতিথি হয়ে থাকবে শেলির জীবনে।
প্রাইম মিনিস্টার আয়াতুল্লাহকে ডেকে পাঠিয়েছেন খবরটা শহরে চাউর হতে ঘন্টা কয়েক সময় লাগে। শহরের দুয়েকটা স্থানীয় পত্রিকা লিড নিউজ করে দেয়। বাকিটা মুখে মুখে রটে যায়। নানা জল্পনা কল্পনা শহর জুড়ে। কী দেবেন পিএম আয়াতুল্লাহকে, কয় লক্ষ টাকা? নাকি জমি? নাকি অন্যকিছু? কেন ডেকেছেন পি এম আয়াতুল্লাহকে? লোকের কল্পনা ভাবনা কিছুই বাস্তবতাকে নাগালে ধরতে পারে না। উৎসুক কৌতুহল কেমন থৈহীন নানা সম্ভাবনায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
থিয়েটারের নেশা ছিলো আয়াতুল্লাহর। সেবার সিরাজউদদৌল্লা নাটকে আলেয়া চরিত্রের জন্য নারী খোঁজা হচ্ছিলো। প্রতিবছর বাইরের যাত্রাদল থেকে মেয়েদের উচ্চ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এনে অভিনয় করাতে হয়। নির্দেশক হিসাবে বড় অতৃপ্তি থেকে যায়। মুখস্থ ডায়লগ থ্রো করে তারা চলে যায়৷ না এক্সপ্রেশন, না আবেগ, না চরিত্রের ভেতরে ঢোকা, কোনও দায় নেই তাদের। নির্দেশক হিসাবে খুব অস্বস্তি হতো আয়াতুল্লাহর। এত পরিশ্রম, সময় ব্যায়। এরপরেও স্বস্তি পেতেন না এই একটা কারণে। তাদের ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া যেতো না। চরিত্রের বিশ্বস্ততা আনা মুশকিল হয়ে পড়তো। নির্দেশক সুলভ পরামর্শ দিলেই তারা ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতো। শো-এর পর কিছুতেই স্বস্তি পেতেন না তিনি।
সেবার অনেক ভেবেচিন্তে মেয়েদের স্কুল কলেজগুলোতে একটা উদ্যোগ নিলেন। হেঁটে হেঁটে মেয়েদের স্কুল আর কলেজে দুটি হাতে লেখা আবেদন পত্র দিয়ে এলেন তিনি। এক্সিবিশনে প্রদর্শনীর জন্য নতুন নাটকে অভিনয়ে ইচ্ছুক মহিলা অভিনেত্রী প্রয়োজন। আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন। শহরের মেয়েদের কমবেশি চিনেন তিনি। জানতেন কেউ আসবে না। তবু দিলেন, যদি কেউ সাড়া দেয়। অপ্রত্যাশিত ভাবেই সেবার বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাকে ডেকে সুখবরটি দিলেন। শহরে নতুন আসা মেয়েটি অভিনয় করতে ইচ্ছুক। শেলির সাথে তখনই পরিচয়। পরে বাসা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় শেলিরা একদম আয়াতুল্লাহদের পাশের বাসার ভাড়াটিয়া। তারপর একসাথে রিহার্সালে আসা এবং যাওয়া। আয়াতুল্লাহর আম্মার সাথে খুব দ্রুতই খাতির হয়ে যায় শেলির আম্মার। জানালা দিয়ে তরকারির বাটি চালাচালি। মাঝে মাঝেই বিকেল বিকেল দুজনের গল্প। উৎসুক শহরবাসীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দুয়েকবার ম্যাটেনি শোতে সিনেমাও দেখতে গেছেন দুজন।
দুজনের আম্মার পারস্পরিক সখ্যতাও জমে যায় সহজেই। শেলির আম্মা আয়াতুল্লাহর আম্মাকে শেখাতেন মোগলাই রান্না, আর আয়াতুল্লাহর আম্মা শেখাতেন সাতকড়া দিয়ে রাজহাঁসের মাংস, কুমড়োর মোরব্বা। বিশেষ বিশেষ সিলেটী পদ। দুবাড়ির মাঝে একটা পলকা বাঁশের বেড়ায় মোটেই আটকাতো না তাদের কারণে অকারণে ‘ও ভাবিজান’ ডাকা গভীর সখ্য।
তবু মফস্বলের পরিবেশে কোন যুবকের যখন তখন কোন বাড়িতে অবাধে ঢোকা খুব সহজ দৃষ্ট নয়, তার উপর যে বাড়িতে যুবতী মেয়ে আছে। শুধু মুরগি মুসাল্লাম হলেই আর কোন কথা নেই৷ আয়াতুল্লাহর বাঁধা দাওয়াত শেলিদের বাড়ি। টাউনহলে সিরাজ আর আলেয়ার অভিনয় করতে করতে শেলির আঞ্চলিক টানহীন কথা বলার ভঙ্গি, জড়তা-সংকোচ হীন স্মার্টনেস আয়াতুল্লাহকে দুর্বল করে দিয়েছিলো শুরুতেই। আসলে শেলি তেমন নারী, যার প্রতি দুর্বল না হয়ে পারেনা কোন পুরুষ। শেলিও সাড়া দিয়েছিলো। জানালা খুলেই দু’বাড়ি থেকে দুজনার আড়চোখ। ঢিল দিয়ে চিঠি ছোঁড়া আর বিকাল বিকাল রিহার্সালের অপেক্ষা। অনেক যত্নে মুখে ক্রিম আর চুলে সুগন্ধি তেল মাখতে দেখে বড়ভাবি টিপ্পনী কাটতো, ঘটনা কী আয়াত, ইদানিং তেল মশলার দাম কমছে মনে হইতেছে!
শেলির বাবা সেই ছোট্ট শহরটির অফিসার ছিলেন, যেদিন তার বদলির অর্ডার এলো, শেলি সেদিন সারাদিন চোখ ফুলিয়ে কেঁদেছে। আর স্টুডিওর পেছনে বসে চেইন সিগারেট টেনেছে আয়াতুল্লাহ। এক শহরের দুই প্রান্তে দুজনেরই সেদিন মনে হচ্ছিলো, তারা একে অপরকে ছাড়া বাঁচবে কী করে! অথচ সময়ের পর্দা সবচেয়ে নিষ্ঠুর, নিশ্ছিদ্র। নিপুনতায় ঢেকে দেয় অপ্রয়োজনীয় অতীত। আবেগের উপর বুলিয়ে দেয় প্রয়োজনের রঙ বেরঙের তুলি। শেলিরা চলে যাবার পর বেশ ক’দিন দু’তরফেরই চিঠি চালাচালি ছিলো তারপর একসময় এশিরিয়া ব্যাবিলনের মতো তাও হারিয়ে গেছে। বারকয়েক একতরফা লিখে গেছে আয়াতুল্লাহ, তারপর উত্তর না পেয়ে পেয়ে ক্ষান্ত দিয়েছে। কে জানে শেলি কোথায় কী অবস্থায় আছে! হয়তো বিয়েশাদি হয়ে গেছে। যদি ওর বরের হাতে পড়ে কোন চিঠি! কত ভাবনা তাকে শেষ পর্যন্ত বিরত করেছে!
রানের মাংসটায় দাঁত বসিয়ে তিনি ভাবেন, শেষ পর্যন্ত শেখের বেটি দেশ চালাচ্ছে। আয়াতুল্লাহ ভাবেননি জীবদ্দশায় তিনি এটা দেখতে পাবেন, মাংস চিবুতে চিবুতে ঘোরগ্রস্তের মতো তিনি বলতে থাকেন, শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ডাকলো মিনু! মিনু ভুল ভাঙিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু নয় গো, বঙ্গবন্ধুর মাইয়া। কী অসীম রহমত আল্লাহর! শেষ পর্যন্ত ডাকলেন তোমারে! আয়াতুল্লাহ জানে, মিনু যে ভুল শুধরে দিয়েছে সেটা সে ইচ্ছা করেই বলেছে। তাঁকে বঙ্গবন্ধুই ডেকেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, শেলির সাথে দেখা করিয়ে দেবেন। অপেক্ষায় অপেক্ষায় জীবন এখন সেই সন্ধ্যাটির মতো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলে যে সন্ধ্যা শেলিদের বাসার বারান্দায় নেমে আয়াতুল্লাহকে জানিয়ে যেতো, এখন চলে যেতে হবে। এত্তোগুলো বছর পর অপেক্ষার বুঝি শেষ হতে চললো।
খাওয়ায় মনোযোগ দেন আয়াতুল্লাহ। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধু যেদিন এই মফস্বল শহরটাতে এসেছিলেন, তার আগের রাতে সারারাত তিনি বসেছিলেন জালাল স্টেডিয়ামের মূল মঞ্চের পাশে। কোনও কারণ ছিলো না। বঙ্গবন্ধু আসবেন, এই মঞ্চে বসবেন। যাঁর জন্য দেশ আজ স্বাধীন ৷ সে শেলির মামা বঙ্গবন্ধু। কতবার শুনেছেন তিনি শেলিদের বাসায় আসবেন, কী প্রবল আখাঙ্ক্ষা তাঁকে একনজর কাছ থেকে দেখার। বঙ্গবন্ধু তখন ছয় দফা পেশ করে পূর্বপাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছেন। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ছয় দফা, আমাদের বাঁচার দাবি প্রকাশের মাধ্যমে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন অঙ্কুরিত করছেন মানুষের মনে। আসবেন আসবেন করেও তখন আসেননি তিনি।
আজ স্বাধীন দেশে তিনি এখানে আসছেন। তাঁর একটা অ্যাঙ্গেলের ছবিও বাদ দেয়া যাবে না। কী প্রস্তুতি আয়াতুল্লাহর! আর ভাগ্যও তেমনই। হেলিকপ্টার থেকে যখন তিনি নামলেন, সেই মুহূর্তেই ক্লিক করলেন আয়াতুল্লাহ পরপর কয়েকটা। সুউচ্চ গ্রীবার চির উন্নত মম শিরের সুপুরুষ। কী তাঁর অনবদ্য ভঙ্গিমা! ক্যামেরা ক্লিক করলেই যেন মুহুর্তটা জীবন্ত হয়ে যায়। তারপর অবশ্য মানুষের ঠেলাঠেলি ধাক্কায় আর একটাও ছবি নিতে পারেননি।
স্টুডিওর ব্যবসা উঠে গেলে তিনি চাকরিতে ঢুকলেন। শহরের বাকি স্টুডিওগুলোও তখন জাদুঘরে যাবার আয়োজন করছে। স্টুডিও ব্যবসা নিয়ে দুঃখ নেই তার, কিন্তু সেদিন বঙ্গবন্ধুর আর ছবি না তুলতে পারার আক্ষেপ এখনও যায়নি আয়াতুল্লাহর।
অবশ্য নিজেকে সান্ত্বনা দেন, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত কর্মী হিসাবে কী ভোগান্তিটাই না তার পোহাতে হয়েছে৷ ‘৭৫ এর পর কতবার পুলিশ তার বাড়ি ঢুকে তছনছ করেছে, তাকে বেঁধে নিয়ে গেছে। জেল খেটেছে। কতগুলো বছর মনের গভীরে অমূল্য রত্নের মতো লুকিয়ে রাখা বঙ্গবন্ধুর নাম সে মুখে নিতে পারেনি ভয়ে। কিন্তু ছবিগুলো যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন তিনি, হারাতে দেননি। বেইমানেরা সন্ধান পেলে সব জ্বালিয়ে দিতো। জেল, জুলুম সহ্য করলেও এই দহন সে সহ্য করতে পারতো না।
সেদিন স্টেডিয়ামে ভীড় ঠেলেঠুলে বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিলেন আয়াতুল্লাহ। নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন শেলির বন্ধু হিসাবে। বঙ্গবন্ধু পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন,যাইস ব্যাটা ৩২ নম্বরে। শেলির সাথে দেখা করাইয়া দেবো নে ।
গিয়েওছিলেন আয়াতুল্লাহ। কী আশ্চর্য মানুষটা! চেহারা দেখেই বললেন তুই আয়াতুল্লাহ! শেলির সাথে দেখা করতে এসেছিস! বলেই হা হা করে হেসেছিলেন। লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলেন আয়াতুল্লাহ। শেলির সাথে দেখা করার প্রবল ইচ্ছা তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিলো এই বিশাল মানুষটার অসাধারণ স্মরণশক্তি দেখে৷ নেহাৎ মফস্বলের এক স্টেডিয়ামের জনসভায় এক মিনিটের কথা! অথচ মোটেই ভুলেননি মানুষটা! কী আশ্চর্য! একটা গোটা রাষ্ট্র চালায় যে মানুষ, সে সামান্য একজন আয়াতুল্লাহকেও এভাবে মনে রাখে! হাসুকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন তিনি, ওরে শেলির সাথে দেখা করিয়ে দিবি৷
হয়তো সেবারই দেখা হতো শেলির সাথে৷ কিন্তু আয়াতুল্লাহর সেদিন আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করলো না। বিশাল মানুষটার এই আপণ সম্ভাষণ তাঁকে ঘোরগ্রস্ত করে দিয়েছিলো। একে সঙ্গী করেই ফিরে এসেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন পরে নাহয় সময় করে আবার যাবেন। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। তার আগেই ১৫ই আগস্ট এসে স্তব্ধ করে দিল বাংলাদেশকে।
সেই দিনটির কথাও স্পষ্ট মনে পড়ে তার। সকালবেলায় বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন তিনি। শহরের বিহারিপট্টির হৈ হুল্লোড় শুনে তিনি প্রথমটায় তেমন পাত্তা দেননি যেমন পাত্তা দিলে কোন ঘটনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে৷ কিন্তু সেখানকার একটা লোক সেদিন সদর রাস্তায় পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিলো আর বলছিলো, শেখ মুজিবররে মাইরা ফালাইছেরে, দেশ আবার পাকিস্তান হইয়া গেছে৷
ধপ করে বিছানার উপর স্তব্ধ হয়ে বসে পড়েছিলেন আয়াতুল্লাহ। বলে কী! এমন মানুষটারে তারা মাইরা ফালাইছে! এটা কীভাবে সম্ভব, এটা কী করে হয়! সেদিন থেকে প্রচণ্ড ক্ষোভ, বেদনা আর আক্ষেপের অপেক্ষা তাঁর, নিশ্চয়ই একদিন সময় কথা বলবে। বলবেই কথা। আজ বলছে…
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি পিএম-এর দপ্তরে। ঢোকার পথে বারকয়েক তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা চেক করা হয়েছে, সে ঝক্কি অবশ্য তার পোহাতে হয়নি। ছেলে ফয়সালই সামলে নিয়েছে। সেই সঙ্গী হিসাবে আয়াতুল্লাহর সাথে এসেছে।
সদ্য পৃথিবী তছনছ করে দেয়া প্যান্ডামিকের কারণে নিরাপদ দূরত্বে বসে পিএম। একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলালেন, জিজ্ঞেস করলেন আপনি আয়াতুল্লাহ ভাই? মেয়েটাও বাপের মতো। মানুষকে খুব ভালোবাসে। কী সুন্দর করে ভাই বললেন, যেন তাঁর সত্যিই ভাই হয় সে, আয়াতুল্লাহ মাথা নেড়ে জবাব দেন, জি আমি৷
পিএম বলতে থাকেন, আব্বার ডায়েরির ভেতরে এই চিরকুটটি পেয়েছি। এখানে লেখা আছে, হাসুকে বলতে হবে যেন আয়াতুল্লাহর সাথে শেলিকে দেখা করিয়ে দেয়। আমাকে বলতে যদি ভুলে যান, তাই সম্ভবত লিখে রেখেছেন। শেলি আপা আমার ফুফাতো বোন…আমি ঠিক করেছি আব্বার শততম জন্মবার্ষিকীতে…
আয়াতুল্লাহ পিএম কে কথা শেষ করতে না দেয়ার স্পর্ধা দেখান। মাঝপথে থামিয়ে দেন৷ সাথে আনা বঙ্গবন্ধুর কয়েকটা অমূল্য ফটোগ্রাফ বের করেন হাতের ব্যাগ থেকে। এক পা হেলিকপ্টারে আরেক পা মাটিতে। হবিগঞ্জের মাটিতে নামছেন বঙ্গবন্ধু। ছবিগুলো পিএম এর হাতে দেন। বলেন, অনেক কাল ভয়ে এই ছবিগুলো বের করতে পারিনি, অনেক কাল অভিমানে বের করিনি, ক্ষোভে বের করিনি, অপেক্ষায় বের করিনি। এই দিনের অপেক্ষায়। আমি শেলির সাথে দেখা করতে চাই না। ও পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক কিংবা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাক৷ আমার কাছে সে ষোল বছরের যুবতী শেলি হয়ে আছে। কিন্তু এই যে এত্ত বিশাল মানুষটা, পুরা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল যাঁর হৃদয়টা। তাঁরে আপনার হাতে তুলে দিতে পেরে বড় শান্তি লাগছে। আমি ভাবিনি এই সুযোগ আমার জীবনে আসবে। আমার আর কোন কষ্ট নাই মা জীবনে। আমি আর কিচ্ছু চাই না।
পিএম ছবিগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে ভাবেন, সত্যি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে কতজন কতভাবেই না বঙ্গবন্ধুকে আঁকড়ে রেখেছে, তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু নামে৷ সেই অশ্রু আয়াতুল্লাহ ঠিক দেখতে পান না। চোখে ছানি পড়েছে।
(বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি হবিগঞ্জে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর কন্যা শেলি হবিগঞ্জ মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। গল্পটির এটুকুই তথ্যসূত্র। বাকি সব কাল্পনিক।)
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন